সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী পর্ব-০৬

0
2

সেই মেয়েটা চন্দ্রাবতী
পর্ব ৬

রহমত সাহেবের পায়জামা বেশ লম্বা। মাহাতাব কোনরকমে পায়জামার ফিতে লাগিয়ে বের হয়ে আসে। যদিও পায়জামাটা পরতে তার খুবই অস্বস্তি লাগছিল। অন্য কারও পোশাক পরার অভিজ্ঞতা তার নেই। নানা প্রশ্ন মনে উঁকি দিচ্ছে। বয়স্ক একজন লোকের পায়জামা, না জানি তার কোনো চর্মরোগ আছে কিনা? পায়জামাটা পরিষ্কার কিনা? তারপরও লুঙ্গি পরার চেয়ে ভালো। মনে মনে চন্দ্রকে ধন্যবাদ দেয়। লুঙ্গি পরে সে আসলেই বের হতে পারত না।

মাহতাবের বের হতে দেরি হচ্ছে দেখে চন্দ্র বুঝে ফেলে কী সমস্যা। দাদার রুম থেকে একটা পায়জামা নিয়ে আসে। এখন মাহতাবকে কাঁচুমাচু হয়ে হাঁটতে দেখে মনে হচ্ছে মাহতাব পায়জামা পরেও স্বস্তিতে নেই।

“তুমি লুঙ্গি পরতে পারো না?”

“জি না আঙ্কেল। আসলে অভ্যাস নেই।”

“এইটা কোনো কথা? তোমরা আজকালকার ছেলেরা লুঙ্গি পরতে পারো না। অথচ লুঙ্গি ছেলেদের জন্য একটা শান্তির পোশাক। গরমে লুঙ্গি হলো আশীর্বাদ। শীতকালে অবশ্য একটা সমস্যা হয়। পা জমে যায়। আমি তাই ট্রাউজার পরে লুঙ্গি পরি।”

“আহ্ বাবা। কী শুরু করলা। পোশাক সেটাই আরামের যেটা পরে মানুষ স্বস্তি পায়। বেচারা শহরের মানুয। লুঙ্গি নাই পরতে পারে।”

“লুঙ্গি জাতীয় পোশাক। এর আবার শহর গ্রাম কী রে বেটি।”

মাহতাবের সেই খিদে পেয়েছে। মৃদুলা রানাঘর থেকে বাটিগুলো এনে টেবিলে রাখছে। আড়চোখে সেদিকে তাকিয়ে মাহতাবের পেটে গুড়গুড় করতে থাকে। পেটের ভেতর ইঁদুর দৌড়ের কথা এতদিন শুধু শুনেছে। আজ অনুভবও হয়ে গেল। অথচ এরা বাবা মেয়ে কী লুঙ্গির পেছনে পড়লো। মনে হচ্ছে লুঙ্গি পরা কোনো লাইফ স্কিল। আর তা না পারা একটা অপরাধ।

“আপনার কাপড় গুলো রান্নাঘরের দড়িতে ঝুলিয়ে দিলাম। সকালে পরতে পারবেন। সকালে বাবার সাথে বাজারে গিয়ে কাপড়চোপড় কিনতে পারবেন। চলার মত কিছু কাপড় তো আপনার কিনতে হবে।”

“হ্যাঁ। আমার আসলে অন্যের কাপড় পরার অভ্যাস নেই।”

“সেটাই তো স্বাভাবিক। তোমার কী মনে হয় আমরা একজন আরেকজনের কাপড় পরি? আজ একটা বিপদে পড়েছ তাই তোমাকে আমার কাপড় দিলাম।”

ফিরোজ সরকারের কথায় মাহতাব থতমত খেয়ে যায়। মৃদুলা ডাকায় চন্দ্র রান্নাঘরে গিয়েছে।

“জি জি। মানে জি।”

“কী জি জি করছ। তোমার বয়স কত হলো? প্রথম চাকরি না? এসএসসি এইচএসসি কত সালে?”

“পঁচিশ শেষ হলো। আমি ষোল আঠারো সেশনের।”

“আচ্ছা আমার তাহলে জুনিয়র তাহল। আমি পনেরো সতেরো সেশনের।”

চন্দ্র টেবিলের কাছ থেকে উত্তর দেয়।

“খাওয়া দেওয়া হয়েছে।”

ফিরোজ সরকার মাহতাবকে নিয়ে টেবিলের কাছে যায়।

“বাবা, তুমি শিক্ষক মানুষ বলে কম বয়সী কাউকে পেলেই তোমার ছাত্র ভাবা শুরু করো। এবার বেচারাকে শান্তিতে খাইতে দাও। বোঝাই যাচ্ছে অনেক ক্ষুধার্ত।”

“না না আমি ক্ষুধার্ত না। বিকেলে বন রুটি খেয়েছি।”

“বিকাল শেষ হয়ে এখন মধ্যরাত।”

