#সুগন্ধি_ফুল
#পর্ব_৫৪
#জান্নাত_সুলতানা
-“ফিজা, তোমার আরও অপেক্ষা করতে হবে। তুমি যদি এখনই বেবি নিয়ে নাও তাহলে তোমার লাইফ রিস্কে চলে যাবে।”
ফিজার মাথা যেনো চক্কর দিলো। স্বাভাবিক ভাবে ওর কাছে এই কথার অর্থ কী হতে পারে বুঝতে অসুবিধা হলো। বেবি মিসক্যারেজ হলে বেবি নিতে টাইম নেওয়া লাগে। ওর মিসক্যারেজ হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস। তাহলে এখনো ডক্টর এমন কথা কেনো বলছেন? ফিজা নড়েচড়ে বসলো। বিয়ের ছয় বছরে ও বাচ্চা না থাকা টা একটু না অনেকটাই একটা মেয়ের জন্য পীড়াদায়ক। ফিজা ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো। কোলের ওপর রাখা ব্যাগ টার ফিতা শক্ত করে চেপে ধরে হাতে মুঠোয় জিজ্ঞেস করলো,
-“বাট হোয়াই আন্টি? আমার বেবি মিসক্যারেজ হয়েছে প্রায় পাঁচ মাস হতে চললো।”
-“দেখো ফিজা আই নো দ্যাট তুমি অনেক স্ট্রং। তোমার থেকে তখন হয়তো কথা টা গোপন করলে-ও এখন তোমার এই কথা টা জানান প্রয়োজন।”
-“কিসের কথা বলছেন আপনি?”
-“দেখো তোমার মিসক্যারেজ সাধারণ হয় নি। পয়জনের ফলে মিসক্যারেজ হয়েছিল। সেইজন্যই আমি বলছি সময় নিয়ে বেবি নাও। এমন তো নয় সময় চলে যাচ্ছে।”
মেয়ে টা নিজের পায়ের তলা শূন্যে ভাসছে মনে হলো। চার দিক থেকে ঘুটঘুটে আঁধারে সে যেনো বড্ড একা। তবুও ঠাই বসা মেয়ে টা। কত বড়ো একটা সত্যি তার অজানা। কে করে ছিলো এটা? ফিজা ডক্টর কে জিজ্ঞেস করলো না কিছু। মুখে মিথ্যা হাসি ঝুলিয়ে সে বিদায় নিলো ডক্টরের চেম্বার থেকে। আবরাজ তাকে বলে ছিলো অপেক্ষা করতে। কিন্তু ফিজা বেরিয়ে উবারে করে বাড়ি ফিরে এলো।
——-
সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে এখন বিকেল। অথচ মেহরিন কিছু খায় নি। আব্রাহাম অফিসে যাওয়ার আগে ব্রেকফাস্ট রুমে রেখে গিয়েছিল। যেখানে খাবার রাখা ছিলো ঠিক সেখানেই পড়ে রয়েছে খাবার প্লেট টা। আব্রাহামের রাগে শরীর টা থরথর করে কেঁপে উঠলো। গা থেকে ব্লেজার টা টেনে খুলে টাই টা আলগা করে শার্টের হাতা ফোল্ড করে নিলো। নিজে রুমে আসার সময় নিয়ে আসা খাবার প্লেট টা হাতে নিয়ে মেহরিনের সামনে এসে বসলো। মেহরিন আধশোয়া হয়ে আছে। আব্রাহাম হাত টা ধুয়ে মেহরিনের মুখের সামনে খাবার ধরলো। মেহরিন মুখ টা ঘুরিয়ে নিতে আব্রাহাম শান্ত স্বরে আদেশ করলো,
-“খাবার টা খেয়ে নাও।”
-“আমার ক্ষুধা নেই।”
মেহরিন মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখে জবাব দিলো। তবে পরক্ষণেই গর্জন কানে আসে। চমকে যায় মেয়ে টা। আব্রাহামের রাগান্বিত মুখের দিকে তাকায়। পুরুষ টার চোখে মুখে ভয়ংকর রাগের আভাস।
-“মেহরিন।”
আব্রাহামের হুংকার মেয়ে টা একটু চমকে উঠলো। নড়েচড়ে বসতে বসতে ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে ফেললো মেহরিন। ভেতর থেকে কষ্ট গুলো যেনো চোখের জল হয়ে সামনে বসা আব্রাহাম নামক পুরুষ টার প্রতি অভিযোগ করতে লাগলো। আব্রাহামের বুকের ভেতর মোচড় দিলো। সে খাবার প্লেট টা রেখে মেহরিনের গালে চেপে ধরে মুখের ভেতর খাবার দিলো। মেহরিন কাঁদতে গিয়ে খাবার তালুতে উঠে গেলো। কাশতে কাশতে মেয়ে টার চোখ লাল হয়ে খুব ভয়াবহ অবস্থা। আব্রাহাম ওকে কোলে তুলে নিলো ওয়াশ রুমে গেলো। হাত মুখ ধুইয়ে দিয়ে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো কিছু সময়। মেহরিন শান্ত। নিশ্চুপ। আব্রাহাম সাড়াশব্দ না পেয়ে বুঝল মেয়ে টা গভীর ঘুমে তলিয়েছে। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। একটা মেয়ে ঠিক কতো টা বিশ্বাস, ভালোবাসা আর ভরসা করে একটা পুরুষের বুকে এমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে যেতে পারে? তার জানা নেই। কিন্তু ধারণা আছে। কিন্তু সত্যি কখনো মিথ্যা হয়ে যাবে না। সে নিজের স্বার্থে এই বোকা মেহরিন কে তুরুপের তাস বানিয়েছে। কিন্তু মেয়ে টা? তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করে, ভালোবাসার ওপর ভরসা করে বিয়েতে রাজী হয়ে ছিলো। যার মূল্য সে একটা দিয়েছে অবশ্য, স্বার্থপরের মতো ব্যবহার করে গেছে। এখন কি হবে? মেহরিন বিশ্বাস করবে তাকে? আগের পরিকল্পনা যেমন মিথ্যা নয় ঠিক তেমন মিথ্যা নয় এই মেয়ে টাকে সে ভালো না বাসলেও ওকে ছাড়া সে একটা সেকেন্ড ও কল্পনা করতে পারে না।
-“আমার তোমাকে আমার করে রাখতে যতোটা খারাপ হতে হয় আমি হবো। কিন্তু তবুও তোমাকে ছাড়ছি না আমি মেহুরানী।”
——-
ফিজা চুপটি করে বসে ব্যালকনিতে। আবরাজ ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বউয়ের কাছে গেলো। অফিসের সব কাজটাজ ফেলে সে ডক্টরের চেম্বারে গিয়েছিলো ফিজা কে নিতে। অথচ মেয়ে টা সেখানে নেই। অদ্ভুত কান্ড। সে হন্নে হয়ে খুঁজতে লাগালো সর্বদিক। পরে মায়ের সাথে কথা বলে জানতে পারলো ফিজা আরও দু’ঘন্টা আগে ফিরেছে বাড়িতে। এরপর আর রুম থেকে বেরোয়নি। আবরাজ তখন একদম শান্ত। বাড়িতে ফিরে সে আগে শাওয়ার নিলো। এরপর বউয়ের কাছে এলো। ফিজা তখনও নিরবতা পালন করছে। আবরাজ ওর মুখ টা নিজের দুই হাতের আঁজল নিয়ে বললো,
-“আমি সকালে বলেছিলাম কিছু।”
ফিজার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। আবরাজ ভ্রু কুঁচকে নিলো। আচমকাই আবরাজ ধাক্কার তাল সামলাতে না পেরে দূরে ছিটকে গিয়ে পড়লো। আর একটু হলেই সে দেয়ালে লেগে হাতে ব্যাথা পাচ্ছিলো। ফিজা আবরাজের দিকে ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তখনও। আবরাজ অবাক হয়ে শুধালো,
-“আর ইউ ক্রেজি? কি করছো মাথা ঠিক আছে তো?”
-“আমার বাচ্চা কে মেরেছে? কেনো মেরেছেন ওকে?”
আবরাজ কোনো দিনই নিজের সাফাই সে দেয় নি। ফিজার দিকে তাকিয়ে সে হিমশীতল গভীর মনোযোগ দিয়ে সে মেয়ে টার আপাদমস্তক দৃষ্টি বুলিয়ে বলে উঠলো,
-“সুগন্ধি ফুল।”
আহ্লাদী এই স্বর ফিজা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আবরাজ জানে বউ কে সে শক্ত কথা দিয়ে নয়। ভালোবেসে নিজের আয়ত্তে নিতে হবে। দুই কদম এগিয়ে আবরাজ যখন সামনে এগিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ বউ তার পাখির ন্যায় উড়ে এসে যেনো আঁচড়ে পড়লো বক্ষদেশ। আবরাজ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আলিঙ্গন দৃঢ় গভীর হলো সাথে সাথে। ফিজা তখনও কাঁদছে। আবরাজের বুকের ভেতর মোচড় দেয়। নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবরাজ বউয়ের এলোমেলো চুল গুছিয়ে দিলো। এলোমেলো চুল, চোখের জলে পুরো মুখ ভেজা। ঘেমে একাকার অবস্থা। কি করুণ সেই দৃশ্য। আবরাজ আর কখনো এতো টা ভেঙে পরতে দেখে নি এই রমণী কে। তবুও তার আজ কোনো ব্যাথা ধরলো না বুকে। বউয়ের এই ক্রন্দনরত মুখের ধার সে অনেক আগেই শোধ করে দিয়েছে।
-“আবরাজ, ও আমার আপনার অংশ ওকে আমি,,,
গলা দিয়ে শব্দ বেড় হচ্ছে না মেয়ে টার। এতো কাঁদতে আবরাজ ওকে আর কখনো ই দেখে নি। আবরাজ দাঁতে দাঁত চেপে বসে থেকে-ও কোনো লাভ হচ্ছে না যেনো। বউ কে কোলে তুলে সে রুমে চলে এলো। ফিজা গুটিশুটি মেরে আবরাজের বুকের ভেতর মুখ গুঁজে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। আবরাজ তপ্ত শ্বাস ফেললো। আগেই তো ভালো ছিলো৷ যখন কিছু জানতো না মেয়ে টা। এখন জানার পর আরও পাগলামি বাড়লো। এই পাগলামো কিভাবে দূর করবে সে! কিভাবে সামলে নেবে বউ কে? এই ব্যাথা যে কতোটা দগদগে তা যে সে পিতা হয়ে ও টের পাচ্ছে হারে হারে। সেখানে একজন মা সে কি করে সহ্য করে যাবে এই নির্মম সত্যি টা!
#চলবে…….