সুরেলা গল্প পর্ব-৪+৫

0
166

#সুরেলা_গল্প
লেখা #AbiarMaria

সুস্ময় ভাইয়া ছিল তার ব্যান্ডের মেইন ভোকালিস্ট। আমি মেয়ে হিসেবে মেয়ের কন্ঠ দিতাম, বেশিরভাগ সময় ব্যাকগ্রাউন্ডে হাল্কা সুরে গাইতাম। ব্যান্ডের নাম ছিল ‘রঙ্গিলা’। আমি সাড়ে তিন বছর তাদের সাথে ছিলাম। অথচ এই সাড়ে তিন বছরে কখনো ঐ রাতের অনুভূতিটা পাইনি, ঐ ক্যামিস্ট্রি অনুভব হয়নি। কি কারণে জানি না, এত বছরেও আমি সেই দুটো রাতের কথা ভুলতে পারিনি। কেন আমার সেই রাত, সেই কন্ঠের উপর এত অবসেশন, তা আবিষ্কার করতে পারিনি। সাধারণ ভাবে দেখলে মনে হবে, এটা একটা সামান্য ব্যাপার। কিন্তু কিশোরী জীবনের প্রথম ভালোলাগা, জীবনের প্রথম প্রেমের মতই অসংখ্য অনুভূতি আমার সেই ঘটনাকে ঘিরে। এবং অবশ্যম্ভাবী হলো এর পেছনে উল্লেখযোগ্য কোনো যুক্তি নেই।

আপনারা এখনো সিনেমার সাথে মিল কোথায়, খুঁজে পাচ্ছেন না, তাই না? গল্পের শুরুতে বলেছিলাম, আমার জীবনটা সিনেমার মত, অথচ কিসব বলে যাচ্ছি! অপেক্ষা করেন, আস্তে আস্তে বলছি।

পড়া শেষ হতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। বলা ভালো, করে ফেললাম। আপুর বিয়ে আর পাঁচ বছর আগে হয়েছে, একটা মেয়েও আছে, সামনে আরেকটা হবে। এই অবস্থায় ‘বিয়ে কর, বিয়ে কর’ বলে মাথা খারাপ করে ফেলল বাড়ির লোক। আম্মু তো শুধু ইমোশনাল ব্লেকম্যাল করতো! বলতো,
“নাদিয়াকে বিয়ে দিলাম, ওর বাচ্চা পালতেছি। বয়স থাকতে থাকতে তুই বিয়ে করলে তোর জামাইকে দুইটা ভালো মন্দ বানায় খাওয়াইতে পারতাম। বাচ্চা হইলে পাইলা দিতাম। বুড়া বয়সে বিয়ে করলে জামাইরেও ভালো মন্দ দিতে পারমু না, বাচ্চা পালা দূরে থাক। বিয়ে কর তাড়াতাড়ি মা, বিয়ে কর।”

আম্মুর যন্ত্রণায় বিরক্ত হয়ে রাজী হয়ে গেলাম। ছেলেও ছিল মোটামুটি ভালোই। প্রথম দেখায় গম্ভীর কন্ঠে কেবল জিজ্ঞাসা করেছিল,
“কোনো অতীত থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু সেই অতীত কখনো বর্তমান হবার সম্ভাবনা নেই তো?”

বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, প্রথমেই সেই ছেলেটা, সেই ছেলেটার গানের কন্ঠ কানে বাজতে থাকলো… আজ তোমার মন খারাপ মেয়ে…। আমার কি কখনো সেই কন্ঠের মালিকের সাথে দেখা হবে না?

কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে অনুভব করলাম, এখন আর সেই কিশোরীটি নেই আমি। বড় হয়ে গেছি, ঠুনকো আবেগ ছুড়ে ফেলার সময় এসেছে। তাই মাথা নেড়ে না জানিয়েছিলাম। তার আমাকে বেশ সাংসারিক মনে হয়েছে, তাই সেও মতামত দিয়েছিল। ফলাফল, এক মাসের ব্যবধানে আমার পরিচয় হলো মিস থেকে মিসেস সাদিয়া।

আমার বর খুব একটা রোমান্টিক না। তার উপর এরেঞ্জ ম্যারেজ। দুজনের সহজ হতে হতে মাস পার হলো। সে আমাকে দেখলে কেমন একটু সরে সরে থাকে, আমিও পারলে খাটের নিচে ঢুকে পড়ি। এত ছেলের সাথে চললাম, কখনো এমন পুরুষ পাই নি! তার কাছ থেকে সরে থাকা কেবল সংকোচ থেকে নয়, অভিমান থেকেও। মেয়েরা তো একটু লাজুক হয়ই। এটা তো একজন পুরুষের কাজ তার স্ত্রীকে সহজ করা। সে কেন দূরে দূরে থাকবে? তার কেন এত অস্বস্তি হবে? আমাকে অতীতের কথা জিজ্ঞেস করে নিজে আবার অতীতে আটকে নেই তো?

