সে আমার অপরাজিতা পর্ব-০১

0
181

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১
#সারা মেহেক

” ছেঁড়া শাড়ি পরে এভাবে ভার্সিটির নবীন বরণে আসার যুক্তি কি বিন্দু? বিবেক বুদ্ধি কি সব লোপ পেয়েছে?”

মারিয়ার তীর ছোঁড়া কথায় বিন্দুর মুখখানা গোমড়া হলো। খানিক ব্যথিতও হলো সে। নিজের শাড়ির দিকে একবার চেয়ে বললো,
” শুধুমাত্র আঁচলটাই তো ছেঁড়া! ”

মারিয়া বিস্ময়ে গলা চড়াও করলো। বললো,
” এটা তোর কাছে মাত্র মনে হয়! দূর থেকে দেখতে কেমন লাগছে দেখেছিস একবারোও? মান সম্মানের কোনো খেয়াল আছে? মানে… আক্কেল কি সব বাসায় রেখে এসেছিস আজ?”

একত্রে এতগুলো প্রশ্নের চাপে পড়ে সংকুচিত হলো বিন্দু। নিজের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করার সাহস হলো না মারিয়ার ঐ কড়া দৃষ্টিজোড়ার সম্মুখে। এমনিতে মারিয়া তার ভীষণ ভালো বান্ধবী। ভার্সিটিতে এসে এই একজনের সাথেই খুব ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার। তবে মারিয়া বেশ শক্ত স্বভাবের মেয়ে। মাঝে মাঝে তার আচার আচরণ, কথাবার্তার সামনে একটি ছেলেও যেনো ছোট পড়ে যায়। সবসময় এক কথায় জবাব দিতে পছন্দ করে সে। আর পরিস্থিতি বিবেচনায় কারোর মুখের উপর সত্য কথা বলতেও দ্বিধা বোধ করে না সে।
বিন্দু মারিয়ার ঐ রুষ্ট চাহনির সামনে নিরীহ কণ্ঠে বললো,
” আমি কি ইচ্ছে করে পরে এসেছি নাকি! রিকশা থেকে নামতে গিয়ে এক পেরেকে আটকে এভাবে ছিঁড়ে গিয়েছে। তখন যে আবার বাড়ি গিয়ে শাড়ি বদলিয়ে আসবো সে সুযোগ ছিলো না। আর হোস্টেলেও শাড়ি ছিলো না। জানিসই তো।”
বলেই সে মারিয়ার নিকটে দাঁড়িয়ে তার বাহু চেপে বাচ্চাদের মতো আদুরে কণ্ঠে বললো,
” এই বান্ধবীকে একটু হেল্প করবি না তুই? তোর হেল্প ছাড়া সারা ভার্সিটিতে আমাকে এভাবে ঘুরতে হবে। করবি না হেল্প?”

বিন্দুর আদুরে কথার ছলে মোমের ন্যায় গলে পড়লো মারিয়া। কিন্তু ভাব দেখানোর জন্য কপট রাগ নিয়ে ভ্রুজোড়া কুঞ্চিত করে বললো,
” হয়েছে হয়েছে ঢং করিস না। তোর সব সমস্যা তো এই একটা মানুষের সামনে এসেই তৈরী হয়। আর সেসব সমস্যা সমাধানের জন্যও এই মানুষটাকে পাস। এখন হোস্টেলে যাওয়ার সময় নেই। ওয়াশরুমে চল। আমি ব্যবস্থা করছি।”

মারিয়া বিন্দুকে নিয়ে লেডিস ওয়াশরুমে চলে এলো। নিজের ব্যাগ থেকে কয়েকটা সেফটিপিন বের করে আধ ছেঁড়া আঁচল একত্র করে পিনআপ করলো। অতঃপর বিন্দুকে আপাদমস্তক একবার দেখে বিস্তৃত হেসে বললো,
” তোকে আজ ভীষণ সুন্দর লাগছে বিন্দু। শাড়ীর কালার কম্বিনেশনটা জোস। নীল, সাদা। আজ নিশ্চিত সিনিয়রদের মাথা খারাপ করে দিবি তুই। ”

