সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-২৯+৩০+৩১

0
222

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ২৯
আলো ঝলমলে দোতলা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়িয়ে চমকে গেলেন সুকান্ত, আগের বারের দেখা পলেস্তারা খসা বাড়িটার সঙ্গে এর আকাশ পাতাল পার্থক্য। খানিকটা বিস্ময় নিয়েই তিনি ভাই ঝির দিকে তাকালেন,

ঠিক বাড়িতে এলাম তো রে পিয়া? বাড়িটা তো একতলা ছিলো মনে পড়ছে যদ্দুর!

বাড়ি যে একতলা থেকে দোতলা হয়েছে, সুমন এবং সোমার সৌজন্যে সে খবর জানা ছিলো অদ্বিতীয়ার, তবুও তারও এতটা আশা ছিলো না। নিজের বিস্ময় লুকিয়ে না রেখে সে ঘাড় হেলিয়ে বললো,

সোমার কাছে শুনেছিলাম ছোট কা! ওদের বাড়ি দোতলা হয়েছে, তবে এতো সুন্দর সেটা ভাবি নি!

সুকান্ত চারপাশে তাকালেন, আশেপাশের বাড়িগুলির মধ্যে কয়েকটা বাদে বাকিগুলোর অবস্থাই বুঝিয়ে দেয়, এটা মোটামুটি নিম্ন এবং মধ্যবিত্তের বসবাসের জায়গা। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে নতুন ঝাঁ চকচকে বাড়িটা বাকি যে কটা বড়ো বাড়ি দেখা যাচ্ছিল, তাদের কেও পেছনে ফেলে দিচ্ছিলো প্রায়। সুকান্ত অবাক হলেন,

মাত্র কয়েক বছরে এতো পরিবর্তন! সোমার বাবা, দাদারা করেন কি?

অদ্বিতীয়া চুপ করে থাকলো, পরিবর্তনের রহস্য ফাঁস করা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। সুকান্ত কয়েক মুহূর্ত ভাবলেন, তারপরে ভাই ঝির দিকে তাকিয়ে বললেন,

আমার একটু খটকা লাগছে! আমরা সম্ভবত ভুল বিয়ে বাড়িতে এসে পড়েছি! একটা কাজ কর, আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি, তুই একবার ভেতরে গিয়ে দেখে আয় বরং। যদি ঠিক বাড়ি হয় তাহলে আমাকে ওখান থেকেই হাত দেখিয়ে বলিস, আমি চলে যাবো, আবার সাড়ে নটা নাগাদ এসে নিয়ে যাবো তোকে!

অদ্বিতীয়া ঘাড় কাত করলো, যদিও সে যে ঠিক বাড়িতেই এসেছে, সে নিয়ে তার কোনো দ্বিধা ছিলো না, তবু ছোট কার কথা অনুযায়ী সে সবে মাত্র বাড়ির দিকে পা বাড়িয়েছিলো, এমন সময় একটা সাদা রঙের অ্যাম্বাসেডর তাদের গাড়ির ঠিক পাশে এসে দাঁড়ালো। সুকান্ত ফিরে তাকালেন, গাড়ির দরজা খুলে যে চারজন যুবক নেমে এলো, তাদের দেখেই তাঁর মুখে বিস্ময়ের ছায়া পড়লো,

এরা তো সবাই আমাদের ক্লাবে খেলে! এখানে কি করছে!

অদ্বিতীয়া মনে মনে প্রমাদ গুনলো, সে কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই ফুলে সাজানো গেটের ভেতর থেকে সোমা বেরিয়ে এলো, বন্ধু কে দেখে হাসি মুখে হাত নেড়ে ডাকলো। সুকান্ত সেটা লক্ষ্য করলেন, ভাই ঝির দিকে তাকিয়ে বললেন,

যা, তোর বন্ধু ডাকছে, আমরা ঠিক বাড়িতেই এসেছি তাহলে!

অদ্বিতীয়া হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, দৌড়ে বন্ধুর দিকে এগিয়ে গেলো। ভাই ঝি যতক্ষন না বাড়িতে ঢুকছে ততক্ষন সুকান্ত ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলেন, তারপরে ধীরে সুস্থে গাড়ি নিয়ে মোড়ের মাথার চায়ের দোকানে এসে বসলেন। সম্ভ্রান্ত চেহারার সুকান্ত কে এই অঞ্চলের ছোট্ট চায়ের দোকানে বসতে দেখে মাঝ বয়সী দোকানি দৌড়ে এগিয়ে এলেন, শশব্যস্ত হয়ে বললেন,

চা দেবো স্যার?

সুকান্ত হাসলেন,

হ্যাঁ, দিন, সঙ্গে দুটো বিস্কুট।

খালি দোকানে চায়ের কাপ হাতে উকিল সুকান্ত দোকানির সঙ্গে কিছুক্ষনের মধ্যেই খোশগল্পে মেতে উঠলেন, এরকম সম্ভ্রান্ত খদ্দের পেয়ে দোকানি নিজেও যথেষ্ট উৎফুল্ল ছিলেন,

কাছে পিঠে কোথাও এসেছেন স্যার? কোনো প্রয়োজন?

দোকানির প্রশ্নে সুকান্ত হাসলেন,

হ্যাঁ, ওই যে বিয়ে বাড়িটা! ওর পাশেই একটা বাড়িতে!

দোকানি কৌতুহলী হলেন,

নিশ্চয়ই শুভদের বাড়িতে স্যার! তাই না?

না, না, আমি আসলে একটা বাড়ি খুঁজতে এসেছিলাম, অনেকদিন আগে এসেছিলাম তো, তাই ভদ্রলোকের ঠিকানাটা কিছুতেই খুঁজে বার করতে পারলাম না! কিন্তু শুভ কে? তার বাড়িতে এসেছি বলে মনে হলো কেনো আপনার?

দোকানি ভদ্রলোক হাসলেন,

আসলে ওর বাবা বড়ো অফিসার তো, তাই আপনাকে দেখে মনে হলো হয়ত ওদের বাড়ীতেই এসেছিলেন। এ পাড়ায় যেটুকু ভদ্রলোকেরা আসেন, সেতো ওই শুভদের বাড়িতেই! বাবাও অফিসার, ছেলেও বড়ো ইঞ্জিনিয়ার, খুব বড়ো পরিবার ওরা। ইদানিং ছেলে একটু গন্ডগোলে জড়িয়েছে শুনলাম, তাই মাঝে মধ্যেই লোকজন আনাগোনা করছে! আমি ভাবছিলাম, আপনিও হয়ত সেরকমই কিছুর জন্যে এসেছেন!

সুকান্ত হাসলেন,

ওহ! আচ্ছা! না, আমি কোনো গন্ডগোলের মিটমাট করতে আসিনি, আমি অনেকদিন আগের পরিচিত একটা বাড়ি খুঁজতে এসেছিলাম! আমার মনে পড়ছে আমি যে বাড়িটা খুঁজছিলাম, সেটা ওই বিয়ে বাড়িটার পাশেই! তবে সে অনেকদিনের কথা! অনেক আগে এসেছি, আমার বন্ধু ছিলো, একসঙ্গে পড়াশোনা করেছিলাম, নাম সন্তু, চেনেন নাকি?

ইচ্ছাকৃত ভুল নামের কাউকে চেনা দোকানির পক্ষে সম্ভব ছিলো না, তিনি চিনলেনও না, ঘাড় নেড়ে বললেন,

না, স্যার! অনেকদিন আছি এখানে! তবে চিনতে পারলাম না! হয়ত আগে থাকতেন, এখন আর থাকেন না!

