সে আমার অপরাজিতা পর্ব-০৮

0
143

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৮
#সারা মেহেক

আশরাফের কথায় বৃত্তের মেজাজ চটে গেলো। অবাধ ক্রোধে তার চোয়ালটা শক্ত হয়ে এলো। দু গালের হাড় দুটো ধারণ করো তীক্ষ্ণ আকার। সে ক্রোধে আগুন হয়ে বললো,
” মুখ সামলে কথা বল আশরাফ। যে বিষয়ে জানিস না সে বিষয়ে কথা বলতে আছিস না। বিন্দু আমার গার্লফ্রেন্ড না। ”

আশরাফ বৃত্ত’র রোষানলে পড়েও কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখালো না। বরং পূর্বের ন্যায় গা ছাড়া ভাব নিয়ে বললো,
” ও গার্লফ্রেন্ড না। তাহলে বউ নিশ্চয়ই? কিন্তু বিয়ে করলি কবে? আমাদের যে দাওয়াতও করলি না। এটা কিন্তু একদম ঠিক করিসনি বৃত্ত।”

” তোকে সব বিষয়ের কৈফিয়ত দিতে আমার ঠ্যাকা পড়েনি আশরাফ। আমি যার সাথেই ঘুরি, যেখানেই যাই না কেনো, এতে তোর নাক গলাতে কে বলেছে? নিজের জীবন নিয়ে খুশি না তুই যে অন্যের জীবন নিয়ে প্রশ্ন-উত্তর পর্ব খেলছিস?”
বলেই সে আশরাফের দিকে এগিয়ে গেলো। আশরাফের দৃষ্টি বরাবর চেয়ে কাঠিন্যপূর্ণ দৃষ্টিতে বললো,
” নিজের কাজ নিজে কর। আর আমার ব্যাপারে নাক গলাতে আসবি না ভুলেও। আর বিন্দুকে নিয়ে ভার্সিটিতে একটা কথা উঠলে তোর একদিন কি আমার একদিন।”
বলেই বৃত্ত আশরাফকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলো। পিছে আশরাফ বৃত্ত’র এহেন আচরণে আনমনে হাসলো। তার মস্তিষ্কে খেলে গেলো কিছু পরিকল্পনা। বিস্তার এক ক্রুর হাসি দিয়ে বৃত্ত’র উদ্দেশ্যে বললো,
” খাঁচায় বন্দি করার মতো পাখি বোধহয় পেয়ে গিয়েছি বৃত্ত। শুধু একটু নিশ্চিত হওয়া বাকি। ”

————-

নিকষ কালো আকাশে নিজেকে পরিপূর্ণভাবে আলোকিত করে রেখেছে আজকের পূর্ণিমার চাঁদ। ফলে গাঢ় ধূসর কালো মেঘের আনাগোনা চোখে পড়ছে স্পষ্টভাবে। শিরশিরে হাওয়া বইছে প্রকৃতিতে। সে হাওয়াতে দুলছে হোস্টেলের সামনের বিশাল ঝোপালো লাল জবার গাছটি। তার তালে তালে দুলছে মাঝারি আকৃতির অপরাজিতা গাছটি। বিন্দু খাটে বসে জানালা দিয়ে আনমনে চেয়ে আছে সেদিকে। আজকের দিনটা তার ভালো কাটেনি। সকালের সেই ভয়টাও এখনও পুরোপুরি কাটেনি। বারংবার শুধু বিশ্রী বিশ্রী চিন্তাগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। ভাবছে, সে মুহূর্তে বাদল না এনে আজ কত বড় সর্বনাশ হয়ে যেতো তাদের দুজনের! এসব ভেবেই প্রলম্বিত এক দীর্ঘশ্বাস ফেললো বিন্দু। তার এ দীর্ঘশ্বাসের কারণ অজানা নয় মারিয়ার। আজকের ঘটনা একটু হলেও নাড়িয়ে দিয়েছে খোদ মারিয়াকেও। কল্পনায়ও ভাবেনি এমন একটা দিনও আসবে তার জীবনে।
দুজনের একজনও গণরুমের কাউকে বলেনি এ ব্যাপারে। কারণ বললেই যে তিল থেকে তাল হয়ে পুরো ভার্সিটি ছড়িয়ে যেতে সময় লাগবে না তা বেশ ভালোই জানা আছে দুজনের।

মারিয়া বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
” কালকে তোর খালার বাসায় যাবি না?”

