#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৫
দেখতে দেখতে আরো মাস কয়েক কেটে গেলো, অদ্বিতীয়ার কলেজের আরো একটা বছর শেষে নতুন ক্লাস শুরু হলো। প্রতাপ সান্যালের কড়া নজর, সুমনের মায়ের বিরক্তি, সোমার সাহায্য, সরলার লুকিয়ে রাখা স্নেহ, সব টুকু নিয়েই টুকটাক মান অভিমানের মধ্যে দিয়ে সুমনের সঙ্গে তার সম্পর্ক এগিয়ে চলছিলো।
বৈশাখের একটা সোমবার, সকাল থেকেই সান্যাল বাড়িতে সাজো সাজো রব, আজ প্রতাপ সান্যালের ভাইপো রথীন এর ছেলের পৈতে। নিজের নামে কার্ড দেখার পর থেকেই বংশ কৌলীন্য তে বিশ্বাসী প্রতাপ সান্যাল সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে নাতির পৈতে দেওয়ার জন্যে উন্মুখ হয়ে আছেন। গত বেশ কয়েকদিন ধরেই তার প্রস্তুতি চলছে, বাড়িতে জনে জনে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, সেদিন সবাইকেই তাঁর সঙ্গে পৈতে বাড়িতে উপস্থিত থাকতে হবে। অদ্বিতীয়ার দু একবার তার কলেজের জরুরি ক্লাসের বা সুকান্তর তাঁর কোর্টের জরুরি শুনানির অজুহাত গ্রাহ্য হয়নি, শেষ পর্যন্ত সবাই পৈতে বাড়িতে যাওয়ার জন্যে তৈরী হয়েছে।
একমাত্র রতিকান্ত কে দোতলা থেকে নামানোর চেষ্টা বৃথা গিয়েছে, প্রতাপ বাবু পুত্র বধূ সরলার মাধ্যমে দু একবার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়েছেন। সে বাড়িতে বউ না থাকার সুযোগে আরো বড়ো একটা বোতল খুলে বসবে বলে মনে মনেই স্থির করে রেখেছে। যদিও বাড়ির কারোরই খুব বেশি যাওয়ার ইচ্ছে ছিলো না, কিন্তু প্রতাপ সান্যালের আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা তাদের কারোরই ছিলো না, তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই তারা রাজি হয়েছেন।
রতিকান্ত বাদেও যদিও সান্যাল মশাইয়ের অবাধ্য হবার ক্ষমতা আরো একজন রাখেন, তিনি সরযূ! তাঁর নিশ্চিত বিশ্বাস এই পৈতের নিমন্ত্রণ পত্রে সান্যাল মশাইয়ের নাম ছাপানোর পেছনে রথীন এর কোনো চাল রয়েছে। সে ধারণা যে মিথ্যে নয় সেটা বাড়ির সবাই মনে মনে স্বীকার করলেও সান্যাল মশাইয়ের সামনে কিছু বলার ক্ষমতা রাখে নি। যদিও বংশ গৌরবে গৌরবান্বিত প্রতাপ সান্যাল এই মুহুর্তে স্ত্রীর কথা কে ধর্তব্যের মধ্যেই আনছেন না, তিনি নাতির পৈতের ঝুলিতে ভিক্ষা হিসেবে ফেলার জন্যে তাঁর একটি সম্পত্তির শেয়ারের কাগজ সঙ্গে নিয়েছেন।
এই সম্পত্তি নিয়ে বেশ অনেকদিন থেকেই রথীন এর সঙ্গে তাঁর শরিকি বিবাদ কাগজে কলমে চলছিলো, যদিও তাতে মুখোমুখি সম্পর্ক কখনোই খারাপ হয়নি। আজ এই সুযোগে নাতিকে নিজের ভাগের অংশ ছেড়ে দিয়ে সম্পত্তির গোটা অংশটাই রথীন কে দিয়ে দিতে চাইছেন প্রতাপ সান্যাল। গত কয়েকদিন ধরেই তাই সরযূ বাড়িতে মোটামুটি দক্ষ যজ্ঞ বাধিয়ে দিয়েছেন, ছেলেরা কেউ তাঁর কথার গুরুত্ব দেয়নি, রতিকান্তের মদের বোতল ছেড়ে ওঠার সময় ছিলো না আর সুকান্তর ওসব নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই!
প্রতাপ সান্যালের গাড়ি যখন রথীন এর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো তখন সকাল আটটাও বাজে নি, তাঁকে দেখে রথীন শশব্যস্ত হয়ে নেমে এলো। একটু পরেই বনেদী সান্যাল দের বিভিন্ন শরিকরা এসে উপস্থিত হতে লাগলেন। সরলা এবং সরযূর সঙ্গে অদ্বিতীয়ার জায়গা হয়ে ছিলো মহিলা মহলে, সেখানের পরিবেশ বাকি অন্য জায়গার থেকে অনেকটাই আলাদা ছিলো। ঠিক সুমনের বাড়ির বিয়ের অনুষ্ঠানের মতোই এখানকার মহিলা মহলও পরনিন্দা, পরচর্চা তেই ব্যস্ত ছিলো তবে তাদের আলোচনার বিষয় ছিলো সান্যাল দের বিভিন্ন শরিকরাই। এই আলোচনায় সরযূ খুব উৎসাহ নিয়ে যোগদান করলেও সরলা এবং অদ্বিতীয়া মুখে বিরক্তি নিয়ে বসে ছিলো।
পৈতের অনুষ্ঠান এগিয়ে চলেছিলো, প্রতাপ সান্যাল নিজে পুরুত মশাইয়ের সঙ্গে বসে পৈতের কাজ করছিলেন। নাতির ভিক্ষার ঝুলিতে তাঁকে চাল, আলু, সিকির সঙ্গে শরিকী সম্পত্তির কাগজ ভিক্ষা দিতে দেখে উপস্থিত অন্য শরিকদের চোখ টাটালেও রথীন এবং তাঁর স্ত্রী সুমনা যারপরনাই বিগলিত হলেন। রথীন তাঁর স্ত্রীর কথা না শুনে জ্যেঠুর নাম নিমন্ত্রণ পত্রে ছাপানোর বিচক্ষণতায় নিজেই গর্বিত হচ্ছিলেন। এরপর থেকেই রথীন এবং সুমনা, প্রতাপ সান্যাল এর পরিবার কে আলাদা গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন, জনে জনে উপস্থিত নিমন্ত্রিতদের সঙ্গে পরিচয় করাতে লাগলেন।
সরলা আর অদ্বিতীয়া যেখানে বসে ছিলো সেখানে সুমনা তার থেকে বয়সে অল্প একটু বড়ো একজন মহিলা কে নিয়ে উপস্থিত হলো, সরলার প্রতি আগের সব বৈরীতা দূরে সরিয়ে রেখে হাসি মুখে বললো,
সরলা! ইনি আমার দিদি! তোমার সঙ্গে আগে পরিচয় ছিলো না কখনো!
সরলা নমস্কারের ভঙ্গিতে হাত তুলে সৌজন্যের হাসি হাসলো,
আচ্ছা! বসুন না!
ভদ্রমহিলা প্রতি নমস্কার জানিয়ে বসতেই যাচ্ছিলেন, অদ্বিতীয়ার দিকে তাকিয়ে থমকে গেলেন,
ওমা! কি মিষ্টি দেখতে! কি রঙ! তোমার সতীনের মেয়েতো তাই না?
এসব কথা শুনতে অদ্বিতীয়া এবং সরলা দুজনেই অভ্যস্ত ছিলো, অদ্বিতীয়া নিস্পৃহ মুখে বসে থাকলেও, সরলা মৃদু হাসলো,
আমার মেয়ে!
