সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০২

0
2

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২

জুয়েনা নিচে নেমে স্বামীকে ডাক দেন,

“মৃদুলার আব্বু, এদিকে শুনে যাও।

” আসতেছি। কাজটা করে নেই।”

ফিরোজ সাহেবের দোলনা লাগানো শেষ। এখন একটা বাক্স বসানোর চেষ্টা করছেন। গাছের গায়ে খোদাই করে একটা ছোটো বাক্স বসাবেন। বাক্সে আবার ছোটো একটা দরজাও আছে। যার ভেতর বই রাখা যাবে। চন্দ্র পছন্দ মতো বই এনে বাক্সে রাখবে। দুলতে দুলতে যেটা মন চায় বের করে পড়বে।

চন্দ্র মায়ের বিরক্ত মুখটা দেখতে পাচ্ছে। এই চেহারার সাথে চন্দ্র পরিচিত। কুঞ্চিত ভ্রু, কপালে কুঁচকানো বলিরেখা আর মুখটা পাথরের মতো নিষ্প্রাণ করে ফেলা। অসম্ভব সুন্দর হওয়ার পরও মাকে এ-সময় দেখতে চন্দ্রের একদম ভালো লাগে না।

“বাবা, মা ডাকছে।”

“শুনলাম তো। কাজ শেষে যাই।”

“এখনি যাও। মা বিরক্ত হচ্ছে। এটা ধনু ভাই লাগিয়ে দিতে পারবে। কী ধনু ভাই, আমি ধরলে লাগিয়ে দিতে পারবেন না?”

ধনু জোরে জোরে মাথা নাড়ে। জুয়েনার বিরক্ত চেহারা বোধহয় ধনুরও নজর এড়ায়নি।

“এত বিরক্ত কেন জুয়ানা?”

“বিরক্ত কে বললো?”

“তোমারে দেখলে যে কেউ বুঝবে তুমি শুধু বিরক্ত না, রেগেও আছ।”

“তোমাদের সমস্যা কি? ইচ্ছে করে বিকৃত নামে ডাকতে ভালো লাগে তাই না।”

“আচ্ছা, আম্মা আবার জুলেখা বলছে। এ তো নতুন কিছু না”

“তুমিও তো জুয়ানা বললে। জুয়েনা নামটা এত কঠিন না নিশ্চয়ই।”

“আমারটা আঞ্চলিক টান। হুটহাট টান চলে আসে। তোমার মতো এত শুদ্ধ আসে না।”

“শুদ্ধ আসাটা অপরাধ?”

” না না। তা হবে কেন? এইটা তো গুণ। তুমি রূপবতী, গুণবতী বলেই তো আব্বার পুত্রবধূ হয়েছ। বেগুন রূপহীন পুত্রের ভবিষ্যত সন্তানেরা যেন গুণবান, রূপবান হয় আব্বার তারই ক্ষুদ্র প্রয়াস।”

জুয়েনা বিড়বিড় করে বলেন,

“না হলেই ভালো হতো।”

“কী জন্য ডাকছিলে তাই বল।”

“ধনুকে কী ফালতু কাজে আটকে রেখেছ। ওর কাজ আছে না।”

“কী কাজ?”

“ছাদের ঘরটা পরিষ্কার করে দিতে হবে। ওকে পাঠাও। তুমিও সাথে যাও। সামনে না থাকলে ঠিক করে কাজ করবে না।”

“ছাদের ঘর? ঐটা তো পরিষ্কারই আছে। চন্দ্র নিয়মিত পরিষ্কার করে।”

“মেয়েকেও বইখাতা ওখান থেকে সরাতে বলো। নিজের টেবিলে নিয়ে রাখুক। অযথা ঘর দখল করে রাখা।”

“এসব কী কথা জুয়ানা। স্যরি জুয়েনা। দখলের কী আছে। চিলেকোঠার ঘরটা ওর পছন্দ। পড়ালেখা করে। গান শোনে।”

“তোমার মেয়ের বয়স কত? পুকুর পাড়ে পা ডুবিয়ে বই পড়া, চিলেকোঠার ঘরে ছবি আঁকা, গান শোনা এসব আহ্লাদ মৃদুলার বয়সী মেয়ে করলেও মানা যায়। এই বয়সী মেয়েরা বিয়ে বসে স্বামী সংসারের দায়িত্ব নেয়।”

“তুমি, আম্মা। তোমাদের সমস্যা কী?”

