সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0
217

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৭
দিনটা রবিবার, কলেজ, কোর্ট কোথাও বেরোনোর তাড়া নেই আজ! অনেকটা ইচ্ছে করেই এই দিনটা কেই বেছে নিয়েছিলেন সুকান্ত, তাঁকে বাবার মুখোমুখি হতে হবে। সকালের জলখাবারের পর্ব মিটে যেতেই সুকান্ত সরাসরি বাবার ঘরে ঢুকে এলেন, প্রতাপ সান্যাল তখন সদ্য সেদিনের সংবাদপত্র হাতে আরাম কেদারায় গা এলিয়ে বসেছেন, তাঁর সামনে খাটে পা ঝুলিয়ে গম্ভীর মুখে বসে আছেন সরযূ!

সুকান্ত কে পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে আসতে দেখেই সরযূ উজ্জ্বল মুখে ছেলের দিকে তাকালেন, ছোটো ছেলেই এই বিয়ে বন্ধ করে তাঁর অর্ধেক সম্পত্তি যাওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে বলে তিনি আশায় আছেন! সুকান্ত বাবার সামনে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিলেন, সান্যাল মশাই খবরের কাগজ থেকে চোখ তুলে তাকালেন,

কিছু বলবে?

সুকান্ত সম্মতি জানালেন,

হ্যাঁ! বলবো বলেই তো এসেছি! আমি পিয়ার সঙ্গে কথা বলেছি আলাদা ভাবে, এই বিয়েতে তার মত নেই!

প্রতাপ সান্যাল সোজা হয়ে উঠে বসলেন, বিস্ময়ের গলায় বললেন,

দিদিভাইয়ের মত নেই! কি দিন এলো! মেয়েও নিজের বিয়েতে মতামত দেবে! কাদের সঙ্গে মেলামেশা করছে ও? এতো বাচালতা তো ওর আগে ছিলো না!

সুকান্ত হাত তুললেন,

এসব অপ্রাসঙ্গিক কথা! এসব নিয়ে আলোচনা করে সময় নষ্ট করে লাভ নেই! শিক্ষিত মেয়ে, তার মতামত তো থাকবেই! এটা তোমাদের সময় নয়, এখন যুগ অনেক এগিয়ে গেছে!

সান্যাল মশাই থমথমে মুখে তাকালেন,

এই জন্যেই মেয়েদের বেশি শিক্ষিত হতে নেই! তাকে ওকালতি পড়তে দেওয়া যে ভুল হয়েছে, সেটা সে প্রতি পদে প্রমাণ করছে! শিক্ষা শুনেছি বিনয় দান করে! কিন্তু অপাত্রে শিক্ষা যে কতো ক্ষতিকারক, সেটা এখন নিজেরাই বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই! যাক! এসব তর্কে সময় নষ্ট করতে আমিও চাইনা! তার কি মতামত আছে সেটা শুনি!

সুকান্ত মাথা কাত করলেন,

ঠিক! এ ব্যাপারে আমিও তোমার সঙ্গে একমত, অহেতুক বিতর্ক করে লাভ নেই! আসল কথা হলো, সে অন্য একটি ছেলেকে পছন্দ করে, তাকেই বিয়ে করতে চায়! ছেলেটি কে তুমি চেনো, সুমন ব্যানার্জি, আমাদের ক্লাবেই খেলে! আমার মনে হয় তাকে জোর করে কোনো কিছু করতে বাধ্য না করানোই ভালো!

প্রতাপ সান্যাল বিদ্রুপের হাসি হাসলেন,

তোমার মনে হয়? তোমার মনে কি হচ্ছে সেটা আমি জানতে চাই না, আমি দিদিভাইয়ের সঙ্গে কথা বলবো!

প্রতাপ সান্যাল চিৎকার করে নাতনির নাম ধরে ডাকলেন, নিজের ঘরে উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অদ্বিতীয়া শক্ত করে ছোটো মার হাত চেপে ধরলো। সরলা অদ্বিতীয়ার চোখের দিকে তাকালো,

যাও! ভয় কি! তুমি কোনো অন্যায় করছো না!

অদ্বিতীয়া পায়ে পায়ে দাদুর ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো, পর্দা তুলে তাকে ঢুকতে দেখেই সান্যাল মশাই কড়া চোখে তাকালেন,

তোমারও নাকি নিজস্ব মতামত আছে শুনলাম! তুমি নাকি অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাও?

অদ্বিতীয়া মাথা নিচু করে ঘরের মেঝেতে পায়ের নখ ঘষতে ঘষতে মাথা কাত করলো,

হুঁ!

এই ছেলেটির বোনই তো তোমাকে মিথ্যে বলে বিপদে ফেলে কার সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিলো না? ছেলেটি তো তোমার নামে পুলিশে অভিযোগ করেছিলো শুনেছিলাম তখন!

অদ্বিতীয়া পায়ের নখ মাটিতে ঘষতে ঘষতেই মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,

ও করেনি দাদুভাই, ওর বাড়ির লোকেরা করেছিলো! ও এসবের কিছু জানতো না!

প্রতাপ সান্যাল সজোরে আরাম কেদারা ঠেলে দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, চিৎকার করে বললেন,

“ও”! ও বলার মতো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে! এতো স্পর্ধা ওই ছেলের যে আমার বাড়ির মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা তৈরি করার সাহস রাখে! বৌমা! রতিকে আমার ঘরে ডেকে দাও! এক্ষুনি!

রতিকান্ত নিজের ঘরে বসেই বাবার চিৎকার শুনছিল, সরলাকে দৌড়ে ঘরে ঢুকতে দেখে নির্বিকার ভঙ্গিতে তাকালো,

বাবা তোমাকে এক্ষুনি ডাকছেন, তাড়াতাড়ি চলো! পিয়া খুব বিপদে পড়েছে, বাবা ভীষণ রেগে গেছেন!

রতিকান্ত নড়লো না, উল্টে বাবার ঘর অবধি আওয়াজ পৌঁছে যায় এতটা জোরে গলা তুলে বিদ্রুপের সুরে বললো,

অদ্বিতীয়া সান্যাল কি প্রতাপ সান্যালের মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছে নাকি? বাহ! বাহ! খুব ভালো! সুকান্ত সান্যাল যা পারেনি এতকাল, তার মেয়ে তাই করে দেখালো! ইসস! তোর জন্যে বড্ড আফসোস হচ্ছে সুকান্ত, তুইও যদি পারতিস তখন, তাহলে আর তোকে আই বুড়ো হয়ে ঘুরতে হতো না এতকাল!

প্রতাপ সান্যাল বড়ো ছেলের সব কথাই শুনতে পাচ্ছিলেন, সে যে তাঁর ডাকেও আসবে না সেটা বুঝতে পেরে এবার সুকান্তর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকালেন,

তুমি কি ভাইঝি কে দিয়ে আমার ওপরে শোধ তুলছো নাকি! যা তুমি পারোনি তাই তাকে দিয়ে করাতে চাইছো এখন! তাহলে জেনে রাখো, প্রতাপ সান্যাল এখনো মরে যায়নি! আমি বেঁচে থাকতে আমার বংশের মেয়ের এই রকম ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে না!

সুকান্ত বাধা দিলেন,

দাঁড়াও, দাঁড়াও! ঠিক কি রকম ছেলে? ছেলের মধ্যে কি দোষ আছে তুমি আমাকে বলো? জানি তুমি একটা কথাই বলবে, বনেদিয়ানা, বংশ! ওরকম বনেদি বংশের ছেলে তো অনেক দেখলাম! জলজ্যান্ত উদাহরণ তো আমাদের নিজেদের বাড়িতেই আছে, বাইরে কোথাও খুঁজতে যেতে হবে না! তোমার বড়ো ছেলে, সেতো নাকি বনেদি! তার কি কি দোষ আছে সেগুলো জানতে চেয়ে তোমাকে বিব্রত করবো না, শুধু একটা গুণের কথা তার বলো তুমি? তারপরে রতন দা! তারও তো গুণের অন্ত নেই! একটা বউকে বিনা চিকিৎসায় মারলো, একটাকে বাচ্চা হয়নি বলে বিদায় করেছে! যোগ্যতা কি তার? বাপের রেখে যাওয়া সম্পত্তি মদ খেয়ে ওড়ানো ছাড়া আজ পর্যন্ত সে বংশের মুখ উজ্জ্বল করার মতো ঠিক কি কি করেছে?

এসব প্রশ্নের কোনো সঠিক উত্তর খুঁজে না পেয়ে প্রতাপ সান্যালের মুখ রাগে থমথম করতে লাগলো, হটাৎ করেই তিনি ছোটো ছেলের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে আঙুল তুললেন,

বেরিয়ে যাও আমার বাড়ি থেকে! বিয়ের সময় তোমাকে আমি এখানে দেখতে চাই না!

সুকান্ত স্থির দৃষ্টিতে বাবার মুখের দিকে তাকালেন,

জানতাম তুমি এমনই কিছু করার কথা ভাবতে পারো! আর কিছু না বাবা, তোমার সমস্যা কোথায় বলতো? এই বনেদী ঘর, বনেদী বংশ, এই যে কথাগুলো তুমি বলো না সব সময়, এগুলো আর কিছুই নয় আসলে তোমার জেদের বহিঃপ্রকাশ! এগুলো সবই অজুহাত মাত্র, আসলে এই সব কে শিখণ্ডী করে তুমি নিজের জেদকে পরিণতি দিতে চাও! তুমি আসলে পিয়ার ভালো চাওনা কিন্তু কারণ তোমার হাতে যা সোর্স আছে শুভ নামের ছেলেটি যে ভালো নয় সেটুকু জানা খুব কঠিন ব্যাপার ছিলো না! কিন্তু তুমি জানতে চাওনা সেসব! কারণ তোমার কাছে তোমার ইচ্ছেটাই সব, অন্য কারো ভালো লাগা, খারাপ লাগার কোনো মূল্যই নেই! এগুলো তোমার ইগো, তুমি লোককে বলবে তোমার নাতনির বনেদী, ইঞ্জিনিয়ার ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছো, তার বিয়েতে কতো খরচ করেছো, এগুলোর মধ্যে তোমার অহংকার প্রকাশ পাবে!

