সে আমার অপরাজিতা পর্ব-৩১

0
121

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৩১
#সারা মেহেক

ডাইনিং এ খেতে বসেছে সবাই। সকলে বেশ তৃপ্তি সহকারে নিশ্চিন্তেই খাবার খাচ্ছে। কিন্তু বিন্দুর গলা দিয়ে কোনো খাবারই নামছে না। বারংবার তার চোখের সামনে আজ সকালের ঘটনাটি ভেসে উঠছে। বৃত্ত কি তবে সামনের দিনগুলোতে তার সাথে জোরজবরদস্তি মূলক সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করবে? কাল রাতে ওটুকু দুশ্চিন্তা দেখানো কি তবে ভুল হয়েছিলো? ভেবে পেলো না সে। বৃত্ত তার পাশেই বসে ছিলো। খাবার প্রতি তার অনিহা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
” খাচ্ছো না কেনো বিন্দু? কোনো সমস্যা? ”
বলেই সে বিন্দুর পাশে খানিকটা এগিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” আজকের এই হুটহাট রোম্যান্স কি হজম হয়নি?”
মাত্রই এক টুকরো রুটি গালে তুলেছিলো সে। অমনিই বৃত্তর এহেন কথা শুনে বিষম খেলো সে। কাশি দিয়ে পানির গ্লাস নিতে হাত বাড়ালো। তবে বৃত্ত নিজের গ্লাসের পানি তার মুখের সামনে ধরে বললো,
” খেয়ে নাও জলদি।”
বিন্দু কোনো দিকে না তাকিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলো। ওদিকে হঠাৎ তার কাশি উঠে যাওয়ায় প্রত্যেকের খাবারে বিঘ্ন ঘটলো। শাহানা হোসাইন উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” ঠিক আছো তো বিন্দু? ”
বিন্দু পানি খাওয়া শেষে বললো,
” জ্বি আন্টি। গলায় খাবার আটকে গিয়েছিলো। এখন ঠিক আছি।”
আফতাব হোসাইন খাবার খেতে খেতে হঠাৎ বললেন,
” বিন্দু? তোমার খালা, খালু তো এখানে আসেনি তাই না?”
হঠাৎ আফতাব হোসাইনের নিকট হতে নিজ নামের সম্বোধন শুনে ভীষণ অবাক হলো বিন্দু। কারণ বিয়ের পর হতে এ কয়দিনে সে একটিবারের জন্যও শ্বশুরের মুখে নিজের নাম শুনেনি। তাই আজ হঠাৎ এমন নাম শোনায় সে প্রথম দফায় খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছিলো।
নিজেকে ধাতস্থ করে বিন্দু তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো,
” জ্বি আংকেল।”
আফতাব হোসাইনের খাওয়া ততক্ষণে শেষ। পানির গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন,
” ভাবছি তাদের দাওয়াত দিবো। তাদের মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে একবার হলেও ঘুরে যাওয়া উচিত। আবার বেয়াইন বলে কথা। তুমি আমাকে নাম্বার দিও বিন্দু। তোমার খালুর সাথে পার্সোনালি কথা বলবো। ”
আফতাব হোসাইনের এ আন্তরিকতায় বিন্দু ভীষণ খুশি হলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে তবে নিজের খুশির দ্যুতি দমিত রেখে বললো,
” জ্বি আংকেল। আমি এক্ষুণি দিচ্ছি। ”
” আচ্ছা। ”
আফতাব হোসাইন ক্ষণিকের জন্য থেমে ফের বললেন,
” আর হ্যাঁ, শোনো, আংকেল বলবে না আমাকে। এ বাড়ির বউ হয়ে এসেছো তুমি। সুতরাং সম্পর্কের মান ধরে রাখতে শিখো। এখন থেকে বাবা বলবে আমাকে। আর শাহানাকে মা। মনে থাকবে?”
আফতাব হোসাইনের বাচনভঙ্গির ধরণে বিন্দু ফের ঘাবড়ে গিয়েছিলো। তবে নিজেকে সামলে বললো,
” জ্বি আংকে…….সরি, বাবা। আর ভুল হবে না বাবা।”
আফতাব হোসাইন মাথা নাড়িয়ে বললেন,
” হুম। যত দ্রুত সব শিখে যাবে তত ভালো।