বিন্দু মারিয়ার দিকে ফিরে তাকালো। বললো,
” হ্যাঁ, কালকেই যাবো। তুই বাড়িতে যাবি না?”

” হ্যাঁ, আমিও কাল যাবো। শোন, আজ যা হয়েছে এ নিয়ে বাড়িতে কাউকে বলিস না৷ অযথা টেনশন করবে।”

বিন্দু মৃদু হেসে বললো,
” তোকে আর বলতে হবে না। আমার টেনশনের গোডাউন খালাকে এ ব্যাপারে বললে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে নিবে। তাই খালার কানে এ ঘটনা ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ”

” হুম ঠিক বলেছিস।
আচ্ছা, চল শুয়ে পড়ি এখন। রুমের প্রায় সবাই শুয়ে পড়েছে। ”

” হ্যাঁ ঘুমাবো আমি। মাথাটা একটু হালকা করার প্রয়োজন। ”

বিন্দু ও মারিয়া দু’জনেই শুয়ে পড়লো। শুয়ে পড়ার দু মিনিটের মাথায় ঘুমে কাতর মারিয়া। কিন্তু বিন্দুর তখনও ঘুম আসছে না।
হঠাৎ বালিশের কাছে থাকা ফোনটা সশব্দে বেজে উঠলো। চমকে উঠলো বিন্দু। ফোন রিসিভ করার পূর্বেই ভলিউম বাটন চেপে রিংটোন বন্ধ করলো
অতঃপর উঠে বসে ফোনের দিকে তাকালো। অপরিচিত একটা নাম্বার থেকে কল এসেছে। রাত তখন বাজে প্রায় বারোটা। নাম্বারটা অপরিচিত হলেও ঠিক পুরোপুরি অপরিচিত মনে হলো না তার নিকট। কেনো যেনো পরিচিত মনে হলো। এ দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে সে কল রিসিভ করলো। সাথে সাথেই ওপাশে বৃত্ত’র কণ্ঠ শুনে পেলো।
” কেমন আছো বিন্দু?”

চমকে উঠলো বিন্দু। চকিত দৃষ্টিতে একবার মারিয়া ও পরবর্তীতে পুরো গণরুমে চোখ বুলালো। কেউ জেগে নেই তো? এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে সে চুপিসারে পা টিপে গণরুমের হলওয়ের মতো ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে কেউ নেই। এ ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে গলার খাদ নিচে নামিয়ে বললো,
” জি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বৃত্ত ভাইয়া।”

বিন্দু কণ্ঠ এপাশ থেকে স্বাভাবিকের তুলনায় খানিকটা আস্তে শুনলো বৃত্ত। জিজ্ঞেস করলো,
” এত আস্তে কথা বলছো কেনো? আশেপাশে কেউ আছে?”

বিন্দুর মন চাইলো সে বলে,
” আশেপাশে কেউ নেই। কিন্তু আপনি আমাকে কল করেছেন, এ ব্যাপারে কেউ জানতে পারলে আমার রক্ষা নেই। ”
কিন্তু সে এটি বললো না। বরং বললো,
” কেউ নেই। তবে এখন বেশ রাত হয়েছে তো তাই।”

বিন্দুর কথা শুনে বৃত্ত কান থেকে ফোন নামিয়ে সময় দেখলো। একদম কাটায় কাটায় বারোটা বাজে। এতো রাতে একটা মেয়েকে ফোন দেওয়াটা আসলেই অনুচিত। এই ভেবে সে জিব কাটলো। খানিক অনুশোচনাপূর্ণ কণ্ঠে বললো,
” আই এম এক্সট্রেমলি সরি বিন্দু। এত রাতে ফোন করা উচিত হয়নি। কিন্তু আমি সারাদিন কাজে ব্যস্ত ছিলাম বলে তোমার খোঁজ নেওয়ার সময় হয়নি।”

বিন্দু এর প্রত্যুত্তরে কি বলবে তা ভেবে পেলো না। বৃত্ত ফের প্রশ্ন করলো,
” তুমি ঠিক আছো তো? মানে আজকের ঘটনার পর থেকে? এ কারনেই তোমার অবস্থা জিজ্ঞেসের জন্য ফোন করেছিলাম। ”