প্রতাপ সান্যাল চিৎকার করে উঠলেন,

আমি তোমাকে আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি! আর বিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুমি এখানে পা দেবে না!

সুকান্ত হাসলেন,

তুমি ভুলে যাচ্ছ, আমারও একটা বাড়ি আছে! পিয়া অ্যাডাল্ট, তার অমতে তুমি তার বিয়ে কিছুতেই দিতে পারবে না! দরকার হলে আমি তোমার বিরুদ্ধে কোর্টে যাবো, বিয়ে আমার বাড়ি থেকেই দেবো!

সুকান্ত বেরিয়ে গেলেন, প্রতাপ সান্যাল স্থির দৃষ্টিতে ছোটো ছেলের চলে যাওয়া দেখলেন, তারপরে সরলার উদ্দেশ্যে কড়া গলায় বললেন,

মেয়ে এবার থেকে তোমার দায়িত্বে থাকলো! দেখো, বিয়ের আগে যেনো বাড়ির বাইরে আর সে পা না দেয়!

সরলা কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই সান্যাল মশাই হাত তুললেন,

আমি যা বলার ইতিমধ্যেই বলে দিয়েছি, আর এই প্রসঙ্গে একটা কথাও হবে না! তুমি তোমার কাজ করো, বিয়ের জোগাড়ে হাত লাগাও তাড়াতাড়ি।

অদ্বিতীয়া মাথা নিচু করে সরলার সঙ্গে বেরিয়ে গেলো, তাদের চলে যাওয়ার পরে সান্যাল মশাই ফোন হাতে তুলে নিলেন,

রতন! এক্ষুনি আমার সঙ্গে এসে দেখা করো!

সরযূ সন্দিগ্ধ চোখে স্বামীর দিকে তাকালেন, এগিয়ে এসে বললেন,

রতন কে তোমার কি দরকার?

প্রতাপ সান্যাল গর্জে উঠলেন,

তোমাকে কি সব কিছুর কৈফিয়ত দিতে হবে? যাও! নিজের কাজে যাও! বৌমার সঙ্গে বিয়ের কাজে হাত লাগাও!

কিছুক্ষনের মধ্যেই রতন সান্যাল বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো, প্রতাপ সান্যাল তখন দোতলার বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে ইতস্তত করতে দেখে ওপর থেকেই চিৎকার করলেন,

ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? এসো, ওপরে উঠে এসো!

সরলা তখন রান্নাঘরে ছিলো, তার মুখোমুখি হয়ে রতন মুখ কাঁচুমাচু করে হাত জোড় করলো,

আমি নিজের ইচ্ছেয় এখানে আসিনি! পিসেমশাই আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন!

সরলা তাকে দোতলার সিঁড়ির দিকে ইশারা করলো,

যান! বেশিক্ষন থাকবেন না! প্রয়োজনীয় কথা বলে এক্ষুনি চলে যাবেন!

রতন ওপরে উঠে এলো, তাকে ঘরে ঢুকিয়ে সরযূর সন্দিগ্ধ দৃষ্টিকে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে সান্যাল মশাই সজোরে ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলেন। সরযূ যদিও সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় কান পাতলেন, কিন্তু ভেতরের আলোচনা তাঁর কানে এলো না!

বেশ বেলার দিকে সুকান্ত রমার আশ্রমে ঢুকলেন, চেয়ার টেনে বসতে বসতে রমার দিকে তাকিয়ে বিজয়ীর হাসি হাসলেন,

পিয়ার রেজিস্ট্রির নোটিস দিয়ে এলাম! বিয়ে কিন্তু এখান থেকেই হবে, তোমার আপত্তি নেই তো?

রমা হাসলেন,

বাড়ি তোমার, আর তুমি আমার কাছে অনুমতি চাইছো! আপত্তির কিছু নেই, শুধু জানতে চাইছি ওখান থেকে সম্ভব হলো না, তাই না?

সুকান্ত মাথা নাড়লেন,

নাহ! অনেক চেষ্টা করলাম! বাবার জেদ তো জানো! কিন্তু এবার এটা বোঝানোর সময় এসেছে যে অন্যায় জেদকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না! আর এবার একটা অন্য সুবিধা আছে, মা এখন আমাকেই সমর্থন করছেন! যদিও তাঁর উদ্দেশ্য অন্য, তবু বাবা এইবার মায়ের সমর্থনও না পেয়ে একদম একঘরে হয়ে গেছেন!

রমা একটু চিন্তিত হলেন,

অতো সহজে হবে না সব কিছু! তোমাকে আরো বড়ো লড়াইয়ের জন্যে তৈরী থাকতে হবে কিন্তু! আগের বারের কথা মনে আছে? তখনও তুমি এরকমই বলেছিলে! তোমার মনে হয়েছিলো তুমি ওনাদের মত আদায় করতে পারবে! কিন্তু হলো না তো!

সুকান্ত রমার চোখের দিকে তাকালেন,

জানি তখন পারিনি, কিন্তু এবার ঠিক পারবো! তখন আমাদের বয়স কতো ছিলো বলো? বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে লড়ার মতো সাহস দেওয়ার কেউ ছিলো না! কিন্তু এখন তো আমি নিজেই পরিণত! আজ পিয়ার জন্যে আমি আছি, তখন আমাদের জন্যে কেউ ছিলো না রমা!

সুকান্তর গলায় হতাশার সুর রমার কানেও বাজলো, তিনি দুঃখিত হলেন,

আমি তো ওনার হুমকি অগ্রাহ্য করেও রাজি ছিলাম সুকান্ত, তুমি পিছিয়ে গেলে! তোমার মনে হচ্ছিলো আমার প্রাণ সংশয় হতে পারে!

একটুও ভুল ভাবিনি রমা, আমার বাবা কে আমি খুব ভালো করে চিনি! শুধু বাবা কেনো, একই কাজ আমার কাকা, দাদুরাও করেছেন! বাবা তোমাকে মিথ্যে হুমকি দেননি তখন! আমরা যদি জোর করে বিয়ে করেও নিতাম তাহলেও তুমি খুন হয়েই যেতে, কিছুতেই সংসার করতে পারতে না! তার থেকে এই ভালো, অন্তত তোমাকে চোখের সামনে দেখতে তো পাই! যতক্ষন না তোমার সঙ্গে সান্যাল বাড়ির সম্পর্ক হচ্ছে ততক্ষন তোমার কোনো বিপদ নেই!

রমা মলিন হাসলেন, চিন্তিত গলায় বললেন,

যাকগে! ওসব পুরনো কথা এখন থাক! কিন্তু তোমার আন্দাজ যদি সঠিক হয়, তাহলে সুমনেরও প্রাণ সংশয় হতে পারে, এটা কি তুমি ভেবে দেখেছো একবারও? আমি ছেলেটিকে নিয়ে চিন্তিত হচ্ছি সুকান্ত!

সুকান্ত হাসলেন,

অবশ্যই ভেবেছি! তবে আজ থেকে পঁচিশ, ত্রিশ বছর আগের প্রতাপ সান্যাল এর সঙ্গে আজকের প্রতাপ সান্যালের যে কিছু ফারাক আছে এটা তুমি মানো নিশ্চয়ই? সেই দাপট সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে রমা, বয়সটা বাবার আরও বেশ কিছু বছর এগিয়ে গেছে এখন! বয়স বাড়লে রক্তের গরমও কমে যায়! আর একটা কথা ভেবে দেখেছো, আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের আমিও তো আর নেই, এখন আমি অন্য সুকান্ত! শুধু প্রতাপ সান্যালের ক্ষমতার কথাই ভাবছো, সুকান্ত সান্যাল কে তুমি ধর্তব্যের মধ্যেই নিয়ে আসছো না! স্বীকার করি আর না করি সান্যাল বংশের রক্ত তো আমারও, তাই এমনিতেই ইচ্ছেয় হোক বা অনিচ্ছেয় সেসব অন্যায় কৃতকর্মের ভাগীদার আমি হবোই! আর এমনই যখন ভাগীদার হবোই তখন একটা ভালো কাজের জন্যে দু একটা খারাপ কাজ করতে আমি পিছপা হবো না!

রমা খানিকক্ষন অবাক হয়ে সুকান্তর দিকে তাকিয়ে থাকলেন, তাঁর মুখ থেকে স্বগতোক্তি বেরোলো,

কি বললে! প্রয়োজনে তুমিও দু একটা খারাপ কাজ করতে পারো! তুমি সত্যিই বদলে গেছো সুকান্ত, তোমার কথার মধ্যে আমি যেনো সেই পঁচিশ বছর আগের তোমার বাবা কে দেখতে পেলাম, যিনি টাকার অফার ফিরিয়ে দেওয়ায় আমার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলেছিলেন, বংশ মর্যাদা রক্ষার জন্যে তিনি দু একটা খারাপ কাজ করতে পিছপা হন না!

সুকান্ত রমার চোখে চোখ রাখলেন,

শুধু প্রতাপ সান্যালের সঙ্গে সুকান্ত সান্যালের ফারাক একটাই, তিনি বংশের সম্মান, বনেদিয়ানা, মর্যাদা কে ঢাল করে নিজের জেদ বজায় রাখতে খারাপ কাজ করার হুমকি দিয়েছিলেন তোমাকে আর আমি সেই জেদটাকেই ভেঙে পিয়ার ভালোলাগা কে প্রাধান্য দেবার জন্যে তাঁকে খারাপ কাজের হুমকি দিচ্ছি!

