সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-১৩+১৪

0
7

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১৩

অদ্ভুত হলেও মাহতাবের এখানে কাজ করতে এখন ভালো লাগছে। মিসেস শেলী আবেদীন নিশ্চিত ছিলেন ছেলে মফস্বলে থাকতে পারবে না। শহরে বড়ো হওয়া, আরাম আয়েশে থাকা ছেলের জন্য এটা সহজ না৷ বিশেষ করে যখন ঘরে অভাব নেই। শুধু জিদ থেকে যে ছেলে এতদূর যাবে কখনো ভাবেননি।

শেলী আবেদীন, উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তার ছোটো মেয়ে। বাবা মায়ের শেষ বয়সের সন্তান বলে যেমন আদর পেয়েছেন, তেমন অহংকারও হয়েছে। যা তিনি অহংকার বলতে নারাজ, বরং নিজের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব বলতেই তিনি পছন্দ করেন। নিজের চারদিকে সবসময় এতটাই সেই ব্যক্তিত্বের দেয়াল তুলে রেখেছেন যে তা ভাঙতে কেবল ওয়াজিউল্লাহ সাহেবই ব্যর্থ হননি, ব্যর্থ হয়েছে শেলীর সন্তানও। মায়ের সাথে মাহতাবের কথাবার্তায় আহ্লাদের চেয়ে তাই মাপা ভাবটাই বেশি থাকে। তাই শেলী আবেদীন যখন জানতে চান,

“কবে ফিরছ তুমি?”

“ছুটিতে কবে আসব? আপাততঃ না। কাজের চাপ যাচ্ছে।”

“এসব পোস্টে সবাই নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়।”

“হয়তো ঘুমাতো। এখন ঘুমায় না।”

কৃষকদের এপসের মাধ্যমে ধান সংগ্রহের বিষয়টা হাতে-কলমে বোঝানোর জন্য মাহতাব একটা কর্মশালার আয়োজন করেছে। বুদ্ধিটা চন্দ্র দিয়েছে। আর সাহায্য করেছেন ফিরোজ সরকার। মাহতাবই সাহায্য চেয়েছিল। ফিরোজ সরকার খুশি মনে পাশে থেকেছেন। যদিও মাহতাবের অফিস সহকারী বিষয়টা একদম খুশি মনে নেয়নি। কিন্তু মাহতাব বোঝাতে চায় এখানে সেই বস। সহকারী বিশ বছর চাকুরি করুক, আর মাতহাব বিশ দিন। দিনশেষে এখানে মাহতাবের নির্দেশ চলবে। না হলে সহকারীই তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে।

“তুমি যা চাইছিলে হয়েছে। একমাস করেও ফেলেছ। এ জায়গা তোমার জন্য নয়। আমি তোমাকে জাপানে পিএইচডির জন্য এপ্লাই করতে বলেছিলাম। তোমার মামা রেকমেন্ড করে দিলে সহজেই তোমার সিলেকশন হবে।”

“মামা রেকমেন্ড না করলেও হবে। I am capable enough.”

শেলী আবেদীন চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ।

“মাহতাব, জেদ ছেড়ে ভবিষ্যত দেখ। তোমার ভবিষ্যত গ্রামে গঞ্জে কাঁদামাটিতে ঘোরা না। সুন্দর ফিউচার অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”

“আমি ভালো আছি। কাঁদা মাটি আমার ভালো লাগছে। রাখি আম্মু।”

ফোন রেখে স্মৃতিতে ফিরে যায় মাহতাব। সেই ছোট্ট বয়সের স্মৃতি, যখন নানা বাসার দাওয়াতগুলোয় বাবা যেত না। আর গোল টেবিল বৈঠকে বসে সবাই বাবার সমালোচনা করতো। ছোট্ট মাহতাব কিছুই বুঝতো না, কিন্তু তার রাগ হতো। শুধু বাবার সমালোচনা শুনতে চাইতো না বলেই একসময় মামার বাসা, খালার বাসা কোথাও যেতে চাইতো না। কারণ কিভাবে কিভাবে যেন মাহতাবের দাদার বাড়ির কথা উঠতোই, আর তারা কতটা আনকালচার্ড, কতটা মিসম্যাচড তাদের সাথে, কতটা ভুল হয়েছে শেলী আবেদীনের ঐ পরিবারে বিয়ে দেওয়া তাই নিয়ে কথা উঠতো। মাহতাবের ব্যবসায়ী বাবা যথেষ্ট অর্থের যোগান দিতেন। যা শেলী আবেদীনকে বিয়ের পরও স্বচ্ছল একটা জীবন দিয়েছে। মাহতাব বুঝতেই পারতো না সমস্যা কোথায়। বাবা মায়ের বিয়েই বা হলো কেন?