সুকান্ত সহমত হলেন,

হতেও পারে! সেকি আজকের কথা! আমার বয়স কি কম হলো! তবে ওই বিয়ে বাড়িটা তো পুরো পাল্টে গেছে দেখলাম! আগে এতো বড়ো ছিলো না!

দোকানি ভদ্রলোক হাসলেন,

সেতো পাল্টাবেই স্যার! ছেলে অতো বড়ো ক্লাবে খেলছে! ওই টাকাতেই তো ভোল বদলে গেছে বাড়ির!

সুকান্ত সতর্ক হলেন,

ভালো, ভালো! আপনার পাড়ার ছেলেই তো! আপনি তো খুব খুশি দেখছি! তাই আসার সময় দেখলাম ক্লাবের ছেলেরা সব গাড়ি থেকে নামছে! ওই বাড়ির ছেলে ফুটবলার নাকি? নাম কি? কোন পজিশনে খেলে?

দোকানি গর্বিত হলেন,

হ্যাঁ স্যার! আমার পাড়ারই ছেলে! সুমন স্যার, সুমন ব্যানার্জি! স্ট্রাইকার স্যার! নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই? খুব ভালো ছেলে, সেই ছোটো থেকে দেখছি! ছোটো থেকেই পাড়ায় খুব পপুলার, যেকোনো বিপদে সব সময় থাকতো! এখন তো এতো ব্যস্ত, তাও সব সময় হাসি মুখ, দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দাঁড়িয়ে কথা বলবেই!

সুকান্ত চায়ের কাপে শেষ চুমুক দিয়ে কাপ টা দোকানির দিকে বাড়িয়ে ধরলেন,

চা টা খুব সুন্দর হয়েছে, আর এক কাপ দিন, এটাতেই ঢালুন!

দোকানি খুশি হলেন, দ্বিতীয় বার পরিপূর্ণ কাপ হাতে নিয়ে সুকান্ত আয়েস করে বসলেন,

বাড়িতে কে কে আছে ছেলেটির? বিয়েটা কার? ওরই নাকি?

দোকানি মাথা নাড়লেন,

না, না, স্যার, ওর দাদার! তবে ছোটো ছেলের বিয়েও লাগলো বলে! লোকজন পেছনে লাইন দিয়ে রেখেছে! নেহাৎ ছোটো বোনের বিয়ে বাকি আছে তাই, না হলে এতদিনে হয়ে যেত! ছেলে ভালো, তবে বাপ, মা একটুও সুবিধার না! ছেলের ঘাড়েই কাঁঠাল ভেঙে কাজ হাসিল করছে, ওই ছেলে কে দেখিয়েই তো বড়ো ছেলের বিয়ে হলো! না হলে বাকিরা আর করে কি! এতদিন তো কোনোক্রমে চলতো, এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ!

সুকান্ত হাসলেন,

বাড়ি তো বেশ জম্পেশ করেছে দেখলাম!

দোকানি সহমত হলেন,

হবে না! কতো টাকায় সই করিয়েছে বলুন তো! আবার তো শুনছি নাকি অন্য ক্লাব ডাকাডাকি করছে! নিশ্চয়ই অন্য জায়গায় আরো বেশি পাচ্ছে!

সুকান্ত দোকানি কে থামিয়ে দিলেন,

টাকাটা বড়ো কথা নয়! আসল কথা ভালোবাসা! ক্লাবের প্রতি টান! সেই টানে থেকে যায় নাকি দেখা যাক!

সে ঠিক বলেছেন স্যার! থেকেই যেতো হয়ত! কিন্তু বাপ, মার যা নোলা! থাকতে দিলে তো! ছেলেটা কে দুয়ে নিতে চায় একদম! আসলে ছিলো তো হাভাতে, ছেলের কল্যাণে টাকার মুখ দেখছে! যা হয় আর কি! বিশাল পয়সার গরম এখন, ধরা কে সরা জ্ঞান করছে! ছেলের কোনো পরিবর্তন নেই, কিন্তু বাড়ির লোকেদের আর চেনা মুশকিল! মাটিতে পা পড়েনা এখন!

একটু কুণ্ঠিত হয়েই সোমার সঙ্গে ভেতরে ঢুকলো অদ্বিতীয়া, এর আগে সে কখনো কোনো বিয়ে বাড়িতে একা যায় নি। এমনিতে তাদের প্রচুর আত্মীয় স্বজন, সেখানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাড়ির সবার সঙ্গেই সে গিয়েছে, তারাও সবাই পরিচিত মুখ, তাই এখানে একা এসে একটু অস্বস্তি লাগছিলো তার। অদ্বিতীয়ার চোখ সুমন কে খুঁজছিলো, আশেপাশে তাকে কোথাও দেখা যাচ্ছিলো না, শেষ পর্যন্ত ধৈর্য্য রাখতে না পেরেই সে সোমা কে প্রশ্ন করলো,

তোর দাদা কই? দেখছি না তাকে?

সোমা হাসলো,

দাদার ক্লাবের সবাই এসেছে, তাই ব্যস্ত! তোর সামনেই তো কয়েকজন নামলো, দেখিস নি?

অদ্বিতীয়া ঘাড় কাত করলো, দেখেছে। নতুন বৌদির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলো সোমা, তারও যথেষ্টই ব্যস্ততা ছিলো আজ, দু এক মিনিট কথা বলার পরেই সে বন্ধু কে বসতে বললো,

তুই এখানে বোস, বৌদির সঙ্গে গল্প কর, আমি একটু আসছি!

সোমা বেরিয়ে যাওয়ার পরে একাই বসে রইলো অদ্বিতীয়া, তার পোশাক, পরিচ্ছদ অন্য দের থেকে অনেকটাই আলাদা ছিলো। বাড়ি বড়ো হলেও বাড়ির আত্মীয় স্বজনদের কোনো বদল হয়নি, তা তাদের পোশাক পরিচ্ছদে বোঝা যাচ্ছিলো। তাদের দেখতে দেখতে এই প্রথমবার দাদুর কথামতো বড়লোক আর বনেদী এই দুটোর স্পষ্ট ফারাক করতে পারছিলো অদ্বিতীয়া।

তাদের অনেক গরীব আত্মীয় স্বজন আছে, তারা দারুন কিছু দামী জামা কাপড় পরে না, কিন্তু সেই সব পোশাকের মধ্যে রুচির ছাপ থাকে। এখানে উপস্থিত মানুষজনের মধ্যে কেমন যেন নিজেকে মানিয়ে নিতে অস্বস্তি হতে লাগলো অদ্বিতীয়ার। তার এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য ছিলো সুমন, তাকে পাশে না পাওয়া তাকে আরো বেশি অভিমানী করে তুলছিলো, কিন্তু সুকান্তর আসতে দেরি আছে, তাই বাধ্য হয়েই বসে রইলো অদ্বিতীয়া। আশেপাশের নিমন্ত্রিত অতিথিদের ভীড় ক্রমশ বাড়তে লাগলো, একপাশে বসে তাদের গল্পই বাধ্য হয়ে শুনতে লাগলো সে।

বউ দেখেছো? বেশ ভালই দেখতে হয়েছে। ছেলের ওই তো ছিরি!

