সুপ্ত প্রেমের অনুরাগে পর্ব-১১

0
14

#সুপ্ত_প্রেমের_অনুরাগে🕊️
#পর্ব:এগারো
#তামান্না_ইসলাম_কথা

শহরের সকালটা আজ বড্ড অলস ঠেকছে। জানালার কাচে সূর্যের নরম আলো থমকে আছে, কফির গন্ধ হালকা বাতাসে মিশে এক ধরনের ঘোর তৈরি করছে ঘরের ভেতর। দূরে কোথাও গাড়ির হালকা হর্ন, পাখির একটানা ডাক সব মিলিয়ে শহরটা যেন নিজের গতি কিছুক্ষণ থামিয়ে দিয়েছে।

আমি তখনও জেগে উঠিনি পুরোপুরি ভাবে। বড্ড অনিহা ঠেকছে উঠে যেতে। আদভিনের বুকের ওপর মাথা রেখে চুপচাপ শুয়ে আছি। এতো সুন্দর জায়গা রেখে কি উঠতে ইচ্ছে করে? উহু! একটুও না। আদভিনের ধীরে ওঠানামা করা বুক তার নিঃশ্বাসের ছন্দ গুনে দেয়। আমি তখনও চোখ বন্ধ করে রেখেছে, কিন্তু আমার প্রতিটি ইন্দ্রিয় জেগে আদভিনের উষ্ণতা, তার ত্বকের গন্ধ, এমনকি হৃদস্পন্দনের মৃদু আওয়াজও যেন এই সকালে একমাত্র সঙ্গীত।
আদভিন ঘুমাচ্ছে, এক হাত আমার পিঠে জড়ানো। সেই স্পর্শে আমার মনে হয়, সারা শহরটাই যেন এখন আমার জন্য থেমে আছে, শুধু এই মুহূর্ত, এই আশ্রয়টুকু চিরন্তন হয়ে থাকুক।
অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি নিঃশব্দে বলে ওঠে বসলাম। একবার ঘুম জড়ানো চোখে আমার একান্ত মানুষকে দেখে নিলাম।

“এমন সকালেই তো মানুষ নিজের জীবনের মানে খুঁজে পায়, তাই না?”

আদভিনের কপালে চুমু দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে রইলাম। আদভিনের নিষ্পাপ ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম কিছু সময়। হুট করেই যেন মানুষটার প্রতি আমার ভালোবাসা বেড়ে গিয়েছে। সে-ই সাথে কথা বারবার গতরাতের কথা মনে হতেই লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছি। আমার কথার জবাবের অপেক্ষায় রইলাম কিন্তু আদভিন জবাব দেয় না। কিন্তু তার হালকা একটা শ্বাস, আমার কপালে ছুঁয়ে যাওয়া ঠোঁট সব কিছুতেই যেন জবাব মিশে থাকে।

“সব কথার উত্তর কি মুখে দিতে হয়? প্রতিটি ছোঁয়াতে মিশে থাকে উত্তর।”

কথাটা বলেই আমার কোমর ধরে টান দিতেই আমি আদভিনের বুকে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়লাম। সে-ই সাথে বোকা হয়ে গেলাম। আদভিনের বুকে মাথা রেখে তার প্রতিটি হৃদস্পন্দন যেন আমি শুনতে পাচ্ছি। মুখ তুলে বোকা বোকা চোখে আদভিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের চোখাচোখি হতেই আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। আদভিনের বুকে আবারো মুখ লোকালাম। আদভিন আমাকে লজ্জা পেতে দেখে উচ্চ শব্দে হেসে উঠলো। সে-ই সাথে হাতের বাঁধন আরো শক্ত হয়ে উঠলো।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