রমা উঠে দাঁড়ালেন,

এই হুমকি জিনিসটাই আমার পছন্দ নয়! যাকগে অনেক বেলা হয়ে গেছে খেতে এসো!

সান্যাল বাড়ির থমথমে পরিবেশ রাত গড়াচ্ছিল, ছেলের সঙ্গে তর্ক, বিতর্কের পর আজ আর চেম্বারে যাননি সান্যাল মশাই, নিজের ঘরের সামনের বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। রাত যখন প্রায় আটটা তখনও সুকান্ত বাড়িতে ফিরলেন না দেখে সরযূ ক্ষিপ্ত হলেন, পাছে সুকান্ত না থাকার সুযোগে স্বামী আরও কিছু করে বসেন অনেকটা সেই ভয়েই তিনি বাড়িতে অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি করলেন,

রাত কতো হলো দেখেছো? ছেলে তো সত্যিই বাড়ি এলো না! একদম ছেলেটাকে বাড়ি ছাড়া করে ছাড়লে! কিসের এতো জেদ তোমার! যে রথীন এর কথায় উঠছো, বসছো সেই রথীন তোমার সব নিয়ে একদিন পথে বসিয়ে ছাড়বে বলে দিলাম!

প্রতাপ সান্যাল কড়া চোখে তাকালেন,

রথীন আমার কাছে শিশু! তাকে এক হাটে কিনে অন্য হাটে বিক্রি করার ক্ষমতা রাখি আমি! সে করবে আমার ক্ষতি!

সরযূ তাঁর শেষ অস্ত্র বার করলেন, আঁচলে চোখের জল মুছতে মুছতে স্বামীর দিকে তাকালেন,

আজ যদি সে বাড়ি না ফিরে ওই মেয়ের আশ্রমে থেকে যায়, তাহলে তুমিই দায়ী হবে কিন্তু! এতো বছর ধরে তাকে আটকে রাখলাম, ওই মেয়ের ছায়া মাড়াতে দিইনি কখনো, শেষ পর্যন্ত সে তোমার দোষেই ওই বাড়িতে উঠলো আজ! তখন কতো করে বলেছিলুম ওগো ছেলে কে জিজ্ঞেস করো কেনো সে বাড়ি কিনছে, তা একবারও জিজ্ঞেস করলে এতবছরে তাকে! এখন তো বুঝতে পারছি ইচ্ছে করেই করো নি তখন! তুমিও চেয়েছিলে সে বাড়ি ছাড়াই হোক!

স্ত্রীর চোখের জল সান্যাল মশাই কে নরম করে ফেললো,

কবে আর তোমার ছেলেদের বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছি গিন্নী, তুমি বলতো? তোমার মুখ চেয়েই তো তোমার ঐ কুলাঙ্গার বড়ো ছেলেকেও বার বার মাফ করে দিয়েছি, কম টাকা আমার সে ওড়ায় নি আজ পর্যন্ত! কি না করেছে সে! কোথা থেকে যে ওই মেয়ে কে এনে তুললো কে জানে! আজ বুঝছি তোমার কথাই ঠিক, শুদ্ধ বনেদী রক্ত থাকলে কি আর আমার নাতনি ওই রকম ছেলের পাল্লায় পড়ে কখনো! কিন্তু কি করবো এখন, আমার একটা সম্মান, বংশ মর্যাদা আছে! আমার বাড়ির মেয়ের এরকম বিয়ে হতে পারেনা কখনো, সেটা আমার সম্মানের জন্যে ক্ষতিকারক! নিজের সম্মান রাখতেই যে করেই হোক এই বিয়ে হতে দেওয়া চলবে না গিন্নী, সেটা তুমি বোঝার চেষ্টা করো! আর তোমার ছোটো ছেলের কথা বলছো? সে নিজের প্রয়োজনেই বাড়ি ফিরে আসবে, সে তার ভাইঝি কে একা ফেলে অন্য কোথাও থাকবে না! তোমার কোনো চিন্তা নেই!

সরযূ শেষ চেষ্টা করলেন,

তাই বলে অতোটা সম্পত্তি দিয়ে দেবে! একটা অজাত কুজাতের মেয়ের হাতে সব চলে যাবে!

সান্যাল মশাই মাথা নাড়লেন,

অজাতের মেয়েকে দিচ্ছি না গিন্নী, সত্যি যদি তাই হতো তাহলে কি দিতাম! তুমিও জানো তার গায়ে আমার রক্ত আছে! সেটুকুর সম্মান তো আমাকে রাখতেই হবে! আর একটা কথা কি জানো, এতো বছরে একটা মায়া পড়ে গেছে তার ওপরে, ছোটো বেলায় যা চেয়েছিলাম করতে, বড়ো হয়ে তো আর সেটা পারিনি! আর পারিনি যখন তখন নিজের রক্ত কে সেরাটাই দেবো আমি, এ ব্যাপারে কারো কোনো মতামত শুনবো না!

শেষের দিকের কথাগুলো কড়া শোনালো, সরযূ মুখ বেঁকালেন,

শুধু রক্ত আর বংশ! এই করে করেই সব গ্যালো আমার! মরণ!

দুপুরে আশ্রম থেকে খেয়ে দেয়ে বিকেলে চেম্বারে আসতে একটু দেরি হয়েছিলো সুকান্তর, তাই আজ চেম্বার থেকে বেরোতেও একটু দেরিই হয়ে গেল। ঘড়িতে রাত প্রায় নটা বাজতে দেখে তিনি যখন ফাইলপত্র গুছিয়ে নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসবেন বলে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, এমন সময় দরজার পর্দা সরিয়ে রতন ঢুকলো। তাকে সামনে দেখেই সুকান্ত উত্তেজিত হলেন,

কি চাই এখানে? প্রতাপ সান্যাল কিছু বলে পাঠিয়েছেন নিশ্চয়ই?

রতন মাথা নাড়লো,

নাহ! নিজের দরকারেই এসেছি! তোর সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে সুকান্ত, মাথা ঠাণ্ডা করে শোন! তোর, আমার দুজনেরই খুব বিপদ!

সুকান্ত কয়েক মুহূর্ত স্থির দৃষ্টিতে রতনের দিকে তাকালেন, তারপরে উল্টোদিকের চেয়ারের দিকে ইশারা করলেন,

বসো!

রতন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়লো, টেবিলের ওপরে রাখা জলের জগ থেকে ঢক ঢক করে জল ঢাললো গলায়, তারপরে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিয়ে গলার স্বর নিচু করলো,

পিয়ার সঙ্গে যে ছেলেটার বিয়ে দিতে যাচ্ছিস, তার খুব বিপদ! পিসেমশাই তাকে সরিয়ে ফেলতে চায়!

সুকান্তর মুখে কোনো পরিবর্তন দেখা গেলো না, তিনি উকিলি দৃষ্টিতে রতনের দিকে তাকালেন,

বুঝলাম! কিন্তু এই খবরটা আমাকে জানিয়ে তোমার লাভ?

রতন মাথা নাড়লো,

কোনো লাভ নেই, বিশ্বাস কর! আমি জব্বর ফেঁসে গেছি সুকান্ত, এগোনো, পেছনোর কোনো জায়গা নেই! আর পারছি না! ভদ্রলোকের ছেলে, চোর ডাকাত নই, তাই বেরিয়ে আসতেও পারছি না! তোর বাবা আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে কাজ হাসিল করতে চাইছে! আমাকে সকালে বাড়িতে ডেকে কাজটা করে দিতে বলেছে!

সুকান্ত সরাসরি তাকালেন,

তুমি রাজি হচ্ছো কেনো? পারবে না, জানিয়ে দিলেই হতো!

রতন মাথা নামালো,

নিজের কবর নিজেই খুঁড়ে ফেলেছি রে! রতি কে জানিয়েছিলাম অনেক আগেই, তার তো কোনো হেলদোল নেই, তাই এবার তোর কাছেই এলাম!

সুকান্ত সোজা হয়ে বসলেন,

উকিল আর ডাক্তার, এদের কাছে সত্যি গোপন করতে নেই, জানো তো? সবটা খুলে না বললে আমি তোমাকে কোনো সাহায্য করতে পারবো না!

রতন আর দেরি করলো না, মায়ার মৃত্যু থেকে আশার মৃত্যু, পিয়া কে মারার চেষ্টা সবটাই সে সুকান্তর কাছে উগরে ফেললো, সুকান্তর হাত জড়িয়ে ধরে বললো,

খুব ভুল করে ফেলেছি, পিসির কথা ফেলতে পারিনি তখন! আমারও মনে হয়েছিলো ওসব অজাত, কুজাতের রক্ত, সরিয়ে দেওয়াই উচিত! পরে বুঝলাম, রক্তের দোষ নেই, দোষ আমাদের মানসিকতার! এখন দ্যাখ! বনেদি রক্তই আমাকে সরিয়ে দিতে চাইছে! পিসেমশাই এর কথামত কাজ না করলে আমাকে পুরনো ঘটনা তুলে এনে ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হচ্ছে! এমনকি আমার নিজের খুন হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়!

সুকান্ত শুনতে শুনতে অবাক হচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি ঘাঘু উকিল, তাঁর চোখে মুখে সেই বিস্মিত ভাব এক মুহূর্তের জন্যেও প্রকাশ পাচ্ছিলো না! তিনি শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন,

বাবার লোকের অভাব নেই, আশাকে তুমি মারো নি! যারা মেরেছে তারা নিশ্চয়ই অনেক বেশি দক্ষ, তাহলে সুমনকে সরানোর দায়িত্ব বাবা তোমাকে দিতে চাইছেন কেনো? এমনকি রথীন দারও সোর্সের অভাব নেই, ইচ্ছে করলে তাঁকে দিয়েও কাজটা করানো যেতো!