বিন্দু এপাশে মৃদু হাসির সহিত মিথ্যে বললো,
” আমি একদম ঠিক আছি বৃত্ত ভাইয়া। আপনি চিন্তা করবেন না। আজ আমাদের হোস্টেলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। আর আমাদের পক্ষ থেকে বাদল ভাইয়াকেও ধন্যবাদ জানাবেন। উনি সময়মতো না এলে আজ বড় কিছু ঘটে যেতো। ”

” এতে ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই বিন্দু।”
এই বলে সে আর কথা বলার মতো কিছু পেলো না। কিন্তু বৃত্ত’র যে এখন ভীষণ কথা বলতে মন চাইছে। এ অপূর্ণ ইচ্ছেকে সে বিন্দুকে কিভাবে বলবে! এদিকে বিন্দুর আর এক মুহূর্তও কথা বলতে মন চাইছে না। এভাবে দুদিনের পরিচিত এক সিনিয়র বড় ভাইয়ের সাথে এভাবে ফোনে কথা বলা বেশ দৃষ্টিকটু। তাই সে ফোন কেটে দিতে প্রস্তুতি নিলো। কিন্তু তৎক্ষনাৎ বৃত্ত জিজ্ঞেস করলো,
” তোমার বাড়ির কাউকে জানিয়েছো এ বিষয়ে?”

পুনরায় প্রশ্ন শুনে এ পর্যায়ে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলো বিন্দু। তবুও সে জবাব দিলো,
” না কাউকে জানাইনি। আসলে জানালে শুধু শুধু টেনশন করবে দেখে বলিনি। ”
বলেই সে বৃত্তকে দ্বিতীয় কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বললো,
” আচ্ছা ভাইয়া, আজ রাখছি তাহলে৷ ঘুমিয়ে পড়বো। কাল ক্লাস আছে।”

বৃত্ত হতাশ হলো। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে এলো। ইশ,আরেকটুখানি কথা বললে কি হয়ে যায়! অনিচ্ছা সত্ত্বেও বৃত্ত বললো,
” আচ্ছা, যাও তাহলে। আর আমার নাম্বারটা সেভ করে রেখো। কোনোদিনও যদি প্রয়োজন হয়, কল করো। আর আমরা যেহেতু একই ডিপার্টমেন্টের সেহেতু বিভিন্ন কাজে আমার সাহায্য লাগতে পারে, সেক্ষেত্রেও নির্দ্বিধায় কল করতে পারো আমাকে। যেকোনো নোট লাগলেও বলতে পারো।
আচ্ছা, আজ তাহলে রাখছি।”

” আচ্ছা ভাইয়া। ”
বলেই বিন্দু কল কেটে দিলো। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সে।
রুমে এসে পুনরায় শুয়ে পড়লো বিন্দু। শুরুতে বৃত্ত’র নাম্বার সেভ করতে চেয়েছিলো না সে। কিন্তু যদি একান্তই কোনোদিন প্রয়োজন হয় তা ভেবে সে নাম্বার সেভ করলো।
বৃত্ত’র নাম্বারটা ‘সিনিয়র ভাইয়া’ নামে সেভ করলো বিন্দু। তারপর অজান্তেই নিশ্চিন্তে চোখ বুজে ঘুমিয়ে পড়লো সে। অথচ বৃত্ত’র ফোন দেওয়ার পূর্বে সে আজকের ঘটনার চিন্তায় ঠিক ঘুমাতেই পারছিলো না।

—————-

বাসস্ট্যান্ডে বিন্দুকে নিতে আসলো জুবায়ের। জুবায়েরকে দেখেই বিন্দুর চোখেমুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। জুবায়ের তাকে জিজ্ঞেস করলো,
” কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছিস এখানে?”

” বেশি না। দশ মিনিটেরও কম। ”

” আচ্ছা বাইকে ওঠ জলদি। তোকে বাড়িতে রেখে আবার অফিসে যাবো।”

বিন্দু দ্রুত জুবায়েরের বাইকে চড়ে বসলো। পথিমধ্যে জুবায়ের তাকে জিজ্ঞেস করলো,
” নবীন বরণ কেমন গেলো তোর?”

” ভালোই গিয়েছে বেশ। তোমার কি অবস্থা ভাই? সিলেট থেকে ট্যূর দিয়ে কবে ব্যাক করলে?”

” পরশুদিন ব্যাক করেছি। ”

এভাবে কথায় কথায় তারা বাড়ি চলে এলো। জুবায়ের বিন্দুকে নামিয়ে দিয়েই অফিসে চলে গেলো পুনরায়।

বিন্দু মহা খুশিতে বাড়িতে ঢোকা মাত্রই সুফিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরলো। অনেকদিন পর বিন্দুকে কাছে পেয়ে সুফিয়া বেগমও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলেন বিন্দুকে। আবেগী কণ্ঠে বললেন,
” কতদিন পর আমার মেয়েটাকে দেখলাম! ভালো আছিস তো মা?”

” অনেক ভালো আছি খালামনি।
আচ্ছা খালামনি, আমাকে জলদি কিছু খেতে দাও। সকালে না খেয়েই বেড়িয়েছি, বাড়ি এসে খাবো বলে।”

” দিচ্ছি দিচ্ছি, তুই হাতমুখ ধুয়েনে। আজ তোর জন্য পরোটা আর ছোলার ডাল রান্না করেছি।”

বিন্দু হাতমুখ ধুয়ে এসে খাবার খাওয়া আরম্ভ করলো। খেতে খেতে জিজ্ঞেস করলো,
” তামিম কোথায় খালা?”

” ও তো স্কুলে। স্কুল থেকে আবার সোজা চলে যাবে প্রাইভেটে।”

” ওহ, আর খালু?”

” কোথায় আর থাকবে। দোকানে আছে।
জানিস, তোকে ছাড়া আমার একদম সময় কাটে না। সারাদিন বাসায় প্রায় একা থাকি। তোর খালু থাকে দোকানে, জুবায়ের থাকে অফিসে, তামিম থাকে স্কুল,প্রাইভেট নিয়ে। এই বুড়ো বয়সে এসে একা সময় কাটানো যায় না।”

” তো আমি সেই কবে থেকে বলছি জুবায়ের ভাইয়ের বিয়ে দাও। ঘরে বউ আসলে তোমরা শাশুড়ী বউ মিলে মজার সময় কাটাতে পারবে। ”

” তোর কি মনে হয় আমি জুবায়েরকে বলি না বিয়ের কথা। কিন্তু ওর কথা হলো আগে প্রোমোশন পাবে, তোর বিয়ের ব্যবস্থা করবে। তারপর নিজের বিয়ে।”

বিন্দু খেতে খেতে রাগ নিয়ে বললো,
” আমার বিয়ের চিন্তা বাদ দাও তো। আগে আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হবে তারপর বিয়ে নিয়ে ভাববো।”

” এটা তোর ভাইকে বলিস। আমাকে না।
আচ্ছা, কয়দিনের ছুটিতে এসেছিস?”

” বেশি না। চার পাঁচদিন থাকবো শুধু। ”

” আচ্ছা তুই খেয়েনে। আমি দুপুরের খাবারের জন্য সবজি কাটি।”

————

বিন্দু তার খালার বাড়ি এসেছে আজ দিয়ে তিনদিন হলো। এ তিনদিন তার সাথে বৃত্ত’র কোনো যোগাযোগ হয়নি। কিন্তু গত দুদিন বিন্দুকে ভার্সিটিতে না দেখে বৃত্ত চিন্তিত হলো। ভাবলো, মেয়েটা সেই ঘটনাতে এখনও আটকে আছে না তো? এই ভেবে বৃত্ত রাতে বিন্দুকে কল দিলো।
বিন্দুর ফোন তখন চার্জে। প্রথমবার রিং হওয়ায় সে শুনতে পায়নি। কারণ তার মনোযোগ ছিলো তামিমের পড়ার প্রতি। বাড়িতে এসে সে প্রতিবার তামিমকে পড়া দেখিয়ে দেয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।

বিন্দুর ফোনে বৃত্ত’র তৃতীয় নং কল এলো। কিন্তু বিন্দু অন্য রুমে থাকায় তা শুনতে না পেলেও জুবায়ের ঠিকই শুনলো। সে গিয়ে চার্জে থাকা ফোনটা হাতে নিলো। দেখলো বিন্দুর ফোনে ইংরেজিতে ‘সিনিয়র ভাইয়া’ নামটা ভেসে উঠেছে। বিন্দুর ফোনে এরূপ নামের নাম্বার দেখে জুবায়ের বিস্মিত হলো। গলার স্বর উঁচিয়ে বললো,
” বিন্দু, তোর ফোন এসেছে। ”