“কোনো সমস্যা নাই। আব্বার কোন বন্ধুর নাতি আসছে। নতুন চাকরি হয়েছে। উপজেলায় পোস্টিং। সে এ-ই বাড়িতে উঠবে। নিচতলায় কোনো রুম নেই। দোতালায় আমরা থাকি, কমবয়সী মেয়েরা থাকে। দোতলায় রুম দেওয়া যাবে না। ছাদের ঘরটা গুছিয়ে দিতে হবে।”

“বন্ধুর নাতি এ বাড়িতে থাকবে? কই আমারে তো আব্বা কিছু বললো না। আর উপজেলায় পোস্টিং হইলে সেখানে না থেকে শহরে কেন থাকবে।”

“শহরে বড়ো হওয়া ছেলে। জঙ্গলে গিয়ে থাকতে পারবে না। সবাই আমার মতো না।”

“থাকতে না পারলে চাকরি নিলো কেন? এরা সরকারি চাকরি নিতে পাগল, কিন্তু চাকরি পাওয়ার পর এইখানে থাকতে পারব না, ঐ খানে যাব না। শুরু করে তদবির।”

“ধনু। এই ধনু। যা তো ছাদের ঘরটা পরিষ্কার কর।”

জুয়েনা আর ফিরোজ সরকারের সামনে দাঁড়ায় না। এসব কথা শোনার তার ইচ্ছে নেই।

“বাবা, মা কী বললো? ছাদের ঘরটা পরিষ্কার করবে মানে?”

“তুই মা তোর বই, ক্যানভাস এইসব নিচের লাইব্রেরি নিয়ে আয়। আমি একপাশে জায়গা করে দিবনে তোরে। তোর দাদার বন্ধুর নাতি আসবে। বেচারা শহরের ছেলে। গ্রামে থাকার অভ্যাস নাই। কোয়াটারে থাকতে পারবে না। এইখানে কয়দিন থাকবে। বাসা ভাড়া নিয়ে গুছিয়ে চলে যাবে।”

***

ধনুর সাথে চন্দ্র নিজের জিনিসগুলো নিচে নামিয়ে আনে। নিজের রুমে এসব রেখে লাভ নেই। মৃদুলা আর চন্দ্র একই রুমে ঘুমায়। মৃদুলা একা ঘুমাতে ভয় পায় বলে একই রুমে ঘুমাতে হয়। না হলে দু’বোনের জন্য দুটো আলাদা ঘর আছে দোতলায়। বড়ো রুমটা মৃদলা একটু বড়ো না হতেই দখল করেছে। নিজের নানা জিনিস দিয়ে সেটা সাজিয়েছে। সাজের জন্য বড়ো আয়না, গান শোনার জন্য মিউজিক সিস্টেম। একপাশে এখন তবলা, হারমোনিয়াম বসানো হয়েছে। মৃদুলার একবার এক শখ চাপে। এখন মৃদুলা নাচ শেখে। তবলচী আসেন, তবলার ছন্দে মৃদুলা নাচের ছন্দ তোলার চেষ্টা করে।

এই ঘরটায় দু’জনের আলাদা দুটো খাট, দুটো পড়ার টেবিল। চন্দ্রর কাপড় রাখার আলমারি রাখা।
মৃদুলা শব্দ করে পড়ে। চন্দ্র সেই শব্দে মনোযোগ দিতে পারে না। আয়েশ করে ছবি আঁকতে হলে, বই পড়তে হলে ছাদের ঘরটাই বেছে নেয়। লাইব্রেরি আর বৈঠকখানায় বাবা, দাদা থাকেন। বাইরের মানুষেরা এসে বসে। ওখানে নিজের মতো করে সময় কাটানো সম্ভব না।

***

হাসির শব্দ আসছে। জুয়েনার মুখের বিরক্ত ভাবটা নেই। মৃদুলা নাচের মুদ্রা দেখাচ্ছে। ঠিক হচ্ছে না। তাই নিয়ে মা মেয়ে হাসাহাসি করছে। চন্দ্র জিনিসপত্র নিয়ে ঢুকতে গেলে জুয়েনার বাঁধার মুখে পড়ে।

‘এগুলো কই নিয়ে আসছ?”

“রুমে মা।”

“এই রুমে এসব কই রাখবে? মৃদুলার জিনিসই জায়গা হয় না। এসব রাখলে ও প্রাকটিস করবে কোথায়?”

“তাহলে কি আমাদের শোওয়ার রুমে নিয়ে রাখব?”

“সেখানেও কই রাখবে? দুই পাশে দুটো খাট, পড়ার টেবিল, আলমারি। দেয়ালে আবার তোমার আয়না ঝুলিয়েছ।”

“তো তাহলে এগুলো কই রাখব?”

“নিচে নিয়ে রাখ। নিচে এ মাথা ওমাথা এত বড় জায়গা আছে। লাইব্রেরির এক পাশে রাখ। না হলে বৈঠকখানা রাখ।”

জুয়েনার ভ্রু কুঁচকানো ভাবটা ফিরে এসেছে। চন্দ্র খেয়াল করেছে জুয়েনা ভ্রু কুঁচকে কথা বললে মুখের হাসি গায়েব হয়ে যায়। তখন জুয়েনাকে আর সুন্দর লাগে না। এতে চন্দ্রের মনে হয়, আসলে মানুষের আসল সৌন্দর্য তার গায়ের রঙ রূপ নয়। সৌন্দর্যের মাপকাঠি হলো হাসি। হাস্যজ্বল চেহারায় যে কাউকে সুন্দর লাগে।

“কী ভাবছ? নিচে নিয়ে যাও।”

চন্দ্র নিচে নামতে নামতে হাসির আওয়াজ শোনে। মৃদুলা আর জুয়েনা আবার হাসিখুশি মুহূর্তে ফিরে গিয়েছে।

(চলবে)