সেই মেয়েটার উপাখ্যান পর্ব-৫৫ এবং শেষ পর্ব

0
428

#সেই মেয়েটার উপাখ্যান
#পর্ব ৫৫
বিকেলের চা নিয়ে সরলা যখন শ্বশুর মশাইয়ের ঘরে ঢুকলো তখনও তিনি একই ভাবে খাটের বাজু তে হেলান দিয়ে বিষণ্ণ দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সরলা চা সামনের টেবিলে নামিয়ে রেখে মৃদু গলায় বললো,

বাবা! চা এনেছি!

সান্যাল মশাই মাথা তুললেন,

রতন এসেছে? প্যান্ডেলের বাঁশ খোলা শেষ হয়েছে?

সরলা ঘাড় কাত করলো,

হ্যাঁ!

সান্যাল মশাই মাথা নাড়লেন,

সারাজীবন যে বংশ মর্যাদার জন্যে এতো কিছু করা, তাই শেষ জীবনে এসে সব শেষ হয়ে গেলো! আমার ছেলে আমাকে দারুন শিক্ষা দিলো বৌমা, যে বনেদিয়ানা নিয়ে এতো অহংকার ছিলো সেই বনেদিয়ানা, বংশ মর্যাদা কে সে ধুলোয় মিশিয়ে দিলো!

সরলা শান্ত গলায় বলল,

ভুল বললেন বাবা! বনেদিয়ানা এতো ঠুনকো নয়, তাকে এতো সহজে কেউ ভেঙে ফেলতে পারে না! ভাঙে তো তখন যখন আমরা জোর করে সেটাকে অন্যের ওপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করি! দেখুন তপু দা তো কবে বিদেশি মেয়ে বিয়ে করেছে, তার ছেলের পৈতে হলো সেদিন! সেই ছেলের গায়ে তো তার মায়ের রক্তও আছে, তাও তো সে বনেদী বলে পরিচিতি পেলো! অথচ পিয়া মেয়ে বলে তার রক্তের বনেদিয়ানা সাধারণ বাড়ির ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলে নষ্ট হয়ে যায়! আসলে এগুলো সবটাই আমাদেরই তৈরি করা, নিজেদের প্রয়োজনে আমরা ইচ্ছে মতো নিয়ম, কানুনের অদল বদল করি!

চোখ বন্ধ করে মাথায় আঙুল চালাতে চালাতে হতাশ গলায় বললেন প্রতাপ সান্যাল,

আজ খুব আফসোস হচ্ছে! তুমি ঠিকই বলেছিলে, দেখো,এই মুহূর্তে আমার থেকে নিঃস্ব আর কেউ নেই! তোমার মা অর্ধেক সম্পত্তি নাতনিকে দিতে চেয়েছিলাম বলে অশান্তি করছিলেন সেদিন, আজ সেই সম্পত্তি নেওয়ার কেউ নেই! সুকান্ত তো সরাসরি নিতে অস্বীকার করেছে আগেই, তোমাদের দিয়ে যাবো তাও তো শেষ পর্যন্ত নেবার মতো কেউ থাকবে না!

সম্পত্তি কেউ তো সঙ্গে নিয়ে যায়না বাবা, এখানেই রেখে যায়! আপনি না থাকলে কার হাতে যাবে সে নিয়ে ভাবনা করে লাভ কি! যদি এখনো আপনি মনে করেন তাহলে আপনার বংশের কাউকে দিয়ে যেতেই পারেন! আমি আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছিলাম, আজ পিয়ার বিয়ে! আমি ছোড়দার বাড়িতে যাবো, তাই আপনার অনুমতি নিতে এলাম!

প্রতাপ সান্যাল চোখ তুলে তাকালেন,

আমার ছেলে যা করেছে তার পরে তোমার ওপরে জোর খাটানোর মতো অধিকার আমি হারিয়েছি! তাও যে তুমি এই সম্মানটুকু দিলে তাতেই আমি খুশি, যাও! আমি তোমাকে আটকাবো না!