রতন হতাশ ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়লো,

রথীন কে বলা সম্ভব নয়, তাহলে পিয়ার যে অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে সম্বন্ধ আছে এটা জানাজানি হয়ে যাবে! সেক্ষেত্রে রথীন বিয়েটা ভেঙে দিতে পারে! আর যারা আশাকে সরিয়েছে, তারা সত্যিই খুব দক্ষ, সুমনের সম্বন্ধে খবর নিয়েছে এক বেলায়! পুলিশের ওপর মহলে খেলার সূত্রে যোগাযোগ আছে ছেলের, এটা তারা জানে! এটাও জানে সে যথেষ্ট পপুলার ফুটবলার, তাকে সরালে ধরা পড়ার চান্স আছে, তাই রিস্ক নিতে চাইছে না! আশা আর সুমন এক নয় সুকান্ত!

সুকান্ত শরীর আলগা করলেন, অনেকটা নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রতনের দিকে তাকালেন,

আমি যেভাবে বলবো সবটা সেভাবে হবে! সাপও মরবে, লাঠিও ভাঙবে না! তুমি তোমার কাজ করো, শুধু সফল হয়ো না! আমি সুমনকে বলে দেবো, ও সতর্ক থাকবে! তবে ইনজুরি যেনো মিনিমাম হয়! আর একটা কথা প্রাণ সংশয় যে তবুও তোমার থেকেই যায় রতন দা, সেটা আশাকরি বুঝতেই পারছো?

রতন ভীত চোখে তাকালো,

জানি রে! কিন্তু বাঁচার উপায় খুঁজে পাচ্ছি না!

সুকান্ত হাত তুললেন,

এখানে একটা বয়ান লেখো, যেখানে সব কথা লেখা থাকবে! এই বয়ান থাকলে তোমাকে মেরেও বাবার লাভ হবে না, এটা তাঁকে সুকৌশলে জানিয়ে দিও! দরকার পড়লে তুমি খুন হলে এটা যে ব্যবহার করা হতে পারে, এটা ওনাকে বুঝিয়ে বোলো সময় নিয়ে, কিন্তু এখনই না! যদি একান্তই দরকার পড়ে তাহলেই! আপাতত তুমি তাঁর বিরাগভাজন হয়ো না, ওদিকের খবর আমার চাই!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৮
দিন কয়েক ধরে যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গেই যাতায়াত করছে সুমন, সুকান্ত তাকে বাইক নিয়ে যাতায়াত করতে বারণ করার পর থেকেই সে ট্যাক্সি বা বাসে যাতায়াত করছিলো ইদানিং। সুকান্তর মুখ থেকেই সে শুনেছিলো অদ্বিতীয়া তার মুখোমুখি হতে লজ্জা পাচ্ছে, সেই থেকেই সে নিজেই অদ্বিতীয়ার সঙ্গে দেখা করবে ভেবে রেখেছিলো।

আজ বিকেলের প্রাকটিসটা বেশ খানিকটা আগেই শেষ হলো, ঘড়িতে সময় দেখে সুমন একটা ট্যাক্সি কে হাত দেখালো, আজকে একবার কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে দেখবে অদ্বিতীয়া এসেছে কিনা! কলেজের গেট থেকে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখে জলখাবারের সামনে দাঁড়ালো সুমন, কারণ তার মাথায় আজ হেলমেট ছিলো না। আগে হলে হয়তো জলখাবারের সামনে দাঁড়ানোটা সে এড়িয়েই চলতো, কিন্তু সুকান্ত রেজিস্ট্রির নোটিস দিয়ে দিয়েছেন এই খবরটা তাকে বেশ খানিকটা বেপরোয়া করে তুলেছিলো, প্রতাপ সান্যালের জানা বা না জানাতে তার কোনো সমস্যা ছিলো না।

জলখাবারের মালিক মনোজ গাঙ্গুলী প্রায় অনেকক্ষন ধরেই সুমনকে চিন্তিত মুখে তাঁর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার ঘড়ি দেখতে দেখছিলেন। প্রতাপ সান্যালের নাতনির বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছে এই খবর তাঁর কাছেও ছিলো, তাই সুমন ওখানে কার জন্যে অপেক্ষা করছে জানার জন্যে তিনি কৌতুহলী হলেন। নিজের টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে তিনি দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন, রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা সুমনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করলেন,

কি বাবা! ওখানে কেনো? কারোর জন্যে অপেক্ষা করছো নাকি?

সুমন চমকে তাকালো,

হ্যাঁ, আমার বন্ধুর জন্যে দাঁড়িয়ে আছি!

মনোজ গাঙ্গুলী আরো জোরে গলা তুলে ডাকলেন,

আহা! তা রাস্তায় কেনো! আমার দোকানে এসে বসো! এখান থেকেও তো দেখা যাবে!

সুমন একটু অন্য মনস্ক হলো, জলখাবারের দোকান থেকে আদৌ অদ্বিতীয়া কে কলেজের ভেতর থেকে বেরোতে দেখা যাবে কিনা ভাবনার মধ্যেই মনোজ গাঙ্গুলী আবার ডাকলেন,

আরে, এসো না! তোমার সঙ্গে যে আসে সেই ছেলেটি তো? সেই বন্ধু তো আর এসেই চলে যাবে না! সেও তো তোমাকেই খুঁজবে! তাকে আমি চিনি!

মনোজ যে গৌরের কথা বলছেন সুমন বুঝতে পারছিলো। সে যে গৌরের জন্যে দাঁড়িয়ে নেই অদ্বিতীয়ার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে সেটা রাস্তার এ প্রান্ত থেকে চিৎকার করে বলা সমীচীন হবে না বলেই তার মনে হচ্ছিলো। অদ্বিতীয়া কে দেখতে না পেলেও জলখাবার থেকে নিশ্চয়ই সুকান্তর গাড়ি দেখা যাবে ভেবে সে একটু অন্য মনস্ক হয়েই রাস্তায় পা দিলো। মনোজ নিজের দোকানের দরজায় দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর দিকে লক্ষ্য রেখে রাস্তা পার হবার জন্যে রাস্তায় পা দিতেই একটা ট্যাক্সি হটাৎ করে সুমনকে ধাক্কা দিয়ে পালিয়ে গেলো। সুমন রাস্তার ধার ঘেঁষে ছিটকে পড়তে আসেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন দৌড়ে এলো, উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা মনোজ নিজেও ছুটে এলেন, সুমন তখন নিজের ডান হাঁটু চেপে ধরে যন্ত্রনায় কাতরাচ্ছিল, দু একবার উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও সে যন্ত্রনায় মুখ বিকৃত করে মাটিতে বসে পড়লো।

যাহ! হাঁটু তে লাগলো নাকি! ইসস! উঠে দাঁড়াতেই পারছো না যে বাবা! মালাইচাকিটা গুঁড়িয়ে গেলো নাকি!

চিন্তিত গলায় বললেন মনোজ গাঙ্গুলী, সুমন কে তুলে তাঁরই গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। সুমন গাড়িতে বসে বিকৃত মুখে বললো,

দাদা, আমাকে অরুন মিত্রের নার্সিং হোমে নিয়ে চলুন!

সুমন সবার কাছেই পরিচিত মুখ ছিলো, তাই তার দুর্ঘটনার খবর কিছুক্ষনের মধ্যেই লোক মুখে ছড়িয়ে পড়লো, ক্রমশ মিত্র নার্সিং হোমের সামনে ভিড় জমতে লাগলো।

প্রতাপ সান্যাল চেম্বারে নিজের জায়গায় বসে টেবিলের কাঁচের ওয়েট পেপারটা কে চিন্তিত মুখে ঘুরিয়ে চলেছিলেন আর বারবার ঘড়ি দেখছিলেন, এমন সময় নবীন পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। তাকে দেখেই সান্যাল মশাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন,

খবর হলো কিছু?

নবীন ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, খবর আছে! রতন বাবু আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন!

প্রতাপ সান্যাল উৎসুক হয়ে তাকালেন, রতন পর্দা সরিয়ে ঘরে ঢুকে তাঁর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই সামনের চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো,

হাঁটু ভেঙে দিয়েছি পিসেমশাই! খবর নিন সে এতক্ষনে হাসপাতালে পৌঁছে গেছে!

প্রতাপ সান্যাল বিরক্ত মুখে তাকালেন,

হাঁটু ভেঙে কি হবে! তোমার সঙ্গে আমার অন্য কথা হয়েছিলো।

রতন মাথা নাড়লো,

একদম সরানো সম্ভব ছিলো না পিসেমশাই, মাঠ আর বাড়ি এর বাইরে তাকে পাওয়াই যাচ্ছিলো না! আর ইদানিং তো সে বাইকও ব্যবহার করছে না!

আমার কাজ হলো কই! শুধু মাত্র হাঁটু ভাঙার জন্যে আমার তোমাকে দরকার ছিলো না!

রতন একটু থতমত খেলো, সান্যাল মশাইয়ের বিরক্ত গলা শুনে এবার নবীন সামনে এগিয়ে এলো, নিচু গলায় বললো,

স্যার! একটা কথা বলি! ফুটবল খেলোয়াড়ের হাঁটু যাওয়া তো মৃত্যুরই সমান! উঠে দাঁড়াতে না পারলে আর খেলবে কি করে! আর খেলা নেই মানেই তো পয়সাও নেই! পয়সা না থাকলে সব ফুটানি বেরিয়ে যাবে, বিয়ের ভুত মাথা থেকে পালাবে তখন! একদিক থেকে এটাই ভালো হয়েছে, মরলে ঝামেলা বাড়তো বই কমতো না! পুলিশ পেছনে পড়ে যেতো তখন! সেই জন্যেই তো কাজটা কেউ করতে চাইছিলো না স্যার! সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলো না!

