#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৩
#জান্নাত_সুলতানা
-“মেহরিন! কোথায় তুই মা? তাড়াতাড়ি আয়।”
আব্রাহাম অপরিচিত নারী কণ্ঠ শুনে সে তীব্র বিরক্ত ঠেলে ইজি চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। হাতে থাকা “দ্য সুইটেস্ট অব্লিভিয়ান” নোবেল টা পাশের গোল চকচকে কাচের টেবিল টায় অবহেলায় রাখলো। বইয়ের অর্ধেক টা টেবিল বাকি অর্ধেক টেবিলের বাইরে। তার আজ কোনো কিছুতেই লাগছে না মন টা। সে ঠোঁট কামড়ে ধরে কণ্ঠস্বরের উৎসাহ খোঁজার জন্য জানালার পাশে গেলো। পর্দা ঠেলে সরিয়ে দেয়। একদম সন্ধ্যা শেষ পুরো আকাশ জুড়ে যখন হালকা হালকা লাল আভা ছড়ায় সাথে আবছা অন্ধকার চারদিকে ঘিরে থাকে। আব্রাহাম খুব ভালো করে দেখলো। একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে সাথে তার মাকে দেখা যাচ্ছে। দারোয়ান গেইট খুলে রেখেছে। আব্রাহাম ভ্রু কুঁচকে নিলো। মহিলা টা কী তার ভাবির মা? হতে পারে। সে টি-শার্ট এর ওপর একটা চেক শার্ট জড়িয়ে নিলো। আর তারপর নিচে নেমে এলো।
সে যতক্ষণে বাইরে এসছে ততক্ষণে দু’জন লিভিং রুমে বসে আছে। একজন মহিলা এবং একটি মেয়ে। সে পেছন থেকে অনুমান করলো তারাই তার ভাবির মা এবং বোন। সে নিজে কে প্রস্তুত করলো। আর তাদের সামনে গেলো। মিলন খান ততক্ষণে ছেলের নাম ধরে ডাকছে। আর বলছেন,
-“আব্রাহাম এদিকে এসো। দেখো তোমার আন্টি। সালাম দাও।”
মোহিতা বেগম মৃদু হাসলেন। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আব্রাহামের দিকে। সে হাসি হাসি মুখে মোহিতা বেগমের সঙ্গে কথা বললো। তবে পাশের বসা মেয়ে টার দিকে তাকিয়ে তার হৃদপিণ্ড কেঁপে উঠলো। স্থির হয়ে গেলো কণ্ঠ। গলা দিয়ে কোনো শব্দ সে চেয়ে ও বের করে আনতে পারলো না। বাবা-র পাশে চুপ করে বসলো সে। তাদের মধ্যে কথাবার্তা ঠিকই জমজমাট হয়ে উঠলো এক সময়।
তবে মাথা নিচু করে বসে আছে মেহরিন। সে চুপচাপ স্বভাবের। মানুষের কোলাহল একদম পছন্দ নয়। তাই যখন বোনের দেবর এসছে দেশে আর তাদের খান বাড়িতে আসতে হবে জেনেছে তখনই সে মা’কে নিষেধ করে ছিলো সে আসবে না। কিন্তু মা তাকে জোর করে আত্মীয়তা রক্ষার খাতিরে নিয়ে এসছে। সামনে বিশেষ কয়েক পদের নাশতা দেওয়া থাকলে-ও মেহরিন কিছুই ছুঁয়ে দেখে নি। আব্রাহাম ওর দিকে আঁড়চোখে বারকয়েক তাকায়। মেয়ে টা দেখতে একটু গুলুমুলু। কী সুন্দর একটা বিড়াল ছানার ন্যায় মায়ের পাশে গাপটি মেরে বসে আছে। গায়ে ধূসর রঙের থ্রি-পিস। চুলের বেণী টা কী দারুণ মোটা। আব্রাহাম খুব বেশি সময় বসে থাকতে পারলো না। তার শরীর অস্থির লাগছে। গরমে অসহ্য। সে ওঠে দাঁড়ালো। মা’কে বললো,
-“আম্মু আমি রুমে যাচ্ছি।”
-“আচ্ছা। তবে খাবারের আগে নিচে চলে এসো।”
ইলা বেগম মুখে মৃদু হাসি টেনে বললো। আর মেহরিনের মুখে এক টুকরো আপেল তুলে দিলো। একটা মেয়ের যে কত শখ ছিলো ওনার। তবে সব শখ পূরণ হয় না। এটা তিনি মানে। তাই তো ফিজা, মেহরিন দুই বোন কেই তিনি নিজের মেয়ে বানিয়ে বসে আছে। যদিও ফিজা কে কাছে পায় নি। আর মেহরিন তেমন আসতে চায় খান বাড়িতে। তবে যখনই আসে তিনি ওকে খুব আদর করে। আব্রাহাম মায়ের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এতো আদর করার কোনো কারণ নেই। মুখ ভেংচি কেটে যখনই সে ওপরে যাওয়ার জন্য পা বাড়াবে তখনই পেছন থেকে মিলন খান ডেকে উঠলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন,