মহিলা সরলা কে আপাদ মস্তক নিরীক্ষণ করলেন,
যাই বলো ভাই, মেয়ে তোমার হোক বা সতীনের, মেয়ে আমাদের খুব সুন্দরী! বাপের মতো হয়েছে নিশ্চয়ই? তা সেতো হবেই! সান্যালদের মেয়ে বলে কথা! রঙ, রূপ তো থাকবেই! আলাদা করে আর বলে দিতে হয়না!
অদ্বিতীয়ার মুখে বিরক্তির ছাপ ফুটলো, সে কিছু বলতেই যাচ্ছিলো তার আগেই সরলা তার হাতে মৃদু চাপ দিলো,
নাহ! বাপের মতো হয় নি, ও একদম ওর মায়ের মতো হয়েছে, ওর মা খুব সুন্দরী ছিলেন। সান্যাল দের বংশে অতো সুন্দর নেই!
মহিলা একটু থতমত খেলেন, নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
ওহ, তা হবে হয়ত! আমি তো ওর মাকে কখনো দেখিনি! শুনেছি মেয়ের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গিয়েছিলো।
সরলা কোনো উত্তর দিলো না, মহিলা এবার অদ্বিতীয়ার দিকে তাকালেন,
পড়াশুনা কর নিশ্চয়ই? কি নিয়ে পড়ছো?
অদ্বিতীয়া ভেতরের বিরক্তি সামলে নিয়ে মুখে হাসি টেনে আনলো,
হ্যাঁ, পড়াশোনা করছি, ল নিয়ে!
মহিলা কয়েক মুহূর্ত অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন, তাঁর মুখ থেকে বিস্ময় সূচক আওয়াজ বেরোলো,
ল! সেকি! এসব পড়ে কি করবে? দাদু, কাকার সঙ্গে কোর্টে যাবে নাকি! না, না, এটা তুমি ঠিক বিষয় নাওনি! বনেদি বাড়ির মেয়ে তুমি, তোমার এসব কোর্টে গিয়ে পুরুষদের সঙ্গে গায়ে গা লাগিয়ে কাজকর্ম ঠিক মানায় না!
অদ্বিতীয়া প্রতিবাদ করার আগেই সরযূ সেটা শুনতে পেলেন, দুর থেকেই চিৎকার করে বললেন,
সে দুঃখের কথা আর বোলো না মা! আজকালকার মেয়ে সব, বড়ো অবাধ্য! আমাদের সময়ে আমরা বড়দের কথার ওপরে কোনো কথা বলার সাহস দেখাতাম না! আর এদের দেখো! কথার অবাধ্যতা করাই যেনো একমাত্র কাজ! তার দাদু কতো বার করে বারণ করেছিলেন, তা মেয়ে শুনলে তো, শেষ পর্যন্ত এইটুকু কথা তিনি দয়া করে দাদু কে দিয়েছেন যে তিনি প্র্যাকটিস করবেন না! তাই সই! নেই মামার চেয়ে তো কানা মামা ভাল অন্তত!
উপস্থিত মহিলা মহল অদ্বিতীয়ার দিকে ঘুরে তাকালো, কিছুক্ষনের মধ্যেই সবাই এই ব্যাপারে একমত হলো যে সান্যাল বাড়ির মেয়ের পক্ষে এই বিষয় নির্বাচন একদম ঠিক হয় নি! প্রতাপ সান্যালের দুর সম্পর্কীয় এক দিদি তো রীতিমত গালে হাত দিলেন, সরযূর দিকে তাকিয়ে বললেন,
প্রতাপ একি ভুল করলো রে সরযূ! সে এই বংশের মাথা হয়ে এমন কাজ করলো কি করে! ও মেয়ের পাত্তর পাওয়া কি মুখের কথা! কোন বাড়িতে সম্বন্ধ করবি বলত! এখনো বেশি লোক জানাজানি হয় নি, এই বেলা একটা বিয়ে দিয়ে দে দেখি! বাকি পড়াশোনা শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে হবে খন!
সরযূ চিন্তিত হলেন, কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন,
সে কি আমি কম বলেছি তখন! বাড়িতে কেউ আমার কথা শোনে? এমনকি তোমার ভাইও আজকাল আমার কথার দাম দেয় না গো! নিজের যা ইচ্ছে তাই করছে!
সরযূর চোখে জল এলো, তার কতটা নাতনির বিয়ের পাত্র না পাওয়ার শোকে আর কতো টা শরীকি জমি হাত ছাড়া হয়ে যাওয়ার দুঃখে সেটা বলা কঠিন!
সরযূর ননদ সমব্যথী হলেন,
আহা! কাঁদিস নে দিকি! আমিই প্রতাপ কে এট্টু বুঝিয়ে বলবো না হয়! বিয়ে একবার হয়ে যাক, তারপরে শ্বশুর বাড়ি যদি পড়াতে চায় পড়বে! সে নিয়ে তো আর তোরা বলতে যাবি নে! তবে একটা কথা, প্রতাপের না হয় ভীমরতি ধরেছে তা মেয়ের বাপ, মাই বা কেমন বাপু, নিজের মেয়ের ভালোমন্দ নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই? তারাই বা তাকে এসব জিনিস পড়তে দেয় কি করে সেইটাই তো বুঝিনা!
সরযূ মুখ বেঁকিয়ে বউয়ের দিকে তাকালেন,
আমারই কপাল! ওর আর মা, বাপ! মাকে তো মেয়ে জন্মেই খেয়েছে, আর বাপ তো ওই সৃষ্টিছাড়া! আজ পর্যন্ত আমার রতি আর সংসারের কোনটা দেখেছে বলো দিকি দিদি! সব ওই বউয়ের হাতে, সে হলো গিয়ে সৎ মা, তার আর অন্যের মেয়ের ভালো মন্দ নিয়ে চিন্তা কি? যতো চিন্তা তো এই বুড়ো, বুড়ির! মরার আগে পার করে যেতে না পারলে, আর তার বিয়ে হবে না, এটুকু আমি জানি! তাই তো উঠে পড়ে চেষ্টা করতে চাই, তাও কি আর ওই বউ হতে দেয়! সেই তো আগ বাড়িয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে শ্বশুরের কাছ থেকে মত আদায় করলো!
সরলা শাশুড়ির কথা কে কোনোদিনই খুব বেশি গুরুত্ব দিতো না, আজও দিলো না, সে পিসি শাশুড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো,
বিয়ে হলেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যায় পিসিমা? এই আমাকেই দেখুন না, কম বছর তো বিয়ে হয়নি আমার, কিন্তু কি আর ঠিক হয়েছে? আগে দাদাদের বাড়ির কাজের লোক ছিলাম এখন শ্বশুর বাড়ির কাজের লোক হয়েছি! আসল কথা বিয়ে নয় আসল কথা বিদ্যে! ওটা থাকলেই সবাই আপনাকে মানুষ বলে মনে করবে, পায়ের তলায় রাখার চেষ্টা করবে না! যারা আসলে পড়াশুনা বন্ধ করে বিয়ে দিতে চায়, তারা সৎ না হলেও আমার মেয়ের একটুও ভালো চায় না!
