#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৭
#জান্নাত_সুলতানা
ফিজা আবরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। একদম বাচ্চাদের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাকে সারারাত জ্বালাতন করে এখন কত নিশ্চিন্তেই না ঘুম হচ্ছে। তার কায়াজুড়েও এখনো ব্যাথা। বুক টা বড্ড ভারি লাগে। এই মানুষ টা তার কাছে কী উন্মাদ। বেপরোয়া। তাকে ভালোবাসে। ফিজার লজ্জা এখন দীর্ঘ শ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে। বেডসাইড টেবিলের কর্ণারে ঝুলে থাকা আবরাজের শার্ট নিয়ে গায়ে দেয়। বাটন লাগাতে গিয়ে দাঁত দ্বারা ঠোঁট চেপে ধরে। শরীরে এখনো মানুষ টার চিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। এগুলো প্রায় কালচে। প্রতিবার একই যায়গায় আঘাত কতোটা ব্যাথার হয় এটা সে খুব ভালো করে টের পায়। এলোমেলো চুল বেঁধে ওঠে যেতে চায় সে। আবরাজ ওর হাত পেছন থেকে আচমকাই টেনে ধরে। আর বিছানায় ফেলে দেয় আবারও। ফিজা কিছু টা চমকায়। হকচকিয়ে বলে,
-“সকাল হয়েছে।”
-“আহ।”
আবরাজ ঠোঁট সামন্য ফাঁকা করে আওয়াজ করে। ফিজার শরীর শিরশির করে। কী ভয়ংকর আওয়াজ। ফিজার শরীর জুড়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়। তার শরীর তার মনের বিরুদ্ধে। সে মুখ ঘুরিয়ে এই চিন্তা মাথা থেকে বের করতে চায়। আবরাজ আবারও ওর গলায় মুখ গুঁজে আর ফিসফিস করে বলে,
-“তোমাকে ছাড়তে ইচ্ছে করে না, সুগন্ধি ফুল।”
-“ঢং বাদ দিয়ে আপনার কাজে যান।”
ফিজা আবরাজ কে ছাড়িয়ে নেয় আর ওয়াশরুম যাওয়ার জন্য টাওয়াল নেয়। আবরাজ বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,
-“চলো তোমাকে হেল্প করছি আমি।”
-“আমি পারবো।”
-“আমি জানি।”
বলতে বলতে আবরাজ ওকে পেছন থেকে কোলে তুলে নেয়। আর ওয়াশ রুমে চলে যায়। ফিজা জানে। এখন তাকে আরও একদফা বেসামাল স্পর্শের সম্মুখীন হতে হবে।
-“আপনি কিছু বলেন নি আমাকে আর।”
ফিজা জিজ্ঞেস করে। আবরাজ শাওয়ার চালু করে আর না বোঝার ভান করে উলটে জিজ্ঞেস করে,
-“কী নিয়ে?”
-“আমরা এখান থেকে কবে যাবো? সংসার কবে হবে?”
