সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৭
আমি তোমার উপর কোনো রাগ রাখিনি মাহতাব। আসলে রাগ করার অধিকারও রাখি কি? কেননা আমিও তো তোমার অপরাধী।”
“তুমি কেন অপরাধী হবে?”
“তোমার বাবা খুব সংগোপনে দুটো জীবন যাপন করে গিয়েছিলেন। আমি অনুভব করতাম আমাদের মাঝে কিছু একটা নেই। কিছু একটার অভাব। কিন্তু তা কী বুঝতাম না। মনে হতো আমাদের বড়ো হওয়া, পড়ালেখা সবকিছুতে অনেক পার্থক্য ছিল বলে হয়তো আমরা একে অপরের সাথে সহজ না। কিন্তু আমি বুঝতেই পারিনি ওর আলাদা একটা বহির্মুখী জীবন ছিল। সেই মেয়েটা নিজে থেকে সামনে না এলে জানতেও পারতাম না৷ মেয়েটা যখন তোমার বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করা শুরু করে, টাকার লোভ পেয়ে বসে তখন তোমার বাবার ধ্যান ভাঙে। সে সংসারে ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু সব জানার পর আমিই তাকে গ্রহণ করতে পারিনি।”
“সেটাই তো স্বাভাবিক আম্মু।”
“আমি জানতে চেয়েছিলাম কেন করলে এমন? কিসের অভাব ছিল আমার মাঝে? জানো কী বললো? বললো অভাব ছিল না বলেই সে পথভ্রষ্ট হয়েছিল। আমার কাছাকাছি এলেই নাকি ওর নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হতো। আমার আভিজাত্য, সৌন্দর্য, শিক্ষা সবকিছু নাকে ওকে অপ্রতুল অনুভব করাতো। তাই সে এমন কারও সাথে জড়াতে চেয়েছিল যেখানে তার নিজেকে ক্ষুদ্র মনে না হয়। এই কথাগুলো আমার মনে থাকা সবটা মায়া শেষ করে দিলো। ও নিজের অপরাধের যুক্তি হিসেবেও আমাকেই ব্যবহার করলো। তার সেই যুক্তিই আমি সারাজীবন বয়ে বেড়িয়েছি। যতদিন বেঁচে ছিল আমার চেষ্টা ছিল নিজেকে শ্রেয় করে দেখানো। যা আগে কখনো করিনি, তাই করেছি।
“তুমি চলে গেলে না কেন আম্মু?”
“আমি এই সম্পর্ক থেকে বের হবার সিদ্ধান্ত যখন নেই, তোমার বোনের বয়স তখন দশ বছর। মেয়েরা দশ বছরেই যথেষ্ট বুদ্ধিমতী হয়ে যায়। অনেককিছুই বোঝে। তোমার বাবার বহির্মুখী জীবন আবিষ্কারের পর আমার মানসিক কষ্ট মেহের অনুভব করতে পেরেছিল। নিজের বাবার প্রতি ওর একধরণের অভিমান জন্মেছিল। সে অভিমান তার মৃত্যুর পরও ভাঙেনি। মেহের কে নিয়ে আমি বাবার বাড়ি চলে গিয়েছিলাম। তোমার দাদা আমাকে আটকাননি। কিন্তু যখন আমি চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেব ভেবেছি, তখনই আবিষ্কার করলাম আমি আবার প্রেগন্যান্ট। মেহেরের জন্মের পর আবার দুটো বাচ্চা মিসক্যারেজ হয়েছিল। তোমার আগমনের খবর আবার জন্য খুব আনন্দের হওয়ার কথা। অথচ তা হয়ে গেল চিন্তার। তোমার নানা তখন বিছানায় পড়ে আছেন। তোমার মামা, খালা সবাই আমার জন্য ব্যথিত, কিন্তু তিনজন মানুষের দায়িত্ব নেওয়া এত সহজ না আমি বুঝতে পারছিলাম। তোমার বাবাও বারবার ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম তারা নিমরাজি হয়ে পড়েছিল। আমি ফিরে আসি। কিন্তু মনে এক অদ্ভুত ক্ষোভ নিয়ে। মনে হলো তোমার আগমন আমাকে এ সম্পর্কে বেঁধে দিলো। সারাজীবন আমি এই মিথ্যা অনুযোগে তোমার সাথে প্রচ্ছন্ন দূরত্ব রেখে দিলাম। সে ফাঁকা জায়গা নিলো তোমার বাবা। সে তোমাকে তার ভালোবাসার সবটাই উজাড় করে দিয়েছিল। তোমার আমার প্রতি অভিমান তাই সবসময় যথাযথ ছিল। তোমার বাবা পরবর্তী জীবনে আমার সাথে লয়্যাল ছিলেন। কিন্তু আমি অতীত ভুলতে পারিনি বাবা। আই এম স্যরি। ভুলতে পারলে হয়তো আমাদের পরিবারটা আর দশটা পরিবারের মতো সহজ সুন্দর হতো।”
মাহতাব সমস্ত সংকোচ ভুলে মাকে জড়িয়ে ধরে। মাকে সামান্যতম অপরাধী ভাবতে পারে না। কিন্তু বাবার জন্য ঘৃণাও মনে আসে না। কী অদ্ভুত! এমন কেন লাগছে!