এই কথার পরেই সরযূ গম্ভীর হয়ে গেলেন, বাকিরা প্রসঙ্গ পাল্টে ফেলার চেষ্টা করতে লাগলো, একমাত্র বুড়ি উঠে দাঁড়ালো, প্রতাপ সান্যাল তখন পৈতের শেষে পুরুষ মহলের মধ্যমণি হয়ে বসে ছিলেন, দিদি কে তাঁর দিকেই এগিয়ে আসতে দেখে উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিলেন,
কেমন আছো? অনেকদিন পরে দেখা হলো।
প্রতাপ বাবুর দিদি মাথা নাড়লেন,
আর থাকা! বাকি দিন গুলো চলে গেলেই হলো। তা হ্যাঁরে প্রতাপ, তোর নাতনি নাকি কিসব আইন টাইন নিয়ে পড়ছে? ওসব কেনো পড়ালি বাপ? এই বংশের মেয়েরা ওসব পড়ে নাকি? বিয়ে দিবি কি করে?
প্রতাপ সান্যাল একটু অপ্রস্তুতে পড়লেন, নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
আরে না, না! ওই শখ হয়েছে দাদু, কাকা কে দেখে তাই! আমিও ভাবলাম বংশের ধারাই তো ওকালতি! তাই পড়তে দিলাম, ক্ষতি কি! কোর্টে তো আর যাচ্ছে না!
রথীন এখন জ্যেঠুর পক্ষেই ছিলেন, পিসি আর কিছু বলার আগেই হাত তুললেন,
আহ্ পিসিমা! আজকাল আর ছেলে আর মেয়ে! সব সমান! ওকালতি পড়লেই বা! তার জন্যে পাত্র পাওয়া যায় না একথা তোমাকে আবার কে বললো? তোমাদের সময় আর নেই, সান্যাল দের বাড়িতে বিদেশি বউ ঢুকে গেলো আর তুমি কিনা মেয়েদের ওকালতি পড়া নিয়ে বসে আছো!
পিসি হারার পাত্রী ছিলেন না, কোমরে হাত দিয়ে ভাই পোর দিকে তাকালেন,
তাই নাকি! এতো কথা তোর, তো দে দেখি প্রতাপের নাতনির জন্যে একখান পাত্তর! দেখি কেমন পারিস? বয়স তো কম হয়নি তার, এখন না হলে আর কবে হবে? আমিও কদিন আর আছি কে জানে দেখে যাই নাতনির বিয়ে এট্টু!
রথীন মুচকি হাসলেন,
জ্যেঠুর নাতনির নাকি পাত্রের অভাব! হাসালে পিসিমা! যে কিনা জ্যেঠুর অর্ধেক সম্পত্তি পাবে ছোটো থেকেই সবাই জানে, তার পাত্র আবার খুঁজতে হয় নাকি!
প্রতাপ সান্যাল মনে মনে চমকে উঠলেন, মুখে ভাতের সময়ের সুকৌশলে ছড়িয়ে দেওয়া কথা তিনি নিজে ভুলে গেলেও রথীন ভোলেন নি! এটুকু তিনি আশ্বস্ত হলেন যে নাতনির পাত্র পেতে তাঁকে খুব বেশি বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
এই সব কথোপকথনের মধ্যে নিজের প্রসঙ্গ বার বার ওঠায় অদ্বিতীয়ার বিরক্ত লাগছিলো, পাছে তাকে সামনে বসে থাকতে দেখে এই প্রসঙ্গ চলতেই থাকে সেই ভয়ে সে উঠে দাঁড়ালো, সরলার উদ্দেশ্যে নিচু গলায় বললো,
ছোটো মা! আমি একটু ছাদে যাচ্ছি, এখানে থাকতে ভালো লাগছে না। তুমি যখন খেতে বসবে আমাকে ডেকে নিও!
উত্তর কলকাতার বাড়ির ছাদগুলো অনেকটা একই রকম, নিজেদের ছাদের সঙ্গে খুব বেশি ফারাক পাচ্ছিলো না অদ্বিতীয়া। মিনিট পনেরো একা একা দাঁড়িয়ে থেকে সে যখন বিরক্ত হয়ে নিচের সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল তখন সেখান দিয়ে একটা ছেলে হাতের সিগারেট তালুর ফাঁকে আড়াল করতে করতে ওপরে উঠে এলো। বোঝাই যাচ্ছিলো বাড়ির বড়দের লুকিয়ে সিগারেট খেতে সে ছাদে এসেছে। তাকে দেখে সিঁড়ির দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালো অদ্বিতীয়া, ছেলেটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো,
নিচে বড্ড লোকের গ্যাঞ্জাম! একটা সিগারেট ধরানোর জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যায় না! তাই বাধ্য হয়ে ওপরে উঠে এলাম!
ছেলেটির সাবলীল ভঙ্গিতে অদ্বিতীয়া হেসে ফেললো,
বেশ তো! খান না! আপনার অসুবিধা হবে না, আমি এমনিতেই নিচে যাচ্ছিলাম!
ছেলেটি হাসলো, মজার গলায় বললো,
আপনিই তো সেই রাজকন্যা? তাই না? আপনি নিশ্চিন্তে ওপরে থাকতে পারেন, এই প্রজা থাকতে রাজকন্যার কোনো অসুবিধা হবে না!
অদ্বিতীয়া অবাক হলো,
রাজকন্যা! মানে? আমি কোনো রাজকন্যা নই, আমি অদ্বিতীয়া! প্রতাপ সান্যাল আমার দাদু হন!
ছেলেটি আরো জোরে হেসে উঠলো,
অদ্বিতীয়া! রাজকন্যারা তো অদ্বিতীয়াই হয়! একটুও ভুল বলিনি তাহলে! আমি জানি আপনি প্রতাপ দাদুর নাতনি, ওই যে একটু আগেই শুনলাম না, আপনাকে যে বিয়ে করবে সে দাদুর অর্ধেক সম্পত্তি পাবে, তাই ওই রাজকন্যা উপমাটাই মনে এলো! অর্ধেক রাজত্ব সঙ্গে রাজকন্যা! এটাই একদম অ্যাপ্রপ্রিয়েট আপনার জন্যে!
এবার অদ্বিতীয়াও হেসে ফেললো,
আপনি বেশ মজার কথা বলেন তো! এই ভাবে আগে কখনো ভাবি নি কিন্তু! তবে আপনি আমাকে চিনলেও আমি কিন্তু আপনাকে চিনলাম না! কাউকে না চিনে, নাম না জেনে কথা বলতে খুব অস্বস্তি হয় আমার!
ছেলেটি মজার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো,
আপনি খুব বড়ো লইয়ার হবেন বোঝাই যাচ্ছে! সরাসরি নাম জিজ্ঞেস না করে কতো অসুবিধার কথা শুনিয়ে দিলেন! আসলে আমি খেয়াল করিনি, সত্যিই আমার নিজের পরিচয় দেওয়া উচিত ছিলো। রথীন সান্যাল মানে আপনার রথীন কাকু আমার মেসোমশাই হন! আমি ধানবাদে থাকি, ওখানে ইঞ্জিনিয়ার, আমার নাম শুভ।
ক্রমশ
#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৬
রথীন এর বাড়ি থেকে ফিরে আসার পর থেকেই সরযূ হটাৎ করেই নাতনির বিয়ে নিয়ে তৎপর হয়ে উঠলেন। স্বামী পাছে সত্যি সত্যিই নাতনি কে অর্ধেক সম্পত্তি দিয়ে দেন সেই নিয়ে তাঁর চিন্তার অন্ত ছিল না। একদিন সন্ধ্যে বেলা সান্যাল মশাই কোর্ট থেকে বাড়ি ফেরার পরে তিনি পাশে বসে নিচু গলায় স্বামী কে জিজ্ঞেস করলেন,
হ্যাঁ গো! সেদিন যে রথীন এর বাড়িতে তোমার দিদি পিয়া কে সম্পত্তির অর্ধেক দেওয়ার কথা বলছিলো, এরকম তুমি আবার সত্যি কিছু ভাবো নি তো?
