#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১৫
#সারা মেহেক
সুফিয়া বেগম নিজের বিস্ময় ভাবকে খানিকটা লুকানোর চেষ্টা করলেন। মৃদু হাসার প্রচেষ্টা করে বললেন,
” শাড়িটা তো অনেক সুন্দর বাবা। কিন্তু তুমি কোথায় পেলে এটা? আর ফেরত দেওয়ার কথা বলছো যে?”
বৃত্ত বেশ সহজ সরল প্রকৃতির অভিনয় করে বললো,
” আপনাকে এটা ফেরত দেওয়ার কথা ছিলো আন্টি। ঐ যে আপনার শাড়িটা ছিঁড়ে গিয়েছিলো যে……”
শাড়ি ছেঁড়ার কথা শুনে সুফিয়া বেগম যেনো ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক করলেন। তার স্বামীর দেওয়া এত শখের শাড়ি কি না শেষমেশ ছিঁড়ে গিয়েছে! বৃত্ত’র কথায় তিনি চট করে বিন্দুর দিকে ফিরে তাকালেন।
বিন্দু তৎক্ষনাৎ ভয়ে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো। তার এ দৃষ্টি লুকানো দেখেই সুফিয়া বেগম যা বুঝার বুঝে গেলেন। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” আমার এত শখের শাড়িটা শেষমেশ তুই ছিঁড়ে ফেললি বিন্দু! কতবার বলে বলে আমার কাছ থেকে শাড়িটা নিয়েছিলি আর শেষে ছিঁড়েই ফেললি। ”
খালার কথায় বিন্দু দ্রুত উঠে এলো। অপরাধবোধ স্বরে বললো,
” সরি খালা, ইচ্ছা করে ছিঁড়িনি। প্রথমে রিকশায় লেগে একটু ছিঁড়েছিলো। আর বাদ বাকিটুকু বৃত্ত ভাইয়া ছিঁড়ে ফেলেছে। ”
সুফিয়া বেগম এক ধমকে বিন্দুকে চুপ করিয়ে দিয়ে বললেন,
” তুই চুপ কর। ওর উপর দোষ দিবি না৷ দোষটা তো তোর সম্পূর্ণ। আর যদি কখনো আমার কাছ থেকে শাড়ি নিতে আসিস তো!”
এই বলতে না বলতেই বৃত্ত পুরো কেবিনটা শান্ত করার চেষ্টা করলো। সতর্ক কণ্ঠে বললো,
” আংকেল ঘুমাচ্ছে আন্টি। একটু ধীরে কথা বলুন।”
সুফিয়া বেগম তৎক্ষনাৎ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। বেডে বসেই দূর হতে সাবধানী দৃষ্টিতে আহসান সাহেবের দিকে তাকালেন। নাহ, ঘুমাচ্ছেন উনি।
বৃত্ত বেশ ভদ্রতা বজায় রেখে নরম সুরে বললো,
” আন্টি, বিন্দুকে কিছু বলতে হলে কেবিনের বাইরে গিয়ে বলুন না হয়। ”
বৃত্ত’র এহেন কথায় বিন্দু কটমট চাহনিতে তার দিকে তাকালো। যেনো এখনি কাঁচা চি’বি’য়ে খেয়ে ফেলবে। তার এ চাহনিতে মিটিমিটি হাসলো বৃত্ত। ভীষণ মজা পেয়েছে সে। তার চেহারায় স্পষ্ট প্রতিশোধাত্মক চাহনি দেখতে পারছে বিন্দু।
সুফিয়া বেগম ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে শাড়িটা পুনরায় ব্যাগে ঢুকিয়ে নিতে নিতে বৃত্তকে বললেন,
” তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ বলবো জানা নেই বাবা। শাড়িটা আমার ভীষণ পছন্দের। যদিও এখন শাড়িটা তোমার আংকেল দেওয়া আর রইলো না। তবুও একই ডিজাইনের জোগাড় করে দিয়েছে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছি।
কিন্তু এই শাড়িটা জোগাড় করলে কি করে? বেশ কষ্ট হয়েছে না? কারণ তোমার আংকেল সেই কুমিল্লা থেকে এনেছিলো। যদিও সেটা আমাকে তখন বলেনি। পরে বলেছিলো। ”
বৃত্ত মৃদু হেসে বললো,
” এসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না আন্টি। আংকেল সুস্থ হলে আপনি শুধু একবার এ শাড়িটা পরে উনার সামনে যাবেন। তাহলেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবে। ”
বৃত্ত’র এ রসিকতায় লাজুক হাসি দেন সুফিয়া বেগম। কিন্তু তৎক্ষনাৎ বিন্দুর দিকে তাঁর দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে। ফলস্বরূপ সকল হাসি উবে গিয়ে শীতল এক মুখভঙ্গিমা ছুঁড়ে দেন বিন্দুর প্রতি।
বিন্দু সুফিয়া বেগমের এ রোষবিষ্ট চাহনি দেখে দ্রুত কেবিন থেকে কে’টে পড়লো। তার পিছু পিছু বেরিয়ে এলো বৃত্ত’ও।
বৃত্তকে দেখা মাত্র বিন্দু বিনা মেঘে বজ্রপাতের ন্যায় ছেয়ে পড়লো। গলার স্বরে খাদে নামিয়ে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বললো,
” আপনি ইচ্ছা করে এমনটা করেছেন তাই না? অথচ আমাকে নিজেই বলেছিলেন খালাকে যেনো না জানাই। তাহলে এভাবে খালাকে শাড়ি ছেঁড়ার কথা বললেন কেনো?”