এসব সত্ত্বেও এক ঝিঝি ডাকা কৃষ্ণপক্ষের রাতে আমাদের মানসিক দূরত্ব না ঘুচলেও শারীরিক দূরত্ব ঘুচে গেল। হয়ত এটাই আমাদের প্রাণীগত বৈশিষ্ট্য বলে। ঘুম, ক্ষুধার মত প্রাকৃতিক প্রবৃত্তির মতো এই শরীরি বিষয়টাও একটা প্রাকৃতিক প্রবৃত্তি। দুজন নারী-পুরুষের সহবস্থানে তাদের মাঝে আকর্ষণ ঘটবে না- এ তো প্রাকৃতিক চক্রের ভাঙন। তাই হয়তো যা হবার হয়েছে।

ধীরে ধীরে আমরা সহজ হয়ে এলাম, সম্বোধন আপনি থেকে তুমিতে নেমে এলো, একে অপরের কাছে আবদার করতে শুরু করলাম, বিরক্তিতে ভ্রুক্ষেপ, রাগ-অনুরাগের খেলা, সবই চলতে থাকলো আর দশটা দম্পতির মতোই। তবে কারো মনের গভীরে যে কেউ যেতে পারিনি, সেটা খুব বুঝতাম। বুঝেও দু’জনের মধ্যে তেমন আগ্রহ ছিল না। যেমন ছা-পোষা জীবন চলছিল, সেভাবেই চালাচ্ছিলাম। এতে বোধহয় দুজনেই স্বস্তি বোধ করতাম।

আমরা থাকতাম শ্বশুর শাশুড়ীর সাথে। বাড়িতে আমার অবিবাহিত দেবর ছিল কেবল। ভাসুর ইংল্যান্ড থাকেন পরিবার সমেত। সেখান তার দুই জমজ সন্তান। বাড়িতে তাই বিশেষ ঝামেলা ছিল না। মাঝে মাঝে হয়ত দু’একজন মেহমান আসতো, এই তো।

বিয়ের কিছুদিন পর আমার চাকরি হয়ে গেল ইসপাহানীতে। চাকরিতে যথেষ্ট ছাড় পাওয়ায় বাতাস লাগিয়ে লাগিয়ে চাকরি আর সংসার করতে থাকলাম। এর মাঝে বরের সাথে যেটুকু সখ্যতা হলো, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। তাছাড়া সে আমাকে যথেষ্ট স্পেস দেয়, চাকরির কারণে সাহায্য করে। শ্বশুর বাড়িতেও সাপোর্ট পাই।

জীবনের তালে তালে চলতে চলতে বছর পূর্তির কিছু দিন আগে একটা বিশেষ দিনে আমি আর আমার বর- উফ, নাম বলতে ভুলে গেলাম না? সায়মন ওর নাম। আমি আর সায়মন সেদিন মনের দূরত্বটাও ঘুচিয়ে ফেললাম। কি করে? বলছি।

আমরা ওদের গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর বেড়াতে গেলাম। ওর ফুফুকে ওদের বাড়ির পাশেই বিয়ে দিয়েছে। ওর ফুফাতো বোনের বিয়েতে আমরা সবাই সেখানে গেলাম। যেদিন পৌঁছালাম, সেদিন সারাদিন আনন্দ করলাম। কত্ত দিন পর আমার গ্রামের দিকে যাওয়া হলো! যদিও ওদের ফুফুর বাড়ি পাকা দালান, ঢাকা থেকে সেখানকার সুবিধা কোনো অংশে কম না, তবুও আমার ভীষণ আনন্দ হলো। রাতের দিকে আড্ডা দিতে দিতে সবার চোখ যখন ঢুলুঢুলু, আমি তখন আর পারছিলাম না। সবাই জোর করা সত্ত্বেও চা না খেয়ে চলে এলাম আমাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঘরে। বেশ গরম ছিল। শরীর ঘেমে চ্যাটচ্যাটে লাগছিল। আমি দরজা আটকে আলো নিভিয়ে কাপড় খুলে ফেললাম। অন্ধকারে মোবাইলের আলোতে পাতলা একটা নাইট ড্রেস খুঁজে বের করলাম। রিসেন্টলি এক মেয়ে কলিগের সাথে মার্কেটে সেটা পছন্দ হয়েছিল। স্লিভলেস ড্রেসটা দেখে মনে হলো, এটা পরে খুব আরামের ঘুম হবে।

