#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৫২
সারাদিন বাড়িতে একটা থমথমে পরিবেশ হয়ে রইলো, রান্নাঘরের দাওয়ায় একসঙ্গে বসে খাওয়ার কোনো প্রশ্নই ছিলো না আজ, তবু সুকান্ত জোর করেই অদ্বিতীয়া কে সঙ্গে করে নিয়ে খেতে বসলেন সেখানে। সরযূ দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বামুনের উদ্দেশ্যে চিৎকার করলেন,
খবরদার! ওই মেয়ে যেনো আমার হেঁসেলের দাওয়ায় না ওঠে! ম্যাগো! কি ঘেন্না! কি ঘেন্না! উঠোনে একটু গঙ্গা জলের ছড়া দে! ভাতের হাঁড়িতে হাত দিবি না একদম!
বামুন সরযূর চিৎকারে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, ওই কথার পরে ভাত বাড়তে যাওয়ার ক্ষমতা তার ছিলো না। তাকে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সরলা এগিয়ে এলো, নিজেই পরিবেশন করতে উদ্যত হলো দেখে সরযূ স্বামীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করলেন,
বাইরে বেরিয়ে এসো শিগগির! দেখো তোমার বউয়ের কান্ড! তার এতো সাহস সে আমার আদেশ অমান্য করে!
প্রতাপ সান্যাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন, তাঁকে দোতলার বারান্দায় দেখেও সরলা নিজের কাজ করে যেতে লাগলো। কিছুক্ষন সেদিকে তাকিয়ে দেখে সান্যাল মশাই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, অসহায় গলায় বললেন,
ভাবতে পারো সরযূ, যে প্রতাপ সান্যালের কথায় বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খেতো, সেই লোককে তোমার ওই গুণধর ছেলে আজ কোথায় নামিয়ে এনেছে! আজ আর কারোর ওপরেই অধিকার ফলানোর মতো অধিকার আমার নেই! কেউ আমাকে ভয় পায় না!
সরলা উঠে দাঁড়ালো, শ্বশুর মশাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
আপনি তো এতক্ষনে নিশ্চয়ই আমার ভাগ্য নির্ধারণ করেই ফেলেছেন বাবা! ছেলে কে মুখে বললেও বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবেন না জানি, কিন্তু আমার যে এখানে থাকা হবে না আর সেটাও আমার জানা!! আসামি যখন রায় জেনে ফেলে তখন তার আর কোনো ভয় থাকে না, না জানতে পারা পর্যন্তই যত ভয়! তাই আর আপনাকে ভয় পেয়ে কি করবো বলুন? আমার এখানে থাকাও যা আর বাপের বাড়িতে বৌদিদের লাথি ঝাঁটা খেয়ে থাকাও তা, আসলে কোনও জায়গাতেই তো আমি বাড়ির ঝি বই আর কিছুই নই! নাহলে মায়ের এতো অপছন্দ হওয়া সত্বেও আপনি কি আমাকে এখানে রেখে দিতেন, আর বিশেষ করে যখন আপনাকে আপনার বংশধর এনে দিতে পারিনি!
প্রতাপ সান্যাল কোনো উত্তর দিলেন না, ঘরে ঢুকে এসে ফোন হাতে তুলে রথীন কে ফোন করলেন,
রথীন! এই বিয়ে আমি বাতিল করলাম! তোমার ভায়রা ভাই কে বুঝিয়ে বোলো, আমার নাতনি আমার মুখে চুনকালি মাখিয়ে দিয়েছে!
রথীন এর গলা শক্ত হলো,
জ্যেঠু বাবু! আপনি একজন সম্মানীয় ব্যক্তি, বিয়ের কার্ড ছাপানো হয়ে গেছে, এখন এই বিয়ে ক্যান্সেল করা আপনাকে মানায় না! আমি তো ছেলেটার ব্যবস্থা করছি!
প্রতাপ সান্যাল গলা নামালেন,
ছেলেটির ব্যবস্থা করা সম্ভব নয়, রতন আমার বিরুদ্ধে সুকান্তর কাছে গোপনে বয়ান জমা দিয়েছে, ছেলেটির কিছু হয়ে গেলে দোষ সরাসরি আমার ঘাড়ে এসে পড়বে! তাছাড়া আর এই বিয়ে আমি দেবো না রথীন, ওই মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেওয়ার প্রবৃত্তি আর আমার নেই! সে একটি থার্ড ক্লাস ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে!