বিন্দুর রোষানলে পড়েও বৃত্ত’র মুখভঙ্গিমায় খুব একটা পরিবর্তন হলো বলে মনে হলো না। উল্টো বিন্দুকে সে তোয়াক্কা করে না এমন একটা ভাব ধরে বললো,
” আমার মন চেয়েছে তাই করেছি।”
বিন্দু দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো,
” আপনার মন! উফ এই মন! এই মনটা বড়ই বে য়া দ ব, ফা জি ল…..উম….তারপর আরোও খারাপ কিছু। ”
বিন্দুর এহেন কথার ভঙ্গিতে বৃত্ত হাসতে হাসতে কুপোকাত হলো। কেবিনের বাইরের চেয়ারে বসে হাসতে হাসতে বললো,
” পারো না তো? আর গা লি পারো না? এতো সতীসাধ্বী মেয়ে নাকি আমার সামনে সাজছো এমন?”
বিন্দু নিজের ক্ষিপ্ততা বজায় রাখলেও আমতাআমতা করে বললো,
” এখন মাথায় আসছে না। কিন্তু পরে আসলে ঠিকই সুযোগ বুঝে শুনিয়ে দিবো। ”
” সে পরে দেখা যাবে। কিন্তু এখন রাগ না দেখিয়ে একটু থ্যাংকস বলো। কারণ এই শাড়িটা জোগাড় করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। একে তো তুমি বলোনি তোমার খালু কোথা থেকে শাড়িটা কিনেছে, আবার এই শাড়িটাও কয়েক বছর আগের পুরোনো। এজন্য ওর্ডার দিয়ে রীতিমতো ঐ ডিজাইনের শাড়ি বানাতে হয়েছে। ভাগ্যিস মারিয়া আমাকে তোমার শাড়ির ডিজাইনটা দিয়েছিলো। ”
বিন্দু মারিয়ার নাম শুনে বিস্মিত হলো। বললো,
” মারিয়া আপনাকে শাড়ির ছবি পাঠিয়েছিলো! আমাকে না জানিয়ে!”
” হ্যাঁ। আমিই তোমাকে জানাতে নিষেধ করেছিলাম। যেনো……”
বৃত্ত’র কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই সেখানে জুবায়ের ও তামিম উপস্থিত হলো। জুবায়েরের হাতে দুটো টেকওয়ে কফি কাপ। সে এসে কাপ দুটো বৃত্ত ও বিন্দুর দিকে দিয়ে বললো,
” আমরা দুজন একটু কফি খেতে গিয়েছিলাম। ভালো লাগলো দেখে তোমাদের জন্য নিয়ে এসেছি।”
জুবায়েরের হাত থেকে কফির কাপ নিতে নিতে বৃত্ত বললো,
” থ্যাংকস ভাইজান। একটু কফির দরকার ছিলো আসলে। মন মেজাজ সব ঠিক করার জন্য। ”
জুবায়ের হাসলো। বললো,
” আচ্ছা, তোমরা কফি খাও। আমি আর তামিম আব্বাকে একটু দেখে আসি। ”
জুবায়ের ও তামিম কেবিনে প্রবেশ করলে বৃত্ত বিন্দুকে নিয়ে একটা খালি জায়গায় এসে দাঁড়ালো। যেখানে দাঁড়ালে ঢাকা শহরের ব্যস্ততা কিছুটা হলেও উপলব্ধি করা যায়।
গাড়ির ব্যস্তময় হর্ণের আওয়াজ উপেক্ষা করে বৃত্ত ও বিন্দু কফির কাপে একেকবারে চুমুক দিচ্ছে। দুজনের মাঝে হচ্ছে না টু শব্দটুকুও। হঠাৎ এ নীরবতা ভেঙে বিন্দু মোলায়েম স্বরে বললো,
” সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ বৃত্ত ভাইয়া। ”
অকস্মাৎ বিন্দুর গলায় ‘ধন্যবাদ শব্দটি শুনে বিষম খেলো বৃত্ত। কণ্ঠে বিস্ময় ভাব নিয়ে বললো,
” আমার কান কি ঠিক আছে? ঠিক শুনতে পারছি তো আমি!”
বিন্দু মৃদু শব্দে হেসে উঠলো। বললো,
” জি আপনি ঠিকই শুনতে পেরেছি।”
” আচ্ছা! কি বললে তাহলে তুমি?”
” ধন্যবাদ বলেছি আপনাকে। ধন্যবাদ।”
” নাহ, শুনতে পাইনি। কেউ কি কিছু বললো?”