আরাম করে যখন বিছানায় শুয়ে কাঁথা টানতে গেলাম, তখন টের পেলাম বিছানায় কে যেন শুয়ে আছে। আঁতকে উঠে এক চিৎকার করে উঠলাম! কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো বোধহয়। তার পরেই সায়মন আমার মুখ চেপে ধরলো দুই হাতে,
“আরে আজিব কারবার! তুমি চিল্লাচ্ছো কেন এই রাতের বেলা?!”

আমি ওর হাত মুখ থেকে সরিয়ে বুকে থুতু দিলাম।
“কখন এসছ রুমে?! এরকম চোরের মত ঘাপটি মেরে শুয়ে ছিলে কেন?!”
“চোরের মত?! আমি ঘুমাতে আসছি। ঘুমাতে এসে কি ঢোল পিটাবো নাকি? তোমার তো কোনো দিকে খেয়াল নাই। সেটা আমার দোষ?”

আমি বেশ বিরক্ত হয়েছিলাম। সায়মন জানালা গলে আসা আলতো চাঁদের আলোয় আমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। অন্ধকারে আমি কিছুই বুঝিনি। তাই আবার কাঁথে টেনে শুয়ে পড়লাম। তখনই সায়মন পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে চুলে মুখ গুঁজে থাকলো।

বিয়ের পর এই প্রথম সে এই কাজ করেছে। আমি হতভম্ব হয়ে শুয়ে থাকলাম। আমার সাথে মিশে থেকে ধীর তালে বললো,
“আজকের রাতটা অন্য রকম না?”

আবেশে আমার কন্ঠ বুঁজে আসছিল। কোনোমতে বললাম,
“হু”
“অন্য রকম সুন্দর লাগছে আজ”
আমি চুপটি করে ওকে বোঝার চেষ্টা করছি। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে ভর করেছে। এখন বুঝি আর আমার শান্তির ঘুম দেয়া হবে না!

সায়মন আমাকে আরও অবাক করে প্রস্তাব দিল,
“চলো, চাঁদের আলোয় বসে গল্প করি”
আমি মনের ভেতরে থাকা বিরক্তিটুকু উগলে দেয়ার চেষ্টা চালালাম,
“ঘুমাই না আজকে? খুব টায়ার্ড লাগছে”
“আমারও তো লাগছে। আচ্ছা, বেশি জাগবো না। কিছুক্ষণ”
আমি জোর করে মাথা নেড়ে ‘না’ করি। সে আবারও অনুরোধ করে,
“প্লিজ! তোমার মাথায় বিলি কেটে দেব, চলো”

অবাক কান্ড! বিয়ের পর থেকে আমাকে দিয়ে সে নিয়মিত এই কাজ করিয়ে নিচ্ছে। অথচ আজ মাথায় বিলি কাটবে?! অসম্ভব!

আমার চাহনিতে অবিশ্বাস দেখে সে হেসে বললো,
“সত্যি সত্যিই দিব”

আবছা আলোয় ওর হাসি দেখে মনে হলো, এই হাসি দেখে আমি শত সহস্রবার ম*র*তে পারবো। বুকের ভেতর কেমন যেন করে উঠলো। মাঝে মাঝে ওকে চোরাচোখে হাসতে দেখতাম। ওর ভাই, বন্ধুদের সাথে যখন মজা করতো, আমি মুগ্ধ হয়ে সেটা দেখতাম। এত সুন্দর ভাবে হাসতে পারা মানুষটা আমার সাথে হাসে না কেন? আমার সাথে এমন হাসি দিলে আমি তো খু*ন হয়ে যেতাম মাইরি! তা না করে সবসময় ফিচলে হাসি হাসে আর আমাকে জ্বালায়। বিয়ের পর এই প্রথম আমার চোখে চোখ রেখে সে এভাবে হেসেছে। আমি তাই তার ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি।