হলুদ রঙের শাড়ি পরিহিত এক মহিলা বললেন, পাশের মহিলা সহমত হলেন,

যা বলেছো! শুনলাম নাকি অনেক দিয়েছে! কি দেখে যে দিলো কে জানে বাবা! মাস গেলে কতো আর পায়, বউ কে খাওয়াতে পারলে হয়!

ওই ছেলে কে দেখে কি আর দিয়েছে নাকি! নাকি ঐ ছেলে বউকে খাওয়াবে? সবই তো ছোটো ছেলের দয়ায়! শুনলাম নাকি সতু মুখুজ্জের বউ তার মেয়ের সঙ্গে ছোটো ছেলের বিয়ে দেওয়ার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে। দুবেলা আসছে যাচ্ছে এখানে।

মুখরোচক আলোচনায় যোগ দিতে অদ্বিতীয়ার ঠিক পাশের চেয়ারে বসে বললেন আরেক মহিলা, অদ্বিতীয়া মনে মনে চমকে উঠলো। মহিলা ততোক্ষনে সতু মুখার্জির বউয়ের সমালোচনায় মুখর হয়েছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই অদ্বিতীয়া বুঝতে পারলো মহিলার নিজেরও কেও আছে যাকে সে সুমনের সঙ্গে বিয়ে দিতে চায়! পাশের মহিলা পরামর্শ দিলেন,

ওই দেখো, মা আসছে! বলেই দেখো একবার! দেওয়া থওয়া টা বলো ভালো করে, আমরা তো পাশেই আছি, এই সময় বলো। আমরাও বোঝাবো না হয়!

সুমনের মা কে এগিয়ে আসতে দেখেই মহিলা বিগলিত হলেন,

খুব ভালো বউ হয়েছে গো দিদি! এবার ছোটো ছেলের টা দাও দিকি! আমার দিদির মেয়েটার জন্যে কবে থেকে তোমার সঙ্গে কথা বলবো ভাবছি!

পাশের মহিলাও সঙ্গত করলেন,

মেয়ে তো খুব ভালো, আমরা জানি! কতো বার তোমার বাড়িতে এসেছে, নিজের চোখে দেখেছি! সাত চড়ে রা কাড়ে না! আর দেওয়া থোওয়া তো ভালই করবে নিশ্চয়ই! তোমার জামাইবাবুর তো ব্যবসা না গো?

আগের মহিলা সম্মতি জানালেন, কিন্তু যার উদ্দেশ্যে এতো কথা সেই সুমনের মা মুচকি হাসলেন,

দেওয়া বললেই কি আর দেওয়া গো! সেতো কতো লোক বলছে! দেওয়া থোওয়াতে কেউ পিছপা নেই! কিন্তু আগে তো মেয়েটাকে পার করতে হবে! তাকে না দিয়ে ছেলে কে দিই কি করে বলো! তোমার কথা মনে থাকবে, যখন ছেলের দেবো তোমাকে বলবো গো!

এরপরেই পাশে বসে থাকা অদ্বিতীয়ার দিকে নজর পড়লো তার,

ওমা! তুমি কখন এলে! বন্ধুর সঙ্গে দেখা হয়েছে?

অদ্বিতীয়া ঘাড় নাড়লো,

হয়েছে!

বাকি সকলের দৃষ্টি এবার তার দিকেই ঘুরল, অন্যদের সঙ্গে তাকে স্পষ্ট পার্থক্য করা যাচ্ছিলো, দু একজনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির উত্তরে সুমনের মা পরিচয় দিলেন,

আমার মেয়ের বন্ধু গো! একসঙ্গে হোস্টেলে থাকতো! খুব বড়োলোকের মেয়ে! এখন ওকালতি পড়ে!

সুমনের মা চলে যাবার পরে সোৎসাহি দর্শকরা তার দিকেই ঘুরে বসলো, বাড়ি কোথায়, কে কে আছে ইত্যাদি প্রশ্নের পর অদ্বিতীয়া মুক্তি পেল সোমার এসে পড়ায়। সোমা তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো তার নতুন কলেজের বন্ধুদের সামনে, বেশ কিছুক্ষন সেখানে গল্প চলার পর অদ্বিতীয়া তাদের সঙ্গেই খেতে বসলো। এতক্ষনে কিছুটা হলেও সমবয়সী কিছু মেয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে স্বস্তি লাগছিলো তার। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর পার করে ফেলেছে, সুকান্তর আসার সময় এগিয়ে আসছে অথচ সুমনের দেখা নেই। শেষ পর্যন্ত সোমার দ্বারস্থ হলো অদ্বিতীয়া, সুমন কে ডেকে দেওয়ার কথায় সোমা তাকে বাড়ির পেছন দিকে নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো,

তুই এখানে দাঁড়া! আমি ছোড়দা কে ডেকে দিচ্ছি!

মশার কামড় খেতে খেতে অপেক্ষা করতে লাগলো অদ্বিতীয়া, বেশ কিছুক্ষন পরে সুমন হন্তদন্ত হয়ে এলো,

সরি! আসলে আমার ক্লাবের সবাই এসেছিলো, তাই আসতে পারিনি!

তুমি তো জানতেই ওরা আসবে! তাহলে আমায় আসতে বললে কেনো? জানো শুধু মাত্র তোমার সঙ্গে দেখা করবো বলে আমি কতো রিস্ক নিয়ে এখানে এসেছি!

ক্ষোভের গলায় বললো অদ্বিতীয়া, আচমকা সুমন বিরক্ত হলো,

আজ দাদার বৌভাত! বাড়ি ভর্তি লোকজন। ক্লাবের বন্ধুরা, পাড়ার বন্ধুরা ওরা যে আসবেই, সবাই কে নিয়ে আমিও যে ব্যস্ত থাকবো এগুলো কি তুমি জানতে না? এখানে তোমাকে আমি আলাদা করে সময় দিতে পারবো এটা তুমিই বা কি করে ভেবেছিলে?

দাদুভাই আসতে দিতে চান নি! ছোটকা তোমার ক্লাবের অন্য ফুটবলারদের আমাদের সামনেই গাড়ি থেকে নামতে দেখেছে! আমি কতটা বিপদে পড়তে পারি তোমার কোনো আন্দাজ আছে? যদি জানতাম তুমি এতটাই ব্যস্ত থাকবে, তাহলে এতো রিস্ক নিয়ে কিছুতেই আসতাম না! দাদুভাই জানতে পারলে আমার কলেজে যাওয়াই বন্ধ হয়ে যেতে পারে!

তাই নাকি! শুধু তুমিই বিপদে পড়বে! আর আমি? আমার সমস্যা হবে না? যদি কেউ জানতে পারে তোমার কথা, তাহলে এক্ষুনি ছড়িয়ে যাবে চারদিকে। এটা আমার বাড়ি, আমার পাড়া, এখানে তোমাকে কেউ চেনে না, কিন্তু সবাই আমাকে চেনে! এইভাবে কোনো অনুষ্ঠান বাড়িতে কাউকে আলাদা করে সময় দেওয়া সম্ভব না!

সুমনের রাগের গলা অদ্বিতীয়ার ক্ষোভ আরো বাড়ালো, সে চাপা অথচ তীক্ষ্ণ গলায় বললো,

আসল কথা তো এইটাই! এতক্ষনে সেটা স্বীকার করলে! এখানে আমাকে তোমার সঙ্গে দেখলে তোমার বিয়ের হবু পাত্রীর সংখ্যা কমে যাবে তাই না? তুমি তো লোভনীয় পাত্র দেখলাম, মেয়ের মায়েরা তো তাদের মেয়েদের তোমার সঙ্গে বিয়ে দেওয়ার জন্যে লাইন লাগিয়ে দিয়েছে, কতো কি দেবে বলছে বিয়েতে সবাই! সেগুলো তো সব বন্ধ হয়ে যাবে তাহলে। বললেই পারতে আমাকে, আসতাম না এখানে!

