#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_২৬
#সারা মেহেক
ড্রইং রুমে মুহূর্তের মাঝেই থমথমে পরিবেশ তৈরি হলো। সকলেই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে অঘটন ঘটতে যাওয়ার পূর্বেই জাহানারা বেগম এগিয়ে এলেন। ছেলের হাত থমকে দিয়ে ক্রোধান্বিত গলায় বললেন,
” ভুলেও এমন কাজ করতে যাস না আফতাব। জোয়ান ছেলের গায়ে হাত উঠাতে নেই। নিজের রাগ সামলে রাখ। ওর বয়সে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া স্বাভাবিক। ”
মায়ের হাত ছেড়ে দিলেন আফতাব হোসাইন। তেঁতে উঠা গলায় বললেন,
” এসবে আশকারা দিও না আম্মা। বৃত্ত এই কথা বলার সাহস কি করে পেলো! আমার অনুমতি ব্যতিত ও বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয় কোন সাহসে!”
বলেই তিনি বৃত্ত’র দিকে ক্রোধাগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,
” এত বড় সিদ্ধান্ত শোনানোর আগে একবারও আমার কাছে অনুমতি নিয়েছো?”
বৃত্ত নত দৃষ্টিতে ঠাণ্ডা সুরে বললো,
” অনুমতি নেওয়ার মতো যথেষ্ট সময় ছিলো না বাবা। বিন্দুকে বিয়ে করার মতো বড় সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি দেখেই নিতে হয়েছে আমাকে। ঐ মুহূর্তে ওর সম্মান বাঁচানোই আমার জন্য ফরজ হয়ে গিয়েছিলো। ”
আফতাব হোসাইন কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা রাখা দায়। তিনি ফের বললেন,
” একটা নগন্য মেয়ের সম্মান বাঁচাতে আজ সবকিছু জলাঞ্জলী দিতে রাজি তুমি!”
বৃত্ত এবার দৃষ্টি তুলে চাইলো। তার দৃষ্টিতে দৃঢ়তার ছাপ স্পষ্ট। বাবার সাথে কঠোর গলায় বললো,
” আজ বিন্দুর জায়গায় বর্ষা থাকলেও কি এমন কথা বলতেন বাবা?”
ক্রোধে থরথর করে কাঁপতে লাগলেন আফতাব হোসাইন। গলার স্বর উঁচিয়ে বললেন,
” জবান সামলে কথা বলো বৃত্ত! কার সাথে কার তুলনা দিচ্ছো তুমি?”
” আমাকে তুলনা দিতে বাধ্য করেছেন বাবা। আমি কখনো আপনার সাথে এমন ব্যবহার করিনি। কিন্তু আজ বাধ্য হয়ে করছি। আমার কারণে বিন্দুর সম্মানে আঁচ এসেছে। সুতরাং ওকে বিয়ে করে ওর সম্মান বাঁচানো আমার কর্তব্য। পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে ওর আর আমার নকল কাবিননামা বানাতে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ওকে বিয়ে করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।”
আফতাব হোসাইন প্রত্যুত্তর দিতে যাবেন। এমন মুহূর্তে গার্ডে দৌড়ে এসে ভেতরে ঢুকলো। আতঙ্কিত গলায় বললো,
” স্যার,বাড়ির বাইরে সাংবাদিকরা আইছে। বাইরে হইহট্টগোল শুরু কইরা দিছে। ”
আফতাব হোসাইন যেটার ভয়ে ছিলেন, ঠিক সেটাই হচ্ছে এখন। তিনি বৃত্ত’র দিকে চেয়ে শক্ত কণ্ঠে বললেন,
” তোমার বপন করা বীজ এখন আমাদের উপর ভারী পড়ছে।”
বৃত্ত অভয় দৃষ্টিতে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
” বাবা,আমি সবটা সামলাবো। মাথা ঠান্ডা করে বর্ষার কথা চিন্তা করবেন। তারপর বিন্দু আর আমার বিয়ের কথা চিন্তা করবেন। তখন আপনার কাছে আমার সিদ্ধান্ত সঠিক মনে হবে।”
বলেই সে জাহানারা বেগমকে জিজ্ঞেস করলো,
” দাদী, আমার সিদ্ধান্ত কি সঠিক পথে এগোয়নি?”
