#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২১
বয়সটা যে বাড়ছে সেটা বুঝতে পারছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রতাপ সান্যাল, আজ থেকে বছর দশেক আগে হলে মুখে মুখে তর্ক করার জন্যে এতক্ষনে সুকান্ত কে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতেন তিনি। কিন্তু আজ পারলেন কই! এমনকি সেদিনের ছেলের বউ, যাকে শুধু গরীব ঘর থেকে এই কারণেই তুলে এনেছিলেন, যে মাথা তুলে দাঁড়াতে সাহস করবে না কখনো, সেও তার মুখের ওপরে সটান না বলে দিলো! পেছনে হাত রেখে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত সমানে পায়চারি করে চলেছেন তিনি, সরযূ পাশেই খাটে বসেছিলেন, স্বামীর ভঙ্গি দেখে খানিকটা চিন্তার সুরে বললেন,
কবেই বলেছিলাম তোমাকে, ও মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে দিও না ছেলে কে! তুমি বললে বনেদী রা নাকি ওরকম কতো সম্পর্ক রাখে! বিয়ে না করলেই হলো! এখন বুঝছো তো! সব ওই মেয়ের শিক্ষা! তখন ঢুকতে পারেনি শুধু আমাদের জন্যে, সেই রাগ সে মনে মনে পুষে রেখেছে এতোদিন। তাও এতদিন কিছুটা দূরে ছিলো, এখন তো তোমার ছেলে এক্কেরে দোরগোড়ায় এনে তুললো! আর একটা কথা ভেবে দেখেছো কখনো, ওই মেয়েটা এতো তাড়াতাড়ি চাকরি ছেড়েই বা দিলো কেনো? বয়স তো এখনও ছিলো অনেক, তাও সাত তাড়াতাড়ি সব ছেড়ে এখানে আমার ছেলের ঘাড়ে এসে উঠলো।
প্রতাপ বাবু বিরক্ত হলেন,
থামো তুমি! সারাক্ষন শুধু আজেবাজে কথা! যাকে তুমি নিজে পছন্দ করে নিয়ে এসেছিলে অজ পাড়াগাঁ থেকে, বলেছিলে কোথাও যাবার জায়গা নেই! সে আজ মুখের ওপরে না বলার সাহস পেলো কোথা থেকে, সেটা ভেবে দেখেছো একবারও?
সরযূ প্রায় তেড়ে উঠে বললেন,
তা সে কি খারাপ হয়েছে শুনি! একসময় তো তুমিও এতে খুশিই হতে! সে মেয়ের ধারে পাশে ঘেঁষতো না বলেই তো না তুমি মায়া কে অতো সহজে সরাতে পেরেছিলে! নেহাৎ রতন টা একেবারেই অপদার্থ, নাহলে অন্য কেউ হলে কি ওরকম সুযোগ কেউ হাতছাড়া করতো সেদিন! সব টাই তো ওই বউয়ের জন্যেই! আজ হটাৎ তোমার নাতনির জন্যে দরদ উথলে উঠেছে এক্কেরে! বেশ করেছে না বলেছে! আমি খুশি হয়েছি, এটুকু বুঝেছি মায়ে ঝিয়ে জোট বেঁধে আমার পেছনে লাগবে না কখনো!
ওই তো তোমার বুদ্ধি! ওই বুদ্ধি নিয়ে চললে প্রতাপ সান্যাল কে আর ওকালতি করে খেতে হতো না! মায়ের ধার ওই মেয়ে আর ধারবে ভেবেছো কখনো? তার কাকা আছে, আর আছে রমা! তাদের কাছে তাকে যেতে দিলে আর দেখতে হবে না! আর আপাতত কিছু করার নেই, রতন কে বাড়ি চলে যেতে বলতে হবে। তবে তার মা কে অন্তত আটকে রাখার চেষ্টা করো যে করেই হোক! আজ পর্যন্ত তো কোনো কাজই ঠিক ভাবে করতে পারো নি, এটুকু করে দেখাও!
স্বামীর কথায় সরযূ চিন্তায় পড়লেন, বৌদি কে যে আটকে রাখা সম্ভব হবে না সেটা তিনি আগের দিন বৌদির কথায় বুঝে গিয়েছিলেন, এখন নতুন করে তাঁর পক্ষে আর কিছু করা সম্ভব হবে কিনা সে নিয়ে তিনি ভাবতে শুরু করলেন। পরের দিন সকালে সুকান্ত কোর্টে বেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রতাপ বাবু রতন কে ডেকে পাঠালেন, বললেন,
সুকান্ত কিছুতেই তোমার এখানে থাকা মেনে নিতে পারছে না, তুমি বরং বাড়ি ফিরেই যাও। তবে বৌদি এখানেই থাকুন, তাঁকে আর এই বয়সে টানা হ্যাঁচড়া করতে যেও না!