***
“মাহতাব,পারিজাত তোমাকে নাকি অনেকবার ফোনদ দিয়েছে। তুমি ধরছ না।”
“ধরিনি তা নয় আম্মু। আমি ধরেছি। কথা হয়েছে। এখন ও যা চাচ্ছে তা আমি চাই না বলে কথা বলছি না।”
“সমস্যা কী? তুমি দাদার কথা ভাবছ? আমি কথা দিচ্ছি আমি ওনার খেয়াল রাখব। তুমি এবার নিজের কথা ভাব। পারিজাতকে বিয়ে করে দেশের বাইরে চলে যাও।”
“আমার লক্ষ্য যে আলাদা আম্মু। সে গন্তব্যে পারিজাত নেই। আমার গন্তব্যে পৌঁছানোর ট্রেন বারোটায় ছাড়বে। আজ রাতে একজনের গায়ে হলুদ। তার আগেই পৌঁছাতে হবে। অনুষ্ঠান মিস করতে চাই না।”
“তুমি সত্যি সত্যি ওখানে যাচ্ছ? জব ছাড়বে না?”
“নাহ্। আম্মু আমি জবটা ভালোবাসি।”
“কিন্তু আমার তো কারণ ভিন্ন মনে হচ্ছে। তুমি কি রহমত আঙ্কেলের নাতনিকে সত্যি পছন্দ করে ফেলেছ? বাবা কী যেন বলছিলেন ওনারা বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।”
“হ্যাঁ। সেজন্যই তো এখনই রওনা দিতে হবে। না হলে এই দিলওয়ালা যাওয়ার আগেই দুলহানিয়া অন্য কেউ নিয়ে যাবে।”
“মানে কী?”
“এসে বলব। এখন যেতে দাও প্লিজ।”
(চলবে)
সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ২৮
সময় মতো ট্রেন ছাড়লে মাহতাবের পৌঁছানোর কথা সন্ধ্যা ছয়টায়। কিন্তু আন্তঃনগর ট্রেন সময় মতো ছাড়লে তো। দুই ঘন্টা লেট হবে শুনে মাহতাব আর অপেক্ষা করে না। ফোন করে গাড়ি আনিয়ে রওনা দেয়। যদিও নিজের কাছে পণ করেছিল বাসার সুযোগ সুবিধা কিছু ব্যবহার করবে না। কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে।
চন্দ্রা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি পরেছে। সাথে গাঁদাফুলের গয়না৷ বাসাতেই সেজেছে। শফিক অনুরোধ করেছিল ছবি পাঠাতে। মৃদুলা ছবি তুলে দেয়। চন্দ্রা শফিককে পাঠায়।
“এইটা আমাদের বাড়ি থেকে দিয়েছে?”
“জি।”
“ওহ্। কী শাড়ি?”