বড্ড ফালতু কথা বলছো তুমি! কেউ তোমাকে জোর করে নিয়ে তো আসে নি এখানে! আমি তোমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম আসার জন্যে এটা ঠিক, কিন্তু আলাদা করে শুধু তোমাকেই সময় দেবো, এরকম কোনো কথা আমি বলিনি। না পোষায় চলে যাও, ফালতু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভুলভাল কথা বলো না! আমার তোমার সঙ্গে ফালতু কথা বলে সময় নষ্ট করার মতো সময় নেই!

সুমনের কথাগুলো যেনো অদ্বিতীয়ার বুকে কাঁটার মতো বিঁধল, এই সুমন! এর জন্যেই ও এতো বাধা পেরিয়ে ছুটে এসেছে! কদিন আগেও যে সুমন ওর সঙ্গে দেখা করার জন্যে স্কুলের মাঠে দাঁড়িয়ে থাকতো, ওর গ্রামের বাড়িতেও পৌঁছে গিয়েছিলো, আজ তার এতো পরিবর্তন! এখন অদ্বিতীয়ার কথা কে ওর ফালতু মনে হচ্ছে! ওর সঙ্গে কথা বলা মানে সুমনের সময় নষ্ট হচ্ছে! সুমন ওর সঙ্গে সম্পর্ক কে সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখতে চায় ওর দাদুর জন্যে নয়, নিজের জন্যেই! অদ্বিতীয়ার চোখ জলে ভরে এলো, দাঁতে দাঁত চেপে চোখের জল লুকিয়ে রেখে সুমনের দিকে সরাসরি তাকালো অদ্বিতীয়া,

ঠিক আছে! আর তোমার সময় নষ্ট করবো না! আমি আসছি, যদি আমার সঙ্গে সম্পর্ক স্বীকার করতে তোমার এখন লজ্জা লাগে, তাহলে আর কোনোদিনও যোগাযোগ করো না! বুঝতেই পারছি, তুমি এখন অনেক বড়ো ফুটবলার, নিজের ইমেজ ধরে রাখতে চাও। তবে এইভাবে না বলে সরাসরি বললে খুশি হতাম! বাড়িতে ডেকে নিয়ে এসে এতোটা অপমান না করলেই পারতে!

সুমন কে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই, বাড়ির ভেতরে না ঢুকে বাগানের ভেতর দিয়ে সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ালো অদ্বিতীয়া। সুমন পেছন থেকে ডাকার আগেই সুকান্ত গাড়ি নিয়ে এসে দাঁড়ালেন, গাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে ঢুকতে অদ্বিতীয়া বললো,

চলো ছোটকা!

সুকান্ত গাড়ি ঘোরাতে ঘোরাতে ভাইঝির দিকে তাকালেন,

কেমন কাটলো বন্ধুর দাদার বিয়ে?

চোখ বন্ধ করে পেছনে হেলান দিতে দিতে অদ্বিতীয়া হাসলো,

দারুন! কোনোদিনও ভুলবো না!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩০
গলার কাছে দলা পাকিয়ে আছে কান্নাটা, চেষ্টা করেও অদ্বিতীয়া সেটা সরাতে পারছিলো না। বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরে আসার পরে চারদিন হয়ে গেছে, সুমন একবারের জন্যেও ফোন করে নি। যত বারই দাদুভাই এর ঘরে ফোনের আওয়াজ হয়েছে ও দৌড়ে গেছে, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত ফোন আসেনি।

ছোটো থেকে মা হারা, হেলাফেলায় মানুষ হওয়া অদ্বিতীয়া জীবনে প্রথম কারোর কাছে ভালোবাসা পেয়েছিলো, সেই ভালোবাসার মূল্য তার কাছে আলাদা। তার ধারণা ছিলো তার রাগ, তার অভিমান কে সুমন বুঝবে, মূল্য দেবে! তাই সেদিন রাগের মাথায় কখনো যোগাযোগ না করার কথা বলে এলেও সে আশা করেছিলো সুমন আবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। আজ চারদিন ধরে সে প্রতি মুহূর্তে আশা করছিলো হয় সুমন তাকে ফোন করবে অথবা তার সঙ্গে কলেজে এসে দেখা করে তার অভিমান ভাঙাবে।

সেই আশাতেই আজও সে কলেজ থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলো। বেশ খানিকক্ষন অপেক্ষার পরও যখন সুমন এলোনা, তখন সে শুকনো মুখে সুকান্তর জন্যে কলেজের গেটে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। কিছুক্ষন পরেই সুকান্ত এলেন, ভাইঝি কে শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু চিন্তিত হলেন,

কি হয়েছে? শরীর খারাপ নাকি? মুখ ওরকম শুকনো কেনো?

মুখে কথা না বলে ঘাড় নেড়ে গাড়িতে উঠে বসলো অদ্বিতীয়া, কথা বলতে গেলেই তার কান্না আসছিলো। বাড়িতে ফিরে এসেও সে মনমরা হয়ে রইলো, তাকে রাতে খেতে নিচে নামতে না দেখে সুকান্ত চিন্তিত হলেন,

পিয়া খেতে আসেনি? ওর কি হয়েছে? আজ ফেরার সময়ও দেখলাম মুখ শুকনো ছিলো!

প্রতাপ সান্যালও অবাক হলেন, গিন্নীর দিকে তাকিয়ে বললেন,

সেকি! সত্যিই তো! দিদিভাই খেতে নামেনি কেনো?

সরযূ বিরক্ত হলেন,

সেকথা আমাকে জিজ্ঞেস করছো কেনো? সেকি আমাকে কিছু বলে নাকি! তার তো যত কথা সব তার কাকার সঙ্গে! আমরা তো বানের জলে ভেসে এসেছি!

সান্যাল মশাই বিরক্ত হলেন,

আহ! বড্ড বিতর্ক সৃষ্টি করো! সোজা কথার সোজা উত্তর দিতে পারো না! জানো না, সেটা বলতে কি অসুবিধা?

তুমি কিছু জানো বৌমা?

এবার প্রতাপ বাবু সরলা কে প্রশ্ন করলেন, সরলা মাথা নাড়লো, মৃদু গলায় বললো,

না, বাবা, আমি তো কিছু জানি না। সেই সন্ধ্যেবেলা সন্ধ্যে দিতে নিচে নেমেছিলাম, তারপর থেকে আর ওপরে উঠিনি!

সেকি কথা! এসব আমার একটুও পছন্দ নয় বৌমা! বাড়িতে মা, ঠাকুমা থাকতে বাড়ির মেয়ে কেনো খেতে আসেনি, সে খবর কেউ রাখবে না! এসব কি?

যেহেতু তির তাঁর উদ্দেশ্যেও ছিলো তাই পুত্রবধূর উত্তর দেওয়ার আগেই সরযূ উত্তর দিলেন, তির্যক গলায় বললেন,

কেনো গো! অতো বড় মেয়ে! তার আবার খবর রাখতে হবে কেনো? আমার বয়স হয়েছে, নিজেরই সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট তার মধ্যে আবার ওই ধিঙ্গী মেয়েকে দেখে শুনে নাকি রাখতে হবে!