রতন সবই বুঝলো, মা এখানে থেকে গেলে যে তার আদতে বাইরে গিয়ে কোনোই লাভ নেই সেটা সে স্পষ্টই বুঝতে পারছিলো। একটু চিন্তা করে বললো,
আমি চলে গেলে মা এখানে থাকতে রাজি হবে না পিসেমশাই! আপনি বরং মা কে যেতে দিন! মায়ের এখানে থাকাও খুব বেশি সুবিধার হবে না, আপনার বৌমা যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, মায়ের কাছ থেকে খবর বার করে নিতে তার বেশি সময় লাগবে না। মাঝখান থেকে আরো বেশি জটিলতা বাড়বে, আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি এমন কিছু করবো না যাতে আপনার সম্মানহানি হয়!
প্রতাপ সান্যাল গম্ভীর হলেন, কিছুক্ষন একদৃষ্টে রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
বয়স আমার সত্তর পেরিয়েছে রতন, শরীরের জোরও অনেকটাই কমেছে, তবে বুদ্ধি বা লোকবল একটুও কিন্তু কমে নি। মা কে নিয়ে যেতে চাও যখন যাও, আমি জোর করে আটকাবো না তবে এমন কিছু করবার কথা স্বপ্নেও ভেবো না যাতে তোমাদের বিপদ বাড়ে! আমার সম্মানহানি করার মতো ক্ষমতা তোমার নেই, তুমি নিজের ভালো থাকার কথা চিন্তা করো।
রতন তাড়াতাড়ি ঘাড় হেলালো,
জানি পিসেমশাই, মনে থাকবে!
রতন আর এক মুহূর্তও দেরি করলো না, পাছে দেরি করলে আবার সান্যাল মশাই মত বদল করে ফেলেন, তাই সে সেদিনই মা কে নিয়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো। সরলা তাদের গোছগাছ করতে দেখে একটু অবাক হলো, বিমলা কে বললো,
আপনিও চলে যাচ্ছেন নাকি মাইমা? আপনার যাওয়ার কথা উঠছে কেনো আবার?
সরযূ কে ধারেপাশে না দেখে বিমলা এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বললো,
আর তুমি আটকিও না বাছা! এখান থেকে বেরোতে পারলে বাঁচি! রতির কাছে তুমি সব শুনেছ নিশ্চয়ই! মেয়ের সঙ্গে তোমার ভাব ভালোবাসা নেই, তাইতে বেঁচে গেছ! নাহলে তোমার দশাও আমাদের মতোই হতো!
সরলা ঘাড় নাড়লো,
কিছু শুনি নি তো মাইমা! আপনাদের ছেলের আমার সঙ্গে কথা বলার সময় কই! তবে এটা ঠিক ও মেয়ের দায়িত্ব আমি কখনো নেবো না! তার তো ভালোবাসার লোকের অভাব নেই, বাপ, ঠাকুমা, দাদু, কাকা সব আছে তার, তারাই সামলাক!
বিমলা মাথা নাড়লো, নিচু গলায় বললো,
ওই ঠাকুমা, দাদুর ভরসায় থেকেছ তো হয়েছে! নিজের ননদ বলে বলছি না, কুকীর্তি তো সেই শুরু থেকেই কম দেখলাম না! একসময় আমি তার চোখের মণি ছিলাম, রতন কে সে বোধহয় নিজের ছেলের থেকেও বেশি ভালো বাসতো! রতনও পিসি বলতে অজ্ঞান ছিলো! মিথ্যে বলবো না, আমার যখন স্বামী চলে গেলো, তখন সে অনেক করেছে! কিন্তু তার জন্যে আমরাও কম করিনি! মায়া কে সরালো, আশা কে গরুখোঁজা খুঁজছে! শুধু পিসির কথায় ওই মেয়েকে সরানোর মতো পাপ কাজ রতন করতে রাজি হয়েছিলো। নেহাৎ তুমি এসে গেলে, নাহলে ওই মেয়ে আজ কোথায় থাকতো! কিন্তু তারপরে তুই কি করলি? আমাদেরই নজরবন্দী করে ফেললি! একবারও তোর মনে হলো না, আমরা তোকে বিপদে ফেলার মতো কিছু করতে পারবো না! এতো বিশ্বাস, এতো ভালোবাসার এই দাম দিলি!
সরলা ঘনিষ্ট হয়ে পাশে ঘেঁসে বসলো, জামা কাপড় ভাঁজ করে বাক্সের মধ্যে রাখতে রাখতে বললো,
বলেন কি মাইমা? এতো কিছু তো জানতামই না! মায়া দি তো মেয়েকে খুব ভালোবাসতো! তা মেয়ে কে সরিয়ে দেওয়ারই ছিলো, তাহলে তো বাড়িতে নিয়ে আসার দরকারই ছিলো না, আগেই হাসপাতালে সে কাজ শেষ করতে পারতো!