“টাঙ্গাইল।”
শফিকের মন খারাপ হয়। শাড়িটা সস্তা মনে হচ্ছে অথচ শাড়ি কেনার জন্য শফিক ভালোই টাকা পয়সা দিয়েছে। মা বা বোনকে এসব কিছু জিজ্ঞেস করা যাবে না, এমনিতেই এখানে বিয়েতে কেউ সানন্দে মত দেয়নি। চন্দ্রার বিষয়ে এলোমেলো কিছু খবরও শফিকের কানে এসেছে। অথচ শফিকের চন্দ্রাকে খুব ভালো লেগেছে। বাড়ির বিষয়টা শফিক বোঝে। কেউই মুখে স্বীকার করবে না, কিন্তু মনে হচ্ছে সবাই ধরেই নিয়েছিল শফিক আর বিয়েশাদি করবে না। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হয়ে গিয়েছে, বাকি জীবনটা চিরকুমার থেকে যাবে। পরিবারের জন্য করবে।
অল্প বয়সে বিদেশে পাড়ি জমানো শফিক এর আগে ধাপে ধাপে তিনবার বাড়ি এলেও কেউ বিয়ের কথা তোলেনি। এমনকি বাবা মাও না। কখনো বাড়ি তোলার জন্য, কখনো বোনদের বিয়ে, কখনো ছোটোভাইকে ব্যবসা ধরিয়ে দেওয়ার টাকা দিতে শফিককে নিজের সংসার শুরু না করেই পাড়ি দিতে হয়েছে। বোনেদের বিয়েতে সে উপস্থিত না থাকলেও চলেছে, তার পাঠানো টাকায় ভালো আয়োজন হয়েছে। ভাইয়ের ব্যবসা দাঁড়িয়েছে। একদিন শুনলো ভাই নিজের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করে ফেলেছে, আর বাবা মা মেনেও নিয়েছে। নতুন আব্দার শুরু হয় বোন জামাইকে বিদেশে নেওয়ার ব্যবস্থা করার। অথচ কালে কালে বেলা গড়িয়ে যাওয়া শফিকের বিয়ে সংসার যেন সবাই একপ্রকার ভুলেই গিয়েছিল। এবার দেশে ফিরে শফিক নিজেকে ভীষণ একা আবিষ্কার করে। বাবা বিছানায় পড়ে গিয়েছে। মা তার দেখভালে ব্যস্ত। বোনেরা নিজের সংসারে, ভাইয়ের বাচ্চা হয়ে গিয়েছে, সে আলাদা ঘর তুলেছে। শফিকের মনে হয় সে আর কিছুদিন পর পরিশ্রম করতে পারবে না, বিদেশ থেকে চলে আসতে হবে। মা বাবাও চিরকাল রইবে না। তখন এদের কারও সংসারেও যে তার ঠাঁই হবে না সে বাস্তবতা সে অনুভব করে। তাই এবার অনেকটা গোঁ ধরেই মেয়ে দেখতে থাকে। বিয়ে না করে ফিরে গেলে আবার তিন চার বছরের জন্য আটকে যাবে। বাড়ির মানুষেরাও কালক্ষেপণ করছে বুঝতে পারে। বোনদের কাজ হলো সব পাত্রীর খুঁত বের করা। শেষ পর্যন্ত নিজে ঘটক লাগায়। চন্দ্রার ফুপুর মাধ্যমে আসা এ প্রস্তাবও নাকচ হয়ে যেত চন্দ্রার বয়স, চাকুরি, রঙের বাহানায়। কিন্তু শফিকের ইচ্ছের কাছে তারা হার মেনেছে। সতেরো আঠারো বছরের কমবয়সী ইম্যাচুয়র মেয়ের চেয়ে সাতাশ আটাশ বছরের ধীরস্বভাব একটা মেয়েই শফিকের কাম্য ছিল। যার সাথে বয়সের পার্থক্যটা অস্বাভাবিক বেশি দেখাবে না, মানসিক মিল হবে। তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অকথা কুকথা শফিক কানে নেয়নি। অথচ বিয়ের দিন যত ঘনিয়ে আসছে, তত অস্বস্তি চেপে বসছে।