বৃত্ত’র নাটকে পুনরায় হাসলো বিন্দু। পূর্বের তুলনায় খানিকটা উচ্চ শব্দে বললো,
” জি আমি বলেছি। ধন্যবাদ,ধন্যবাদ,ধন্যবাদ।”
” এট লাস্ট। কারোর মুখ থেকে থ্যাংকইউ শব্দটা শোনার সৌভাগ্য হলো। আমি তো ভেবেছিলাম এই ওয়ার্ডটা কখনও শুনতেও পারবো না।”
বলে সে অন্যদিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে মুচকি হাসতে হাসতে কফিতে চুমুক দিলো।
বিন্দু বললো,
” আসলে তখন আপনি না থাকলে এতকিছু আমি করতে পারতাম না। আবার জুবায়ের ভাইও ছিলো না যে আমাকে সাহায্য করবে। হয়তো দিশেহারা হয়ে পারতাম সেই মুহূর্তে।
আর আমার ব্যবহারের জন্য সরি।”
বৃত্ত’র যেনো পুনরায় বিষম খাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়ে পড়লো। তার এহেন অবস্থা দেখে বিন্দু মুচকি হাসতে হাসতে বললো,
” এবারও কি শুনতে পাননি আপনি?”
বৃত্ত বিন্দুর দিকে ফিরে বললো,
” না শুনতে পেয়েছি। তবে আরেকটু জোরে বললে বোধহয় ভালো হতো।”
” আচ্ছা বললাম। আমার ব্যবহারগুলোর জন্য সরি। এক্সট্রিমলি সরি।”
” শুনতে পেরেছি এবার। ভাবছিলাম বোধহয় কালা হয়ে গেলাম।”
বলেই দুজনে সমস্বরে হেসে উঠলো।
.
আহসান সাহেবের বাম পাশ পুরো প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।(ঢাকা থেকে ডাক্তার যেসব ওষুধ লিখে দিয়েছে তা নিয়মিত চলছে। পাশাপাশি নিয়মিত ফিজিওথেরাপি সেশনও চলছে। সুফিয়া বেগম নিজের সর্বাত্মক দিয়ে স্বামীর সেবায় মনোনিবেশ করেছেন। বিন্দুও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সপ্তাহে দু থেকে তিনবার খালুকে দেখতে বাড়িতে আসবে।
————–
ঢাকা থেকে এসে সোজা অফিসে গিয়েছিলো বৃত্ত। সেখান থেকে খানিকটা রাত করেই বাড়ি ফিরেছে সে। আফতাব হোসাইন তখনও জেগে ছিলেন। ছেলের ফেরার আশায়। ফলস্বরূপ বৃত্ত বাড়িতে পৌঁছানো মাত্রই রিডিং রুমে প্রবেশ করলো।
আফতাব হোসাইন শীতল কণ্ঠে বৃত্তকে বললেন,
” বসো বৃত্ত।”
বৃত্ত নীরবে বসলো। আফতাব হোসাইন প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রথম প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন,
” কোথায় ছিলে এতোদিন?”
বৃত্ত সচকিত স্বরে জবাব দিলো,
” ঢাকায় ছিলাম। ”
” তোমার কোনো আত্মীয় ছিলো হসপিটালে?”
বৃত্ত কিছুটা সময় নিয়ে জবাব দিলো,
” না বাবা।”
” তাহলে এই যে সময়গুলো ব্যয় করলে এর হিসাব আছে কোনো?”
বৃত্ত নীরব। আফতাব হোসাইন পুনরায় রুষ্ট স্বরে বললে,
” এই তিনটা দিন তোমার জন্য কতকিছু আটকে ছিলো জানা আছে তোমার? সব কাজ বাদলে দিয়ে হয় না৷ ও তোমার চেয়ে ছোট। এখনই আমি ওকে সব দায়িত্ব দিতে চাই না। অথচ এই তিনদিনের কাজগুলো সব বাদলের উপর চাপিয়ে দিতে হয়েছে। এর জবাবদিহি করবে না তুমি?”
বৃত্ত মিহি কণ্ঠে বললো,
” ওখানে আমার প্রয়োজন ছিলো বাবা। ”
আফতাব হোসাইন গলার স্বর চড়াও করলেন৷ বললেন,
” এখানে তোমার প্রয়োজন বেশি ছিলো। তুমি চাইলেই হসপিটালে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আসতে। ওরাই সব করতে পারতো। তোমার ওখানে থাকার কোনো প্রয়োজন ছিলো না। ”
” বাবা,বিন্দুর পরিবার সবকিছু সামলাতে পারতো না। আমার পরিচিত যেমন আছে, আমি যে সুবিধাটুকু সেই সময় উপস্থিত থেকে ওদের দিতে পারবো, আমার অনুপস্থিতিতে তা সম্ভব ছিলো না।”
” তাহলে কি ঐ মেয়ের কাছে তোমার বাবার মূল্য নেই? ঐ মেয়ের সামনে তোমার রাজনীতির সবকিছু তুচ্ছ! কি হয় ঐ মেয়ে তোমার? কাগজে কলমে ঐ মেয়ের সাথে কোনো সম্পর্ক আছে তোমার? বলো।”
#চলবে