রথীন এর গলা কড়া হলো,
কিছু মনে করবেন না জ্যেঠু বাবু, আমি এতকাল আপনাকে যথেষ্ট সম্মান দিয়ে এসেছি! আমার ধারণা ছিলো আপনি সান্যাল বংশের সম্মান নিয়ে কখনো ছিনিমিনি খেলবেন না! কিন্তু আজ আপনাকে এটা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনার এই বয়সে এসে মতিভ্রম হচ্ছে! সব কিছু ছেড়ে দেওয়ার একটা বয়স থাকে, এবার আপনার সেই সময় এসেছে, বাকি দায়িত্ব আপনি আমার ওপরে ছেড়ে দিন! রতন আপনাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে এই ভয় দেখিয়ে সুকান্ত আপনাকে থামিয়ে দিলেও আমি সেটা মানতে বাধ্য নই! আমি সান্যাল বংশের মর্যাদাহানি হতে দিতে পারিনা, ওই থার্ড ক্লাস ছেলেটি আমাদের বাড়ির জামাই হবে, আমি সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারবো না!
আমার বিপদে পড়ায় তোমার কিছু যায় আসেনা, একথা তুমি বলতে পারলে রথীন!
অসহায় গলায় বললেন প্রতাপ সান্যাল, রথীন এর গলায় তাচ্ছিল্য ঝরে পড়লো,
এর জন্যে তো আপনিই দায়ী জ্যেঠু বাবু! রতন কে চোখে চোখে না রেখে সরিয়ে দিলেই তো অনেক আগেই ঝামেলা মিটে যেতো! এতো বার সে ভুল করছে তাও আপনি তাকে বারবার ছেড়ে দিচ্ছেন! সে না থাকলে আশা কে নিয়েও এতো সমস্যা তৈরি হতো না কখনো! রতন যে বেইমানি করছে, সে খবর তো আপনি অনেকদিন থেকেই রেখেছেন, তাও তার ওপরে বিশ্বাস করে থেকেছেন! আসলে বড়মা আপনার দুর্বলতা জেঠু বাবু, আপনি তাঁর কথাকে ফেলতে পারেন নি কখনো! আমি কিন্তু আমার স্ত্রীর সব কথা কে বেদ বাক্য হিসেবে নিইনি কখনো, যত টুকু শুনলে আমার কাজের ক্ষতি না হয় ততটুকুই শুনেছি! অথচ বড়ো মার ভাইপো এই কারণেই আপনি রতন কে সরাতে পারেন নি সেটা আমি জানি! কিন্তু আমাকে দেখুন, শুভর থেকে পিয়া কে আমি সব সময় আমি অনেক বেশি আপন ভেবেছি, তার যে অন্য কোনো ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে সেটা একবারের জন্যেও তার হবু শ্বশুরবাড়ি জানতে পারে নি!
প্রতাপ সান্যালের গলায় হতাশা প্রকাশ পেলো,
তুমি জানো না রথীন আমি কতোটা বিপদের মধ্যে আছি! তুমি যদি জানো সত্যি টা আসলে কি, তাহলে তুমিও এই বিয়েটা আর জোর করে দিতে চাইবে না! তোমার অকালকুস্মণ্ড ভাইটি এতদিন পরে আমার কাছে স্বীকার করেছে যে পিয়া আদৌ তার সন্তান নয়, সে নাকি কোনো এক নষ্টা মেয়েকে অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় বাড়িতে এনে তুলেছিলো! তাও সে একথা স্বীকার করতো না, যদি না একটি বেনামী চিঠি আমার কাছে এসে পৌঁছাতো!
ফোনের ওপারে কয়েক সেকেন্ড স্তব্ধতার পরে রথীন এর তীক্ষ্ণ গলা ভেসে এলো,
অসাধারণ! তাহলে এরপরে আপনার ওই গুণধর ছেলের কল্যাণে সান্যাল দের সম্পত্তি হাত বদল হয়ে কোনো এক অনাথ, ভিখিরি মেয়ের হাতে পৌঁছচ্ছে, তাই তো?
