সুতো কাঁটা ঘুড়ি পর্ব-৪+৫ এবং শেষ পর্ব

0
13

#সুতো_কাঁটা_ঘুড়ি
#পর্ব_০৪_০৫ (অন্তিম পর্ব)
#শেখ_সাদিয়া_স্বীকৃতি
________________

মেঘকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়েছে। জ্বর এবং শরীর দুর্বল হওয়ায় কেবিনে স্যালাইন চলছে। জ্বরের ঘোরে ঘুমের মধ্যে প্রতিনিয়ত আবোলতাবোল বলে চলেছে। তড়িঘড়ি করে রুদ্রকে আসতে দেখে তার পথ আঁটকে দাঁড়ায় মিজান আকবর খান। রাগান্বিত স্বরে আঙুল তুলে শাসিয়ে বললেন,

– অনেক খেলেছিস রুদ্র। সব চুপচাপ সহ্য করেছি বলে এই নয় যে তুই পার পেয়ে যাবি। একটা কথা শুনে রাখ, আমার মেয়ের যদি কোনো ক্ষতি হয় আমার অন্য রূপ দেখবি।

রাশেদা ক্ষিপ্ত হয়ে তার ছেলের হাত ধরে বললো,

– চল রুদ্র। আমাদেরও কোনো কাজ নেই এখানে থেকে সময় নষ্ট করার।

দরজার বাইরে থেকে ঘুমন্ত মেঘকে এক নজর দেখে রুদ্র তার মায়ের হাত ধরে তাকে নিয়ে হসপিটালের বাইরে চলে যায়।

*
*
পেপারটা রাশেদার সামনে রেখে রুদ্র প্রশ্ন করলো,

– এমনটা কেন করলে মা? কেন নিজের ছেলের জীবন এভাবে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিলে?

রাশেদার চোখ প্রায় কপালে উঠার অবস্থা। সে বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো,

– তোরা বিয়ে করেছিস!

রুদ্র ক্লান্ত চাহনি মেলে তার মায়ের মুখের দিকে চেয়ে আছে। রাশেদা ছেলের হাত ধরে বললো,

– রুদ্র, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।

– তাহলে কি জানো মা? প্লিজ আমায় বলো! আমরা তিনজন মানুষ একটা ব্লাক হোলের ভেতর ঘূর্ণিপাক খাচ্ছি।

রাশেদা একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নুইয়ে বসলো। অনুতাপে তার মন বিষিয়ে যাচ্ছে।

আমি তোর বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী, সেজন্যে বাড়ির কারো কাছেই আমি ভালো হয়ে উঠতে পারিনি। সুরভি মানে মেঘের মা ছিলো তোর মায়ের ছোটবেলার বান্ধবী। ও সবসময় আমায় অনেক কথা শোনাতো। বাড়ির সকলের প্রিয় বউ হয়ে ওঠে। আমি সহ্য করতে পারতাম না। তাই মেঘ আর মিরাজের প্রতি ক্ষোভ রয়ে যায়। যখন জানতে পারি মেঘের সাথে তোর বিয়ের কথা চলছে তখন আমি মেনে নিতে পারিনি। অনেক অন্যায় অত্যাচার করেছি ওর উপর আমি। তোকে নিয়ে আমি যখন সুইজারল্যান্ড যাই, সেখানে তোর এক্সিডেন্ট হয়। আমি একা তোকে নিয়ে কি করবো কোনো কিছু বুঝে ওঠার অবস্থায় ছিলাম না। তোর বাবাকে কল করেও পাইনি। মন্ত্রীত্ব নিয়ে সে এতটাই ব্যস্ত যে নিজের পরিবারকে সময় দেওয়ারও সময় পায় না। তাই রাগ-ক্ষোভে আমি তোর এক্সিডেন্টের খবর কাউকে জানাই না। অনেক মেজর অপারেশন হয় তোর। ১৭ ঘন্টা পর যখন চোখ তুলে চাইলি তখন তোর অবস্থা অনেকটা সদ্য জন্ম নেওয়া বাচ্চার মতোই ছিলো। না চিনতে পারছিলি আমাকে না নিজেকে। তোকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়েছিলো প্রায়। একে-একে বাড়ির সবার ছবি দেখিয়ে সবাইকে চেনাতে শুরু করি। তখনই হঠাৎ খবর পাই যে মিরাজ রুহিকে খু ন করেছে। তাই আমি তোকে নিয়ে দেশে ফিরে আসি।

– আমি মেঘকে ভালোবাসি। তাহলে হিনা কে?