-“আ শোনো আব্রাহাম। মেহরিন কে নিয়ে যাও সাথে, একা বসে থেকে বোরিং হচ্ছে।”
-“হ্যাঁ যা মা।”
ইলা বেগম ও ঠেলে দিলেন যেনো। মেহরিন না চাই তেও দাঁড়িয়ে গেলো। আব্রাহাম চোখ বন্ধ করে তাদের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার রাগ হচ্ছে বাবা-র ওপর। যেই কারণ সে এখান থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো বাবা তার সাথে সেটাই বেঁধে দিলো। এখন সে কিভাবে এই আগুন সাথে নিয়ে হাঁটবে? তার যে প্রচুর গরম লাগছে।
——–
পুরো সাতচল্লিশ মিনিট ধরে ফিজা একই যায়গায় একই ভাবে বসে আছে। তার কোমর ব্যাথা করছে। শরীর টা ম্যাজম্যাজ করছে। আবরাজ কী সেটা বুঝতে পারছে না? তার ঘুম পাচ্ছে। এভাবে বসে থাকতে থাকতে ক্ষুধা বেড়েছে। ফিজা আবরাজের শান্ত চোখের দিকে তাকালো। আর পিটপিট করে আহ্লাদী স্বরে বললো,
-“এই শুনুন না, আমার ঘুম পাচ্ছে।”
-“না।”
আবরাজ এক শব্দে তার সিদ্ধান্ত জানায়। ফিজা তেতে উঠে এবার। ঝাঁজালো স্বরে আওড়ায়,
-“কী না? ঘুমাব আমি।”
এরমধ্যেই ওর পেটে গড়গড় শব্দ করে। ও চোরা চোখে তাকায় আবরাজের দিকে। আবরাজ পিটপিট করে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি সন্ধ্যায় খাবার খাও নি, কেনো?
ফিজা ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এখানে এসছে পর সে একদিন ও আবরাজের সাথে ডিনার করতে পারে নি। আর এটাই ওর আফসোস সাথে আরও একটা আছে। সেটা হলো আবরাজ এতোদিনে তাকে নিয়ে একবার বাইরে যায় নি। সে রাতে খাবার খায়। তবে কখনোই সেটা তৃপ্তির হয় না। কেনো জানি আজ ইচ্ছে করেই খায় নি। ওর ভাবনার মাঝেই আবরাজ ওঠে এলো। হাত থেকে ঘড়ি টা খুলে রাখলো। আর শার্টের হাতা ফোল্ড করতে লাগলো। ফিজা কিছু বুঝে উঠতে পারে না। আবরাজ তার আগেই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে গম্ভীর স্বরে বলে গেলো,
-“ওয়েট ফর মি, সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা ঠোঁট ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ছাড়লো। দম বন্ধ হয়ে বসে ছিলো সে৷ আবরাজ বেরিয়ে যেতেই নিজের উন্মুক্ত বাহু আরেক হাতে ছুঁয়ে দিলো। শরীরের যেনো জ্বলছে এখনো। কী অদ্ভুত মানুষ এভাবে অর্ধ উন্মুক্ত করে বসিয়ে রাখা কোনো মানে নেই। শুধু শুধু ঠান্ডার মধ্যে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। যদিও রুমে হিটার চালু আছে। আর তারচেয়ে বড়ো হিটার তো আবরাজ খান। যে আশেপাশে থাকলে ফিজার অস্থির লাগে।
—–
-“কাম, বেবি গার্ল।”
ফিজা চোখ উলটে চাইলো আবরাজের দিকে৷ খাবার খাইয়ে দিয়েছে আবরাজ তাকে। আর এখন এতো সুন্দর করে ডাকছে। ফিজা সোফায় বসে আছে। সে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বললো,
-“আপনি কাল আমাকে বাইরে নিয়ে যাবেন।”
-“এটা নিয়ে কাল কথা হবে। এখন এদিকে এসো, জান।”