তার উপায় ছিলো না বৌমা! সুকান্ত যে প্রথম দিন থেকেই হত্যে দিয়ে পড়েছিলো হাসপাতালে! সে তার মাতাল দাদা কে চিনতো, তার ওপরে সে একটুও ভরসা রাখতে পারে নি। আর মেয়ে যা ফুটফুটে, এক্কেরে মায়ের মুখ কেটে বসানো! ওই মুখ দেখলে, আর ছেড়ে আসতে মন চাইবে না কারো! ওই ঠাকুমা, দাদু নেহাত একেবারেই পিশাচ, তাই ওই অতো সুন্দর মেয়ে কে মারতে চেষ্টা করে।
সরলা তাড়াতাড়ি গলা নিচু করলো, বিমলার কথার উত্তরে বাইরের দিকে তাকিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বললো,
তা মা যে মরেনি, পালিয়ে গেছে, এটা ছোড়দা জানতে পারেনি?
বিমলাও গলার স্বর আরও নিচুতে নামালো,
তোমার শ্বশুর কি কম শয়তান নাকি! আর বউটাও তো লোভী ছিলো! কম টাকা পয়সা তো পায়নি! যে নিজেই পালাতে চায়, তাকে পালাতে দেওয়া খুব কষ্টের নাকি, আর হাসপাতালের লোকজন তো সবই চেনা, তাই অসুবিধা হয়নি। সুকান্ত তাই জানে যা বাকি সবাই জানে! তবে তুমি কি করে জানলে মা? মায়া বলেছে বোধহয়!
সরলা ঘাড় হেলাল,
হ্যাঁ, মাইমা! সেই সব বলেছিলো! বেচারা মরেই গেলো! তা মা খুব সুন্দরী ছিলো বুঝি? মেয়ে তো বেশ সুন্দরী হয়েছে!
বিমলা হাসলো,
সে এক্কেরে ডানাকাটা পরী ছিলো মা গো! জানিনা রতি তাকে কোথা থেকে নিয়ে এসেছিলো, কিন্তু আমার তাকে দেখে ভদ্র ঘরের মেয়ে বলেই মনে হয়েছিলো। মেয়ে একদম তার মায়ের মতো। তবে তোমার শাউড়ির সামনে সে কথা বলা যাবে না! বললেই বলে সে নাকি সান্যালদের মতো! তা ওই রঙ সান্যালদের কার আছে বলো তো? যাকগে! ওসব কথা থাক! তোমায় একটা কথা বলি মা, ওই মেয়ের থেকে দূরেই থেকো! দায়িত্ব নিতে চাও নি সে ভালো করেছো! আমরা এ বাড়ি থেকে যাচ্ছি ঠিকই, কিন্তু নজরেই থাকবো তাদের, সে আমি জানি! তুমি সাবধানে থাকো! ওই মেয়ের আর কিছু হবে না, এখন সে বড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু তাকে নিয়ে মাতামাতি করতে গেলে তুমি বিপদে পড়বে!
সরলা সম্মতি জানালো, সে যে ওই মেয়ের ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামাবে না এটা জানার পরে বিমলা শান্তি পেলো। সরলার সঙ্গে তার শাশুড়ির বনিবনা না থাকলেও বিমলার সঙ্গে সে কখনো খারাপ ব্যবহার করে নি। বিমলা যদিও বরাবরই তার শাশুড়ির ধামাধরা সেটা তার জানা ছিলো, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে তার সঙ্গে বিমলা কখনো খারাপ ভাবে কথা বলেনি, তাই তার প্রতি সরলার কোনো বৈরীতা ছিলো না।
সান্যাল বাড়ির পট পরিবর্তন হচ্ছিলো, বিমলা এখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সমস্ত গোপন তথ্য বউয়ের কাছে দিয়ে যেতে নিজেই উৎসুক ছিলো। ছেলের বউয়ের সঙ্গে সরযূর সম্পর্ক কেমন সে তার থেকে বেশি আর কেই বা জানতো। এককালে ননদের সব চেয়ে হিতাকাঙ্খী বিমলা ননদের ব্যবহারে ক্ষুব্ধ হয়ে দল পরিবর্তন করছিলো, ক্রমশ বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে যাওয়া সরযূর থেকে তার বৌমার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখা যে তার ভবিষ্যতের জন্যেই জরুরি সেটা বিমলা ভালোই জানতো।
রতন তার মা কে নিয়ে সান্যাল বাড়ি থেকে বিদায় নিল, পিসেমশাই এর সতর্ক বাণী তাকে মনে মনে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করলেও প্রতাপশালী প্রতাপ সান্যালের হুমকি অগ্রাহ্য করার মতো ক্ষমতা তার ছিলো না। তবে অপমান ভুলে যাওয়ার বান্দা রতন ছিলো না, তলে তলে সান্যাল দের গোপন কথা কিভাবে প্রকাশ্যে আনা যায় সে বিষয়ে সে ভাবনা চিন্তা করতে লাগলো।
দেখতে দেখতে অদ্বিতীয়ার কলকাতা ফেরার দিন এসে গেলো, যদিও সুকান্ত সেখানে কোর্টের কাজকর্ম সেরে পৌঁছানোর অনেক আগেই সুমন সোমা কে নিয়ে যেতে পৌঁছে গেলো। পরীক্ষা মিটে গিয়েছিলো, তাই এতো দিন ধরে সরলা কে দেওয়া কথা মতো নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখলেও এবার আর তার প্রয়োজন ছিলো না। সোমা কে সে অদ্বিতীয়া কে ডেকে দিতে বললো, আজ আর হোস্টেল সুপারের দেখে নেওয়া, বা বড়ো দিদিদের জানিয়ে দেওয়ার প্রশ্ন ছিলো না, তাই সুমন সরাসরি হোস্টেলের সামনের মাঠে এসে দাঁড়ালো। সোমা দৌড়ে ঘরে ফিরে এলো,
ছোড়দা তোকে ডাকছে!
