#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২০
#সারা মেহেক
মারিয়ার কথা শুনে তেড়ে আসলো ফয়সাল। তার দৃষ্টিজোড়া আক্রোশে ভরপুর। যেনো এখনই সে এই আক্রোশের জোরে বিন্দু ও মারিয়াকে পরাজিত করবে।
ফয়সাল মারিয়ার উপর আক্রমনাত্মক হতে চাইলো। কিন্তু এর পূর্বেই মারিয়া অকস্মাৎ তার গালে একটা চড় মেরে বললো,
” সাহস কত! এত লোকজন থাকতেও আবার আমাদের উপর অ্যা’ টা’ ক করতে আসছে!”
বলেই সে উপস্থিত গুটিকয়েক লোকজনের দিকে চাইলো। বললো,
” আর আপনারা এখানে দাঁড়িয়ে কি তামাশা দেখছেন!”
বিন্দু জোরালো স্বরে বললো,
” লোকটা যে দুটো মেয়ের দিকে এভাবে এগিয়ে আসছিলো, এটা কি আপনাদের চোখে পড়েনি? আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেনো? ”
বিন্দু ও মারিয়ার কথায় যেনো টনক নড়লো তাদের। এতক্ষণ তারা আসল ঘটনা খুঁজে বের করার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছিলো। কিন্তু বিন্দু ও মারিয়ার কথায় তারা ভাবনার কাজ রেখে তেড়ে গিয়ে সবদিক থেকে ফয়সালকে জাপটে ধরলো। হইহই করতে করতে অন্যদিকে নিয়ে গেলো ফয়সালকে। ফয়সাল তাদের বারংবার আকুতি মিনতি করছে। কিন্তু কেউই তার কথার গুরুত্ব দিচ্ছে না।
ফয়সালকে নিয়ে যেতে যেতেই রাস্তার ওপাশ থেকে বাইক নিয়ে এপাশে এলো বাদল। এসেই বাহবা দিয়ে বিন্দুকে বললো,
” বাহ! ওয়ান্ডার উইমেন! কি মা’ রটাই না দিলে ঐ ব্যাটাকে!”
অকস্মাৎ বাদলকে দেখে ঈষৎ চমকে উঠলো বিন্দু ও মারিয়া। বিন্দু কিঞ্চিৎ ভীত কণ্ঠে শুধালো,
” আপনি এখানে! সব দেখেছেন আপনি?”
বাদল হেসে বললো,
” হ্যাঁ, সব দেখেছি। তোমার এ কান্ডের কথা ভাইকে শোনালে ভাই তো আকাশ থেকে পড়বে। তার বউ যে এমন ‘জাবারদাস্ত পাঞ্চ’ মা’ র’ তে পারে তা কে জানতো।”
বাদলের কথায় বিন্দু বোকা বোকা হাসলো। তবে বাদলের মুখে ‘বউ’ শব্দটা শুনে শুকনো বিষম খেলো সে। খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছে সে। এদিক ওদিক চেয়ে বিষয়টিকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করলো। সামনে আর কি না কি বলে ফেলে বাদল কে জানে! মারিয়া বিন্দুর এহেন অবস্থা বুঝে তৎক্ষনাৎ বাদলের মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরানোর চেষ্টায় বললো,
” আরেহ আপনি শুধু বিন্দুর পাঞ্চ দেখলেন! আমার চ’ ড় মা’ রা’ টা দেখলেন না তো!”
বাদল বললো,
” আপনার চ’ ড় মা’ রা’ টাও দেখেছি মিস। আপনারা দু বান্ধবী একে অপরের চেয়ে কম না।
বাই দা ওয়ে, লোকটা কে ছিলো? ”
” ব’ খা’ টেই ধরতে পারেন। বিন্দুকে ডিস্টার্ব করছিলো। প্রেমের প্রপোজাল, বিয়ের প্রপোজাল, আর না জানি কিসের কিসের প্রপোজাল!”