আবরাজ গম্ভীর স্বরে বললো। ফিজা মুখের পানি গিলে নিলো। যেনো সাথে ভয় ও গিলে খেয়ে নিচ্ছে। আবরাজ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যা আরও ফিজার অস্থিরতা কারণ। ফিজার এখন অস্বস্তি হচ্ছে না। আবরাজ তার আরও একটা সৌন্দর্য খুঁজে বের করেছে। যা সে নিজেও জানতো না। ফিজা হাত দু’টো সামনে রেখে নখ খুঁটতে খুঁটতে লাগলো। আর এক পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছে। আবরাজের এতো ধৈর্য আছে? সে অস্থির কণ্ঠে আবার ডাকলো,
-“ফাস্ট, সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা মিটমিট করে হাসলো। তার ভালোই লাগে যখন আবরাজ তাকে অনেক বেশি প্রায়োরিটি দেয়। যত্ন করে। আর যখনই কাছে আসে তখন পুরো উন্মাদ। ফিজার গাল লাজরাঙা হয়ে ওঠে। আবরাজ ওকে হঠাৎ করে হেঁচকা টানে আর নিজের বাহুর ওপর শুইয়ে দেয়। ফিজা চোখ বন্ধ করে নেয়। আবরাজ ওর চোয়ালে হাত ছুঁইয়ে দিয়ে থুতনিতে এসে আঙুল ঠেকায়। আর ফিসফিস করে বলে,
-“তুমি নব্বইয় দশকের কোনো এক জমিদার প্রেমিকার মতো দেখতে লাগছো, সুগন্ধি ফুল।”
-“ওই জমিদার প্রেমিকটা কী জমিদার আবরাজ খান?”
-“অফকোর্স, তোমার জমিদার প্রেমিক আবরাজ খান।”
ফিজার কুঁচকানো ভ্রু জোড়া টানটান হয়ে আসে। আবরাজের কথা শুনে হঠাৎ করে মেয়ে টা জোরে জোরে হাসতে লাগলো৷ আবরাজ বউয়ের প্রাণখোলা হাসির দিকে কিছু সময় মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। ফিজার চোখের কোলে জল জমেছে। সে তবুও হাসছে। মনে হচ্ছে বিশ্বের সেরা জোক্স টা আবরাজ তার সাথে করেছে। আবরাজ বউয়ের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত এক হাসি দিলো। যা দেখে ফিজার গলা আবার শুঁকিয়ে আসে। আবরাজ ফিজার চোয়াল আঙুল ছুঁয়ে ধীরে ধীরে স্লাইড করে। ফিজা ক্ষণেক্ষণে কেঁপে ওঠে। ফিসফিস করে অনুরোধ স্বরে বললো,
-“এমন করবেন না প্লিজ। আমার অস্থির লাগে।”
-“ফর মি।”
ফিজা দুইদিকে অনবরত মাথা নাড়ে। আবরাজ বাঁকা হেঁসে বলে,
-“ডোন্ট বি লায়িং, সুগন্ধি ফুল।”
আবরাজ খুব সন্তপর্ণে বউয়ের গলায় মুখ গুঁজে দেয়। ফিসফিস করে আওড়ায়,
-“তোমার স্মেল! এটা আমায় তুমি ছাড়া সবকিছু ভুলিয়ে দেয়। ওয়াইনেও এতো নেশা হয় না। যতোটা তোমার শরীরের সুগন্ধি থেকে হয়, সুগন্ধি ফুল।”
ফিজা আবরাজের পিঠের দিকে শার্ট টা শক্ত করে হাতের মুঠো পুরো নেয়। আবরাজ শব্দ করে চুমু দেয় ফিজার ঘাড়ে। আর হেঁসে উঠে উচ্চস্বরে। সে জানে এই মেয়ের ছোট ছোট আঙুলের ডগায় থাকা গোলাপি নখ তার হাল খুব শীগ্রই বেহাল করে দিবে।
আর সে টি-শার্ট উলটো করে মাথার ওপর দিয়ে খুলে নিতেই ফিজা চোখ বন্ধ করে নেয়। পেশিগুলো ক্রমে ভেসে উঠছে নিজেদের অবস্থান জানান দিয়ে। দীর্ঘ দিন ওয়াকআউট এমন সুন্দর ফিটনেস দিতে পারে। ফিজা ঢোক গিলে। গলা শুঁকিয়ে আছে, পানির অভাব বোধ করে। অথচ সে একটু আগেই অনেকটা পানি খেয়েছে। আবরাজ ওর হাত দু’টো বিছানায় চেপে ধরে হাতের দিকে ইশারা করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস টেনে বলে,
-“এগুলো কাল সকালে সাইজ করবো জান। জানো তো, ক্ষত স্থানে পানি লাগলে খুব জ্বলে।”