প্রতাপ সান্যাল হাসলেন,
প্রতাপ সান্যাল না ভেবে কিছু করে না! তোমার ছেলের কুকীর্তি ঢাকতে আর উপায় কি বলো, ওটুকু রটনা তো থাকতেই হবে! তার বাবা, মায়ের পরিচয় কি আর মুছে ফেলা যাবে কখনো? তোমার কি মনে হয় না যে পিয়ার বিয়ের ঠিক হলেই এসব লুকিয়ে রাখা গল্প গুলো আবার নতুন করে মুখে মুখে ছড়াতে শুরু করবে?
সরযূ শঙ্কিত হলেন,
তাহলে কি হবে? এই সেদিন রথীন এর ছেলেটা কে অতো টা ভাগ ছেড়ে এলে, আজ আবার নাতনির বিয়েতে সম্পত্তি দেবার কথা রটিয়ে দিতে চাইছো! এই ভাবে যদি দান ছত্র খোলো, তাহলে আর কি থাকবে আমাদের হাতে?
সান্যাল মশাই মাথা নাড়লেন,
এমনিতেও কি থাকবে আর! আমার তো বংশধরই নেই! সবই ওই পাঁচ ভূতে লুটে পুটে খাবে! তবে রথীন এর ছেলেকে সম্পত্তি এমনই দিইনি! সে তুমি পরে বুঝতে পারবে! এখন কিছু বলা যাবে না!
সরযূ ক্ষুব্ধ হলেন,
এখন তুমি আমাকেও বিশ্বাস করো না আর! সব সম্পত্তি বুঝতে পারছি এই করেই এদের হাতে যাবে! আমার পছন্দের কেউ কিছু পাবে না!
সান্যাল মশাই হাসলেন,
তোমার পছন্দের লোক কে দিতে চাও কিছু! বেশ, তা দাও না, কে বারণ করেছে! কিন্তু দেবে কাকে? ওই তো তোমার ভাইপো রতন, তা সেও তো বুড়ো হয়ে মরতে চললো, আর এখন যা সম্পর্ক, এমনিতেও সে এদিকে আর পা দেয় না! আমরা মরে গেলে এমনিতেই সব ওই তোমার ছোটো ছেলের অনাথ আশ্রমের খপ্পরে যাবে, অজাত, কুজাতের হাতে সান্যাল দের সম্পত্তি যাওয়ার থেকে কিছুটা হলেও নিজের কাজে লাগুক!
দাদুভাই এর ঘরে বেশ অনেকক্ষন ধরেই ফোনটা বাজছে আর কেটে যাচ্ছে, শুনতে পাচ্ছিলো অদ্বিতীয়া। ফোন বাজার এই ধরনটা তার খুব পরিচিত! ফোনটা যে সুমনের বুঝতে পারলেও দাদু, ঠাকুমা দুজনেই ওখানে উপস্থিত থাকায় ফোন ধরার কথা ভুলেও ভাবছিলো না সে। বেশ কয়েকবার ফোন ধরা আর উত্তর না পেয়ে কেটে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটার পরে প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত হলেন,
ফোনটা ইদানিং বড্ড গন্ডগোল করছে! সুকান্ত কে বলতে হবে একটু এক্সচেঞ্জে কথা বলার জন্যে।
রাত নটার দিকে নিচে খাওয়ার জোগাড় হচ্ছিলো, দাদু, ঠাকুমা দুজনেই নেমে যাবার পরে অদ্বিতীয়া দ্রুত দাদুর ঘরে ঢুকে এলো, ডায়াল করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সুমন ফোন তুললো,
কতক্ষন থেকে ফোন করছি! ধরছো না কেনো?
অদ্বিতীয়া গলার স্বর নিচুতে করলো,
কি করবো! দাদুভাই, ঠাম্মা দুজনেই ঘরে ছিলো, এর মধ্যে ফোন ধরা যায় নাকি! কি বলছিলে তাড়াতাড়ি বলো, আমাকে নিচে খেতে যেতে হবে!
আমাকে কিছুদিনের জন্যে বাইরে যেতে হবে, খেলা আছে, মনে আছে তো? কাল কলেজের সামনে দাঁড়াবে অবশ্যই, এর পরে আর দেখা করার সময় পাবো না!
সুমনের কথায় অদ্বিতীয়া দুঃখিত হলো,
হ্যাঁ, মনে আছে! ঠিক আছে, দাঁড়াবো! এখন রাখছি!
ফোন রাখার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই নীচের থেকে সুকান্তর গলা ভেসে এলো,
পিয়া! কি হলো তোর! তাড়াতাড়ি আয়, সবাই খেতে বসে গেছে!
দোতলার সিঁড়ি দিয়ে প্রায় ছুটে নামতে নামতে অদ্বিতীয়া চিৎকার করলো,
আসছি ছোট কা!
অদ্বিতীয়া যখন রান্নাঘরের দাওয়ায় উঠে এলো তখন বাকিদের খাওয়া শুরু হয়ে গেছে, পিঁড়িতে বসতে বসতে দাদু আর ছোট কার কথোপকথন কানে এলো। প্রতাপ সান্যাল উচ্ছসিত হয়ে সুমনের প্রশংসা করেছিলেন, সুমন মনোজ গাঙ্গুলির ক্লাবে নাকি সই করতে চাইছে না!
এই প্রথম কাউকে শুনলাম অতো টাকার অফার ফিরিয়ে দিতে, বুঝলে সুকান্ত! যদি তুমি মনোজের মুখখানা নিজের চোখে দেখতে একবার! বেচারা খুব আশা করে ছিলো এই মরশুমে তারা নতুন ছেলেটি কে নিয়ে নেবে!
সুকান্ত খেতে খেতেই হাসলেন,
তাই নাকি! এতো টাকার অফার ফেরানো চাট্টিখানি কথা নয়! ভালোই হলো, আমাদের হাতে ও চলে গেলে সেরকম ভালো কোনো স্ট্রাইকার থাকতো না আর! টিম তো এবার বাইরে খেলতে যাচ্ছে শুনলাম, খেলাটা তো বোধহয় কলকাতায় হবেনা, তাই না? কোথায় হবে যেনো?
প্রতাপ সান্যাল মাথা নাড়লেন,
হ্যাঁ, সেরকমই তো জানি, বাইরে খেলতে যেতে হবে! কোথায় যাচ্ছে সেটা ঠিক মনে পড়ছে না! আজকের কাগজের শেষ পাতাতেই তো ছিলো! বয়সটা বাড়ছে বুঝলে তো, সকালেই পড়লাম অথচ দেখো এখন আর মনে করতে পারছি না!
অনেকটা নিজের অজান্তেই অদ্বিতীয়ার মুখ থেকে বেরিয়ে গেলো,
গোয়া দাদুভাই! গোয়ায় যাচ্ছে খেলতে!
সান্যাল মশাই হাত তুললেন,
হ্যাঁ, হ্যাঁ ঠিক ঠিক! তুমি তো টিমের বেশ খোঁজখবর রাখো দেখছি! অবশ্য রাখবে নাই বা কেনো! এখন তো তোমাদেরই এসব খবর রাখার বয়স! তবে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে মাঠে যেওনা কিন্তু!
