সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
212

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪১
অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা একসাথে পাওয়া কাকে বলে জানিস?

সুমন কে বাইক থেকে ক্লাবের সামনে নামতে দেখেই দাঁড়িয়ে থাকা বন্ধুদের জটলা থেকে গৌর এগিয়ে এলো। প্রায় মাসখানেক বাদে কলকাতায় ফিরেই কোনমতে ব্যাগটা ঘরে রেখেই সুমন ক্লাবে এসেছিলো। জীবনের জটিলতা নিয়ে সুমন খুব বেশি মাথা ঘামায় না কখনো, ওর কাছে জীবন অতি সহজ, এক্কেবারে সরল রেখার মতো। গৌরের ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলা কথার মর্মার্থ না বুঝতে পেরে ও হা করে বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।

ওরকম হা করে তাকিয়ে আছিস কেনো?

সুমনের বোকার মতো তাকিয়ে থাকা লক্ষ্য করে বললো গৌর, সুমন মাথা নাড়লো,

হা করে থাকবো না তো কি! কি বললি মাথা মুন্ডু কিছুই তো বুঝলাম না!

কিছুই বুঝিস নি? তা তোর আর দোষ কি! সারা মাস তো ছিলিস না! পাড়ার খবর রাখবি কি করে!! শুভ কে দ্যাখ, খবর জানিস কিছু? ব্যাটা তলে তলে অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যার ব্যবস্থা করে ফেলেছে।

একসঙ্গে এতগুলো কথার রেশ সামলাতে বেশ বেগ পেতে হলো সুমন কে, কয়েক মিনিট সব বন্ধুদের হৈ চৈ এর পরে যেটুকু ওর কাছে পরিষ্কার হলো তার সারমর্ম এটাই যে শুভর বিয়ের কথা হচ্ছে কলকাতার এক বনেদী পরিবারের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে, বন্ধুদের ভাষায় অর্ধেক রাজত্ব আর রাজকন্যা!

বেশ কিছুদিন ধরেই ইঞ্জিনিয়ার শুভর জন্যে সুপাত্রীর সন্ধান চলছিলো, তার বাবার ভালোবাসার মোড়কে মোড়া উপহার স্বরূপ দেনা পাওনা, আর শুভর একই সাথে প্রকৃত সুন্দরী, গৌর বর্ণা, শিক্ষিতা, আধুনিকা অথচ ঘরোয়া, গৃহকর্মে নিপুনা পাত্রী পাওয়া সম্ভব না হওয়ায় বিয়ের কথা এগোচ্ছিল না। এতদিনে সব কিছু মিলে যাওয়ায় এবং জ্যোতিষীর কোষ্ঠী বিচারে রাজযোটক মিল খুঁজে পাওয়া যাওয়ায় এই সম্বন্ধ অবশেষে পাকা হয়েছে।

শালা! মালটা ঝাড়গ্রামে কিসব কেলো করে এলো তারপরেও মেয়ে জুটে গেলো ঠিক মাইরি! আর তুই? এতদিন ধরে প্রেম করেও এখনও বিয়ে করে উঠতে পারলি না!

খানিকটা হতাশ গলায় বললো গৌর, সুমন হেসে ফেললো,

তুই তো বেশ দুঃখ পেয়েছিস মনে হচ্ছে!

গৌর মাথা নাড়লো,

সত্যি পেয়েছি ভাই! আমার না হয় চাকরি বাকরি নেই কেও মেয়ে দেবে না, কিন্তু তোর তো তা নয় একটুও! টাকা আছে, বউ রেডী আছে তবু করছিস না কেনো? একটু কব্জি ডুবিয়ে খেতাম কদিন! শুভ টা শালা যা খঞ্চু মাল, নেমন্তন্ন তো করবেনা এটুকু শিওর!

সুমন ম্লান হাসলো,

আমারও প্রায় একই অবস্থা রে! সোমা যা করলো! একে বাড়িতে ওই নিয়ে গন্ডগোল, তার মধ্যে অদ্বিতীয়া ওতে জড়িয়ে পড়ায় মা পুরো ক্ষেপে আছে একদম! আমিও একটা গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলেছি তার মধ্যে! যাকে ধরে আনতে বলেছিলাম সে বেঁধে এনেছে ভাই! জাস্ট ফোন করে বলেছিলাম আমার বোন বাড়ি ফেরেনি একটু খবর নিন, লোকটা শালা থানার ওসি কে দিয়ে অদ্বিতীয়ার বাড়িতে পুলিশ পাঠিয়ে দিয়েছে! আমি অথচ অদ্বিতীয়ার নামই বলিনি ওকে! লোকটা ওকে থানায় নিয়ে চলে গেছে একদম! অদ্বিতীয়া আমার ফোন ধরছে না ভাই, দেখাও করছে না , আমি হেভি চাপে আছি!

গৌর গলার স্বর নিচুতে করলো,

থানার লোকটার দোষ নেই রে! লোকটা বলছিলো,

মেয়েটি খুব বড়ো ফ্যামিলির, ওর দাদু বড়ো উকিল, আপনার মেয়ে অ্যাডাল্ট, এই ভাবে ওকে অ্যারেস্ট করা যাবে না!

কাকিমা শুনলেন না! আর তোর দাদা তো শালা আরেক কাঠি ওপরে! ওরাই তো থানায় অদ্বিতীয়ার নামটা ঢুকিয়ে দিলো, কাকিমা লোকটাকে বলছিলো,

আমার ছেলে ফুটবল খেলে, অনেক সোর্স আছে আমাদের, আপনি অ্যারেস্ট করুন ওকে! তাও তো ভাগ্যিস পরের দিন ওরা থানায় আসার আগেই তোর বোন বিয়ে করে ফিরে গিয়েছিলো, না হলে সেদিন অদ্বিতীয়া অ্যারেস্ট হতোই ভাই! বিশ্বাস কর, আমারও তোর মা আর দাদার ওপরে হেভি রাগ হচ্ছিলো সেদিন মেয়েটাকে থানায় দেখে! মেয়েটা মাথা নিচু করে ছিলো ভাই, লজ্জায় মুখ তুলছিলো না!

তোর সঙ্গে অদ্বিতীয়ার থানায় দেখা হয়েছিলো?

সুমন জিজ্ঞেস করলো, গৌর ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ! সেই কথাই তো বলছি! তোর মা আর দাদা ইচ্ছে করে পুরো ফাঁসিয়েছে মেয়েটাকে! পুলিশ কিন্তু বারবার বলছিলো আপনার মেয়ে বিয়ে করে নিয়েছে ঠিক ফিরে আসবে! একটা কথা কি জানিস? তোকে বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু যোগাযোগ তো হয়নি তাই বলা হয়নি! তরুণদের বাড়ি থেকে বিয়ের পরে বৌভাতের অনুষ্ঠান করেছিলো, সেখানে কিন্তু তোদের বাড়ির সবাই গিয়েছিলো, তুই তো বোধহয় কিছুই জানতে পারিস নি, তাই না?

আমার বাড়ির লোক তরুণদের বাড়িতে গিয়েছিলো!

সুমনের গলায় বিস্ময় ঝরে পড়ছিলো।

হ্যাঁ ভাই! তুই তো প্রায় মাস খানেক পরে এলি, এর মধ্যে অনেক কিছু হয়ে গেছে! তোদের বাড়ি থেকে তো তরুণ কে মেনে নিয়েছে, সোমা তো মাঝে মাঝেই বাড়ি আসছে এখন! এমনকি তোদের বাড়ি থেকেও তো অনুষ্ঠান করবে শুনলাম! দুদিন আগেই মোড়ের চায়ের দোকানে নাকি কাকু বলছিলো! ওরা আসলে তোর ফেরার জন্যে অপেক্ষা করছিলো, তোর ক্লাবের সব লোকেদের বলবে, খবরের কাগজে ছাপা হবে তাহলে!