ছেলের দিকে অপরাধীর মতো চেয়ে বললো,

– হিনার সাথে তোর এয়ারপোর্টে দেখা হয়। হিনার বাবা মহসিন আলী তোর ট্রিটমেন্ট করেছে। আর সেখানেই তোদের প্রথম দেখা। মেয়েটা ওর বাচ্চাসুলভ আচরণেই একদিন জানায় যে ও তোকে ভালোবাসে কিন্তু তুই সবসময় নিজেকে গুটিয়ে রাখতি। এমনিতেই মেঘকে আমি পছন্দ করতাম না। তারমধ্যে একটা খু নি র বোন মন্ত্রীর ছেলের বউ এসব কথা শুনলে লোকে তো হাসাহাসি শুরু করবে। তাই আমি তোর স্মৃতি হারানোর সুযোগটাকেই কাজে লাগাই। তোকে বলি যে তুই আর হিনা একে-অপরকে ভালোবাসিস। আর তোদের কাবিন করিয়ে ফেলি যাতে স্মৃতি ফিরলেও তুই কিছু করতে না পারিস। কিন্তু..কিন্তু আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না যে তোরা আরও আগেই বিয়ে করেছিস!

*
*

– এই যে আপনার সাথে একজন দেখা করতে এসেছে, আসেন।

জেলারের কথা শুনে খুশি হলো মিরাজ। নিশ্চয়ই তার বাবা অথবা বোন তার সাথে দেখা করতে এসেছে। তাই সে তাড়াতাড়ি করে জেলারের পিছু পিছু গেলো। কিন্তু ওয়েটিং রুমে আসতেই তার মুখের সব খুশি গায়েব হয়ে গেলো। তার বদলে দেখা দিলো বিষাদের ছাপ।

– তুই?

রুদ্র সামনে এগিয়ে এসে বললো,

– কেমন আছিস ব্রো?

– তুই এখানে কেন এসেছিস?

– কেন? ভাইকে দেখে খুশি হসনি? আমি তো ভাবলাম তুই আমায় জড়িয়ে ধরবি।

মিরাজ তাচ্ছিল্য করে বললো,

– ভাই? সম্পর্কের পাঠ তুই অনেক আগেই চুকিয়ে ফেলেছিস।

রুদ্র মিরাজের কাঁধে হাত রেখে বললো,

– রুহিকে কেন মারলি? ও তো আমাদের বোন হয়।

– মারিনি আমি রুহিকে! আর কতবার বলবো এ কথা! (চিৎকার করে)

কয়েক মুহুর্ত চুপ থেকে রুদ্র বললো,

– আমি তোর কেইস রি-ওপেন করিয়েছি। যদি তোর কথা সত্যি হয়..যা শাস্তি দিবি মাথা নেবো।

চলে যেতে গিয়ে আবার গেলো সে। পেছনে না ঘুরেই চোখ বন্ধ করে গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

– তোদের সাথে জড়ানো কোনো স্মৃতিই আমার মনে নেই ভাই। যা করেছি অন্যের কথা বিশ্বাস করে করেছি। যা করবো নিজে থেকে করবো। আমায় মাফ করেছিস৷

এই বলে চোখের আড়াল হয়ে যায় রুদ্র। মিরাজ এখনও তার যাওয়ার পথে আছে। একটা কথাই বারবার কানে ঘুরপাক খেতে থাকে।

– তোদের সাথে জড়ানো কোনো স্মৃতিই আমার মনে নেই!

*
*

দিনশেষে ক্লান্ত হয়ে রুদ্র আবারও হসপিটাল এসে পৌঁছায়। এক নজর মেঘকে দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যখনই সে মেঘের কেবিনে আসে সে দেখতে পায় বিস্ময়কর এক দৃশ্য। ঘুমন্ত মেঘের হাতে চলা স্যালাইনে একজন মহিলা সিরিঞ্জ দিয়ে কিছু একটা প্রবেশ করানোর চেষ্টা করছে। তার পোশাক পরিচ্ছদ দেখে মোটেও হসপিটাল স্টাফ বলে মনে হচ্ছে না। রুদ্রের আর বোঝার বাকি রইলো না কি হচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে মহিলাটির হাত ধরে ফেলে।

– বড় মা!

ঝর্ণা বেগম প্রথমে চমকে গেলে পরমুহূর্তে রুদ্রকে ধাক্কা দিয়ে এবার সরাসরি সিরিঞ্জ টা মেঘের হাতে পুশ করতে যায়। তখন রুদ্র পাশে থাকা টুল দিয়ে ঝর্ণার হাতে আঘাত। ব্যথায় সে আর্তনাদ করে উঠলো। ততক্ষণে মেঘ জেগে ওঠে। বাইরে থেকে চিৎকার আর ধস্তাধস্তির শব্দ শুনে বাড়ির সবাইও ভেতরে চলে আসে। শামসুন্নাহার চিন্তিত হয়ে বললেন,

– বড় বউ কি হইছে? তুমি কখন আসলে?

কোনোকিছু না বলে ঝর্ণা পুনরায় মেঘের দিকে এগিয়ে গেলো। এদিকে মেঘ কিছুই বুঝে ওঠতে পারছে না কি হচ্ছে এসব। রুদ্র দ্রুত পায়ে মেঘকে আড়াল করে নিজে ঝর্ণার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। রাশেদাও তড়িঘড়ি করে এসে ঝর্ণার দুই হাত আটকে ধরে বলে,

– পাগল হয়ে গেছো বড় মা! কি করছো তুমি? এটা মেঘ। তুমি ওকে মারতে চাইছো।

– মারতে চাইছি না ওকে মে রে ফেলবো আমি! (চেঁচিয়ে)

ঝর্ণার এমন হিংস্রাত্মক রূপ দেখে সবাই হতবাক হয়ে যায়। মিজান খান বিস্মিত হয়ে বললেন,

– এসব কি বলছেন বড় ভাবী?