-“সব হবে।”
আবরাজ আস্তে করে বলে। কণ্ঠে কোনো কিছুর ছোঁয়া নেই। তবে কিছু একটা আছে। শরীর পানি লাগতেই সব ক্ষত জ্বলতে থাকে। ফিজা ঠোঁট কামড়ে ধরে। আবরাজ ওর কোমরে হাত চেপে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে। ওপর থেকে পানি পরে দুজনকেই ভিজিয়ে দিয়ে যায়। রেখা বেয়ে শরীরে প্রতিটি ভাজ ছুঁয়ে যায় সেই পানি। পুরুষালী উষ্ণ, আর্দ্র ছোঁয়া ফিজার ত্বকে লাগতেই তার শরীর কম্পিত হতে থাকে বারবার। ফিজা ফিসফিস করে বলে,
-“আপনি আমায় আর ধোঁকা দিয়েন না আবরাজ।”
আবরাজ ওর ভেজা চুলে ভেজা মুখে চুমু খায় মাথায়। তার অনেক কাজ। হয়তো সে হাঁটতে হাঁটতে সামনে এতোটাই এগিয়ে গিয়েছে যে সে এখন পেছনে ফিরে যাওয়ার রাস্তা টা ভুলে গিয়েছে।
—-
মেহরিন শুক্রবার সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠে। মায়ের হাতে হাতে কাজ করে সাহায্য করে। আজও তাই করছে। কিন্তু বেলা এগারো টা বাজতেই তার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। মায়ের কথা সে বুঝতে একটু ও অসুবিধা হয় না তাকে আজ দেখতে আসবে। কাজের মেয়ে টা ও কিছু বলছে না বেশি।
-“আম্মু আগে একবার বলতে আমায়।”
-“এখন বললাম।”
মেহরিনের মায়ের সাথে এইটুকু কথা। এরপর বিকেলে মানুষ এলো। মেহরিন রুমে গাপটি মেরে বসে রইলো। মোহিতা বেগম আর পাশের বাড়ির একজন আন্টি মিলে পাত্রপক্ষ আপ্যায়ন করে। মেহরিনের খুব পরিচিত মনে হয় বসার ঘরে থেকে আসা কণ্ঠস্বর। তাকে যখন নিয়ে আসা হয় মেহরিন লজ্জায় মাথা তুলেও সামনে দেখে না। অথচ সবাই তার পরিচিত। তার ভয় লাগে আব্রাহাম নামক যুবক কে। সে বিয়ে করবে না তাকে। না-কি কাউকেই নয়? তার মাঝেমধ্যে মনে হয় বিয়ে নিয়ে তার ফোবিয়া আছে। নয়তো কেনো বিয়ে কথা হলে তার ভয় লাগে। আব্রাহাম আসে নি। মেহরিন এতে আরও চিন্তায় পরে। তাহলে কী আব্রাহামের সম্মতিতে হচ্ছে না এসব? কতরকম চিন্তা সবাই বিদায় নিতেই সে চিন্তা করতে থাকে। কিভাবে কী হবে? বোনের সাথে এব্যাপারে পরামর্শ করতে হবে।
——
আবরাজ রেডি হতে হতে সোফায় বসে থাকা ফিজার দিকে তাকায়। সব টা জানার পর মেয়ে টা একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছে। আগে আবরাজ কে রেডি হতে সাহায্য করলেও এখন করতে চায় না। চুপচাপ মনমরা হয়ে বসে থাকে। আবরাজ ইশারায় ডাকে ওকে। ফিজা তপ্ত শ্বাস ফেলে ওঠে আসে। আর আবরাজ ওর হাত নিজের শার্টের বাটনে রাখে। ফিজা কিছু না বলে এক এক করে সেগুলো লাগাতে থাকে। আবরাজ ওর লম্বা চুল কাঁধ থেকে সরিয়ে দেয়। আর গলা থেকে মাফলার সরিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় সেখানে। ফিজা কাপে। পরপরই আবরাজ কয়েকবার ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়। আর চোয়ালের পাশে ও ঠোঁট ছুঁয়ে দেয়।
-“তোমার ফোন কোথায়?”
আচমকাই আবরাজ গায়ে ওয়েস্ট কোট টা পরতে পরতে জিজ্ঞেস করে। ফিজা সেটার বাটন লাগানোর আগেই টাই বাঁধে। আর জানায়,
-“আছে।”
-“কোথায়?”
