#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_১৯
#সারা মেহেক
অর্ধ চন্দ্রের অর্ধ জ্যোৎস্নায় মৃদু আলোকিত হয়ে আছে প্রকৃতির সামান্য অংশ। সে মৃদু চাঁদের আলোয় হোস্টেলের লম্বা করিডোরের ন্যায় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে বিন্দু। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে মারিয়া। দুজনে টুকটাক গল্প করতে করতে রাতের পরিবেশ উপভোগ করছে। গল্পের মাঝে হঠাৎ মারিয়া বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলো,
” বৃত্ত ভাইয়া যে তোকে এতো সাহায্য করে, তোর বিপদে সবসময় তোর পাশে থাকে, তবুও কি উনার জন্য কোনো সফট কর্ণার তৈরী হয় না তোর মনে?”
বিন্দু ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। মৃদু হাসি দিয়ে বললো,
” আমি কোনো পাথর না মারিয়া। আমি মানুষ। একটা মানুষ যদি সব পরিস্থিতিতেই আমাকে সাহায্য করে, অবশ্যই তার জন্য আমার মনে একটা সফট কর্ণার তৈরী হবে। এটা স্বাভাবিক। ”
বিন্দুর কথায় মারিয়া ভীষণ খুশি হলো। কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” এর মানে বৃত্ত ভাইয়ার জন্য তোর মনে ফিলিংস তৈরী হচ্ছে! ”
বিন্দু তৎক্ষনাৎ মারিয়ার কথার প্রতিবাদ করে বললো,
” মোটেও না। সফট কর্ণার তৈরী হওয়া মানেই কারোর প্রতি ফিলিংস বা ভালোবাসা তৈরী হওয়া না। ”
” সিরিয়াসলি বিন্দু! তোর কথা আমি বিশ্বাস করলাম না। আমি নিশ্চিত তুই বৃত্ত ভাইয়াকে পছন্দ করতে শুরু করেছিস। কিন্তু এই সত্যটা মানতে চাইছিস না। ”
” যেখানে কোনো সত্যতাই নেই সেটা মানা আর না মানার কোনো কথা আসে না। ”
” কেনো সত্যতা থাকবে না? আচ্ছা, বৃত্ত ভাইয়ার একটা খারাপ দিক সম্পর্কে বল যেটার কারণে তোর উনার প্রতি ভালোবাসা তৈরী হয়েও হচ্ছে না। আমার তো মনে হয় না উনার কোনো খারাপ দিক…..”
মারিয়াকে মাঝ পথে থামিয়ে বিন্দু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
” রাজনীতি। এই খারাপ দিকটাই উনার সব ভালো দিককে ঢেকে দেয়। আর কিছু জানতে চাস?”
মারিয়া বিন্দুর হেন কথায় তাজ্জব বনে গেলো। বিস্মিত কণ্ঠে বললো,
” সিরিয়াসলি! রাজনীতি! এটা কোনো খারাপ দিক হলো! উল্টো এ কারণেই তোর খালুর চিকিৎসায় কত সুবিধা পেলি তোরা। আর এটাকে খারাপ বললি কি করে?”