সুমন সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো, বাড়ির দিকে রওনা হবার আগে গৌরের দিকে তাকিয়ে বললো,

যদি তোর কথাগুলো সত্যি হয় না, তাহলে শালা এই বাড়িই ছেড়ে দেবো!

সুমন জোরে বাইক চালিয়ে বাড়িতে পৌঁছালো, সে কিছু বলার আগেই, ছেলেকে বাড়িতে ঢুকতে দেখেই সুমনের মা এগিয়ে এলো, এদিক ওদিক তাকিয়ে বললো,

জানিস একটা খবর শুনলাম! অদ্বিতীয়ার সঙ্গে নাকি ও বাড়ির শুভর বিয়ে ঠিক হয়েছে!

সুমন চমকে উঠে মায়ের দিকে তাকালো, কি বলতে এসেছিলো সেকথা ভুলে গিয়ে অবাক গলায় বললো,

কে বললো? কি করে জানলে?

মায়ের উত্তরের আগেই ঘরের ভেতর থেকে সোমা দৌড়ে বেরিয়ে এলো, দাদার দিকে তাকিয়ে গোপন খবর দেওয়ার মতো করে উৎফুল্ল হয়ে বললো,

আরে! আমার শাশুড়ির সঙ্গে ওদের পাশের বাড়িতে গিয়েছিলাম সেদিন! ওদেরকে তো শুভর বাবা নেমন্তন্ন করেছে, ওরাই কার্ড দেখালো! আমি তো কার্ডে নাম দেখে থ! আমার এতো বছরের বন্ধু অথচ দেখ আমাকে নেমন্তন্নই করলো না!

সুমনের মাথায় আগুন জ্বলে উঠলো, সে বিদ্রুপের গলায় বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,

বন্ধু! হ্যাঁ তা ঠিক! সত্যিই তো,তোর থেকে বড়ো বন্ধু আর ওর কে আছে! কিন্তু তুই এখানে কেনো? তোর সঙ্গে এই বাড়ির কোনো সম্পর্ক নেই! তোকে কে এই বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছে?

সোমা একটু থতমত খেয়ে মায়ের দিকে তাকালো, সোমার মা তাড়াতাড়ি সামনে এগিয়ে এলো,

মাথাটা একদম গেছে তোর! ঘরে জামাই বসে আছে আর তুই বোন কে বাড়ি থেকে বার করে দেবার কথা বলছিস? আমার বাড়ি আমি ঠিক করবো এখানে ও আসবে কিনা! তুই এতো কথা কেনো বলছিস?

সুমন মায়ের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বললো,

বাড়ি আমার! এখানে আসতে গেলে আমার পারমিশন লাগবে! এটা এক্ষুনি ওকে বুঝিয়ে দাও! কোনোদিনও যেনো আর না আসে!

সুমনের মা চিৎকার করলো, বড়ো ছেলে কে উদ্দেশ্য করে বললো,

শোন তোর ভাইয়ের কথা! ওই মেয়ের জন্যে নাকি নিজের বোনকেও বাড়ি থেকে বার করে দেবে! আমরা সব ওর পর হয়ে গেলাম, আর ওই সর্বনাশী মেয়ে তার আপন হলো! যে মেয়েটা ওর বোনের এতো বড়ো সর্বনাশ করলো তাকে মাথায় তুলে নাচছে এখনও!

সুমন বিদ্রুপের গলায় বললো,

তোমার মেয়ের সর্বনাশ কোথায় করলো, তুমি তো বাড়িতে বসে ফ্রিতে জামাই পেয়ে গেলে দেখলাম! শুনলাম মেয়ের বৌভাতে গিয়েছিলে, আবার বাড়ি থেকে অনুষ্ঠান করার কথাও ভাবছো নাকি! যা জামাই জামাই করছো, মনেতো হচ্ছে না তোমার মেয়ের সর্বনাশ কিছু হয়েছে বলে!

সুমনের মা তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলো, নরম গলায় বললো,

অনুষ্ঠান করলাম কোথায়, তোর জন্যেই তো অপেক্ষা করছি! তুই ফিরে না এলে কি কিছু করবো নাকি! হয়েই যখন গিয়েছে তখন আর রাগ দেখিয়ে লাভ কি বল! সামনের সপ্তাহে একটা ভালো দিন আছে, ওই দিনটায় করে ফেলি তাহলে? তোর ক্লাবের লোকেদের বলিস কিন্তু!

সুমন দাঁতে দাঁত চাপলো,

আমার জন্যে অপেক্ষা করছিলে! সেতো করবেই, না হলে পয়সা দেবে কে? আর ক্লাবের বন্ধুরা এলে কি সুবিধা? তোমার মেয়ের বিয়ের গল্প কাগজে ছাপবে তাই? হয়েই গিয়েছে বলে রাগ দেখাচ্ছ না সেটা খুব ভালো কথা, কিন্তু যদি মেনে নেওয়ারই ছিলো তাহলে অদ্বিতীয়া কে পুলিশে দিতে গেলে কেনো?

মা কে থতমত খেতে দেখে সুমনের দাদা সামনে এসে দাঁড়ালো, বাড়ির সব কাজ তার ভাই কে দিয়ে করানো হয়ে গিয়েছিলো, এখন আর ভাইকে তার প্রয়োজন ছিলো না, বরং ভাইকে এখান থেকে তাড়াতে পারলে তার একজন ভাগীদার কমতো। সে হুমকির সুরে বললো,

বাড়ি বাবার, তোর নয়! পয়সা দিলেই তোর হয়ে যাবে না! থাকতে গেলে বাড়ি মাঝে মাঝে সারাতে হয়, তুই না করলেও আমিই দোতলা করতাম! তোর ইচ্ছেয় কিছু হবে না, পোষালে থাকবি না হলে চলে যা, কেও তোকে আটকাবে না!

সুমন মায়ের দিকে তাকালো,

শুনছো দাদা কি বলছে? শালা, ওই তো গিয়ে অদ্বিতীয়ার নামে থানায় ডায়েরি করেছে শুনলাম!

সুমনের মা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ালো,

তো কি করবে? ধুপ ধুনো দিয়ে পুজো করবে ওই মেয়ের? শোনো, আমি তোমাকে শেষ কথা বলে দিলাম, আমার বাড়িতে আমি ওই মেয়েকে কোনোদিনও ঢুকতে দেবো না, তাতে তুমি থাকলে থাকো, না হলে বিদেয় হও! পয়সা দাও বলে মাথা কিনে নাওনি! ওই মেয়ের জন্যে আমার মেয়ে জামাই এই বাড়িতে ঢুকতে পারবে না, সেটা কোনোদিনও আমি বেঁচে থাকতে হবে না!

সুমন দ্রুত নিজের ঘর থেকে জামা কাপড় গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো, সে যখন বাইকে স্টার্ট দিচ্ছিলো তখন সুমনের মা পেছন থেকে চ্যাঁচালো,

ওই মেয়ে কে যদি বিয়ে করো, এক পয়সাও তোমাকে দিয়ে যাবো না বলে দিলাম! বাড়ির ভাগও তুমি পাবে না!

তুমি তোমার মেয়ে জামাই নিয়ে থাকো! তোমার বাড়ি, তোমার পয়সা ওসব তোমার নিজের কাছেই রাখো! বাড়ির ভাগ, তোমার টাকা পয়সা কোনো কিছুর আমার দরকার নেই! আমি যা পারবো সব নিজের যোগ্যতায় করবো, ওসব ভয় তোমার বড়ো ছেলেকে, মেয়েকে দেখিও! আমি এতদিন যা করেছি নিজের ভেবেই করেছি, তুমি আমাকে কি দেবে সেই ভেবে করিনি!