-“বললাম তো আছে।”
ফিজা যেনো বিরক্ত হচ্ছে। আবরাজ ওর কথায় তেমন প্রতিক্রিয়া দেখায় না। শেষবারের মতো ওর কপালে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে শান্ত স্বরে বলে,
-“ফোন আর ঘড়ি সব সময় সাথে রাখবে।”
ফিজা মাথা নাড়ে। আবরাজ বেরিয়ে আসে। পেছন পেছন ফিজাও আসে। আবরাজ সদর দরজায় দাঁড়িয়ে ও একবার পেছন তাকায়। আর মিষ্টি করে হাসে বউয়ের দিকে তাকিয়ে। চমৎকার একটা হাসি। গালে টোল গুলো স্পষ্ট হয়। এতো সুন্দর করে আবরাজ আগে কখনোই হাসে নি। ফিজা ঠোঁট চেপে নিজের অদ্ভুত অনুভূতি সামলাতে ব্যাস্ত হয়।
—–
ফিজা রুমে এদিক-ওদিক পায়চারি করছিলো। রুমে খাবার দেওয়া হলে-ও সে এই খাবার ছুঁয়ে দেখে নি। তার শুধু মন টা অস্থির অস্থির করছে। তার সেন্টার টেবিলের ওপর থাকা ফোন টা বাজতেই সে ভ্রু কুঁচকে ফোন হাতে নেয়। আর কল রিসিভ করে কানে তুলে।
-“তোমার হাসব্যান্ড আমার সাথে আছে।”
-“কে বলছেন?”
ফিজা ভ্রু কুঁচকে বিরক্ত নিয়ে জিজ্ঞেস করলো। এটা আবার কোত্থেকে উদয় হলো কে জানে। সমস্যার অভাব ছিলো এখন আবার এটা।
-“ইট’স মি, তৃণা। আবরাজের গার্লফ্রেন্ড।”
ফিজার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে যেনো। আবরাজের গার্লফ্রেন্ড আছে? এটা কতটুকু সত্যি? সে কিভাবে বিশ্বাস করবে এটা? সে তো দীর্ঘ দিন থেকেছে এখানে। কখনো তো এমন কিছু চোখে পরে নি। ফিজার মন না চাইতেও তাকে কথা বলতে হলো সেই মেয়ে টার সাথে। যার সাথে তার একটি বার দেখা হয়েছে মাত্র। তাও এদেশে আসার পর একটি পার্টিতে। সে তখন ও মেয়ে টাকে সহ্য হয় নি কেন জানি। অদ্ভুত ভাবে মেয়ে টা বেহায়ার মতো আবরাজের শরীরে ঢলে পড়ে ছিলো। এতে আবরাজ বিরক্ত এবং রেগে গিয়েছিল। সে স্পষ্ট দেখেছে। ফিজার বিশ্বাস না হওয়ার আরও একটি বড়ো কারণ সে আবরাজ কে এখনো বিশ্বাস করে।
-“কিভাবে বিশ্বাস করবো?”
-“কেনো করতে চাইছো না? হোয়াই?”
-“আমি ওনার ওয়াইফ। এবং তিনি আমাকে ভালোবাসে।”
-“সব মিথ্যা।”
-“সব সত্যি।”
-“কোনো প্রুফ আছে? এনি ক্লো?”
তৃণা তাচ্ছিল্য হেঁসে জানতে চায়। ফিজা থতমত খেয়ে যায়। তার মুখ বন্ধ হয়। সত্যি তো। তাকে আবরাজ মিথ্যা বলেছে। আর এটা? এটাও কী মিথ্যা না সত্যি? আবরাজ তাকে ভালোবাসে স্বীকার করেছে। শুধু প্রশ্ন। ফিজার ভাবনার মাঝেই তৃণা ফোনের ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
-“নেই তো। ওকে ফাইন। আমার কাছে আছে। তুমি চাইলে আমি সব দেখাতে পারি।”
-“দরকার নেই।”
-“ওহ কামন সুন্দরী। আবরাজ খান তোমাকে মাত্র ইউজ করছে৷”
-“যা ইচ্ছে করুক।”
ফিজা কাঁপা কাঁপা অধরে শুধালো। তৃণা বোধহয় বিরক্ত আর নিজের কাজে কিছু টা সফল। সে কণ্ঠস্বর নরম করে বলে,
-“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই।”
-“কেনো? আমি চাই না।”
-“আমি তোমার বাড়ির সামনে আছি। একবার দেখা করো।”
অনুরোধ করে তৃণা। ফিজা শক্ত কণ্ঠে জবাব দেয়,
-“সরি।”
-“আমি প্রেগন্যান্ট। প্লিজ।”
ফিজার চোখ অন্ধকার হয়ে এলো৷ নিজে কে সবচেয়ে বেশি বোকা মনে হচ্ছে। হৃদয় ভাঙার শব্দ হলো বোঝা যেতো সে কতোটা শকট এই একটা কথায়। তবুও সে বিশ্বাস করে না। আবার তার মন না চাইতেও খারাপ দিক গুলোই ভাবছে। এইজন্যই কী আবরাজ এতো দ্রুত বাচ্চা নিতে চাই ছিলো না? আকাশ ঘুরছে না-কি তার মাথা? সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সোফায় বসে পরে ধপ করে।
#চলবে…..….