জানালার কাঁচ ভেদ করে আসা নরম ভেজা জোছনায় ও আমাকে নিজের গায়ের উপর নিয়ে মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিল, আর আমি মুগ্ধতা নিয়ে আকাশ দেখছিলাম। ওর সেদিন মন ভীষণ ভালো ছিল, তাই অন্য এক রূপের বহিঃপ্রকাশ দেখেছি।

টুকটুক করে গল্প বলতে বলতে সে জানালো,
“আগামীকাল অভ্রদা আসবে”
“অভ্রদা আবার কে?”
“আমার মামাতো ভাই”
“বাইরে থাকে নাকি?”
“হুম, অস্ট্রেলিয়া”
“বিয়েতে এটেন্ড করতে আসছে?”
“হুম। আর দেশে ঘুরতে”
“ওহ। কিন্তু তোমার মামাতো ভাই বিদেশ থেকে আসবে শুধু তোমার ফুফাতো বোনের বিয়ের জন্য? ”
“তুমি তো জানো না, অভ্রদা ভীষণ পপুলার আমাদের কাজিন মহলে। সবাই এক কথায় উনার ফ্যান। আগে ভাইয়ারা, মানে ভাইয়া আমার মেঝ মামার ছেলে তো; ওরা যখন পূর্ব রামপুরা থাকতো, তখন আমি মাঝে মাঝেই ওখানে গিয়ে পড়ে থাকতাম”

পূর্ব রামপুরা নামটা শুনেই আমার কান খাড়া হয়ে গেল। আমরাও তো ওখানেই থাকি! ইনফ্যাক্ট আমার বাবার বাড়ি তো ওখানেই! বেশ সতর্কতার সাথে প্রশ্ন করলাম,
“পূর্ব রামপুরা কোনদিকে মামার বাসা?”
“তোমাদের বাসার কাছেই ছিল। টাকার জন্য ওটা বিক্রি করে দেয়া হয়। বিয়ের পর তোমাদের বাসায় গিয়ে তো দেখলাম, ডেভেলপার দশতলা বিল্ডিং করে ফেলেছে”

উত্তেজনায় আমার ভেতরে কাঁপতে থাকলো। আবারও প্রশ্ন করলাম,
“উনি কি গীটার বাজায়?”
“মারাত্মক বাজায়! অভ্রদার তো নেশা ছিল এক কালে। এখনো সুযোগ পেলে বাজায়। কাল আসলে শোনাবো”

আমি আর তেমন কিছু বললাম না। মাথা ব্যথার অযুহাত দিয়ে দ্রুত বিছানায় চলে আসলাম। আমার মাথায় কেবল চক্কর কাটছে কথাটা, পূর্ব রামপুরায় অভ্রদারা থাকতো যেটা আমাদের এক বিল্ডিং পরেই। আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই বিল্ডিং ভাঙার দিনের কথা। এত সুন্দর বাড়ি ভেঙে ফেলায় আমি খুব মনঃক্ষুন্ন হয়েছিলাম। অথচ কখনো ভাবিনি, আমার কিশোরী মন যে কন্ঠের প্রেমে ম*রেছিল, সেই কন্ঠের অধিকারী ঐ বাসাটায় ছিল! এজন্যই বোধহয় এর ধ্বস দেখে মনে করুণ সুর বাজছিল!

আমার দম আটকে আসতে থাকলো। অভ্রদা আমার ভাসুর হয়। উনিই আমার কিশোরী মন চুরি করা কন্ঠের মালিক। এই লোককে নিয়ে কোনো উলটপালট চিন্তা মাথায় যেন না আসে! ইশ, সে কেন অন্য কেউ হলো না? কেন এই বয়সে তাকে খুঁজে পেলাম? তাও আবার এমন পরিচয়ে?

ক্ষণিক পরে আবার মাথায় এলো, সে তো সেই মানুষটা নাও হতে পারে। বিষয়টা কাকতালীয় হওয়াটা অবাক কোনো বিষয় নয়। হতেই পারে, আমি আসলে অযথা বেশি ভাবছি।

অভ্রদাই কি সেই ব্যক্তি কিনা, সেটা জানার একমাত্র উপায় আগামীকাল তার গান শুনে নিশ্চিত হওয়া। তবুও নিজেকে বুঝ দিলাম, যদি তিনিই সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হোন, তবে আমি স্বাভাবিক থাকবো। রহস্যভেদ হচ্ছে, এই ভেবেই সুখী থাকবো। আর যদি তিনি সেই তিনি নাও হোন, তাতেও আশাহত হবো না। এই বয়সে, এই পর্যায়ে এসে কিশোরী জীবনের প্রেমের রহস্য আর ভেদ করতে চাই না। থাকুক না কিছু রহস্য বাকি জীবনে। ক্ষতি কি?