আর কথা না বলে সজোরে বাইক নিয়ে সুমন বেরিয়ে যাওয়ার পরে সুমনের বাবা নিচে এসে দাঁড়ালো। তাকে দেখেই সুমনের মা চিৎকার করলো,

এতক্ষন কোথায় ছিলে? ছেলেকে আটকাতে পারলে না? ও চলে গেলে, ওই মেয়ে কে বিয়ে করে নিলে, আমার সংসার কি করে চলবে?

সুমনের বাবা নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে কোমরে হাত রেখে ছেলের চলে যাওয়া দেখছিলো, হেসে বললো,

বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে, এখন ওই মেয়ে আর তোমার ছেলে কে বিয়ে করবে? আজকের রাতটা যেতে দাও, ছেলে তোমার বাড়িতেই ফিরবে। ওই সতু মুখার্জির মেয়েটার কি হলো? কথা এগোলে কিছু?

সুমনের মার মুখ উজ্জ্বল হলো,

হ্যাঁ, কথা তো হয়েই আছে, শুধু তোমার ছেলের ঘাড় থেকে এই ভুতটা নামাতে পারলেই দিন ঠিক করবো!

সুমন দ্রুত গতিতে বাইক চালিয়ে গৌরের বাড়ির সামনে পৌঁছালো, মোটর সাইকেলের মুহুর্মুহু হর্নের আওয়াজে গৌর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সুমন কে দেখেই চমকে গেলো,

কি রে! এক্ষুনি তো বাড়ি গেলি! ফিরে এলি কেনো?

সুমন দ্বিতীয় হেলমেট গৌরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

উঠে বস! তাড়া আছে! তোকে বলেছিলাম একদিন মনে আছে? শালা শুভটা সারাজীবন আমাকেই জ্বালিয়ে গিয়েছে! অর্ধেক রাজত্বের রাজকন্যা টা কে জানিস! অদ্বিতীয়া!

গৌর হতভম্ব হয়ে গেলো, বাইকের পেছনে উঠতে উঠতে অবাক গলায় বললো,

যাহ শালা! একি রে! তুই এখন কোথায় যাচ্ছিস? অদ্বিতীয়ার বাড়িতে নাকি?

সুমন অ্যাকসেলেটরে চাপ দিলো,

নাহ! আমাদের ক্লাবের মালী সুখময়দার কাছে! বলেছিলি না মালটা ঝাড়গ্রামে থাকতে কিসব কেলো করেছিলো? পুরো খবরটা আমার চাই! সুখময়দার বাড়ি ঝাড়গ্রামে, ওর কাছ থেকে সবটা খবর নেওয়াতে হবে!

গৌর একটু চিন্তায় পড়লো,

যদি ধর বিয়েটা এতে ভেঙেও যায়, তাহলেও কি অদ্বিতীয়ার সঙ্গে তোর সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে! তোর দাদা, মায়ের করা অপমান ভুলতে পারবে ও?

সুমন মাথা নাড়লো,

জানিনা! শুধু এটুকু জানি, আমার সঙ্গে বিয়ে না হলেও ওর ক্ষতি যেনো না হয়। ওই শুভ কে বিয়ে করলে ওর জীবনটাই শেষ হয়ে যাবে গৌর! আমি বেঁচে থাকতে সেটা কিছুতেই হতে দেবো না!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪২
দেখতে দেখতে প্রায় মাস দেড়েক কেটে গেলো, ইতিমধ্যেই সুকান্ত আলাদা করে ভাইঝির সঙ্গে কথা বলেছিলেন, অদ্বিতীয়ার এই বিয়েতে আপত্তি নেই এটা শুনে মনে মনে যথেষ্টই আশ্চর্য্য হলেও মুখে প্রকাশ করেন নি। তাঁর ধারণা ছিলো সুমনের সঙ্গে ভাইঝির যোগাযোগ আছে। কিন্তু সেকথা ভাইঝি অস্বীকার করায় তিনি মনে মনে একটু খুশিই হয়েছিলেন, কারণ সেদিনের সুমনের ফোনের ব্যবহার বা তার বাড়ির লোকেদের করা ব্যবহার তাঁকে যথেষ্টই ক্ষুব্ধ করেছিলো।

সুকান্ত বিয়েতে পণ দিতে চান না এটা শোনার পরে ছেলের সঙ্গে অযথা বিতর্কে না গিয়ে প্রতাপ সান্যাল মনে মনে অন্য ফন্দি আঁটতে লাগলেন, তাঁর কথায় একদিন রথীন তাঁর ভায়রা ভাই কে সঙ্গে নিয়ে জ্যেঠুর বাড়িতে এলেন। সেখানে সুকান্ত কেও ডাকা হলো, সেখানে বসেই আলাপচারিতার মধ্যেই সুকান্ত সরাসরি সেই প্রসঙ্গ তুললেন, হাত জোড় করে রথীন এর ভায়রভাই কে লক্ষ্য করে বললেন,

কিছু মনে করবেন না, আমি অন্য রকম মানসিকতায় বিশ্বাসী, কোনো কিছুর বিনিময়ে বাড়ির মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ করতে পারবো না!

ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি সুকান্তর হাত ধরে ফেললেন,

আমিও একই পন্থায় বিশ্বাসী! মেসোমশাই বয়স্ক মানুষ, বলে ফেলেছেন ওসব! কিন্তু আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি, আমি আপনাদের কাছ থেকে শুধুই মেয়েকেই নিয়ে যাবো! সান্যাল বাড়ির মেয়ে আমার বাড়ির বউ হবে এটাই আমার যথেষ্টই পাওনা! এর বেশি আর কিছুই চাই না!

সুকান্ত খুশি হলেন, ছেলের বাবার হাত ধরে বললেন,

আর একটা অনুরোধ বেয়াই মশাই! পিয়ার খুব উকিল হবার শখ, বাবা বলেছিলেন ওকে প্রাকটিস করতে দেবেন না! আমি আপনাকে অনুরোধ করছি ব্যাপারটা একটু দেখবেন!

ভদ্রলোক হাসলেন,

ওসব নিয়ে আপনি চিন্তা করবেন না! আজকালকার ছেলে মেয়ে, ওসব কথা ওরা নিজেরাই বলে নেবে! বাড়ির বউয়ের চাকরি করায় আমার কোনো আপত্তি নেই!

সব কিছু সহজেই মিটে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল আড়ালে রথীন কে কথা দিলেন, তিনি তাদের চাহিদা মতোই সম্পত্তি মেয়ের নামে বিয়ের দিন রাতে রেজিস্ট্রি করে দেবেন। রথীন এর সঙ্গে ভায়রা ভাইয়ের দৃষ্টি বিনিময় হলো, রথীন একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,

পিয়া ওকালতি পড়ছে, ওসব ফাঁক ফোকর তার জানা! বিয়ের পরে তার নামে সম্পত্তি থাকলে আর শুভর লাভ কোথায়! আর এমনিতেই সুকান্তর জন্যে তো সবটাই লুকিয়ে করতে হচ্ছে, ও পরে জানতে পারলে সম্পত্তি পিয়া তো কাকাকে ফিরিয়ে দিতেও পারে! তাই ওটা শুভর নামে করে দিলে সুবিধা হয় ওদের! এটুকু অনুরোধ জ্যেঠু, দয়া করে বিরক্ত হবেন না!

প্রতাপ সান্যাল রাজি হয়ে গেলেন, শর্ত দিলেন বিয়ে মিটে যাওয়ার পরে সেদিন রাতেই সুকান্তর অগোচরে হস্তান্তর হবে!

সুকান্ত ছেলের সম্বন্ধে খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা চালানোর মধ্যেই একদিন প্রতাপ সান্যাল সন্ধ্যেবেলায় কোর্ট থেকে ফিরে হইচই বাধিয়ে দিলেন,

গিন্নী কোথায় গেলে! দেখো দিদিভাইয়ের বিয়ের কার্ড ছাপিয়ে এসেছে!