#সুগন্ধি_ফুল_২
#পর্ব_১৮
#জান্নাত_সুলতানা
-“স্যার বাড়িতে কিছু হয়েছে।”
-“তোমার এটা কেনো মনে হচ্ছে?”
-“বাড়ির কোনো গার্ড কল ধরছে না।”
আবরাজের মাথা চক্কর দেয়। তার মাথায় কী চলছে কেউই বুঝতে পারবে না। আবরাজ চেয়ার ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালো। আর জনের কলার ধরে তাকে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। নিজের ফোন টা টেবিল থেকে তুলে নিয়ে দরজার উদ্দেশ্যে হাঁটতে হাঁটতে বলে,
-“অল ওভার।”
চারদিকে কাচের দেয়ালে। সর্বোচ্চ আধুনিকতার ছোঁয়া চারপাশে। আর আবরাজ সেখানেই একটা মিটিং রুমেই ছিলো। ডিল হচ্ছে কয়েকশো কোটি টাকার। তার একটা সাইনে সবকিছু বদলে যেতে পারে। তার সাথে ডিল করার জন্য ছোট ছোট কোম্পানি গুলো সর্বদাই প্রস্তুত। আর মিস্টার জি এই সুযোগ টাই কাজে লাগান। পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন কয়েকগুণ। আবরাজ এতে হস্তক্ষেপ করে না। আবরাজের কথায় মিস্টার জি এর মাথায় ভাজ পরে। তিনি হুংকার করার ব্যাক্তি নয়। গভীর চিন্তাভাবনা করে তিনি সামনে কদম ফেলেন। আর এবার ও তাই হলো। কিছু টা উচ্চস্বরে বলে উঠলেন,
-“আর ইউ ম্যাড আবরাজ?”
এই ডিলটা তাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেননা কিছুদিন পর-ই একটা নিলাম যেটা বছরে একটি বার হয় মাত্র। সেখানে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী একজন কে নিলামে তোলা হবে। আর এটার আজ ডিল হচ্ছে। আর এই আয়োজন মিস্টার জি করে। তবে এখানে নাম আবরাজের থাকে। যদি কোনো আইনী ঝামেলা হয় তখন যেনো মিস্টার জি পর্যন্ত পৌঁছাতে না পারে। আবরাজ এমন একটা যায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যেখানে থেকে সে চাইলেও আর পেছনে যেতে পারবে না। যদি মিস্টার জি এর বিরুদ্ধে যায় তাহলে তিনি তাকে পুলিশে দিবে। আর যদি পুলিশের কাছে সে যায় তবুও কোনো লাভ হবে না। কারণ যতরকম বেআইনি কাজ সব তিনি আবরাজ কে দিয়েই করিয়েছে। খুব সুক্ষ্ম ভাবে গোপনে তিনি আবরাজ কে কাজে লাগিয়ে এখানে এসছে।
আবরাজ ওনার দিকে ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকালেন। যেনো চোখ দিয়ে রক্ত ঝরছে। মিস্টার জি আর কিছু বলেন না।
মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে আগে আবরাজ জনের থেকে থাবা দিয়ে আইপ্যাড টা নিলো। জন কাউকে লাগাতার ফোন করে যাচ্ছিলো। আবরাজের আইপ্যাড স্ক্রিনে তাকিয়ে চোয়াল মটমট করে। সে নিজের রাগ সংবরণ করতে ট্যাব ছুঁড়ে ফেলো দিলো। ওরা যখন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আসে তখন নিচে গার্ড সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে। আবরাজ গাড়িতে বসে জন কে কিছু নির্দেশ দিয়ে নিজের ফোন বের করলো। মেহরিন কল দিচ্ছে তাকে। আগে কখনোই মেয়ে টা তার সাথে সেধে কথা বলে নি। নিশ্চয়ই বোনের খবর না পেয়ে কল দিচ্ছে এখন। তারউপর গতকাল রাতে আব্রাহাম তাকে বিয়ের ব্যাপারে ইনফর্ম করেছে।
আবরাজ কল রিসিভ করে কানে ধরে। কথা বলে ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে। মেহরিন কিছু টা জড়তা নিয়ে বলে,
-“ভাইয়া, আপু কল ধরছে না। কাল শেষ রাত থেকে কল দিচ্ছি।”
বাংলাদেশ শেষ রাত মানে এই দেশে অনেক বেলা। আর এখন এই দে-শে সন্ধ্যায়। আবরাজ ঠোঁট কামড়ে ধরে। না জানি কোথায় এখন তার বউ। কতটা সময় জানোয়ার গুলো ওকে আঁটকে রেখেছে। হাত বেঁধেছে কী? আর মুখ? অজ্ঞান করতে নিশ্চয়ই ড্রাগসের ব্যবহার করেছে। আচ্ছা অজ্ঞান হওয়ার সময় তার সুগন্ধি ফুল তাকে স্মরণ করেছে? তাকে ডেকে ছিলো? ইশ! আবরাজের শরীরের শিরা-উপশিরায় আগুন জ্বলে ওঠে যেনো। রাগে চোয়াল মটমট করে। কপালের সবকয়টি রগ ভেসে ওঠে।
-“ও তো আমার সাথে আছে। ফোন টা মেবি বাড়িতে ফেলে এসছে।”
আবরাজ মিথ্যা বলে। তার এটা মুখ দিয়ে তো বেরিয়েছে তবে কথা টা সত্যি হলে কতোটা নাই ভালো হতো। মেহরিন বোধহয় চিন্তা মুক্ত হয়েছে। বড়ো করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করার শব্দ সেটাই প্রমাণ করে। মেহরিন আরও কিছু বলার আগেই আবরাজ আবার বলে,
-“আমরা বাড়ি ব্যাক করে তোমায় কল করছি৷ ও এখন ঘুমচ্ছে।”
-“ভাইয়া, আম্মু আপনার সাথে কথা বলবে বলেছিলো।”
পাশ থেকে মোহিতা বেগম এর কণ্ঠ শোনা যায়। আবরাজের হাতে সময় খুব সীমিত। সে জানে কী নিয়ে কথা বলতে চাইছে শাশুড়ী। তাই তড়িঘড়ি করে জানায়,
-“আম্মু কে বলো, ভাইয়া সব জানে। আর বিয়ের ডেট ও যেনো ফিক্সড করে নেয়। আমরা খুব আর্লি ব্যাক করবো।”
-“আচ্ছা ভাইয়া।”
মেহরিন বলে। আবরাজ কল কাটে। আর জন পাশ থেকে বলে,
-“স্যার ওরা সেখানেই আছে।”
-“কতক্ষণ টাইম লাগতে পারে?”
