সে আমার অপরাজিতা পর্ব-২১

0
124

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২১
#সারা মেহেক

আশরাফের বিশ্রী ও অশোভনমূলক কথায় বৃত্ত’র মেজাজ এবার পুরোপুরি বিগড়ে গেলো। প্রচণ্ড ক্রোধে তার কপালের শিরা দপদপ করছে। এতক্ষণ যাবত নিয়ন্ত্রণে রাখা ক্রোধটুকু সে মুহূর্তের মধ্যেই ঝেড়ে ফেললো আশরাফের উপর।
শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আশরাফের নাক বরাবর একটা ঘু’ ষি মা’ র’ লো বৃত্ত। অকস্মাৎ আক্রমণে দূরে ছিটকে পড়লো আশরাফ। ভয়ার্ত চাহনি নিয়ে নাকের নিচে হাত বুলিয়ে দেখলো টপটপ করে র’ ক্ত ঝরছে। তার এ ভয় মুহূর্তেই ক্রোধে পরিণত হলো। সে উঠে গিয়ে বৃত্তকে আক্রমণ করতে উদ্যত হলো। কিন্তু এর পূর্বেই বৃত্ত তার উপর দ্বিতীয়বার আক্রমণ করতে করতে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ করলো। এত কিছুর পরও আশরাফ খুব একটা তোয়াক্কা করলো না। বরঞ্চ এ আহত শরীর নিয়েও সে বাঁকা হেসে বৃত্তকে বললো,
” উফ, খুব গায়ে লেগেছে তাই না? বিন্দু তোর মিসেস হলে তো এতো গায়ে লাগার কথা না। তাহলে কি ও তোর মিস্ট্রে……..”
পুরো বাক্যটা শেষ করার পূর্বেই বৃত্ত পাঞ্জাবির হাতা গোটাতে গোটাতে আশরাফকে পুনরায় ঘু’ ষি মারলো। তার যেনো রাগ কিছুতেই কমছে না। সে আশরাফকে আরোও মা’ র’ তে চাইলো। কিন্তু এর পূর্বেই স্পোর্টিং ক্লাবের কিছু সদস্য এসে বৃত্তকে বাঁধা প্রদান করলো। বৃত্ত নিজেকে ছাড়ানোর বেশ চেষ্টা করলো। কিন্তু পেরে উঠলো না তাদের সাথে। চোয়াল শক্ত করে ক্রোধান্বিত কণ্ঠে আশরাফকে বললো,
” কু** বাচ্চা। তুই জীবনেও লাইনে আসবি না তাই না? আজ যদি এরা না আসতো তাহলে তোর লা’ শ পরে থাকতো এখানে। ভাগ্যিস আমার চলে যাওয়ার আগেই এসেছিলি তুই। কয়েকটা মা’ র তো খেয়ে গেলি আমার থেকে। তবুও কেনো যেনো আমার মনটা শান্ত হচ্ছে না। ”
এই বলেই সে বড় বড় নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তাকে শান্ত হতে দেখে লোকগুলো তাকে ছেড়ে দিলো।
আশরাফ এখনও মেঝেতে পড়ে আছে। বৃত্ত’র নিকট হতে এমন ব্যবহার পাওয়া সত্ত্বেও তার মাঝে কিঞ্চিৎ পরিমাণ অনুশোচনারও দেখা মিলছে না। বরঞ্চ সে খুশি হয়েছে। এ খুশির আভাস কি তা হয়তো বৃত্ত ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারবে না।

বৃত্ত বেশ কিছুক্ষণ আক্রোশমূলক চাহনিতে আশরাফের দিকে চেয়ে রইলো। যাওয়ার পূর্বে আশরাফকে বললো,
” এটা আমার লাস্ট ওয়ার্নিং আশরাফ। এরপর এমন কাজ করলে আমি দ্বিতীয়বার ভাববো না। সোজা তোকে খু’ ন করে নালার পানিতে ভাসিয়ে দিবো। ”
বলেই সে পাশের বেঞ্চে থাকা নিজের স্পোর্টিং ক্লাবের ব্যাগটা নিয়ে চলে গেলো। পিছে আশরাফ বৃত্ত’র দিকে চেয়ে বাঁকা হেসে বললো,
” একটু অপেক্ষা কর বৃত্ত। তোর পিছনে এমন একটা ঘা মা’ র’ বো যে সারাজীবন মনে রাখবি তুই।”

————-

বাড়িতে এসে দাদি আর মায়ের মুখোমুখি পড়লো বৃত্ত। জাহানারা বেগম বৃত্তকে দেখা মাত্রই টেনে টেনে বললেন,
” রাজপুত্র বৃত্ত হোসাইন তো দেখি ডুমুরের ফুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখাই পাওয়া যায় না তার।”