বিন্দু মারিয়ার কথার তোয়াক্কা করলো না। আয়নার সম্মুখে দাঁড়িয়ে পরনের হিজাব ঠিক করতে করতে বললো,
” এসবের প্রতি আমার একটুও ইন্টারেস্ট নেই মারিয়া। আজ শাড়ি পরতাম না। শুধুমাত্র সিনিয়র আপুদের থ্রেটের জ্বালায় পরেছি। আসলে শাড়ি সামলানো আমার দ্বারা সম্ভব নয়। তাই তো একটা অঘটন ঘটিয়ে বসেছি। বাসায় গিয়ে খালাকে কি জবাব দিবো তাই ভেবে কূল পাচ্ছি না।”

” এতো ভাববার কি আছে। তোর খালা বেশ চিল টাইপের মানুষ। উনি তেমন কিছু বলবে না দেখিস।”

” অন্য শাড়ির ছিঁড়ে গেলে হয়তো কিছু বলতো না। কিন্তু এটা খালুর পছন্দে কেনা শাড়ি। আর সে শাড়িই আমি ছিঁড়ে বসে আছি।”
বলেই সে মারিয়ার দিকে চাইলো। মারিয়া চুলে খোঁপা করে এসেছিলো। সে একনজর দেখা মাত্রই মারিয়ার চুলের খোঁপা খুলে দিয়ে বললো,
” এখন তোকে সুন্দর লাগছে। আজ সিনিয়ররা আমাকে না,তোকে দেখে পাগল হবে নিশ্চিত। ”

মারিয়ার তখন একরাশ হতাশা নিয়ে বললো,
” আর পছন্দ! আমার এ ছেলে ছেলে টাইপের চালচলন, কথাবার্তা, ভাবসাব দেখেই তো সবাই এক মাইল দূর থেকেই দৌড়ে পালাবে। ”
বলেই মুহূর্তেই সে নিজের হতাশাগ্রস্ত মেয়েলী সত্তাকে দূরে ঠেলে কড়কড়ে প্রত্যয়ী গলায় বললো,
” হু কেয়ারস! আমাকে কেউ পছন্দ করুক বা না করুক আমি কাউকে পরোয়া করি না কি! দরকার নেই ওসব আপদ বিপদকে ঘাড়ে বসানোর।
আচ্ছা, এখন অডিটোরিয়ামে চল জলদি। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গিয়েছে আরোও আধ ঘণ্টা আগে। কোনো সিনিয়রের চোখে পড়লে আজকের দিনটাই মাটি।”

মারিয়া ও বিন্দু দ্রুত পায়ে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে অডিটোরিয়ামের দিকে গেলো।
মারিয়া আর বিন্দুর বন্ধুত্বের সূচনা ভার্সিটির প্রথম দিন থেকেই। হোস্টেলের গণরুমের পাশাপাশি দুটো সিটে তাদের সিট পড়েছে। উপরন্তু তাদের সাবজেক্টও এক। এজন্য বন্ধুত্বটা আরো জমেছে ভালো। সর্বপ্রথম মারিয়া বিন্দুর সাথে ভাব জমাতে শুরু করে। কিন্তু প্রারম্ভে মারিয়ার ছেলেসুলভ আচার আচরণ বিন্দুর খুব একটা ভালো লাগেনি। অবশ্য পরে ঠিক এই কারণেই তাদের দুজনের মাঝো বন্ধুত্বটা গাঢ় হয়। মারিয়ার এরূপ ছেলেসুলভ, প্রতাপ কথাবার্তায় গণরুমের সকলে খানিক ভয়ে ভয়ে থাকে। ফলে তার সাথে মেশার মতোও কেউ থাকে না বিন্দু বাদে।