সুকান্ত সদ্য সদ্য ঘরে ফিরেছিলেন, বাবার কার্ড ছাপিয়ে ফেলার সিদ্ধান্তে তিনি যথেষ্টই ক্ষুব্ধ হলেন,

তুমি কার্ড ছাপিয়ে ফেললে! আমাকে ছেলের সম্বন্ধে খবর নেওয়ার সময়টুকুও দিলে না!

প্রতাপ সান্যাল বরাভয়ের ভঙ্গিতে হাত তুললেন,

আহা! আর কদিনই বা দেরি বলোতো! এখন থেকে নিমন্ত্রণ শুরু করতে না পারলে শেষ হবে কি করে! মেয়ের বিয়ে কি মুখের কথা! তাছাড়া তুমি তো ছেলের বাবার সঙ্গে কথা বলে সম্মতি জানিয়েছ! তাঁরাও এগিয়েছেন ইতিমধ্যেই! বাকি রইলো ছেলের খবর, সে তুমি নিশ্চিন্তে নাও! আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি একটাও ভুল খবর তুমি পাবে না!

অগত্যা সুকান্ত চুপ করে গেলেন তখনকার মতো, তাঁর সোর্স সত্যিই ছেলের বিরুদ্ধে খুব বেশি খারাপ কিছু খবর দিতে পারেনি। এইসব ঘটনা প্রবাহের মধ্যেই অদ্বিতীয়ার বিয়ের দিন ক্রমশ এগিয়ে আসতে লাগলো। প্রায় দিন পনেরো বন্ধ থাকার পরে বিয়ে ঠিক হয়ে যাওয়ায় দাদুর কাছে কলেজে যাবার অনুমতি পেয়েছিলো অদ্বিতীয়া, কিন্তু তারপরে এতো দিন কেটে গেলেও সে নিয়মিত কলেজে যাওয়া বন্ধ করেছিলো। গোঁড়া বনেদি শুভদের পরিবারে বিয়ে হওয়ার পরে যে তার পড়াশুনার খুব বেশি সুযোগ থাকবে না এটা সে শুভর সঙ্গে তার কথোপকথনে বুঝতে পেরেছিলো। অনেকটা প্রতাপ সান্যালের ইচ্ছেতেই একদিন রথীন তাঁর ভায়রা ভাই কে সঙ্গে নিয়ে সপরিবারে উপস্থিত হয়েছিলেন।

এর আগে একদিন শুভ ফোনে অদ্বিতীয়ার সঙ্গে কথা বলতে চাওয়ায় প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত হয়েছিলেন, সরাসরি বারণ না করে নাতনির সঙ্গে কথা বলতে দিলেও তিনি রথীন কে পরে বলেছিলেন, ব্যক্তিগত ভাবে তাঁর বিয়ের আগে হবু স্বামীর সঙ্গে নাতনির কথোপকথন পছন্দ নয়। সেক্ষেত্রে যদি শুভ যদি অদ্বিতীয়ার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চায় তাহলে রথীন তাঁদের নিয়ে তাঁর বাড়িতে আসতে পারে। তাদের সপরিবারে আগমনের কারণ ছিলো সেটাই!

অদ্বিতীয়া বিয়ের পরেও কলেজে যেতে চায় এই কথার উত্তরে শুভ হেসেছিলো, হাসতে হাসতেই বলেছিলো,

মেয়েরা খুব ভালো ঝগড়া করতে পারে জানি! আমাদের বাড়ির মানদা মাসীকে কেউ ঝগড়ায় হারাতে পারেনি কখনো! কিন্তু সেসব ঝগড়ায় মাসি কখনো যুক্তি তর্কের ধার ধারেনা! সেই ঝগড়া করতে পারা আর কোর্টে গিয়ে যুক্তি তর্ক সাজিয়ে উল্টোদিকের পুরুষ ল ইয়ারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সওয়াল করা দুটো এক নয়,এটা মানেন তো?

অদ্বিতীয়া প্রতিবাদে কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই শুভ হাত তুলেছিলো,

এই রে! আমি যে হবু উকিলের সঙ্গে তর্কে নেমেছি, সেটাই ভুলে গিয়েছিলাম! আপনি নিশ্চয়ই অনেক যুক্তি দিয়ে কিছু কথা বলবেন! আমি তার আগেই হার স্বীকার করে নিচ্ছি! তবে আমার একটা সমস্যা আছে, মূলত বিয়েটা সেই জন্যেই করা! আমি বাইরে থাকি, ওখানে রান্না বান্না, খাওয়া দাওয়ার অসুবিধার জন্যেই আমার বিয়ে করা, আপনি এখানে কলেজে গেলে আমার যে একটু অসুবিধা হবে! যদি কখনো কলকাতায় ফিরে আসি তখন না হয় এমনি প্রাইভেটে কোনো বিষয় নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করে নেবেন! তবে গ্র্যাজুয়েশনটা সত্যিই খুব জরুরি, বন্ধুদের সামনে নিজের স্ত্রীকে আন্ডার গ্রাজুয়েট পরিচয় দিতে আমারও লজ্জাই লাগবে!

অদ্বিতীয়া অবাক হয়ে তাকিয়েছিলো,

আপনার বাবা কিন্তু ছোট কা কে বলেছিলেন, আমার পড়া বা চাকরি করায় তাঁর কোনো আপত্তি নেই!

শুভ হেসেছিলো,

আরে! আমি কখন বললাম, আমার আপত্তি আছে! যদি কলকাতায় ফিরে আসতে পারি তখন পড়াশোনা, চাকরি সবই করবেন নিশ্চয়ই! কিন্তু কবে ফিরবো, আদৌ ফিরবো কিনা সেটা তো এই মুহূর্তে বলা মুশকিল, তাই না? আর চাকরি তো অনেক আছে, ওকালতিই যে করতে হবে এরকম তো কোনো কথা নেই! মেয়েদের জন্যে সম্মানজনক হবে সেরকম কিছু সময় সুযোগ পেলে করবেন না হয় কখনো!

অদ্বিতীয়া সরাসরি তাকিয়েছিলো,

আমি যদি আপনার সঙ্গে না যাই? শুনেছি আপনি প্রতি সপ্তাহে বাড়িতে আসেন, আমি তো কলকাতায় থেকেও যেতে পারি তাহলে? পড়াশোনাটা চালাতে অসুবিধা হবে না আর।

শুভ গম্ভীর হয়েছিলো তৎক্ষণাৎ, একটু কড়া গলায় বলেছিলো,

আপনি আমার সঙ্গে ধানবাদ গেলে আমার সুবিধা হবে! আমি আপনার কথাটা মাথায় রাখবো, তিন, চার বছরের মধ্যেই কলকাতায় ফেরার চেষ্টা করবো নিশ্চয়ই! তারপরে আপনি আবার না হয় শুরু করবেন!