সান্যাল মশাই কিছু উত্তর দেওয়ার আগেই সরলা উঠে দাঁড়ালো,

আপনি খান বাবা! চিন্তা করবেন না, আমি ওপর থেকে পিয়ার খবর নিয়ে আসছি!

সরলা দোতলায় উঠে এসে দেখলো অদ্বিতীয়া পড়ার টেবিলে মাথা রেখে শুয়ে আছে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,

কি হয়েছে পিয়া? খেতে নামনি কেনো?

ছোটো মার গলা শুনে চোখ ভর্তি জল নিয়ে অদ্বিতীয়া মুখ তুলে তাকালো। চোখে জল দেখে সরলা বিস্মিত হলো,

চোখে জল কেনো! কিছু হয়েছে নাকি? কেউ কিছু বলেছে?

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

কিছু না! আমি খাবো না ছোটো মা, তুমি যাও! আমার শরীরটা ভালো নেই!

অদ্বিতীয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে সরলার সন্দেহ হলো, সে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে নিচে নেমে এলো। তাকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে প্রতাপ বাবু এবং সুকান্ত দুজনেই উদ্বিগ্ন হয়ে তাকালেন,

ও খাবে না! শরীর ভালো নেই! থাক এখন ঘুমাক একটু, আমি রাতে শোওয়ার আগে কিছু দিয়ে আসবো না হয়!

সরলার কথায় সান্যাল মশাই সন্তুষ্ট হলেন,

আচ্ছা! ঠিক আছে! তবে কিছু খেয়ে শুতে বোলো কিন্তু! রাত উপোসে হাতি পড়ে যায়!

সরলা ঘাড় নাড়লো,

হ্যাঁ, খেয়েই শোবে! ও নিজেই বললো সেটা!

রাতে খাওয়া দাওয়া মিটে যাওয়ার পরে যখন সরলা থালা হাতে দোতলায় উঠে এলো, তখন আশেপাশের সব বাড়ির আলো নিভে গেছে। অদ্বিতীয়া একই ভঙ্গিতে বসে ছিলো, তার দিকে তাকিয়ে সরলা হাসলো,

বাবা! সেই থেকে একভাবে বসে আছো! বসে বসে পায়ে খিল ধরে যাবে তো! চলো ছাদে যাই!

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

না, আমার ইচ্ছে করছে না! তুমি শুয়ে পড়ো ছোটো মা!

ইচ্ছে তো আমারও কতো কিছু করে না, কিন্তু অন্যের জন্যে বাধ্য হয়েই করতে হয়! তেমনি তুমিও না হয় আমার ভালোলাগার জন্যে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাদে গেলে একটু!

কেমন যেনো অসহায় লাগলো ছোটো মার মুখটা! সত্যিই তো, ছোটো মা কে তো কতো কিছুই ইচ্ছের বিরুদ্ধে করতে হয়! কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে চেয়ারটা ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো অদ্বিতীয়া,

আচ্ছা! চলো!

সরযূর অন্ধকার দরজার দিকে তাকিয়ে সতর্ক হয়ে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখলো দুজনে, ওপরে উঠে এসে সরলা দরজাটা চেপে আটকে দিলো। দেওয়ালে হেলান দিয়ে হাতের খাবারের থালাটা মেয়ের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সোজাসুজি অদ্বিতীয়ার চোখের দিকে তাকালো,

বলো এবার! কি হয়েছে! সুমনের বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই দেখছি মনমরা হয়ে রয়েছো! কিছু হয়েছে ওখানে?

ছোটো মা! আমার সব শেষ! সুমন আমাকে যে কি অপমান করেছে আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারব না!

সব শেষ! এ আবার কি কথা! কিছু হয়েছে হয়ত, সেটা মিটে যাবে একসময় বা নাও মিটতে পারে। সম্পর্ক থাকতে পারে বা নাও পারে, কিন্তু তার জন্যে তোমার সব শেষ হবে কেনো? যদি ধরো এমন কিছু হয় যে সম্পর্ক থাকলো না তাহলে কি সুমনেরও সব শেষ হবে? সে কি খেলা ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে বসে থাকবে তোমার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার দুঃখে? কখনোই থাকবে না! তাহলে তুমি নাওয়া খাওয়া ভুলে বসে থাকবে কেনো? তবে আমার জানতে ইচ্ছে করছে সুমন তোমাকে কি বলেছে!

অদ্বিতীয়া মুখ নিচু করলো,

আমাকে সময় দিলে ওর সময় নষ্ট হয় ছোটো মা! ওর বাড়িতে নাকি অনেক নিমন্ত্রিত, তাই আলাদা করে আমার জন্যে সময় নেই! ও আসলে সম্পর্কটা লুকিয়ে রাখতে চায়, অনেকেই এখন ওর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চায়, সেজন্যই ও আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে!

সরলা একদৃষ্টিতে অদ্বিতীয়ার মুখের দিকে তাকালো,

এটা আমিও মানি যে নিজের দাদার বিয়েতে ও ব্যস্ত থাকতে পারে, হয়ত তোমার জন্যে সময় বার করতে নাও পারে, কিন্তু অনেকে ওর সঙ্গে নিজের মেয়ের বিয়ে দিতে চায় বলে যদি তোমায় জানিয়ে থাকে তাহলে এটা সুমন সত্যিই খুব খারাপ কাজ করেছে!

অদ্বিতীয়া ঘাড় নাড়লো,

না এটা ও মুখে বলেনি, কিন্তু আমি দেখেছি! অনেকেই বিভিন্ন পাত্রীর কথা বলছিলো!

সরলা এবার হেসে ফেললো,

সেতো বিখ্যাত লোকেদের কতো ফ্যান থাকে! কিন্তু এতে তুমি অপমানিত হলে কেনো? সময় দিতে না পারার জন্যে যদি খারাপ লেগে থাকে তাহলে নিজেই ভাবো, তোমার বাড়িতে এটা হলে তুমি কাউকে আলাদা করে সময় দিতে পারতে কিনা! সুমন যোগাযোগ করেছে ওখান থেকে আসার পর থেকে?

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

নাহ! আমি চাইও না ও যোগাযোগ করুক!

সরলা হেসে ফেললো,

তাহলে তো ভালোই! তাহলে তো সুমনের অপমানে তোমার মন খারাপ হবার কথা নয়! তাদের ব্যবহারে আমরা দুঃখ পাই, যাদের আমরা ভালোবাসি! যেখানে সম্পর্কই নেই, সেখানে আবার কিসের অপমান! নাও, খেতে শুরু করো!

অদ্বিতীয়া চোখ মুছলো,

আমি সত্যি চাই না ও যোগাযোগ করুক, কিন্তু তবু কেনো জানিনা আমার মন খারাপ হচ্ছে!

সরলা আস্তে করে মেয়ের মাথায় হাত রাখলো,

আমরা অনেক সময় নিজেরাই জানি না, আমরা আসলে কি চাই! সময় নাও, তাড়াহুড়ো করে কিছু করোনা! আরো একটু ভেবে দেখো না হয়! শুধু নিজের দিক থেকে না ভেবে ওর দিকটাও ভাবো!