অদ্বিতীয়া না বলতে যাওয়ার আগেই সুকান্ত হাসলেন,
তোর কি মাঠে যাওয়ার ইচ্ছে আছে নাকি? একবার তোকে নিয়ে যাবো না হয়! সামনে বসে খেলা দেখার যে উত্তেজনা সে কি আর টেলিভিশনের পর্দায় দেখলে হয়!
মনে মনে অনেকদিন থেকেই সে ইচ্ছে অদ্বিতীয়ার ছিলো, সামনে বসে সুমন কে খেলতে দেখতে কার না ইচ্ছে করবে! সে একটু করুন দৃষ্টিতে দাদুভাই এর মুখের দিকে তাকালো, প্রতাপ সান্যাল মৃদু হাসলেন,
সেটা অবশ্য তোমার কাকা ঠিকই বলেছে, মাঠে বসে দেখার আনন্দই আলাদা! বিয়ের পরে নাত জামাই কে বলে দেবো আমি, তোমাকে নিয়ে মাঠে ঘুরে আসবে একবার! নিজের চোখে মাঠের উত্তেজনা দেখে আসবে তখন! একবার বিয়ে হয়ে গেলে তো আর সমালোচনার জায়গা থাকবে না তখন!
অদ্বিতীয়ার মুখে দুঃখের ছাপ ফুটলো, সেদিকে তাকিয়ে সুকান্ত হাসলেন,
তোকে আমিই নিয়ে যাবো একবার, চিন্তা করিস না!
প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকালেন,
সব ব্যাপারেই তুমি মতামত দাও কেনো বলো তো? এই তোমার, আর শুধু তোমারই বা বলি কেনো, তোমাদের সবার, মানে তুমি, বৌমা আর পিয়া সবার কথাই বলছি! তোমাদের জেদের জন্য আজ আমাকে কতো প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। সেদিন রথীন এর বাড়িতে সবাই কে দেখলে তো? বুঝতে পারলে তো কেনো তখন আমি ওকালতি পড়াতে চাই নি দিদিভাই কে? এখন আবার তুমি ওকে মাঠে নিয়ে যাওয়ার হুজুগে মেতে উঠলে!
সুকান্ত তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন,
অতো লোকের কথায় কান দাও কেনো? রথীনদা তো তোমাকে সমর্থন করেই কথা বললো। ঠিকই তো বলেছে, বনেদি বাড়ির আর কি আছে আমাদের? বড়ো পিসির ছেলে তপু তো আজ কতো বছর আগে বিদেশি মেয়ে বিয়ে করেছে! তার ছেলের তো পৈতে শুনলাম সেদিন রথীনদার বাড়ি গিয়ে!
সরযূ মুখ বেঁকালেন,
ছেলে আর মেয়ে এক হলো? রথীন কি বললো শুনলি তো? অর্ধেক সম্পত্তি নাকি দিতে হবে ও মেয়ে কে পার করার জন্যে! একে মা মনসা তায় আবার ধুনোর গন্ধ! এই মেয়েকে কি করে পার করবো তাই একে বুঝে পাচ্ছি না, তার ওপরে সে উকিল হবে, মাঠে গিয়ে ছেলেদের গায়ে গা লাগিয়ে খেলা দেখবে! কতো শখ তার!
এতক্ষন চুপ করে সবার কথা শুনছিল সরলা, শাশুড়ি কে এতো কথা বলতে দেখে এবার মুখ খুললো,
ছেলের সত্যি কোনো দোষ হয়না তাই না মা!! তপুর বউ বিদেশি তাও সে যখন বনেদি সান্যাল দের বউ হতে পারে, এমনকি ধুমধাম করে তার ছেলের পৈতেও হয় তখন ছোড়দার বাঙালি মেয়ে বিয়েতে আপনারা আপত্তি করেছিলেন কেনো? আর পিয়ার বিয়েতে অর্ধেক সম্পত্তির কথা রথীন দা তো নিজে বলেন নি, এটা তো বাবাই ছোটো থেকে বলে এসেছেন সবাই কে! আর সেটা যে কেনো বলেছিলেন তা আপনার থেকে বেশি ভালো আর কে জানে? নিজের ছেলে কে ঠিক সময়ে শাসন করে সঠিক পথে রাখতে পারেন নি বলেই তো এতো ভালো মেয়ের জন্যেও বাবা কে পাত্র পক্ষ কে পনের লোভ দেখাতে হয়! মেয়ের বাবার কথা কে না জানে! যদি বিয়ে না হয় তাহলে তার বাবার কুকীর্তির জন্যে হবে না, এর সঙ্গে পিয়ার ওকালতি পড়া বা একদিন মাঠে খেলা দেখতে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই!
সরযূ থতমত খেলেন, বউ সাধারণত শ্বশুর মশাই থাকলে খুব বেশি মুখ খোলে না। আজ সরলা কে এতো কথা বলতে দেখে প্রতাপ সান্যাল ও অবাক হলেন, বৌমার দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললেন,
কে কি করেছে ওসব শুনে আমার কোনো লাভ নেই বৌমা! তপু বিদেশি মেয়ে বিয়ে করেছে বলেই আমাকেও অজাত, কুজাতের যেকোনো মেয়ে কে ঘরের বউ করে আনতে হবে সেটা কখনই হবে না! ওসব আধুনিকতা তোমরা আমি মরে গেলে দেখিও! তপুর বিয়ে কে আমি সমর্থন করিনা বলেই তাদের বিয়ের অনুষ্ঠানে যাই নি, এমনকি পৈতের অনুষ্ঠানেও যাবো না! তবে এটা ঠিক, অর্ধেক সম্পত্তি দিদিভাই কে দেওয়ার কথা আমিই বলেছি, তার কারণ সত্যিই আমার ওই কুলাঙ্গার ছেলে! কতো লোকের মুখ বন্ধ করবো বলো! তুমি হয়ত তোমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে একথা বললে যে আমরা তাকে ঠিক সময়ে শাসন করতে পারিনি কিন্তু সেটা সঠিক নয়! আমি যখনই তার ভালো করতে গিয়েছি সেটা সে খারাপ ভাবে নিয়েছে! সে সিনেমা করতে গিয়ে টাকা উড়িয়েছে, বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে মদের আসর বসিয়েছে তাও মেনে নিয়েছি বাধ্য হয়ে! তাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম যখন তখন সে কিছুতেই বিয়ে করলো না, ঘটকের একের পর এক আনা বনেদি বংশের সুন্দরী মেয়ে কে সে ফিরিয়ে দিলো! তখন তো আর বুঝিনি যে সে আসলে আমাকে ছোটো করার ফন্দি আঁটছে! সে ইচ্ছাকৃত ভাবে আমাকে অপমান করার জন্যেই অতো ভালো ভালো সম্বন্ধ ফিরিয়ে দিয়ে কোথা থেকে যে ওই মেয়েটিকে হটাৎ নিয়ে এলো তা আমি জানতেও পারলাম না! আমি খোঁজ নিয়েছিলাম পরে, তার সঙ্গে মেয়েটির আগে থেকে কোনোই সম্বন্ধ ছিলো না, শুধু মাত্র ওই মেয়েটিকে বিয়ে করার কারণ তার আমাকে লোকের সামনে হেয় করা! যাইহোক, আমি তাকে আমার বাড়ির বউ হিসেবে মেনে না নিলেও সে আমার ছেলের প্রথম স্ত্রী ছিলো, দিদিভাইয়ের মা, এগুলো আমি অস্বীকার করতে পারি না। আর সে আজ জীবিত নেই তাই তাকে নিয়ে কোনো রকম বাজে আলোচনা আমি করতে চাই না।
মায়ের সম্বন্ধে বলা কথাগুলো অদ্বিতীয়ার চোখে জল আনছিল, তাই সে মাথা নিচু করে খেতে লাগলো। সরযূ উৎফুল্ল হলেন, স্বামীকে তাঁর হয়ে কথা বলতে দেখে বউয়ের দিকে তাকিয়ে শ্লেষের গলায় বললেন,
এই তো সেদিন বউ হয়ে ঘরে পা দিলে, ছেলেকে কি করে মানুষ করেছি তার খবর তুমি রাখবে কি করে? তুমিও তো কম দিন হয়নি এ বাড়ির বউ হয়েছো, তা নিজের সোয়ামী কে সৎ পথে ফেরাতে কি কি করেছো শুনি? তার মদ ছাড়াতে পেরেছো কি আজ পর্যন্ত?
