সুরেলা গল্প পর্ব-০২

0
168

#সুরেলা_গল্প
লেখা #AbiarMaria

আমি গ্রিলের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে চুপ করে থাকলাম। ঐ ছেলেটা কি রাগ করেছে? না বিরক্ত? ভুল কিছু করলাম কি? না জানি আশেপাশের কে না কে শুনে ফেলেছে! আমি অন্ধকারে ঘাপটি মেরে আশেপাশের কিছু বিল্ডিংয়ের জানালাগুলো লক্ষ্য করলাম। না, কোথাও আলো নেই। তবে কি সে ছাদে? নাকি আমার মতোই কোনো অন্ধকার বারান্দায়?

ঘড়িতে তখন রাত দেড়টা বাজে। রাত জেগে পড়াশোনা করার কারণে বাসার সবার হাতে বকা খাই নিয়মিত। আমার বোন দ্রুত ঘুমিয়ে পড়ে বলে আমার সাথেই তার সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ হয়। তার ঘুমানোর সময় আমি বই খাতা নিয়ে টানাটানি করি। এদিকে তিন রুমের বাসায় দু’বোনের আলাদা ঘরের কোনো অপশন নেই। বসার ঘরটা মেহমানদের জন্য বরাদ্দ। মেহমান না থাকলে আমি ঐ ঘরে বসে থাকি। তবুও বকা শুনতে হয়। আমিই নাকি বিদ্যুৎ খরচ বাড়াই এই বাসার!
একারণে আপু যখন থাকে না, তখনই আমার মাথায় সব দুষ্টুমি চাপে, সারাদিন ঈদের দিনের মতো আনন্দ হয়।

আপুর অনুপস্থিতিতে কাজটা করে একটু আগে যে উত্তেজনা, পুলক অনুভব হচ্ছিল, এখন আর তা হচ্ছে না। বুকটা দুরুদুরু করছে। অধীর আগ্রহে আমার সমস্ত সত্ত্বা সেই গম্ভীর সুরেলা কন্ঠের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে। কতক্ষণ কেটেছে? কয়েক সেকেন্ড বোধহয়? আমার কাছে লাগছে অনন্তকাল।

এমন একটা সময় আবারো গীটারের সুর কানে এসে বাজলো।
“রাতেরই আকাশের নিশ্চুপ সাক্ষী
দূরের ধ্রুবতারা,
কতটা বেসেছি ভালো,
শুধু মন জানে,
এ হৃদয় জানে…”

আমি তখন পারছি না খুশিতে বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়ে যাই! তার মানে সে আমার গান শুনেছে! সে এখন রেসপন্স করছে! ও মাই গড!

মন চাইলো চেঁচিয়ে তার নাম পরিচয় জানতে চাই। পরক্ষণেই দমে গেলাম। আরে ভাই, পুরো পাড়া তাহলে এসব জেনে যাবে। সে নিজের পরিচয় বলবে? বরঙ আমাদের নিচ তলার হামিদ আংকেল আব্বুকে কাল বলবে,
“ভাইসাব! আপনের মাইয়া তো মনে হয় কালকে রাইতে টাংকি মারতাছিল কোন পোলার লগে। গলা শুইন্যা তো আপনের মাইয়াই লাগলো। ভাইসাব! যা জামানা পড়ছে, পোলাপান লাহ শরম খাইয়্যা ফালাইতাছে। একটু শাসন কইরেন ভাইসাব! টিভি দেইখ্যা দেইখ্যা আজকালকার পোলাপাইন সব বদ হইতাছে, বদ!”

হামিদ আংকেলের স্বভাব সবাইকে বদ ডাকা। সব্বাইকে সে বদ ডাকে। আমি ভাবি, এখনকার পোলাপানদের তাহলে উনি কি বলে? উনার সাথে এখনো যোগাযোগ থাকলে সেটা জানা যেত।

ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখলাম, সেই ব্যক্তির পরিচয় জানা সম্ভব না। আর আমি জানিও না কোন বিল্ডিং থেকে তার কন্ঠ ভেসে আসছে। এজন্য খানিকটা মনঃক্ষুন্ন হলাম। তবুও ভালো, এই গান গান খেলাটা বেশ লাগছে। আমি কল্পনায় ভেসে যাচ্ছি সেই কল্পিত রাজকুমারের সাথে।

তার গান শেষ হতেই আমি গান ধরলাম,
“রাত নির্ঘুম, বসে আছো তুমি।
দক্ষিনের জানালা খুলে,
যত নির্বাক অভিমান মনে।
আজ সবটুকু নিলাম তুলে।
এসো তবে বৃষ্টি নামাই
সৃষ্টি ছাড়া ভালোবাসায়।
এসো তবে জোছনা সাজাই
দু’চোখের তারায় তারায়…”

আমার গান শেষ হতে সে গাইলো,
“সেই তুমি কেন এতো অচেনা হলে?
সেই আমি কেন তোমাকে দুঃখ দিলেম?
কেমন করে এতো অচেনা হলে তুমি?
কিভাবে এত বদলে গেছি এই আমি?”

আমার মন খারাপ হয়ে গেল। তার গানে একটা আকুলতা, বিরহ গ্লানি প্রকাশ পাচ্ছিল। গায়ক সাহেব কি ছ্যাকা খেয়েছে? তার মানে তার প্রেমিকা ছিল? আর এদিকে আমি তো একেবারে পিওর, কোনো ছেলের সাথে ঠিকঠাক টাংকিও মারিনি। ইশ! মারডালা!

মন খারাপ করে বিছানায় এসে সিনেমার নায়িকাদের মত উপুড় হয়ে পড়লাম। বালিশে মুখ গুঁজে বললাম, কেন প্রেম করলে? ও হে বালক, কেন কেন কেন?!

প্রেম করুক, আর না করুক, তাকে তো একটা নাম দিতে হবে। কি নামে নামকরণ হবে তার?

আমি যখন তার নাম ভাবছি, তখন তার গান বন্ধ ছিল। হয়ত সে আমার গানের অপেক্ষা করছিল। কিছু শুনতে না পেয়ে আবারও দূর থেকে তার কন্ঠস্বর ভেসে আসলো,

“একা পাখি বসে আছে শহরের দেয়ালে…”

একটা অদ্ভুত দুঃখবোধ বুকে চেপে আমি সেইরাত্র ঘুমিয়ে পড়লাম। আমার তাক্র কোনো নাম দেয়া হলো নাহ।

চলবে…