সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-১৫+১৬

0
2

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১৫

“আমার তিন ফুপুরই একসময় দাদা বাড়িতে খুব আসা যাওয়া ছিল। আমার ফুপুরা সবাই সুন্দর, দাদির মতো তাদেরও গায়ের রঙ সাদা। আমার মা তো আরও বেশি সুন্দর। শুধু বাবার গায়ের রঙ কালো। বাবা নাকি আমার দাদার বাবার রঙ পেয়েছেন। মানে আমার দাদার বাবা কালো ছিলেন। তবে বাবা ছিলেন তিন মেয়ের পর হওয়া ছেলে। তিনি কালো হলেও সবার কাছে হীরা ছিলেন। মানে তার রঙ নিয়ে কারও আফসোস ছিল না। এছাড়া আমাদের বংশে দুকূলেই সব সাদা মানুষ। মৃদুলাও মায়ের রঙ পাইলো। পেলাম না খালি আমি। জানি না কেন ছোটোবেলা থেকেই দাদির অপছন্দের ছিলাম। একসময় বুঝলাম এই কালো রঙ দাদির চরম অপছন্দ। তার বংশে সব সুন্দর মানুষ, আমিই কালো দাগ।”

“আমার অদ্ভুত লাগছে। নিজের ঘরে এমন বর্ণবৈষম্য হয়?”

“কেন হবে না? নিজের ঘরেই সবচাইতে বেশি হয়। যে ছেলে বা মেয়েটা মোটা সে তার ঘরের মানুষের কাছেই সবচাইতে বেশি মোটা মোটা ডাক শোনে। কালো মেয়ে তার মায়ের কাছে সবচাইতে বেশি শুনে যে তারে বিয়ে করবে কে?”

“অদ্ভুত।”

“অদ্ভুতের কিছু নাই। দাদি কোথাও গেলে মৃদুলাকে সাথে নিতো। তবে মৃদুলাকেও যে দাদি খুব ভালোবাসে তা না। আমাকে কষ্ট দিতে নিতো। আমি বুঝতে পারতাম। মৃদুলার প্রতি ভালোবাসার চেয়ে আমার প্রতি দাদির এক অদ্ভুত বিতৃষ্ণা ছিল। দাদির জন্য আমি ছিলাম মাকে আঘাত করার অস্ত্র। দাদাজানের ভালোবাসা বা অবহেলা কোনোটাই তীব্র ছিল না। তিনি একজন নাতি পায়নি বলে আফসোস করতেন একসময়। তবে এটা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে দাদি। নাতি হয় নাই, কালো মেয়ে হয়েছে এসব ব্যবহার করে দাদি মাকে আঘাত করার যে পথটা খুঁজে পেয়েছিলেন, তা থেকে আমাদের সবসময় আগলে রেখেছেন বাবা। তিনি এই আফসোস মায়ের গায়ে আসতে দিতেন না৷ দাদির অপছন্দের শতগুণ বেশি ভালোবাসা আমাদের দিয়ে শোধ দিতেন।”

“আন্টি?”

“মায়ের সাথে আমার দূরত্বের কারণটা আসলে…”

চন্দ্র চুপ করে থাকে। মাহতাব তার বন্ধু, স্বজন কেউ না। তবু তার সাথে পারিবারিক এই গোপন কথাগুলো সে কেন বলছে? হয়তো কথা বলার অপেক্ষায় ছিল। মাহতাবকে সেই সিন্দুকের মতো মনে হচ্ছে, যার ভেতর গোপন কষ্টগুলো নিরাপদে রেখে তালা মেরে দেওয়া যায়। নিজের কলিগ, বন্ধু বান্ধব কাউকে এসব বলা যায়নি কখনো। ভয় ছিল তারা আজ শুনে কালই পাড়া জানিয়ে ফেলবে। শুধু এইজন্য বছরের পর বছর জমানো কথাগুলো নিজের ভেতরই ছিল। অনেকদিন ধরে মনে হচ্ছিল কথা বলার কেউ নেই কেন? আজ সামনে কথা বলার মানুষ পেয়ে মনে হচ্ছে সব বলে দেই।

চন্দ্র চুপ করে আছে দেখে মাহতাব বলে,

“বলতে না চাইলে থাক। আমার মনে হলো আপনার দাদির পাশাপাশি আন্টিও কেন জানি স্বাভাবিক নয়।”

“মৃদুলার অসুস্থতার জন্য মা আমাকে দায়ী করে। মায়ের ধারণা আমি মৃদুলার সৌন্দর্যকে হিংসা করে ওর জীবন নষ্ট করছি।”

“মৃদুলা অসুস্থ?”