ঝর্ণা তার কাছে এসে বললেন,

– হ্যাঁ মিজান, শুধু তোমার মেয়েকে না তোমার ছেলেকেও আমিই জেলে পাঠিয়েছি!

মেঘ যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। শুধু কি মেঘ! বাড়ির সকলের মনে হচ্ছে তারা ভুল শুনছে। শামসুন্নাহার ধমকে বললেন,

– তোমার কি মাথা ঠিক আছে বড় বউ?

উদ্ভ্রান্তের মতো হেসে ঝর্ণা সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

– কেন তোমরা বিশ্বাস করতে চাইছো না বলো তো? আমিই করেছি। (মিজানের দিকে আঙুল তাক করে) কারণ আমি কোনোদিনও চাইনি তোমার ছেলেমেয়ে সুখে থাকুক। আমার সুখ কেড়ে নিয়ে তোমাকে কি করে সুখে থাকতে দেই আমি!

মিজান খান হতবাক হয়ে বললেন,

– আমি আপনার সুখ কেড়ে নিয়েছি!

– সবকিছুর জন্যে তো তুমিই দায়ী। তুমি তো আমার বন্ধু ছিলে! তাহলে তোমার মন সুরভিকে কিভাবে চাইতে পারে? আমায় কেন নয়? আচ্ছা মানলাম। তোমার ভাই! আমায় বিয়ে করলো কিন্তু সেখানেও বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় এই মহিলা। (রাশেদাকে দেখিয়ে) একদিকে তুমি সুরভিকে নিয়ে আমার সামনে সুখের সংসার করছো। আর অন্যদিকে এই মহিলা আমার সংসারটাও ভেঙে দিলো। তাই আমি পণ করে নিয়েছি, আমি যখন সুখ পাইনি তোমরাও পাবে না।

অতঃপর বিশ্রীভাবে হেসে মিজানকে বললো,

– সুরভি বাচ্চা জন্ম দিতে যেয়ে মরেনি। আমি আমি মেরেছি। ও-ই তো মূল! বেচারি আমার কষ্টের কথা ভেবে রাশেদাকে কত কথা শোনাতো! সেই সুযোগটা কাজে লাগাই। রাশেদার মনে ওর মেয়ের জন্য ঘৃণার বীজ পুঁতে সেখানে নিয়ম করে রোজ পানি ঢালতে শুরু করি। কিন্তু পরে যখন আমার পোঁতা চারাগাছ বড় হয়ে ডালপালা ছড়িয়ে আমার উপরেই ভেঙে পড়তে চাইলো তখন আমি এই..এই মেঘকে খু ন করার সিদ্ধান্ত নেই। সব প্ল্যান ঠিকঠাক চলছিলো। কিন্তু মাঝপথে! (কান্না করে) মাঝপথে মেঘের জায়গায় প্রাণ গেলো আমার মেয়ের! আমার ফুলের মতো মেয়েটা..!! আমার রুহি..

হাঁটু গেড়ে ধপ করে মেঝেতে বসে দুইহাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। ঝর্ণার আহাজারিতে ভারী হয়ে গেলো বাতাস। অনুভূতিশূন্য মেঘ বিছানা ছেড়ে ঝর্ণার সামনে এসে দাঁড়ায়। যেই মানুষটা তাকে আদর স্নেহে বড় করলো সে-ই তার জীবনের চরম ক্ষতিটা করেছে! এমনি এখনও করছে। যাকে আপন ভেবে মনের সমস্ত গোপন কথা, দুঃখ, দুর্বলতা জানিয়েছে সে-ই তার দুর্বলতার একের পর এক সুযোগ নিয়ে গেছে। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নিলে রুদ্র তড়িঘড়ি করে তাকে ধরে ফেললো। তা দেখে ঝর্ণা কান্না বন্ধ করে আবারও পাগলের মতো হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে টালমাটাল পায়ে ওদের কাছে এসে বললো,

– মেয়েকে হারিয়ে সুখে থাকতে দেবো ভেবেছিলি? আমি আমার মেয়ের মুখে শেষবারের মতো মা ডাকটাও শুনতে পারিনি। রুদ্র..রুদ্র দেখে ফেলেছিলো আমায়। তাই আমি ওকে উপরে পাঠানোর ব্যবস্থা করি। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য দেখ! স্মৃতি হারিয়ে এখনো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

একের পর এক বিস্ময়কর ধাক্কা। মেঘের পায়ের তলা থেকে এবার যেন মাটি-ই সরে গেলো। রাশেদা বাদে বাড়ির কেউই এই বিষয়ে জানতো না। ঝর্ণার দুই বাহু ধরে বললো,

– কি করেছো তুমি? হা?