সরলা হাসলো,

আপনি গেলে আরও ভালো লাগতো! হয়ত মেয়েটা আমাদের কেউ ছিলো না, কিন্তু আমরা সবাই তো তাকে নিজেদের ভেবেছিলাম তাই না বাবা? ভালোও বেসেছিলাম নিজের ভেবেই! একটা চিঠি কি সেই ভালোবাসা কে এক মুহূর্তে মিথ্যে করে দিতে পারে! ধরুন আজ যদি আপনার ছেলে অস্বীকার করতো, তাহলে তো আপনার চোখে সে বনেদী রক্তই থেকে যেতো, তাই না!

প্রতাপ সান্যাল বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, সিন্দুক খুলে একটা গয়নার বাক্স এগিয়ে দিয়ে বললেন,

আমার ছেলে আমাকে জব্দ করার জন্যেই সত্যি বলেছে, নাহলে সে যে অস্বীকারই করতো তাতে কোনো সন্দেহ নাই! যাইহোক তার অন্যায় সত্বেও তাকে আমি ক্ষমা করেছি, হয়ত সেটা নিজের স্বার্থেই, তবু করেছি তো! হয়ত কোথাও শেষ জীবনে একা হয়ে যাওয়ার ভয় কাজ করেছে মনের মধ্যে! তাই তাকে যখন করেছি তখন তার অপরাধের শাস্তি আমি আর ওই মেয়েটি কে দেবো না! আমার মাথা নিচু হয়ে যাওয়ার পেছনে তার কোনো ভূমিকা নেই! আমিও ইতিমধ্যেই নিজের এতদিনের কৃতকর্মের জন্যে নিজেকে শাস্তি দেবার ব্যবস্থা করেছি। সুকান্ত কে বলেছি সব গোপন কথা প্রকাশ্যে নিয়ে আসতে, আর আমি কোনো কিছু গোপন রাখতে চাই না! এই গয়না তার নাম করেই তৈরি করা, আমার বনেদি সম্পত্তির অংশ নয়, এটা তাকে দিও! নিজের এতদিনের চিন্তাধারা এই বয়সে আর বদলানো সম্ভব নয়! তবে আমি সুকান্ত কে বলেছি, তোমাকেও বললাম, যে অর্ধেক সম্পত্তি আমার দুই ছেলের থাকলো, সেই সম্পত্তি যদি তোমরা ইচ্ছে করে, তাহলে যাকে খুশি দিয়ে যেতে পারো! হ্যাঁ, ওই মেয়েটি পেলেও আমার কোনো আপত্তি থাকবে না!

তুমি কি যাবে আমার সঙ্গে?

তৈরি হতে হতে রতিকান্ত কে জিজ্ঞেস করলো সরলা, রতিকান্ত তাড়াতাড়ি হাত নাড়লো,

নাহ! ও তুমিই যাও! আমি গেলে কেউ এমনিতেই খুশি হবে না!

সরলা যখন বিয়ে বাড়িতে পৌঁছালো তখনো অনুষ্ঠান শুরু হয়নি, তাকে দেখেই অদ্বিতীয়া দৌড়ে এগিয়ে এলো,

ছোটো মা! আমি জানতাম তুমি আসবে! যদিও তুমি না এলে আমাকেই হয়ত যেতে হতো! আমার জন্যে এতো বড়ো একটা কথা তুমি প্রকাশ্যে এনে ফেললে! তুমি অস্বীকার করতে চাইলেও পারবে না, আমি সব জানি!