ফিজা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দুই দিকে মাথা নেড়ে বলে,
-“প্লিজ না।”
-“ইয়েস।”
মাথা দুলিয়ে আবরাজ বাঁকা হেঁসে লাইট অফ করে। ফিজা একটু স্বস্তি পায়। একটা নির্লজ্জ পুরুষ। যার মুখে কিচ্ছু আঁটকায় না। আর অদ্ভুত হলে-ও সত্যি সে এই মানুষ টাকে ধীরে ধীরে ভালোবেসে ফেলেছে। যার সাথে সে এখন ছোট একটা সংসারের স্বপ্ন দেখে।
#চলবে……
#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৪
#জান্নাত_সুলতানা
-“নাম কী মেয়ে?”
-“ম মে মেমেহরিন সিদ্দিকী।”
আব্রাহাম ভ্রু কপালে তুলে। এই মেয়ে এতো ভীতু? হাউ ফানি। এখনো এমন মেয়ে হয়? অবিশ্বাস্য এটা। হয়তো নার্ভাস। আব্রাহাম ওকে স্বাভাবিক করতে বলে,
-“কিসে পড়ো তুমি?”
-“অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।”
মেহরিন নিচের দিকে তাকিয়ে কথা বললেও তার দৃষ্টি ঠিকই আব্রাহামের সেন্টার টেবিলের ওপর পরে থাকা বই টার ওপর। মেহরিন আস্তে করে ঢোক গিলে। তার ভয় লাগছে। সে খুব বেশি ইংলিশ নোবেল সম্পর্কে।। জানে না। তবে তার বোন বই পড়ে। আর সে সেখান থেকেই জানে এগুলো ভালো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ পড়ে হজম করতে পারবে না। আর যদি হয় মেহরিনের মতো মেয়ে। তার গা ঘুলিয়ে আসে।
আব্রাহাম এরমধ্যে নিচে সোফায় বসে ওকে বলে,
-“ওহ আচ্ছা। তুমি ও বসো।”
মেহরিন তবুও দাঁড়িয়ে থাকে৷ নখ দিয়ে টাইলস খুঁটতে থাকে। সে নার্ভাস। আব্রাহাম কিছু সময় ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। এরপর ওঠে দাঁড়ালো। আর বললো,
-“তুমি আগে এই বাড়িতে এসেছো? পুরো বাড়ি দেখেছো?”
হ্যাঁ মেহরিন এই বাড়িতে আগে এসছে। তবে গেস্ট রুম। আর লিভিং রুম খাবার টেবিলে পর্যন্ত সে সীমাবদ্ধ। এর বাইরে কিছু সে জানে না।
মেহরিন মাথা হেলিয়ে জবাব দিলো,
-“এসছি।”
-“আচ্ছা।”
আব্রাহাম রুমের ভেতর ঘুরঘুর করে। আর মেহরিন এক পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ভয় লাগছে। কিন্তু কেনো? কে জানে। আব্রাহাম আঁড়চোখে নয়। বরং পূর্ণ দৃষ্টিতে ওকে দেখে। সব দিক থেকে। পেছনে দাঁড়িয়ে। সামনে থেকে ডানে বাঁমে সব দিক থেকে। আর সে মনে মনে নিজেই অবাক হয়। দেশের বাইরে গিয়ে তার মেয়ে ফ্রেন্ড ভালোই হয়েছে। দেশেও আছে। তবে কোনো মেয়ে তাকে এতোটা টানে নি যতটা এই মেহরিন নামক মেয়ে টা টানে।
——-
বেলা দশ টা বাজে। আবরাজের বুকে এখনো ফিজা শুয়ে আছে। আবরাজ সামন্য উঁচু হয়ে ফিজার কপালের এক পাশে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। একবার দুইবার অনেকবার। ফিজা ঘুমেই ছিলো। তবে শীতল ঠোঁটের স্পর্শ সে পিটপিট করে চোখ খুলে। আর ঘাড় বাঁকিয়ে আবরাজের দিকে তাকালো। দুর্বল শরীর যে আবরাজ বুঝতে সময় লাগলো না। কেননা আজ ফিজা না সকালে ওঠেছে আর না তাকে ডেকেছে। আবরাজ ওর কপালে চুমু খেলো। আর ফোন হাতে কাউ কে ম্যাসেজ করলো বোধহয়। ফোন রেখে সে ফিজার কপালে আবারও চুমু দেয়। আর মোলায়েম স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
-“শাওয়ার একা নিতে পারবে, জান?”