জানি না!
সান্যাল মশাইয়ের গলায় হতাশার সুর রথীন কে ক্ষিপ্ত করে তুললো,
জানিনা বললে চলবে কি করে জ্যেঠু বাবু, জানতে তো আপনাকে হবেই! একটা সোজা কথা আপনাকে সোজা ভাবেই বলি, যা শুনলাম এর পরে ওই মেয়ে কাকে বিয়ে করছে বা আদৌ করছে কিনা সেসব কথা জানার প্রবৃত্তি আর আমার নেই! তবে সান্যাল বংশের সম্পত্তির দাবিবার কিছুতেই ওই মেয়েটি হতে পারবে না, এটা এক্ষুনি আপনাকে আমি জানিয়ে দিলাম! আমি এই ঘটনার কথা কাউকে জানতে দেবোনা, আপনি তাকে ত্যাজ্য করেছেন এই কথাই সবাই জানবে, এমনকি আমি আমার স্ত্রী এবং ভায়রা কেও সেই কথাই বলবো। তবে শর্ত একটাই ওই সম্পত্তির সবটাই আমার ছেলের নামে আপনাকে লিখে দিতে হবে, সবাই কে বলবেন যে নাতনি নিজের পছন্দে বিয়ে করেছে বলে আপনি তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে আমার ছেলে কে সব লিখে দিয়েছেন! যদি আপনার কথার খেলাপ হয় তাহলে আমি এসব প্রকাশ্যে আনবো, আপনার সম্মানের কথা চিন্তাও করবো না!
তুমিও আমাকে ব্ল্যাকমেল করছো রথীন, তোমার কাছ থেকে এটা আমি কখনো আশা করিনি!
হতাশ গলায় বললেন প্রতাপ সান্যাল, রথীন সশব্দে হেসে উঠলেন,
এসব তো আপনার কাছ থেকেই শেখা জ্যেঠু বাবু, আপনিই তো শিখিয়েছেন যে কাউকে বিশ্বাস করতে নেই! দেখুন না, এই যে আশার ব্যাপারটা! আপনি আমাকে দায়িত্ব দিলেন, কিন্তু বিশ্বাস করলেন না! শেষ পর্যন্ত নিজেই দায়িত্ব নিয়ে আশা কে সরিয়ে দিলেন!
আজ দুপুরে রতিকান্ত কে খেতে ডাকার কেউ ছিলো না প্রথম বার, সে খানিকক্ষন অপেক্ষার পর নিজেই নেমে গিয়ে বামুনের কাছে ভাত চেয়েছিলো। ভাত খেয়ে যখন সে ওপরে উঠে এলো ততোক্ষনে সরলা তার জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেলেছে। ঘরে ঢুকেই রতিকান্ত অবাক হলো, একটু কুন্ঠার সঙ্গে সরলার দিকে তাকিয়ে বললো,
বাবা তো তোমাকে বাড়ি ছেড়ে যেতে বলেনি, বলেছে আমাকে, তুমি কোথায় যাচ্ছো?
সরলা বিদ্রুপের গলায় বললো,
বাবা তোমাকে তাড়িয়ে দেবেন? তাই যদি হতো তাহলে আরো অনেক বছর আগেই তিনি সেটা করতেন! যেদিন তুমি বাচ্চা সহ ওই মেয়েকে বউ সাজিয়ে নিয়ে এসেছিলে, সেদিনও কিন্তু তোমাকে নয় ওকেই তাড়িয়ে ছিলেন!
রতিকান্ত হটাৎ রুখে দাঁড়ালো, রাগের গলায় বললো,
ভুল কথা! বাবা ওকে তাড়ান নি! ও বাবার সঙ্গে সওদা করেছিলো! ও যে টাকার বদলে নার্সিং হোমে বাচ্চা ছেড়ে যাবে সেকথা কখনো আমাকে আগে বলেনি!
তাই নাকি! বললে তুমি তাকে আটকে দিতে? তাহলে যখন আশা কে দিয়ে বাচ্চা নষ্ট করার চেষ্টা করছিলেন তোমার মা তখন কেনো তুমি চুপ করে বসেছিলে?