সরলা খানিকক্ষন চুপ করে থাকলো,

যখন প্রথম জেনে ছিলাম সত্যিটা, তখন সত্যিই মনে হয়েছিলো সবাই কে সব কিছু জানিয়ে দিই! অসম্ভব রাগ হয়েছিলো, সারা জীবন সোজা কথার মানুষ আমি, এই মুখ বন্ধ করে রাখা আমার পক্ষে খুব কঠিন ছিলো হয়ত!! কিন্তু যখন মায়ার কাছ থেকে সব জানতে পারলাম, তখন বুঝলাম যারা এমনিতেই পুরোপুরি বনেদী রক্ত নেই বলে বাড়ির মেয়ে কে সরিয়ে দিতে চায়, তারা যদি এই সত্যি টা জানতে পারে তাহলে তোমার আর বেঁচে থাকার কোনো সুযোগই থাকবে না! বাবা, মা না থাকার কষ্ট আমি নিজের জীবন দিয়ে জেনেছিলাম দাদা, বৌদিদের সংসারে অবহেলিত হয়ে, সেই একই জিনিষ আমি তোমার ক্ষেত্রে হতে দিতে চাইনি! প্রথম প্রথম নিজের মধ্যেও কেমন যেনো একটা অস্বস্তি কাজ করতো, তোমাকে কোলে নিতে ইচ্ছে করতো না! আসলে আজন্ম যে সংস্কারে মানুষ হয়েছি তার থেকে বেরিয়ে আসা খুব বেশি সহজ ছিলো না কখনো! তারপরে আস্তে আস্তে তুমি চোখের সামনে একটু একটু করে বড়ো হতে লাগলে, না চাইতেও একটা ছোট্ট শিশুর পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ানো, আধো আধো গলার মা ডাক, কখন যে তোমাকে ভালোবেসে ফেললাম নিজেও বুঝিনি! কিন্তু মায়া মরার আগে এইটুকু শিখিয়ে গিয়েছিলো যে তোমাকে বেশি আগলে রাখতে গেলে তোমার আমার দুজনেরই ক্ষতি, তাই সুযোগ পেয়েই তোমাকে হোস্টেলে পাঠিয়ে দিলাম! হয়ত তোমার আমার ওপরে অনেক ক্ষোভ আছে কিন্তু আমার কিছু করার ছিলো না!

অদ্বিতীয়া সরলা কে জড়িয়ে ধরলো,

তুমি আমার সঙ্গে থেকে যাও ছোটো মা, ওখানে তোমাকে কেউ ভালোবাসে না! বাবা তোমাকে তাড়িয়ে দিতে পারলেই বাঁচে,তাঁর স্বাধীনতা তাহলে ফিরে আসে! এতকাল তো তুমি তাঁকে ব্ল্যাকমেল করেই রেখেছো! শুনেছি দাদুভাই তোমাকে থাকতে বলেছেন কিন্তু তারপরেও আমি চাইবো তুমি আমার সঙ্গে থাকো!

সরলা হাসলো,

শেষ জীবনে একা হয়ে যাওয়ার ভয় পাচ্ছেন! আসলে এই দুনিয়াতে উনি যে ধরনের মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন এতো কাল, তারা তো নিজেদের স্বার্থ ছাড়া কিছুই দেখেনি, তাই আজ তিনি ভয় পাচ্ছেন পাছে তাঁর একাকীত্বে বিনা স্বার্থে কাউকে পাশে না পান! আর তোমার বাবার কথা বলছো? জানিনা এক সঙ্গে অনেকদিন থাকলে বোধহয় কুকুর, বেড়ালের ওপরেও মায়া পড়ে যায়, হয়ত তাই হয়েছে ওনার, উনি নিজে থেকে আমাকে থাকতে বলেছেন! আর যদি আমার কথা বলো, তাহলেও একই কথা বলবো! ওই বাড়িতে আমার সম্মান কতটা আছে আমি জানিনা, কিন্তু অধিকার আছে! সেই অধিকারটুকু আমি ছেড়ে দেবো না! আর পরে যদি ইচ্ছে করে তাহলে এখানে যখন খুশি চলে আসতে পারি, রমার সঙ্গে আমার কথা হয়েই আছে!