“এখন অনেকটা সুস্থ। ছোটোবেলায় দাদির কথায় আমি অনেক কষ্ট পাইতাম। বাবা আগলে রাখতো। মাও চেষ্টা করতো আমাকে আদর দিতে। দাদি, ফুপু সবাই নানা ছলেই বলতো, মা বাবা আমাকে বেশি আদর করে। ছোটোবেলা থেকে মৃদুলার মনে একটা ধারণা বসে যায় যে আমি ওর আদরটাও নিয়ে নিয়েছি। আমাকে বেশি আদর দিয়ে ওরটা কম হইতেছে। ছোটোবেলায় ওর এই অভিযোগ শুনলে বাবা হাসতো। মাও ঐ ভাবে গায়ে নেয় নাই। কিন্তু এটা সত্যি ওর মনে বসে গিয়েছে আমি বুঝেছি অনেক পরে। যতদিনে তা ঠিক করার আর উপায় নাই। আসলে কী জানো মাহতাব, এটা তোমাকে বুঝানো খুব কষ্ট হবে। কিন্তু পরিবারের বড়োরা দিনের পর দিন একটা কথা যখন বলতে থাকে, একটা ঘৃণার চাষ করতে থাকে, তখন দেখবা তা একসময় বাচ্চাদের মনেও বসে যায়। অল্প শিক্ষিত হওয়ায়, তিনটা মেয়ে হওয়ায় আমার দাদি এই বাড়িতে অনেক ছোটো হইছে। তাকে অনেক কটু কথা সইতে হইছে। বয়সকালে তিনি তা মাকে ফেরত দিতে চাইছেন। মায়ের শিক্ষা, মায়ের জন্য বাবার ভালোবাসা, সম্মান কিছু দাদির ভালো লাগতো না। তাদের মধ্যকার তিক্ততা বাবা মায়ের সম্পর্কও দেখ কত নষ্ট করছে। ফুপুরা আমাদের বাড়িতে মেয়ে হিসেবে আদর আহ্লাদ পায় নাই। অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে তাদের বিদায় করা হয়েছে। সেখানে আমাদের দুই বোনকে তেমনটা পাইতে দেখে নাই বলে তাদের হিংসা হয়। অযথাই তারা রঙ, রূপ, আদরের তুলনা এনে আমাদের দুই বোনের ভেতর ছোটোবেলা থেকে দূরত্ব আনছে। আমরা সবাই জানি এখন সব। কিন্তু কেউ কাওকে অপছন্দ করা থেকে বাহির হতে পারি না। বরং আরও খুঁচাই। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে একে অপরকে আরও রক্তাক্ত করি। এখন মায়েরও ধারণা হইছে আমি মৃদুলাকে হিংসা করি। ওর সৌন্দর্য আমার চোখে লাগে। বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া বাড়িগুলো বড়ো বোনের জায়গায় ছোটোবোনকে পছন্দ করবে ভেবে আমি ওর ক্ষতি করতে চাই।”

চন্দ্র কাঁদতে শুরু করেছে। মাহতাবের কেন জানি খুব খারাপ লাগে। এত আত্মীয় স্বজন, আপনজনের ভেতর থেকেও মানুষ কেন এত একা হয় মাহতাব বোঝে না। মাহতাব অনেক সংকোচে চন্দ্রর কাঁধে হাত রাখে। চন্দ্র আলগোছে মাহতাবের কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। চেষ্টা করে এই কান্না আটকাতে। এমন খোলা জায়গায় এসব ঠিক নয়। কিন্তু অযথাই চোখের পানি নামে। মাহতাব আস্তে আস্তে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

মাঝি আস্তে লুঙ্গির খুট থেকে ফোনটা বের করে। সস্তা স্মার্টফোন। তবে ছবি তোলা যায়। পার্কের ইজারা নেওয়া এই ঘাটের মাঝিরা নদীর গরীব মাঝি নয়। এরা লোকাল ছেলেপেলে। যারা এই বিল ঘুরিয়ে ভালোই পয়সা আয় করে।

(চলবে)

