সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৫
ট্রেন দেড় ঘন্টার ক্রসিং এর জায়গায় দুইঘন্টায় পড়ে। মাহতাব ট্রেনের কামরায় ফিরে এসে দেখে ব্যাগ নিয়ে একটা বড়ো ব্যাকপ্যাক আর ছোটো একটা ট্রলি ব্যাগ নিয়ে ট্রেনে উঠেছিল। ট্রেন থেকে নিচে নামার আগে কোলের ব্যাকপ্যাকটাও ট্রলি ব্যাগের সাথে উপরে উঠিয়ে রাখে। কে ফলো করছিল আল্লাহ মালুম, মাহতাব নামার পর ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। আশেপাশের কেউ নাকি খেয়ালই করেনি ট্রলিব্যাগ আর ব্যাকপ্যাক কে তুলে নিয়ে চলে গিয়েছে। মাহাতাব কিছুক্ষণ এদিক সেদিক খোঁজার বৃথা চেষ্টা চালায়। টিটির হেল্প নেওয়ারও চেষ্টা করে। কিন্তু টিটিও খুব একটা গা করেন না। বরং মাহাতাব কে বলেন এভাবে ব্যাগ রেখে ওর নিচে নেমে যাওয়া একদমই ঠিক হয়নি। প্রচুর লোকাল মানুষ ভেতরে ওঠানামা করে। এখান থেকে ব্যাগ চুরি হওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা।
ফোন নিজের কাছে থাকলেও চার্জার তো ব্যাগের ভেতরেই ছিল। চার্জ দেওয়ার জন্য একটা পাওয়ার ব্যাংকও নিয়ে এসেছিল। সেটাও ব্যাগের ভেতরে। ফোনের চার্জ শেষ হয়ে ফোন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কারও সাথে যোগাযোগ করতে পারছিল না। ফোন বন্ধ হওয়ার আগে দাদাজান কে ফোন দিয়ে ব্যাগ হারানোর কথা বলতে পারতো। কিন্তু ভাবলো বয়স্ক মানুষ টেনশন করবেন। আর মাকে বললেই তো মা আবারও মাহতাবকে খামখেয়ালী বলার সুযোগ পাবে। তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে চুপচাপ সরকার বাড়ি খুঁজে বের করবে এটাই ঠিক করে মাহতাব। ক্রসিং এর বিষয়টা দাদাজানকে জানানো ছিল। একটু লেট হবে পৌঁছাতে তাও জানিয়েছে। কিন্তু এত ঝামেলা হবে মাহতাব বোঝেনি। দাদাজান বলেছিল স্টেশনে কাউকে থাকার জন্য বলবে কিনা? তাহলে ওনার বন্ধুকে অনুরোধ করতেন, স্টেশনে লোক পাঠানোর জন্য। কিন্তু মাহতাব তো নিজেকে প্রাপ্তবয়ষ্ক, প্রাপ্তমনস্ক প্রমাণ করতে মরিয়া। নিজে নিজেই নিজের সবকিছু ম্যানেজ করতে পারবে এটাই তো দেখাতে চায়। তাছাড়া সে ভেবেছে এটা তো আর ঢাকা শহর নয় যে অসংখ্য গলি, অসংখ্য রাস্তা। হুট করে কেউ এসে হারিয়ে যাবে। মফস্বল শহরে একটা বাড়ি খুঁজে বের করা খুব কঠিন কিছু নিশ্চয়ই হবে না। আত্মবিশ্বাস থেকে ঠিকমত রাস্তার নাম, বা জায়গার বিষয়ে বিস্তারিত জানার প্রয়োজনও বোধ করেনি।
স্টেশনে নামে রাত দশটায়। রিকশাওয়ালাকে বলে মেথর গলি, সরকারবাড়ি। রিকশাওয়ালা ঠিক চিনতে পারে না। তবু আন্দাজ মতো নিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে আনলেও কোনো সরকার বাড়ির হদিস পায় না। এদিকসেদিক কিছুক্ষণ রিকশা নিয়ে ঘোরে। সরকার ছাড়া তার আর কোনো কিছু মনে আসে না। এমনকি রহমত সরকারের পুরো নামও না। তিনি যে জেলা শিক্ষা অফিসার ছিলেন, এই তথ্যটা দিলেও বাড়ি খুঁজে পাওয়া সহজ হত। তাও রিকশাওয়ালা ভালো মানুষ। শীতের রাতে পথ হারানো শহুরে মানুষকে একা ফেলে যাননি। নিষ্ঠার সাথে সামান্য তথ্য থেকেই খোঁজার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত উপায় না পেয়ে রিকশাওয়ালার ফোন থেকেই দাদাকে ফোন দেয় মাহতাব। চুরির বিষয়টা এড়িয়ে গিয়ে বলে ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ক্রসিং এ লেটও হয়েছে অনেক। এখন বাসার ঠিকানা মনে করতে পারছে না।
অবশেষে রাত সাড়ে এগারোটায় মেথরপট্টির সরকার বাড়ির খোঁজ পায় মাহতাব। মেথর গলি আর মেথর পট্টি নামের পার্থক্যে ঠিকানা বদল হয়ে গিয়েছে। মাহতাবের গায়ে পাতলা সুয়েটার ছিল। ঢাকায় ঠান্ডা অতটা মালুম হয়নি। অথচ ব্যাগ হারানোর পর থেকে কাপড় নেই মনে হতেই মনে হয় শীত গায়ে বেশি ঝাঁকিয়ে বসেছে। রিকশা চলতে শুরু করলে মাহতাবের মনে হয়েছে গতবছর কাশ্মিরে গিয়েও এই শীত টের পায়নি। এই শীতে মনে হচ্ছে নাক, কান সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
***
নাতি বাড়ি খুঁজে পাচ্ছে না তা রহমত সরকারকে জানিয়েছেন ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব। ঠিকানা বুঝিয়ে দিয়ে রহমত সাহেব ঘুমুতে গিয়েছেন। বাইপাস হওয়ার পর থেকে তিনি রাত জাগতে পারেন না। অসুস্থ বোধ করেন। নাহার বেগমও শুয়ে পড়েছেন। জুয়েনার মাইগ্রেনের ব্যথা উঠেছে। সন্ধ্যার পর থেকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে। ফিরোজ সরকারে নিচে থাকতে চেয়েছিলেন। চন্দ্রই তাকে জোর করে উপরে পাঠিয়ে দেয়। এই ঠান্ডার ভেতর বসার ঘরে বাবা বসে থাকুক, তা চন্দ্র চায় না। এমনিতেও ফিরোজ সাহেবের ঠান্ডার ধাত আছে। শীতকালে এজমার সমস্যা বাড়েে। মৃদুলাও আর শীতের ভেতর নিচে নামেনি। ধনুকে বলাই ছিল। কাচারী ঘরে ঘুমায় ধনু। বলা ছিল কেউ গেটে আসলে গেট খুলে দিয়ে চন্দ্রকে ডাকতে। চন্দ্র বারান্দার গ্রিল লাগিয়ে বসার ঘরে পেরিয়ে লাইব্রেরিতে যায়। জিনিসগুলো এলোমেলো হয়ে আছে, এমনি বসে থাকার চেয়ে তাই গোছানোতে মন দেয়। লাইব্রেরিটা রাস্তার দিকে। রাস্তার অপরপাশে দীঘি। জানালা খুললেই ঠান্ডা বাতাস। তাই এই রাতে জানালা লাগানোই থাকে।
“আপনি জানালায় খুটখুট করছেন কেন? গেটে নক করেননি?”
“করেছিলাম। কেউ খোলে না।”
দীঘির ঠান্ডা বাতাসে মাহতাবের হাড় পর্যন্ত জমে যাচ্ছে। না চাইলেও দাঁতে দাঁত বাড়ি খায়। চন্দ্র বুঝতে পারে।
“আসেন, সামনে গেটে আসেন। ধনু ভাই বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। টের পায়নি। জোরে ধাক্কাবেন না! এত ভদ্রতা করে নক করলে কে শুনবে! আসেন আসেন।”
ধনু আসলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ধনুকে ডাক দিয়ে চন্দ্র মাথায় চাদর জড়িয়ে নিচে বারান্দা থেকে নামে। ধনু গেট খুলে দিলে মাহতাবকে চন্দ্র ভেতরে চলে আসতে বলে।
“ব্যাগপত্র কই?”
“নাই।”
“ঢাকা থেকে এমনি এসেছেন?”