-“অবশ্যই।”
ফিজা এক ভ্রু কুঁচকে নাক টেনে জবাব দিলো। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরলো। চোয়াল বাঁকা করে হাসলো একবার। এরপর ফিসফিস করে বললো,
-“বাট তোমাকে দেখে দুর্বল মনে হচ্ছে, সুগন্ধি ফুল।”
-“একদম ভুল আপনি। আমি মোটেও দুর্বল নই।”
বলতে বলতে ফিজা আবরাজের বুকের ওপর থেকে সরে আসতে চাইলো। আর সাথে সাথেই লজ্জায় পরে গেলো। রাতে কোথায় যে শাড়ী টা ফেলে ছিলো এই উন্মাদ পুরুষ সেটা ও এখন মনে করতে পারছে বেচারি। তাই কটমট করে আবরাজের দিকে চাইলো। আর বললো,
-“আপনি খুব জঘন্য আবরাজ।”
-“বিয়ের পর থেকেই তো দেখছো। রাতে ও তো দেখে ছিলে। এটা আবার এখন রিপিট করতে হবে কেনো? হোয়াই, সুগন্ধি ফুল? না-কি আবার চাইছো কিছু?”
-“চুপ করুন প্লিজ। আমি আপনার মতো অসভ্য নয়।”
ফিজা রাগ চোখ গরম করে কথাগুলো বলে ওঠে যেতে চাচ্ছিলো তবে আবরাজ ওর হাত ধরে আঁটকে দিলো। এরপর একটু কাত হয়ে ফ্লোরে পরে থাকা নিজের শার্ট টা তুলে আনলো। আর ফিজার শরীরে জড়িয়ে দিলো। ফিজা দ্রুত বাটন গুলো লাগিয়ে নিলো। আবরাজ ওকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানা ছাড়লো। আর ওয়াশরুমের উদ্দেশ্য যেতে যেতে বলে উঠলো,
-“আচ্ছা শাওয়ার নিতে আমি হেল্প করছি।”
-“আবরাজ একদম না।”
ফিজা চোখ বড়ো বড়ো নিয়ে নিষেধ করে দিলো। আবরাজ ওয়াশরুমের ভেতর ততক্ষণে। আর টেনে টেনে বললো,
-“একদম হ্যাঁ জান।”
ফিজা লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আবরাজের গলায় মুখ গুঁজে দিলো। আবরাজ ওকে নিচে নামিয়ে দেয়। আর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,
-“এই শরীরে কোথায় কী আছে সব আমার জানা আছে, সুইটহার্ট।”
ফিজা আর কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে পারে না। লজ্জায় বারবার ওর গলায় সব কথা আঁটকে আসছে। তাই চুপচাপ রইলো।
——-
গ্যারেজে গাড়ি চেক করছে জন। আবরাজ গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের মধ্যমা এবং তর্জনী আঙুলের ফাঁকে সিগারেটের লালচে আগুন পিটপিট করে জ্বলছে। তবে তার ক্ষমতা বিশাল। পিটপিট করে জ্বলতে জ্বলতে ছাই করে দিচ্ছে তিন ইঞ্চি লম্বা সিগারেট টাকেও। আবরাজ যেনো নিজের জীবন চক্রটাই দেখছে। ঠিক এভাবে ওই পাঁচ ফিট দুই ইঞ্চির মেয়ে টাও তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রতিদিন একটু একটু করে। আবরাজের ভাবনার মাঝেই জন আস্তে করে ডাকলো,
-“স্যার!”