শাহানা হোসাইন অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
” দেখবেন কিভাবে আম্মা। রাজপুত্র যে ঘরেই থাকে না। তার তো মা দাদির কোনো চিন্তাই নেই। সারাদিন রাজনীতি আর ভার্সিটি নিয়ে পড়ে থাকে।”
বলেই তিনি বৃত্ত’র দিকে চেয়ে বললেন,
” বলি কি, ওখানে কোনো বিয়ে শাদি করে রেখেছিস নাকি? মা দাদির যে একেবারেই খোঁজ নিস না তুই! বোনটারও খোঁজ নিস না কতদিন৷ ভাবছি তোর বাবাকে বলে তোকে এসব রাজনীতি থেকে আউট করিয়ে দিবো। ”

মা আর দাদির অভিযোগ শুনে বৃত্ত ব্যাগ রেখে হাসতে হাসতে এগিয়ে এলো। সোফায় বসে মা’কে বললো,
” রাজনীতি থেকে আউট করিয়ে দিলে আমি পথে বসে পড়বো মা। কারণ এ রাজনীতি বাদে অন্য কোথাও মন বসে না আমার। ”

” তাই বলে একটু সময় বের করে মা আর দাদির সাথে গল্প করা যায় না? এখনই এতো ব্যস্ততা দেখাস। নির্বাচনের তো আর বেশিদিন নেই। তখন হয়তো সকালের নাস্তাতেও তোকে পাওয়া যাবে না। ”

” ইশ, এত্ত অভিযোগ! আচ্ছা, যাও। কালকে সারাদিন দুজনকে সময় দিবো আমি।”

জাহানারা বেগম ভ্রুজোড়া নাচিয়ে টিপ্পনী কেটে তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করলেন,
” আমাদের সময় দিলে বিন্দুর কি হবে?”

দাদির মুখে এহেন কথা শুনে হতচকিত হলো বৃত্ত। বিস্মিত কণ্ঠে তৎক্ষনাৎ শুধালো,
” বিন্দুর কথা জানলেন কি করে!”

শাহানা বেগম হেসে বললেন,
” বাড়িতে এমন বহু মানুষ আছে খবর দেওয়ার।”

” কে দিয়েছে খবর? বাদল নাকি বর্ষা।”

” সে তো বলা যাবে না। শুধু বল বিন্দুর খবর কি? কবে আসছে সে এই বাড়িতে?”

বৃত্ত’র বিস্ময়ের মাত্রা আকাশচুম্বী হলো। বললো,
” এসব কি বলছেন মা? এখনও ওপাশ থেকে গ্রিন সিগনাল আসেনি। আর আপনারা বলছেন বাড়ি আসবে কবে!”

” তো এখনও কি রেড সিগনাল ওপাশে?”

” উম….. ঠিক রেড সিগনালও না। আবার গ্রিন সিগনালও না। মাঝামাঝিতে আটকে আছে। গ্রিন সিগনাল হতে আরোও সময় লাগবে। ”

” সে কি! কত সময় লাগবে? আমাদের বউমাকে দ্রুত দেখতে চাই। ”

বৃত্ত খানিকটা লাজুক স্বরে বললো,
” বউমা বানাতে এখনও দেরি আছে মা। অপেক্ষা করুন।”

” আর অপেক্ষা সয় না৷ কতদিন আর অপেক্ষা করবো?”

” তা তো বিন্দুর উপর নির্ভর করছে। ও আপনাদের অপেক্ষার প্রহর বাড়ায় নাকি কমায়। সেটাই দেখার বিষয়।”

আরোও কিছুক্ষণ মা, ছেলে আর দাদির মাঝে এ নিয়ে কথোপকথন চললো।

————–

তিনদিন পর,

ভার্সিটি থেকে বেরুনোর পরপরই বৃত্ত ও বিন্দু একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। গতকাল রাতে বিন্দুর কাছ থেকে কিছু সময় চেয়ে নিয়েছে বৃত্ত, জরুরি কথা বলবে বলে। বিন্দু প্রথম প্রথম নিষেধ করলেও পরে রাজি হয়ে যায়।
বৃত্ত রেস্টুরেন্টে বসার পরপরই ওর্ডার দিলো। অতঃপর অকস্মাৎ বিন্দুকে শুধালো,
” তুমি কি কিছু বুঝো না বিন্দু?”

বিন্দু হতচকিত চাহনিতে বৃত্ত’র দিকে চাইলো। শুধালো,
” কি বুঝার কথা বলছেন আপনি?”