অদ্বিতীয়া কোনো উত্তর দেয়নি, দাদুভাই কে বললেও যে এর কোনো সুরাহা হবে না সেটা তার জানা ছিলো। তিনি যে আগেই তাঁর মতামত শুভ দের বাড়িতে জানিয়ে দিয়েছেন এটা বুঝেই সে শুধু চুপ করে শুভর মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে ছিলো। সেই থেকেই মোটামুটি কলেজে যাওয়ার উৎসাহ সে হারিয়েছে। মাঝে মাঝে গেলেও সে কলেজের ভেতরেই বসে থাকতো, সুকান্তর আসার সময় হলে গেটের সামনে এসে দাঁড়াতো। সুমন ফিরে এসেছিলো মাস খানেক পরেই, তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ছিলো অনেকবার, মাঝে মাঝেই বার বার বেজে ওঠা ফোন, কলেজের গেটের ভেতর থেকে গেটের বাইরে বাইকে হেলমেটে মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে থাকা সুমন সব কিছুই নজরে এলেও একবারের জন্যেও ফোন ধরা বা সামনে আসা কোনোটাই করে নি অদ্বিতীয়া।

সরলা তার দিক থেকে নিজের মতো করে মেয়েকে বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলো, কিন্তু নিজের অপমানের সঙ্গে সঙ্গে সুমনের দাদুভাই কেও করা অপমান মেনে নেওয়া অদ্বিতীয়ার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। ইতিমধ্যেই শুভর তাকে পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলা সরলার কানে এসেছিলো, একদিন দোতলায় কেউ না থাকার সুযোগে সরলা অদ্বিতীয়ার মুখোমুখি হলো,

পিয়া তুমি শুধু শুধু জেদ দেখিয়ে নিজেই নিজের পায়ে কুড়াল মারছো! সুমন তোমাকে বার বার ফোন করছে আমি বুঝতে পারছি, কিন্তু তুমি জেদ ধরে রাখতে গিয়ে সেই ফোন ধরছো না! তুমি কি নিজের জীবনটা শেষ করে দিতে চাইছো? শুভ তোমাকে পড়তে বা চাকরি করতে দেবে না এটা জানার পরও তুমি চুপ করে বসে আছো! জানি বাবার সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ নেই, কিন্তু ছোড়দা কে জানাচ্ছ না কেনো? তুমি যদি না বলো এবার কিন্তু আমিই কথা বলবো!

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

তোমাকে কিছু বলতে হবে না ছোটো মা! ছোটকা এই কথাগুলো জানতে পারলেই বিয়েটা বন্ধ করে দেবে! আমি এমনিতেই থানা পুলিশ করে দাদুভাই এর মাথা হেঁট করে দিয়েছি, কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে, সবাই জানে সব কিছু, এখন এই বিয়েটা যদি ক্যান্সেল হয়, তাহলে দাদুভাই এর সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না! আর দাদুভাই তো বলেই দিয়েছিলেন যদি শুভর বাড়ি থেকে চায় তাহলেই আমি পড়বো, এক্ষেত্রে তো ওদের কোনো দোষ নেই! শুভ আমাকে বলেছে যদি ও কলকাতায় ফিরে আসে কখনো তখন আমি চাইলে পড়তে বা চাকরি করতে পারি!

সরলা বিদ্রুপের হাসি হাসলো,

তাই নাকি! হবে ছেলে বলবে বাপ, সেই আশায় বসে থাক! কবে শুভ কলকাতায় ফিরবে, আদৌ ফিরবে কিনা কিছুই জানা নেই, তুমি সেই কথায় বিশ্বাস করে বসে আছো! আসলে কি জানো তো, দু ধরনের মানুষ হয়! কিছু পরিবার সোজাসুজি বলে যে আমরা বউকে পড়তে, চাকরি করতে দেবো না। আর কিছু মানুষ আছে যারা বলে বউয়ের বিয়ের পরে পড়াশোনা, চাকরি কোনো কিছুতেই আমাদের আপত্তি নেই, কিন্তু পরিস্থিতি এমন তৈরি করে যে তুমি এটুকু বুঝতে পারবে যে তুমি আসলে কিছুই করতে পারবে না! সত্যি কথা বলতে কি, আমি বরং এই প্রথম ধরনের মানুষদেরই অনেক বেশি পছন্দ করি! তাদের অন্তত মুখে এক, কাজে আরেক থাকে না!

অদ্বিতীয়া সরলার দিকে অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো,

তুমি আজ পর্যন্ত আমার জন্যে অনেক কিছু করেছো ছোটো মা! আমি জানি সব! অনেকটা ছোটো ছিলাম তখন, তাও রতন কাকার করা কাজটার কথা ভুলি নি! সেদিন তুমি না থাকলে আজ যে আমি বেঁচেই থাকতাম না, সেটাও জানি! দাদুভাই এর হাতে ধরা পড়ার হাত থেকেও গ্রামের বাড়িতে থাকার সময় তুমিই বাঁচিয়েছিলে! কিন্তু আজ আমি তোমাকে অনুরোধ করছি, এই ব্যাপারটায় তুমি আর ঢুকো না প্লিজ!

অদ্বিতীয়ার বিয়ের দিন ক্রমশ এগিয়ে আসছিলো, এমন সময় একদিন সকালে সান্যাল মশাই এর গলা শোনা গেলো,

দিদিভাই! এদিকে এসো!

অদ্বিতীয়া শুকনো মুখে বেরিয়ে এলো, তাকে দেখেই সান্যাল মশাই উচ্ছসিত হলেন,

বাড়িতে বসে আছো কেনো? যাও কলেজে যাও! আর তো কদিন বাকি! বন্ধুদের সঙ্গে একটু ঘোরাফেরা করো! বনেদি পরিবার ওরা, বিয়ের পরে তো আর খুব বেশি বাড়ি থেকে বার হতে পারবে না! ওই নাত জামাই যখন বাড়ি থাকবে তখন সঙ্গে নিয়ে ঘুরতে বেরোবে তোমায়! আমি বলে দেবো সে তোমাকে খেলার মাঠেও নিয়ে যাবে একদিন!

তাঁদের কথোপকথনের মধ্যেই ফোন বেজে উঠলো, প্রতাপ সান্যাল ফোন ধরে হ্যালো বলার সঙ্গে সঙ্গেই ফোন কেটে গেলো। বিরক্ত গলায় স্বগতোক্তি করলেন সান্যাল মশাই,

আজ প্রায় মাস খানেক ধরে প্রায় দিনই এটা হচ্ছে! ধরছি আর কেটে যাচ্ছে! কতো জরুরি ফোন আসে আমার! এরকম হলে খুব অসুবিধা! সুকান্ত তো কতোবার এক্সচেঞ্জে গেলো, কিছুই হলো না!

অদ্বিতীয়ার জানা ছিলো ওটা কার ফোন, দাদু কে অন্য মনস্ক হতে দেখে সে ঘুরে দাঁড়ালো, বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,

আমি আসি দাদুভাই? আর কিছু বলবে?

প্রতাপ সান্যাল বাস্তবে ফিরলেন,

না, না, তুমি যাও! আমি একটু ফোনটার কথা ভাবছিলাম!

দাদুভাই এর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় তার কাকার সঙ্গে দেখা হলো, সুকান্ত তাকে দেখে অবাক হলেন,

আজও যাবিনা নাকি তুই! কি করছিস? এই ভাবে কেও কামাই করে? পরে ম্যানেজ করবি কি করে? যা, যা তৈরি হ!

অনেকটা সুকান্তর জোরাজুরিতেই শেষ পর্যন্ত তৈরি হলো অদ্বিতীয়া, সুকান্ত তাকে গেটে নামিয়ে চলে যাওয়ার পরে যখন সে অন্য মনস্ক হয়ে মাথা নিচু করে কলেজের গেটের দিকে এগোচ্ছিল, তখন একটা বাইক তার পথ আটকালো। অদ্বিতীয়া চমকে তাকালো, সুমন বাইক থেকে নেমে এসে তার সামনে দাঁড়ালো, হেলমেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,

চলো! কথা আছে!

অদ্বিতীয়া কড়া চোখে তাকালো,

আমার কোনো কথা নেই! সরে যাও, আমার ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে!

সুমন শেষ চেষ্টা করলো,

ঠিক আছে! আমার সঙ্গে কথা বোলো না ইচ্ছে না হলে! কিন্তু নিজের জীবনটা এই ভাবে শেষ কোরো না অদ্বিতীয়া! শুভ খুব বাজে ছেলে, আমাদের পাড়ায় থাকে, একসঙ্গেই পড়তাম! আমি ছোটো থেকে চিনি ওকে! ঝাড়গ্রামে পোস্টিং থাকার সময়ে একটা মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলো, অনেক পয়সা দিয়ে ম্যানেজ করেছে সবটা!