-“বলো।”
-“ম্যাম কে বাইরে নেওয়া কতোটা সঠিক সিদ্ধান্ত?”
-“এটা সঠিক নয় জন।”
-“তাহলে?”
জন অবাক হয়ে জানতে চায়। তার স্যার জানে তারপরও কেনো বাইরে নিচ্ছে? আবরাজ জনের মনে থাকা প্রশ্নের উত্তর দিলো। আর সিগারেটে শেষ টান দিয়ে বললো,
-“ওর খুশি সবার আগে।”
-“যদি কিছু হয়ে যায়?”
-“তুমি তো জানো ওদের তাহলে জ্যান্ত জ্বালিয়ে দেবো আমি।”
আবরাজ ডাস্টবিনে সিগারেটের ফিলটার ফেলে দিয়ে বলে। জন দীর্ঘ শ্বাস ছাড়ে। তার যে একটা পরিবার আছে। একজন চমৎকার জীবনসঙ্গী পেয়েছে সে তার পেছনের সবটাই কৃতিত্ব আবরাজ খানের। এই মানুষ টার কিছু হলে সে নিশ্চয়ই সেটা মেনে নিতে পারবে না।
ফিজা কে আসতে দেখে জন চুপ করে গেলো। আবরাজ বউয়ের দিকে তাকিয়ে রইলো। শিফন প্যাস্টেল মাল্টিকালার পিঙ্ক, স্কাই ব্লু, মিন্ট, পীচ মিশ্রণের লং স্কার্ট আর সাদা রঙের শার্ট। হাত ফোল্ড করা। গলায় একটা স্কার্ফ। আবরাজ আস্তে করে ঢোক গিলে। তার পরনে সব সময়ের মতো স্যুট, বুট। আর মাথার চুল গুলো সুন্দর করে জেল দিয়ে সেট করা। চোয়ালে চাপদাড়ির ফাঁকে মাঝে একজোড়া সিগারেটের পোড়া ঠোঁট।
সূর্য আজ মাথার ওপর মনে হচ্ছে। শরীরে চামড়া জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো। ফিজার কাছে মনে হচ্ছে আজকের দিন টা ঘুরাঘুরির জন্য সঠিক নয়। সে মুখে তা স্বীকার করতে চাইছে না। আবরাজের কাছে এসে দাঁড়িয়ে কোমরে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে নিজের ক্লান্তি দূর করতে চায়। আর ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
-“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
-“কোথায় যেতে চাও?”
-“আপনি যেখানে নিবেন।”
আবরাজ জন কে ইশারা করে। জন সাথে সাথে অনেকটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। আবরাজ
-“ওকে প্রথমে টেমস নদী।”
-“তারপর?”
-“সেখানের কফি-শপ।”
আবরাজ ওর চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে জানায়। ফিজা বুকে হাত ভাজ করে দাঁড়ায়। আর আবার জিজ্ঞেস করে,
-“তারপর?”
-“তারপর শপিং অ্যান্ড ডিনার করে বাসায় ফিরবো।”
-“তারপর?”
ফিজা আবারও জিজ্ঞেস করে। আবরাজ ওর কোমরে হাত রাখে। আর নিজের নিকটে নিয়ে আসে। বাঁকা হেসে ফিজার চোয়ালে হাত বুলায়। ফিজা শরীর কাপে। আবরাজ এক ভ্রু কপালে তুলে ঠোঁট কামড়ে জবাব দেয়,
-“রোমাঞ্চ হবে।”
ফিজা আলতো করে ধাক্কা দেয় আবরাজ কে। সে সরে দাঁড়ায় আর ঠোঁট কামড়ে ধরে হাসে। ফিজা বিড়বিড় করে বলে “অসভ্য” তারপর গাড়ির পেছনের সিটে বসে যায়। আবরাজ জন কে ইশারা করে আসতে বলে নিজেও ঘুরে এসে পেছনে ফিজার পাশে বসে পরে।
——-
সাব্বির একটা জরুরি কাজ নিয়ে কথা বলছিলো আব্রাহামের সাথে। তখন তার ফোনে কল আসে। আব্রাহাম বিরক্ত হলে-ও কল রিসিভ করতে বললো। সাব্বিরের মুখে তৎক্ষনাৎ হাসি ফুটে ওঠে। আব্রাহাম ভ্রু কপালে তুলে ওর দিকে চায়। সাব্বির বোকাবোকা হেঁসে বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে। আব্রাহাম জানে সাব্বিরের পরিবার নেই। বিয়ে হয়েছে বেশিদিন হয় নি। তার ভাই বিয়ে দিছে সাব্বিরের। এর বেশি কিছু তার জানার আগ্রহ নেই। তবে এখন হঠাৎ করে হচ্ছে। সাব্বির ফিরে এলো হাসি-হাসি মুখে। মনে হচ্ছে বেশ খুশি বউয়ের সাথে কথা বলে। সাব্বির চেয়ারে বসে ফাইলে আবারও মনোযোগ দিতে যাচ্ছিলো আব্রাহাম তখন গম্ভীর স্বরে ডাকলো,
-“সাব্বির?”