ওই মেয়েটার সঙ্গে পেছনের বাগানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল ছেলে তোমার! কেনো রে? কিসের অতো কথা! ওই জন্যেই ওকে নেমন্তন্ন করার জন্যে এতো লাফালাফি দুজনের তাই না! আমাকে জানতে দিতে চাস না, তাই না?

বাবার দিকে তাকিয়ে মায়ের দুপুরে খেতে বসে একই কথার পুনরাবৃত্তি তে সুমন লাফিয়ে উঠলো, থালা ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বললো,

আরে! ধুর! শান্তিতে খেতেও দেবে না মানুষ কে! আর কতো বার একই কথা বলবে! বৌভাত, অষ্টমঙ্গলা হয়ে গেলো দাদার, দাদা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলো তবু তোমার ঐ কথা আর বন্ধ হলো না! কি এমন অপরাধ করেছি! কথাই তো বলেছি দশ মিনিট! তাতেও তোমার আপত্তি!

সুমনের মা চিৎকার করে উঠলো,

শুনলে তোমার ছেলের কথা! আমার কিসের আপত্তি! সেটাও নাকি এখন ওকে বোঝাতে হবে! সতু মূখুজ্জের বউ, গণেশের মা সব সারাদিন বাড়িতে আসছে যাচ্ছে! মুখুজ্জের বউ তো শুধু হ্যাঁ বলার অপেক্ষা! সেদিন বৌভাতের রাতে তো ওই যতীন বাবুর বউও আমায় ধরেছিলো, ওর দিদির মেয়ের জন্যে বলছিলো। জামাইবাবুর নাকি বড়ো ব্যবসা! এই অবস্থায় একটা কেউ যদি ওই মেয়ের সঙ্গে দেখে, তাহলে আর বিয়ে দিতে পারবো!

সোমা খেতে খেতে মুচকি হাসলো,

তোমার মুখুজ্যের বউ অদ্বিতীয়া দের থেকেও বড়লোক! অদ্বিতীয়ার সঙ্গে তুমি ওর মেয়ের তুলনা করছো! যদি অদ্বিতীয়া কে ছোড়দা বিয়ে করে তাহলে ওর ডবল পাবে! বুঝলে!

হ্যাঁ, সেই বুদ্ধি নিয়েই তুমি চলো! ওই জন্যেই তো তুমি মেয়ে আর আমি মা! ওই মেয়ে কে বিয়ে করলে বাড়িতে এক পয়সাও আসবে না, তোমার দাদাকেই কিনে নিয়ে ঘর জামাই রাখবে তারা! তোমার বিয়ের পয়সা জোগাড় হবে না, সারাজীবন বাড়িতে বসে থাকতে হবে মনে রেখো!

সুমন ততোক্ষনে হাত ধুয়ে প্যান্ট পরে ফেলেছিলো, আলনা থেকে গেঞ্জি টেনে নিয়ে দরজা দিয়ে বেরোতে বেরোতে বললো,

ওই মেয়েকেই বিয়ে করবো! ক্ষমতা থাকলে আটকে দেখাও!

দরজায় দড়াম করে আওয়াজ করে সুমন বেরিয়ে গেলো, সোমাও মুখে বিরক্তি ভাব এনে খাওয়া শেষ করে উঠে যাওয়ার পরে সুমনের বাবা বউয়ের দিকে ঘুরে বসলো,

মাথা টা ঠান্ডা করো দিকি! যা করার ধীরে সুস্থে করো, ছেলেকে চটিয়ে কিছু করো না! মেয়ের বিয়েটা আগে পার করো, রাগ দেখিয়ে যদি সত্যিই ওই মেয়ে কে বিয়ে করে ঘরে তোলে, তাহলে আর এক পয়সাও বোনের বিয়ের জন্যে খরচা করবে না! নিজের ভালো পাগলেও বোঝে, তুমিই শুধু বোঝো না! এখন কেউ ছেলের বিয়ে দেয়! যার সঙ্গেই দাও না কেনো টাকা একবারই পাবে, তারপর থেকে সব বউয়ের হাতে থাকবে! তাই আগে অন্য সব কাজ মেটাও, এখন ছেলের বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ কোরো না!

সুমনের মা চুপ করে গেলো, স্বামীর কথাগুলো তার যথেষ্টই যুক্তিপূর্ণ মনে হলো। যতদিন ছেলে বিয়ে না করছে ততদিনই যে ছেলের টাকা তারই এটা বোঝার পরে আপাতত সে ছেলের বিয়ের প্রস্তাব মুলতুবি রাখলো।
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩১
জামা গলাতে গলাতে মাঠের পাশ দিয়ে ক্লাবের দিকে এগোতে এগোতে উল্টো দিক থেকে গৌর কে হেঁটে আসতে দেখলো সুমন, ওকে দেখেই গৌর দাঁড়িয়ে পড়লো,

কই যাস?

সুমন হাত তুললো,

ক্লাবের দিকে যাচ্ছিলাম, তুই চলে এলি নাকি!

গৌর হাসলো,

কটা বাজে ঘড়ি দেখছিস? নিজে তো খেয়ে দেয়ে এলি মনে হচ্ছে! ওদিকে আর কেউ নেই, সব বাড়ি গেছে, আমারও পেটে ছুঁচো ডন দিচ্ছে, বাড়ি চল ভাই!

সুমন একটু থমকালো,

চল তাহলে খেয়ে আসি কোথাও! আমিও ঠিক ভাবে খাইনি আজ!

খাওয়া দাওয়ার ব্যাপারে গৌরের কোনোদিনই বিশেষ আপত্তি নেই, সে এক কথায় রাজি হলো। একটু দূরেই ট্যাক্সি স্ট্যান্ড, সেখানে আসতেই ড্রাইভার এগিয়ে এলো, সুমন কে দেখে বিগলিত গলায় বললো,

আসুন দাদা! কোথায় যাবেন?

গৌর একটু ইতস্তত করছিলো, সুমন তার ছোটবেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু, কিন্তু ইদানিং সুমনের সঙ্গে তার অর্থনৈতিক অবস্থার পার্থক্য প্রকট হচ্ছিলো। সে মৃদু গলায় বললো,

চল না বাসে উঠি! ট্যাক্সির দরকার কি!

সুমন ঘাড় নাড়লো, ট্যাক্সির দরজা খুলে উঠে বসতে বসতে নিচু গলায় বললো,

না, চাপ আছে! চল গিয়ে বলছি ওখানে।

গৌর হাসলো,

একটা মোটর সাইকেল কিনে ফ্যাল, প্র্যাকটিসে আসতে যেতে সুবিধা হবে।

সুমন মুচকি হাসলো,

হ্যাঁ, কিনছি তো! এখন বলিস না কাউকে, মা জানতে পারলে হেভি গন্ডগোল বাধবে!

রেস্টুরেন্টের ভেতরে বসে অর্ডার দেওয়ার পরে সুমন গৌরের দিকে ফিরলো,

প্রচুর ঝামেলা ভাই! বাসে উঠলেই লোকজন হামলে পড়ে! একটা বাইক কিনবো নিজের টাকায় তাতেও মায়ের আপত্তি, এগুলো নাকি বাজে খরচ! জীবনে একটুও শান্তি নেই! শান্তি তে যে বাড়িতে বসে খাবো একটু, সেটুকুও শালা হয় না!

এবার গৌর অবাক হলো,

হ্যাঁ, কি যেনো বলছিলি তুই তখন! খাসনি আজ ভালো করে! কেনো? বাড়িতে আবার কি হলো?