আগেই সুমনের সঙ্গে ছোটো মায়ের কথোপকথন সোমার কাছে অদ্বিতীয়ার শোনা হয়ে গিয়েছিল, তাই ছোটো মার সমর্থন যে তার সঙ্গেই থাকবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে অদ্বিতীয়া আজ অনেকদিন পরে স্বেচ্ছায় সুমনের মুখোমুখি দাঁড়ালো। সুমন বরাবরের সোজা কথার মানুষ, সে সরাসরি প্রশ্ন করলো,
আমি কাকিমার সঙ্গে কথা বলেছিলাম তোমাদের গ্রামের বাড়িতে গিয়ে, সোমা তোমাকে বলেছে নিশ্চয়ই?
অদ্বিতীয়া ঘাড় হেলালো, সে জানে। সুমন তার চোখের দিকে তাকালো,
কাকিমা বলেছিলেন পরীক্ষার পরে তোমার সঙ্গে কথা বলবেন, জানতে চাইবেন তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো কিনা! আমি বলেছি, আমি জানি তুমি এখনো আমাকে ভালোবাসো! ঠিক বলেছি তো?
অদ্বিতীয়া চোখ নিচু করলো, সে সুমন কে এখনও ভালোবাসে, গত দু বছরে সেই ভালোবাসা বেড়েছে আরো, কিন্তু সরাসরি সেই প্রশ্নের উত্তরে সে এই কথা গুলো মুখে কি করে উচ্চারণ করবে! হাত ঘামতে লাগলো অদ্বিতীয়ার, সে মাথা নিচু করে ঘাসে পায়ের নখ ঘষছে দেখে সুমন হেসে ফেললো। পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে অদ্বিতীয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
এটা আমার কার্ড! এতে ক্লাবের নম্বর আর বাড়ির নম্বর দুটোই আছে। তবে বাড়িতে কোরো না। সকাল, বিকেল ক্লাবে থাকি ওই সময় কোরো। আর হ্যাঁ, যদি তোমার ফোন পাই কালকের মধ্যে তাহলে তোমার উত্তরটা হ্যাঁ বলেই জানবো। আর যদি না হয় তাহলে আর কখনো ফোন করার দরকার নেই।
অদ্বিতীয়া কাঁপা হাতে কার্ড টা নিলো, একটু অবাক গলায় বললো,
তুমি কার্ড ছাপিয়েছ!
সুমন মুচকি হাসলো,
কেনো? কার্ড কি শুধু তোমার দাদুই ছাপতে পারে নাকি! বনেদী না হলে কার্ডও ছাপা যায়না নাকি! তবে তোমার দাদু নিজে পয়সা দিয়ে ছাপায়, আমার টা ক্লাব ছাপিয়েছে।
ক্লাব ছাপিয়েছে!
বিস্ময় ঝরে পড়ছিলো অদ্বিতীয়ার গলায়, সুমন একটু গম্ভীর হলো এই বার, অদ্বিতীয়ার চোখে চোখ রেখে বললো,
বনেদী হতে পারবো না তোমার মতো, কিন্তু এখন আমাকে অনেকেই চেনে! তুমি ফুটবলের খবর রাখো না, তাই জানো না। কোনোদিন মাঠে এসো, বুঝতে পারবে!
অদ্বিতীয়া কার্ডটা দেখতে দেখতে মাথা নিচু রেখে প্রশ্ন করলো,
কাল কখন ফোন করবো? সকালে দাদুভাই থাকে, ফোন ওই ঘরেই, তাই সকালে করতে পারবো না।
সুমন হেসে ফেললো,
তাহলে বিকেলে কোরো! তবে তখনও তোমার দাদু যদি ঘরে বসে থাকে তাহলে আর কিছু করার নেই। বুথ বলে একটা জিনিষ হয় জানো সেটা? সেখান থেকে যখন ইচ্ছে ফোন করা যায়। তবে তুমি তো আবার গাড়ি ছাড়া বাইরে বেরোনোর অনুমতি পাবে না, সঙ্গে ওই বুড়ো ড্রাইভারটা তো থাকবেই। ফোন করলেই শালা তোমার দাদু কে গিয়ে লাগিয়ে দেবে! তবে এই যে তুমি কখন ফোন করবে জিজ্ঞেস করলে, এতেই তোমার উত্তর পেয়ে গেছি! আর ফোন না করলেও চলবে কাল, সময় সুযোগ মতো অন্য কোনোদিন কোরো নাহয়!