এবার কেবল অপেক্ষা!

চলবে…

#সুরেলা_গল্প
লেখা #AbiarMaria

৫ এবং শেষ পর্ব

সকালে ঘুম ভেঙে আগের রাতের কিছুই মনে পড়লো না ততক্ষণ যতক্ষণ না অভ্রদাকে নিয়ে বাড়িতে হৈচৈ পড়ে। লোকটা আসলেই সেলিব্রিটি। আমি তখন সায়মনের সাথে নাস্তা করছিলাম চালের রুটি, গরুর গোস্তো আর ডিম পোচ দিয়ে। এই সময় ওর কয়েকটা কাজিন এসে বলল,
“অভ্রদা একটু আগে ল্যান্ড করেছে। বললো, দুপুরের খাবার নাকি এখানে এসে খাবে!”

বাড়ির বড়, বুড়ো সবাই হৈহৈ করে উঠলো। অভ্রদাকে নিয়ে সবাই খুব উত্তেজিত। দেখতে গেলে সে ফার্স্ট কাজিন না, তবুও তাকে নিয়ে উত্তেজনা দেখে সেটা বোঝার উপায় নেই। রাতের মতো আমার ভেতর কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, বরং ভালো লাগছে। আমি হাসিমুখে সবার গল্প শুনে যাচ্ছি। অভ্রদা কত মজার মানুষ, কত সুন্দর গান করেন, গীটার বাজান, কবে সবাইকে খাইয়েছেন, আজ হলুদের অনুষ্ঠানে কি পারফর্ম করবেন- সে নিয়ে সবাই আলোচনা করে যাচ্ছে। এর মধ্যে অভ্রদার কেন ডিভোর্স হলো এবং কেন সেই মহিলা একটা বাস্তব শাকচুন্নি হবে না, সেই নিয়েও সবাই গল্প করছে।

গল্প আড্ডায় দুপুরের খাবারের আয়োজনের মাঝেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হাজির হলেন। আমি সবার কথা শুনে যতটা হ্যান্ডসাম ভেবেছিলাম তাকে, তেমনটা তিনি হলেন না। লম্বায় খুব বেশি না, ৫’৭ হবে হয়ত। তবে মুটিয়ে যাওয়া শরীরের জন্য আরও খাটো দেখা যায়। মাথায় চুল কমে গেছে, গায়ের রঙ মোটামুটি ফর্সা হলেও চেহারা খুব বেশি আকর্ষণীয় নয়। তবে ভীষণ মজার মানুষ এবং প্রত্যেকের সাথে সুদূর বিদেশে থেকেও যোগাযোগ রাখেন, তা বেশ বোঝা গেল। অবাক করা বিষয়, সায়মনের কাছ থেকে আমার সব খবরাখবরও পান তিনি। আমার সাথেও এমন ভাবে কথা বললেন, যেন বিয়ের পর থেকে নিয়মিত কথা হয় আমাদের! বলা বাহুল্য, ভাসুর হিসেবে তাকে আমার খুব পছন্দ হলো। চমৎকার একজন মানুষ!

রাত ৮টার কিছু পরে হলুদের ফাংশন শুরু হলো। সবাই হলুদ কমলা শাড়ি পরে ছুটোছুটি করছে। আমি সায়মনের টিকিটিও খুঁজে পাচ্ছি না। ও খাবারের মূল দায়িত্বে আছে। দেড়শো জনের মত আয়োজন হলেও কাজ করার মত ছেলেপেলে কম। এজন্য আমার বরটা খেটে মরছে।

এদিকে আমি সবার সাথে টুকিটাকি কথা বলার চেষ্টা করেও খুব বেশি সুবিধা করতে না পেরে একটা চেয়ার নিয়ে স্টেজের কাছাকাছি বসে ফোন ঘাটছি। এমন না যে আমাকে কেউ পাত্তা দিচ্ছে না, বরং আমিই কারো সাথে কথা বলে আনন্দ পাচ্ছি না। অপেক্ষা করে আছি, কখন ফাংশন শুরু হবে, সবাই নাচানাচি করবে। আর মাথায় তো ঘুরছেই অভ্রদার গানের বিষয়টা।