এক সময় জানতে পারে মাকে কোন একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে দেখে তার দাদার খুব পছন্দ হয়েছিল। নিজের একমাত্র ছেলের জন্য পছন্দ করেই শেলী আবেদনের পিতা কাছে তিনি বিয়ের প্রস্তাব পাঠান। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা মাহতাবের নানা তখন অবসরে গিয়েছেন। দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতায় ভুগছেন। পেনশনের টাকাটাই সম্বল। বড়ো ছেলেমেয়েদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। জমাকৃত টাকার অনেকটাই বাড়ি বানাতে খরচ হয়ে গিয়েছে। ছেলেমেয়েরাও নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। শেলী যতই আদরের মেয়ে হোক তিনি বুঝতে পারছিলেন তিনি জীবিত থাকতে মেয়ের বিয়ে না দিয়ে গেলে এই একসময় আদরের ভাইবোনেরা তাকে বোঝা মনে করবে। কেননা তিনি বেশ কিছুদিন ধরে শেলীর বিয়ের জন্য পাত্র খুঁজছিলেন কিন্তু কাউকেই খুব একটা গা করতে দেখেননি। শেলীর বিবাহিত বোনদের তো নয়ই এমনকি ভাইদেরও কোনো মাথা ঘামাতে দেখেননি। তাই অনেকটা নিজ উদ্যোগেই ওয়াহিদ সাহেবের ছেলের সাথে কথাবার্তা চালান। শেলীর ইচ্ছে ছিল দুলাভাই এবং নিজের ভাইদের মতোই উচ্চশিক্ষিত, উচ্চপদস্থ, শিল্প সংস্কৃতি প্রেমী কারও সাথে বিয়ে হোক। ব্যবসায়ী পাত্র শুনেই বিয়ে না করার গোঁ ধরে। কিন্তু বাবার ইচ্ছের কাছে নত হতেই হয়। বিয়ে হলেও মাহতাবের ধারণা তার মা কখনোই ওয়াজিউল্লাহ সাহেবের সাথে মানাতে পারেননি। ওনার পোশাক থেকে, কথা বলা, খাবার ধরণ সবকিছুই হয়তো মায়ের অপছন্দ ছিল। মা আর বাবার ব্যক্তিত্ব যে একদম আলাদা। বাবা মায়ের মাঝে সম্পর্কের উষ্ণতার অভাব, মাহতাবের জীবনটাকেও শীতল করে দিয়েছিল।

আনন্দ খুঁজে নিয়েছিল মাহতাব অন্য জায়গায়। প্রচুর বন্ধুবান্ধব করেছিল। টাকা পয়সার সমস্যা তো কখনোই ছিল না। টাকা খরচ করেছে তাদের পেছনে। যতটুকু সম্ভব পারিবারিক মহল থেকে দূরে থেকেছে। পরিবার বলতে সবসময় দাদার ঘনিষ্ট ছিল। দাদার কাছেই জানার চেষ্টা করেছে মা বাবার ভেতরকারই দূরত্ব কেন বেড়েছে? কিন্তু দাদার কাছেও কোন স্পষ্ট উত্তর ছিল না। তারপর আসে সেই কালো দিন যেদিন মাহাতাবের বাবা হুট করে ঘুমের ভেতর মারা যান। মাহতাবের বয়স তখন তেইশ। মাত্র দু’বছর আগের ঘটনা। বাবা আর মায়ের মাঝে দূরত্ব থাকার পরও বাবা মা দু’জনই বেঁচে আছে এই অনুভূতিটা ওর জন্য যথেষ্ট ছিল। ঘরে ফেরার টান না থাকলেও ঘরে ফেরার কারণ ছিল। বাবার মৃত্যুর পর মায়ের সাথেও বন্ধনটা কেমন জানি আরও হালকা হয়ে গেল। কেন জানি বাবার হঠাৎ মৃত্যুর পেছনে মাকে অবচেতন মনে দায়ী ভাবতো। মায়ের অবহেলায় হয়তো বাবা এতটা একাকী আর অসুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। না চাইলেও মাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে মনে মনে বারবার পক্ষে বিপক্ষে যুক্তি তর্ক করে মাহতাব। তাই শেলীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে মাহতাব ছন্নছাড়া জীবন শুরু করে। হুট করে ছয়মাসের কোর্স ড্রপ দেয়। নিজের মানসিক অস্থিরতার সেই সময়গুলো মাহতাব কাউকেই পাশে পায়নি। না বড়ো বোন মেহেরকে, না পারিজাতকে।