বিন্দু ম্লান হাসলো। স্মিত হেসে উদাস গলায় বললো,
” সে তুই বুঝবি না মারিয়া। শুধু এটুকু জেনে রাখ, রাজনীতি কারোর জীবনে ভালো কিছু বয়ে আনে না। অন্ততঃ আমার জীবনে না।”
বলেই সে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। পিছে মারিয়া এ কথার অর্থ পুনরুদ্ধার করতে ব্যস্ত হলো। কিন্তু শত চেষ্টার পরও সে বিন্দুর বলা কথার অর্থ পুনরুদ্ধার করতে অক্ষম হলো।
ওয়াশরুম হতে ফিরেই ম্যাসেঞ্জারের টুংটাং শব্দে ফোনটা হাতে নিলো বিন্দু। ম্যাসেঞ্জারে গিয়েই দেখলো ফয়সাল নামক সেই ব্যক্তি তাকে ম্যাসেজ দিয়েছে যে তাকে এডমিশনের টাইম থেকে বিরক্ত করছে। ফয়সালের বয়স পঁয়ত্রিশ উর্ধ্ব। এডমিশনে ভার্সিটিতে চান্স পাওয়ার পর একটা জব খোঁজার মাধ্যমে ফয়সালের সাথে পরিচয় হয় বিন্দুর। শুরুতে বড় ভাইয়ের ন্যায়ই আচরণ করতো বিন্দুর সাথে। কিন্তু গত এক মাস যাবত বিন্দুকে নানাভাবে বিরক্ত করে চলছে ফয়সাল নামক ব্যক্তিটি। বিন্দুকে প্রপোজ করে বিয়ে পর্যন্তও গড়িয়ে পড়েছে সে। কিন্তু বিন্দু বারংবার এতে নিষেধ করা সত্ত্বেও সে লোকটি তাকে বিরক্ত করে চলছে। শেষমেশ প্রচণ্ড জ্বালায় বিন্দু সব জায়গা থেকে ফয়সালকে ব্লক করে। কিন্তু ফয়সালও কম যায় না। সে নানা নাম্বার থেকে, নতুন নতুন আইডি থেকে বিন্দুকে বিরক্ত করেই চলছে।
আজকে ফয়সাল ম্যাসেজ দিয়েছে,
” বিন্দু, আমি আর কতভাবে বুঝাবো যে তোমাকে ভালোবাসি আমি। তোমাকে বিয়ে করতে চাই। তোমার জন্য কি করলে আমার প্রস্তাবে রাজি হবে তুমি?”
এ ম্যাসেজ দেখে বিন্দুর জবাব দিতে মন চাইলো, ‘ম’ র’ লে রাজি হবো।’ কিন্তু এ জবাব না দিয়ে সে সোজা ব্লক করে ফোনটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লো। মারিয়া এসে শুয়েছে আরোও প্রায় পাঁচ মিনিট আগে। এখন মারিয়া প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছে। বিন্দুও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এমন মুহূর্তে তাকে অকস্মাৎ চমকে দিয়ে বৃত্ত কল করলো। বৃত্ত’র নাম্বার দেখে সাথে সাথেই সে কল রিসিভ করে ফিসফিস করে বললো,
” এই রাতে কল করার অভ্যাসটা আপনার কবে যাবে বলুন তো!”
বিন্দুর কথায় ওপাশে মুখ চেপে হাসলো বৃত্ত। বিন্দুর এ ক্ষুদ্র শাসনের কথাগুলো তার ভীষণ পছন্দের। ঠিক এই কথাটিই এর আগেও বহুবার বলেছে বিন্দু। কিন্তু তবুও বৃত্ত শুধারাবার পাত্র নয়। বরং সে ইচ্ছে করেই যেনো বিন্দুকে উসকিয়ে দেয় এমন শাসন করার জন্য।
বিন্দুর কথার প্রত্যুত্তরে বৃত্ত বেশ আদুরে গলায় বললো,
” যেদিন তুমি আমার পাশে থাকবে সেদিন।”
বিন্দু ততক্ষণে ব্যালকনিতে চলে এসেছে। আশেপাশে কেউ আছে কি না এ দেখতে গিয়ে বৃত্ত’র কথাটি প্রায় উপেক্ষা করলো সে। এবার স্বাভাবিক স্বরে বললো,
” এখন ফোন করার কারণ?”
বৃত্ত তার বাড়ির ব্যালকনির রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে মুগ্ধ স্বরে বললো,
” কারণ তোমার কণ্ঠ শুনতে ইচ্ছে করছিলো।”
” কেনো? এতদিনে শুনেননি বুঝি?”
” শুনেছি। কিন্তু আজ তো শুনিনি। তাই কথা বলতে মন চাইলো। ”
বৃত্ত’র সাথে কথা না বলার জন্য বিন্দু কঠোর হতে চাইলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার মন এতে অসম্মতি জানালো। কেননা বৃত্ত’র সাথে এখন খারাপ ব্যবহার করলে সেটা বৃত্ত’র প্রতি সরাসরি অকৃতজ্ঞ হওয়ার সামিল হবে। যা বিন্দু মোটেও চাইছে না৷
বৃত্ত পুনরায় বললো,
” আজ আমাকে দেখতে কি খুব ভালো লাগছিলো?”