সাড়ে দশটা নাগাদ চললো কেবল ছবি তোলা আর মিষ্টি খাওয়ার পর্ব। সায়মনকে কয়েকবার দেখেছিলাম। তারপর জোর করে স্টেজে উঠে কয়েকটা ছবি তুলতেই আবারও সে গায়েব। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে সবার খাবারের তদারকি করলো। শেষ ব্যাচে বর কনের সাথে আমরা দুজনও বসলাম। খেতে বসে ওকে পেয়েই জিজ্ঞেস করলাম,
“ফাংশন কখন শুরু হবে?”
“এই তো, খাবার দাবার শেষ হলেই”
“আরও আগে হলে ভালো হতো না? খেয়ে দেয়ে নাচানাচি করতে গিয়ে যদি বমি করে দেয়?”
“ভালো হবে তো। আমরা বমির ঝরণা দিয়ে গোসল করবো!”

আমি খাওয়া থামিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালাম। খেতে বসে এইসব কথা কে বলে? অবশ্য ভুল আমারই। বমির প্রসঙ্গ তোলার কি দরকার ছিল বাবা! আর আমার বরটাও এমন ভাবে এইসব কথা বলে যে মুখ দেখে মনে হবে খুবই সিরিয়াস কিছু বলে ফেলেছে।

খাবারের পর্ব শেষ হতেই ফাংশন শুরু হলো। ছেলে মেয়েদের কয়েকটা দল পালাক্রমে নাচলো। অতঃপর এলো বহুল আকাঙ্ক্ষিত সেই সময়। অভ্রদা স্টেজে উঠেছে। আমি তখন স্টেজের সামনেই চেয়ারে বসে আছি।

অধৈর্য্য লাগতেছে গল্পটা শুনতে? মনে হচ্ছে না, কি খারাপ একটা মহিলা! বিয়ে করেও অন্য লোকের উপর ক্রাশ খাচ্ছে জাস্ট বিকজ কোনো এক জনমে তারা রাতের আঁধারে এক বিল্ডিং থেকে আরেও বিল্ডিং এ বসে ছাইপাঁশ পুরোনো গান গাইছিল, সেটা মাথায় সেট করে বসে আছে! প্রতারক, স্বামী থাকতেও বাজে চিন্তা, ছি ছি ছি!

এমন মনে হচ্ছে না আমাকে? তবে শুনুন। গল্পের শুরুতেই বলেছিলাম, যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য বই মিথ্যা বলিব না। আমি এখানে নিজের মনের এক ফোঁটা অনুভূতিও কমিয়ে বা বাড়িয়ে বলিনি। সায়মন যখন অভ্রদার কথা বলল, তখন ক্ষণিকের জন্য মনে আফসোস উঁকি দিয়েছিল বটে যে কেন ‘যাহা চাইলাম, তাহা পাইলাম না’? অত:পর সকালে ঘুম ভেঙে যখন সায়মনের মুখটা দেখলাম, আমার মনে হলো ওকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। এই যে খুব আনরোমান্টিক, সিরিয়াস গোছের দায়িত্বশীল পুরুষটি যিনি কিনা আমাকে পটানোর বিন্দুমাত্র চিন্তা আজ অব্দি করেনি, আমার মেয়েলী ন্যাকামোর গুরুত্ব দেয়নি, কখনো ভালোবাসি বলেনি; এরেঞ্জ ম্যারেজ সত্ত্বেও নীরব ঘাতকের মতো তার প্রতি আমার প্রেম আমার সমস্ত কোষ, অস্থিমজ্জা, রক্তকণিকা এবং নিঃশ্বাসে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি ওর প্রতি যে অনুভূতি নিয়ে বছর খানেক ধরে বেঁচে আছি, আর কোনো পুরুষের প্রতি সেই অনুভূতি আসবে না। কারণ সন্তর্পনে এই পুরুষটি আমাকে নানান সময় বুঝিয়ে দেয়, সেও আমাকে ভালোবাসে যা সে তার দায়িত্ব বোধ এবং আমাকে আগলে রাখার মাধ্যমে প্রকাশ করে। তাই ভবিষ্যতে আমার কিশোরী জীবনের রহস্য মানব হাজির হলেও তাতে আমার তার প্রতি অনুভূতি বিন্দুমাত্র বদলাবে না।

এইসব কারণে আমি হাসিমুখে অপেক্ষায় আছি অভ্রদার গান শোনার জন্য। কিছু সময় সেই কৈশোর থেকে নাহয় ঘুরে এলাম। এটুকুই সান্ত্বনা থাক নাহয়?