মা পুরো পাগল করে দেবে বুঝলি তো! সেদিন বৌভাতের রাতে অদ্বিতীয়ার সঙ্গে কথা বলেছিলাম মিনিট দশেক, সেই নিয়ে আজ কদিন ধরে অশান্তি করে যাচ্ছে!

গৌর একটু অবাক হলো,

তুই ওকে বাড়িতে নেমন্তন্ন করেছিলি! যাহ শালা! কখন এলো আর কখন গেলো! জানতেও তো পারলাম না! এটা কি করলি ভাই! একটু বলতে পারতিস! দেখতাম একবার!

আরে! ধুর! আমিই তো কথা বলতে পারিনি ভয়ে! একবার ক্লাবের লোকজন আসছে, তো একবার আত্মীয় স্বজন! সব শালা কথা বলার জন্যে হামলে পড়ছিলো! তার মধ্যেই মিনিট দশেকের জন্যে কথা বলতে গেছি পেছনের বাগানে, তাও মা নাকি কোথা থেকে দেখেছে! সেই থেকে বাড়িতে সারাদিন চিৎকার করছে!

সুমনের হতাশ গলা শুনে গৌর দুঃখিত হলো,

কাকিমা জানলো কি করে? কে বললো?

সুমন বিরক্ত হলো,

কে আবার বলবে! নিজেই বুঝেছে নিশ্চয়ই! মাঝে মাঝে ফোনে কথা বলতে দেখে তো! তার মধ্যে শালা অদ্বিতীয়ার সঙ্গেও গন্ডগোল হয়ে গেলো! আমি নাকি ওকে ইচ্ছে করে অ্যাভয়েড করছি! ও নাকি ভেবেছিলো আমি ওর সঙ্গেই গল্প করবো!

তুই বুঝিয়ে বলতে পারতিস একটু! আর অন্য দিকে কোথাও গিয়ে আর একটু বেশি সময় দিতে হতো ওকে!

সুমন ঘাড় নাড়লো, গলায় বিরক্তি এনে বললো,

অন্য দিকে গিয়ে! কি যে বলিস! শালা গোয়েন্দার মতো ফলো করছে লোকজন! সবচেয়ে মাথা গরম হয় ওই আত্মীয় গুলো কে দেখলে! এতোকাল ফিরে তাকাতো না, এখন সব দল বেঁধে চলে এসেছে! আমি তো ওদের নেমন্তন্ন করতেই চাইছিলাম না, মা শুনলো না তাই! তার মধ্যে আবার শালা ওই সতু মুখার্জির বউ নাকি ওর মেয়ের জন্যে আমাকেই খুঁজে বার করেছে! এতদিন তো শুভর পেছনে পড়ে ছিলো জানতাম, এখন কি হলো কে জানে!

গৌর মাথাটা একটু সুমনের দিকে সরিয়ে আনলো, আসে পাশে তাকিয়ে নিয়ে বললো,

খবর জানিস না? মাল টা তো শালা কিসব লটর পটর কেস বাধিয়েছে! বাপের শালা ছেলে ইঞ্জিনিয়ার বলে গর্বে মাটিতে পা পড়তো না, এখন তো থানা পুলিশ হচ্ছে! সতু মুখুজ্জের কাছে সব খবর আছে, ওসব শুনেই ওই বিয়ে ক্যান্সেল করে তোর পেছনে পড়েছে!

সুমন অবাক হলো, শুভ তাদের বন্ধু ছিলো। বরাবরই পড়াশুনায় ভালো। সুমন যখন ফুটবল খেলে বাবার মারের ভয়ে লুকিয়ে সন্ধ্যেবেলা বাড়ি ঢুকতো, শুভর ততোক্ষনে ঘন্টাখানেক পড়াশোনা হয়ে যেতো। গোটা পাড়ায় তাকে সবাই এক ডাকে চেনে, ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে সুযোগ পাওয়ার পরেই সে আগে যেটুকু বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলতো, সেটুকুও বন্ধ হয়ে ছিলো। ইদানিং সে বাইরে চাকরি করে, পাত্র হিসেবে সবার কাছেই বেশ লোভনীয়। ক্লাবে আড্ডা মারা সুমন সহ সুমনের বাকি বন্ধুদের কাছে সে বরাবরই দূরের মানুষ, কিন্তু তার খবর সবার কাছেই থাকে। সুমনের নিজের ব্যস্ততা বাড়ায় সে এই খবর এখনও পায় নি।

মালটা ঝাড়গ্রামে থাকে না? ওখানেই কেস করেছে নাকি?

খবর জানতে উৎসাহী হলো সুমন, গৌর মাথা হেলালো,

হ্যাঁ, ওখানেই কিসব ঘটিয়েছে নাকি শুনলাম! ঠিক মতো কেউ বলতে পারছে না, তবে মিটমাটের চেষ্টা চলছে। ওর মেসোটা তো নাকি বড়ো উকিল, ওই সব করছে! শুনলাম অনেক টাকা দিতে হচ্ছে মেয়েটাকে!

কথা বলতে বলতে খাবার এসে গেলো, খেতে খেতে সুমন হাসলো,

শালা শুভটা সারাজীবন আমাকেই জ্বালিয়ে গেলো! ওর জন্যেই বাবার কাছে মার খেয়েছি কতো! ও ফার্স্ট হতো আর আমি শালা মার খেতাম! এখনও জ্বালাচ্ছে! মালটা না গন্ডগোল পাকাবে, না সতু শালা আমার পেছনে পড়বে! তার মধ্যে অদ্বিতীয়াও নাকি কার কাছে শুনেছে সে আমার সঙ্গে তার মেয়ের বিয়ে দিতে চায়! জীবনটা হেল হয়ে গেলো মাইরি!

গন্ডগোল মিটেছে তো? নাকি এখনো ঝামেলা পাকিয়ে রেখেছিস!

সুমন মাথা নাড়লো,

নাহ! এখনো কথা বলি নি! সব দিকেই চাপ বুঝলি তো! এখন ফোন করলেই ভাও খাবে! দু দিন যাক আগে, মাথাটা ঠান্ডা হোক! তারপর ফোন করবো। এদিকে ক্লাবেও চাপ, ওই জলখাবারের মালিকটা সুখময় দা কে ধরেছে! সামনের মরশুমে ওদের ক্লাবে সই করার জন্যে!

গৌর তার বিরুদ্ধ দলে সুমন কে খেলতে দেখে একটুও খুশি হয় না, নিজের পছন্দের দলে সুমনের আসার সম্ভাবনায় সে উৎসাহী হলো,

আরে বস! দারুন খবর ভাই! সই করবি তো?

সুমন হাসলো,

দেখি! এখনো ভাবি নি কিছু! অনেক টাকার অফার বুঝলি! সোমার বিয়েটা বাকি আছে এখনো, তাই ঠিক করে উঠতে পারছি না কিছু!

গৌর মাথা নাড়লো,

সে ঠিক! তবে এখন দোতলা না তুললেই পারতিস! আগে সোমার বিয়েটা হয়ে যেতো না হয়!

সুমনের মুখ মলিন হলো,

তাহলে দাদা বিয়ের পরে থাকতো কোথায়! সবটাই একটার সাথে একটা জড়িয়ে আছে ভাই! ওই জন্যেই তো বলছিলাম, জীবনে শান্তি নেই! ঘরের জন্যেই তো দাদা বিয়ে করতে পারছিলো না!