বৃত্ত’র কণ্ঠে আকুলতা। সেদিন মা ও দাদির সাথে কথা বলার সে ভেতরে ভেতরে ভীষণ ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। অস্থিরতা কাজ করছে তার মাঝে। হঠাৎ করেই যেনো তার ধৈর্য্য শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। বিন্দুর এমন উপেক্ষামূলক আচরণ সে আর সইতে পারছে না। হ্যাঁ, বিন্দু পূর্বের চেয়ে বেশ ভালো ব্যবহার করে। কিন্তু বিন্দু কি এখনও তার অনুভূতি বুঝতে পারছে না? নাকি বুঝেও সে অনুভূতিকে তোয়াক্কা করছে না। এসব প্রশ্ন জানার জন্যই আজ বিন্দুকে ডেকেছে সে। আজ এসবের সঠিক ও যথাযথ জবাব সে জেনেই ছাড়বে।

বৃত্ত আকুল কণ্ঠে বললো,
” আমাকে বুঝার কথা বলছি। আমাকে কি বুঝো না তুমি? তোমার প্রতি আমার ব্যবহারগুলো বুঝো না?”

বিন্দু এবার সবটা বুঝতে পারলো। খানিক সময় বৃত্ত’র দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর স্মিত হেসে বললো,
“,আপনার কি মনে হয় আমি ভার্সিটিতে পড়েও অবুঝ?

” অবুঝ না হলে তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলো কি বুঝো না?”

“বুঝি। কিন্তু বুঝেও না বুঝার ভান করি।”

“কিন্তু কেনো? এই অবুঝ হওয়ার ভণিতা কেনো?”

” কারণ সব বুঝে আমি আপনাকে প্রশ্রয় দিতে চাইনি। আমি আপনাকে প্রতিবার নানাভাবে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আপনি ঠিক প্রতিবারই আমার আশেপাশে চলে আসেন। আমি চাই না এ অনুভূতিগুলোর ভবিষ্যত আসুক।”

” আমি তো এটাই চাই বিন্দু।”

” কিন্তু আমি চাই না। কারণ আমাদের এ সম্পর্কের ভবিষ্যত নেই। আবার আমিও রিলেশনে জড়াতে চাই না। আমাদের স্ট্যাটাসও মিলে না।”

” স্ট্যাটাস? শুধু এই একটা কারণে এতোদিন আমাকে ইগনোর করছো তুমি?”

” উঁহু। এ কারণ তো নগন্য। আমার আপনার ভবিষ্যত না থাকার কারণটা আরোও বড়।”

” কি সেই কারণ? আমি জানতে চাই। যাকে আমি মনেপ্রাণে চেয়েছি, তার আমাকে ‘না’ বলার কারণটা জানতে চাই।”

” শুনতে পারবেন সেই কারণ?”

” হ্যাঁ, অবশ্যই পারবো।”

” আচ্ছা, তাহলে শুনুন। আপনার রাজনীতি। এটাই আমাদের ভবিষ্যত এক করার সবচেয়ে বড় বাঁধা।”

বিন্দুর এহেন কথায় চরম বিস্মিত হলো বৃত্ত। আশ্চর্যজনক কণ্ঠে শুধালো,
” রাজনীতি! এটা কি করে বাঁধা হতে পারে বিন্দু? ”

বিন্দু নিষ্প্রাণ হাসলো। বললো,
” এটাই আপনাকে অপছন্দ করার সবচেয়ে বড় কারণ। কেননা রাজনীতিকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করি আমি। দু চোখেও দেখতে পারি না রাজনীতিকে, রাজনীতির সাথে জড়িত লোকজনদের। ”

” কেনো বিন্দু? কি করেছে এ রাজনীতি? ”

” করেছে অনেককিছু। এর সাথে আমার অতিত জড়িয়ে আছে। আমি চাই না যে রাজনীতি আমার অতিতের সাথে জুড়ে আছে, সে রাজনীতি আমার ভবিষ্যতের সাথেও জুড়ে থাকুক। ”

” কিন্তু এমন কি আছে তোমার অতিতে?”

” সে আমি বলতে পারবো না। শুধু এটুকু জেনে রাখুন, আমার আপনার কোনো ভবিষ্যত নেই। ”

বৃত্ত আহত কণ্ঠে বললো,
” তোমার প্রতি আমার অনুভূতিগুলোকে এভাবে এক কথায় শেষ করে দিলে বিন্দু?”

বিন্দু শক্ত কণ্ঠে বললো,
” যা সত্য সেটাই বলেছি আপনাকে।
আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি। আমার প্রতি আপনার যে অনুভূতি, তাকে আশ্রয় করে কি আদৌ আপনি রাজনীতি ছাড়তে পারবেন কোনোদিন? আমার কথা ভেবে? ”
®সারা মেহেক

#চলবে