” ওও এই অবস্থা….. ভাইকে জানাওনি কেনো বিন্দু? ভাইকে আগে বললে আজ এমন ঘটনা হতো না।”
বিন্দু বাদলের কথায় স্মিত হেসে ভদ্রতার সহিত জবাব দিলো,
” আসলে এসব ছোটখাটো ব্যাপারে কাউকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে না। আমি একাই কোনো না কোনোভাবে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করি।”
বাদল কিঞ্চিৎ বিস্মিত সুরে বললো,
” এসব মোটেও ছোটখাটো ব্যাপার না বিন্দু। এটলিস্ট এমন ডিস্টার্ব করা টাইপ ঝামেলার জন্য ভাইকে ডিস্টার্ব করলে কিছু মনে করতো না সে। বরঞ্চ তোমার কোনো ঝামেলাতেই সে কিছু মনে করতো না। উল্টো নিজের সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করতো। আমি যতটুকু ভাইকে চিনি তাতে……”
কথা সম্পূর্ণ শেষ করতে পারলো না সে। তার ফোনে কল আসতেই সে বিন্দু ও মারিয়াকে ইশারায় ‘আসি’ বলে চলে গেলো।
বাদল যেতেই মারিয়া বিন্দুকে বললো,
” আসলেই বিন্দু, বাদল ভাইয়া ঠিক বলেছে। এই ম্যাটারের জন্য বৃত্ত ভাইয়াকে নক করলে এতদিনে সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেতো। ”
” আচ্ছা এখন এসব বাদ দে তো প্লিজ। ঘটনার সমাধান তো হয়ে গিয়েছে তাই না? তাহলে এখন উনাকে এখানে টেনে আনার মানে কি!
আর হোস্টেলে চল তো। এখন আর খাওয়াদাওয়ার মুড নেই। ”
মারিয়া ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
” আচ্ছা চল।”
—————
রাত প্রায় দশটার দিকে বিন্দুকে কল করলো বৃত্ত। বৃত্ত’র কল দেখেই বিন্দু অনুমান করলো আজকের ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়েই কিছু বলবে বৃত্ত।
বিন্দু কল রিসিভ করলো। বৃত্ত সাথে সাথে ওপাশ থেকে বললো,
” কি ব্যাপার মিস হাল্ক! শুনলাম পাঞ্চ-টাঞ্চ মে’ রে মানুষজনকে উড়িয়ে দিচ্ছো তুমি!”
বৃত্ত’র মুখে ‘হাল্ক’ সম্বোধন শুনে হেসে ফেললো বিন্দু। বললো,
” সোজা হাল্ক বানিয়ে দিলেন! এতোটা পাওয়ারফুলও না আমি। যাস্ট একটা পাঞ্চ দিয়েছি।”
” এই ‘যাস্ট একটা পাঞ্চ’ই অনেক কিছু। তোমাকে ‘হাল্ক’ নাম দেওয়াটা অবশ্য ভুল হয়নি আমার। মাঝে মাঝে আমার সাথে যেভাবে কথা বলো, মনে হয় সুযোগ পেলে আমাকে হাতে নিয়ে ‘লোকি’র মতো এপাশ ওপাশে বাড়ি দিয়ে সব ভাঙচুর করতে।”
বৃত্ত’র কথা শুনে কোনোরূপ কঠোরতা না দেখিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠলো বিন্দু। এই প্রথম বিন্দুর এমন প্রাণ খোলা হাসির ঝংকারে মুগ্ধ হলো বৃত্ত। তার মনটা উতলা হয়ে উঠলো বিন্দুর সেই হাসি দেখার জন্য। বোধহয় আবারো বিন্দুর প্রেমে পড়লো সে!