ওহ! তোকে একটা কথা বলবো ভাবছিলাম কদিন ধরেই, ভালোই হলো কথাটা উঠলো। তোর বোন কে একটু চোখে চোখে রাখ, শালা তরুণকে আবার তোর বোনের কলেজের সামনে ঘুরতে দেখছি কিন্তু!

গৌরের উদ্বিগ্ন গলা সুমনকেও উদ্বিগ্ন করলো,

তাই নাকি! এর আগে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম ওকে, বলেছিলো কথা বলে না আর! খোঁজ লাগা তো ভালো করে! মালটা কে দু ঘা দিতে হবে মনে হচ্ছে, না হলে থামবে না শালা!

একটা বড়োসড়ো ঝড়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে রমা! আগের বার পারিনি, এবার পারতেই হবে!

সোফায় বসে চায়ের কাপ হাতে তুলে নিতে নিতে বললেন সুকান্ত, রমা অবাক হলেন।

কি হয়েছে বলো তো তোমার? গত কয়েকদিন ধরেই বেশ অন্য মনস্ক দেখছি তোমাকে!

সুকান্ত হাসলেন, রমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

হোস্টেলে থাকতে পিয়া একটা ছেলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলো তোমার মনে আছে? তুমি তখন পা ভেঙে কলকাতায় ছিলে? বাবা ওকে ফেরত নিয়ে চলে এসেছিলেন স্কুল থেকে?

রমা ঘাড় কাত করলেন,

হুঁ, সোমার দাদা তো? মনে থাকবে না কেনো? সোমা মেয়েটি খুব ভালো ছিলো না, এখনো যোগাযোগ আছে নাকি অদ্বিতীয়ার সঙ্গে?

আছে! কয়েকদিন আগেই ওর বড়দার বিয়েতে পিয়া গিয়েছিলো, আমিই পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম। সেখানে গিয়ে একটা নতুন কথা জানতে পারলাম, শুধু সোমা নয়, সোমার সেই দাদার সঙ্গেও সম্ভবত পিয়ার যোগাযোগ আছে!

অন্য মনস্ক গলায় বললেন সুকান্ত, রমা একটু অবাক হলেন,

তাই নাকি! তুমি কি করে বুঝলে? দেখেছো দুজনকে একসঙ্গে?

সুকান্ত মাথা নাড়লেন,

নাহ! সেটা দেখিনি, তবে বুঝতে পেরেছি! এর আগে একদিন সেই ছেলেটির সঙ্গেই পিয়া মনোজ কাকুর রেষ্টুরেন্টে গিয়েছিলো, বাবা কে উনি খবর দিয়েছিলেন। তখন ভেবেছিলাম পিয়া ওর খেলার ফ্যান, এখন নাম শুনে বুঝলাম ব্যাপারটা। ছেলেটি ভালো খেলে জানি, কিন্তু সেই যে সোমার সেই দাদা সেটা সেদিন বিয়ে বাড়িতে গিয়ে বুঝতে পারলাম।

তোমার বাবা কে খবর দিয়েছিলেন ভদ্রলোক! ওরে বাবা! তোমার বাবা জানতে পেরেছেন মানে তো বিরাট ব্যাপার হয়ে গেছে! ছেলেটি প্রাণে বেঁচে আছে তো? আমাকে তো একদিন বাড়ির বউ হবার চেষ্টা করলে প্রাণে মারার হুমকি দিয়েছিলেন!

খানিকটা বিদ্রুপের গলায় বললেন রমা, সুকান্ত মাথা নিচু করলেন,

এখনো এসব মনে রেখেছো রমা! আর এসব বলে নিজেকেই কষ্ট দাও কেনো? আসলে নিজেরা ভালো থাকতে জানলে, অন্য কেউ সেটা কে আটকাতে পারে না! আমরা তো ভালোই আছি, নিজেদের মতন করে আছি! বিয়ে না করেও তো ভালো থাকা যায়। এই তো প্রতি মুহূর্তে বাড়িতে দাদা, বৌদির সম্পর্ক দেখছি, বৌদির মতো মেয়েকেও মা সহ্য করতে পারে না। দাদাও তো নিজের মতোই থাকে, দিনে কটা কথা বউয়ের সঙ্গে বলে গুনে বলতে পারবে তুমি।

রমা লজ্জিত হলেন, সুকান্ত তাঁর জন্যে অনেক করেছেন, তাও পুরনো অপমান তিনি ভুলতে পারেন না কিছুতেই। সেই অল্পবয়সী তরুণী রমার মনে প্রতাপ সান্যাল আর সরযূর জন্যে যে পরিমাণ ঘৃনা জমে আছে, তার থেকে বেরিয়ে আসা বোধহয় এ জন্মে আর সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। তবু তিনি দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন, কৌতুহলী গলায় বললেন,

সরি! আমারই ভুল হয়েছে! যাকগে! অদ্বিতীয়ার কথা বলো! এখন কি হবে? তোমার বাবা খবর পেয়ে কি করলেন?

সুকান্ত একটু হাসলেন,

বাবাও আসলে আমার মতোই পিয়া কে ছেলেটির ফ্যান ভেবেছেন, তাই অতো গুরুত্ব দেন নি এখনো! তবে কিছু কানে এসেছে মানে ওকে তো চোখে চোখে রাখবেন এবার থেকে অবশ্যই! দেখা যাক বাবার নজর এড়িয়ে ওরা কদ্দিন থাকতে পারে!

রমা একটু চিন্তিত হলেন,

সোমার বাবা কে আমি বেশ কয়েকবার দেখেছি, আমার সঙ্গে দেখা করতে আসতেন। পরিবারটি কিন্তু একেবারেই নিম্ন মধ্যবিত্ত, তোমাদের সঙ্গে খাপ খায় না। আমি সামাজিক অবস্থানের কথা বলছি না তবে অর্থনৈতিক ফারাক এতটাই বেশি যে তোমাদের বাড়ির মেয়ের পক্ষে ওই বাড়িতে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া খুব মুশকিল!

সুকান্ত সহমত পোষণ করলেন,

আমিও সেকথা অস্বীকার করছি না। তবে আগের মতো অবস্থা আর নেই এখন,সেটা সেদিন বিয়ে বাড়িতে গিয়ে দেখেছি, ছেলেটির রোজগার বেশ ভালোই এখন! আর সেদিন ওকে বিয়ে বাড়িতে ঢুকিয়ে যে চায়ের দোকানে বসেছিলাম সেখানে ছেলেটি সম্পর্কে খারাপ কিছু শুনলাম না। তবে বাবা, মার সম্পর্কে দোকানদার একটু অন্য রকম ধারণা পোষণ করছিলো। তবে হটাৎ বড়লোক তো, আরো একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে! দেখা যাক কোথাকার জল কোথায় গড়ায়!

তোমার বাবা কে রাজি করতে পারবে?

বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলেন রমা, সুকান্ত মাথা নাড়লেন,

নাহ! সে আশা করি না! তবে ছেলেটি যদি ভালো হয় মানে আমার লোক যদি খবর আনে শুধুমাত্র বনেদী না হওয়া বাদে তার কোনো দোষ নেই, তাহলে আমি এর শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই এইবার! নিজের ক্ষেত্রে যা পারিনি ভাইঝির ক্ষেত্রে সেটাই করে দেখাতে চাই! ওর ভালো থাকাটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য, তার জন্যে যদি বাবার বিরুদ্ধে যেতেও হয় তাহলে তাই যাবো আমি।
ক্রমশ