পারিজাত, মাহতাবের মামাতো বোন। সমবয়সী বন্ধু, কাজিনের পরিচয় ছাপিয়ে যে একসময় হৃদয়ের খুব কাছাকাছি এসে যায়। বাবার মৃত্যুর পর যে পারিজাতের মাহতাবকে বোঝা উচিত ছিল। সেও মাহতাবের আচরণকে খামখেয়ালি নাম দেয়। মামা তো স্পষ্ট বলে দেন, বলার মতো কোনো পরিচয় সৃষ্টি করতে না পারলে শুধু পারিবারিক টাকা পয়সা, ব্যাংক ব্যালেন্স দেখে মেয়ের বিয়ে দেবেন না। বোনের মতো মেয়ের জীবনও শেষ করতে চান না। দরকার হলে তিনি মাহতাবকে বাইরে পাঠাবেন। অথচ মাহতাব কারও সাহায্য ছাড়াই দাঁড়াতে চায়। নিজেকে প্রমাণ করতে চায়। পারিবারিক টাকায় হাত না দিয়ে তা সম্ভব না বলেই চাকরি করার কঠিন পথটাই বেছে নেয়।

আর বোন মেহের তো সবসময় মা ঘেঁষা। বাবার সাথে মেহেরের দূরত্বের কারণ কী মা কিনা মাহতাব জানে না। তবে বাবা মেয়ের নির্মল ভালোবাসার ছবি মাহতাবের স্মৃতিতে আসে না। আসে শুধু বোনের বাবাকে এড়িয়ে যাওয়া। মেহের মাহতাবের চাইতে আট বছরের বড়ো। মাহতাবের বয়স যখন বারো, তখন মেহের উচ্চশিক্ষার জন্য অস্ট্রেলিয়া চলে যায়। এতে শেলীর পূর্ণ সমর্থন ছিল। মেহের বাইরে গিয়ে আর ফিরে আসার ইচ্ছে রাখে না। শেলীই গিয়ে মেয়েকে দেখে আসতেন। বয়ঃসন্ধি কাল হতেই বোনের সাথে তীব্র অভিমান মাহতাবের। কেন তার পাশে রইলো না। কেন এই নিঃসঙ্গ মহলে তাকে ফেলে গেল? এরপর মেহের বহুবার মাহতাবকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু মাহতাব বোনের কাছে যায়নি।

***

“দুঃখ ভাগ করতে হয়। একদিন কে জানি বলেছিল।”

মাহতাব টেরও পায়নি কখন চন্দ্রা এসে পেছনে দাঁড়িয়েছে। দ্রুত নিজেকে সামলে নেয় মাহতাব।

“সন্ধ্যে নেমে গেল! টেরও পাইনি। এই সময়টাই খারাপ। অযথা মন উদাস হয়।”

চন্দ্র দড়ির শুকনো কাপড়গুলো তুলতে তুলতে বলে,

“এখানে একটা পদ্মপুকুর আছে। শাপলাও হয়। শীতের শাপলা দেখতে দেখতে নৌকা ভ্রমণ করা যায়। আমার খুব শখ যাওয়ার। একা ভয় লাগে। মৃদুলা সাথে যাবে না।”

“আমাকে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছেন?”