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ১৬

সেদিনের পর মাহতাবের সাথে চন্দ্রের সম্পর্কটা আরেকটু জটিল হয়ে গিয়েছে। মাহতাবের কাঁধে মাথা রেখে কিভাবে কেঁদেছে মনে পড়লেই চন্দ্রের লজ্জা লাগে। আবার মনে হয় এই কান্নার প্রয়োজনও ছিল। হালকা না হলে মনের ভেতর জমে থাকা গল্পগুলো কখনো বলতে চাইলেও বলা সহজ হবে না। যদিও সেই গল্পগুলো চন্দ্র কখনোই তুলতে চায় না। তাই সদিন সেখানেই থেমে গিয়েছিল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে তারা ঘাটে ফিরে এসেছিল। যতই ঘোরাঘুরির জায়গা হোক, মফস্বল শহরে এসব শোভনীয় না। যদিও বেশিরভাগ নৌকাতে জুটিই ছিল। তবে মেয়েগুলোর বেশিরভাগই বোরখায় মুখ ঢাকা ছিল। হুট করে চেনা যাবে না। চন্দ্র শাড়ি পরে গিয়েছিল। তাকে আর মাহতাবকে চট করে চিনে ফেলা সহজ।

মাহতাবের অবশ্য অন্য অনুভূতি হয়। নতুন করে কারও জন্য মন আদ্র হবে তা সে কখনোই ভাবেনি। প্রেম, ভালোবাসার উপর একটা বিরক্তি জন্ম নিয়েছিল। ছোটোবেলার বন্ধু, কাজিন, যার সাথে মৌখিক ভাবে বিয়ে একরকম ঠিকই ছিল, তার কাছ থেকে যখন কাঙ্ক্ষিত সাহচর্য পায়নি, তখন ধরেই নিয়েছিল নারী জাতিকে বোঝা তার কম্ম নয়। নিজের মা, বোনের মতো নারীর প্রেমিক স্বত্বাও তার কাছে দুর্বোধ্যই থেকে যাবে। কিন্তু এখন চন্দ্রের জন্য তার বিচিত্র অনুভূতি হচ্ছে। চন্দ্র যত লজ্জা আর অস্বস্তিতে তার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, মাহতাবের তত বেশি চন্দ্রকে দেখতে মন চাইছে। অথচ গত দুইদিন চন্দ্র একবারও ছাদে আসেনি। ঘরে থাকলেও দেখা দেয়নি।

চন্দ্রের মাঝে একটা পরিবর্তন মৃদুলাও খেয়াল করে। গত দুইদিন চন্দ্র স্কুলের সময় ছাড়া পুরোটা সময় ঘরের ভেতরই কাটিয়েছে। ঘরের কাজ শেষে হয় বৈঠকঘরে ছবি এঁকেছে, না হয় বই পড়েছে রুমে বসে। দোলনা বা ছাদে কোথাও যায়নি।

“আপু।”

“হু।”

“ঘটনা কী?”

“কী ঘটনা?”

“এই যে হঠাৎ দুদিন ধরে গৃহবন্দী। শুক্রবার সকাল থেকেই তো তোমার নিজের গুণ দেখানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়।”

“আজ শুক্রবার না। ইসস ভুলে গিয়েছি।”

আজ বাদ যোহর সালমা সুলতানার বিয়ে। চন্দ্র অনেক ভেবেছে। বিয়ে বন্ধ করার জন্য লোকজন না নিয়ে যাক, শিক্ষক হিসেবে নিজে গিয়ে কথা বললে তো পারে। সালমার মা বাবাকে বোঝালো যে পরীক্ষাটা যেন দেয়। কিন্তু একা যাওয়ার সাহস হয় না। আর মৃদুলাকে সাথে নিয়ে এসব জায়গায় যাওয়ার কথা ভাবলে জুয়েনা ওকে খু*নই করবে। এমনিতে এখনো মা ভাবে চন্দ্র ইচ্ছে করে মৃদুলার ক্ষতি করতে চেয়েছে। চন্দ্র বইটা রেখে চোখ বন্ধ করে বালিশে মাথা রাখে। তুর্যের চেহারাটা খুব স্পষ্ট করেই চোখে ভাসে চন্দ্রের।

