সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০১

0
2

#সেই_মেয়েটা_চন্দ্রাবতী
পর্ব ১

“কেমন নাম রাখছস মেয়ের? চন্দ্র!”

“নামে খারাপ কি আম্মা? চন্দ্র নাম সুন্দর না?”

“তোর বাপে যে তোর উপরে সবসময় বিরক্ত থাকে। এইটা আসলে এমনে এমনে না।”

“জি। এমনে এমনে না। আব্বা যা পছন্দ করেন, ছেলের মাঝে যা চান। তার কিছুই আমি হইনি। কিন্তু তার সাথে চন্দ্রের কী সম্পর্ক আম্মা? দুনিয়ায় আসছে কয়েকঘন্টা হলো।”

“চন্দ্র, সূর্য এসব কী নাম। চাঁদনি রাখ। মোসম্মৎ চাঁদনি সরকার। কত সুন্দর নাম হয়।”

“আপনি ডাকেন চাঁদনি। সমস্যা কী। ডাকনাম তো আদর করে আলাদা আলাদা হইতেই পারে আম্মা। আর নামের সাথে সরকার থাকার প্রয়োজন নাই।”

ফিরোজ সাহেব হাসেন। মায়ের সাথে তর্কে যান না। তবে মেয়ের নাম চন্দ্রই থাকে। ভালো নাম চাঁদ সুলতানা। ডাকনাম চন্দ্র।

***

শহরের উপর বনেদি দোতলা বাড়ি। বাড়ির নাম সরকার বাড়ি। ফিরোজ সরকারের বাবা রহমত সরকারের বানানো এই বাড়ি। রহমত সরকার পাকিস্তান আমলে এইচএসসি পাশ করেছিলেন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে বের হন। অত্র এলাকায় তখন ওনার মতো উচ্চশিক্ষিত কেউ ছিল না। চাকুরি জীবনে জেলা শিক্ষা অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই বাড়িটি অবসর গ্রহণের কিছুকাল আগে করেছিলেন। নিচ তলায় বৈঠকখানা আর লাইব্রেরি। এপাশ ওপাশ টানা বারান্দা। সামনে বাগান। পেছনে বড়ো একটা পুকুর। তাতে শান বাঁধানো পুকুর ঘাট। পুকুরের চারদিকে গাছ।

ফিরোজ সরকার, রহমত সরকারের একমাত্র ছেলে। তিন মেয়ের পর ফিরোজ সরকারের জন্ম। ভীষণ আদরের সন্তান হওয়ার পাশপাশি, বাবার অনেক সাধনার ধনও ছিল ফিরোজ সরকার। যদিও শিক্ষায় সেই আমলেই তিনি এ এলাকার সর্বাগ্রে ছিলেন। তবু নাড়ি পোঁতা যে মাটিতে সে মাটির আলো হাওয়ায় বেড়ে ওঠা রহমত সরকারও এই মানসিকতা থেকে মুক্ত ছিলেন না যে বংশ আগে বাড়াতে ছেলে প্রয়োজন। ছেলে না হলে সরকার বংশ তার সাথেই শেষ হয়ে যাবে। কাঙ্ক্ষিত ছেলে সন্তান হিসেবেই ফিরোজ সরকার এই পরিবারে এসেছেন। তবে ছেলে শুধু সরকার বংশের নামই পেয়েছে। বাবা দাদার রাগ, প্রতাপ কিছুই পায়নি। রহমত সরকারের ইচ্ছে ছিল ছেলে উচ্চশিক্ষা শেষে বড়ো চাকুরি করবে। ওনার চেয়েও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হবে। কিন্তু ফিরোজ সরকারের মাঝে সে-ধরনের কোনো আগ্রহ দেখা যায়নি। ভালো ছাত্র ছিলেন। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ভালো ফলাফলও করেছিলেন। কিন্তু স্নাতক স্নাতকোত্তর বিষয়ের জন্য বেছে নিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। মূলত এখান থেকে বাবা ছেলের দ্বন্দ্ব শুরু। সবসময় বাবার কথা মেনে নেওয়া নরম সরম ফিরোজ সরকারের তখন থেকেই বাবার ইচ্ছের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো শুরু।

বেয়াদবি না করেও তিনি নিজের সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার পর এই শহরেরই সরকারি কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। বাবার তীব্র অনিচ্ছা, বিরক্তি, রোষানল, কিছুই তাকে বিচলিত করতে পারেনি। স্মিত হেসে তাই করেছেন, যা করতে চেয়েছেন। রহমত সরকার নিজের মেয়েদের প্রতি অতটা অনুরক্ত না থাকলেও ফিরোজ সরকার ব্যতিক্রম। দুই কন্যা চন্দ্র আর মৃদুলা তার ভীষণ আদরের। ছেলের কোনো আকাঙ্খা না তার নিজের ছিল, না সামাজিক চাপে স্ত্রীকে পড়তে দিয়েছেন।