“যদি নিজের কথাগুলো বলতে ইচ্ছে হয়, যদি আমার গল্পগুলো শুনতে ইচ্ছে হয়। তবে…”

চন্দ্রা আর কিছু না বলে কাপড় নিয়ে নিচে নেমে যায়।

(চলবে)

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১৪

চন্দ্রার ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছে। ঈদের পরপরই এসএসসি পরীক্ষা। প্রাথমিক, নিম্ন মাধ্যমিকের ক্লাস বন্ধ থাকলেও এসএসসি পরীক্ষার্থীদের টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে। চন্দ্রা দেখে প্রি টেস্ট থেকে টেস্টে আসতে আসতে এগারোজন ছাত্রী ঝরে গিয়েছে। এরা অকৃতকার্য হয়েছে প্রি-টেস্টে তা নয়। এরা আর পড়বে না।
সাধারণত ওরা মোটামুটি সবাইকে এখন পরীক্ষায় বসতে দেয়। কেননা এখন এসএসসি, এইচএসসিতে ফেলের সংখ্যা কম রাখা হয়। তুলনামূলক পাশ করে বেশি। কেউ এক দু বিষয়ে ফেল করলে পুরো পরীক্ষা আবার দেওয়া লাগে না। শুধু সেই বিষয়ে পরীক্ষায় বসলেই হয়। তাছাড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের যতটা সম্ভব কম আটকায়। কারণ এরা পরীক্ষায় বসতে না পারলে পরের বছর হয়তো আর পরীক্ষাই দিবে না। চন্দ্রা ক্লাসে চোখ বুলিয়ে একটা মেয়ের সন্ধান করে।

“সালমা সুলতানার কথা কেউ জানো? ক্লাসে আসে না কেন?”

“ম্যাডাম, ওর বিয়া ঠিক হইছে।”

“কী বলো? কবে?”

“এই শুক্কুরবার। জামাই ব্যবসা করে। হোন্ডা আছে।”

পটপট করে সব তথ্য দিয়ে যাওয়া মেয়েটার নাম তন্বী। পড়ালেখায় অতটা ভালো না হলেও আর সব বিষয়ে দারুণ চটপটে। সবার হাঁড়ির খবর তার জানা। চন্দ্রার মনটা খারাপ হয়। সালমার পরিবার ছিন্নমূল নয়। বাবা প্রবাসী। তিন ভাইয়ের এক বোন। এত তাড়াহুড়ো কী ছিল বিয়ের! মেয়েটা ছাত্রী ভালো। জিপিএ ফাইভ না হোক, ভালো একটা গ্রেড ঠিকই পেত। বিয়ে হলে না হয় হলো, পরীক্ষাটা দিতে দিলেই তো হয়। ক্লাস শেষে চন্দ্রা বের হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে একটা ছেলে এসে পথ আগলে দাঁড়ায়। ছেলেটার নাম রবি। বয়েজ সেকশনের।

“কিছু বলবা?”

“ম্যাডাম, আপনের জন্য। সালমা দিছে।”

ছেলেটা একটা চিঠি তুলে দেয় চন্দ্রাকে। চিঠি দিয়েই দৌড়। চন্দ্রা কৌতূহলে সেখানেই দাঁড়িয়ে চিঠি পড়তে শুরু করে। মেয়েটা ঠিক ব্যাকরণ বইয়ের নিয়ম অনুযায়ীই চিঠি লিখেছে।

“তারিখ
বরাবর,
চন্দ্রা ম্যাডাম।
বাংলা বাজার উচ্চবিদ্যালয়।
বিষয়ঃ সাহায্য চাহিয়া আবেদন।

ম্যাডাম,
শুরুতেই আমার সালাম নিবেন। আমি সালমা সুলতানা, রোল তিন, দশম শ্রেণি (এসএসসি পরীক্ষার্থী)। ম্যাডাম আসন্ন এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা আমার আজীবনের স্বপ্ন। আমি পড়ালেখা করে আপনার মতো একজন শিক্ষক হতে চাই। সেই লক্ষ্যে পড়ালেখা করিতেছি। কিন্তু আমার বাবা ও ভাই তাহা চায় না। তাহারা চান আমার বিবাহ দিয়ে দিতে। পাত্র আমার চাইতে বয়সে অনেক বড়ো, এবং খারাপ লোক। কিন্তু লোকাল নেতা। তাই বাবা তাহার সাথে বিবাহ দিতে চান। আমার জন্ম নিবন্ধনের কাগজখানা পাঠাইলাম চিঠির সাথে। শুনেছি শিক্ষক চাইলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করিতে পারেন। নিবন্ধন অনুসারে আমার বয়স আঠারো হয় নাই। আমি যেন কারও সাহায্য না নিতে পারি, তাই আমারে মোবাইলে কথা কইতে দেয় না।

