#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৫০
#জান্নাত_সুলতানা
[পর্ব টা একটু রোমান্টিক, পড়তে না চাইলে স্কিপ করতে পারেন।]
আবরাজ ফিজার একদম নিকটে দাঁড়িয়ে আছে। ঘনিষ্ঠতা তাদের মধ্যকার দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়েছে। শাড়ির আঁচলে মেয়ে টা কাঁধে তুলে নেয়। আয়নায় সুদর্শন পুরুষ কে একপলক দেখে নিলো। কালো শার্টের হাতা ফোল্ড করে রাখা। গলায় তখনও টাই ঝুলছে। ইন করে রাখা শার্ট টা এলোমেলো হয়েছে কোমরের দিকে। সম্পূর্ণ খোলার অপেক্ষা মাত্র। ফিজা আবরাজের দিকে তাকিয়ে থেকে সেফটিপিন হাতে নিলো। আঁচল টা ঠিকঠাক করে সেথায় সেফটিপিন লাগাতে নিলেই আবরাজ ফিজার হাত চেপে ধরলো। শীতল স্পর্শে একটু কাঁপন ছড়িয়ে পরে রমণীর সর্বাঙ্গে। আবরাজ মুখে কিছু বলা না। কিছু সময় আয়নায় বউয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে সময় নিয়ে স্লো ভয়সে বললো,
-“লাগিও না। এটা খোলার মতো ধৈর্য্য আমি পাই না সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা আবরাজের থেকে হাত টা আচমকাই টান মেরে ছাড়িয়ে নিলো। সেফটিপিন আবার আগের স্থানে রেখে শাড়ির স্ট্যান্ড টার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার শাড়ী ভালো লাগে?”
-“তোমার লাগে।”
-“আপনার লাগে না?”
-“শাড়ী তোমার ভালো লাগে। আর আমার তোমাকে।”
আবরাজ ওর উদরে আলতো করে হাত ছুঁয়ে দেয়। শাড়ী ভেদ করে মেয়ে টার উজ্জ্বল কোমর টা কি আকর্ষণীয় লাগছে। আবরাজ তার ব্যাখা এই মূহুর্তে করতে পারছে না কিংবা করতে চাইছে না।
-“একই তো। সোজাসুজি বললেই হলো।”
শাড়ী টার রং প্যাস্টেল পিংক। যার মধ্যে হালকা সোনালি বা শিমারিং গ্লো আছে। বোর্ডার ও ডিজাইনে সোনালি কাজ রয়েছে। যা দরুন শাড়ী টার আরও এলিগ্যান্ট দেখাচ্ছে। না-কি এই রমণীর গায়ে গিয়ে শাড়ী টা আরও চমৎকার সুন্দর হয়ে উঠেছে!
চেহারা ও সাজসজ্জার সঙ্গে একদম মানান সই হয়েছে ফিজার। নরম, রোমান্টিক ধরনের একটা লুক মেয়ে টার আবরাজ কে খুব করে আকর্ষণ করছে।
আবরাজ কে এমন অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিজা ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। এরপর নিজে থেকে আবরাজের এক হাত নিজের কোমরে টেনে নিলো রাখলো। চোখ দিয়ে যেনো ইশারা করলো কিছু। আবরাজ মেয়ে টার কোমরে দুই হাত রাখা মাত্র ফিজা কোমর মৃদু দুলিয়ে পা সামনে বাড়ালো। আবরাজ পেছনের দিকে যেতে লাগলো। মেয়ে টা তখন ও দোলে চলছে। দুলতে দুলতে এক সময় মাস্টার বেড রুম টার মাঝে চলে এলো। আবরাজ নিজের বাঁ হাতের আঙুলের ফাঁকে ফিজার আঙুলের ভাঁজে চেপে ধরলো। রুমে ডিম লাইট জ্বলছে। লাইটের আলোয়ে ফিজার শাড়ী টা চকচক করছে। যার ফলে মেয়ে টার মুখ ও জ্বলজ্বল করে। আবরাজ বিছানার দিকে যেতে চৈতন্য ফিরে পেলো ফিজা। আবরাজ ওকে তুলতুলে নরম গতিতে ধাক্কা দিয়ে ফেলতে সে আবরাজের টাই টা টেনে নিলো। যার ফলে আবরাজ ব্যালেন্স ঠিক রাখতে পারে না। আবরাজ দুই হাতে ফিজার দুই পাশে রেখে হাতের ওপর ভর রেখে ফিজার ওপর ঝুঁকে রইলো। চোখ গুলো ফিজার চোখে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে। নিষ্প্রভ এই দৃষ্টিতে ফিজা বেশি সময় তাকিয়ে থাকার মতো সাহস করতে পারলো না। দৃষ্টি নুইয়ে মুখ অন্য পাশ করে নিতে আবরাজ নিজের মুখ এগিয়ে ফিজার কানের কাছে নিলো ঠোঁট। উষ্ণ নিঃশ্বাস কানে ঘাড়ে আঁচড়ে পরতে ফিজার শরীর জুড়ে শিহরণ বয়ে গেলো। অস্থিরতা বেড়ে গেলো। হৃদপিণ্ডের অতিমাত্রায় ধুকপুক ধুকপুক শব্দ সে বিরক্ত হয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো। আবরাজ তৎক্ষনাৎ ফিসফিস স্বরে বলে উঠলো,
-“ইউ আর ভেরি চার্মিং সুগন্ধি ফুল।”
-“এইজন্যই তো বারবার কাছে আসেন।”
-“নো ওয়ে। ইউ আর টোটালি রং।”
-“তাহলে কেনো আসেন?”
আবরাজ এই প্রশ্নের জবাব দিলো না। নিজের কাজে মগ্ন হয়ে পড়লো। অতিরিক্ত উন্মাদনায় ফিজা শুধু অনুভব করে গেলো। আবরাজ খানের এক অদ্ভুত শীতল স্পর্শ তাকে কাবু করে নেয়। ভালোবাসার চাদরে যেনো জড়িয়ে সে অনুভব করে। তবে মুখে কেনো তা প্রকাশ করতে নারাজ এই পুরুষ!
রাতের গভীরতা বাড়তেই থাকে। সেই সাথে গভীর হয় আবরাজের এক এক টা স্পর্শ। যখন সে নিজের কার্যসিদ্ধি হাসিল করে বউ কে বুকে চেপে ধরে শুয়ে পরে। তখন তার রাশভারী কণ্ঠস্বর হিমবাহের ন্যায় শীতল হয়ে আসে। বউয়ের দেহখানা নিজের সঙ্গে স্বযত্নে আগলে নিয়ে ললাটে আদুরে স্পর্শ দিয়ে বলে,
-“ইউ নো হোয়াট, তোমার মধ্যে আমার সুখশান্তি বাসা বেঁধেছে। ব্যাস্ততায় ভরা এই জীবনে তোমার কাছে এসে আমার সকল গ্লানি, ক্লান্ত ঘুচে যায় সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা চুপ করে শুনে। তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে। সে ঠোঁটের কোণায় হাসি ঝুলিয়ে তন্দ্রা মজে গেলো। আবরাজ তপ্ত শ্বাস ফেললো বউয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে। এরপর হাতের বাঁধন দৃঢ় গভীর করে নিজেও চোখ বন্ধ করে নিলো।
——