বিন্দু মূলত হোস্টেলে থাকে। তবে ভার্সিটি ছুটি দিলেই সে খালার বাসায় ছুটে যায়। তার ভার্সিটি থেকে খালার বাসার দূরত্ব প্রায় পয়তাল্লিশ মিনিটের মতো। এখানেই সে প্রায় সময় কাটায়।

আজ ভার্সিটির নবীনবরণ। পনেরোদিন পূর্বেই নবীনবরণ হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু ভার্সিটির অস্থিতিশীল পরিবেশের কারণে তখন অনুষ্টান আয়োজন করার সুযোগ হয়নি। তাই আজ এ আয়োজন করা।
বিন্দুর কাছে হোস্টেলে কোনো ভালো শাড়ি না থাকায় গতকাল খালার বাসায় চলে যায় সে। সেখানে বেছে বেছে সবচেয়ে সুন্দর শাড়িটা পরে আসে। কিন্তু ভার্সিটির গেটের সামনে এসে রিকশা হতে নামতেই ঘটলো দূর্ঘটনা। অসাবধানতাবশত রিকশারই এক পেরেকের সাথে লেগে আঁচলের প্রায় অর্ধাংশ ছিঁড়ে গেলো। তা দেখে ওখানেই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো বিন্দু। তার খালার শখের শাড়ি এভাবে ছিঁড়ে যাবে তা কল্পনাতীত ছিলো তার জন্য।

.

অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠান চলছে। দুটো গ্রুপের দলীয় নৃত্য শেষে উপস্থাপক নতুনরূপে ঘোষণা করলো,
” এবার আমাদের মাঝে গান নিয়ে আসছেন ভার্সিটির মোস্ট সিনিয়র,মোস্ট এলিজ্যাবল ব্যাচেলর, মাস্টার্স ব্যাচের বৃত্ত ভাই। সকলে করতালির মাধ্যমে তাকে আমন্ত্রণ জানান।”
বলেই সে চলে গেলো। মঞ্চের পর্দা পড়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। ততক্ষণে পিছনে গানের প্রস্তুতি নিলো বৃত্ত। একটা চেয়ারে বসে গিটার হাতে নিলো সে। তার নির্দেশনাতেই পর্দা উঠানো হলো। শুরু হলো গান,
” এ যেন সহজ স্বীকারোক্তী আমি যুগান্তরী নই
এ যেন ভীষন আক্ষেপ আমার আমি দীগ্বিজয়ী নই
শুধু একটাই আশা আমি বুকে জড়িয়ে রবো সারাটি জীবন তোমায় নিয়ে
কোনো এক নিঃসংগ রোদেলা রাতে দেখেছি, প্রিয়তমা তোমার চোখে মিষ্টি হাসি
কোনো এক দুঃসহ জোৎস্না দিনে বাতি নেভে গেলে
কড়া নেড়িছি তোমার হাতের ঘরে
কিছু অর্থহীন শব্দ বুনে ডেকেছি তোমায়
প্রেম তুমি কোথায়
বিন্দু আমি তুমি আমায় ঘিরে, বৃত্তের ভেতর শুধু তুমি আছো
মাতাল আমি তোমার প্রেমে, তাই অর্থহীন সবি যে প্রেমে লাগে…….”
গান শেষ হতেই করতালির শব্দে পূর্ণ হলো অডিটোরিয়াম। সকলের করতালিতে মিষ্টি ভদ্রতাপূর্ণ হাসি দিলো বৃত্ত। তার এ হাসিতে যেনো সেখানেই কাঁত হলো কতিপয় জুনিয়র মেয়েরা। বৃত্তের পরনে আজ পেস্টেল ব্লু কালারের একটা পাঞ্জাবি। মাথার ঘন চুলগুলো অগোছালোভাবেও সযত্নে গুছিয়ে রাখা আছে। গালে ঘন খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। মোটা ভ্রুজুগলের নিচে প্রশান্ত দুটো চোখ। চেহারায় সবসময়কার মতো এক গাম্ভীর্যপূর্ণ ভাব। যেনো এ গাম্ভীর্যতার মাধ্যমেই সকলকে কাবু করে ফেলবে। অন্যান্যরা হয়তো এই গাম্ভীর্যতাকেই ভয় পাবে। কিন্তু জুনিয়র মেয়েরা বৃত্তের এ গুরুগম্ভীর চেহারাখানাই ভীষণ পছন্দ করলো। অডিটোরিয়ামে বসে বসেই নতুন আগমন অগণিত মেয়ের ক্রাশ লিস্টে নাম তুললো বৃত্ত।

