#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৫৩
#জান্নাত_সুলতানা
আবরাজ অফিস থেকে দ্রুত ফিরেছে। বউয়ের জন্য মন কেমন ছটফট করছে তার। বাড়িতে এসে সে বউয়ের দেখা পেলো না। নিজে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো রুমের ভেতর সেই মিনি রুমের দরজা খোলা। আবরাজ উঁকি দিলো সেখানে। বউ তো তার প্রায় সেখানে সাজতে বসে। আজ-ও বসলে ক্ষতি হয় না। ধীরে পা চলে না আবরাজের। খুব দ্রুত সে রুমের ভেতর প্রবেশ করলো। ধারণা সত্যি হলো। বউ তার আজ-ও শাড়ী পড়ছে। সফট ল্যাভেন্ডার বা হালকা পার্পল রঙ, যাতে হালকা গোলাপি আভা রয়েছে। অর্গানজার মতো হালকা ও ঝলমলে ফ্যাব্রিক। পুরো শাড়ির উপর ছোট ছোট সোনালি পুঁতির মত এমবেলিশমেন্ট রয়েছে। আর পাড়ে গোল্ডেন লেইসের কাজ যা খুব সূক্ষ্ম এবং পরিপাটি।
গলায় একটি পাতলা সোনালি চেইন টাইপ নেকলেস। যার মধ্যে ছোট ছোট স্টোন বা মুক্তার মতো কাজ রয়েছে। যেটা ঘাড়ে একদম ফিট করে বসে। গলার সৌন্দর্য এই নেকলেস আরও কয়েকগুণ বাড়িয়েছে যেনো।
কানের দুল গুলো বড় সোনালি ঝুমকা। নিচে দুলতে থাকা ডিজাইন যা ট্র্যাডিশনাল লুকে চমৎকার মানিয়ে গেছে আবরাজ খানের সুগন্ধি ফুল কে।
হাতে একটা সোনালি চুড়ি এবং একটি ঘন ডিজাইনের ব্রেসলেট পরা আছে। আবরাজের নিকট এ-সব ভালো ঠেকে না। বউয়ের ন্যাচারাল লুক তাকে বেশি আকর্ষিত করে।
আবরাজ চঞ্চল পায়ে যখন বউয়ের পেছনে দাঁড়িয়ে কাঁধে হাত রাখলো। ফিজা মিষ্টি করে হাসলো,
-“আজ তাড়াতাড়ি এসেছেন? আমি তো ভাবলাম আরও লেট হবে।”
-“কি হয়েছে সুইটহার্ট?”
-“কি হবে? কিছু হওয়ার কথা ছিলো? মেয়ে না ছেলে?”
ফিজা ঠোঁট চেপে হেঁসে বলে উঠলো। আবরাজ ওর কথা অগ্রাহ্য করে জিজ্ঞেস করলো,
-“শরীর ভালো?”
-“উম, কেনো? আমি তো ভালো।”
আবরাজ বউয়ের মাথার ঠিক মধ্যিখানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। বললো,
-“তোমার ওই রূপে সুগন্ধিতে আমি বারবার মাতাল হই সুগন্ধি ফুল।”
ঘোরলাগা দৃষ্টি ফিজা উপেক্ষা করতে পারে না। আবরাজ যখন ওকে পাঁজা কোলে তুলে রুমে ফিরে এলো মেয়ে টা তখন ওর গলায় জড়িয়ে বুকে মাথা ঠেকিয়ে বলে উঠলো,
-“আবরাজ। তৃণা মিস্টার জি এর বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল ছিলো।”
ফিজা কে আবরাজ বিছানায় রেখে ভ্রু কুঁচকে চাইলো। সেদিন মিস্টার জি এর সাথে যে ফিসফিস করে কথা বলছিলো সব শুনেছে সে। তাই তেমন কোনো রিয়াকশন হলো না তার। আর নাই বউয়ের কথা বুঝতে অসুবিধা হলো। বউয়ের ফোনের সাথে নিজের ফোনের কানেকশন আছে যার সবকিছুতে নিজের দখলদারি বিধায় সে এটাও জানে মিস্টার জি ফিজা কে সব কিছু জানিয়েছে। আবরাজ ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
-“ডু ইউ নো আবরাজ খান কে যা দেওয়া হয়, তা সে কড়ায়-গণ্ডায় ফেরত দেয়।”
-“আবরাজ। আপনার এসব কথার মানে বুঝতে পারি না আমি।”
-“বুঝতে হবে না। নাউ আই নিড সামথিং।”