ফিজাদের বাড়ির উঠোন বেশ যায়গা জুড়ে। সেখানেই বরের বাড়ি থেকে আসা অতিথিদের জন্য ডেকোরেশন করা হয়েছে। ব্যাকড্রপে ব্যাবহৃত হয়েছে সাদা কাপড় ড্রেপিং স্টাইল যা ভাঁজ করে আর্টিস্টিক ভাবে সাজানো। সাদা ড্রেপের মাঝে মাঝে লাল গোলাপ ফুল জুড়ে দেওয়া হয়েছে। পেছনের ব্যাকড্রপে ঝুলছে ওয়াল মাউন্টেড ক্যান্ডেল স্টাইল লাইট। সোনালি রঙের এবং উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে। ব্যাকড্রপের উপরের অংশে রয়েছে ঘন ভাবে সাজানো সাদা কৃত্রিম ফুলের গারল্যান্ড।
তিনটি সিটিং চেয়ার। মাঝখানে একটি বড় সোফা যেখানে বসে আছে মেহরিন আব্রাহাম। পাশে দুটি আরামদায়ক হাতলচেয়ার। যেগুলোর মধ্যে বসে অনেকে বর বউয়ের সাথে নিজেদের ক্যামেরা বন্দী করছেন প্রতিচ্ছবি।
পুরো পরিবেশকে উজ্জ্বল ও রাজকীয় করে তুলেছে।
স্টেজের সামনের অংশে এবং পাশের টেবিল স্ট্যান্ডের ওপর রাখা হয়েছে সাদা ও লাল ফুলের কৃত্রিম গুচ্ছ যার ফলস্বরূপ ডেকোরেশন আরও প্রাণবন্ত, নজরকাঁড়া লাগছে।
স্টেজের নিচে দুই কোণায় রাখা হয়েছে সবুজ গাছ-পাতাসহ ফুলের অ্যারেঞ্জমেন্ট।
স্টেজটি উঁচু প্ল্যাটফর্মে তৈরি সাথে ফ্লোরে বিছানো কার্পেট।
পাশে একটি এয়ার কন্ডিশনার রয়েছে পরিবেশ শীতল করতে তার ব্যবহার।
ব্যাকগ্রাউন্ডের একটি অংশে রয়েছে পর্যাপ্ত পর্দা যার সংমিশ্রণ ব্যবহার করে রাজকীয়, মার্জিত পরিবেশ তৈরি করছে। মফস্বলের দিকে এমন দারুণ দৃশ্য আশেপাশে ভীড় জমিয়েছে কিছু বাচ্চা পোলাপান। গার্ডের জন্য তাদের ভেতরে আসায় অসম্ভব। আর এতো সব নজরকাঁড়া ডেকোরেশন স্বয়ং আবরাজ খান নিজে থেকে এই ডেকোরেশন এর ইন্সট্রাকশন দিয়েছে। তার প্রতিটা কাজেই যেনো মেহরিন এর একজন বড়ো ভাইয়ের অভাব টা পূরণ করে দিয়েছে। বাড়ির প্রতিটা কোণায় কোণায় সৌন্দর্য ছুঁয়ে আছে।
আবরাজ ফিজা যখন মেহরিন এর পাশে এসে বসলো। মেহরিন তখন অনেক বেশি আবেগি হয়ে পড়লো। আবরাজ মেহরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আলতো করে।
ফিজার পরনে একটি হালকা, নরম ও মসৃণ ধাঁচের বেইজ রঙের শাড়ী। আবরাজ ও সেইম স্যুট পরা। আবরাজ বউ বাড়ি থেকে বেরিয়েছে পর এদিক-ওদিক ঘুরে আঁড়চোখে দেখে যাচ্ছে। মূলত ফিজা সকালেই নিজেদের বাড়িতে চলে এসছিলো মেহরিন এর ফোন পেয়ে। মেয়ে টা একা। কোনো ভাই বোন নেই। একমাত্র বোন বলতে ফিজা। তাই সকালে বোকা-সোকা মেহরিন কেঁদে গিয়ে বোন কে ফোন করে নিয়ে এসছে।
মেহরিন এর লেহেঙ্গা ধূসর ও বাদামির মাঝামাঝি। আব্রাহামের পাঞ্জাবি সাদা রঙের। বর কনে কি বড়ো ভাই না-কি ছোট ভাই? অনেক অফিসের স্টাফ এবং ফ্রেন্ড সার্কেলে এটা নিয়ে বেশ গুঞ্জন তুললো।