– আরও করেছি! আমার মেয়েটাকে আমি যত্ন করে তোর ভাইয়ের ঘরে রেখে আসি। আর তারপর আমিই ওকে পুলিশে ধরিয়ে দিয়েছি। নাহ্, তোর রুদ্রকে করিয়েছি। তোদের দুই ভাইবোনকে আমি বাঁচিয়ে রেখেও মৃত করে রেখেছি। সন্তানদের নরক যন্ত্রণায় মিজানের ছটফটানি দেখে আমার মনকে শান্তি দিতে। হা হা হা!

এমন পর্যায়ে হঠাৎ রুদ্রের মুখ দিয়ে র ক্ত বেরিয়ে আসে। আঁতকে ওঠে মেঘ।

– রুদ্র কি হয়েছে তোমার?

– বিষ দিয়েছি বিষ। ঐ ইনজেকশনে বিষ ছিলো। তোকে মা রা র জন্য এনেছিলাম। তোর ভালোবাসার শরীরে দিয়ে দিয়েছি।

যা শুনে মেঘ ক্ষিপ্ত হয়ে ঝর্ণার হাত চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,

– আমি তোমায় শেষ করে ফেলবো!

কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই গরগর করে র ক্ত বমি করে রুদ্র পুরো ফ্লোর ভাসিয়ে দেয়। ছেলের এই অবস্থা দেখে রাশেদার মরিমরি অবস্থা। মিজান খান হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে দৌড়ে ডাক্তার ডাকতে চলে যান। সেই সুযোগে ঝর্ণা বেগম এক ধাক্কায় মেঘকে ছিটকে ফেলে চারতলার জানালা থেকে নিচে ঝাপ দিলেন।

*
*
অপারেশন থিয়েটারের দরজায় লাল বাতিটা এখনো টিমটিম করে জ্বলছে। খান ভিলার সকলে দুশ্চিন্তায় করিডোরের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে। একটু পরই হন্তদন্ত হয়ে বেশ কয়েকজন দেহরক্ষী নিয়ে প্রবেশ করেন মন্ত্রী রমজান মোস্তফা খান। দেশের সুনামধন্য মন্ত্রীকে এরূপ হম্বিতম্বি হয়ে হসপিটালে আসতে দেখে বাইরে-ভেতরে প্রায় ভীর জমে গেছে। লোক মারফত খবর খেয়ে ইতোমধ্যে কয়েকজন সাংবাদিকও চলে এসেছে হসপিটালের বাইরে। কে জানে তারা কি খবর রটাচ্ছে!

চোখের সামনে আদরের নাতির এতবড় দুর্ঘটনা সহ্য করতে পারেনি বৃদ্ধা শামসুন্নাহার। কেবিনে শিফট করে রাখা হয়েছে তাকে। পাথর প্রায় স্ত্রীয়ের নিকট এসে রমজান আস্থা দিয়ে বললেন,

– সব ঠিক হয়ে যাবে রাশেদা। আল্লাহকে ডাকো!

রাশেদা কোনো জবাব দিলো না। ওদিকে হিনা তার মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কেঁদেকেটে বিলাপ করছে আর বারবার বলছে,

– মম, রুদ্র! ঠিক হয়ে যাবো তো? ওর কিছু হবে না তো মম্?

তানিয়া তার পাগলপ্রায় মেয়েকে সামলানোর বৃথা করছে।

– শান্ত হ হিনা। সব ঠিক হয়ে যাবে। কিচ্ছু হবে না রুদ্রের। তোর বাবা আছে তো ভেতরে!

প্রায় আধা ঘণ্টা পর ওটি থেকে ডক্টর মহসিন আলী আর একজন তরুণ বয়সী ডাক্তার বেরিয়ে আসেন। সবাই তার কাছে এগিয়ে যায়। রমজান খান অস্থির চিত্তে বললেন,

– আমার ছেলের কেমন আছে ডক্টর?

– বিষ টা অনেক বিষাক্ত ছিলো তবে পেশেন্ট সুস্থ আছে। জ্ঞান ফিরলেই আমরা তাকে কেবিনে শিফট করবো।

রমজান খান আবার বললেন,

– জ্ঞান কখন ফিরবে?

– পাঁচ/ছয় ঘন্টা..!!


দরজার বাইরে স্বচ্ছ কাচের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রুদ্রকে দেখছে মেঘ। এখনও জ্ঞান ফেরেনি।

– আমার জন্য তোমাকে কত ধকল পোহাতে হচ্ছে! কোনো না কোনোভাবে সবকিছুর জন্য আমি-ই দায়ী৷ অথচ আমি তোমায় কাঠগড়ায় দাড় করিয়েছিলাম। তুমি তো এই খেলার সবচেয়ে বড় ভিকটিম। সবার চোখে চোখ রাখতে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। মন চাইছে এখুনি ছুটে পালিয়ে যাই।

এমন সময় মেঘের মোবাইল কেঁপে বেজে ওঠে। আননোন নাম্বার দেখে সে রিসিভ না করেই দেখে দেয়। কিছুক্ষণ পরে আবারও সেই একই নাম্বার থেকে কল আসায় মেঘ বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলো,

– হ্যালো কে?

– ম্যাম, আমি মেডিক্যালের বাইরে-ই আছি। আপনি একটু তাড়াতাড়ি এসে আপনার পার্সেল নিয়ে যান। আমার আরও অনেক জায়গায় যেতে হবে।

– পার্সেল? আপনার ভুল হচ্ছে। আমি কিছু অর্ডার করিনি।

– আপনার মিস মেঘ আরবি খান?

– হ্যাঁ..(অবাক হয়ে)

– এখানে আপনার নাম-ই লেখা আছে ম্যাম। এরজন্যেই তো আমি আপনার ফোন নাম্বার পেলাম। প্লিজ একটু তাড়াতাড়ি আসুন।

মেঘকে কিছু বলাবার সুযোগ না দিয়েই ডেলিভারি বয় কল কেটে দিলো। কতক্ষণ ভেবে সে ঠিক করে একবার যেয়েই দেখা যাক। নিচে আসতেই দেখতে ডেলিভারি বয়কে ওয়েটিং রুমে বসে থাকতে দেখতে পেলো। মেঘ সন্দেহের চোখে তাকে কিছুক্ষণ পরখ করে তার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,

– আমি মেঘ।

ডেলিভারি বয় হাসিমুখে একটা ছোট ছাই রঙের র্যাপিং পেপারে মোড়ানো পার্সেল তার দিয়ে বললো,

– ম্যাম, এখানে আপনার সিগনেচার লাগবে।

– কিন্তু..

– একটু তাড়াতাড়ি করুন প্লিজ!

কথামতো সিগনেচার করে দিতেই লোকটি দ্রুত সেই জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে। মেঘ হতবুদ্ধি হয়ে একবার তার চলে আরেকবার হাতের পার্সেল এর উপর চেয়ে রইলো। লোকটি দৃষ্টির আড়ালে চলে গেলে সে পার্সেল টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখতে লাগলো। পার্সেলের গায়ে থাকা কাগজে প্রেরকের পাশে মার্কার পেন দিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষী লেখা রয়েছে। মেঘ কপাল কুঁচকে কাগজ ছিড়ে পার্সেল খুলে দেখতে পেলো একটা এয়ার টিকেট আর চিরকুট। টিকেট টা দেখে মেঘ আরও বেশি অবাক হয়ে গেলো৷ কেননা তাতে আজকের তারিখ লেখা। কালবিলম্ব না করে চিরকুটটা খুলে পড়তে শুরু করে,

– ” Don’t be afraid to start all over again, you may like your new story better.. (লেখাটা সংগৃহীত)

your well-wisher”


জ্ঞানহীন রুদ্রের মাথায় হাত বুলাতে গিয়ে কপাল কুঁচকে তাকায় মেঘ। ভালো লক্ষ করে বললো,

– ভালোই হয়েছে। স্মৃতির সাথে দাগগুলিও মুছে গিয়েছে।

এলেমেলো হয়ে কেবিনের বাইরে বসে আছে হিনা। অতি সন্তর্পণে মেঘ তার পাশে এসে বসে। জড়ডা ভেঙে হিনা বললো,

– আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাদের জীবনে তৃতীয় নারী। কিন্তু সেজন তো আমি!

ঈষৎ হাসলো মেঘ।

– জীবন সবাইকে দ্বিতীয় সুযোগ দেয় না হিনা। আর যদি কেউ সুযোগ পায় তাহলে তোমার উচিৎ তার সঠিক মূল্যায়ন করা।

এই বলে সে বাইরে পা বাড়ায়। হিনা তখন দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করলো,

– কোথায় যাচ্ছে?

প্রতিত্তোরে মেঘ পেছন ফিরে মুচকি আবারও পা বাড়ায় সামনে।

*
*

“রুদ্র,
কখনো কখনো জীবন এমন একটা মোড়ে এনে দাঁড় করায়, যখন আমরা যাকে ভালো না বেসে থাকতেই পারি না তাকে ভালো না বেসে থাকতে হয়। যাকে কখনো ছেড়ে যাওয়ার কথা

আমি তোমায় ভালোবাসি এতে কোনো সন্দেহ নেই। ঠিক তেমনি তুমি আর কোনোভাবেই আমার নেই এই সত্যিটা মেনে নেওয়া কঠিন। তার চাইতেও বেশি কঠিন তোমার হাতে হাত রেখে একসাথে পথ চলা। নাহ্ দোষ নেই তোমার, কিন্তু মানুষটা তো তুমিই ছিলে! এই সাত মাসে তুমি আমায় যেই অমানবিক কষ্ট দিয়েছো তার কাছে তোমার দীর্ঘ আট বছরে দেওয়া ভালোবাসা হার স্বীকার করেছে। ভাগ্যিস তোমার কিছু মনে নেই নইলে অনুতাপে তুমি শেষ হয়ে যেতে।

মাফ করে থাকা যায়, মনের গহীনে পীড়া দেওয়া ক্ষতের কষ্ট কি এত সহজে নিরাময় হয়। ভালোবাসার গায়ে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। আমি ক্লান্ত, আমি পরিশ্রান্ত।

আমার জন্যে হিনাকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তুমি ভুলের বোঝা আর ভারী করো না৷ অন্তত তার ভালোবাসার মান রেখো!