সান্যাল মশাইয়ের কোঁচকানো ভ্রু সোজা হলো, নবীনের কথা তাঁর মনঃপুত হয়েছে! রতন স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো,

আমি তাহলে আসি পিসেমশাই! আপনার কথা রেখেছি কিন্তু আর আপনি আমাকে চাপ দেবেন না!

প্রতাপ সান্যাল গম্ভীর হলেন,

বিয়ের দায়িত্বে কিন্তু তুমিই, সেটা মাথায় রেখো! আর ওই ছেলে যদি বিয়ে হওয়ার আগে আবার উঠে দাঁড়ায় তাহলে আরেকটা হাঁটু ভেঙে দিও!

রতন ঘাড় নেড়ে উঠে দাঁড়ালো, সে বেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল নবীনের দিকে তাকালেন,

ট্যক্সিওলা ধরা পড়েনি তো? ছেলেটার উঠে দাঁড়াতে কতদিন লাগবে বলে মনে হয়?

নবীন ঘাড় নাড়লো,

নাহ! ধরা কেনো পড়বে? শ্যামলাল অনেক পুরনো লোক, এসব তার কাছে জলভাত! আর মরলে পুলিশ খুঁজে বার করতো ঠিক, ওসব টুকটাক ধাক্কা তো যেকোনো সময় যেকোনো জায়গায় হতে পারে! পথে ঘাটে বিপদ তো হতেই পারে, ওসব নিয়ে পুলিশ মাথা ঘামায় না! আর ছেলেটার কথা ছেড়ে দিন, যেভাবে রাস্তায় হাঁটু চেপে বসেছিলো ওর উঠে দাঁড়ানোর অনেক দেরি আছে! বিশ্বাস না হয় আপনার বন্ধু মনোজ বাবু কে জিজ্ঞেস করে নিন, ওনার গাড়িতেই তো তোলা হলো তাকে!

সান্যাল মশাই মুচকি হাসলেন,

মনোজের গাড়িতে তুললো? সেকি এখনও আশায় আছে নাকি! ওই হাঁটু নিয়ে সে ছেলে তার ক্লাবে সই করবে!

নবীন মুচকি হেসে বেরিয়ে যাওয়ার পরে প্রতাপ সান্যাল ফোন হাতে তুলে নিলেন, উল্টোদিকে মনোজ গাঙ্গুলীর সাড়া পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গলায় উচ্ছাস এনে বললেন,

মনোজ! নাতনির বিয়ে, শুনেছ নিশ্চয়ই! আজ সন্ধ্যেয় তোমার বাড়িতে যাবো ভেবেছিলাম গিন্নিকে নিয়ে, তোমরা বাড়িতে থাকবে তো?

মনোজ সম্মতি দিলেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ! নিশ্চয়ই থাকবো, আপনি আসবেন আর আমি থাকবো না তাই কখনো হয় স্যার!

প্রতাপ সান্যাল মৃদু হাসলেন,

খুব ভালো কথা! তাহলে সন্ধ্যেয় দেখা হচ্ছে! আর তোমার ক্লাবের খবর কি? গোয়াতে তো একেবারে শুয়ে পড়লে আমাদের কাছে!

মনোজ একটু দুঃখিত হলেন,

সে আর কি করা যাবে! একটা ভালো স্ট্রাইকার পাচ্ছি না স্যার! তবে আপনাদের অবস্থাও এবার খারাপই হবে মনে হচ্ছে!

সান্যাল মশাই কৌতুহলী হলেন,

কেনো? কেনো?

আর কেনো! আপনাদের স্ট্রাইকার, ওই যে সুমন নামের ছেলেটি, ও তো আজ আমার দোকানের সামনেই রাস্তা পার হতে গিয়ে ট্যাক্সিতে ধাক্কা খেল! আমিই তো আমার গাড়ি দিয়ে, দোকানের একটা ছেলে কে সঙ্গে দিয়ে হাসপাতালে পাঠালাম! ছেলেটা এসে বলছিলো, হাঁটুর মালাইচাকি বোধহয় গিয়েছে, সেতো উঠেই দাঁড়াতে পারছে না! খুব খারাপ লাগছে স্যার, আমিই ওকে আমার দোকানে আসতে ডেকে ছিলাম!

মনোজের কথার উত্তরে, দুঃখিত গলায় উত্তর দিলেন প্রতাপ সান্যাল,

ইসস! তাই নাকি! খবর তো তাহলে সত্যিই খুব খারাপ! তবে নিজেকে দোষ দিওনা মনোজ! আমরা তো সাধারণ মানুষ, আমরা নিমিত্ত মাত্র, যা করেন সব তো ঈশ্বর করেন, আমরা শুধু মাত্র দোষের ভাগীদার হই!

ফোন নামিয়ে রেখে সান্যাল মশাই চেম্বারের ঘূর্ণায়মান চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিলেন, মনের ভেতরে অদ্ভুত একটা শান্তি হচ্ছে!

পিসেমশাই এর চেম্বার থেকে বেরিয়ে বাসে উঠে পরের স্টপেজে নেমে পড়লো রতন, একটা বুথ থেকে সুকান্তর চেম্বারের নম্বরে ফোন করলো। সুকান্ত একটু চিন্তিত হয়েই বসেছিলেন, রতনের গলা শুনে চাপা গলায় বললেন,

হাঁটু কি সত্যি গুঁড়িয়ে গেছে নাকি! তখন থেকেই সবার মুখে একই কথা শুনছি! ফুটবলারের হাঁটুর মালাইচাকি ভাঙার অর্থ জানো? পুরো কেরিয়ারটাই শেষ!

রতন ফোনের উল্টোদিকে সজোরে হেসে উঠলো,

তোর হবু জামাই যথেষ্টই চালাক চতুর সুকান্ত! কি অভিনয়টাই না করলো! আপাতত বিয়ে পর্যন্ত বিছানায় শুয়ে থাকতে বলিস! মাঠের ধারে কাছেও যেনো না যায়, তাহলেই আবার তোর বাবার শ্যেন দৃষ্টি পড়বে!

সুকান্ত হেসে উঠলেন,

শোনো, শ্যামলাল যেনো মুখ না খোলে! যা রফা হয়েছে তোমার সঙ্গে তার থেকে খানিক বেশীই দিও ওকে!

রতন ফোন রেখে দেওয়ার পরে কিছুক্ষন পরেই অদ্বিতীয়ার ফোন এলো, সে কান্না ভেজা গলায় বললো,

ছোট কা! রেডিওর খবরে কি বলছে শুনেছ? সুমনের নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে! ওর হাঁটুতে লেগেছে, এরকমই বলছিলো খবরে। কি হবে ছোট কা, ও আর কখনো খেলতে পারবে তো?

সুকান্ত বিস্ময়ের ভঙ্গি করলেন,

সেকি! কখন! ঠিক আছে তুই চিন্তা করিস না, আমি ওকে দেখে আসছি।

সুকান্ত ফোন রেখে নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন, গাড়ির চাবি পকেট থেকে বার করতে করতে দ্রুত গাড়ির দিকে পা চালালেন, তাঁকে তাড়াতাড়ি নার্সিং হোমে যেতে হবে। ওখানে পৌঁছে জমা হওয়া ভক্তদের ছোটখাটো ভীড় টপকে গিয়ে সুমনের বিছানার সামনে দাঁড়ালেন সুকান্ত,

খুব বেশি লাগে নি তো?

সুমন মুচকি হাসলো,

নাহ! আমি মোটামুটি সতর্ক ছিলাম কদিন ধরেই, আর ড্রাইভারটাও খুব একটা জোরে মারেনি!

সুকান্ত হেসে ফেললেন,

তুমি তো বেশ ভালো অভিনেতা শুনলাম, আমাকেও ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে! যাইহোক, আপাতত আর খেলা, প্রাকটিস সব বন্ধ! বিয়ে পর্যন্ত বাড়ির বাইরে পা দেবে না একদম!

সুমন ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ, ক্লাব থেকে বন্ধুরা এসেছিলো, ওদের জানিয়ে দিয়েছি এখন অনেকদিন প্রাকটিসে আসতে পারবো না!

সুমনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সুকান্ত নার্সিং হোমের রিসেপশনে পৌঁছলেন,

ডক্টর মিত্র আছেন?

মেয়েটি কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই পাশের দরজা খুলে ডক্টর মিত্র হাত বাড়ালেন,

এদিকে আয় সুকান্ত!

সুকান্ত ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন, এক সময়ের সহপাঠী অরুনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

রিপোর্টে কিন্তু হাঁটু ভাঙার কথাই থাকবে!

অরুন মাথা নাড়লেন,

হ্যাঁ, মনে আছে! তুই চিন্তা করিস না!

সুকান্ত যখন বাড়ি ফিরলেন তখন অদ্বিতীয়া উৎকন্ঠিত মুখে দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলো, সরলা রান্না ঘরে ব্যস্ত থাকলেও তার মন পড়ে ছিলো সুকান্তর দিকেই। সুকান্ত গাড়ি ঢোকাতে ঢোকাতে অদ্বিতীয়া দৌড়ে এলো,

সুমন কেমন আছে ছোট কা!

সুকান্ত চিন্তিত মুখে ঘাড় নাড়লেন,

মনে হচ্ছে হাঁটু তে ভালোই লেগেছে বুঝলি তো! এতো তাড়াতাড়ি কিছু বোঝা যাবে না! কয়েকটা দিন যাক, তারপরে বোঝা যাবে! বৌদি কই? বৌদিকে ডেকে নিয়ে আমার ঘরে আয়, কিছু কথা আছে!