***

চন্দ্র অনেকক্ষণ ধরেই দোলনা লাগানোর চেষ্টা করছে। ধনু ভাইকে ধরে এনেছে দোলনা লাগাতে। ফিরোজ সরকার একা পারছেন না। পুকুর পাড়ে পাশাপাশি থাকা দুটো আমগাছে আড়াআড়ি বাঁশ বসানো হয়েছে। তার সাথে দোলনা লাগানো হবে। চওড়া লোহার পাতের সাথে শেকল ঝালাই করে লাগানো। দড়ি ছিঁড়ে যেতে পারে বলে এই ব্যবস্থা। এই দোলনা চন্দ্রের ইচ্ছায় লাগানো হয়েছে। পুকুরের পানিতে পা ভেজাতে ভেজাতে দোলনা চড়বে এমন অদ্ভুত শখ চন্দ্র ছাড়া কারও থাকতে পারে না।

নাহার সুলতানা ছাদ থেকে ছেলের এসব কান্ড কারখানা দেখছেন। এত বড়ো মেয়েকে নিয়ে ছেলের এই আহ্লাদ দেখলে ওনার কেন জানি ভালো লাগে না। এই যেমন এখনও। বিরক্তিতে মুখের ভেতরটা তেতো লাগছে।

“জুলেখা, ও জুলেখা। জবাব দাও না ক্যান?”

জুয়েনার এখন আর রাগ লাগে না। আগে শাশুড়ি জুয়েনা না ডেকে জুলেখা ডাকলে খুব বিরক্ত লাগতো। ফিরোজও অনেকদিন বলেছে, জুলেখা না জুয়েনা বলতে। কিন্তু নাহার সুলতানার কথা এসব খটমটে নাম তিনি ডাকতে পারেন না। যেমন চন্দ্রকে তিনি চাঁদনিই বলবেন। অথচ মৃদুলাকে ঠিকই তিনি মৃদুলা ডাকেন।

“কী বলেন আম্মা?”

“চা কী বানাও, মুখে দিতে পারি না। তিতা, কষ।”

জুয়েনা নিচে তাকিয়ে বোঝে শাশুড়ির বিতৃষ্ণা লাগার কারণ।

“চিনি দেব?”

“চিনির রোগীরে চিনি দিতে চাও? মারার বুদ্ধি ভালা। এমনে সুগার কমে না।”

জুয়েনা প্লেটের দিকে তাকায়। মাত্রই শাশুড়ি নিমকি মিষ্টি খেয়েছেন। চায়ের চিনির সময়ই ডায়াবেটিস এর কথা মনে পড়ে।

“চিনি ছাড়া দুধ চা তো তিতাই লাগে আম্মা। রঙ চা খেতে পারেন। ডায়াবেটিস এর চিন্তা করলে মিষ্টি খান কেন? এজন্য সুগার কমে না।”

“হইছে, তোমার আর বুদ্ধি দেওয়া লাগবো না। দুই পাতা পইড়া সব বুঝ ভাব নাও। কলেজ পাশ দিছ। ডাক্তারি না। এইটা মিষ্টি ছাড়া সন্দেশ আছিল। আমার মাইয়া পাঠাইছে। তোমরা পারলে চিনি খাওয়াইয়া মারবা।”

জুয়েনা উত্তর দেয় না। একমাত্র ছেলের বৌ হিসেবে এ বাড়িতে তার অবস্থান আদরের হওয়ার কথা। না নাহার সুলতানা তার সাথে এমন ব্যবহার করেন যেন জুয়েনা উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ। মাঝামাঝে মনে হয় রহমত সরকার তাকে পছন্দ করে ছেলের বৌ করায় নাহার সুলতানা ওনাকে অপছন্দ করেন।

তোমার শ্বশুর কই?”

“লাইব্রেরিতে।”

“আরেক বিদ্যার জাহাজ। বাড়ি ভর্তি সব জাহাজ। আমি একাই মুখ্য সুখ্য।

“আম্মা, আপনার নাস্তা করা হলে আব্বা নিচে যেতে বলেছেন। কী দরকারি কথা আছে।”

“যাই। কর্তা ডাকছে যখন বান্দী তো হাজির হইতেই হইব। আইচ্ছা তুমি এত শুদ্ধ কথা না কইলে হয় না? এত শুদ্ধ কথা শুনলে আমার গাল ব্যথা করে।”

“শুদ্ধ কথা তো নতুন বলি না আম্মা। সাতাশ বছর ধরেই বলি। এতদিনে যখন গাল ভালো আছে। সামনেও থাকবে।”

ছেলের বৌয়ের জবাবে নাহার সুলতানার রাগ হয়।

“তোমার এই গালের দোষে মাইয়া কান্ধে বইয়া রইছে। মার গুণে মাইয়া বিয়া হয়। দুইদিন পর চাঁদনির বয়স সাতাশ হইব। কদিন বাদে যতই খুকি সাজার নাটক করুক খুকি আর লাগব না।”

জুয়েনা আর দাঁড়ায় না। শাশুড়ির সাথে কিছুক্ষণ কথা বললেই তার মেজাজ খারাপ হয়। চারদিকে ক্রমবর্ধমান শহুরে জীবন আর উঁচু দালানের ভীড়ে এই গাছপালা ঘেরা বাড়িটা শহরের বুকে এখন যতটা চমকপ্রদ, এই বাড়ির মানুষগুলো ততটাই অদ্ভুত। একই ছাদের নিচে বছরের পর বছর থেকেও যেন তারা বন্ধনহীন। গাছের ছায়ার মতো অন্ধকার রহস্যে ঘেরা শুধু আঙিনা না। সবার মনও।

(চলবে)