ঈষৎ চমকে উঠলো বিন্দু। নিজেকে শুধালো, বক্তৃতা দেওয়ার সময় কি বৃত্ত তাকে দেখে ফেলেছে নাকি! তাহলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে। এ নিয়ে বৃত্ত নিশ্চয়ই তাকে নানা ধরণের প্রশ্ন করবে। হয়তো সুযোগ বুঝে ক্ষ্যাপাবেও। কে জানে!
বিন্দু জড়তা বিহীন কণ্ঠে তৎক্ষনাৎ নাকচ করে বললো,
” সে আমি জানবো কি করে?”
” তোমারই তো জানার কথা। যেভাবে দেখছিলে আমাকে!”
বৃত্ত’র দৃষ্টি আড়ালে ফোনের ওপাশে নীরবে কপাল চাপড়ালো বিন্দু। ইশ,এটাই তো চাচ্ছিলো না সে। এ নিয়েই ভয়ে ছিলো। অথচ বৃত্ত ঠিকই ধরে ফেললো। তখন যে কি মনে করে মঞ্চের সামনে দাঁড়িয়েছিলো সে!
বিন্দু তবুও বুক ফুলিয়ে বৃত্ত’র কথা প্রত্যুত্তরে বললো,
” কে বলেছে আপনাকে দেখছিলাম! আমার অতো সময় নেই। আর আপনাকে দেখার মতো কি এমন আছে! যেই না চেহারা। হুহ!”
বলেই সাথে সাথে কল কেটে জিব কাটলো বিন্দু। সে জানে বৃত্ত’র চেহারায় আকর্ষণীয় ভাবটা আছে যা খুব কম ছেলেদের মাঝেই আছে। অথচ সে সরাসরি মুখের উপর এমন কথা বললো! না জানি বৃত্ত ওপাশে কি মনে করছে!
এদিকে বিন্দুর জবানে এমন কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লো বৃত্ত। কান থেকে ফোন নামিয়ে হতভম্ব হয়ে নিজেই নিজেকে শুধালো,
” আমার চেহারা নিয়ে কথা বললো বিন্দু! আমার চেহারা কি খারাপ! আজ পর্যন্ত এ চেহারা খারাপ বলেনি কেউ। অথচ বিন্দু! ”
বিস্ময়ে হতভম্ব বৃত্ত ব্যালকনি থেকে রুমে এসে আয়নার সম্মুখে দাঁড়ালো। নিজের চেহারায়, দাড়িতে, চুলের মাঝে হাত বুলাতে বুলাতে বিড়বিড় করে বললো,
” আমার চেহারা কি এতোটাই খারাপ? বিন্দু ওভাবে বললো কেনো! অথচ ছোট থেকেই এই চেহারা নিয়ে সবার কাছে প্রশংসা শুনেছি। অদ্ভুত!”
—————–
পরদিন ক্লাস শেষে বিন্দু ও মারিয়া টুকটাক ফাস্ট ফুড খেতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে পড়লো। গেট থেকে বেরুতে না বেরুতেই হঠাৎ কোথা থেকে যেনো ফয়সাল উদয় হলো বিন্দু ও মারিয়ার সামনে। অকস্মাৎ ফয়সালকে দেখে চমকে উঠলো বিন্দু। বিস্মিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” আপনি এখানে কি করছেন!”
মারিয়া প্রথমে ফয়সালকে চিনতে না পারলেও পরবর্তীতে ফয়সালের মাথায় ফুটবলের ন্যায় বিশাল টাক দেখে চিনে ফেললো।
ফয়সাল অসহায় কণ্ঠে বিন্দুকে বললো,
” তুমি সবখানে আমাকে ব্লক করে রেখেছিলে। তাই আর উপায় না পেয়ে সরাসরি এখানে চলে আসলাম। বিন্দু আমার প্রস্তাবে কেনো রাজি হচ্ছো না তুমি? কি সমস্যা আছে আমার মাঝে?”