অদ্বিতীয়া শঙ্কিত মুখে দ্রুত ওপরে উঠে গেলো, সরযূর ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকা কে ধর্তব্যের মধ্যে না এনেই সরলা মেয়েকে সঙ্গে করে নিয়ে দেওরের ঘরে ঢুকে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলো। সুকান্ত বৌদি এবং ভাইঝি কে সামনে বসিয়ে কিছুক্ষন আগের সুমনের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা বর্ণনা করলেন, শুধু এর পেছনে যে তাঁর বাবার হাত আছে এই অংশটুকু সচেতন ভাবে এড়িয়ে গেলেন। অদ্বিতীয়ার মুখ কাঁদো কাঁদো হলো, সরলা চিন্তিত মুখে ভ্রু কুঁচকে বসে রইলো। বৌদি কে ওইভাবে বসে থাকতে দেখে সুকান্ত একটু চিন্তা করলেন, তারপর ভাই ঝি কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

যা! তুই এবার নিজের ঘরে যা! একটু বরং ঠাম্মার সঙ্গে গল্প কর গিয়ে! ঠাম্মা ভাবছে আমরা খুব গোপন কিছু আলোচনা করছি! আমি বৌদির সঙ্গে বিয়ের ব্যাপারে কিছু আলোচনা করবো!

অদ্বিতীয়া বেরিয়ে গেলো, ঘরের ভেতর থেকে তার ঠাম্মার সঙ্গে বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথোপকথনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো, সেদিকে তাকিয়ে সুকান্ত একটু নিচু গলায় বৌদির উদ্দেশ্যে বললেন,

আপনাকে চিন্তিত লাগছে! কি ভাবছেন?

সরলা সোজাসুজি দেওরের দিকে তাকালো,

এটা কি শুধুই দুর্ঘটনা ছোড়দা? এতে কারোর কোনো হাত নেই তো?

সুকান্ত একটু ইতস্তত করলেন,

বৌদি! আপনার কাছে আর কিছু লুকিয়ে রাখবো না! বিয়েটা হোক এটা তো কেউ কেউ চায় না, তাদেরই কারোর কাজ বলে মনে হচ্ছে!

সরলা চিন্তিত মুখে ঘাড় নাড়লো,

আমারও সেইরকমই কিছু মনে হচ্ছিলো ছোড়দা! এ যাত্রা নাহয় রক্ষা পেলো কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে! বারবার কি বিপদ থেকে বাঁচা সম্ভবপর হবে! আর রক্ষা পেলো সেটাই বা কি করে বলি ছোড়দা, হাঁটু ভেঙে পড়ে থাকলে সে আর কখনো খেলবে কি করে!

সুকান্ত ইতস্তত করছিলেন, সমস্ত ব্যবস্থা যে তাঁর নিজের হাতেই করা এটা জানলে বৌদি কেমন ভাবে নেবেন এটা বুঝে উঠতে না পেরে তিনি সান্ত্বনার সুরে বৌদি কে বললেন,

সোর্স আমারও আছে বৌদি, আপনি চিন্তা করবেন না! আর এই সমস্যাগুলো সবটাই বিয়েটাকে আটকানোর জন্যে, বিয়ে একবার হয়ে গেলে তখন আর এসব নিয়ে কোনো উৎসাহ থাকবে না কারোরই!

সরলা অন্য মনস্ক ভাবে মাথা নাড়লো,

আমার সেটা মনে হয়না ছোড়দা! বংশের নাম, মর্যাদা ডুবিয়ে দিয়ে এই বিয়ে করলে তারপরে সেই মর্যাদা ফিরিয়ে আনার শেষ চেষ্টা কি বাবা করবেন না বলে আপনার মনে হয়? সেক্ষেত্রে বিয়ের পরেও সুমনের কোনো ক্ষতি করে দিয়ে তিনি আবার নাতনিকে বাড়ি ফিরিয়ে আনতে পারেন! আমার মনে হয় নাতনির এই বিয়ের থেকে বৈধব্য তাঁর কাছে অনেক বেশি কাম্য হবে!

এটা সুকান্তরও জানা ছিলো, কিন্তু তিনি বৌদিকে বলে তাঁকে ভয় দেখাতে চাইছিলেন না। সরলা যদিও যথেষ্টই বুদ্ধিমতী সে দেওরের উপরে খুব বেশি ভরসা রাখতে পারছিলো না। সুকান্ত কে চুপ করে থাকতে দেখে সে আবার মাথা নাড়লো,

ছোড়দা! আমার কিন্তু ভয় লাগছে! বাবা যে এতোটা এগোতে পারেন সেটা আমি সত্যি ভাবিনি আগে! এরপরে তো আবার রথীন দা আছেন তাঁর সঙ্গে, মা একটা কথা কিন্তু ঠিকই বলেন ওই মানুষটি একটুও বিশ্বাসযোগ্য নন!

সুকান্ত হাত তুললেন,

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন বৌদি রথীন দা কে বাবা কিছু জানাবেন না! পিয়ার খবর জানতে পারলে রথীন দা এই বিয়ে ভেঙে দিতে পারেন এটা বাবা জানেন!

সরলা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো,

আপনার কথাই যেনো ঠিক হয়, আমি কিন্তু কোনো কিছুর ওপরেই ভরসা রাখতে পারছি না আর!

একটু রাতের দিকে রমার কাছে ফোন করলেন সুকান্ত, রমা ফোন ধরেই উত্তেজিত গলায় বললেন,

ছেলেটি এখন কেমন আছে সুকান্ত, নিউজে শুনলাম তার নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়ে হাঁটুর মালাইচাকি ভেঙে গেছে?

সুকান্ত একটু চিন্তায় পড়লেন, সেদিনের রমার সঙ্গে কথোপকথন তাঁর মনে পড়ছিলো। তিনিও তাঁর বাবার মতোই সব কিছু পরিকল্পনা করে এগোচ্ছেন এবং আজকের ঘটনা সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ সেটা জানলে রমার প্রতিক্রিয়া ঠিক কি হবে সেটা তিনি বুঝতে পারছিলেন না। রমা একটু অন্য ধরনের, সত্য গোপন করে সুকান্ত বাবার দেখানো পদ্ধতিতে তাঁকেই মাত দিতে চেষ্টা করছেন সেটা জানলে তাঁর মনে সুকান্ত সম্পর্কে বিরূপ ধারণা তৈরি হতে পারে! সুকান্ত কে চুপ করে থাকতে দেখে রমা আরও চিন্তিত হলেন,

কি হলো! তুমি চুপ করে আছো কেনো? ছেলেটি সুস্থ আছে তো?

সুকান্ত তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিলেন,

হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেরকম কিছু লাগে নি! আসলে তোমাকে বলা হয়নি, দিন দুয়েক আগে রতন দা আমার চেম্বারে এসেছিলো, বলছিলো বাবা সুমন কে সরিয়ে দেওয়ার জন্যে তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছেন! আমি সেই খবর পেয়েই সুমন কে সতর্ক করেছিলাম, তাই সে খানিকটা সতর্ক ছিলোই!

রমা অবাক হলেন,

বলো কি! রতন দা নিজে থেকে তোমার চেম্বারে এসে এই খবর দিলো! কিন্তু কেনো?

সুকান্ত হাসলেন,

কেনো আবার! নিজের দরকারেই! ও তো নিজেই বিভিন্ন ভাবে ফেঁসে আছে, খুন হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছে! আমার কাছে বয়ান লিখতে চাইলো যাতে ও খুন হয়ে গেলেও বাবা ধরা পড়েন!

রমা চিন্তিত হলেন,

তুমিও কি একই পথে যাচ্ছো সুকান্ত! রতন দার বয়ান লিখিয়ে বাবা কে ভয় দেখাতে চাইছো! আমি চাই না তুমি তোমার বাবার মতো হও, আমি তোমাকে সেই ভাবেই দেখতে চাই যা তুমি আগে ছিলে! প্রতাপ সান্যাল কে পরাজিত করতে গিয়ে সুকান্ত সান্যাল যেনো প্রতাপ সান্যাল না হয়ে যায়, সেটা দেখো! সৎ পথে যা করার করো!

সুকান্ত কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন,

রমা! কখনো কখনো সোজা আঙ্গুলে ঘি না উঠলে আঙ্গুল বাঁকাতে হয়! এতে সৎ, অসৎ এর কোনো ব্যাপার নেই! আজ যদি আমি চুপ করে বসে থাকি আর সুমন বা রতন দা খুন হয়ে যায় তারপরেও কি সৎ থাকার কথা বলবে তুমি! বয়ান ব্যবহার হবে না শুধু ব্ল্যাকমেলের কাজে লাগবে!

রমা বিরক্ত মুখে ফোন নামিয়ে রাখলেন,

আমি এ পথে বিশ্বাসী নই, তুমি নিজে যা ভালো বোঝো তাই করো তাহলে!
ক্রমশ

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৪৯
প্রতাপ সান্যাল এবং সুকান্তর মধ্যে জেদাজেদি চরমে উঠেছিল ক্রমশ, সান্যাল বাড়িতে যেমন বিয়ের মণ্ডপ তৈরি হচ্ছিলো তেমনি সুকান্ত তাঁর আশ্রমেও রেজিস্ট্রির ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছিলেন। সুমন নার্সিং হোম থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পর থেকেই আর বাড়ির বাইরে বেরোয়নি যদিও সান্যাল মশাই নবীন কে দিয়ে তাকে চোখে চোখে রাখছিলেন।

ঘটনাটা ঘটলো বিয়ের ঠিক দিন সাতেক আগে, হটাৎ করেই একদিন সন্ধ্যে বেলায় জ্যেঠুর সঙ্গে দেখা করতে উপস্থিত হলো রথীন। রথীন কে দেখেই সরযূর মুখ গম্ভীর হলো, কিন্তু সান্যাল মশাই উচ্ছ্বসিত হলেন,

আরে! রথীন যে! এসো, এসো! কি খবর বলো?