“ট্রেনে চুরি হয়ে গিয়েছে। স্যরি।”
মাহতাবের এত লজ্জা লাগছে। চন্দ্র পথ দেখিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে। পেছন পেছন মাহতাবও ওঠে।
“আরে আপনার ব্যাগ চুরি হয়েছে। আপনি আমাকে স্যরি কেন বলেন? দাঁড়ান একটু, বাবাকে ডাক দেই।”
চন্দ্র আস্তে পা টিপে বাবা মায়ের রুমে যায়। ফিরোজ সাহেব রুমের দরজা খোলাই রেখেছেন। চন্দ্র কাছে গিয়ে দেখে মা ঘুমিয়ে পড়েছে। ফিরোজ সাহেব মেয়েকে দেখে আস্তে উঠে আসেন।
“এসেছে?”
“হ্যাঁ বাবা। বাবা তোমার একটা লুঙ্গি দিও, টিশার্ট আর সুয়েটার বা চাদর দিও। তোয়ালে আমার একটা আছে নতুন। সেটাই দেব।”
“এসব কেন দিবি?”
“ব্যাগ চুরি হয়ে গিয়েছে। তুমি নিয়ে আসো। আমি ওনাকে উপরে না পাঠিয়ে আগে খেতে বসাই। মনে হচ্ছে ক্ষুধার্ত।”
ফিরোজ সাহেবের উচ্চতা কম। তাই ওনার প্যান্ট মাহতাবের গায়ে লাগবে না। চন্দ্র তাই লুঙ্গি, দিতে বলেছে। একটু ভারী শরীর বলে টিশার্ট আবার ঢোলাঢালা। মাহতাবের লুঙ্গি পরার অভ্যাস নেই। বাসায় ট্রাউজার, থ্রি কোয়াটার পরে থেকেছে। চন্দ্র ওর হাতে কাপড়গুলো দেওয়ার আগে মগে গরম পানি ঢেলে এনেছে। শব্দ শুনে মৃদুলাও খাওয়ার ঘরে এসে দাঁড়ায়। শীতে কাতর, নতুন পরিবেশে হতবিহ্বল এক সুদর্শন যুবককে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অবাকই হয়। দাদার বন্ধুর নাতি আসবে শুনে মৃদুলার আলাদা কোনো অনুভূতি ছিল না। এখন সামনাসামনি দেখে অবাকই হয়। ছেলেদের জন্য সুন্দর বিশেষণ কেন জানি মানুষ ব্যবহার করে না। অথচ একদেখায় বলা যায় লোকটা পুরুষ হিসেবে নিখুঁত সুন্দর। চাঁদের দাগের মতো সামান্য খুঁত বলতে কপালের উপর ডান ভ্রুের কাছে একটা কাটা দাগ আছে।
“মৃদু, এসেছিস। ভালো হলো, ওনাকে বাথরুমটা দেখিয়ে দে। গরম পানির মগটা নিয়ে যা।”
চন্দ্র ব্যস্ত হাতে টেবিল গোছাচ্ছে। খাবার গরম দিয়েছে। ঠান্ডা ভাতের সাথে ঠান্ডা তরকারি খেতে পারবে না। মাহতাবের ভালো লাগে। এই পরিবারের মানুষগুলো মায়া আছে। ফিরোজ সাহেব কী সুন্দর নিজের কাপড় দিলেন। গায়ে না লাগুক, দিয়েছেন তো। চন্দ্র যত্ন করে পানি গরম করে দিলো। অথচ এদের জন্য তো ও বলতে গেলে ভাড়াটে। হয়তো তাদের দাদার বন্ধুর ছেলে বলে করছে। তবুও করছে তো।
টিশার্ট পরলেও লুঙ্গি কিছুতেই বাঁধতে পারছে না মাহতাব। ভয় লাগছে বাইরে গেলে দু দুটো মেয়ের সামনে যদি বাঁধন খুলে পড়ে যায়। কী অবস্থা হবে।
“ঠক ঠক ঠক”
বাথরুমের দরজায় নক হচ্ছে।
“আপনাকে দাদাজানের পায়জামা দিচ্ছি। তিনি লম্বা মানুষ। আপনার গায়ে হবে। দরজাটা একটু ফাঁকা করুন।”
(চলবে)