অদ্বিতীয়াও হেসে ফেললো, কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সোমা ছুটতে ছুটতে এলো, উত্তেজিত গলায় বললো,
ছাদ থেকে তোর কাকার গাড়ি দেখলাম মোড়ের মাথায়, শিগগির ঘরে যা!
আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না অদ্বিতীয়া, দৌড়ে হোস্টেলে ঢুকে পড়লো, ছোট কা দেখতে পেলে খুব রেগে যাবে সেটা ও খুব ভালো করেই জানে।
ক্রমশ
#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২২
উচ্চ মাধ্যমিকে অদ্বিতীয়া যথেষ্টই ভালো ফল করলো, তার ফলে প্রতাপ সান্যাল বাস্তবিকই খুশি হলেন। সে কাকার সঙ্গে ইস্কুল থেকে মার্কশিট নিয়ে ফিরে এসে যখন দাদু কে প্রণাম করলো, প্রতাপ বাবু প্রায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন,
আমি খুব খুশি হয়েছি দিদিভাই, তুমি আমার বংশের মান রেখেছো। এই হলো সান্যাল বংশের মেয়ের মতো রেজাল্ট! শোনো আমি তোমার জন্যে খুব ভালো কলেজের কথা ভেবে রেখেছি! তুমি তো আর যে সে কলেজে ভর্তি হতে পারো না! কোন বিষয় নিয়ে পড়বে তুমি?
অদ্বিতীয়া বরাবরই দাদু কে খুশি দেখতে চাইতো, দাদুর খারাপ লাগে এমন কোনো কাজ সে কখনো করতো না। দাদু তার রেজাল্টে খুশি হয়েছেন জেনে সে শান্তি পেলো, উচ্ছসিত গলায় বললো,
দাদু ভাই, আমার ছোট কার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে! আমি ল পড়বো! ছোট কা সব ব্যবস্থা করে দেবে বলেছে!
প্রতাপ সান্যাল ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, বিস্ময়ের গলায় বললেন,
তুমি আইন নিয়ে পড়বে! কোর্টে গিয়ে ঘর ভর্তি লোকজনের সামনে সওয়াল জবাব করবে! ছি ছি! এ কেমন কথা! বনেদি বাড়ির মেয়ে তুমি, এ কেমন রুচি তোমার! আমার সব চেয়ে অদ্ভুত লাগছে, সুকান্ত এতে রাজি হলো! সে নিজে একজন উকিল হয়ে জানে না, যে কোর্টে কতো ধরনের লোকজন থাকে! তুমি যাও এখন, আমি তোমার জন্যে অন্য ভালো কলেজে অনার্স নিয়ে পড়ার ব্যবস্থা করছি!
অদ্বিতীয়ার মুখ শুকিয়ে গেলো, সে অনেক দিন থেকে কাকা, দাদুর মতো উকিল হওয়ার স্বপ্ন দেখেছে! আজ দাদু যদি শেষ পর্যন্ত রাজি না হন তাহলে তার কি হবে ভাবতে ভাবতে সে করুণ মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সন্ধ্যে বেলায় সুকান্ত কোর্ট থেকে ফিরতেই অদ্বিতীয়া কাকার ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলো,
ছোট কা! দাদুভাই আমাকে অনার্স নিয়ে ভর্তি হতে বলছেন!
সুকান্ত টেবিলের ওপর ফাইল রাখছিলেন, ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললেন,
তুই যে বললি ল পড়বি?
সেটাই তো! দাদুভাই রাগ করছেন, বলছেন ওখানে অনেক বাইরের লোকজন থাকে!
হতাশ গলায় বললো অদ্বিতীয়া। সুকান্ত বিরক্ত হলেন,
মানে! ওটা তো কাজের জায়গা! সেখানে আমরা কাজ করতে যাই! সেখানে বাইরের লোকজন তো থাকবেই! যত্ত সব অদ্ভুত অদ্ভুত কথা! তুই যা এখন, আমি পরে বাবার সঙ্গে কথা বলে নেবো!
অদ্বিতীয়া চলে যাবার জন্যে ঘর থেকে বেরোতে যাচ্ছিলো এমন সময় সরযূ পর্দা সরিয়ে ঢুকলেন, নাতনির দিকে তাকিয়ে রাগের গলায় বললেন,
এই মেয়ের পেটে পেটে অ্যাতো! দাদুর কোনো কথাই শুনতে নেই, তাই না? অমনি কাকার কাছে নালিশ করতে চলে এসেছিস!
অদ্বিতীয়ার মুখ শুকিয়ে গেলো, সে কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সুকান্ত মায়ের দিকে তাকালেন,
নালিশ আবার কি! ও যেটা পড়তে চায়, বাবা রাজি হচ্ছেন না, এটুকুই শুধু বলতে এসেছে! তিল কে তাল করা তোমার সারা জীবনের অভ্যাস! সাধারণ কথা কে সাধারণ হিসাবে নিতে পারো না, তাই না?