অভ্রদা স্টেজে ওঠার পর সায়মন গীটার নিয়ে এলো। তারপর দুটো চেয়ার আনা হলো। তাতে ওরা দু’জন বসলো। আমি বুঝতে পারলাম না। সায়মন স্টেজে কি করে? ওর কাজ কি ওখানে?

অভ্রদা গীটারের টিউন ঠিক করলো। সেই মুহূর্তে আমি খেয়াল করলাম, ওর কাজিন মহল ওদের দুজনের নামেই চিয়ার আপ করছে। আমি অবাক হয়ে চারদিকে তাকালাম। অভ্রদা খুব পপুলার সবার মাঝে, সেটা খেয়াল করেছি। কিন্তু সায়মন যে কত পপুলার, সেটা এই প্রথম খেয়াল করলাম! সায়মনের এক চাচাতো বোন বলল,
“ভাবি, তোমার বর যা মারাত্মক পপুলার, তুমি তো জানো না!”

স্টেজে তখন অভ্রদা গীটার বাজাচ্ছে, আর মাইক হাতে চোখ বুঁজে সায়মন গানের সুরে টান দিল,

“আ আ আ আ আ আ আ আ
না জানে কাবছে
উম্মিদে কুচ বাকি হ্যায়।
মুঝে ফির ভি তেরি ইয়াদ কিউ আতি হ্যায়?
না জানে কাবছে…”

‘জা আ আ আ আ আ ল’ বলে সবাই এক সাথে চিৎকার দিল। অথচ সেই তীব্র শব্দের কড়াঘাত আমার মনোজগতকে কিছুতেই টলাতে পারলো না। আমি সেখানে বিদ্যুৎস্পৃশ্য ব্যক্তির মত তাকিয়ে রইলাম। সায়মন কন্ঠের সব জোর ঢেলে গেয়ে যাচ্ছে,

“দূর জিতনা ভি তোম মুঝছে পাছ দে রে ম্যা,
আব তো আদাত সি হ্যায় মুঝকো এয়ছে জিনে ম্যায়।
জিন্দেগীছে কোয়ি শিকয়া ভি নেহি হ্যায়।
আব তো জিন্দা হু ম্যায় ইস নীলে আসমামে…”

আমার দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ছে। নিজেকে আমার আটকে রাখা অসম্ভব হয়ে গেছে। আমি ভাবতেই পারছি না, কৈশোরে প্রেমে পড়া সেই কন্ঠের মালিক আর কেউ নয়, আমার বর সায়মন!!!

শকড না?! সিনেমা না পুরা? একদম সিনেমা!

আমি ওদের গান শেষের দিকে আসার আগেই স্টেজে উঠে সায়মনের গায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম স্থান কাল পাত্র সব ভুলে গিয়ে। সামনে মুরুব্বিরাও ছিল, ওর পাশে ওর বড় ভাই ছিল, চারদিকে বয়সে ছোটরাও ছিল। আমি কিচ্ছু দেখলাম না, কিচ্ছু ভাবলাম না, কিচ্ছু চিন্তা করলাম না। আমি কোনোমতে সায়মনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।

আমাকে এভাবে ছুটে আসতে দেখে ভাগ্য ভালো সায়মন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। যে কারণে বউয়ের ওজনে তাকে মঞ্চে চিৎপটাং হতে হয়নি। সবার সামনে বিস্মিত আমার বর আমাকে ধরে কোনোমতে শান্ত করলো। কেউ কেউ আমাকে দেখে লজ্জায় হেসে ফেলল, কেউ আবার আমি ঠিক আছি কিনা, এই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। দ্বিতীয় দলে ছিল সায়মন। সে কয়েক সেকেন্ডের মাঝে আমার মুখখানা দুহাতে ধরে তুলে চাইলো। ভীত কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
“সাদিয়া! কি হইছে তোমার?! ঠিক আছো?!”

আমি চোখে পানি নিয়ে অদ্ভুতভাবে হাসলাম। এতবড় সারপ্রাইজ আল্লাহ আমাকে দিয়েছে, আমি তখনও বিশ্বাস করতে পারছি না। সায়মন কাকে যেন ইশারা দিয়ে এক বোতল পানি এনে আমাকে খাওয়ালো। দুহাতে চোখের পানি মুছে দিল। বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকলো, কি সমস্যায় পড়েছি আমি হুট করে।

নিজেকে একটু ধাতস্থ করে ওকে বললাম,
“আই লাভ ইউ!”