বিয়ে আগেই হয়েছে। শুধু ফর্মালিটি মাত্র এটা। ফটোশুট শেষ হতে প্রায় রাত নয়টার ঘর ছাড়িয়ে গেলো। অতিথি বিদায় নিতে লাগলো ধীরেধীরে। এক সময় বরের গাড়িও গন্তব্যের পথ অনুসরণ করলো। গাড়িতে বসে বোকা-সোকা মেহরিনের কান্না আরও জোরে পেলো। যখন আব্রাহাম ওর লেহেঙ্গা আর ব্লাউজের ফাঁকে উম্মুক্ত উদরে হাত রাখলো মেয়ে টার কান্না সাথে সাথে স্টপ হয়ে গেলো। আব্রাহাম বউ কে নিজের দিকে টেনে নিয়ে স্লো ভয়সে বললো,
-“কাঁদো। অফ করলে কেনো? ডোন্ট স্টপ। প্লিজ কাঁদো।”
মেহরিন অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই আব্রাহাম বাঁকা হাসলো। বউয়ের ক্রন্দনরত মুখ তার নিজে কে এতো সময় চোর-ডাকাত মনে হচ্ছিল। এখন শান্তি লাগছে বেচারার। চোখ বন্ধ করে মেহরিন কে টেনে নিয়ে বুকে মাথা চেপে ধরে সিটা গা এলিয়ে দিয়ে বললো,
-“ওকে। এখন না কেঁদে সব কান্না জমিয়ে রাখো। রাতে আবার কাদিও মেহুরানী।”
মেহরিন কান্না ভুলে গেলো। তার মুখশ্রী জুড়ে লজ্জা এসে ছেয়ে গেলো। আব্রাহামের পাঞ্জাবি খামচে ধরতে আব্রাহাম ফের বলে উঠলো,
-“প্লিজ ডোন্ট পোক মি নাউ। কন্টোল হারিয়ে কিছু করে ফেললে পরে কিন্তু দোষারোপ করতে পারবে না।”
মেহরিন একদম স্তব্ধ হয়ে গেলো। নীরবতা তার এখন শ্রেয়। এই পুরুষ দিন কি দিন লাগামহীন, অসভ্য, নির্লজ্জ হচ্ছে। এই সত্যি সে ছাড়া আর কে-ই বা জানবে!
——
ফিজা মা কে কিছুতেই বোঝাতে পারলো না। কেঁদে কেঁদে দুই মেয়ের জন্য হয়রান। নিশ্চয়ই মেহরিন এর অন্য কোথাও বিয়ে হলে ফিজা এখন মায়ের কাছে থাকতো। দুই বোনের বিয়ে এক বাড়িতে হয়েছে বলেই তো এখন দু’জন কে এক সাথে চলে যেতে হচ্ছে। অগত্যা ইলা বেগম ফিজা কে মোহিতা বেগম এর কাছে রেখে যাওয়ার জন্য ঠিক করলেন। তবে আবরাজ খান! সে কি মানবে! ফিজা চিন্তায় অস্থির নিশ্চয়ই আবরাজ কিছুতেই ফিজা কে রেখে যাবে না। ফিজা যখন আবরাজের দিকে তাকিয়ে এ-সব ভাবছে আবরাজ গাড়ি থেকে নেমে এসে ফিজার পাশে দাঁড়ালো। মা এবং বাবার উদ্দেশ্যে বললো,
-“রাত অনেক হয়েছে আব্বু। আম্মু যাও। আব্বু গাড়ি সাব্বির ড্রাইভ করবে। মিষ্টি ফাতিহার সাথে আছে।”
এই কথার অর্থ যেনো একদম পরিষ্কার। সে তাদের সাথে যাবে না। ইলা বেগম মৃদু হাসলেন শুধু। মিলন খান শুঁকনো কাশি দিলেন। এরপর বেয়াইনের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।
ফিজা লজ্জা একটু পেয়েছিলো বটে। তবে আবরাজ খান মানুষ টা তার জন্য সব করতে পারবে। এটুকু ভরসা, বিশ্বাস সে এই পুরুষ কে চোখ বন্ধ করে করতে পারবে। যদি পুরো পৃথিবী এক দিকে থাকে। আর ফিজা থাকে তার বিপরীতে তবে এই পুরুষ তা-ও নিজের অর্ধাঙ্গিনীর সাইড নিবে। এই শুধু মুখের কথা নয়। এর প্রমাণ আবরাজ খান নিজেই।
#চলবে….