ফিজা গোপনে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই মানুষ টা কে সে বুঝতে পারে না। না-কি সে বেশি বুঝতে গিয়ে জটিল করে ফেলেছে এই পুরুষ কে! যা করা একদম উচিৎ হয় নি।
——
আব্রাহাম মেহরিনের দিন কেটে যাচ্ছে। ভোলাভালা স্বভাবের মেহরিন নিজের স্বামী সংসারের অতল গভীরে তলিয়ে গেছে। একটা মেয়ের বিয়ের পর সবচাইতে কাছের এবং আপন যে হয় সে হচ্ছে স্বামী। যার কাছে সব সাজে। তেমনই মেহরিনের আহ্লাদ আরও দিগুণ হয়েছে আব্রাহাম তাকে যত্ন করে আদরে আগলে রেখেছে বাহুতলে, কতোই না মানুষের রূপ। এই যেনো মেহরিন কোনো দিন কল্পনা ও করে নি। এক ভয়ংকর মানুষের সাথে সে বাসা বেঁধেছে। আব্রাহাম আজ অফিস থেকে ফিরে ঘর অন্ধকার দেখে অনেক টা অবাক হলো। মেহরিন কখনোই এমন করে না। কিছু হলো কী? আব্রাহামের বুকের ভেতর একটু ভয়ের আশংকা বৃদ্ধি পেলো। গলা থেকে টাই আলগা করে সে বেডের পাশে এসে লাইট অন করলো। রুম জুড়ে কোথাও দেখা নেই বউয়ের। কোথায় গেলো মেয়ে টা? আব্রাহাম নিজের ছোট ব্যালকনিতে দেখলো, সেখানে নেই। রুমে ফিরে আচমকাই শুনতে পেলো হেঁচকির শব্দ। যেনো খুব করে কেঁদেছে সে। গুনগুন কান্না আর হেঁচকি। শোনার জন্য গভীর মনোযোগের প্রয়োজন। যা আব্রাহাম এতো সময় দেয় নি। সে দৃষ্টি নত করে আলমারির পাশে দৃষ্টিপাত করলো। তৎক্ষনাৎ নজরে পড়লো আলমারির সঙ্গে চেপে এলোমেলো হয়ে বসে মেহরিন। আব্রাহামের বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। ভীষণ পানির তেষ্টা পেলো। আস্তে করে ঢুক গিলতে অ্যাডামস অ্যাপেল টা ওঠানামা করলো। অতিরিক্ত টেনশন ভয় থেকে তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করলো।
ব্লেজার টা খুলে কোনো রকম ছুঁড়ে ফেলে এক ছুটে গিয়ে মেহরিনের পাশে বসলো। মেহরিন চোখ তুলে চাইলো না। আব্রাহাম আলতো করে নিজের কাঁপতে থাকা হাত মেহরিনের মাথায় রাখলো। বললো,
-“মেহুরানী।”
মেহরিন ঝট করে আব্রাহামের হাত টা নিজের মাথার ওপর থেকে সরিয়ে দিলো। চোখ দুটো লাল হয়েছে কাঁদতে কাঁদতে। চুলের বিনুনি টা এলোমেলো। গালে চোখের জলের দাগ বসে আছে। খুব বেদনাতেই মানুষের এমন দুর্দশা হতে পারে। আব্রাহামের বুকের ভেতর টা অজানা কোনো কারণেই টিপটিপ করছে। মেহরিন এক সময় আব্রাহামের হাতে একটা ছোট মিনি ডায়েরি ছুঁড়ে দিলো। উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
-“একবার ও বুক কাঁপলো না আপনার? কেনো করলেন আমার সাথে এটা? আমি তো আপনাকে বলি নি আমাকে বিয়ে করুন। তাহলে কেনো করলেন আমার সাথে এমন টা? কেনো ঠকালেন আমায়? কি দোষ আমার? আপনাকে বিশ্বাস করে ভালোবাসা? আব্রাহাম প্লিজ প্লিজ, একবার বলুন না আপনি আমাকে ভালোবাসেন। নিজের স্বার্থের জন্য বিয়ে করেন নি।”
মেহরিন আব্রাহামের হাত টা আগলে নিয়ে বলে। তার চোখে কিছু পাওয়ার আশা। সব মিথ্যা হোক। শুধু আব্রাহাম একবার তাকে ভালোবাসি বলুক। কিন্তু হায়! যারা অল্পতেই খুশি হয় তারা যে ওই অল্প টুকু ও পায় না।
