সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১০
মাহতাব কাজ শুরু করেছে। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ের অফিসটা ছোটো। এখানে আছে একজন অফিস সহকারী, আর একজন পিয়ন। মাহতাব অফিসের দায়িত্বে আছে। উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কাজ তদারকি করে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। শুরুতে কাজ বুঝতেই কয়েকদিন লেগে গিয়েছে। মাহতাব আগাগোড়া শহরের ছেলে। কৃষিকাজ নিয়ে তার কোনো ধারণাই ছিল না। সরকারি চাকরির পরীক্ষা না দিলে হয়তো দেশ নিয়ে, দেশের অবকাঠামো, সংবিধান এমনকি খাদ্যশস্য নিয়ে এইটুকুও জানা হতো না।
কৃষিপণ্য নিয়ে পরিষ্কার ধারনা তো দূর, মাহতাব তো এটাও জানতো না কখন কোন ধান চাষ হয়, কী কী কৃষি পণ্য বাংলাদেশ উৎপাদন করে, আর কী আমদানি করতে হয়। পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতেই এসব বিষয়ে টুকটাক পড়ালেখা করতে হয়েছে।
আগে অন্যদের মতো মাহাতাবও ভাবতো বিসিএস বা যেকোনো সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় এসব পড়ার প্রয়োজন কী? বন্ধুদের সাথে অনেক সময় এ নিয়ে মজাও করেছে। কিন্তু এখন কিছুটা হলেও তার ধারণা হয়েছে। দেশের কাজ করতে হলে আগে দেশ সম্পর্কে জানতে হবে। পাশাপাশি প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে প্রশাসনিক আইন, দেশের সরকার কাঠামো, প্রতিবেশী দেশ থেকে শুরু করে উন্নত দেশের সরকার কাঠামো, কৃষিকাজ সবকিছু সম্পর্কেই ধারণা থাকা প্রয়োজন। জিও পলিটিক্স সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। বিভিন্ন দেশের মুদ্রার নাম, রাজধানীর নাম এগুলোও জানা কিন্তু অপ্রয়োজনীয় নয়। কর্মক্ষেত্রের কাজ করতে গেলে দেখা যায় কোনো না কোনোভাবে প্রশাসনিক কাঠামোতে সবধরনের জ্ঞানের প্রয়োজন হয়েই যায়। না হলে মাহতাবের মতো যার নিজের দেশেরই গ্রাম সম্পর্কে কোন ধারণা নেই সে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের পদ সামলাতে পারতো না। চার মাসের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং যখন শেষ করেছে তখন মনে হয়েছিল সে সবই বুঝে ফেলেছে। কিন্তু এখন সরাসরি কর্মক্ষেত্র এসে দেখেছে হাতে-কলমে শেখার ক্ষেত্রটা পুরোই আলাদা।
এখন শীতকাল। আমন ধান সংগ্রহ করার সময়। সম্প্রতি খাদ্য নিয়ন্ত্রক কার্যালয় কৃষকের অ্যাপ উদ্বোধন করেছে। এবার সরকারি ভাবে অ্যাপের মাধ্যমে কৃষকের কাছ থেকে আমন ধান সংগ্রহ করা হবে। প্রতি মন ধানের দাম ধরা হয়েছে তেরোশো বিশ টাকা। কৃষক যেন ন্যায্য মূল্যেই আমন ধান বিক্রি করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে শুরুতেই। মাহতাবের মনে হয়েছিল এ আর এমন কী। এপসের মাধ্যমে ধান সংগ্রহ করবে, তা সরকারি গুদামে মজুদ করবে। আর সময় মতো সেই ধান থেকে চাল করে বন্টন করে দেয়া হবে। ব্যস বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কিন্তু হাতে-কলমে কাজ করতে এসে দেখেছে বিষয়টা মোটেও এমন নয়। অনেক কৃষকই দাদনের টাকা নিয়ে চাষ করে থাকে। সে ক্ষেত্রে উৎপাদিত ধানের মালিক আর কৃষক থাকে না। ফলে দাদনের টাকা দেওয়া লোকেরা তাদের ইচ্ছামত দামে ধান নিয়ে যায়। যেখানে মূলত লাভবান হচ্ছে দাদনের টাকা দেওয়া লোক এবং ব্যবসায়ীরা। কৃষক না ধান বিক্রি করার অধিকার পাচ্ছে, না প্রাপ্য অর্থ পাচ্ছে।