সরযূ দুজনের দিকেই রাগের দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন, মনে মনে তিনি সুকান্ত কে বরাবরই সমীহ করে চলেন। তাঁর একার পক্ষে যুক্তি বুদ্ধি তে ছেলের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয় বুঝেই এই মুহূর্তে রণে ভঙ্গ দিয়ে তাড়াতাড়ি তিনি নিজের ঘরের দিকে রওনা দিলেন। তিনি যখন ঘরে ঢুকলেন তখন প্রতাপ বাবু চেয়ারে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বসে ছিলেন, ঘরে ঢুকেই সরযূ তীক্ষ্ণ গলায় স্বামী কে উদ্দেশ্য করে বললেন,
চোখ বন্ধ করেই বসে থাকো সারাজীবন, এদিকে যে তলে তলে সান্যাল বাড়ির সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে সে খবর রাখো?
প্রতাপ সান্যাল চোখ খুলে সোজা হয়ে উঠে বসলেন, স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বিষয়ের গুরুত্ব বুঝতে চেষ্টা করলেন, তারপর প্রশ্ন করলেন,
কে আবার সর্বনাশ করছে?
সরযূ নিজের গলার আওয়াজ নিচু করলেন,
তোমার ছোটো ছেলে আর তোমার ওই নাতনি! তুমি সকালেই তাকে ঐসব পড়তে বারণ করে দিলে, এখন সে গিয়ে কাকার সঙ্গে জোট বেঁধে তোমাকে অপমানের চেষ্টা করছে! তার এতো সাহস যে তোমার বলা কথার ওপরে সে কথা বলে! বলছে সে ওই আইন নিয়েই পড়বে! ছ্যা ছ্যা! সারা পাড়ায় ঢি ঢি পড়ে যাবে গো! সান্যাল বাড়ির মেয়ে নাকি পুরুষ দের সঙ্গে দাঁড়িয়ে তক্ক করছে কোর্টে!
প্রতাপ সান্যাল সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, নাতনির নাম ধরে চিৎকার করে ডাকলেন, তাঁর আওয়াজে অদ্বিতীয়া ভয়ে পড়িমরি করে দৌড়ে এলো। বাবার গলার আওয়াজ সুকান্তর কানেও গিয়েছিলো, ভাই ঝি বিপদে পড়তে চলেছে বুঝেই তিনিও পেছন পেছন বাবার ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালেন। ততোক্ষনে অদ্বিতীয়া দাদুর ঘরে ঢুকে গিয়েছিলো, তাকে দেখেই প্রতাপ বাবু কড়া গলায় বললেন,
আমি তোমাকে বলে দিয়েছি তুমি অনার্স নিয়ে পড়বে, তারপরেও তুমি আবার একই বিষয় নিয়ে সুকান্তর সঙ্গে আলোচনা করছো!
অদ্বিতীয়া ঢোক গিলে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই সুকান্ত ভেতরে ঢুকে এলেন, মায়ের দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের গলায় বললেন,
ধৈর্য্য বড্ড কম তোমার! এরমধ্যেই বাবা কে এসে বলে দিয়েছো! ইচ্ছে করেই বাবা কে সব সময় উত্তেজিত করার চেষ্টা করো তাই না? বয়স তো হচ্ছে, এবার এসব বন্ধ করো! নিজের সম্মান নিজেকেই ধরে রাখতে হয়! এইসব ঘটনার পরেও কি তোমার নাতনি তোমায় সম্মান করবে বলে ভাবো?
সরযূ স্বামীর দিকে তাকালেন, প্রতাপ সান্যাল ছেলের দিকে ফিরে গম্ভীর গলায় বললেন,
তুমিই যত নষ্টের গোড়া!! ভাই ঝি কে প্রশ্রয় দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলছো! কোনো দিনও শুনেছ আমাদের বাড়ির মেয়েরা কোর্টে গিয়ে সওয়াল জবাব করছে!
সুকান্ত হাসলেন, বিদ্রুপের সুরে বললেন,
আমাদের বাড়ির মেয়েরা! আমাদের বাড়িতে আবার মেয়ে কবে হলো? আজ পর্যন্ত তো সান্যাল বংশে মেয়ে হয়েছে বলে শুনিনি কখনো! আর যদি আমাদের বংশধরদের কথা বলো, তাহলে তো সান্যালদের একটাই পেশা, ওকালতি! বংশ পরম্পরায় চলছে! তোমরা করেছো, তোমাদের বাবা, কাকারা করেছে, আমরা করছি, পরের প্রজন্মও করতে চাইছে! অসুবিধাটা কোথায়?