অদ্বিতীয়া বিদ্রুপের হাসি হাসলো,

আমার বিয়ের খবর পেয়ে গেছো? আমার পেছনে গোয়েন্দা লাগিয়েছো নাকি? বিয়ে ভাঙতে চাও? শুভ খারাপ হোক বা ভালো, তাতে তোমার কি? পৃথিবীর সব মেয়েদের বিয়ের সময় এইভাবে তাদের হবু পাত্র সম্বন্ধে খোঁজ নাও নাকি? তুমি তো জানতাম খুব ব্যস্ত মানুষ, এতো সময় কোথায় পাও?

সুমন আহত চোখে তাকালো,

সব মেয়ে আর তুমি এক হলে অদ্বিতীয়া? পৃথিবীর সব মেয়েদের খবর রাখি না, কিন্তু তোমার টা রাখতে চাই! সেটা নিজের স্বার্থেই!

বাবাহ্! তুমি কতো ভাবো আমার জন্যে! এতো ভাবনা এতদিন কোথায় ছিলো? যখন তোমার বোন আমাকে বিপদে ফেলে পালিয়ে গেলো, তখন তো আমার কথা ভাবো নি একবারও! নিজের বোনের কথাই ভেবেছো! আমাকে অ্যারেস্ট করবে বলে তো পুলিশও পাঠিয়ে দিয়েছিলে ওপর মহলে চাপ দিয়ে!

সুমন অদ্বিতীয়া কে থামিয়ে দিলো,

বিশ্বাস করো, আমি চেনাশোনা অনেককে বলেছিলাম ঠিকই, কিন্তু তোমার বাড়িতে পুলিশ পাঠানো বা অ্যারেস্ট করার কথা একবারও বলিনি! ওটা আমার মা আর দাদা করিয়েছে অদ্বিতীয়া, আমি জানতেও পারিনি! আমি ক্ষমা চাইছি তার জন্যে!

খুব ভালো! ক্ষমা চাইলেই আমাদের বাড়ি পুলিশ আসা, আমাকে থানায় নিয়ে যাওয়া, দাদুভাই এর সম্মান সবটা ঠিক হয়ে যাবে তো? তাহলে তো আর কথাই নেই! তোমার তো অনেক ক্ষমতা এখন, মুছে দিতে পারো যদি ঘটনাগুলো তাহলে আবার আমার কাছে এসে কথা বোলো না হয়!

বিদ্রুপের গলায় বললো অদ্বিতীয়া, সুমন হতাশ ভঙ্গিতে তাকালো,

আমি সরি বলেছি অদ্বিতীয়া, প্লিজ! নিজের ভুল স্বীকার করছি!

ইতিমধ্যেই হেলমেট খুলে দাঁড়ানো সুমন কে দেখে কলেজের অনেকেই কৌতুহলী হচ্ছিলো, গেটের বাইরে একটা ছোটো খাটো ভিড় জমতে দেখে অদ্বিতীয়া চাপা গলায় বললো,

সিন ক্রিয়েট কোরো না, সরে যাও! আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে!

হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা সুমন কে টপকে গিয়ে অদ্বিতীয়া পা চালালো, আর কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকলেই দাদুর কাছে খবর পৌঁছে যাবে!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৩
ভেতরে আসবো কাকু?

সুকান্ত মাথা নিচু করে ফাইল দেখছিলেন, চোখ তুলে তাকিয়ে সামনে দাঁড়ানো সুমনকে দেখেই মনে মনে একটু চমকে গেলেন। নিজেকে সামলে নিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করলেন,

কে তুমি? কি চাও?

সুমন একটু থতমত খেলো, তার ধারণা ছিলো সুকান্ত তাকে চেনেন। সে দুটো হাত সামনে নিয়ে এসে নমস্কারের ভঙ্গি করলো,

আমি সুমন, অদ্বিতীয়ার বন্ধু সোমার দাদা!

সুকান্ত কড়া চোখে তাকালেন,

সোমা নামে অদ্বিতীয়ার কোনো বন্ধু নেই! যাইহোক, তুমি যেই হও তাতে আমার কিছু বক্তব্য নেই, প্রশ্ন হলো তোমার আমার কাছে কি প্রয়োজন?

সুমন একটু চুপ করে থাকলো, তারপরে নিচু গলায় বললো,

আমি আপনাকে কিছু কথা বলতে এসেছিলাম অদ্বিতীয়ার সম্বন্ধে! যে ছেলেটির সঙ্গে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে সে ভালো নয় কাকু, ছেলেটির ঝাড়গ্রামে পোস্টিং থাকতে একটি মেয়েকে রেপ করার অভিযোগ ছিলো।

সুকান্ত কড়া চোখে তাকিয়েছিলেন, পলক না ফেলেই বাইরের দরজার দিকে আঙুল তুললেন,

বেরিয়ে যাও! বিয়ে ভাঙাতে এসেছো!

সুমন অনুনয়ের দৃষ্টিতে তাকালো,

না, কাকু! বিশ্বাস করুন, সেরকম কোনো কিছু করার ইচ্ছে আমার নেই! আমি অদ্বিতীয়ার ভালো চাই, ওর কোনো ক্ষতি হয়ে যাক চাইনা! ছেলেটা আমার পাড়ার ছেলে, ছোটো থেকে চিনি, আমি ওর বাড়ির অ্যাড্রেস দিচ্ছি, ওই পাড়ায় গেলেই সব খবর পেয়ে যাবেন! আমি যদি একটা কথাও মিথ্যে বলে থাকি, তাহলে আপনি আমার বিরুদ্ধে যা কিছু করতে চান করবেন! এটা আমার কার্ড, এখানে আমার ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা সব আছে! আপনাকে আমি অনুরোধ করছি বিয়ে দেওয়ার আগে সবটা জানুন প্লিজ!

কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে সুকান্ত হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলেন, সুমন বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে পেছন থেকে ডাকলেন,

শোনো! তুমি অদ্বিতীয়ার ভালো করতে চাইছো কেনো? সেতো তোমার বোনের ক্ষতি করেছে অনেক!

সুমন পেছন ফিরে তাকালো, ম্লান হেসে বললো,

আমার বোন যা করেছে নিজের ইচ্ছেয় করেছে, এতে অদ্বিতীয়ার কোনো হাত নেই! হয়ত সেই মুহূর্তে আমি উত্তেজনায় ওকে ফোন করে কিছু কথা বলে ফেলেছিলাম, কিন্তু পরে বুঝেছি অদ্বিতীয়া পরিস্থিতির শিকার! আর আমার বোনের বিয়ে আমার বাবা, মা মেনে নিয়েছে, তাই এ বিষয়ে আর অদ্বিতীয়ার ওপরে রাগের কোনো কারণ নেই! আমার মনে হয়েছে এই খবরটা আপনাকে দেওয়ার দরকার, তাই দিলাম! আমি আসলে অদ্বিতীয়া কেই বলেছিলাম, ও গুরুত্ব দেয় নি, তাই আপনার কাছে আসতে বাধ্য হলাম!

সুকান্ত সরাসরি তাকালেন,

কেনো দেয়নি?

সুমন একটু চুপ করে থাকলো,

বোধহয় আমার ওপরে রাগ দেখিয়ে নিজের ক্ষতি করতে চাইছে!

তোমার ওপরে রাগ দেখিয়ে নিজের ক্ষতি করতে চাইবে কেনো? এরকম মনে হওয়ার কারণ কি?

সুকান্তর প্রশ্নে সুমন ম্লান হাসলো,

সেটা ওকেই জিজ্ঞেস করে নেবেন! আমি আসি!

সুমন বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই সুকান্ত বেরিয়ে পড়লেন, গাড়ি চালিয়ে সোজা উপস্থিত হলেন, সুমনের পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে। দোকানি তাঁকে দেখেই শশব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে এলেন,

আরে ! স্যার! আপনি! কেমন আছেন? কতোদিন পরে এদিকে এলেন আবার! সেই বন্ধুর খোঁজ পেয়েছেন নাকি?