আমার সমস্ত পিছুটান আজ আমার হাত ছেড়েছে৷ আমি মেনে নিলাম আমার তুমি #সুতো_কাঁটা_ঘুড়ি-র মতো হারিয়ে গেছো দূর অজানায়। যার নাগাল পাওয়ার সাধ্য নেই আমার। স্মৃতিটুকুই না-হয় আমার একাকিত্বের সঙ্গি হলো। অতীতের খোঁজ করো না রুদ্র। সেখানে শুধু আগুন আর নিকষ কালো ধোঁয়া। একবার সেখানে গেলে তুমি আর ফেরত আসতে পারবে না। কারণ তোমার অতীত আমি। সেই অতীত থেকে বেরিয়ে আসার চাবিকাঠিও আমি আর আমি হারিয়ে গেছি। রূপকথায়..!!

ইতি মেঘ “🍁

খামের ভেতর থাকা আরেকটা কাগজ বের করে আনলো হিনা। কাগজ নয় ডিভোর্স পেপার। যেখানে কাঁচা কালিতে লেখা মেঘের সিগনেচার থেকে এখনও গন্ধ নাকে আসছে। আপনা-আপনি তার বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো গভীর দীর্ঘশ্বাস। বুঝতে পারলো তখন মেঘের বলা কথাগুলোর মানে।

– আমি বড্ড স্বার্থপর হয়ে গেলাম। তুমি কি ভালো থাকতে পারবে মেঘ!

মিজান খান অস্থির হয়ে বললেন,

– কি হলো রুদ্র হলো? কি লেখা আছে ওতে? আমার মেয়ে আছে তো?

রুদ্র এখনও স্থির হয়ে বসে আছে। বাড়ির সকলের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। উত্তর না দেওয়ায় মিজান রেগে চিৎকার করে বললেন,

– আরে বলছিস না কেন আমার মেয়ে কোথায়?

– চলে গেছে।

হিনার দুই শব্দে বলা ছোট্ট প্রতিত্তোরের ভারে মিজান আকবর খান টাল সামলাতে না পেরে ধপ করে নিচে বসে পড়লেন।


সময়ের ঢেউয়ে পাল্টে যায় সবকিছু, বদলে যায় মানুষ। বদলায় না শুধু দৃঢ় অনুভূতি। দিন পেরিয়ে মাস, মাস পেরিয়ে আজ এক বছর হতে চললো। সেদিনের পর থেকে ঝর্ণা বেগম কোমায় রয়েছে। মিরাজকেও বেকসুর খালাস করা হয়েছে।

হিনা ছাড়তে পারেনি রুদ্রের হাত। প্রতিনিয়ত অপরাধবোধের কুঁকড়ে থাকা রুদ্রকে এনে দিয়েছে বাঁচার নতুন উপায়। তাদের রুদ্রের স্মৃতি চিরতরেই নষ্ট হয়ে গেছে তবুও মাঝেমধ্যে মেঘের কথা ভেবে সে আত্মগ্লানিতে ভোগে। তখন আবার হিনা তার ভালোবাসা দিয়ে আগলে নেয়। অন্ধকার অমানিশা থেকে বাচঁতে রুদ্রও আঁকড়ে ধরেছে হিনার হাত।

খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে জীবনের হিসেব-নিকেশের খাতায় মশগুল রুদ্রকে পেছন জড়িয়ে ধরে হিনা বললো,

– আজ আমি তোমাকে খুশী রাখার পার্মানেন্ট উপায় পেয়ে গেছি রুদ্র।

পেছন ফিরে হিনার হাতদুটো নিজের হাতে নিয়ে আলতো চুমু খেয়ে রুদ্র বললো,

– তুমিই তো আমার সুখ।

– তবে এটা আমাদের দু’জনের পার্মানেন্ট সুখ।

– সেটা কি!?