এবার প্রতাপ সান্যাল নিজেই বিরক্ত হলেন, বউয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
এই তোমার এক দোষ সরযূ, কিছুতেই তুমি অহেতুক কথা বলা বন্ধ করতে পারো না। আমি তো যা বলার ইতিমধ্যেই বলেছি, তুমি আবার অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছো কেনো? তুমি নিজে যা পারোনি তা অন্য কেউ পারেনি কেনো, সেটা নিয়ে অহেতুক মন্তব্য করার তো কোনো প্রয়োজন নেই! বৌমা যথেষ্টই চেষ্টা করেছে, তার চেষ্টাতেই যে আজ রতি কিছুটা হলেও ঘর মুখো হয়েছে সেটা তুমি অস্বীকার করতে পারো? তুমি তো সেটুকুও পারোনি তাকে, সে নিজের ইচ্ছেমতো বাড়িতে আসতো যেতো তখন!
সরযূর মুখ গম্ভীর হলো, প্রতাপ সান্যাল খাওয়া শেষ করে উঠে পড়লেন। তিনি চলে যেতেই সরলা শাশুড়ির উদ্দেশ্যে শ্লেষের গলায় বললো,
এতোকাল আপনার মুখে সব সময় শুনে এলাম আমি নাকি আপনার ছেলেকে বশ করে রেখেছি। এমনকি কি দিয়ে বশ করেছি তা জানার জন্যে কম চেষ্টা করেন নি আজ পর্যন্ত! আজ বলছেন আপনার ছেলে কে ঘরে ফেরাতে কিছুই করিনি! কোনটা ঠিক তাহলে!
সরযূ তড়িঘড়ি দোতলার সিঁড়িতে পা রাখলেন, সুকান্ত হাত ধুতে ধুতে মুচকি হাসলেন,
মাঝে মাঝে আপনি এমন কথা বলেন না বৌদি যে মনে হয় আপনি ওকালতি পড়লে বড়ো উকিল হতেন!
সরলা হেসে ফেললো, অদ্বিতীয়া থালা থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে বললো,
এটা আমি ছোটো মা কে আগেই বলেছি! তাই না ছোটো মা?
সরলা মজার গলায় উত্তর দিলো,
ভালোই হতো, তাহলে আর আমাকে সান্যাল বাড়ির বউ হতে হতো না!
অদ্বিতীয়া হেসে ফেলে মাথা নাড়লো,
না, একটুও ভালো হতো না! তাহলে আমি আমার ছোটো মাকে কি করে পেতাম!
ক্রমশ
#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৩৭
কলেজ থেকে বেরিয়েই খানিকটা দূরে দাঁড়ানো সুমনের কালো রঙের রাজদূত টা দেখতে পেলো অদ্বিতীয়া, এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে সে চট করে মাঝের বড়ো রাস্তাটা টপকে দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকলো। বাইকটা টপকে আরো কিছুটা পথ পেরিয়ে যাওয়ার পরে সুমন বাইক নিয়ে পেছন থেকে এগিয়ে আসতেই অদ্বিতীয়া হেলমেট টা সুমনের হাত থেকে নিয়ে বাইকে উঠে বসলো।
কতো দিন দেখা হবে না আর! কবে ফিরবে তুমি?
গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে করুন গলায় জিজ্ঞেস করলো অদ্বিতীয়া, সুমন ম্লান হাসলো,
প্রায় মাসখানেক তো বটেই, তার কম হতেও পারে, সবটাই খেলার রেজাল্টের ওপরে নির্ভর করছে তো।
আমার না খুব স্বার্থপর লাগছে নিজেকে!
সুমন একটু অবাক হলো,
কেনো?
যদি তোমরা হেরে যাও, তাহলে তো তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে তাই না? আমি কেনো যেনো টিমের কথা ভাবতে পারছি না। শুধু মনে হচ্ছে এতদিন আমি তোমাকে ছেড়ে থাকতে পারবো না, এর থেকে ভালো টিম হেরে যাক, আর তুমি তাড়াতাড়ি ফিরে এসো!
সুমন হাসলো,
টিম জিতলেই কিন্তু আসলে তোমার লাভ! যদি ধরো টিম হেরে যায় তাহলে তো আমাকে আর রাখবে না দল, আমার কেরিয়ার ডোবা মানেই কিন্তু আমাদের দুজনেরই সমস্যা! তারপরে তোমার দাদু? তিনি তো এমনই আমি বনেদি নই সেজন্য আমাকে পাত্তা দেবেন না তারপরে টিম হারলে তো আরো রেগে যাবেন!
অদ্বিতীয়া অনেকক্ষন সুমনের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলো, তারপরে মৃদু হেসে বললো,
আমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম, তুমি আজ বেশ ভদ্রভাবে কথা বলছো, এমনকি তুমি দাদুভাই কে একবারও বুড়ো বলোনি আজ!
সুমন অদ্বিতীয়ার হাত টা নিজের মুঠোয় নিলো,
আজ আসলে তোমাকে রাগাতে একটুও ইচ্ছে করছে না! তাই চেষ্টা করছি যাতে তুমি খুশি হও!
অদ্বিতীয়া অভিমানী হলো,
তারমানে তুমি ইচ্ছা করে রাগাও আমাকে!
তোমাকে রাগতে দেখলে আমার মজা লাগে! রাগলে তোমাকে একদম ছোট বাচ্চা মনে হয়! আসলে তুমি সারাক্ষন বড্ড সিরিয়াস মুখ করে থাকো অদ্বিতীয়া, কেমন যেনো চিন্তিত লাগে তোমাকে সব সময়। এতো কি ভাবো বলো তো?
অদ্বিতীয়ার মুখে কষ্টের ছাপ পড়লো,
আমার না ছোটো থেকে চুপচাপ একা একা বাড়িতে থেকে থেকে কেমন যেনো অভ্যাস হয়ে গেছে। আসলে ছোটো মা আর ছোট কা বাদে কথা বলার সেরকম কেউ নেই! ওঁরা দুজনেই নিজেদের কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই আমিও চুপচাপ থাকি। দাদুভাই আর ঠাম্মার সাথে কথা বলতে গেলে বড্ড ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয়, সব সময় ভয় লাগে আমি কিছু ভুল বলে ফেললাম কিনা! নিজের বাড়িতে অতো ভেবেচিন্তে কথা বলা যায়? তুমিই বলো! তাই আমি কথাই বলিনা, আমার শুনতেই ভালো লাগে!
সুমন হেসে ফেললো,
এই তো কতো কথা বললে!
তোমার সঙ্গেই তো বলি, সেইজন্যেই আরো মন খারাপ লাগছে! এতদিন কথা না বলে থাকবো কি করে!
আমি ট্রাংককল করবো তোমাকে! প্রতিদিন একবার! প্রমিজ!