জাহানার বেগম বললেন,
” অবশ্যই সঠিক পথে এগিয়েছে। পরিস্থিতিটা তোর কারণে তৈরী হয়েছে। এখন এ পরিস্থিতি থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে তোর যা যা করা প্রয়োজন তার সবটা করবি।”
বলেই তিনি আফতাব হোসাইন এর কাঁধে হাত দিয়ে বললেন,
” মাথা একটু ঠান্ডা কর আফতাব। আজ যদি বর্ষা এমন কোনো বিপদের মুখে পড়তো তাহলে কি তুই এমন সিদ্ধান্ত নিতিস না? বিন্দুকে বিপদ থেকে বাঁচাতে বৃত্ত নকল কাবিননামা বানিয়েছে। সেটা ওর পরিবারও জানে খুব সম্ভবত। আর এই সংবাদ ওর বাড়ির আশপাশ ছড়িয়ে যেতে সময় লাগবে না। তাহলে এমন ঘটনা ঘটার পর কোনো পরিবার কি ওকে আপন করে নিবে? ওর সাথে কোনো ছেলের বিয়ে দিবে? দিবে না। আর বৃত্ত ওকে ভালোবাসে। ও-ই বিন্দুকে এই মুহূর্তে সামলাতে পারবে। তুই একটু মাথা ঠান্ডা করে চিন্তা কর। বাকিটা বৃত্ত আর বাদল সামলে নিবে। ”
বলেই তিনি বৃত্ত ও বাদলের উদ্দেশ্যে বললেন,
” তোরা বাইরে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দে। ওরা যেনো ভুলেও সত্য ঘটনা না জানতে পারে।”
বৃত্ত বাদলকে নিয়ে বাড়ির গেটের সামনে এসে দাঁড়ালো। শহরের বেশ কিছু পরিচিত সাংবাদিক তাদেরকে পেয়ে জেঁকে বসলো যেনো। শুরুতেই এক সাংবাদিক নিঃসংকোচ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
” ভিডিওতে দেখানো ঐ মেয়েটার সাথে কি আপনার অবৈধ সম্পর্ক আছে বৃত্ত সাহেব? ঐ মেয়েটার সাথে কি আপনি বিবাহ সম্পর্ক ব্যতিত রাত যাপন করেছেন?”
সাংবাদিকের এহেন প্রশ্নে ক্রোধে সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগলো বৃত্ত’র। সে হাতের মুঠো শক্ত করে
বললো,
” মুখ সামলে কথা বলুন। ভদ্র ভাষায় প্রশ্ন করা কি আপনাদের পেশায় নেই? ফার্দার এমন প্রশ্ন করলে আপনাদের নামে মানহানীর কেস করতে দ্বিতীয়বার ভাববো না। ”
সাংবাদিকরা চুপসে গেলো। বাদল এবার বললো,
” ভিডিওতে দেখানো মেয়েটি ভাইয়ার বিয়ে করা বউ। সো, তারা একসাথে রাত যাপন করুক বা না করুক এতে আপনাদের এতো জ্বালা কেনো?”
সাংবাদিকরা বিস্মিত হলো। একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো। তন্মধ্যে একজন সাহস জুগিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” তারা বিবাহিত এর প্রমাণ কি? কেননা তাদের বিয়ে সম্পর্কে কেউই জানে না। তাহলে আমরা কি করে মেনে নেই?”
” বিয়ে হয়েছে সম্পূর্ণ পারিবারিকভাবে। সামনে নির্বাচন দেখে এ ব্যাপারে ঘটা করে বলা হয়নি। আর প্রমাণ দেখতে চান? আমি এক্ষুণি কাবিননামা নিয়ে আসছি।”
বলে বাদল বাড়ির ভেতর যেতে নিলো। কিন্তু এর পূর্বেই আফতাব হোসাইনের আগমন ঘটলো সেখানে। সাংবাদিকরা সব তটস্থ হলো। আফতাব হোসাইন এসেই গাম্ভীর্যতার সহিত বললেন,
” স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এভাবে প্রশ্ন করার আপনারা কে? ঐ মেয়েটার নাম বিন্দু। বিন্দু এ বাড়ির বড় ছেলে বৃত্ত’র বিয়ে করা বউ। আর কিছু জানতে চান?”
সাংবাদিকরা দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। কেননা তারা আফতাব হোসাইনের ক্ষমতা সম্পর্কে বেশ ভালোভাবে অবগত। তাই পিছিয়ে গেলো তারা। এমতাবস্থায় বৃত্ত’র ফোনে জুবায়েরের কল এলো। ওপাশ থেকে জুবায়ের আতঙ্কিত গলায় বললো,
” বৃত্ত, এদিকে ঝামেলা হয়ে গিয়েছে। আমাদের বাড়ির সামনে সাংবাদিক এসে হাজির হয়েছে। ওরা এখানকার ঠিকানা পেলো কি করে?”
জুবায়েরের কথায় বিস্মিত হলো বৃত্ত। বিন্দুদের বাড়িতে সাংবাদিকরা গেলো কি করে? ওখানকার ঠিকানা পেলোই বা কি করে? এখানেও কি আশরাফের হাত আছে?