পুরো বাজারটাই এলাকার স্থানীয় নেতা এবং প্রভাবশালী লোকেরা নিয়ন্ত্রণ করে। ধান ক্ষেত থেকে সরাসরি তাদের গুদামে চলে যাচ্ছে। বেশি দাম দিয়েও সরকারি গুদামে পর্যাপ্ত ধান আনা যাচ্ছে না। এমনটা হলে সময়মতো ন্যায্য মূল্যে চাল পৌঁছানো যাবে না।
মাহতাব অফিস সহকারী সহায়তাও খুব একটা পাচ্ছে না। এ সহকারী এখানে প্রায় বছর ধরে কাজ করে। এ পদের লোকদের সহজে বদলে হয় না। একই এলাকায় দীর্ঘদিন থাকায়, তারাও লোকালের মতো হয়ে যায়। তিনি মাহতাবের বাবার বয়সী প্রায়। মাহতাবের মতো বাচ্চা ছেলেকে তিনি গুরুত্বই দিচ্ছেন না। যদিও মুখে স্যার স্যার বলেন, কিন্তু আচরণে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিচ্ছেন এখানে মাহাতাবের কাজ শুধু চেয়ারে বসে থাকা। বাকিটা তিনিই দেখে নিবেন।
মাহতাব আগে ভিলেজ পলিটিক্স এর কথা অনেক শুনেছে। তখন এগুলোকে কোনো বিষয় মনে হয়নি। কিন্তু এক মাস হওয়ার আগেই মাহতাব বুঝে ফেলেছে ভিলেজ পলিটিক্স মোটেই সহজ জিনিস নয়।
***
আজ জুয়েনার সহকারী খালা কাজে আসেনি। জুয়েনা একাই রান্নাঘরে কাজ করছে। মৃদুলার পরীক্ষা শুরু হয়েছে। ফিরোজ সাহেবেরও কলেজে পরীক্ষা শুরু হয়ে গিয়েছে। সবাই সকালেই বের হয়ে গিয়েছে তাই। ধনুকে মাহতাবের নাস্তা নিয়ে যেতে বলেছিল জুয়েনা। ধনু উঠোনে কাজ করছে বলে মাহতাবের নাস্তা নিয়ে চন্দ্রাই উপরে উঠে আসে। মাহতাব অফিসের জন্য রেডি হচ্ছে। চন্দ্রার স্কুলের পরীক্ষা শেষ। আজ টুকটাক অফিসিয়াল কাজ আছে। আজ সেসব শেষ করে পরীক্ষার খাতা বাসায় নিয়ে আসবে। আপাততঃ ছুটি চন্দ্রার। ছুটিতে পরীক্ষার খাতা দেখে শেষ করবে। আজ শেষ কর্মদিবস বলে শাড়ি পরেছে চন্দ্রা। কালো গলাবন্ধ সুয়েটারকেই ব্লাউজের মতো পরে হলুদ রঙের তাঁতের শাড়ি পরেছে। চন্দ্রার পরনে কালো, হলুদ এসব রঙ চন্দ্রার দাদির অপছন্দ। ইদানীং চন্দ্রা এসব রঙই ঘুরেফিরে পরে। ইচ্ছে করে যেন নাহার বেগমের বিরক্তি উস্কে দেওয়া।
মাহতাবের দরজায় নক করে ভেতরে আসে চন্দ্রা
“একি অবস্থা রুমের?”
মাহতাবের রুমে ঢুকেই চন্দ্রা অবাক হয়ে যায়। এদিক সেদিক কাপড় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টেবিল এলোমেলো। ব্যাগ হাট করে খুলে রাখা।
হঠাৎ চন্দ্রাকে রুমে দেখে মাহাতাবও চারপাশে চোখ বুলিয়ে বিব্রত হয়ে যায়।
“আরে আপনি যে। সরি একটু কাজের চাপ যাচ্ছে তো। রুমটা গোছানো হয়নি।”
“রুম গোছানো না হওয়া এক বিষয়। আর এমন ভয়ংকর এলোমেলো থাকা আরেক বিষয়।”
“স্যরি।”
“আমাকে স্যরি বলার কিছু নেই। একটা কথা বলব?”