যদিও মাহাতাব খিদের কথা মুখে স্বীকার করতে চায়নি তবে সত্যিটা হলো এটাই তো সে আসলেই ভীষণ ক্ষুধার্ত। বনরুটি দুটি বহু আগেই হজম হয়ে গিয়েছে।
খাবারের আয়োজন সাধারণ। ঘন ডাল, শীতকালের জাতীয় তরকারি- ফুলকপি, শিম, আলু টমেটো শিং মাছ দিয়ে রান্না আর কাঁচা টমেটো কুঁচি করে ভাজি। খাবার নিয়ে নখড়া করার কথা এই মুহূর্তে মাহতাবের মাথায় আসে না।
পৃথিবীর সবচাইতে সুস্বাদু খাবার হলো ক্ষুধার্ত অবস্থায় খাওয়া খাবার। ক্ষুধার্ত অবস্থায় শুধু লবণ দিয়ে সেদ্ধ ভাত খেতেও অমৃত লাগে। স্বাভাবিক সময়ে শিং মাছ দিয়ে এক গামলা তরকারি রান্না করা হলে সে জীবনেও খেতে আগ্রহী হতো না। অথচ এখন তার কাছে মনে হচ্ছে তার জীবনের একটা বেস্ট খাবার সে এতদিন মিস করেছে। গরম গরম ফুলকপি শিম আলুর তরকারির মতো অসাধারণ খাবার দ্বিতীয়টা হতেই পারে না। ফুলকপিগুলো গোটা গোটা আছে কিন্তু সেদ্ধ হয়ে নরম হয়ে গিয়েছে। মুখে দিলেই মিশে যাচ্ছে। কাঁচা টমেটোর যে ভাজিও হয়, এটা তার জানা ছিল না। দুইবার ভাত নেওয়ার পর তৃতীয়বার ভাতের জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে একটু লজ্জা পেয়ে যায় মাহতাব। মৃদুলা ঘরে চলে গেলেও চন্দ্র আর ফিরোজ সাহেব সাহেব এখানেই আছেন। তারা কী ভাববেন! ভাববে মাহতাব যেন কতদিন পেট ভরে খায়নি। অথচ খাবার নিয়ে মাহাতাব ভীষণ রকমের বাছবিচার করা ছেলে, যাকে আধুনিক ভাষায় বলে চুজি।

চন্দ্র আরেক চামচ ভাত দেয়। ভাত ওদের একটু বেশিই রান্না করা হয়। সকালে ধনু বারোমাসই ভাত খায়। রুটি তার গলা দিয়ে নামে না। যে খালা আসে মায়ের হাতে হাতে কাজ এগিয়ে দিতে। সে ভাত খায়। তাই ভাত সবসময় বাড়তি রান্না হয়। আজ তো মাহতাব আসবে বলে চাল আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

“আরে আর লাগবে না।”

“একটু ডাল আর টমেটো ভাজি দিয়ে খেলে ভালো লাগবে।”

***

চন্দ্র মগে করে ঘন দুধ চা বানিয়ে এনেছে। এখানে কফি পাওয়া যাবে কিনা নিশ্চিত না থাকায় মাহতাব কফির বড়ো একটা পট কিনেছিল। একটা ওয়াটার হিটার নিয়েছিল। যখন তখন কফি বানাতে সুবিধা হবে ভেবে। কিন্তু ব্যাগের সাথে সেসবও চলে গিয়েছে। একবার ভেবেছিল চায়ের জন্য না করে দিবে। কিন্তু ঠান্ডায় আরাম হবে ভেবে না করে না। কিন্তু চা মুখে দিয়ে মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দেয়। পানির মতো টলটলে না। বরং বেশ কড়া লিকারে করা।

“দুধ চিনি কিছু লাগবে?”

“না না, চিনি এমনিতেই খাওয়া হয় না। চা-টা খুব ভালো হয়েছে। আমি তো চা খাই না। তারপরও এত ভালো লাগছো।”

“তোমার কী ডায়াবেটিস আছে নাকি? চিনি খাও না, চা খাও না, লুঙ্গি পর না। শহরে বড়ো হওয়া ছেলেপেলেরা আসলেই মুরগী হচ্ছে নাকি?”

“না মানে। জি জি।”

“এই জি জি আবার কী?”

“বাবা, অনেক রাত হয়েছে। বাকি ইন্টারভিউ সকালে নিলে হয় না? মা একবার এসে দরজায় উঁকি দিয়ে গেছে। চা শেষ করে শুতে যাও। ওনাকে উপরে রুমটা দেখিয়ে দিতে হবে তো। আমি শুতে যাব।

***

রাত কম হয়নি। চারদিক নিস্তব্ধ। সারাদিনের উত্তেজনায় মাহতাব টের পায়নি। এখন ছাদের উপর এই একলা রুমে দুনিয়ার একাকিত্ব এসে ঘিরে ধরছে। মনে হচ্ছে দুনিয়া হতে বিচ্ছিন্ন জায়গায় এসে পৌঁছেছে। স্মৃতিরা সব হানা দিচ্ছে একসাথে। স্মৃতিদের হাত থেকে পালাবে বলেই এতদূর আসা। অথচ স্মৃতিগুলো সব মাথায় করে তার সাথে এসেছে। বিছানায় মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে মাহতাব। এই কামরাটাকে ওর নদীর উপর একটা নৌকা মনে হচ্ছে। পানির স্রোতের সাথে নৌকা অল্প অল্প যেমন দুলে। রুমটাও তেমনই যেন দুলছে। মাহতাব চোখ বন্ধ করে। এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে তার চোখের কোল ঘেঁষে।

(চলবে)