-“স্যার জিপিএস অনেক দূর সিগ্ন্যাল দিচ্ছে। টোটাল নাইন টু টেন আওয়ার্স টাইম লাগতে পারে।”
আবরাজ মাথা টা সমানে নিজের দিকে রেখে নাড়াতে থাকে। নিজের ধৈর্য কে সে সাপোর্ট করছে। তাকে ধৈর্য ধরতে হবে। আর কিছু করার নেই। হাত আর্মরেস্টে রেখে পেছনে মাথা এলিয়ে বসে। আর চোখ বন্ধ করতেই তার চোখের সামনে ওই ধনুকের ন্যায় ভ্রু আর কান্নাভেজা মায়াবী চোখ দু’টো সর্বপ্রথম মানসপটে ভেসে ওঠে। আবরাজের মনে পরে তাকে জড়িয়ে ধরে ফিজা আবদার করে ছিলো একটি সংসার। একটি সুখের সংসার। ব্যাস আর কিছু চাহিদা ছিলো না মেয়ে টার। টাকাপয়সা কিংবা বিলাসবহুল জীবন নিয়ে সে কখনো এক্সাইটেড ছিলো না।
—–
বড়ো একটা গোডাউন। ভেতরে লোহার দরজা বন্ধ। চারপাশে লোহার রড, মরিচা ধরা মেশিন, আর হালকা আলোতে ছায়া নড়ছে। মেয়েটার শ্বাস দ্রুত, চোখে ভয় আর অসহায়তা। ম্লান আলোয় বাঁধা অবস্থায় ফ্লোরে পরে আছে ফিজা। তার চোখে ভয়। কৌতূহল। কিছু মনে করার নিখাঁদ চেষ্টা। সে কোথায়? কিভাবে এসছে এখানে? সে বাড়ির গেইটে এসছিলো। রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো তৃণা। তার পেছনের গার্ড হঠাৎ করে পরে যাওয়ার শব্দে সে পেছনে তাকায়। আর তারপর? তারপর? হ্যাঁ তার গলার পাশে একটি ছোট সুইচ ফোটানোর যন্ত্রণা। তার মাথা বড্ড ভারী লাগছে। লন্ডনের ঠান্ডা আবহাওয়া অথচ তার গরমে চোয়াল বেয়ে ঘাম ঝরে গলা বেয়ে নামছে। এলোমেলো চুল টাও বিছিয়ে ফ্লোরে। জুতা একটা আছে আরেকটা নেই। গায়ের পোষাক ঠিকঠাক। স্বস্তি পায় তার সাথে খারাপ কিছু এখনো হয় নি। তবে হতে পারে কিংবা খারাপ হয়ে গেছে আরও ভয়ংকর কিছু অপেক্ষা করছে হয়তো। সে অনুভব করতে চায়। সে কোথায়। কিন্তু কিছুই বুঝে না। তার ফোন টা ছিলো হাতে। ইশ সেটাও এখন নেই। সে এদিক-ওদিক তাকায়। কিছু একটা উপায় খুঁজতে হবে। সে এটুকু বুঝেছে তৃণা তাকে কিডন্যাপ করেছে। তার সাথে আর কে আছে? আবরাজ কী তাকে এইজন্য বারবার সতর্ক করতো? তার দৃষ্টি এদিকে ওদিকে কিছু খোঁজার মধ্যেই কিছু পায়ের শব্দ শোনা গেলো। বড়ো লোহার দরজা খুলে দু’জন প্রবেশ করলো। একজন ছেলে আর একটা মেয়ে। ফিজার খুব সন্নিকটে এসে তার চারদিকে ঘুরে ঘুরে তাকে কটাক্ষ করে দেখে দুজন। কিছু বলাবলি করে তারা। কণ্ঠ শোনা গেলো। তাদের চেহারা ফিজা দেখে না। শুধুমাত্র হাঁটু পর্যন্ত তার চোখ যাচ্ছে। সে মাটিতে পেট ঠেকিয়ে পরে আছে।
-“আজ রাতে তোমার হিসাব মিটে যাবে। আর আমার রাস্তা।”
একটি মেয়ের কণ্ঠে বলে। তারপর ছেলের কণ্ঠে ভেসে আসে,
-“কেউ এসে তোমাকে বাঁচাতে পারবে না। তবে জানো তো, আবরাজ খানের এপ্রিশিয়েট করতেই হয়, সেক্সি গার্ল।”
হঠাৎ করে ছেলে টা হাঁটু গেঁড়ে ওর সামনে বসে বলে। চোয়ালে হাত বুলায়। ফিজা তাকায়। জুনায়েদ কবির। এটাই তো। হ্যাঁ তার সাথে ফিজার পরিচয় হয়েছে। আবরাজ তাকে জুনায়েদ নিয়ে কিছু বলেনি। তবে ফিজা বুঝে ছিলো বেশি সুবিধার নয় জুনায়েদ কবির। দৃষ্টিতে সব সময় নোংরা কিছু ঘুরঘুর করতো।
-“আমি এখানে কত সময় আছি?”