প্রারম্ভে বিন্দুর মিষ্টি কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ বৃত্ত ফের বিমোহিত হলো বিন্দুর হাসিতে। কি মিষ্টি সেই হাসির ঝংকার।
বৃত্ত’র বিভোরতা কাটলো বিন্দুর কথায়,
” আপনার মতো গাট্টাগোট্টা শরীরের মানুষকে ওভাবে মা’ রা সম্ভব নয়।”
বৃত্ত আমুদে কণ্ঠে বললো,
” উঠিয়ে না মা’ র’ লেও নাক বরাবার একটা ঘুষি মারলেই তো শেষ আমি। তখন ভাঙা নাক নিয়ে আমার বাচ্চাকাচ্চাদের বলতে হবে, দেখ তোর মা আমার কি অবস্থা করেছে। ”
বৃত্ত’র কথায় চমকিত হলো বিন্দু। এ কি বললো বৃত্ত! ইশ, কি পরিস্থিতি! এখন সে এ কথার প্রত্যুত্তর দিবে কি করে? তবে যাই করুক না কেনো, আত্মবিশ্বাসের সহিত কথা বলতে হবে বৃত্ত’র সাথে। যেনো বৃত্ত মনে করে, সে এসব কথা আমলে নেয় না। তাই তো বিন্দু খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে বেশ আত্মবিশ্বাসের সহিত বললো,
” আপনার মতো কনফিডেন্স লেভেলটা আমার দরকার। মানে এখনি আপনি আমাকে আপনার বাচ্চার বানিয়ে দিলেন!”
” তা নয়তো কি! আমার বাচ্চার মা কে হবে জানি আমি।”
” এতোটা কনফিডেন্সও ভালো না৷ বিয়ে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভাগ্যের উপর। ”
” সে ভাগ্যের জোরেই আমার সাথে তোমার নাম জুড়ে দিবো আমি। আজ হোক বা কাল হোক। জোর দিয়ে বলতে পারি আমি।”
নাহ, বিন্দু এবার আর পারছে না। আত্নবিশ্বাসী হতে গিয়ে কথোপকথন অনেক দূরে গড়িয়ে গিয়েছে। এর চেয়ে বেশি কথোপকথন গভীরে চলে গেলে পরবর্তীতে সে বৃত্ত’র মুখোমুখি হতে পারবে না। তাই তো সে তৎক্ষনাৎ বললো,
” আচ্ছা, এখন রাখছি। মারিয়া ডাকছে আমাকে।”
বলেই সে বৃত্তকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে দিলো।
বিন্দু কল কেটে দিতেই বৃত্ত মুচকি হাসলো। বিছানায় শুয়ে মাথার নিচে হাত রেখে প্রশান্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। বিড়বিড় করে বললো,
” বিন্দু তাহলে বদলাচ্ছে। ওর আচরণ আমার প্রতি বদলেছে। ধীরেধীরে সাকসেস হচ্ছি আমি। সে সময় আর দূরে নেই যখন মিস বিন্দু মিসেস বিন্দু বৃত্ত হোসাইন হবে।”
.
সেই রাতেই বাদল নাম্বার জোগাড় করে মারিয়াকে কল করলো। অপরিচিত নাম্বার থেকে কল রিসিভ করে হঠাৎ বাদলের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে উঠলো মারিয়া। বিস্মিত কণ্ঠে বাদলকে বললো,
” বাদল ভাইয়া আপনি! আমার নাম্বার পেলেন কি করে?”
বাদল একটু ভাব নিয়ে বললো,
” তোমার নাম্বার জোগাড় করা আমার জন্য কোনো ব্যাপার নাকি! কি করছিলে তুমি? হাতের ব্যায়াম নাকি?”
” হাতের ব্যায়াম করবো কেনো?”
” আজকে যেমন চড়টা দিলে ভাবলাম রোজ বোধহয় হাতের ব্যায়াম করো। ”
মারিয়া হাসলো। সাথে সাথেই বললো,
” ভালোই তো ফ্লার্ট করতে পারেন আপনি!”
” সে কি ফ্লার্ট করতে যাবো কেনো আমি।”
” বুঝি বুঝি,সব বুঝি। মেয়েরা এসব বিষয় বুঝতে বেশ পারদর্শী। ”
” আই এম ইম্প্রেসড। এতো সহজে তুমি সব ধরে ফেলবে বুঝিনি।”
মারিয়া হেসে বললো,
” মেয়েরা এসব ট্রিক খুব ভালোভাবেই ধরতে পারে। ”
” তাই বলে সব মেয়েরা না।”
” আপনি কি করে বুঝলেন? এক্সপেরিমেন্ট চালিয়েছেন বুঝি?”