সুকান্ত দোকানের বেঞ্চে গুছিয়ে বসতে বসতে হাত তুললেন,

বলছি! বলছি! আগে এক কাপ কড়া করে চা খাওয়ান দেখি!

দোকানি লজ্জিত হলেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ, স্যার! বসুন না!

চায়ের কাপ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এসে গেলো, দোকানির হাত থেকে কাপ নিয়ে চুমুক দিয়ে মুখ দিয়ে একটা তৃপ্তির আওয়াজ করলেন সুকান্ত,

আহ্! চাটা সত্যিই খুব ভালো করেন আপনি, আগের দিনও মনে হয়েছিলো সেটা!

দোকানি উৎসুক ভঙ্গিতে মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সুকান্ত মুচকি হাসলেন,

আপনার পাড়ার ফুটবলারের খবর কি? ক্লাব পাল্টে ফেললো নাকি?

দোকানি মাথা নাড়লেন,

নাহ স্যার! সেসব খবর আর কোথায় পাবো এখন? সেতো বাবা, মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে!

বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে! মানে?

সুকান্ত বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকালেন, দোকানি দুঃখিত হলো,

কি আর বলবো স্যার! বোনটা পালিয়ে একটা বাজে ছেলেকে বিয়ে করলো, তা সেই নিয়েই বাড়িতে নাকি কিসব রাগারাগি হয়েছে! তার বাবা, মা মেয়েকে বাড়ি ঢোকাবে, ছেলে দেবে না! কথা কাটাকাটি হতে হতে ছেলে কে বেরিয়ে যেতে বলেছে শুনলাম! সেও নাকি রাগ করে বেরিয়ে গেছে! আসলে কাজ গোছানো হয়ে গিয়েছে স্যার, বাড়ি দোতলা হয়ে গিয়েছে, ছেলে, মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, আর এখন ছোটো ছেলেকে দরকার নেই! দুনিয়াটাই স্বার্থপর স্যার, সব সম্পর্কেই স্বার্থ ঢুকে গেছে!

সুকান্ত কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পরে প্রশ্ন করলেন,

সে এখন থাকে কোথায়?

দোকানি মাথা নাড়লেন,

ঠিক জানিনা, তবে কোথাও একটা ভাড়া থাকে শুনছিলাম! যাকগে সেসব কথা, আপনি কেনো এসেছেন সেটা তো বললেন না?

সুকান্ত তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন,

হ্যাঁ! একটা কথা জানতে এসেছিলাম আপনার কাছে! শুভময় নামে এই পাড়ায় কাউকে চেনেন? ইঞ্জিনিয়ার, ধানবাদে থাকে?

দোকানি উৎসাহের গলায় বললেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ! খুব ভালো করে চিনি! ওর তো বিয়ে শুনলাম! কার্ডও তো ছাপানো হয়ে গেছে! কেনো স্যার? ওর সঙ্গে কিসের দরকার?

সুকান্ত দুঃখিত মুখে দোকানির দিকে তাকালেন, আফসোসের গলায় বললেন,

ইসস! বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে! যাহ! আমি তো তাহলে বড্ড দেরি করে ফেললাম! আসলে আমার মেয়ের সম্বন্ধের জন্যে এসেছিলাম একটু, কিন্তু বিয়ে যখন ঠিক হয়েই গেছে, তখন আর কি করা যাবে! এতো ভালো ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটা হাতছাড়া হয়ে গেলো!

দোকানি ভদ্রলোক আশেপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিয়ে সুকান্তর কানের কাছে মুখ নামালেন,

খুব জোর বেঁচে গেছেন স্যার! ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ঠিকই কিন্তু চরিত্র ভালো নয়! কিসব মেয়ে ঘটিত গন্ডগোল করেছিলো ঝাড়গ্রামে থাকার সময়! তার মেসো অনেক বড়ো উকিল, পয়সাওয়ালা লোক স্যার ওরা, ধামাচাপা দিতে অসুবিধা হয় নি! বেশ কিছু টাকা দিতে হয়েছে মেয়েকে! কি আর বলবো স্যার, যত বড়ো ফ্যামিলি, তার ততো বড়ো কেচ্ছা! ওসব ওদের কাছে জলভাত! এতো কিছুর পরেও তো শুনলাম বিরাট বড়োলোকের মেয়ের সঙ্গে নাকি বিয়ে হচ্ছে! কে জানে এরা কারা! যারা জেনেশুনে এইরকম ছেলের সঙ্গে নিজেদের বাড়ির মেয়ের বিয়ে দেয়!

অনেকটা নিজের অজান্তেই সুকান্তর গলার স্বর কড়া হলো,

জেনেশুনে বিয়ে দিচ্ছে এমন ধারণা আপনার হলো কেনো?

দোকানি ভদ্রলোক একটু থতমত খেলেন,

কিছু ভুল বলে ফেললাম নাকি স্যার? আসলে সেরকমই শুনছিলাম পাড়ায়, মেয়ের বাবারও কিছু নাকি দোষ আছে, তাই ওদের এই ছেলেতে কোনো আপত্তি নেই। শুভদের বাড়িতে যে মহিলা সব সময় থাকে, মানদা নাম, ওই সেদিন বলছিলো। মেয়ের দাদু নাকি বলেছে, বনেদিদের এসব ছোটখাটো দোষ থাকে! এমনকি অর্ধেক সম্পত্তিও দিচ্ছে ছেলে কে!

আপনি মনে হচ্ছে এই ছেলেটির কথাই আগের বার বলেছিলেন আমাকে, তাই না? শুভর বাড়ি খুঁজছি কিনা জানতে চেয়েছিলেন না?

দোকানি ঘাড় কাত করলেন,

হ্যাঁ, স্যার! সেই সময়ই তো চলছিলো ব্যাপারটা, লোকজন আসছিলো বারবার, আমার চায়ের দোকানেই বসছিলো তারা! তাই আপনাকে দেখে আমি ওদের বাড়ি যাচ্ছেন বলেই ভেবেছিলাম!

কিছুক্ষন হতবাক দৃষ্টিতে দোকানির দিকে তাকিয়ে থেকে চায়ের দাম মিটিয়ে সুকান্ত দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ালেন, তাঁকে গাড়িতে উঠতে দেখে দোকানি বললো,

আবার আসবেন স্যার!

সুকান্ত কোনো কথা না বলে গাড়ি চালিয়ে দিলেন, তাঁকে প্রতাপ সান্যালের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে!

একটু পা চালিয়ে আসুন দাদা! দেখবেন, সামনেই বড়ো একটা নর্দমা আছে!

আশার বাড়ির দরজায় টোকা মারতে মারতে অন্ধকারের মধ্যে কোনো মতে হাতড়াতে হাতড়াতে গলির মধ্যে ঢুকে আসা সঙ্গের সাংবাদিক ছেলেটা কে বললো রতন। ছেলেটা এদিক ওদিক তাকিয়ে গলার স্বর নিচুতে নামালো,

বেশ ভালো জায়গায় লুকিয়েছেন তো মশাই! আপনাদের মতো ভদ্র লোকেদের বাড়ির মানুষদের সোর্স যে এরকম জায়গায় থাকতে পারে, কারো কল্পনায়ও আসবে না কখনো!

রতন গম্ভীর হলো, চাপা গলায় বললো,

সোর্স হলো সোর্স! ভদ্রলোকদের সোর্স বস্তিতে থাকেনা, এটা আবার আপনাকে কে বললো? এটা ওরই বাড়ি! ও এখানেই থাকে, আমার পিসির বাড়িতে টুকটাক কাজ করতো! আমি ওকে লুকিয়ে রাখিনি!