তুর্য, চন্দ্র আর মৃদুলার ফুপাতো ভাই। একসময় এ বাড়িতে ফুপুদের নিয়মিত আসা যাওয়া ছিল। যদিও ফিরোজ সরকারের জন্ম এ বাড়িতে নাহার বেগমের অবস্থান শক্ত করেছে। কিন্তু নাহার বেগমের ছেলের প্রতি সেই টানটা নেই, যা তার মেয়েদের জন্য আছে। হয়তো মেয়েদের এ বাড়িতে একটা সময় অবহেলিত হতে দেখে মেয়েদের প্রতি হৃদয়ে একটা দুর্বল জায়গা তৈরি হয়েছে। সংসারে নিজেই যখন শাশুড়ি হয়ে কর্তৃত্ব হাতে পেলেন, তখন তিনি সবসময়ই চাইতেন ঘুরেফিরে মেয়েরা বাড়িতে আসুক, মেয়ের ঘরের নাতি নাতনিরা আসুক। তুর্য, নাহার বেগমের ভীষণ আদরের নাতি। এবাড়ির সবকিছু তুর্যের জন্য খোলা ছিল। অবাধ যাতায়াতও ছিল। কৈশোরের আবেগ ভয়াবহ জিনিস। তুর্যের প্রতি চন্দ্রের আবেগ আকর্ষণ তৈরি হওয়াটাও তাই স্বাভাবিকই ছিল। তুর্য হৈচৈ করতো, বাড়ি মাতিয়ে রাখতো। আর তাতে মুগ্ধ দর্শক ছিল চন্দ্র। মেয়েদের আগে প্রেমের কথা বলতে হয় না। ছিঃ, মেয়ে আগে কিভাবে নিজের ভালোবাসার কথা বলে। বান্ধবীদের কাছে এসব এত শুনেছে, যে নিজের আবেগ প্রাণপণে নিজের ভেতরই রাখার চেষ্টা করতো। তবে মনে মনে চাইতো একদিন তুর্য নিজেই আগ্রহ দেখাক। তুর্য আগ্রহ তো দেখায়, তবে শুধুনচন্দ্রের প্রতি নয়। বরং মৃদুলার প্রতিও। চন্দ্র বিষয়টা বুঝতে পারেনি, আড়ালে চোখের ইশারা, এটাসেটার বাহানায় হাতে হাত ছুঁয়ে দেওয়ার সেই ক্ষণগুলো শুধু চন্দ্রের সাথেই ছিল না, ছিল মৃদুলার সাথেও। একদিন বোনে বোনে গল্পের ছলে তুর্যের প্রতি জন্ম নেওয়া আকর্ষণের কথা অকপটে বলে দেয় চন্দ্র। তখনই প্রথম জানতে পারে তূর্য ইতোমধ্যে মৃদুলাকে ভালোবাসার কথা জানিয়েছে। অথচ চোখের ভাষা কি ভুল হতে পারে? চন্দ্র তো স্পষ্ট তূর্য চোখের ওর জন্য প্রশ্রয় দেখেছে। মৃদুলা জানায় চন্দ্র বড়ো আর মৃদুলা ছোটো বলে তাদের বিষয়টা পারিবারিক ভাবে এখনও ওঠেনি। চন্দ্র অবাক হয়, তুর্যের চোখের সেই ভাষা পড়তে কি আসলেই তার ভুল হয়েছে?
বিষয়টা দুইবোনে চাপা থাকে না। শীঘ্রই জুয়েনার কানে যায়। মৃদুলা আর তুর্যের বিষয়টা ফুপু আর দাদির কাছেও লুকানো থাকে না। ফুপু ভাতিজিকে অবশ্যই বৌ করতে আগ্রহী, তবে চন্দ্রকে নয়, মৃদুলাকে। কিন্তু মৃদুলা তখন সবে এইচএসসি দিয়েছে, আর চন্দ্র অনার্সে পড়ছে। চার বছরের বড়ো বোনকে বাদ দিয়ে ছোটোবোনকে তো বিয়ে দেওয়া যায় না। জুয়েনাও চন্দ্রকে বোঝায়, তুর্যের সাথে মৃদুলার বিয়ে হোক না হোক, সেটা পরের বিষয়। কিন্তু এই মুহুর্তে তিনি চন্দ্রের বিয়ের বিষয়টাই ভাবতে চান। ফিরোজ সরকারও চন্দ্রকে কোনোরকম দোষ দেননি এই ভুল বোঝাবুঝির। বরং একমাত্র ওনারই মনে হয়েছে তুর্য একই সাথে দুইবোনকে একটা মিথ্যা ঘোরে রেখেছে। তাই তুর্যের আসাযাওয়াও এ বাড়িতে অনেকটা কমে যায়। তারপর আসে সেই দিন। চন্দ্রকে এক পাত্রপক্ষ পছন্দ করে। সবার সাথে কথা বলে ঠিক হয় আঙটি বদলের দিনই আকদ হয়ে যাবে। মামার কাজে সাহায্য করার বাহানায় তুর্য আগেই চলে আসে। আকদের আগেরদিন রাতে ছাদ থেকে পড়ে যায় তুর্য। একটা পা ভেঙে যায়। তারপর থেকে এ বাড়ির সাথে চন্দ্রের ফুপুদের একরকম যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