” ঐ টুকটাক অভিজ্ঞতা আছে।”
এভাবে বাদল ও মারিয়ার মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো।
———
বেশ ক’দিন পর,
ভার্সিটিতে এসে বৃত্ত’র কানে কিছু কথা গেলো। ক্যাম্পাসের কিছু ছেলেপেলে বৃত্ত ও বিন্দুকে নিয়ে নানারকম আলোচনা করছে। কটু কথা বলছে তাদের নিয়ে। যা কখনো হয়নি সেটাও কিভাবে যেনো বানিয়ে বলছে তারা। বৃত্ত’র কানে এ কথাটি গেলো। সে খোঁজ লাগালো প্রকৃতপক্ষে এসবের পিছনে কে দায়ী। কেননা হুট করে কখনো এমন গুজব ছড়ায় না। নিশ্চয়ই কেউ এ গুজবের সুত্রপাত ঘটিয়েছে। কিন্তু কে সেটা খুঁজে বের করতে চায় বৃত্ত।
রাতে এক স্পোর্টিং ক্লাবে দেখা হলো বৃত্ত ও আশরাফের। বৃত্ত এই স্পোর্টিং ক্লাবে প্রায়ই আসে। আশরাফ এসব জেনেই এখানে এসেছে।
আশরাফ এসেই বৃত্তকে বললো,
” কি ব্যাপার বৃত্ত? কতদিন পর দেখলাম তোকে? খবর কি?”
বৃত্ত জবাবা দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলো। আশরাফ ফের বললো,
” তোকে নিয়ে আজকাল ভালোই চর্চা হয় ক্যাম্পাসে। ঘটনা কি? কিছু-টিছু করলি নাকি।”
আশরাফের কণ্ঠে কুটিলতা প্রকাশ পেলো। বৃত্ত আশরাফের এ কথার সুরেই তৎক্ষনাৎ ধরে নিলো, এই গুজব রটানো ব্যক্তিটি আর কেউ নয় বরং আশরাফ।
বৃত্ত আশরাফকে জিজ্ঞেস করলো,
” তোর এসব নিয়ে এতো ইন্টারেস্ট কেনো? এর মানে কি ওসব মিথ্যা নিউজ তুই ছড়িয়েছিস ক্যাম্পাসে?”
আশরাফ জবাব দিলো না। বাঁকা হাসলো বৃত্তর দিকে চেয়ে। আশরাফের এ হাসিতে বৃত্ত’র সমস্ত শরীর যেনো জ্বলে উঠলো। চট করে মেজাজ গরম হয়ে এলো। তীব্র আক্রোশে সে আশরাফের দিকে এগিয়ে এসে তার কলার চেপে ধরলো। দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
” তোর সাহস তো কম না বিন্দুর নামে ওসব বাজে কথা ছড়িয়েছিস তুই! তোর শত্রুতা আমার সাথে। বিন্দুকে এর মাঝে টানছিস কেনো?”
আশরাফের ঠোঁটে এখনও সেই হাসি। সে বললো,
” তোর দূর্বলতায় একটু হাত দিয়ে দেখলাম, কেমন ছ্যাঁত করে উঠিস তুই।”
” আশরাফ, শেষবারের মতো বলছি। বিন্দুর সাথে খারাপ কিছু করার চিন্তাও মাথায় আনবি না। না হয় তোর লা’ শের টুকরা টুকরা করবো আমি।”
” আহ হা। এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো। খারাপ কিছু তো করিনি আমি। ক্যাম্পাসের সবার আগ্রহ তোরা দুজন। ”
বলেই সে বৃত্ত’র কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
” জাতি জানতে চায়, বিন্দু তোর মিসেস নাকি মিস্ট্রেস।”
®সারা মেহেক
#চলবে