-“টোটাল এইটিন আওয়ার্স। অবাক করা কান্ড কী জানো? তোমাকে ট্উয়েলভ আওয়ার্সের জন্য ড্রাগস দেওয়া হয়েছে। আর তুমি পুরো এইটিন আওয়ার্স ঘুমিয়েছো। এই শরীর নিয়ে আবরাজ খান কে হ্যান্ডেল করো কিভাবে?”
ফিজার দুর্বল দৃষ্টি জ্বলে ওঠে মূহুর্তেই। ঘৃণা ছড়ায় পুরো শরীরে। সে মুখ ঘুরিয়ে নেয় তৎক্ষনাৎ। কিন্তু জুনায়েদ এর পছন্দ হলো না বোধহয়। সে ফিজার মুখের বাঁধন খুলে আর চোয়াল চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলে,
-“এই সুন্দর চোখ গুলো দিয়ে শুধু আমাকে দেখো সেক্সি গার্ল। কজ আজ থেকে আগামী এক মাস তুমি আমাকেই দেখবে শুধু। এরপর তোমাকে এক বিলিয়নিয়ার হতে তুলে দেওয়া হবে তোমাকে। যে তোমাকে তার দাসী বানাবে।”
ফিজার ঘৃণায় পেট মুচড়ায়। বমি গলায় এসে দলাপাকিয়ে যায়। সে মুখ খুলে সর্বশক্তি দিয়ে তার মুখের সব থুতু জুনায়েদের মুখে ছুঁড়ে দেয়। জুনায়েদ তৃণা দুজনেই ফিজা রমণীর সাহস দেখে চোখ বড়ো বড়ো রাগী দৃষ্টিতে তাকায়। কিন্তু পরক্ষণেই তৃণা জুনায়েদের অবস্থা দেখে উচ্চস্বরে হাসতে লাগলো। হাসির শব্দ চারদিকে ঝংকার তুলে। কিছু শব্দ শোনা গেলো ঠাহর করা যায় না কিসের সেটা। জুনায়েদ দাঁত কটমট করে তাকায় তৃণার দিকে তৃণা ব্যঙ্গ করে বলে,
-“ফাইভ মিনিটস। এতেই তোমার এই হাল। আই ডোন্ট নো হাউ টু হ্যান্ডেল দিস গার্,,,
-“জাস্ট শাট আপ। নিজের মুখ বন্ধ রাখো। বাইরে থেকে আসছি আমি।”
জুনায়েদের এই মূহুর্তে তৃণার কথায় রাগ হলে-ও বাইরে শব্দ তাকে দেখতে হচ্ছে। সে যাওয়ার আগেই ফিজার দিকে তাকিয়ে নিজের মুখ থেকে থুতু নিয়ে জিহ্বায় রাখে। ফিজা ঘৃণাভরে দৃষ্টি তাকিয়ে থাকে।
-“স্বাদ ভালো। বেটার অফ ইউ।”
শেষের কথা তৃণা কে বলে। তৃণা হাত মুঠো করে পা আছাড় মারে।
হঠাৎই বাইরে থেকে গাড়ির ব্রেকের শব্দ। সেকেন্ডের মধ্যে দরজা দিয়ে ঢুকে পড়ে অনেকগুলো মানুষ। আর তাদের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে কালো স্যুট বুট পরহিত এক পুরুষ। সে কউ নয়। তৃণা সাথে সাথে নিজে ফিজার দিকে গান পয়েন্ট করে। জুনায়েদ স্বস্তি পায় যেনো। সে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসে। আবরাজের ঠান্ডা চোখ, হাতে বন্দুক। সে কিভাবে এখানে আসতে পারে? এটা অসম্ভব। আবরাজের হাত অনেক লম্বা তবে এখানে আসা কোনো ভাবে সম্ভব নয়। আবরাজ গভীর স্বরে বলে,