-“জি স্যার!”
সাব্বির চমকে ওঠে উত্তর দিলো। আব্রাহাম কলম টা হাতের আঙুলের ভাঁজে ঘোরাতে ঘোরাতে ঠোঁট কামড়ে ধরে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“তুমি ফাতিমা কে কিভাবে প্রপোজ করেছিলে?”
-“স্যার প্রপোজ করি নি। স্যার আমার বউ রাশিয়ান। ওর বাবা মা কেউ নেই। যখন ওকে লন্ডন থেকে দেশে পাঠানো হলো। পরে আমি আবরাজ স্যার কে বলেছিলাম আমার ওকে ভালো লাগে। আর তারপর স্যার ডিরেক্ট ওকে আমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো।”
সাব্বির কথা গুলো বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে থামলো। আব্রাহাম অবাক হলো। চোখ বড়ো বড়ো করে জিজ্ঞেস করলো,
-“রাজি হয়ে গেলো?”
-“স্যার ও আমার ফ্ল্যাটে আমার সাথে তিনমাস ছিলো। এরমধ্যে আমি ওকে চিনেছি জেনেছি। পরিচিত হয়েছি। দু’জনেই তাই। ও আমাকে পছন্দ করতো।”
সাব্বির মৃদু হেসে জানায়৷ আব্রাহাম চোখ বড়ো বড়ো করে সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে বিস্ময় নিয়ে অবিশ্বাস্য স্বরে বলে উঠলো,
-“তাহলে কী বিয়ের আগে একে-অপরকে চিনে জেনে নিতে হলে এক সাথে ফ্ল্যাটে থাকতে হবে? ও মাই গড।”
সাব্বির প্রথমে ভ্রু কুঁচকে নিলো। তবে পরক্ষণেই তার স্যারের কথার অর্থ বুঝতে পেরে দাঁত দ্বারা জিহ্বা কেটে তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
-“ইয়া আল্লাহ, ছিঃ ছিঃ নাউজুবিল্লাহ। স্যার আমি ওটা বলি নি। আর আমরা এক সাথে ছিলাম কিন্তু আলাদা। তাছাড়া আমি সারাক্ষণ বাইরে থাকতাম। আমি বলতে চাইছি। আপনি যদি বিয়ের আগে মেয়েটার সম্পর্কে একটু ধারণা নিতে চান। তাহলে মেয়েটার টাচে থাকুন।”
-“ওকে ফাইন। মেহরিন সিদ্দিকী। ওকে আমার আশেপাশে রাখার ব্যবস্থা করো।”
আব্রাহাম সহজ স্বাভাবিক ভাবে ব্লেজার ঠিক করতে করতে বলে। সাব্বিরের চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জোগাড়। এতো সময় সে আব্রাহাম কে অবাক করার মতো কিছু কথা বললেও তার স্যার যেনো তাকে কয়েক কদম ছাড়িয়ে গেলো। সাব্বির অবাক হয়ে শুধালো,
-“স্যার বড়ো স্যারের ওই শালিকা?”
-“ইয়াহ ব্রো। ওই ভীতুরানী কে আমার চাই।”
আব্রাহাম ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে। সাব্বির আস্তে করে ঢোক গিলে। শেষমেশ এই ছিলো বেটার মনে! হায় ওই কিউট নাদুসনুদুস মেয়ে টার কপালে বহুত দুঃখ লেখা আছে তাহলে।
#চলবে……
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#জান্নাত_সুলতানা