রথীন কে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে ঢোকার আগে দোতলার বারান্দা থেকে নিচের দিকে হাঁক দিলেন প্রতাপ সান্যাল,

বৌমা! দেখো রথীন এসেছে, চা নিয়ে এসো ওপরে!

সরলা তাড়াতাড়ি রান্না ঘরের দাওয়া থেকে নিচে নেমে এসে মাথায় ঘোমটা টেনে ওপরের দিকে তাকালো,

যাই বাবা!

রথীন একটু গম্ভীর মুখে ঘরে ঢুকে এলেন, জ্যেঠু র দিকে তাকিয়ে খানিকটা রাগের গলায় বললেন,

জ্যেঠু বাবু! এতবড়ো কথাটা আমাকে লুকিয়ে গেলেন! এটা আপনার কাছে আশা করিনি!

সান্যাল মশাই খাটের ধারে পা ঝুলিয়ে বসতে বসতে একটু শঙ্কিত হয়ে রথীন এর দিকে তাকালেন, কাঠের সোফার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন,

আহা! এতো উত্তেজিত কেনো রথীন? বসো আগে, তারপর কি হয়েছে খুলে বলো আমাকে!

রথীন সোফায় বসতে বসতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে জ্যেঠু র দিকে তাকালেন,

পিয়া একটি ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে শুনলাম!

সান্যাল মশাই একটু থতমত খেলেন,

ওই! সেরকম কিছু না! অল্প বয়সের ভুল বলতে পারো!

কিন্তু সুকান্ত তো রেজিস্ট্রির নোটিস দিয়েছে শুনলাম, সেটাও কি অল্প বয়সের ভুল জ্যেঠু বাবু!

বিদ্রুপের গলায় বললেন রথীন সান্যাল, সান্যাল মশাই মাথা নাড়লেন,

তোমার কাছে আর কি লুকিয়ে রাখবো রথীন, তুমি তো সবটাই জানো! আমার দুই ছেলেই আমাকে অপমানিত করতে পারলেই খুশি হয়! এসব তারই প্রকাশ, ভাইঝি কে সামনে রেখে সে নিজের অপমানের শোধ তুলতে চাইছে এখন! তুমি চিন্তা করো না, ওই বিয়ে আমি হতে দেবো না!

রথীন এর গলা নরম হলো,

আপনি আমাকে কেনো বলেন নি জ্যেঠু বাবু, আমি কবেই ওই ছেলের ব্যবস্থা করে দিতাম! আর পিয়া কেই বা কি বলি,এসব কি তার শোভা পায়!

সরলা এতক্ষনে চা নিয়ে ওপরে উঠে এসেছিলো, ঘরের পর্দা সরানোর আগেই রথীন এর সঙ্গে সান্যাল মশাই এর কথোপকথন সরলার কানে এলো, তিনি চাপা গলায় রথীন কে বলছিলেন,

কি বলি বলতো রথীন! মায়ের দোষ তার যাবে কোথায়! তোমার কাছে বলার কি আর মুখ ছিলো! ওই থার্ড ক্লাস ছেলের মধ্যে যে সে কি দেখেছে সেই জানে!

রথীন যে সব খবর জেনেই এখানে এসেছেন সেটা তাঁর কথোপকথন থেকেই সরলার কাছে স্পষ্ট হলো,

সে যাই হোক, আপনার আমাকে একবার বলা উচিত ছিলো জ্যেঠু বাবু! আপনিও আমাকে নিজের ভাবতে পারলেন না! হলেও বা সে আমার শ্যালিকার ছেলে, তাই বলে নিজেদের বংশ মর্যাদা, সম্মানের কথা ভাববো না! তাদের দিকটা দেখতে গিয়ে নিজেদের বাড়ির মেয়েকে ভুলে যাবো! আপনি কিছু চিন্তা করবেন না জ্যেঠু বাবু, সুকান্তর চেষ্টা কিছুতেই সফল হতে দেবো না! শুভর থেকেও পিয়া আমার কাছে অনেক আপন, তার ক্ষতি আমি কিছুতেই হতে দেবো না!

প্রতাপ সান্যাল লজ্জিত হলেন,

আমি তোমাকে ভুল বুঝেছিলাম রথীন, আমার মনে হয়েছিলো তোমার সাহায্য নিতে গেলে পাত্র পক্ষ জেনে যাবে! তোমাকে আমি পাত্র পক্ষ হিসেবেই ভেবেছি, নিজের রক্ত ভাবতে পারিনি! এটা আমারই ব্যর্থতা রথীন!

রথীন তাড়াতাড়ি জ্যেঠুর পায়ের দিকে হাত বাড়ালেন,

আগে সান্যাল বাড়ির মর্যাদা, নিজের বংশ, রক্ত, তারপরে অন্য কিছু জ্যেঠু বাবু! আমি পাত্র পক্ষ নই, আমি কন্যা পক্ষে! চিন্তা করবেন না, এমন কিছু করবো যাতে বিয়েতে বাধা হয়ে দাঁড়ানোর জন্যে সে আর পৃথিবীতেই না থাকে! সুকান্তর ব্যাপারটাও আমার ওপরেই ছেড়ে দিন, ওকেও কদিনের জন্যে ঘরে শুইয়ে রাখতে হবে!

প্রতাপ সান্যাল গলা নামিয়ে বললেন,

ছেলে কে নিয়ে খুব বেশি চিন্তা আর করছি না, ওকে হাঁটু ভেঙে আপাতত বিয়ে পর্যন্ত শুইয়ে রেখেছি, তাই সরিয়ে না দিলেও চলতো রথীন!

রথীন মাথা নাড়লেন,

নাহ! এবার আর কোনো চান্স নেবো না! আগের বার রতন কে ছেড়ে দিয়ে যে ভুল করেছিলেন তার পুনরাবৃত্তি যেনো না হয়! বিয়ের পরে যদি কোনো ভাবে একবারও পিয়ার মুখোমুখি হয় সেই ছেলে তাহলে সবটা শ্বশুরবাড়িতে জানাজানি হয়ে যাবে! আমি তো ভায়রা ভাইয়ের কাছে মুখ দেখাতেই পারবো না, আমাদের বংশের সম্মান নিয়েও টানাটানি পড়ে যাবে! সান্যাল বাড়ির মেয়ে পর পুরুষের সঙ্গে বিয়ের পরে কথা বললে আমাদের মান সম্মান বলে আর কিছু থাকবে না জ্যেঠু বাবু! আপনি চিন্তা করবেন না ওটা আমার দায়িত্ব, বিয়ের আগে কাঁটা একেবারে নির্মূল করে তারপর কাজে বসবো!

সান্যাল মশাইয়ের ভ্রু কুঁচকে গেলো,

ঠিক আছে! তুমি যা ভালো বোঝো করো তাহলে! তোমার ওপর আমার সম্পূর্ন ভরসা আছে রথীন, শুধু দেখো সুকান্তর যেনো বড়ো কোনো ক্ষতি না হয়! ও আর রতি দুজনেই একটু জেদী, ওই বংশের ধারা! যাবে কোথায়! নাতনিটাও একদম বাবা, কাকার মতো হচ্ছে দিনদিন! আমার মুখের ওপরে কথা বলার সাহস রাখলো! আমি অবশ্য জানতাম এরকমই কিছু হবে, সান্যাল বংশের রক্ত তো! দেখো তার গায়েও যেনো আঁচড় না পড়ে! আর ছেলের বাড়িতে কিছু বলার দরকার নেই রথীন!

রথীন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাত নাড়লেন,

ছেলের বাড়ি নিয়ে ভাববেন না! ও আমি যা বলবো তাই হবে!! ওদের কিছু জানানোর প্রয়োজন নেই তো! আমাদের মেয়ে, আমরাই সবটা বুঝে নেবো! আর আপনি নিশ্চিন্ত থাকবেন জ্যেঠু বাবু, সান্যাল বংশের কারোর গায়ে আঁচড় টুকুও পড়বে না, পিয়ার সামনে বিয়ে, ওর গায়ে আঁচড় পড়লে চলবে নাকি! মেয়ের শরীরে খুঁত হলে বিয়ে হবে কি করে! ওই ছেলেটার বাড়ির ঠিকানাটা জানতে হবে শুধু, যদি বাড়ি থেকে না বেরোয় তাহলে ওখানেই কাজ শেষ করতে হবে সেরকম হলে!

সরলা যথেষ্ট শক্ত মনের, তাও তার হাতে ধরা চায়ের ট্রে কাঁপতে লাগলো, কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে নিজেকে শক্ত করে নিয়ে সে পর্দার বাইরে থেকে মৃদু গলায় ডাকলো,

বাবা! চা এনেছি!

পরমুহূর্তেই সান্যাল মশাইয়ের গলা শোনা গেলো,

এসো বৌমা! আমরা কখন থেকেই তো চায়ের জন্যেই অপেক্ষা করছি! তেষ্টায় গলা শুকিয়ে গেছে একেবারে!

সরলা রথীন এর দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলো,

নিন দাদা!

রথীন মৃদু হেসে হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিলেন, সরলার দিকে তাকিয়ে বললেন,

বিয়ের জোগাড় কদ্দুর? রতি কে তো পাওয়ার উপায় নেই, সব দায়িত্ব তো তোমার ঘাড়েই পড়েছে তাহলে!

সরলা হাসলো,

ওই, বাবা, মা আছেন! সবাই মিলে হয়ে যাবে। দিদি কে তো একটু পাঠাতে পারেন দাদা, বিয়ের কাজ তো কম নয়!

রথীন সশব্দে হেসে উঠলেন, সুমনা যে সরলার দরকারে কখনোই আসবে না সেটা আড়াল করার জন্যে বললেন,

সুমনাকে তুমি পাচ্ছো কোথায়! সেতো বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি! দিদির বাড়ি সারাদিনে চোদ্দ বার যাচ্ছে আর আসছে! তবু তুমি বলে দেখো একবার!