রতিকান্ত বিছানায় বসে পড়লো, অসহায় গলায় বললো,
আমি তাকে কতটুকুই বা চিনতাম! তার বাচ্চা সে এমনই নষ্ট করতেই যাচ্ছিলো, কারণ যে লোকটা তাকে মন্দিরে বিয়ে করে রাস্তায় বসিয়ে রেখে চলে গিয়েছিলো তার ফিরে আসার আর কোনো সম্ভাবনা ছিলো না! আমি বরং তাকে বাচ্চা সহ মরার হাত থেকে বাঁচিয়েছিলাম! যদিও স্বার্থ আমারও ছিলো, কিন্তু সেও তো মুক্তি পেয়েছিলো, নাহলে তো সে ট্রেনে গলা দিতে যাচ্ছিলো সে রাতে! আমি বরং তাকে আরো ভালো জীবন দিতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সেতো আমার বাবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে টাকা নিয়ে বাচ্চা রেখে আরো ভালো থাকার জন্যে পালিয়ে গেলো!!
সরলা রতিকান্তের চোখের দিকে সরাসরি তাকালো,
আর আমার ভালো জীবন? সেটা তো কখনো দিতে চাওনি! বিয়ের পর থেকে শুধু তোমাকে হুমকি, ভয় দেখিয়েই চলতে হয়েছে আমাকে! সবাই জানতো আমি তোমাকে বশ করে রেখেছি, তুমি আমার কথায় বাইরে যাওয়া বন্ধ করেছো, কিন্তু সত্যিই কি তোমার বাইরে রাত কাটানোর কোনো প্রয়োজন ছিলো কখনো! তোমার তো একটাই নেশা ছিলো মদ, সেটার যোগান তো কখনো তোমার বন্ধ হয়নি! তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসোনি, শুধু নিজের প্রয়োজনে আমার সব কথা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছ এতদিন! আজ তো আর তোমার সে প্রয়োজন নেই, এমনই সবাই সব কিছু জেনে গিয়েছে, তাই আমার প্রয়োজনও ফুরিয়েছে!
রতিকান্ত বিষণ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,
কি জানি! ছোটো থেকেই বেশি আদরে আদরে বিগড়ে গিয়েছিলাম তো, শাসন করার কেউ তেমন ছিলো না! বাবা যত চেষ্টা করতেন, মা ততো আগলে রাখতে চাইতেন! তাতে বাবার ওপরে রাগ আরও বাড়তো! এই অহংকারী, নাক উঁচু লোকটাকে ছোটো করতে পারলে মনে অদ্ভুত একটা শান্তি আসতো! তারপরে তুমি এলে, যেভাবেই হোক না কেনো জীবনে একটা নিয়ম হলো, সময় জ্ঞান হলো! যে কাজটা বাবা করতে পারেনি মায়ের বাধায়, সেটা তুমি করে দেখালে! এখন কেমন যেন এগুলোতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি, এগুলো ছাড়া ভাবতেই পারিনা আর! তুমি চলে গেলে আমার সত্যি খুব খারাপ লাগবে!
সরলা ম্লান হাসলো,
তুমি আমাকে ধরে রাখার কে? কি যোগ্যতা আছে তোমার? বাড়ি তো বাবার, উনি বললে তো আমাকে চলে যেতে হবেই! তোমার কি এক পয়সাও রোজগার আছে যে আমাকে খাওয়াবে?
রতিকান্ত অসহায় ভঙ্গিতে তাকালো,
তখন মনে হতো, বাবার অতো পয়সা থাকতে রোজগার কেনো করবো! ওই টাকা ওড়ানোর মধ্যেও বাবাকে একটা জব্দ করার মতো ব্যাপার ছিলো, অদ্ভুত একটা আনন্দ হতো টাকাগুলো উড়িয়ে দিতে পারলে! তখন ভাবিনি এরকম একটা দিন আসবে, যখন নিজের রোজগার না থাকার জন্যে আফসোস হবে!