অতএব আপনার নিকট আকুল আবেদন যে শুক্রবার আপনি আমাদের বাড়িতে লোকজন নিয়ে এসে বিবাহ আটকাবেন। এবং আমাকে এই বিপদ হইতে উদ্ধার করবেন।

বিনীত অনুরোধ,
সালমা সুলতানা
রোল তিন, দশম শ্রেণি।”

চন্দ্রার ইচ্ছা করছে একটা লাল কালি কলম নিয়ে চিঠির ভুলগুলো দাগিয়ে মেয়েটার কাছে আবার ফেরত পাঠাতে। পরীক্ষা দিতে চায়, শিক্ষক হতে চায়। অথচ একটা চিঠি লিখতে এত ভুল। সাধু চলিত জগাখিচুরি তো আছেই, শুদ্ধ আর কথিত ভাষার মিশ্রণও আছে। কিন্তু এখন এসব ভাবার সময় না। সত্যি মেয়েটা বিয়ে না করতে চাইলে আটকাতে হবে। পড়ালেখা শেখার সুযোগ পেলে ভুলও ঠিক করে নিতে পারবে। হয়তো আসলেই পড়ার ইচ্ছে আছে, পরিবার সহনশীল না হলে কী করে হয়।

***

“ম্যাডাম আসি?”

চন্দ্রা তন্বীকে অফিস রুমে দেখে অবাক হয়। স্কুল ছুটি। অফিসরুম মোটামুটি খালি হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রাও বের হবে।

“হ্যাঁ। কিছু বলবা?”

“ম্যাডাম, রবি আপনেরে একটা চিঠি দিছে দেখছি। সালমার চিঠি আপা?”

চন্দ্রা সতর্ক হয়ে যায়। চিঠির বিষয়ে কিছু জানাজানি হোক তা চায় না। প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করেছিল চন্দ্রা। তিনি চন্দ্রাকে এসবে না জড়াতে পরামর্শ দিয়ে চিঠির বিষয়টা চেপে যেতে বলেন।

“কিসের চিঠি? আর তুমি লেখাপড়া বাদ দিয়ে মানুষের পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াও? পাড়ার চাচীআম্মা হইছো? সামনে পরীক্ষা। নিজের লেখাপড়ায় মন দাও। যাও।”

“না ম্যাডাম।, মানে পানি খাইতে নামছিলাম। তখন দেখলাম রুবেল আপনের কাছে আইসা কী দিলো। রবি কিন্তু সালমারে লাইক করে ম্যাডাম। ওগো লাইন আছে…”

চন্দ্রা তন্বীকে থামিয়ে দিয়ে বাসায় যেতে বলে। প্রধান শিক্ষক রুহুল আমীন স্যার ঠিকই বলেছেন। এরা নাইন টেনে পড়লেও মননে এখন আর বাচ্চা নেই। প্রযুক্তি, ফেস*বুক, অনলাইনের কারসাজিতে একেকজন পেকে গিয়েছে একদম। নাইন টেনের ছেলেমেয়ে, তারা নাকি লাইক করে, লাইন করে।

***

শাপলা-পদ্ম বিলটা বেশ বড়ো। ঘন্টা হিসেবে নৌকা ভাড়া করেছে চন্দ্রা আর মাহতাব। স্কুল থেকে আজ একটু আগেই বের হয়েছে চন্দ্রা। মাহতাবও লাঞ্চ ব্রেকটা তাড়াতাড়ি নিয়ে নিয়েছে। নৌকায় শুরুতে একটু ভয় ভয় লাগছিল মাহতাবের। সাঁতার পারে না, পানি ভয় লাগে। তবে মাঝি যখন বললো পানি কম এখন। পানিতে পড়লেও ডুববে না। তখন মনে সাহস এসেছে। এখন মৃদুমন্দ হাওয়ায় ভালো লাগছে।

“শুনলেন তো আমার কথা।”

“হ্যাঁ, যতটা তুমি বললা, মনে হচ্ছে এর বাইরেও কিছু আছে। যা হয়তো তুমি সেভাবে খেয়াল করো নাই। মানে আন্টির উপর একতরফা অভিমান রাখছ। ভেবে দেখ, সারাটা জীবন আন্টিও তো একা কাটাইতেছেন। আপু বিদেশে, তুমিও দূরে, স্বামী নেই। ওনার জন্য বিষয়টা সহজ না।”