কেটে যায় গিয়েছে আরো কয়েক মাস। সময়ের সাথে সাথে আমার আর আদভিনের সম্পর্কে এসেছে বিস্তার পরিবর্তন। আর্দ্র এবং রোদ্র ও বড়ো হয়েছে।। আগামীকাল তাদের এক বছর পূরণ হবে। সে-ই সাথে আর্দ্র রোদ্র মায়ের মৃত্যু বার্ষিকী। এই নিয়ে শাশুড়ি মা কিছুটা মুখে হাসি রাখলেও সেই হাসিতে প্রাণ নেয়। নিজের ছোট্ট মেয়েকে যে ননীর পুতুল করে রেখেছিল। কিন্তু একটা ভুলে সব কিছু শেষ হয়ে গেল। একজন মা হারালো তার বুকে ছেঁড়া ধনকে আর দুজন নিষ্পাপ শিশু হারালো তার মা’কে। মায়ের আদর কি বা মায়ের ভালোবাসা কি সেটা বুঝে উঠার আগেই তাদের একা করে চলে গেল না ফেরার দেশে। আর্দ্র এবং রোদ্রকে অবশ্য আমি নিজের সন্তানের মত করে বড়ো করে চলেছি। এই দুজন যে এখন আমার পৃথিবীর একটা অংশ। তারা দুজনেই আধো আধো গলায় আমাকে মাম্মাম বলে ডাকে। আমার মনে খারাপ গলা জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে লজ্জা পায় তারা। আমার এইসব নিয়ে যে ছোট্ট একটা সংসার হয়েছে।

” তরু আদি কোথায়? আদিকে দেখছি না কেন?”

শশুর বাবার সামনে চায়ের কাপ এনে দিতেই আমাকে প্রশ্ন করলো।‌ শশুর বাবার প্রশ্ন শুনে কিছু না বলে মাথা নিচু করে নিলাম।
আদভিন কোথায় আমি নিজেও সে কথা জানিনা। সকালে বিষন্ন মন নিয়ে বের হয়েছিল আর এখন রাত দশটা। কোন খবর নেই আদভিনের। বার কয়েক ফোন করেও কোন কাজ হয়নি।‌ সাহেবের ফোন অফ। যতটা চিন্তা হচ্ছে তার থেকেও বেশি রাগ এবং অভিমান জমে যাচ্ছে আমার মনে।
আমার চুপ করে থাকা দেখে হয়তো শশুর বাবা আমার মনের কথা বুঝতে পারলো।

“আদি এলে ওকে আজকে রুমে ঢুকতে দিও না। আর যদি কিছু বলে তাহলে তুমি আমার কাছে বিচার দিবে।”

কথাটা বলেই শশুর বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমিও বাধ্য মেয়ের মত মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলাম। শশুর বাবার প্রতিটি স্নেহে যেন আমি আমার বাবাকে দেখতে পাই। আমার বাবা থাকলে এভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।
আদভিনের কথা মনে হতেই ড্রয়িংরুমে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে নিজের রুমের দিকে চলে গেলাম।

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

আকাশের গোলার চাঁদ তখন নিজের আলো ছড়িয়ে দিতে ব্যাস্ত। সে-ই সাথে পাল্লা দিয়ে মেঘেরাও ছুটাছুটি করতে ব্যাস্ত। রাতের শহর ঘুমিয়ে আছে। চারদিকে কেমন শান্ত পরিবেশ। মাঝ রাতে পায়ের উপর গরম কিছু পড়তেই ঘুমটা হালকা হয়ে এলো। প্রথমে নিজের মনের ভুল ভেবে আবারো ঘুমিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেকেন্ড খানেক পর পায়ের উপর ভার অনুভব হতেই ভয়ে ধরফর করে উঠে বসলাম।
ডিম লাইটের নিভু নিভু আলোয় পায়ের কাছে কাউকে দেখে পা গুটিয়ে নিতে গিয়েও নিতে পারলাম না। পা দুটো শক্ত করে ধরে বসে আছে সে। নিজেকে ধাতস্থ করে রুমের লাইট অন করতেই পায়ের কাছে আদভিনকে দেখে বুকটা ধক করে উঠল।

“আদি আপনি এভাবে? কি হয়েছে আপনার?”