অদ্বিতীয়া হাসলো, জলভরা চোখে তাকিয়ে বললো,

তুমি তখন বলেছিলে বাপের বাড়ি চলে যাবে! এখানের কথা জানতে দিতে চাওনি না!

সরলা হেসে ফেললো,

তাহলে তো তুমি বুঝে যেতে! যাক! যা হয়ে গেছে সেসব থাক! আজকের দিনে অন্য কথা বলি!

উত্তর কলকাতার বনেদী সান্যাল বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে কলকাতার অন্য এক প্রান্তে আলো ঝলমলে পরিবেশে এক শুভ বিবাহের অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিলো। “অদ্বিতীয়া ওয়েডস সুমন” লেখা বাহারি রঙের ফুলে সাজানো গেটে অভ্যর্থনার জন্যে সুকান্ত স্বয়ং দাঁড়িয়েছিলেন, একের পর এক এসে পৌঁছানো গণ্য মান্য ব্যক্তিদের হাত জোড় করে নিয়ে যাচ্ছিলেন অনুষ্ঠান প্রাঙ্গণে। সুমনের ক্লাবের বন্ধুরা, পাড়ার বন্ধুরা এমনকি বাড়ির লোকেরাও শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল এই বিয়েতে।

সান্যাল বাড়ির মেয়ের সঙ্গে কলকাতায় নামকরা ক্লাবের ফুটবলারের বিয়েতে যথেষ্ট কৌতুহলী সবাই। সেখানে উপস্থিত বড়ো বড়ো সংবাদ মাধ্যম প্রায় ঘিরে ধরেছিলো নব দম্পতি কে,

ম্যাডাম! বিয়েতে শুনলাম আপনার দাদুর মত নেই! তাই কি বিয়েটা এখান থেকে হচ্ছে?

অদ্বিতীয়া কে অস্বস্তির হাত থেকে বাঁচাতে সুমন কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই অদ্বিতীয়া হাত তুললো,

খুব ভালো প্রশ্ন করেছেন, আমিও উত্তরটা আপনাদের দিতেই চেয়েছিলাম! আসলে আমি বা আমার বাবা সুকান্ত সান্যাল দুজনের কেউই চাইনি ওনাকে এই বয়সে অস্বস্তিতে ফেলতে, তাই বিয়ের অনুষ্ঠান এখান থেকে করারই ডিসিশন নিয়েছি আমরা!

মুহূর্তে টেপ রেকর্ডার এবং শর্ট হ্যান্ড এর খাতা হাতে নিয়ে তৈরি থাকা সাংবাদিকদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হলো,

সুকান্ত সান্যাল আপনার বাবা! কিন্তু আমরা তো তাঁকে আপনার কাকা বলেই জেনেছি এতকাল!

অদ্বিতীয়া মাথা নাড়লো,

সেটা আসলে একান্তই আমার দাদু প্রতাপ সান্যাল, মানে যাঁকে আমি দাদুভাই বলেই ডেকে এসেছি এতকাল, অনেকটা তাঁরই মহানুভবতা বলতে পারেন। আমার মাকে অন্তঃস্বত্তা অবস্থায় তিনি তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, যিনি আমাকে হাসপাতালে ফেলে রেখে চলে যান! তারপরে তিনি তাঁর বড়ো ছেলে রতিকান্ত সান্যালের কন্যা হিসেবে পরিচয় দিয়ে আমাকে বড়ো করে তোলেন, আজ যে আমি আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি সেটা তিনি বা তাঁর বাড়ির লোকেরা না থাকলে কখনোই সম্ভব হতো না!

তাহলে তিনি নিজে আপনার বিয়েটা দিলেন না কেনো?