জুনিয়র মেয়েরা নিজেদের মধ্যে বৃত্তকে নিয়ে তুমুল আলোচনা শুরু করলো। তাদের এ আলোচনা পাশ থেকেই শুনছিলো বিন্দু ও মারিয়া। দুজনেই একারণে যারপরনাই বিরক্ত হলো। মারিয়া ফিসফিস করে বললো,
” দেখ দেখ, ব্যাচে কত্তগুলো বেহায়া মেয়ে বসবাস করছে! আরে, আমাদেরও তো ভালো লেগেছে সিনিয়রটা। কিন্তু আমরা কি ওমন প্যাচাল শুরু করেছি!”

মারিয়ার কথা শোনামাত্র বিন্দু চট করে পাশে ফিরে তাকালো। কিঞ্চিৎ বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” তোর পছন্দ হয়েছে!”

বিষয়টি বেশ স্বাভাবিক এমন ভাব ধরে মারিয়া বললো,
” না হওয়ার কি আছে? উনি পছন্দ হওয়ার মতোই একজন। কেনো, তোর পছন্দ হয়নি?”

” এখানে পছন্দ, অপছন্দের কি আছে বুঝলাম না। আর উনাকে পছন্দই বা করতে হবে কেনো। উনি…”

বিন্দুর মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে মারিয়ে বললো,
” তুই দেখি আমার সাধু সন্ন্যাসী লেভেলের বান্ধবী! যে সুন্দর ছেলেকে দেখলেও গায়ে লাগাবে না। টিপিক্যাল পড়ুয়া স্টুডেন্টের মতো সারাদিন পড়া আর পড়া। কোনো প্রেম ভালোবাসায় জড়াবে না সে।”

মারিয়ার কথার জবাব দিতে যাবে বিন্দু, কিন্তু এর পূর্বেই সে শাড়ির আঁচলের দিকে আচমকা টান অনুভব করলো। সাথে শুনতে পেলো ফরফর এক শব্দ, যেনো কোনো কাপড় ছিঁড়ে যাচ্ছে। চমকে বা দিকে তাকালো বিন্দু। দেখলো তার শাড়ির আঁচলখানা পূর্বের চেয়েও বাজেভাবে ছিঁড়ে গিয়েছে। আর সে আঁচল ছিঁড়েছে স্বয়ং বৃত্ত।

পারফরম্যান্স শেষে দু সারি সিটের মাঝখানের সিঁড়ি বেয়ে চলে যাচ্ছিলো বৃত্ত। সিঁড়ি পাশের সিটে বসে থাকা বিন্দু আনমনে সেখানে শাড়ির আঁচল ফেলে রেখেছিলো। আর সেই আঁচলেই অসাবধানতাবশত পা আটকে যায় বৃত্তের। আর তখনই পিনআপ করার আঁচলটা আরো বর্ধিত এবং বাজেভাবে ছিঁড়ে যায়।
শাড়ির আঁচলখানা ছিঁড়ে বৃত্ত হা করে তাকিয়ে রইলো শাড়ির দিকে। আর বিন্দু সেদিকে তাকাতেই দু’জনে একে অপরের দিকে চরম বিস্মিত এবং স্তব্ধ চাহনিতে চেয়ে রইলো।
পরবর্তী পর্ব পেতে পেইজ ফলো দিয়ে রাখুন: সারা মেহেক । Sara Jahan Mehek
®সারা মেহেক

#চলবে কি?