হিনা পেছন থেকে প্রেগ্ন্যাসি কীট বের করে রুদ্রের হাতে দিলো। রুদ্রের চোখ খুশিতে টলমল করে ওঠলো। শক্ত করে হিনাকে নিজের বুকে জড়িয়ে বললো,

– থ্যাংক ইউ সো মাচ্ হিনা! থ্যাংক ইউ সো মাচ্

🌸

ওদিকে সুইজারল্যান্ডে এখন কনকনে শীত। সেই সাথে নানান ফুলে সেজে ওঠেছে এর মনোরম প্রকৃতি। ঝড়ে পড়া গাছের পাতার উপর একা একা আনমনে হাঁটছে মেঘ। সেদিনের ঐ টিকিট টা তাকে কে দিয়েছিলো সে তা আজও জানতে পারেনি। কিন্তু তার কাছে সে সত্যিই কৃতজ্ঞ। এখানে এসে প্রথমে নতুন করে নিজের ভিসা প্রসেসিং করে একটা রেস্টুরেন্টে কাজ নিয়েছে। পাশাপাশি পড়াশোনাও চালিয়ে যাচ্ছে। ভালোই চলছে তার দিনকাল।

আচমকা কোথা থেকে একটা কুকুরছানা এসে ঘেউঘেউ করে ডাকতে শুরু করে। কুকুরের প্রতি মেঘের বরাবরই ভয়। তাই সে চিৎকার দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। আর স্বভাবসুলভ কুকুরছানাটাও তার পেছন পেছন দৌড় লাগায়। রাস্তায় দাড় করানো গাড়ি থেকে একটা স্থানীয় বেরিয়ে নিজের ভাষায় চিৎকার করে ডাকতে থাকে,

– কি করছো! থামো থামো দৌড়িও না! দৌড়ালে ভয় পেয়ে তোমায় কামড় দেবে!!

মেঘ একটা গাছের পেছনে গিয়ে ভয়ার্ত গলায় বললো,

– আরে আপনার কুকুর কোথায় ভয় পাচ্ছে? ভয় পাচ্ছি আমি! এটাকে সরান….আআআ

মোটাসোটা একটা গাছকে কে কেন্দ্র করে চিৎকার করতে করতে মেঘ ঘুরছে আর তার পেছন পেছন কুকুর। ফরেনার সেই লোকটি দ্রুত তাদের কাছে চলে আসে। তাদের এভাবে গাছের চারদিক দিয়ে ঘুরতে দেখে সে কি করবে কুল কিনারা পাচ্ছে না। তখনই মেঘ জোরে চিৎকার করে ওঠে। যা হওয়ার তাই হলো! কামড় বসিয়েছে তার পায়ে। তার চিৎকার শুনে গাড়ি থেকে আরেকজন লোক বেরিয়ে জোরে সেই ফরেনার লোকটিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

– বেক্! একটা কুকুর সামলাতে পারো না তাহলে পারো টা কি!

লোকটি দৌড়ে তাদের কাছে চলে আসে। বেক্ তাড়াতাড়ি কুকুরটাকে কোলে তুলে বললো,

– সরি স্যার, প্যান্থার কোনদিক দিয়ে বের হয়েছে আমি খেয়াল করিনি।

– আহ্ আমার পা!

মেঘ নিচে বসে কান্না করছে। পায়ের মোজা ভেদ করে তরল র ক্ত বেরুচ্ছে। যা দেখে সে ব্যথার চাইতে ভয়টাই বেশি পাচ্ছে। লোকটি তারসামনে হাঁটু গেড়ে বসে নরম স্বরে বললো,

– কাম ডাউন মিস! ডোন্ট বি প্যানিক। লেট মি চেক!

তারপর আলগোছে মেঘের পা থেকে জুতো-মোজা খুলে ফেলে। অনেক গভীর ভাবে দাঁত বসে গেছে গোড়ালির ওপর। নিজের কোলের উপরে পা রেখে সে তার সাথে করে নিয়ে আসা ফাস্টএইড বক্স খুলে এন্টিসেপ্টিক নিয়ে মেঘের কেটে যাওয়া অংশে রাখতেই মেঘ ব্যথায় ককিয়ে উঠে। পা ওয়াশ করে দেওয়ার ফাঁকে মেঘকে ভরসা দিতে লোকটি বললো,

– আপনার কোনো ক্ষতি হবে। প্যান্থার ভেক্সিনেটেড। তারপরও একটু মেডিক্যাল ট্রিটমেন্টের দরকার আছে। এটা হয়ে গেলেই আমি আপনাকে নিয়ে যাবো। বেক্ গাড়ি নিয়ে এসো।

– ইয়েস স্যার।

মেঘ এতক্ষণ ভয়ে অন্যদিকে চেয়ে ছিলো। লোকটির কথা শুনে সে মানা করতে তার দিকে তাকাতেই থমকে গেলো মেঘ। নিজের চোখের ভুল ভেবে মৃদু মাথা ঝাকিয়ে আবার সামনে থাকায়। সুঠাম দেহির, চওড়া কাঁধ বিশিষ্ট ফর্সা বর্ণের লোকটি নিজের চোখ ঢেকে রাখা চুলগুলোকে একটা হেয়ার ব্যান্ড দিয়ে আঁটকে রেখেছে। ভুল দেখছে না সে। তাড়াতাড়ি লোকটির থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো মেঘ। মেঘের এমন ব্যবহারে লোকটা অবাক হয়ে বললো,

– আরে কি হলো? এমন করছেন কেন?

ততক্ষণে বেক্ গাড়ি নিয়ে চলে আসে। তা দেখে লোকটা মেঘের দিকে হাত ধরে বললো,

– হসপিটালে যেতে হবে। লেটস্ গো!