সরযূ এবার মুখ খুললেন, প্রায় তেড়ে উঠে বললেন,
বংশধর আবার কি? মেয়ে সন্তান আবার বংশধর হয় নাকি! ছেলেদের যা শোভা পায়, মেয়েদের তাই পায় নাকি! একে তো আমার কপালটাই মন্দ, আজ পর্যন্ত সান্যালদের কোনো তরফেই মেয়ে হয়নি, আমারই হলো! তারপরে সে মেয়ে আবার কালো কোট চাপিয়ে তক্কো করতে যাবে! এ আমি কিছুতেই হতে দেবো না! একবার বদনাম ছড়ালে আর এ মেয়ের বিয়ে দিতেও পারবে না তুমি, এই বলে দিলাম।
প্রতাপ বাবু সুকান্ত কে অগ্রাহ্য করে এই বার বড়ো ছেলের নাম ধরে চিৎকার করলেন। রতিকান্তর এটা আনন্দের সময়, এই সময়ে সে নিজের ঘরে মদের বোতল খুলে বসে, বাবার চিৎকারে বিরক্ত ভঙ্গিতে বউয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
বড়ো কর্তার হলো কি? সন্ধ্যে থেকেই গলা শোনা যাচ্ছে আজ!
সরলা আলনায় জামা কাপড় ভাঁজ করে রাখছিলো, বিরক্তির সুরে বললো,
বাবা তো তোমার! তিনি কেনো বিরক্ত সে খবর তো তোমারই রাখার কথা! তোমার নাম ধরেই তো চিৎকার করছেন, যাও, গিয়ে দেখো কি হয়েছে!
রতিকান্ত মাথা নাড়লো, নির্বিকার ভঙ্গিতে গেলাসে মদ ঢালতে ঢালতে বললো,
ধুস! নাম ধরে ডাকলেই যেতে হবে নাকি! বেশি ডাকাডাকি করলে বলে দিও, আমি বোতল নিয়ে বসেছি! প্রতাপ সান্যালের কিছু বলার থাকলে বলে যাবে এখানে এসে!
ইতিমধ্যেই সান্যাল মশাইয়ের গলা আরো জোরে শোনা যাচ্ছিলো, বাপের ডাকে মাতাল রতিকান্ত কে বিন্দুমাত্র বিচলিত হতে না দেখে অগত্যা বাধ্য হয়েই সরলা শ্বশুরমশাই এর ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
আপনার ছেলে এখন আসতে পারবে না বাবা, কি জন্যে ডেকেছেন ওকে সেটা আমাকেই বলুন!
প্রতাপ বাবু বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেও মনে মনেই জানতেন বড়ো ছেলে রতিকান্ত সব সময়ই তাঁর বিরুদ্ধে যেতেই পছন্দ করে। অনেকটা বাধ্য হয়েই তিনি বৌমা কে উদ্যেশ্য করে বললেন,
আমার নাতনি ল পড়তে চাইছে! আমি তাতে আপত্তি জানিয়েছিলাম, কিন্তু তার কাকাও তাকে ল পড়াতে চায়। মেয়ে তোমাদের, তোমরাই ঠিক করো সে কি করবে! যাদের মেয়ে, তাদের মতামত ই আমি নেবো, এ ব্যাপারে অন্য কারো কথা শুনবো না!
সরলা বুদ্ধিমতি, প্রতাপ সান্যাল যে যুক্তিতে ছোটো ছেলের সঙ্গে পারবেন না, সেটা বুঝেই বড়ো ছেলে কে জড়িয়ে ফেলতে চাইছেন, সেটুকু বুঝতে তার একটুও দেরি হলো না। সে মৃদু গলায় মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে শ্বশুর মশাই কে উদ্দেশ্য করে বললো,
জন্মের প্রমাণপত্রে নাম থাকলেই কি আর বাপ হওয়া যায় বাবা? আজ পর্যন্ত আপনার বড়ো ছেলে কোন দায়িত্বটা পালন করেছে বলুন তো? এই তো আজ আপনি ডাকলেন, তাও মেয়ের ব্যাপারে কথা বুঝেই সে এ ঘরের দিকে পা বাড়ালো না! আসল বাপ তো ছোড়দাই, আজ পর্যন্ত মেয়ের ব্যাপারে তিনি যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাতে তার ভালো বই খারাপ হয়নি কখনো। আজও তিনিই যা ঠিক করবেন সেটাতে ওর ভালোই হবে নিশ্চয়ই।
প্রতাপ সান্যাল ক্ষুব্ধ হলেন, বিরক্তির গলায় বললেন,
আমি প্রথম থেকে লক্ষ্য করেছি বৌমা, তুমি মা হয়েও মেয়ের দায়িত্ব নিতে চাওনি কখনো! গতবার তো সরাসরি আমার মুখের ওপরে না বলে দিয়েছো! সুকান্তর ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে তুমি নিজেকে দায়িত্ব মুক্ত করতে চাইছো! তোমার এই মানসিকতা আমার ভালো লাগছে না!