ফয়সালের শেষোক্ত প্রশ্নটি শুনে মারিয়া মনে মনে বিস্মিত হয়ে বললো,
” কি সমস্যা! মাথায় একটা ফাঁকা মাঠ নিয়ে ঘুরে বলে কি সমস্যা! ”
বিন্দু বললো,
” দেখুন, আপনার সাথে কথা বলার কোনো ইন্টারেস্ট নেই আমার। আমি আগেও আপনাকে এ ব্যাপারে বলেছি। আমি আপনাকে বিয়ে করতে পারবো না। ”
” কেনো পারবে না? কারণটা তো বলো।”
বিন্দু জবাব দিলো না। মারিয়ার হাত ধরে ফয়সালকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে এগুলো সে। ফয়সালও তার পিছু নিলো। পিছে বারবার বিন্দুকে অনুরোধ করতে লাগলো। কিন্তু বিন্দু বা মারিয়া কেউই ফয়সালের কথার গুরুত্ব দিলো না।
বিন্দুর এ অবজ্ঞায় এক পর্যায়ে ফয়সালের মেজাজ চটে গেলো। সে শক্ত কণ্ঠে বললো,
” ভালোমতো শুনছো না তো আমার কথা! তোমাকে তুলে নিয়ে বিয়ে করতে একটু কষ্ট হবে না আমার। কিন্তু ঠিকই তোমার মান সম্মান যাবে।”
বলেই সে পিছন থেকে বিন্দুর হাত চেপে ধরলো।
ফয়সালের এ অসংগত আচরণ ও বাজে কথায় বিন্দুর তব্দা খেলো। কিন্তু এর চেয়েও বেশি তার মেজাজ গরম হলো। এভাবে জনসম্মুখে তার হাত ধরা আর এরূপ কথা বলার সাহস কিভাবে পেলো ফয়সাল! ফয়সালের এমন আচরণে বিন্দু কোনোরূপ ভাবনা চিন্তা ছাড়াই একটা কাজ করে বসলো।
তীব্র ক্রোধে ফয়সালের দিকে ফিরে অপর হাত মুঠো করে সজোরে একটা ঘু’ ষি দিলো ফয়সালের মুখ বরাবর। অকস্মাৎ এ আক্রমনে তৎক্ষনাৎ বিন্দুর হাত ছেড়ে দু হাত নিজের মুখ ধরে কয়েক কদম ছিটকে দূরে সরে পড়লো ফয়সাল।
জনসম্মুখে বিন্দুর এহেন আচরণে ফয়সালসহ মারিয়াও চরম বিস্মিত হলো। মারিয়া ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি বিন্দু এমন কিছু করে বসবে।
এদিকে এ রাস্তা ধরেই বাইক নিয়ে ক্যাম্পাসে যাচ্ছিলো বাদল। রাস্তায় বিন্দু ও মারিয়ার পিছে একটি ছেলেকে হাঁটতে দেখে রাস্তার ওপাশে বাইক থামিয়েছিলো সে। ভেবেছিলো রাস্তার ওপাশে গিয়ে ছেলেটাকে ধরবে সে। কিন্তু তার এ ভাবনার পূর্বেই বিন্দুর সে অকল্পনীয় কার্য সাধন করা সারা!
বিন্দুকে এভাবে ঘু’ ষি দিতে দেখে হা করে মুখ চেপে ধরলো চরম বিস্মিত বাদল। সে ভাবতেও পারেনি বিন্দু এরূপ কিছুও করতে পারে! বিস্ময়ে হতভম্ব সে বিড়বিড় করতে করতে বললো,
” ওহ ম্যান! এ কি করলো! বিন্দু তো সাক্ষাৎ একটা বো’ ম!”
ফয়সাল মুখ ধরে বিন্দুর দিকে এগিয়ে আসতে আসতে আক্রোশের সহিত বললো,
” তোমার সাহস তো কম না! আমার উপর হাত তুলেছো তুমি!”
ততক্ষণে আশেপাশে গুটিকয়েক মানুষজন জড়ো হয়েছে। তারা সকলে কৌতূহলী হয়ে দেখছে এখানে কি চলছে। কিন্তু কেউই বিন্দুর দিকে এগিয়ে আসছে না।
এদিকে বিন্দুও নিজের কাজে নিজেই স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ফয়সালের কথার কোনো প্রত্যুত্তর করার মতো পরিস্থিতিতে আপাতত নেই সে। তাই হয়তো তার পক্ষ নিয়েই মারিয়া ধমকের সুরে টিটকারি মেরে বললো,
” মাথায় তো ফুটবল মাঠের মতো ইয়া বড় একটা টাক। তারপর আবার আসছে কচি মেয়ে বিয়ে করতে! শখ কত বুইড়ার! যৌবনের কুড়কড়ানি থামেনি এখনও তাই না?”
®সারা মেহেক
#চলবে