তুর্য সবার কাছে বলেছিল জরুরি কথা আছে বলে চন্দ্রই তাকে একটা চিরকুট পাঠিয়ে রাতে ছাদে ডেকেছে। দুমড়নো চিরকুটে হাতের লেখাটাও চন্দ্রেরই। চিরকুটটা নাকি চন্দ্রই একফাঁকে তার হাতে দিয়েছে। ছাদে গিয়ে চন্দ্রকে খুঁজে পায় তুর্য। চন্দ্র তাকে বলেছিল মৃদুলার জীবন থেকে চলে যেতে। কিন্তু তুর্য রাজি হয়নি বলে চন্দ্র ক্ষেপে চলে যায়। একটু ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে নিজেকে শান্ত করতে দাঁড়িয়ে ছিল তুর্য। হঠাৎ মনে হয় পেছনে কারও পায়ের শব্দ। পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল তুর্য ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই মনে হলো কেউ হঠাৎ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে চাইছে। নিজেকে সামলাতে চেষ্টা করলেও সামলাতে পারেনি তুর্য। দোতলার ছাদ থেকে পড়ে প্রাণে বাঁচলেও আজীবনের জন্য খোঁড়া হয়েই চলতে হবে তুর্যকে। তুর্যের অভিযোগের তীর যায় চন্দ্রের প্রতিই। চন্দ্রকে বাদ দিয়ে মৃদুলাকে পছন্দ করায় চন্দ্র হিংসার বশীভূত হয়েই এ কাজ করেছে। আর সবাই তো বটেই এমনকি জুয়েনাও চন্দ্রকে ভুল বোঝে। মৃদুলা চন্দ্রের হিংসার যে অভিযোগ মায়ের কাছে করেছে, তাই তারও সত্য মনে হয়। একমাত্র ফিরোজ সরকার মেয়ের ঢাল হয়ে দাঁড়ান। চন্দ্রের বিয়েটা ভেঙে যায়। গত চার বছরে আস্তে আস্তে অনেককিছু স্বাভাবিক হলেও স্বাভাবিক হয়নি মৃদুলা আর চন্দ্রের সম্পর্ক। সেই ঘটনার পর ফুপু কোনো ভাতিজিকেই আর বৌ বানাতে চান না জানিয়ে দেন। বাবার বাড়ির সাথে একরকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। দাদির চোখে চন্দ্র আরও বেশি বিরক্তির কারণ হয়ে গিয়েছে। তুর্যের সাথে সম্পর্ক ভাঙন মৃদুলা সহ্য করতে পারেনি। কমবয়সের আবেগে অনেকগুলো ঘুমের ঔষধ খেয়ে সুইসাইড করারও চেষ্টা করে। সময়মতো দেখে ফেলায় বাঁচানো যায় ঠিকই, কিন্তু দীর্ঘদিন হতাশা, অবসাদে ভুগেছে। তখন থেকে জুয়েনা মৃদুলার জন্য অনেক বেশি যত্নশীল হয়েছেন। যত জুয়েনা মৃদুলাকে আগলে রেখেছেন, ততটাই চন্দ্রের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়েছেন।

সেইদিনের পর থেকে দুই বোনের সম্পর্কটাও জটিল হয়েছে। কেননা দুই বোনের মাঝে যেসব ছোটোখাটো মান অভিমান, খুনসুটি স্বাভাবিক ছিল। সেদিনের পর তা আর স্বাভাবিক রইলো না।
চন্দ্র মৃদুলাকে বহুবার বলতে চেয়েছে আসলে কী হয়েছে। কিন্তু চন্দ্রের জন্য মৃদুলার মনে আক্রোশ আর রাগ ছাড়া আর কিছুই নেই।

(চলবে)