বিছানা থেকে নেমে আদভিনের চিবুকে হাত দিয়ে প্রশ্ন করতেই আদভিন আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।
আদভিনের কাজে আমি হতভম্বের মতো বসে রইলাম। এর আগে আদভিনকে আমি কখনো এভাবে ভেঙে পড়ে যেতে দেখিনি। এতো সময় মনের মধ্যে থাকা সকল অভিমান গুলো ছুটি নিয়ে মনের মাঝে ভয় দিয়ে চলে গেল।

” আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে তরু? আমি তোমাকে একটা গল্প বলবো।”

আদভিনের কথা শুনে মনটা আমার আবারো বিষিয়ে উঠলো। আদভিনের কথা মতো এক হাত তার পিঠে রেখে অন্য হাত চুলে ডুবিয়ে দিলাম।

“আমি যখন ইউনিভার্সিটি ভর্তি হই তখন আমার পরিচয় হয় অন্তুর সাথে। একটা সময় আমার সাথে অন্তুর সম্পর্ক ভালো হয়। ‌আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল একটা সময়। বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়াতে অন্তু আমাদের বাড়িতে প্রায় আসা যাওয়া করতো। এমন একদিন অন্তুকে দেখে প্রেমে পড়ে। আমাদের সবার অগোচরে অন্তুর সাথে প্রেম করতো ইয়ানশিরা। অন্তু বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ফিজিক্যাল হতো। অন্তু আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এবং ইয়ানশিরাকে ভালোবাসায় সেও কিছু বলতো না। আমার বোনটা অন্তুকে খুব ভালোবাসতো জানো। কিন্তু প্রতিটি ফ্রেন্ড সার্কেলে একটা করে ছেলে থাকে না, যে সব মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করে, একাধিক প্রেম করে তেমনি ছিল অন্তু। যখন ইয়ানশিরার থেকে মন উঠে গেল তখন নতুন মেয়ের পিছনে চলে গিয়ে ফেলে দিল আমার বোনকে। কিন্তু ততদিনে ইয়ানশিরা বুঝতে পারে সে প্রেগন্যান্ট। যখন এইটা জানতে পারি তখন মা বাবা দুজনেই ছিল ইয়ানশিরার বিরুদ্ধে। অবিবাহিত মেয়ে এভাবে প্রেগন্যান্ট হওয়ার জন্য বাবা মা চিন্তায় ছিলো। তখন আমার সদ্য মাস্টার্স কমপ্লিট হয়েছে। অনেক কিছু ভেবে ইয়ানশিরাকে নিয়ে চলে গেলাম লন্ডন। সেখানে সুন্দর দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু আমার বোনটা সে-ই আগের মতো হতে পারেনি। সব সময় মন খারাপ নিয়ে বসে থাকতো। দেখতে দেখতে ডেলিভারি ডেট চলে আসে। টুইন বেবি থাকায় কিছু সমস্যা ছিল। তবুও আমি ইয়ানশিরাকে আশ্বাস দিয়ে নিয়ে যাই। তার দাভাই কিছু হতে দিবে না। কিন্তু আমি সে কথা রাখতে পারিনি। আর্দ্র এবং রোদ্র হওয়ার ঘন্টা খানেক পর ইয়ানশিরা মারা যায়। এরপর থেকেই আর্দ্র রোদ্রকে আমি নিজের সন্তানের বলে পরিচয় দিয়েছি। ওরা যেমন আমার ইয়ানশিরার শেষ চিহ্ন ঠিক তেমনি আমার বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। তরু! তরু! প্লিজ তুমি আমাদের ছেড়ে,এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেও না।”

আদভিন কথা গুলো বলতে বলতে নিঃশব্দে অশ্রু ফেলতে লাগলো। আদভিনকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে আছে নিলাম।

“আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না আদি। আমি সবসময় আপনার সাথে থাকবো।”

🍁🍁🍁🍁🍁🍁

“মানুষ কখনো একা একা কান্না করতে চায় না আদি। মানুষের একটা বিশ্বস্ত কাঁধের প্রয়োজন হয়। আমার সে-ই কাঁধটা আপনি।”

#চলবে