“জি।”
“আমার মাঝে মাঝে মনে হয় তুমি ভীষণ আহ্লাদে বড় হওয়া ছেলে। তোমার কোন রকম কাজ করার অভ্যাস নেই। মানে মধ্যবিত্ত ছেলেরা কিছুটা হলেও ঘরের কাজকর্ম শিখে যায়। অন্তত চলার মত কাজ পারে। যদি না তার অনেকগুলো বোন থাকে। অনেক বোন থাকলে একমাত্র ভাইকে তেমন কাজ করা লাগে না। আচ্ছা অবাক বিষয়। তোমার পরিবার নিয়ে কখনো কিছু জানাই হলো না। আসলে ওভাবে তো কথা বলার সুযোগই হয় না। পরিবারে কে কে আছে তোমার?”
“দাদা আছেন। মা আছেন।”
“আর? ভাই বোন নেই? বাবার কথা বললে না? তিনি কি…?”
“চন্দ্রা, আপনি দুটো মিনিট সময় দিন। আমি রুমটা একটু গুছিয়ে নিয়ে আপনাকে বসতে দেই। খুব এলোমেলো হয়ে আছে।”
“সমস্যা নেই। বসব না। আমাকেও স্কুলে যেতে হবে। তুমিও তো অফিসে যাবে। নাস্তা করে নাও। চা বাইরে খেও। আজ মা একা কাজ করছেন। চা বানানো হয়নি।”
মাহতাব পরিবারে কথাই এড়িয়ে যেতে চাইছে বুঝতে পারে চন্দ্রা। বের হতে গিয়ে আবার দাঁড়ায়।
“আচ্ছা শোনো, খেয়াল করেছি তোমার কাপড়চোপড় খুব ময়লা হয়। হয় তোমার ধোয়া হয় না। না হলে তুমি ধুচ্ছ না।”
“আমার আসলে কাপড় ধোয়ার অভ্যাস নেই।”
“হুম। আমি বললে মা রাগ করতে পারেন। কারণ আমি যাই বলি, মায়ের রাগ হয়। তাই বাবাকে বলতে পারি যে তুমি আলাদাভাবে টাকা দিবে। আমাদের কাজ শেষে ধনু ভাই অথবা খালা যেন তোমার কাপড় চোপড় ধুয়ে দিয়ে যান। এক হাজার দিলেই চলবে। তোমার রুম পরিষ্কার করে কাপড় ধুয়ে দিবে।”
“তাহলে তো খুবই ভালো হয়।”
“দেখ আবার, সমস্যা হবে না তো? আর্থিক চাপ পড়লে থাক।”
“না না। লোক পেলে আমারই ভালো। আমি এমনিও ধনু ভাইকে বখশিশ দিয়ে টুকটাক কাজ করাই।”
***
চন্দ্রা মাথায় চাদর দিয়ে ঘোমটা দিয়েছে। হাঁটছে অনেকক্ষণ হলো। এখন গরম লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে দীঘি পেরিয়ে চলে এসেছে। বাসার বাইরে আজ রিকশা ছিল না। মনে হচ্ছে মেইনরোডে না উঠলে রিকশা পাবে না।
হঠাৎ পেছন থেকে রিকশার বেলের শব্দ শুনতে পায়। মাহতাব আসছে রিকশায়। চন্দ্রার কাছে এসেই রিকশা থামে।
“আপনি এই রিকশায় চলে যান। আমি অন্য আরেকটা নিচ্ছি।”
“তোমারও তো অফিসের দেরি হবে।”
“সমস্যা নেই। আমার অফিসে আমিই বস। বকা খাব না। আমি অফিসে না গেলে অফিস সহকারী বরং খুশি। সে চায় আমি ঘুরেফিরে বেড়াই। কাজ না করি।”
মাহতাব নামার আগেই চন্দ্রা রিকশায় উঠে বসে।
“বসের অফিস ফাঁকি দেওয়া উচিত নয়। চলো একসাথেই গেলাম। তোমার অফিস আগে পড়বে। তুমি নেমে গেলে আমি ওনার রিকশায় স্কুলে চলে যাব। যাবেন না ভাই?”
“যে যামু আফা।”
রিকশা টান দেয়। চাদর খুলে বসে চন্দ্রা। বেনী করা লম্বা চুলের খোলা অংশগুলো বাতাসের সাথে মুখে এসে এসে পড়ে। চন্দ্রা চুলগুলো মুখে এসে পড়তে দেয়, কানের পেছনে সরিয়ে দেয় না।
(চলবে)