-“ইয়েস। আমি আমার স্বার্থের জন্য তোকে বিয়ে করেছি। হোয়াট টু ডু? ছেড়ে যাবি আমাকে? ট্রাই ইট। জাস্ট খুন করে ফেলবো। তবুও ছাড়বো না।”
টুঁটি চেপে মেহরিনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে আব্রাহাম হিসহিসিয়ে বলে উঠলো। মেহরিনের স্বভাবগত কারণে আর কথা বলার মতো শব্দ সে এক সঙ্গে জুড়তে পারলো না। চোখ দু’টো ভীষণ অসহায় দেখালো। অভিযোগ সেখানে প্রচুর। কিন্তু আব্রাহাম কি সে-সব দেখবে? দেখার মতো ধৈর্য কিংবা পরিস্থিতি এই পুরুষের এখন নেই।
-“তোর কাঁদার অনেক শখ তাই না? চল আমি তোকে কাঁদিয়ে দিচ্ছি। তোকে কষ্ট করতে হবে না। আজ সারারাত কাঁদবি তুই। আমি দেখতে চাই তুই কত কাঁদতে পারিস।”
মেয়ে টার চোখের জল তার সহ্য হয় না। অথচ এখন তার রাগে একে হিতাহিতজ্ঞান টুকু যেনো বিলীন হয়েছে। যখন বিছানায় ফেলে লাইট অফ করে আব্রাহাম মেহরিনের দেহটা টেনে নিজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করলো। মেয়ে টা তখন ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নেড়ে না করে যাচ্ছে। অথচ আব্রাহাম দেখলই না। সে নিজের কথা সত্যিতে রূপ দিলো। যার একটু ও বরখেলাপ হলো না। সত্যি মেয়ে টা কাঁদল। গোঙানির শব্দ পেলো আব্রাহাম। কিন্তু তার তখন মাথায় অন্য চিন্তা। যদি এই মেয়ে তাকে ছেড়ে যায়? সে থাকতে পারবে না। অথচ পুরুষ এটা ভাবলো না নারীর রাগের চেয়ে অভিমানে বেশি করে। যার ফল ভয়ংকর হতে পারে। সেটা হয়তো শখের পুরুষের ধারণার বাইরে।
——
আবরাজ ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখলো বউ তার কথা বলছে ফোনে। সে ফিজার দিকে খেয়াল রেখে রেডি হয়ে নিলো। অফিসের জন্য রেডি হয়ে এসে বসলো ফিজার সামনে। আবরাজ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফিজা বলে উঠলো,
-“আবরাজ আজ ডক্টর আন্টি ডেকেছে।”
-“তোমার মেডিসিন শেষ হয়েছে?”
-“না তো। বললো কি একটা টেস্ট করে নিলে ভালো হবে।”
ফিজা চিন্তিত স্বরে জানালো। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরলো। তার তো অজানা নয় কিসের জন্য বলেছে। কিন্তু ফিজা তো আর জানে না। সে চায়ও না বউ এব্যাপারে কিছু কখনো জানে। আবরাজ ভাবতে ভাবতে বললো,
-“ওকে তুমি বিকেলে ড্রাইভার নিয়ে চলে যাও। আমি বাড়ি ফিরার পথে তোমায় নিয়ে আসবো।”
ফিজা ঘাড় নেড়ে সায় দিলো। আবরাজ বউয়ের কপালে চুমু খেয়ে ব্লেজার হাতে ওঠে দাঁড়ালো।
-“নিচে যাওয়ার দরকার নেই। ব্রেকফাস্ট রুমে দিয়ে দিতে বলবো আমি।”
-“আমি যেত,,
ফিজা নিজে যেতে পারবে এটা আর সম্পূর্ণ করতে পারলো না। তার আগেই গম্ভীর স্বরে আবরাজ বলে উঠলো,
-“আমি জানতে চাই নি।”
আবরাজ কথা টা বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো। ফিজা ভোঁতা মুখ করে বসে রইলো। এভাবে ধমকে কথা বলার কারণ সে খুঁজে পায় না। অদ্ভুত পুরুষ। গিরগিটির ন্যায় মর্জি সেকেন্ড সেকেন্ড চেঞ্জ হয়। এটা আর বলার অপেক্ষায় রাখে না।
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]