এত জোরে বললাম যে প্রায় সবাই শুনেই ফেলল। মুরুব্বিরা নিঃসন্দেহে ঘরের বউয়ের উপর খুব বিরক্ত হলো। আর ইয়াং জেনারেশন খুশিতে নেচে উঠলো। দু’একটা শিসও শুনতে পেলাম। সায়মনের মুখে কোনো লাজুকতা ছিল না, বরং বিশ্বজয়ের একটা হাসি দেখতে পেলাম। সেই হাসি মুহূর্তেই ওর পুরো মুখে ছড়িয়ে পড়লো। আমি ওর দু’চোখ দেখছি। ওর দু’চোখ বিশ্বজয়ের প্রাপ্তিতে জ্বলছে।
“এটা কি স্টেজে বলতে উঠেছ?”

আমি জোরে মাথা নেড়ে মানা করলাম। ওকে বললাম,
“তোমার সাথে একটা ডুয়েট গান করবো”

সায়মন ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। আমি নিচু হয়ে মাইক তুলে নিলাম। ওর চোখে চোখ রেখে নিঃশ্বাস ছেড়ে খুব স্বাভাবিকভাবে গানে সুর তুললাম,
“যখন নিঝুম রাতে সবকিছু চুপ
নিষ্প্রাণ নগরীতে ঝিঁঝিঁরাও ঘুম হুমমমম
আমি চাঁদের আলো হয়ে তোমার কালো ঘরে
জেগে রই সারা নিশি,
মমমমম এতটা ভালোবাসি।
এতটা ভালোওবাসিইইই”

সায়মন কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর বিস্ময় খেলে গেল ওর চোখ জোড়ায়। হ্যাঁ, আমি স্পষ্ট পড়তে পারলাম, ও আমার কন্ঠস্বর চিনেছে! তাছাড়া, এই গানটাই আমরা শেষ একত্রে গেয়েছিলাম দ্বিতীয় রাতের শেষে।

আমার দিকে অবিশ্বাস নিয়ে ও রইলো। ইশারায় বুঝালো, তুমি কি সেই? আমিও চোখে পানি নিয়ে দু’হাতে মাইক চেপে মাথা নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম। সে কয়েক সেকেন্ড মুখে হাত চেপে চোখ বড়বড় করে স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো।

অতঃপর সায়মন সবার সামনে আমাকে দুই হাতে জড়িয়ে উপরে তুলে ফেলল। পুরো প্যান্ডেল জুড়ে তখন আমাদের দুজনকে নিয়ে হৈহৈ রৈরৈ ধ্বনি। আমি ভাবতে পারিনি আমার প্রচন্ড আনরোমান্টিক বর আমাকে তার পুরো আত্মীয় মহলের সামনে এইভাবে জড়িয়ে ধরবে! আমার মাথায় তখন কাজ করছে, অনেকেই আমাদের ভিডিও ছবি তুলে ফেলেছে। অনেকে হয়ত গসিপও বানিয়ে ফেলেছে আমরা বিবাহিত দম্পতি হওয়া সত্ত্বেও। অথচ তাতে ওর বা আমার কিছুই এসে যায় না!

কয়েক সেকেন্ড পর সায়মন মুগ্ধ কন্ঠে আমাকে ফিসফিস করে বলল,
“আমি বিশ্বাস করতে পারছি না!”
আমি আনন্দে কাঁপতে কাঁপতে বললাম,
“আমিও না!”

সেই রাতে আমাদের স্বাভাবিক হওয়ার সাথে সাথে অভ্রদাসহ ওর কিছু কাজিন এসে জিজ্ঞেস করলো,
“সিন ক্যায়া হ্যায় বস?”

সায়মন সবাইকে শান্ত করে হাসতে হাসতে ছোটবেলার কাহিনী বলতে থাকলো। সাথে আমিও কিছু যোগ করলাম। আমাদের এই সিনেমাটিক মিলন দেখে সব মেয়ে গুলো হাহাকার করে বলে উঠলো,

“আহা, আমাদের জীবনেও যদি এরকম সিনেমাটিক কিছু হতো!”

আমরা দুজন সেদিন অপার বিস্ময়ে নিজেদের আবিষ্কার করেছিলাম। সত্যিই, জীবন মাঝে মাঝে নাটকের চেয়েও নাটকীয় হয়ে যায়।

তাই না?

সমাপ্ত

**অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না কেউ!**