গত কয়েকদিন ধরেই শফিকের মনে হচ্ছে চন্দ্রার তরফ থেকে বিয়ে নিয়ে সামান্য উচ্ছ্বাস নেই। এমন না যে চন্দ্রা কথা বলছে না, বা তাকে অসম্মান করছে। তবু কী যেন নেই, কিসের যেন অভাব। বিষয়ে আয়োজন থেকে শুরু করে কেনাকাটা কোনো কিছু নিয়ে না চন্দ্রার আব্দার আছে না অভিযোগ। চন্দ্রা যেন সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু হয়েও সবকিছু থেকে অনুপস্থিত।
***
“তুমি একটু পার্লারে যাইতা, একটু সাদা বাইনতো। রঙটা বেশি ময়লা লাগে।”
“হলুদ রঙে তোমার বোনরে বেশি মানাইছে।”
“ছোটোটা বেশি সুন্দর।”
পাত্রের বোনদের কথায় জুয়েনা চরম বিরক্ত। ফিরোজ সরকার তো মেয়েকে হলুদ ছুঁয়ে দিয়ে উঠে গিয়েছেন। ওনার ওদের দেখতেও বিরক্ত লাগছে। বুঝতে পারছেন না ঠিক হচ্ছে কিনা। মন বলছে এই পরিবেশ আর মানুষগুলো চন্দ্রার জন্য যথার্থ নয়। তবে ছেলেটা ভালো, ভদ্রলোক মনে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে আয় করা ছেলের বৌয়েরা খারাপ থাকে না। স্বামীর আয়ই সংসারে তাদের শক্তি। সেখানে শফিক পরিবারের প্রধান চালিকাশক্তি। তার বৌয়ের জন্য মনে ভালোবাসা না থাকলেও, সরাসরি আঘাত করার সাহস কেউ করবে না।
তবু ফিরোজ সরকারের মন মানে না। মেয়েকে তো এভাবে বড়ো করেননি যে গলগ্রহ ভাববেন, আর কোনো রকমে কামাই করা ছেলে পেলেই দিয়ে দায়গ্রস্ত পিতার অপবাদ হতে মুক্ত হবেন। মেয়েটাও গোঁ ধরে বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। দুই বোন আর মা মেয়ের মধ্যকার বরফ গলে যাওয়ার পর জুয়েনা শাশুড়ির মুখোমুখি হতে চাইলেন। ফিরোজ সরকার বহু কষ্টে আটকেছেন। যে গোপন কথা এ বাড়ির দেয়ালের ভেতর বহুবছর গোপন ছিল, তাই থাক। এতে যে চন্দ্রা আর মৃদুলার জীবন কঠিন হবে বই সহজ না। ফিরোজ সরকারের জন্ম পরিচয় তার মেয়েদের জীবনে কোনো সমস্যা আনুক তা তিনি চান না। স্বামীর কথার গুরুত্ব বুঝে জুয়েনাও চুপ করে। তবে চন্দ্রার বিয়ে এখানে হলে কতটা ভালো হয়, তা নিয়ে তিনিও দ্বিধায় ছিলেন। অথচ নাহার বেগম আগ্রহ নিয়ে বিয়ের আয়োজন করলেন। বিয়ের কাজও এগিয়ে গেল। চন্দ্রার মনে হলো তার বিদায়ে দাদি এত খুশি হবে আগে বুঝলে আরও আগেই বিয়ে করে নিতো।
***
মেহমানরা বিদায় নিয়েছে। চন্দ্রার তিন ফুপু বহুদিন পর এ বাড়িতে এসেছেন। বিয়েকে কেন্দ্র করে বহুদিন পর পারিবারিক মহল স্বাভাবিক হয়েছে। ফুপুরা সব উপরের তলায় আছে। সারাদিনের হৈচৈ এর পর ক্লান্ত অনেকেই শুয়ে পড়েছে। ভালোই রাত হয়েছে। চন্দ্রা নিচের লাইব্রেরিতে শেষবারের মতো পছন্দের বই আর চিত্রকল্পগুলো গুছিয়ে রাখছে। বিয়ের পর আবার কবে আসতে পারে কে জানে।
‘খট খট খট’
জানালায় শব্দ হয়।
“কে?”
“চন্দ্রা আমি। আমি মাহতাব।”
সবসময় আপনি বলে কাজ চালালেও আজ প্রথম মাহতাব সরাসরি চন্দ্রা বলে ডেকেছে। একমুহূর্তের জন্য চন্দ্রার মনে হয় সে ভুল শুনছে। মাহতাব এত রাতে এখানে কেন হবে! জবাব না দিয়ে স্থানুবৎ বসে থাকে।
“চন্দ্রা, খুলবেন না?”
তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় চন্দ্রা। এ যে সত্যি মাহতাব!
(চলবে)