একটু বিকেলের দিকে সুকান্ত যখন বাবার ঘরে উপস্থিত হলেন, প্রতাপ সান্যাল তখনও থমথমে মুখে খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছিলেন। ছেলে কে ঢুকতে দেখে বিরক্ত মুখে চোখ তুলে তাকালেন, সুকান্ত সেই মুখ কে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
আমি পিয়া কে নিয়ে আমার বাড়িতে চলে যাচ্ছি, বিয়ে ওখান থেকেই হবে। আশাকরি এই ব্যাপারে আর তোমার কোনো মতামত থাকবে না! আর একটা কথা, তুমি ছোটো থেকে পিয়া কে অর্ধেক সম্পত্তি লিখে দেওয়ার যে রটনা নিজের স্বার্থে রটিয়ে এসেছো এতকাল সবটাই তো তোমার বড়ো ছেলের গুণকীর্তন লুকিয়ে রাখার জন্যে, আজ নিশ্চয়ই আর তার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই সেই সম্পত্তি তুমি ইতিমধ্যেই অন্য কাউকে দেবার কথা ভেবে ফেলেছো নিশ্চয়ই! তুমি তোমার সম্পত্তি কাকে দেবে সে নিয়ে আমার কোনো কৌতূহল নেই, আমি শুধু একটা কথাই বলতে এসেছি যে তোমার অর্ধেক সম্পত্তি আইনত দাদা এবং আমার পাওয়ার কথা। দাদা কি করবে আমি জানিনা, কিন্তু আমি তোমার সম্পত্তির ভাগ নিতে চাইনা, কারণ আমি পিয়া কে দত্তক নিচ্ছি! আমি চাইনা আমার মেয়ে ভবিষ্যতে কোনো খুনীর সম্পত্তির মালিকানা পাক!
সান্যাল মশাই হতবাক হয়ে তাকালেন,
তুমি ওই মেয়ে কে দত্তক নিচ্ছ! আবার সে ঘুর পথে সান্যাল বাড়ির অংশীদার হলো!
সুকান্ত সরাসরি তাকালেন,
হ্যাঁ! আমি তাকে দত্তক নিচ্ছি! সেতো আমারই মেয়ে ছিলো শুধু এতদিন মেয়ের পরিচয় দেওয়ার আইনি অধিকারটুকু আমার ছিলো না! তাই জন্যেই তো বললাম, তোমার সম্পত্তির মালিকানা আমার মেয়ের চাইনা! আর যদি ওকে আমি দত্তক নেওয়াতে তোমার মনে হয় যে ও ঘুরপথে আবার সান্যাল বাড়ির অংশীদার হচ্ছে তাহলে তুমি আমাকে আইনি পথে ত্যাজ্য পুত্র করতে পারো, তাতে আমি বা আমার মেয়ে কেউ আর সান্যাল বাড়ির অংশীদার থাকবো না!
অবাক চোখে তাকিয়ে থাকা হতাশ প্রতাপ সান্যাল কে পেছনে ফেলে সুকান্ত বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার জন্যে ঘুরে দাঁড়ালেন, টেবিলের ওপরে কালকের চিঠিটা তখনও রাখা ছিলো। সুকান্ত নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে চিঠিটা হাতে তুলে নিলেন, কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে চিঠিটা উল্টে পাল্টে দেখে তিনি পকেটে রাখলেন, বাবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
এটার দরকার তোমার ফুরিয়েছে আশাকরি, আমি এটা নিজের কাছে রাখলাম!
সুকান্ত অদ্বিতীয়া কে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষন পরে সরলা চায়ের ট্রে হাতে শ্বশুর, শাশুড়ির ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো, তাকে পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকতে দেখে সান্যাল মশাই সোজা হয়ে উঠে বসলেন। সরলা ট্রে নামিয়ে রেখে শ্বশুর মশাই কে বললো,
আমি কাল সকালে চলে যাচ্ছি, আপনি কি শাস্তি দেন তার জন্যে আর অপেক্ষা করলাম না!
সান্যাল মশাই গম্ভীর মুখে তাকালেন,
তোমাকে আর নতুন করে কি শাস্তি দেবো! তুমি তো আমার ওই কুলাঙ্গার ছেলে কে বিয়ে করে এবাড়িতে এসে ইতিমধ্যেই যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছ! এবার শাস্তি তাকে দেবো যে আমার দুর্বলতার সুযোগে এতো বড়ো একটা অন্যায় করেছে! তুমি এই বাড়িতেই থাকবে, তাকে আমি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে বলেছি!