বিন্দু তামিমের রুমে থেকে গলার আওয়াজ তুলে বললো,
” রেখে দাও ভাই। আমি এসে পরে দেখবো।”

” তোর কোন এক ‘সিনিয়র ভাইয়া’ কল দিয়েছে।”

জুবায়েরের এহেন কথা শোনামাত্র বিন্দুর সকল মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। বিস্ময় ও ভয়ে তার আঁখিদুটি গোল গোল আকার ধারণ করলো। বৃত্ত ফোন দিয়েছে! সেটাও আবার জুবায়েরের উপস্থিতিতে!
প্রতিকূল এ ঘটনায় পড়ে বিন্দুর মনোযোগ সব জানালা দিয়ে পালালো। হাতের কলম নিয়েই সে দৌড়ে ছুটে গেলো তার রুমে।
ইতোমধ্যেই বৃত্ত কল করে না পেয়ে চতুর্থবারের মতো ফোন করেছে বিন্দুর ফোনে। কিন্তু বিন্দু পৌঁছে কল রিসিভ করার পূর্বেই জুবায়ের তার কল রিসিভ করলো। থমকে দাঁড়ালো বিন্দু। আজ যে তার কপালে শনি আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

জুবায়ের কল রিসিভ করে হ্যালো বললো। ওপাশে বৃত্ত বিন্দুর ফোনে ফোন দিয়ে অকস্মাৎ পুরুষালী কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলো। কান থেকে ফোন নামিয়ে সন্দেহ নিয়ে একবার স্ক্রিনের দিকে তাকালো। সঠিক নাম্বারেই কল গিয়েছে তো? হ্যাঁ, বিন্দুর ফোনেই কল দিয়েছে সে। তাহলে পুরুষালী কণ্ঠ এলো কি করে। বিন্দু কোনো বিপদে পড়েনি তো! এই শঙ্কা নিয়ে সে দ্রুত জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি কে? বিন্দু কোথায়?”

বৃত্ত’র এরূপ হক জমানো কথায় অবাক হলো জুবায়ের। বিন্দুর দিকে সন্দেহ ও প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে চাইলো সে। ততক্ষণে বিন্দুর তার থেকে দ্রুত ফোন কেড়ে নিয়ে কল কেটে দিলো।সারা মেহেক। বিচলিতপূর্ণ ও ভয়ভীতি নিয়ে আমতাআমতা করে সে জুবায়েরকে বললো,
” আমার ভার্সিটির এক সিনিয়র ভাইয়া। গুরুত্বপূর্ণ একটা নোটের জন্য কল দিয়েছিলাম। আসলে আজ বিকেলে অনেকবার কল দিয়েছিলাম। তাই বোধহয় উনিও আমাকে এতবার কল দিচ্ছে। কল রিসিভ করিনি যে তাই।”

বিন্দুর আতঙ্কিত চেহারা দেখে সন্দেহ হলো জুবায়েরের। ভ্রু উঁচিয়ে সন্দেহপূর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” সত্যি তো? নাকি মিথ্যে বলছিস?”

” সত্যি বলছি ভাই। নোটের জন্যই কল করেছে।”

বিন্দুকে আরো কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইছিলো জুবায়ের। কিন্তু হঠাৎ তার ফোনে তার এক কলিগ ফোন করলো। ফলে বিন্দুকে ছেড়ে সেই কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে অন্য রুমে চলে গেলো।
জুবায়েরকে যেতে দেখে হাফ ছেড়ে বাঁচলো বিন্দু। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। ততক্ষণে বৃত্ত পুনরায় কল করেছে। কেননা আচমকা বিন্দুর ফোনে কোনো পুরুষের কণ্ঠ শুনে সে ভীষণ চিন্তায় পড়ে গিয়েছে। পাছে বিন্দুর কোনো ক্ষতি হলো কি না!