সাংবাদিক ছেলেটি নিজেকে সামলে নিলো,

না, না আমি ঠিক এই ভাবে বলতে চাই নি! আসলে আপনার পিসেমশাই খুব প্রতাপশালী! গোটা কলকাতা শহরে ওনার নাম আছে! তাঁর খবর পাওয়ার জন্যে আমি ভেবেছিলাম বেশ ক্ষমতাবান কারোর কাছে যেতে হবে! এ তো দেখছি চুনোপুঁটি, শেষ মুহূর্তে বেঁকে বসবে না তো! আমি কিন্তু বিপদে পড়ে যাবো তাহলে! সম্পাদক মশাই বলেছেন, এটা করে দিতে পারলেই আমি পার্মানেন্ট হবো! উনি নিজে কথা বলতে আসবেন কিন্তু সোর্সের সঙ্গে, তখন যেনো আমি বিপদে না পড়ি!

রতন মুচকি হাসলো,

কে বলেছে সোর্সের খোঁজে বড়ো বড়ো জায়গায় যেতে হয়! যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলে পাইতে পারো, অমূল্য রতন! শোনেন নি, এই প্রবাদটা? এর কাছে যা রত্ন আছে না, সান্যাল বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার জন্যে যথেষ্ট! প্রতাপ সান্যালের মাথা নিচু মানেই বনেদী সান্যাল বংশের মাথাও একেবারে মাটিতে মিশে যাবে!

আরো বার দুয়েক টোকার পরে দরজাটা অল্প খুলে মুখ বার করলো আশা, রতন পাশে দাঁড়ানো সাংবাদিকের দিকে ইশারা করলো,

কাল সন্ধ্যেবেলায় এই বাবুর সঙ্গে গিয়ে ছাতা কারখানার গলিতে আরেক বাবুর সঙ্গে একবার দেখা করে নিবি! ব্যাস, তারপরে একদম কোর্টে আসবি, আর তোকে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে না!

আশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো,

অন্য বাবুটা কে গো রতন দাদাবাবু? জানিনা, চিনিনা অন্য কারো সঙ্গে কথা কইতে যাবো কেনো?

রতন বিরক্ত হলো, কিছু বলতে যাওয়া সাংবাদিক ছেলেটিকে হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিয়ে বললো,

আহ্! তোর বড়ো কথা! যা বলছি তাই কর! আমিই তোকে নিতে আসতে পারতাম, কিন্তু সেটা আমাদের দুজনের জন্যেই ভালো হবে না! কেউ একসঙ্গে আমাদের দেখে ফেললে দুজনেরই বিপদ! শুধু কালকের দিনটা, আর তোকে বেরোতে হবে না কোর্টের দিন ছাড়া! আর তখন তো তুই সাক্ষী, দেখি প্রতাপ সান্যালের কতো দম, ওই সাক্ষীকে সরায়!

আশাকে এরপরেও চিন্তিত মুখে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাংবাদিক ছেলেটা মুখ খুললো,

আরে ভয়ের কিছু নেই, উনি আমাদের কাগজের মালিক! তোমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চান! যা জানো সবটা বলবে, কিছু লোকাবে না! তাহলে কাল এরকম সময়েই আসবো? আমি নিজে এস নিয়ে যাবো তোমাকে, চিন্তা করোনা!

একটু রাতের দিকে যখন রথীন এর ফোনটা এলো তখন প্রতাপ সান্যাল শুয়ে পড়ার তোড়জোড় করছিলেন। সরযূ ফোন ধরে স্বামী কে দেওয়ার আগেই সুকান্ত আচমকা ঘরে ঢুকে এসে মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে চিৎকার করে উঠলেন,

বাবা কে বলে কোনো লাভ নেই, তাই সরাসরি তোমাকেই একটা কথা বলছি রথীন দা! পিয়ার এখানে বিয়ে আমি কিছুতেই দেবো না! তোমার শালীর ছেলের গুনপনা আমি সব শুনতে পেয়েছি! হতে পারে সেসব তুমি নিজের ক্ষমতায় ধামাচাপা দিয়েছো, কিন্তু তার মানেই কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যায় না!

রথীন ফোনের ওপারে সশব্দে হেসে উঠলেন,

তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে সুকান্ত! কোনো প্রমাণ ছাড়া এসব কথা তোর মতো উকিলের মুখে মানায় না! এতো ভালো ছেলের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে তোর ভাইঝির, কেউ সেই বিয়ে ভাঙাতে চাইছে! আরে! পিয়া কি আমার কেউ নয়, জেনেশুনে আমি ওর ক্ষতি করতে পারি কখনো?

সুকান্ত কয়েক মুহূর্ত থমকে থেকে চিৎকার করলেন,

আর অর্ধেক সম্পত্তির কথাটা? এটাও রটনা বলতে চাও তুমি? তোমার ভায়রা ভাই আমাকে কথা দিয়েছিলেন এরকম কিছু হবে না!

রথীন আবারও হেসে উঠলেন,

শান্ত হ দেখি একটু! এটাও রটনা ছাড়া আর কিছুই নয়! আগের কথাগুলোই তুই শুনছিস এখন, যা কথা তোকে দেওয়া হয়েছে তার কোনো নড়চড় হবে না!

সুকান্তর হটাৎ করেই নিজেকে অসহায় লাগলো, সত্যিই কোনো প্রমাণ ছাড়া তিনি এই বিয়ে কিছুতেই ঠেকাতে পারবেন না। আর রথীন যা ধুরন্ধর, সে যখন এতো জোরের সঙ্গে কথাগুলো বলছে, তখন নিশ্চয়ই সে কোনো প্রমাণ রাখেনি! সুকান্তর এই ভাবনার মধ্যেই প্রতাপ সান্যাল ছেলের হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলেন, ছেলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললেন,

রথীন কে অহেতুক অপমান করো না! সে আমাদের ভালো বই খারাপ চায় না কখনো! তুমি ঘরে যাও, অনেক রাত হয়েছে এখন! যা বলার সেটা আমাকে বোলো, কিন্তু কাল সকালে!

সুকান্ত বেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল ফোন মুখের কাছে নিয়ে এলেন,

বলো রথীন! এতো রাতে যখন ফোন করেছো তখন নিশ্চয়ই কিছু জরুরি দরকার?

রথীন ফোনের ওপারে গলা নামালেন,

সোর্সের নাম পাওয়া গেছে জ্যেঠু বাবু! মেয়েটার নাম আশা, আপনাদের বাড়িতে নাকি কাজ করতো আগে! কাল শুভঙ্করের সঙ্গে সন্ধ্যেবেলায় দেখা করতে আসছে ছাতা কারখানার কাছে কোথাও, আমি শুভঙ্করের সঙ্গে কথা বলে নিয়েছি! ও বলেছে মিটিয়ে নেবে সবটা, একটু খরচ করতে হবে, এই আর কি! সেটা আমিই দিয়ে দেবো, আপনাকে চিন্তা করতে হবে না!

আশা! সে রতনের সোর্স! আশ্চর্য্য! সে কি এমন খবর জানে! কতোকাল আগে সে আমার বাড়ির কাজ ছেড়েছে!

বিস্মিত হবার ভান করে বললেন প্রতাপ সান্যাল, রথীন গলা নিচু করলেন,

খবর তো অনেক আছে জ্যেঠু বাবু, কিন্তু সেসব আমিই সামলে নেবো, আপনাকে চিন্তা করতে হবে না!

তুমি আছো, আমি নিশ্চিন্ত রথীন! এই বয়সে আর এতো অশান্তি ভালো লাগে না! এখন কি আর সেই বয়স আছে আমার, যে এসব মুখ বন্ধ করতে ছুটবো? যা করার সব তোমার ওপরে ছেড়ে দিলাম, শুধু দেখো, একটা শব্দও যেনো বাইরে না আসে!

হতাশ গলায় বললেন প্রতাপ সান্যাল, রথীন হাসলেন,

নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন জ্যেঠু বাবু, আমি আছি!
ক্রমশ