-“ওকে ছেড়ে দাও। নাহলে এই গোডাউনেই তোমাদের শেষ শ্বাস গুনতে হবে।”
বেশ শান্ত স্বর। হিমবাহের ন্যায় শীতল কণ্ঠে যেনো হুমকি দিচ্ছে। আবরাজ কানে ব্লুটুথ চাপে। জন কে কিছু ইশারা করে। আর সামনে থেকে হঠাৎ গুলি গিয়ে তৃণার হাতে লাগে। জুনায়েদ কোনো অস্ত্র নেয় নি। কেননা সে কল্পনা ও করতে পারে নি এমন কিছু হবে। এরমধ্যে তৃণার ফোনে কল আসে সে ফোন রিসিভ করে আর কানে তুলে,
-“ভেরি ব্যাড পাপ্পা। এখন কল না দিলেই আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতাম।”
জুনায়েদ এরমধ্যে হোচট খেয়ে বন্দুক তুলতে গেলে মুহূর্তেই গুলি ছুটে যায়। জুনায়েদ ভয়, আতঙ্কে পালাতে চায় কিন্তু আবরাজ তাকে দেয়ালে ঠেসে বন্দুক তার কপালে ঠেকিয়ে ফিসফিস করে,
-“যে মেয়ের দিকে চোখ তুলেছিস, তার রক্ষক আমি। হোয়াট ডু ইউ থিংক আমি তোর এইটুকু ইঁদুরের গর্ত টা খুঁজে পাবো না? ইঁদুর কোথাকার।”
আবরাজের স্বর ভয়ংকর। জুনায়েদ মূহুর্তে ঘেমে ওঠে। জন বাঁধন কেটে দিয়েছে ফিজার। আবরাজ জুনায়েদ কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় ফ্লোরে। আর একটু পেছনে সরে বুকের কাছে টেনে নেয় নিজে বউকে কে। যে তাকে সুগন্ধি দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। নিঃশ্বাস টানে মেয়ে টার শরীর থেকে গন্ধ নেয়৷ তার মন দেহ মূহুর্তে চাঙা হয়ে যায়। শরীর জুড়ে শিহরণ। ফিজার চোখে জল। কিন্তু মুখে ভরসার হাসি। সে একদম খরগোশ ছানা ন্যায় গুটিয়ে থাকে আবরাজের শক্ত-পোক্ত বুকের মধ্যে। নিজে কে লুকাতে চায়। ফিসফিস করে কাঁদে। সে এতো সময় নিজে কে যথেষ্ট শক্ত রেখেছে। কিন্তু এখন সেটা ভীষণ কষ্ট। মেয়ে টা নিজের মধ্যে নেই যেনো। আবরাজ ওর কপালে মাথায় চোয়ালে সমানে ঠোঁট ছুঁয়ে চুমু খেতে থাকে। আর বলে,
-“আই অ্যাম হিয়ার, জান। নাউ ইউ আরে সেইফ। আই অ্যাম অলওয়েজ উইথ ইউ।”
লাগাতার আবরাজ রিপিট করেই গেলো। ফিজা শুনলো। কয়েকবার। এরপর তার চোখ দু’টো বন্ধ হয়ে এলো আবারও। নিশ্চিন্তে নিজের ভালোবাসার মানুষ টার বুকে। ঠিক হৃদপিণ্ডটা বরাবর। যেখানে আবরাজ খানের হৃদপিণ্ডের প্রতিটি স্পন্দন তার নামে হয়।
#চলবে…..
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]
#জান্নাত_সুলতানা