——-
সম্পূর্ণ চুপিসারে বিন্দু ও বৃত্তর বৈধ বিয়ের কার্যক্রম সম্পন্ন হলো। গতকাল রাতের ঘটনা ঘটার পরপরই আজ রাতে আফতাব হোসাইন, বৃত্ত ও বাদল গিয়ে বিয়ের সম্পূর্ণ কার্যক্রম সম্পন্ন করে বিন্দুকে এ বাড়িতে নিয়ে এসেছে।
বিন্দু কারোর সাথে কোনোরূপ কথা বলছে না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস কবুল করে বিয়েতে মত দিয়েছিলো সে। বিয়েতে শুধুমাত্র কবুল বলা ব্যতিত আর জবান খুলেনি সে। শুধু যাওয়ার পূর্বে সুফিয়া বেগমকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছে সে। বারবার খালা ও খালুর কাছে ক্ষমা চেয়েছে। আজ যদি সে না থাকতো তবে তাদের এ সম্মানহানী হতো না নিশ্চয়ই। তাদের এ করুন পরিণতির জন্য বারংবার নিজেকে দোষারোপ করছে বিন্দু। তবে একবারও এ নিয়ে কারোর কাছে অভিযোগ করেনি। এমনকি বৃত্তর কাছেও না। বরং সে গতকাল এর পর হতে এ পর্যন্ত বৃত্তর সাথে মুখ ফুটে কথাও বলেনি।
গোলাপ ও রজনীগন্ধা দিয়ে অতি সাধারণভাবে সাজানো হয়েছে তাদের বাসর ঘর। যদিও এ বাসর ঘর সাজানোর পক্ষে ছিলো না বৃত্ত। তবে বর্ষার জোরাজোরিতে শেষমেশ বাসর ঘর সাজানোর অনুমতি দিয়েছিলো সে।
বিন্দুকে সাদরে গ্রহণ করে শাহানা হোসাইন, জাহানারা বেগম ও বর্ষা তাকে বৃত্তর রুমে বসিয়ে দিয়ে গেলো। যাওয়ার পূর্বে শাহানা হোসাইন বিন্দুর মাথায় হাত রেখে সস্নেহে বললেন,
” বিয়েটা যেমন পরিস্থিতিতে হয়েছে তাতে বৃত্তকে মেনে নিতে হয়তো কষ্ট হতে পারে তোমার জন্য। কিন্তু আমার একটা কথা মনে রেখো বিন্দু, আমার ছেলের মতো জীবনসঙ্গী দ্বিতীয়টি খুঁজে পাবে না তুমি। ওর মতো ছেলে সারাজীবন তোমার পাশে থাকবে। দেখো, একদিন আমার কথাটা বেশ ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পারবে তুমি। শেষ পর্যন্ত এই দোয়াই করি যেনো তোমাদের এ সংসার সুখের সংসার হয়। ”
বিন্দু প্রত্যুত্তর করলো না। শুকনো মুখে চেয়ে রইলো শাহানা হোসাইনের পানে। শাহানা হোসাইনও আর কথা বাড়ালেন না। শাশুড়ি ও মেয়েকে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন রুম থেকে। তাদের বেড়িয়ে যাওয়ার পরপরই বৃত্ত প্রবেশ করলো রুমে। রুমে প্রবেশ করতেই তার দৃষ্টি আটকে গেলো বিন্দুর পানে। লাল টুকটুকে শাড়িতে বিন্দুকে ভীষণ মানিয়েছে। কিন্তু তার ঐ নিষ্প্রাণ চেহারাখানির নিকট এ শাড়ির রঙ সম্পূর্ণতরে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বৃত্ত’র মায়া হলো ভীষণ। সে এগিয়ে গিয়ে বিন্দুর মুখোমুখি বসলো। তটস্থ হলো বিন্দু। কিছুটা পিছিয়ে বসলো সে। যেনো বৃত্ত তার অপরিচিত কেউ। বৃত্ত তার এহেন কান্ডে কিছুটা বিস্মিত হলো বটে। কিন্তু এ বিস্ময়ভাব কাটিয়ে সে বিন্দুর হাতে হাত রাখতে উদ্যত হলো। তৎক্ষনাৎ এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নিলো বিন্দু। ঘটনার আকস্মিকতায় ঈষৎ ঘাবড়ে গেলো বৃত্ত। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কি হলো বিন্দু? এভাবে দূরে সরে যাচ্ছো কেনো?”
মুহূর্তেই বিন্দু অশ্রুসিক্ত চাহনিতে অনুনয়ের সুরে বললো,
” আমাকে ছোঁবেন না প্লিজ।”
#চলবে