সুমনের কথায় অদ্বিতীয়া তাড়াতাড়ি হাত নাড়লো,
না, না, প্লিজ! একদম কোরো না! দাদুভাই ঠিক বুঝতে পেরে যাবেন! একমাস আমি কাটিয়ে ফেলবো ঠিক!
সুমন হাসলো,
ঠিক আছে, করবো না! তুমি কিন্তু টিভিতে দেখবে খেলা গুলো, আজ পর্যন্ত তো মাঠে এলেনা একবারও!
অদ্বিতীয়ার মুখ ম্লান হলো,
জানো কাল দাদুভাই কি বলছিলেন? আমি নাকি বিয়ের পরে বরের সাথে মাঠে যাওয়ার পারমিশন পাবো, তার আগে কোনোদিনও হবে না!
সুমন মুচকি হাসলো,
বরের সাথে! এটা কিন্তু অনেকটা না জেনেই তোমার দাদু ঠিক বলে ফেলেছে! আমার সঙ্গে বিয়ের পরে তুমি সব খেলা দেখতে যাবে, তুমি গ্যালারি তে বসে থাকলে আরো ভালো খেলবো আমি!
অদ্বিতীয়া সুমনের হাতটা জোরে চেপে ধরলো,
আমার খুব ভয় লাগে সব সময়! এসব যদি সত্যি না হয় কখনো! বিশ্বাস করো, অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে আমি মাঠে গিয়ে তোমার খেলা দেখতে পারবো না। আমি না একটা স্বপ্ন দেখি প্রায়, আমি একটা অন্য কারোর সঙ্গে গ্যালারিতে বসে আছি, আর তুমি আমার সামনে দিয়ে বল নিয়ে গোলপোস্টের দিকে ছুটছ! সেই ছেলেটা পাশে বসে আছে বলে আমি তোমার হয়ে চিৎকার করতেও পারছি না!
সুমন অদ্বিতীয়ার হাতটা শক্ত করে ধরলো,
তোমার মতো গুছিয়ে বলতে পারিনা হয়ত, কিন্তু এটা বলতে পারি তোমাকে পাওয়াটাও আমার জীবনের একটা গোল। ওই বনেদী বাড়ির গোলপোস্টে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতাপ সান্যাল নামের গোলকিপার টাকে কাটিয়ে সেটা করে দেখাবো আমি, প্রমিস করলাম!
অদ্বিতীয়ার গলা কান্নায় বুজে এলো,
এক মাস অনেকটা সময়, জানিনা কি করে থাকবো! জানো কদিন আগেই আমরা এক কাকার ছেলের পৈতে তে গিয়েছিলাম, সেখানে সবাই দাদুভাই কে আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্যে বলছিলো। একে আমার বাবা ওই রকম, তারপরে আমি নাকি ওকালতি পড়ছি বলে আমার বিয়ে হবে না কোথাও। দাদুভাই সবাই কে নাকি ছোটো থেকে বলে রেখেছেন, যে আমাকে বিয়ে করবে তাকে উনি অর্ধেক সম্পত্তি দেবেন!
তোমার বাবা ড্রিংক করেন বলে তোমাকে সাত তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলতে হবে? দোষ করলো একজন আর শাস্তি পাবে তুমি! তবে অর্ধেক সম্পত্তির ব্যাপারটা হয়ে সুবিধাই হবে বুঝলে? তোমার দাদু কে বলে দিও আমার সঙ্গে বিয়ে দিলে ওটা দিতে হবে না! শালা বুড়োটা কঞ্জুস মাল, পয়সা বেঁচে যাবে শুনলে বিয়েতে না বলবে না!
বিদ্রুপের গলায় বললো সুমন, অদ্বিতীয়া অবাক হয়ে গেলো,
আর ধৈর্য্য ধরতে পারলে না না? শালা, বুড়ো, মাল সব একসাথে বলে দিলে একদম! তুমি আর বদলালে না! আমি কোথায় ভাবছিলাম তুমি খুব ভদ্র হয়ে গেছো, এবার দাদুভাই এর সামনে তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো খুব দরকার পড়লে!
সুমন সরাসরি অদ্বিতীয়ার চোখের দিকে তাকালো,
আমি খুব সাধারণ বাড়ির ছেলে অদ্বিতীয়া, তোমাদের মতো বনেদি নই, তাই অতো ভেবেচিন্তে কথা বলতে পারি না। তবে একটা কথা কি জানো সোজা কথা সোজা ভাবেই বলতে ভালোবাসি, তাতে তোমার খারাপ লাগলে আমার কিছু করার নেই। তোমার বাবার দোষ ঢাকতে যে অর্ধেক সম্পত্তি দেবার কথা বলে, সেতো আসলে তোমাকে নিয়ে দরই কষছে, তাই না? তাই ফ্রি করে দেওয়ার কথা বলে কিছু কি ভুল বললাম আদৌ? আর এরকম লোককে ভাই আমরা মাল আর শালাই বলি, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি না।
হটাৎ করেই অদ্বিতীয়ার খুব খারাপ লাগলো, সুমন যেনো চোখে আঙুল দিয়ে ওকে দেখিয়ে দিলো যে আসলে দাদুভাই এর কাছে ও পণ্য ছাড়া কিছুই না। এটা ও একবার হোস্টেলে থাকতে সুমিতা দিদির কাছেও শুনেছিলো, দাদুভাই নাকি বড়দিকে ছোটকাকে বিয়ে না করার জন্যে টাকার অফার দিয়েছিলেন। বড়দি রাজি না হওয়ায় প্রাণে মারার হুমকিও দিয়ে ছিলেন তাঁকে!
মলিন মুখে অদ্বিতীয়া কে চুপ করে থাকতে দেখে সুমনেরও খারাপ লাগলো, ও এইভাবে বলতে চায়নি, কিন্তু সম্পত্তি দেবার কথাটা শুনেই ওর মাথাটা কেমন যেনো গরম হয়ে গেলো হটাৎ। নিজেকে সামলে নিয়ে সুমন অদ্বিতীয়ার হাতে চাপ দিলো,
সরি! এইভাবে বলতে চাই নি কিন্তু তোমাকে কেউ সম্পত্তির লোভে বিয়ে করতে চাইবে এটা ভাবলেই না কেমন যেনো ঘেন্না হচ্ছে তোমার দাদুর ওপর। মনে হচ্ছে এক্ষুনি বিয়ে করি ফেলি, যাতে ওই লোকটা তোমাকে নিয়ে অন্য কারোর সঙ্গে আর দর কষাকষি করতে না পারে!
অদ্বিতীয়া শুকনো মুখে তাকালো,
বিশ্বাস করো, আমার দমবন্ধ লাগে ওই বাড়িটায়, ফিরতে ইচ্ছে করে না ওখানে! ওই বনেদিয়ানা জিনিসটা যে কি ভয়ঙ্কর তুমি বাইরে থেকে বুঝতেই পারবে না। ছোটো মা একটা কথা বলেছিলো আমাকে একদিন, এসব বাড়ির প্রতিটা ইঁট নাকি গল্প বলে! এদের কাছে শুধু বংশের সম্মান, মর্যাদা এগুলোই শেষ কথা, এগুলো ধরে রাখতে গেলে যদি বাড়ির মেয়েকে হাঁড়ি কাঠেও চড়াতে হয়না এরা পিছপা হবে না। মাপা হাঁটা, মাপা চাওনি, এর সঙ্গে মেলামেশা করো না খারাপ হয়ে যাবে, ওর সঙ্গে কথা বলো না, লোকে খারাপ বলবে। স্ট্যান্ডার্ড, বনেদিয়ানা, এসব মেনটেইন করতে গিয়ে মাঝে মাঝে ক্লান্ত লাগে। মনে হয় সব ছেড়ে তোমার সঙ্গে পালিয়ে যাই, এমন জায়গায় যেখানে শালা বললে কেউ অবাক হয়ে তাকাবে না, উঁচু গলায় কথা বললে কেউ আমার চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করবে না!