বিন্দু দ্রুত রুমের দরজা লাগালো। বৃত্ত’র কল রিসিভ করে তাকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো গর্জে উঠলো,
” এই রাতে ফোন করার অভ্যাসটা কবে যাবে বলুন তো? আমার ভাই যে কল রিসিভ করে আপনার কণ্ঠ শুনেছে, এখন আমাকে নিয়ে কি ভাবছে কে জানে। ভাই যদি আমাকে অযথা সন্দেহ করে তাহলে আপনার একদিন কি আমার একদিন। আর কল করবেন না। আমি বাড়িতে এসেছি।”
বলেই কট করে কল কেটে দিলো বিন্দু। এদিকে বৃত্ত বিন্দুর এহেন আচরণে পুরো বেকুব বনে গেলো। বিড়বিড় করে নিজেকে বলতে লাগলো,
” এ কি হলো! যার চিন্তায় আমার রাতের খাবারদাবার বন্ধ হয়ে আছে সেই কি না আমাকে ঝাড়ি মেরে আমার মুখ বন্ধ করে দিলো! আশ্চর্য!”
বিন্দুর এই পরিবর্তিত আচরণে ঘোর সারা রাতেও কাটলো না বৃত্ত’র।

———–

ভার্সিটির পরিবেশ গরম। চারদিকে তুমুল মা’ রা’ মা’ রি চলছে। গতকাল রাতে পরিসংখ্যান বিভাগের এক ছেলে আইন বিভাগের এক ছেলেকে মে’ রে’ ছিলো বলে আজ সে নিয়ে দু ডিপার্টমেন্ট মিমাংসা করতে বসেছিলো। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হওয়ার বদলে উল্টো আরোও বিগড়ে গিয়েছে।

বিন্দু বাড়ি থেকে সোজা এসেছিলো ক্লাসে। ভার্সিটির এ অবস্থা সম্পর্কে তার সামান্যতম ধারণাটুকুও ছিলো না। ওদিকে মারিয়া যে কিছু বলবে, সে নিজেই বাড়িতে আছে এখনও।

মা’ রা’ মা’ রি ধীরেধীরে খারাপ পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পূর্বে দু ডিপার্টমেন্টের মধ্যে এ ঘটনা থাকলেও এখন তা পুরো ভার্সিটিতে ছড়িয়ে পড়েছে। এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে ক্যাম্পাসে। যে যার মতো যাকে তাকে মারছে।

চরম এ প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়ে দিশেহারা হয়ে পড়লো বিন্দু। সবসময় সকল পরিস্থিতিতে দৃঢ় রাখার চেষ্টা করা মেয়েটির মনে অজানা আতঙ্ক গ্রাস করলো। এদিকে ডিপার্টমেন্টে নেই কোনো মেয়ে, নেই কোনো স্যার। হয়তো সকলেই এরূপ ঘটনা ঘটবে তা অনুমান করে ফেলেছিলো।
ক্লাসরুমের আশেপাশে একটা কাকপক্ষীও নজরে এলো না বিন্দুর। এদিকে কল করে যে কারোর কাছে সাহায্য চাইবে সে আশাটুকুও শেষ হয়ে গিয়েছে ভার্সিটিতে আসতে আসতে।সারা মেহেক। কেননা ভার্সিটিতে প্রবেশের পূর্বেই তার ফোনের ব্যাটারি ডাউন হয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তীব্র উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিশেহারা হয়ে পড়লো সে। কিন্তু এভাবে ডিপার্টমেন্টে কতক্ষণ আটকে থাকবে সে! তাই অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিলো ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা হোস্টেলে চলে যাবে। যেহেতু এদিকটায় মা’ রা’ মা’ রি হচ্ছে না সেহেতু সোজা রাস্তা ধরে হোস্টেলে যেতে বেশি সময় লাগবে না। আর পথে সমস্যা হলে কোনো এক ডিপার্টমেন্টে লুকিয়ে পড়বে সে। এ সিদ্ধান্তে অটল থেকে নিজ ডিপার্টমেন্ট হতে বের হলো বিন্দু।

এদিকে বিন্দুকে কল দিয়ে দিয়ে অস্থির হয়ে পড়েছে বৃত্ত। ফোন বন্ধ। দুশ্চিন্তায় তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যাচ্ছে যখন সপ বারবার ওপাশ থেকে যান্ত্রিক কণ্ঠে শুনছে ‘দা নাম্বার ইউ হ্যাভ কলড,ইজ কারেন্টলি আনরিচেবল’

#চলবে