সরলা মাথা নাড়লো,

আচ্ছা দাদা, আমি এমনিতেই একদিন মাকে নিয়ে পুজো দিতে যাবো ওদিকে, তখন নিজে গিয়ে দিদি কে বলে আসবো!

পরের দিন সকালে সান্যাল বাড়িতে তাড়াহুড়ো চলছিলো, সুকান্ত এবং প্রতাপ বাবু কোর্টে বেরোবেন। সুকান্তর সঙ্গে গন্ডগোলের পর থেকেই অদ্বিতীয়ার কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়েছিলো, তাই তার কোথাও বেরোনোর ছিলো না। সুকান্ত বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই প্রতাপ সান্যালও বেরিয়ে এলেন, তিনি যখন দোতলার সিঁড়ি থেকে নেমে এসে উঠোনের ওপর দিয়ে দরজার দিকে এগোচ্ছিলেন তখন রান্নাঘরের দাওয়া থেকে সরলা মাথায় ঘোমটা টানতে টানতে নেমে এলো। তাকে সামনে এসে দাঁড়াতে দেখে সান্যাল মশাই একটু অবাক হলেন,

কিছু বলবে বৌমা?

সরলা ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ বাবা! বলছিলাম বিয়ের তো আর দেরি নেই, নেমন্তন্নও শুরু করে দিয়েছেন, কিন্তু একটু পুজো দিয়ে এলে ভালো হতো না? শুভ কাজে এসব একটু না হলে মন বড়ো খুঁত খুঁত করে বাবা!

প্রতাপ সান্যাল একটু থমকে দাঁড়ালেন,

হ্যাঁ! সেতো ভালো কথা! কালই তো রথীন এর সামনে বলছিলে! আসলে এসব তো তোমার মায়েরই মনে করানো উচিত ছিলো! কিন্তু তার তো এই বিয়ে পছন্দ নয়, তাই সে মুখে কুলুপ এঁটেছে! ঘুরে এসো তাহলে! আর তোমার শাশুড়িকেও জিজ্ঞেস করে নিও একবার, যদি সঙ্গে যেতে চান, যাবেন!

স্বামীর কোর্টে বেরোনোর সময় সরযূ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকেন বরাবরই, আজও ছিলেন। ছেলের বউয়ের সঙ্গে স্বামীর সব কথোপকথনই তাঁর কানে আসছিলো, তাঁকে উদ্দেশ্য করে সান্যাল মশাইয়ের তীর্যক মন্তব্য শুনে আর তিনি ধৈর্য্য রাখতে পারলেন না,

বুড়ো হয়ে মরতে চললো তবু সারাক্ষন মুখে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা! কিসের নাতনি! কিসের বিয়ে! ওই অজাত কুজাতের রক্তকে তুমি মাথায় তুলে নাচতে পারো, আমি ওসব ভুলি না! যবে থেকে ওই মেয়ে এসেছে তবে থেকে আমার সংসারে অশান্তি! জন্মেই তো মাকে খেয়েছে, এখন বিয়ে হয়ে চলে যাচ্ছে তাও দেখো! আমাদের ভিটে মাটি উৎখাত করে বাটি হাতে পথে বসিয়ে যাচ্ছে!

সান্যাল মশাই ঘুরে দাঁড়ালেন,

কিসের পথে বসানো? রথীন কে তো সুকান্ত আগেই জানিয়েছিল আমরা কিছু দেবো না! আর তোমার ছেলে কে দেখেছো? সেতো গুণের আধার! তার খুঁত মেরামত করতেই তো সব বেরোচ্ছে!

হ্যাঁ, জানি জানি! ওসব ছেলে ভুলানো কথা আমাকে বলতে এসো না! আমার বাপ, শ্বশুর দুজনেই উকিল ছিলো, ওসব প্যাঁচের কথা অনেক ছোটো থেকে দেখেছি! রথীন একটা শয়তান! ও উদ্দেশ্য ছাড়া আজ পর্যন্ত কিছু করেছে নাকি, যে আজ করবে! আর কিসের ছেলে ছেলে করো! বনেদি বাড়ির ছেলেদের ওটাতে কিছু যায় আসে না! আমি ওই ছেলের আবার বিয়ে দিইনি! ওই তো তোমার বৌমা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে, তাকে জিজ্ঞেস করো, তাদের বাড়ি থেকে এই বিয়ে কেনো দিয়েছিলো। আমি এই বলে দিলাম, ওই বিয়েতে আমি নেই! যা করার তুমি আর তোমার বৌমা মিলে করো!

সান্যাল মশাই চিৎকার করলেন,

হ্যাঁ! দরকার হলে তাই করবো! তার গায়ে আমার রক্ত আছে যখন, তখন ব্যবস্থা আমাকেই করতে হবে! আর একটা কথা মনে রেখো, শুধু সেই নয় আমার বংশের সবার জন্যেই এটা প্রযোজ্য! রথীন এর ছেলে কে দিয়েছি, দরকার হলে আরো দেবো! অন্য কারো কথা শুনবো না! দিদিভাইয়ের গায়ে অজাতের রক্ত এটা বলার আগে তোমার ছেলের দিকে আঙুল তোলো, তাকে জিজ্ঞেস করো সে কেনো এমন মেয়েকে হটাৎ করে ঘরে এনে তুললো! আর তুমিতো মা, ছেলেকে দেখেশুনে রাখতে পারোনি কেনো? আমি কি আমার ওকালতি ছেড়ে সেটার দায়িত্বও নিতাম!

শ্বশুর, শাশুড়ির ঝগড়ার মধ্যেই সরলা মৃদু গলায় বললো,

বাবা! আপনার দেরি হয়ে যাচ্ছে, এখন এসব কথা থাক! আমিই বরং তাড়াতাড়ি করে একটু বেরিয়ে পুজোটা দিয়ে আসি আজ!

সান্যাল মশাই অন্য মনস্ক হলেন,

যাও তবে! কিন্তু গাড়ি কোথায়! সুকান্ত বেরিয়ে গেছে, আমিও বেরিয়ে যাচ্ছি!

সরলা তাড়াতাড়ি মাথা নাড়লো,

আমি বামুন ঠাকুরকে দিয়ে ট্যাক্সি ডাকিয়ে নেবো বাবা, কিছু অসুবিধা হবে না!

সান্যাল মশাই চিন্তিত হলেন,

ট্যাক্সি নিয়ে যাবে! বাড়ির বউ, অসুবিধা হবে না তো? সাবধানে যেও আর আজ তাহলে আর রথীন এর বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই, ওটা অন্য একদিন গাড়ি নিয়ে যেও না হয়!

সরলা মাথা কাত করলো,

ঠিক আছে বাবা তাই হবে!

সুমন দুর্ঘটনার পর থেকেই প্র্যাকটিসে বেরোনো বন্ধ করেছিলো, সুকান্ত তাকে বিয়ের আগে বাড়ি থেকে বেরোতে বারণ করেছিলেন। তার খুব বেশি আঘাত ছিলো না, সুস্থ মানুষের পক্ষে বেশিক্ষন বাড়িতে বসে থাকা মুশকিল! সে ঘরের মধ্যেই ঘোরা ফেরা করছিলো এমন সময় দরজার বাইরে কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো, দরজা খুলেই সুমন চমকে গেলো,

ছোড়দা! তোর নাকি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে! গৌর দার কাছে শুনলাম! তুই কি রে! এতো রাগ তোর! আমাদের একটু খবরও দিসনি!

বলতে বলতে সোমা ঘরে ঢুকে এলো, পেছন পেছন সুমনের মা! সুমন একটু বিরক্ত চোখে তাকালো, তারপরে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,

বলার মতো কিছু ঘটেনি! সেরকম হলে নিশ্চয়ই জানাতাম! তবে এসেছিস ভালো হয়েছে, আমার মায়ের সঙ্গে কিছু কথা ছিলো, সেগুলো বলে নিই! আমি অদ্বিতীয়া কে বিয়ে করছি, দিনটা জানিয়ে দেবো, পারলে এসো!

সুমনের মা চোখে আঁচল চাপা দিলো,

যা করেছি সবতো তোর ভালোর জন্যেই! তুই যখন বুঝলি না তখন আর কি করি বল! তুই যাতে সুখী হতে পারিস সেটাই কর! অতো বড়োলোকের মেয়ে সেতো আর আমাদের বাড়িতে থাকতে পারবে না, তোকেই ওদের বাড়িতে থাকতে হবে! তুই ঘরজামাই হয়ে থাকলে কি আর আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারবি!

সুমন মাথা নাড়লো,

ঘরজামাই হয়ে থাকবো কেনো! এই বাড়িতেই থাকবো! তবে তোমার বাড়ি আমি দাদাকে ছেড়ে দিলাম, ওখানে গিয়ে থাকতে যাবো না আর! আর যা দরকার লাগবে বোলো, সংসার খরচ আমি পাঠিয়ে দেবো!

নিমেষে সুমনের মায়ের মুখ উজ্জ্বল হলো, চোখ মুছে নিয়ে বললো,

সে দিসখনে এখন! আমি কি তোর কাছে পয়সার জন্যে এসেছি! শুনলাম তোর অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে, তাই ছুটে এলাম! কোনো মা কি ছেলের এই খবরে না এসে থাকতে পারে!

সুমন আর বিতর্কে গেলো না! সুকান্ত বলার পর থেকেই সেও চাইছিলো তার বাড়ির লোকেরা অন্তত বিয়েতে উপস্থিত থাকুক! পরিচিত মানুষের হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া এড়িয়ে যেতে এটাই সর্বোৎকৃষ্ট উপায় ছিলো তার কাছে!
ক্রমশ