অদ্বিতীয়ার চোখ থেকে গড়িয়ে আসা জল হাত দিয়ে মুছতে মুছতে সুমন বললো,
পালাবো না! তোমাকে প্রতাপ সান্যালের সামনে দিয়ে বার করে নিয়ে আসবো, দেখি কি করে!
অদ্বিতীয়ার চোখ জলে ভরে আসছিলো, নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
চলো ছোট কা চলে আসবে, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!
সুমন লাফ দিয়ে উঠলো,
এইরে! একদম ভুলে গিয়েছিলাম, গৌর আমার জন্যে জলখাবারের সামনে দাঁড়াবে!
সুকান্ত আজ একটু তাড়াতাড়িই এসে গিয়েছিলেন, এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাইঝিকে কোথাও দেখতে না পেয়ে যখন কি করবেন ভাবছিলেন, তখন পেছন থেকে একটা পরিচিত গলার ডাক এলো। সুকান্ত চমকে তাকালেন, জলখাবারের মালিক মনোজ গাঙ্গুলী কে দেখে একটু হেসে বললেন,
আরে! মনোজ কাকু! কেমন আছেন?
সদা হাস্যময় মনোজ গাঙ্গুলী মাথা নাড়লেন,
ভালো, ভালো! আমি সব সময় ভালোই থাকি! তুমি কি ভাইঝি কে নিতে এসেছো নাকি? এখানে দাঁড়িয়ে কেনো?
সুকান্ত হাসলেন,
হ্যাঁ ভাইঝি কে নিতেই এসেছি, কিন্তু একটু তাড়াতাড়িই এসে পড়েছি আজ! এখনো তার আসতে একটু দেরি আছে, তাই দাঁড়িয়ে আছি!
মনোজ গাঙ্গুলী এরপর আর কোনো কথা শুনলেন না, সামনেই তাঁর রেষ্টুরেন্ট থাকতে সুকান্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলে যে তাঁর অসম্মান হবে, একথা বলতে বলতে তাকে প্রায় জোর করে নিজের দোকানে নিয়ে গেলেন। ভাইঝি এলে সুকান্ত তাকে দেখতে পাবেন না, এই কথাকেও তিনি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন,
আরে, চলো তো! তোমার ভাইঝি আসছে কিনা দেখার জন্যে আমি একটা ছেলে কে এখানে দাঁড় করিয়ে রাখছি।
সুকান্ত একটু অবাক হলেন,
আপনি পিয়া কে চেনেন জানি, তবে আপনার দোকানের ছেলে কি করে চিনবে?
মনোজ একটু অস্বস্তি তে পড়লেন, তিনি যে প্রতাপ সান্যালের কথা মতো তাঁর নাতনির ওপরে নজর রাখেন সেটা সুকান্ত কে বুঝতে না দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন,
ওই একদিন পিয়া দোকানে এসেছিলো খেতে তখন দেখেছে তো সবাই। তবে এটা ঠিক এতদিন পরে তারা তাকে চিনতে পারবে কি না কে জানে! আচ্ছা, তুমি চলো তো আগে, তারপরে আমি কিছু ব্যবস্থা করছি!
সুকান্ত দুঁদে উকিল, মুখ ফস্কে বলা ওই কথাটুকুই তাঁর জন্যে যথেষ্ট ছিলো, তিনি এবার নিজের ইচ্ছেই মনোজ গাঙ্গুলীর দোকানের দিকে এগিয়ে গেলেন। মালিকের আদেশে তাঁদের টেবিলের চা এসে গেলো দ্রুতই, চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে মনোজ গাঙ্গুলী হাসলেন,
স্যার কেমন আছেন? শরীর ভালো তো?
সুকান্ত মাথা কাত করলেন,
হ্যাঁ, ভালোই আছেন! বাবা, আপনার কথা খুব বলেন সব সময়! আপনার ওপরে তাঁর অগাধ আস্থা!
মনোজ বিগলিত হলেন, হাত কচলে বললেন,
আমিও স্যার কে ভীষণ শ্রদ্ধা করি, ওনার কথাই আমার কাছে আদেশ! এই আমার এতো বড়ো ব্যবসা, জমিজমা সব কিছুতে তো উনিই আমার বড়ো ভরসা! কতো গুণী মানুষ! তবে উনি কদিন আগেই বলছিলেন নাতনির বিয়েটা দিয়ে নাকি প্রাকটিস ছেড়ে দেবেন? আমি বললাম, আমি যাই কোথায়? উনি অবশ্য তোমার কথা বললেন, এরপর কিন্তু তোমাকেই নিতে হবে বাবা!
সুকান্ত হাসলেন,
সে হবে! চিন্তা করবেন না! তবে বাবা এখনই প্রাকটিস ছাড়বেন না সে বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন!
তাঁদের কথপোকথনের মধ্যেই সুমন আর গৌর ওখানে ঢুকলো, সুমন কে দেখেই মনোজ গাঙ্গুলী একটু উত্তেজিত হলেন,
তুমি একটু বসো বাবা, একটু কথা বলে আসি!
সুকান্ত মুচকি হাসলেন, আগের দিনের বাবার সঙ্গে হওয়া কথোপকথন সম্পূর্ন লুকিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
সই করাবেন নাকি? বাবার মুখেও শুনছিলাম সেদিন, আপনি নাকি সামনের মরশুমে আপনাদের ক্লাবে নিয়ে নিচ্ছেন ওকে!!
মনোজ গাঙ্গুলী একটু দুঃখিত মুখে ঘাড় নাড়লেন,
সেরকম কথাই তো হয়েছিলো আগে, এখন একটু ধানাই পানাই করছে! ওই তোমাদের ক্লাবের মালী সুখময়, ওকেই ধরেছিলাম, ওর সঙ্গে সম্পর্কটা বেশ ভালো ছেলেটার, কথাও হয়েছিলো দু একবার, তারপর জানিনা কি হলো, এখন আর সই করতে চাইছে না।
সুকান্ত পুলকিত হলেন, উৎসাহের গলায় বললেন,
তাই নাকি! এতো বেশ ভালো খবর! তা তাহলে আর কথা বলে কি হবে?
দেখি একবার অফারটা বাড়িয়ে! যে করেই হোক চেষ্টা তো করতে হবেই! খবর তোমার কাছে ভালো হলেই তো আমার কাছে নয় বাবা!
মনোজ গাঙ্গুলী কথা বলতে উঠে গেলেন, চায়ের কাপ নামিয়ে রেখে সুকান্তও উঠে দাঁড়ালেন, পিয়ার আসার সময় হয়ে গিয়েছে! তিনি যখন টেবিলের পাশ দিয়ে মনোজ গাঙ্গুলী কে হাত নেড়ে বেরিয়ে আসছেন, তখন কথোপকথনের টুকরো তাঁর কানে ভেসে এলো,
এতোটা অফারও ফিরিয়ে দিলে বাবা, কিছু কারণ তো বলো? কেনো হটাৎ মত বদলে ফেললে?
হতাশ মনোজ গাঙ্গুলীর কথার উত্তরে সুমনের উত্তর ভেসে এলো,
কারণ একদম ব্যক্তিগত, এর বেশি কিছু জানতে চাইবেন না!
ক্রমশ