সরলা তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো, মৃদু গলায় বললো,
আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না বাবা! আমি সাধারণ ঘরের বউ, এসব ওকালতি পড়া বা না পড়ার ব্যাপারে কি বুঝি বলুন? কোনটা মেয়েদের পেশা হতে পারে, কোনটা নয়, এ ব্যাপারে সত্যি আমার কোনো ধারনাই নেই! আর আপনার বড়ো ছেলে তো সারাজীবন ঘরে বসেই কাটিয়েছে, সে এসব ব্যাপারে কি সিদ্ধান্ত নেবেন বলুন তো? সেই জন্যেই আমি ছোড়দার কথা বলেছিলাম, উনি এসব ব্যাপারে আমাদের থেকে তো বেশি জানেন অবশ্যই, তাই না?
বৌমা তাঁকে অসম্মান করছে না বুঝে প্রতাপ বাবু শান্ত হলেন, গম্ভীর গলায় বললেন,
আচ্ছা, সে ঠিকই বলেছো অবশ্য, তোমার এ ব্যাপারে ধারণা না থাকাই স্বাভাবিক! তবে মেয়েদের পেশার কথা আসছে কেনো? সান্যাল বাড়ির মেয়েকে কি ভবিষ্যতে চাকরি করে খেতে হবে নাকি? সে ভালো কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভালো ফল করে বেরোবে, ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে! আমি তার জন্যে তার উপযুক্ত পাত্রের খোঁজই করবো! কেউ যাতে কখনো না বলতে পারে যে আমার বংশের মেয়ের উপযুক্ত পাত্র আমি তার জন্যে জোগাড় করে উঠতে পারিনি! এইসব ওকালতি ছেলেদের জন্যে, কোনো বনেদী বাড়ি তাদের ছেলের জন্যে উকিল বউ খোঁজে না! তারা সব সময় শিক্ষিত, সুন্দরী, বনেদী, ঘরোয়া পাত্রীর খোঁজ করে!
সুকান্ত বাবার দিকে তাকিয়ে বিরক্তির গলায় কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সরলা তাঁকে থামিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো, বললো,
সে ঠিক আছে বাবা, এটা আপনি ঠিকই বলেছেন, আমি এ ব্যাপারে আপনার সঙ্গে একমত। বনেদী ঘরের মেয়েদের চাকরি করা আমারও একটুও পছন্দ নয়। তবে আমি একটা কথা ভাবছিলাম, ওকালতি পড়লেই কি উকিল হয়ে কোর্টে যেতেই হবে বাবা? ওর যখন শখ হয়েছে পড়ুক না হয়! চাকরি না করলেই তো হলো, তাই না?
সরযূ পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন, রাগের গলায় বললেন,
তা এ পড়ে কি করবে শুনি? কোন কাজে লাগবে এ পড়া?
সরলা হাসলো, শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে বললো,
অনার্স পড়েই বা কি কাজে লাগবে মা? সেই একটাই তো কাজ! বিয়ে! তা কাজে যখন কোনোটাই আসবে না, তখন নাহয় ওর শখ টুকুই পূরণ হোক!
আর আত্মীয় স্বজন? পাড়ার লোক? তারা আমাদের ছেড়ে দেবে? পাড়ায় মুখ দেখাতেই পারবো না, সেকথা ভেবেছো কখনো?
শাশুড়ির কথা কে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে সরলা এবার শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকালো,
বাবা! পাড়ায় বা আত্মীয় মহলে কেউ বললে আপনি না হয় বলবেন, আপনার বংশ মর্যাদার কথা ভেবেই আপনি ওকে এটা নিজেই পড়তে দিয়েছেন। হাজার হোক, বংশধর হোক বা না হোক, সান্যাল বাড়ির মেয়ে তো! সেও তো বংশের বাইরে যেতে পারে না, তাই না? ওকালতি ছাড়া এবাড়ির কোনো সন্তান অন্য কিছু পড়বেই বা কেনো?
এবার প্রতাপ সান্যাল খুশি হলেন, বৌমার দিকে তাকিয়ে সপ্রশংস গলায় বললেন,
দেখেছো গিন্নী, এই জন্যেই বলি বংশ বনেদী হলে তাদের ভাবধারাও বনেদী হয়! বৌমা এটা একদম ঠিক বলেছে! আমার বাড়ির মেয়ের তো ওকালতি পড়াই উচিত! তবে বৌমা, আগেই বলে দিলাম, চাকরি কিন্তু সে করবে না! শুধু তার ইচ্ছে, আর আমার বংশগত ওকালতির কথা ভেবেই তাকে আমি অনুমতি দিচ্ছি! একথা আমি আজ এখানে দাঁড়িয়েই বলে দিলাম!
অদ্বিতীয়া করুন গলায় কিছু প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিলো, সরলা তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
বাবা! আপনি বলছিলেন না আমি কিছু দায়িত্ব নিতে চাইনা! এই দায়িত্বটা আমি নিলাম! এই বংশের মেয়ে যেনো কোনোদিনও চাকরি না করে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার!
ক্রমশ