অদ্বিতীয়া হাসলো,

যে মানুষটা সারাজীবন আমাকে নাতনির মতো মানুষ করেছেন, তাঁর অমতে এই বিয়েতে তিনি কতোটা আঘাত পেয়েছেন আশাকরি আপনারা বুঝতেই পারছেন! তিনি খুব আশা করেছিলেন আমার পাত্র তিনি নিজে পছন্দ করবেন, তা হয়নি বলে তাঁর এই ক্ষোভ ভীষণ রকম যুক্তিযুক্ত নয় কি? আমি তাঁর কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি তাঁর ইচ্ছের মর্যাদা রাখতে পারিনি বলে! আশাকরি আজ না হলেও তিনি কোনো একদিন আমার এই কাজের জন্যে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন! আর একটা কথা, ওনার বড়ো ছেলে রতিকান্তের সঙ্গে আমার কখনো বাবা মেয়ের সম্পর্ক ছিলো না, সে সম্পর্ক বরাবর যার সঙ্গে ছিলো তিনিই আমাকে তাঁর মেয়ের মর্যাদা দিয়েছেন, তার জন্যেও আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো!

সাংবাদিকদের মধ্যে গুঞ্জন উঠলো,

রতিকান্ত সান্যালের সন্তান নেই, সুকান্ত সান্যাল আপনাকে দত্তক নিয়েছেন, তাহলে কি বকলমে সব সম্পত্তি এখন আপনারই হলো ম্যাডাম?

অদ্বিতীয়া হাত তুললো,

এখানে আমার একটা কথাই বলার আছে, রতিকান্ত সান্যাল আমার কেউ নন! আমার বাবার নাম অবশ্যই সুকান্ত সান্যাল, তবে আমি সান্যাল বংশের কেউ নই, তাই তাদের বংশের সম্পত্তির ওপরে আমার কোনো অধিকার নেই বলেই আমি মনে করি! আমি শুধুই সুকান্ত সান্যালের মেয়ে বলেই পরিচিত হতে চাই, সান্যাল বংশের সম্পত্তির দাবিদার আমি নই!

সাংবাদিকদের আর কোনো প্রশ্ন করার আগেই সুমন উঠে দাঁড়ালো,

আমার স্ত্রী বলে দিয়েছেন উনি সান্যাল বাড়ির কেউ নন, তাই আর ওই বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করবেন না! আরে, ভাই! আমিও তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি নাকি! আমাকেও দু একটা ফুটবল নিয়ে জিজ্ঞেস করুন কিছু! আপনারা তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছেন না দেখছি! আর হ্যাঁ, কেউ না খেয়ে চলে যাবেন না কিন্তু!

অনেকটা দূরের অন্ধকার সান্যাল বাড়িতে রাতের খবরে এই ইন্টারভিউ দেখার পরে টিভি বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন সান্যাল মশাই, পাশে মুখ চুন করে বসে থাকা গিন্নীর দিকে তাকিয়ে ভাঙা গলায় বললেন,

আজ তুমি খুশি তো গিন্নী! দেখো, আজ তোমার হাতে কতো সম্পত্তি, দাও যাকে দিতে চাও দুহাত ভরে দাও! একটা বাচ্চা মেয়ে সব কিছু শুধু হেলায় ছেড়ে দিয়ে গেলো না, আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে গেলো আসলে সম্পত্তি র লোভে কেউ কাউকে ভালোবাসে না! সে আজ আমাকে সবার সামনে মহানুভব বলে আসলে নিজের মহানুভবতাই প্রমাণ করলো, দেখিয়ে দিলো আসল শিক্ষা, আসল বনেদিয়ানা কাকে বলে! হতে পারে সে বনেদি নয়, তার কোনো বংশ পরিচয় নেই তবু সেই যে সান্যাল বাড়ির অনেক বনেদি সন্তানদের থেকে যোগ্য আজ তার ব্যবহারে তা প্রকাশ পেলো! একটা অদ্ভুত শান্তি হচ্ছে আজ মনের মধ্যে, মনে হচ্ছে তাকে এতদিনের দেওয়া শিক্ষা, সহবত, কোনো কিছুই বৃথা যায় নি, সে সত্যি মানুষের মতো মানুষ হয়েছে!