“আম্মু অনেক একটিভিটিসে জড়িয়ে পড়েছেন। আমার বয়স যখন সাত বছর, তখন থেকে একটা এনজিওর সাথে আছেন। মাস্টার্স করেছেন পাবলিক রিলেশনে। রিসার্চার হিসেবেও কাজ করছেন। আসলে আম্মু সবসময় স্টুডিয়াস। আমার আব্বু ছিলেন গড়পড়তার লেখাপড়া করা ব্যবসায়ী। মননে দু’জনের মিলেনি। তারা সেপারেটেড ছিলেন না, কিন্তু একই ছাদের নিচে থেকেও আলাদা ছিল।”

“যেহেতু তোমাদের বিদেশে যাওয়ার সুযোগ আছে। আন্টি এমন মেধাবী মানুষ, নিজেই ছেলেমেয়ে নিয়ে বিদেশ চলে যেতে পারতেন।”

“আমি আব্বুর প্রতি দুর্বল ছিলাম। আম্মু যখন বাইরে ব্যস্ত হলো, আমার জন্য ন্যানী, মানে আয়া রেখেছিল। আব্বু তখন বাইরে থেকে তাড়াতাড়ি আসার চেষ্টা করতো। আপুর তখন চৌদ্দ পনেরো বছর বয়স। নিজের পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত। আমি দাদার খুব নেওটা ছিলাম। বাবাও তখন দুপুরে এসে আমাকে সময় দিতো। একসময় আম্মু বাইরে সেটেল্ড হওয়ার কথা বললেও আমার ইচ্ছে করতো না।”

“এখন?”

“এখন পিছুটান পাই না। আমি বাইরে চলে গেলে আম্মু হয়তো আপুর কাছে চলে যাবে। আমার বোনও একা।”

“ওনার বয়স তো প্রায় তেত্রিশ -চৌত্রিশ। না মানে…”

“বুঝেছি। বিয়ে তো? আপুর বিয়ে নিয়ে বহুবার কথা উঠেছে। ও চায় না। আমরা দু ভাই বোন বোধহয় আব্বু আম্মুকে দেখে এমন হয়েছি। বাবা মায়ের সম্পর্ক ছেলেমেয়েকে প্রভাবিত করে তাই না? মানে আপনাদের দুই বোন, একজন বাবার ঘেঁষা, একজন মায়ের।”

“আমার মা শহরের মেয়ে। বাবার কিন্তু মায়ের তুলনায় শিক্ষার ঘাটতি নেই। বরং মা, বাবাকে ভালোবেসে বিয়ে করছেন।”

“সত্যি!”

“হুম, বাবা যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করছেন, মাও সেখানেই পড়ছেন। আমার নানা, দাদাজানের পূর্বপরিচিত ছিলেন। শহরে গেলে ছেলে কোথায় থাকবে, কোথায় উঠবে সেসব দেখার জন্য দাদাজানও সাথে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে নানার সাথে বাবাকে পরিচয় করে দেন। বিপদে আপদে যেন সাহায্য নিতে পারে। মা তখন ইন্টারমিডিয়েট মানে এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে মাও ভর্তি হয়। বাবা মায়ের বিয়ে হয় তারা ছাত্র থাকা অবস্থাতেই। বাবা তখন অনার্স থার্ড ইয়ারে পড়ে, মা ফাস্ট ইয়ারে। বাবার বিয়েতে দাদির মত ছিল না। দাদাজানের মত ছিল। তিনিই বিয়ে পড়ান।”

“এ জন্য কি এখনো ওনাদের দু’জনের মধ্যে সদ্ভাব নাই?”

“কখনোই ছিল না। তারা দুইজন দুই মেরুর বাসিন্দা। মাকে পছন্দ করে না দেখে আমরাও দাদির অপছন্দ। এর মধ্যে আমি একটু বেশি কারণ আমি কালো।”

“কী বলেন এসব? আপনি কালো?”

“ঐ মানুষ মন রাখতে শ্যামলা বলে।”

“তো? এ জন্য অপছন্দ কেন হবে?”

“দুষ্টুমি করলাম।”

বলে অযথাই হাসে চন্দ্রা। মাহতাব চুপ করে থাকে। চন্দ্রার গল্পটা এত সহজ নয় বুঝতে অসুবিধা হয় না। চন্দ্রাকে সময় দেয় সামলে নিতে। মনে মনে কৌতূহলও হচ্ছে অনেক।

(চলবে)