মেঘ এক ধাক্কায় লোকটাকে নিজের দূরে সরিয়ে দিয়ে চিৎকার করে বললো,

– তুমি আমার পিছু কেন নিয়েছো! কেন এসেছো!

মেঘের এমন আচরণ লোকটার ইগোতে লাগলো যেন। বেক্ তা দেখে মেঘকে বললো,

– স্যার আপনার পিছু নিতে যাবে কেন? বরং আপনি জানেন স্যার কে?

লোকটা বেক্ কে থামিয়ে বললো,

– স্টপ বেক্। অ্যা নৌন ম্যাম নীডস্ নো রিকমেন্ডেশন।

তারপর মেঘের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,

– হাই আ’ম ! জেইন আদম।

মেঘ যেন আকাশ থেকে পড়লো। জ্যাকেট থেকে তড়িঘড়ি করে ফোন বের সেই কাজটাই করলো যা সে এই এক বছরে কোনোদিনও করেনি। ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত নারী স্বর ভেসে আসতেই মেঘ সঙ্গে সঙ্গে বললো,

– হিনা! আমি মেঘ। ভিডিও কল দিচ্ছি রিসিভ করো!

এতদিন পরে অচেনা মেঘের কল পেয়ে হিনা যতটাই না খুশি হয় তারচেয়েও ঢেরবেশি অবাক হলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মেঘের ভিডিও কল আসলে হিনা লক্ষ্য করে মেঘকে কেমন যেন অস্থির দেখাচ্ছে। হিনার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে।

– তুমি কোথায় আছো মেঘ? জানো আমরা তোমায় কতটা খুঁজেছি? চাচার কি অবস্থা হয়েছিলো আর..

মেঘ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

– হিনা সেসব পরে কথা হবে। আগে বলো রুদ্র কোথায়?

মেঘের প্রশ্নে হিনা কি মনে করলো কে জানে। কিছু বলছে না দেখে মেঘ আবারও তাড়া দিয়ে বললো,

– হিনা রুদ্র কোথায়?

– কিচেনে..

– তুমি শিউর?

– হ্যাঁ..!! এইতো রুদ্র

এই বলে হিনা ব্যাক ক্যামেরা অন করে রুদ্রের দিকে ঘোরায়। একটা ট্রে হাতে রুদ্র দাঁড়িয়ে আছে। স্ক্রিনে রুদ্রকে দেখে মেঘের হাত ফসকে ফোন রাস্তায় পড়ে গেলো। বিস্মিত হয়ে দেখে জেইনকে, যে নিজেও তার দিকেই চেয়ে আছে।

– হেই মিস, আর ইউ ওকে?

সন্ধ্যা তখনো নামেনি তার আগেই আকাশ চিড়ে ঝড়তে শুরু করে পেঁজা তুলোর মতোন তুষার। কতক বরফ মাথায় পড়লে জেইন হাত দিয়ে ঝেড়ে চুলগুলো মাথার পেছনে সরিয়ে নেয় আর তা দেখে মেঘ অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলো। টলমলে পায়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক পা দূরে।

– চেহারা মিলে যয..যাওয়া নাহয় কয়েন্সিডেন্স ক..কিন্তু কাঁটা দাগ! এটা মিলে যাওয়াটাও কি কয়েন্সিডেন্স!

নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে আরেক দফা চমকায় মেঘ।

– হসপিটালে রুদ্রের কপালে আমি এই দাগ দেখিনি!

দু’জনের মাঝের দূরত্ব কমিয়ে জেইন একদম মেঘের সন্নিকটে এসে দাঁড়ায়। ততটা কাছে যতটা কাছে থাকলে দু’জন দুইজনের নিঃশ্বাস অনুভব করতে পারে। দু’জনই দু’জনকে দেখছে। একজনের চোখে বিস্ময় ঘেরা প্রশ্ন তো আরেকজনের চোখে রহস্য। অপলকভাবে তাকিয়ে শ্লথ স্বরে পুরাদস্তুর বাংলা ভাষায় জেইন প্রশ্ন করে,

– কি দেখছো এমন করে? (একটু থেমে) শ্যামলতা..!!

মেঘের প্রায় দম আঁটকে আসার জোগাড়। কথা রা সব গলায় দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। জেইনের চোখের দিকে চেয়ে মেঘ মনেমনে বললো,

– যদি রুদ্র ওখানে থাকে তাহলে ও কে! ও রুদ্র হলে হিনার সাথে যে রয়েছে সে কে! এটাও কি বড় মায়ের কোনো ষড়যন্ত্র। রুদ্র-ই বা কেন বাংলাদেশে না ফিরে এখানে আছে!? নাকি ষড়যন্ত্রকারী রুদ্র নিজেও! ভিন্ন দেশে চেনা চেহারায় অচেনা এই মানুষ কি আমার আপন নাকি ষড়যন্ত্র..!!

______________________সমাপ্তি____________________