কথা শেষ করে অনেকক্ষন ধরে বাজতে থাকা ফোনের দিকে তাকিয়ে সান্যাল মশাই রিসিভার হাতে নিলেন, রাশভারী গলায় বললেন,

হ্যালো, কে বলছেন?

ফোনের ওপারে রথীন এর হতাশ গলা ভেসে এলো,

জ্যেঠু বাবু! খবর দেখেছেন? পিয়া তো সব কথা বলে দিয়েছে! আপনার সম্মান বলে আর কিছু থাকলো না!

কোনটা না থাকার কথা বলছো? আমার সম্মান না তোমার সম্পত্তি রথীন! ভেবে দেখেছি আমার সম্মান এতো ঠুনকো নয় যে এতো সহজে ভেঙে যাবে! বরং তোমার খুব অসুবিধা হয়ে গেলো, আমাকে চাপ দিয়ে সম্পত্তি আর আদায় করতে পারলে না! আর একটা কথা সম্পত্তি আমি বড়ো বৌমা আর ছোটো ছেলের নামে লিখে দিয়েছি ইতিমধ্যেই, তাই এ বিষয়ে আর আমাকে চাপ দিয়ে কোনো লাভ নেই!

সেই তো সে সম্পত্তি ওই অনাথ মেয়ের হাতে আসবে জ্যেঠু বাবু, সান্যাল বাড়ির সম্পত্তি অন্য লোকের হাতে চলে গেলো!

হতাশ গলায় বললেন রথীন সান্যাল, প্রতাপ সান্যাল গলা তুললেন,

আরে দাঁড়াও, দাঁড়াও! কিছুদিন আগেই যখন সম্পত্তি পিয়ার বদলে তোমার শ্যালিকার ছেলের নামে লিখে দিতে বলেছিলে তখন তো তোমার মনে হয়নি একথা! সেখানেও তো সান্যাল দের সম্পত্তি অন্য বংশেই যাচ্ছিলো! যাইহোক, এই নিয়ে আর কোনো আলোচনা আমি তোমার সঙ্গে করতে চাই না!! জানি এরপরে আর তোমার এই বুড়ো জ্যেঠু জ্যেঠিমার খবর নেওয়ার কোনো উৎসাহ থাকবে না তবু যদি ইচ্ছে করে আমাদের দেখে যেও কখনো!

রথীন কে থামিয়ে দিয়ে কথাগুলো বলেই ফোন নামিয়ে রাখলেন প্রতাপ সান্যাল।

এখানে একটা সই করুন ম্যাডাম, নিজের নামের পাশে ব্যানার্জি লিখুন! আজ থেকে আপনি অদ্বিতীয়া ব্যানার্জি!

কনের দিকে পেন এগিয়ে দিয়ে বললেন রেজিষ্টার, টকটকে লাল রঙের বেনারসি আর চন্দনে সাজানো অদ্বিতীয়া আর ধুতি পাঞ্জাবিতে সাজা সুমনকে ঘিরে তখন কৌতুহলী নিমন্ত্রিতদের ভিড়। সদ্য সই করে ওঠা সুমনের হাত থেকে পেন নিয়ে অদ্বিতীয়া সুমনের দিকে তাকিয়ে হাসলো, নিজের নাম সই করে কাগজ ফেরত দিয়ে রেজিষ্টারের দিকে তাকিয়ে বললো,

ব্যানার্জি নই, সান্যালও নই, আজ থেকে আমি অদ্বিতীয়া, শুধুই অদ্বিতীয়া! তাই তো সুমন?

সুমন হেসে ঘাড় কাত করলো,

একদম!
সমাপ্ত