সরলা সান্যাল মশাইয়ের চোখের দিকে তাকালো,
আর আপনার শাস্তি? সেটা কে দেবে? আপনার ছেলে যতো অন্যায় করেছে আপনিও তো ঠিক ততটাই অন্যায় করেছেন বাবা! ছেলের অন্যায় ঢাকতে গিয়ে একের পর এক অন্যায় করেছেন! আপনার ছেলের অন্যায় ঢাকতে আমি যদি একটা অন্যায় করে থাকি তাহলে আপনি দশটা করেছেন! আমার অন্যায় করাতে বরং একটা মেয়ের জীবন বেঁচেছে, কিন্তু আপনি তো পর পর মানুষ কে হয় পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছেন অথবা ভয় দেখিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করিয়ে দিয়েছেন! আপনার হাতে ক্ষমতা তাই আপনাকে আজ শাস্তি দেওয়ার কেউ নেই!
প্রতাপ সান্যাল কড়া চোখে তাকালেন,
তাহলে তুমি কি বলতে চাও, এসব আমি ঠিক করিনি, আমার উচিত ছিলো এগুলো সবটাই মেনে নেওয়া! আমার বংশের সম্মান, মর্যাদা ধুলোয় মিশে যাচ্ছে দেখেও চুপ করে ঠুঁটো জগন্নাথ হয়ে বসে থাকতাম আমি?
সরলা ঘাড় নাড়লো,
না, বাবা! সম্মান, মর্যাদা যে মিশিয়ে দিচ্ছে শাস্তি তাকে দিতে হতো, কিন্তু তা আপনি দেননি! আপনি তাদের গায়ে বনেদী রক্ত দেখে তাদের মাফ করে দিয়েছেন, ক্ষতি তাদের করেছেন যারা আপনার রক্তের, বংশের কেউ নয়! তাদের বাঁচা মরায় আসলে আপনার কখনো কিছু যায় আসেনি! তারাও যে মানুষ, কারো সন্তান, কারো বাবা, মা সেগুলো আপনার কাছে কোনো গুরুত্বপূর্ন বিষয় হয়ে ওঠেনি! আপনি যে প্রতারণার শাস্তি অন্যদের দিয়েছেন, সেই প্রতারণার শাস্তি আপনার বংশের লোকেদের দেননি! কখনো ভেবেছেন এই বংশ মর্যাদা, বনেদিয়ানা এসব রক্ষা করার নামে এই যে শাস্তি আপনারা যুগযুগ ধরে দিয়ে আসছেন অন্য দের, সেই শাস্তি দেওয়ার অধিকার কে আপনাদের দিয়েছে? অন্য কে শাস্তি দিতে দিতে আপনি নিজেই যে কখন অপরাধী হয়ে উঠেছেন আপনি সেটা হয়ত নিজেও বুঝে উঠতে পারেন নি! কাকে বলে বনেদীয়ানা? কে তৈরি করে এসব? যে মেয়েটিকে আপনার রক্ত, বনেদি সান্যালদের বংশধর বলে আপনি নিজেও মানতেন এতদিন, সে এক লহমায় আজ অনাথ নাম গোত্রহীন হয়ে গেলো! তাহলে কি তার মধ্যে কখনো বনেদিয়ানা বলে কিছুই ছিলো না, সবটাই তৈরি করা একটা জিনিষ? এখন তো সে যে ছেলেটিকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চাইছিলো তার থেকেও খারাপ অবস্থা তার, ছেলেটির তবু একটা বংশ পরিচয় আছে মেয়েটার তো তাও নেই! বনেদি রক্ত, বংশ এসব আসলে কিছু হয়না বাবা, পরিবেশ, পরিস্থিতি, কাজ আমাদের জীবন তৈরি করে! জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো!
সরলা ট্রে রেখে দিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পরেও প্রতাপ সান্যাল একই জায়গায় স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন, সরযূর বউকে চিৎকার করে করতে থাকা গালমন্দ তাঁর কানেও ঢুকছিলো না।
ক্রমশ