কিছু কথা বলছি। মন দিয়ে শোনো বিন্দু। এগুলো বলার আসলে সময় পাইনি। তাই আজ খাবার টেবিলেই বলছি৷ তুমি এখন এই শহরের
মেয়রের একমাত্র পুত্রবধূ। তোমাদের বিয়েটা এক্সিডেন্টলি হয়েছে। এটা তুমি, আমি, আমরা জানলেও জনগণ জানে না। এ শহরের প্রায় প্রতিটা মানুষ আমাকে চিনে, সম্মান করে। প্রতিবার তারা আমাকে ভোট দিয়ে জিতিয়ে দেয়। সুতরাং তাদেরও তো কিছু চাওয়া-পাওয়া আছে। আমি যে বড় ছেলের বউ ঘরে তুলেছি, এর বিনিময়ে তারাও তো কিছু চাইবে। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, বৃত্তর মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হলে নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম ছাড়ার আগেই তোমাদের রিসেপশনের আয়োজন করবো। এতে করে জনগণ খুশিও হলো, আর আমার ছেলের বউকেও চিনে রাখলো।”
বলে আফতাব হোসাইন কিছুক্ষণের জন্য বিরতি নিলেন। সকলের মতামত জানার উদ্দেশ্যে। সকলেই খাবার শেষ করে আফতাব হোসাইনের কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। জাহানারা হোসাইন বেশ সন্তুষ্ট হলেন ছেলের কথায়। বললেন,
” ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। জনগণকে অভিযোগ করার সুযোগ না দিয়ে আগেভাগে কাজ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ঠিক বললাম না বৃত্ত?”
বৃত্ত মাথা নাড়িয়ে বললো,
” জ্বি দাদি।”
বৃত্তর রিসেপশনের কথা শুনে বর্ষা ভীষণ খুশি হলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে বললো,
” তাহলে রিসেপশনের তো আর বেশিদিন নেই। শপিং শুরু করতে হবে। বাদল ভাইয়া আর ভাবি, তোমরা আমাকে হেল্প করবে। বৃত্ত ভাইয়া তো পরীক্ষা নিয়ে বিজি থাকবে।”
মেয়ের উৎফুল্লতায় ব্রেক কষলেন আফতাব হোসাইন। গম্ভীর মুখাভাব এনে বললেন,
” বিন্দু, যেহেতু এখন থেকে তুমি পরিচিত মুখ হতে যাচ্ছো, তার উপর সামনে নির্বাচন তাই একটু সাবধানে থাকবে। এখন ঝোপঝাড় থেকে আমাদের শত্রুরা উঠে আসবে। নানাভাবে আমাকে, আমার পরিবারের সবার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে। অন্যান্য শহরে এতো খু’ ন’ খা’ রা’ বি’ না হলেও এ শহরে হয়। এ শহরের রেকর্ড খুব একটা ভালো না। নির্বাচন এলেই আশেপাশে অনেক ঘটনা শোনা যায়। এজন্য তখন আমি সিকিউরিটি বাড়িয়ে দেই। আবার এ বছর আমি এমপি পদে নমিনেশন দিবো। আর বৃত্তকে এমপি পদে নমিনেশন দেওয়াবো।”
আফতাব হোসাইনের শেষোক্ত কথাটি ডাইনিং এ হঠাৎ পিনপতন নীরবতা সৃষ্টি করলো। এতদিন কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি যে তিনি বৃত্তকে মেয়রের পদে দাঁড় করাবেন। বৃত্ত নিজেও জানতে পারেনি এ ব্যাপারে। বাবার কথায় আকাশসম বিস্ময় নিয়ে সে বললো,
” আমাকে মেয়র পদে দাঁড় করাবেন! এ সিদ্ধান্ত কখন নিলেন! ”
” নিয়েছি অনেক আগেই। কিন্তু কাউকে জানাইনি। মনের মধ্যেই রেখেছিলাম। তোমার পড়ালেখার পাট চুকে যাবে এবার। আমি চেয়েছিলাম অনার্স শেষ করেই তোমাকে রাজনীতির মধ্যে ঢুকাবো। কিন্তু তুমি মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য এপ্লাই করলে দেখে আমি সিদ্ধান্ত বদলে ফেললাম। তোমাকে রাজনীতির জগতে আনবো বলেই যেসব কাজ তোমাকে দিয়ে করানো সম্ভব, সবটা করিয়েছি। তুমিও নিজের দায়িত্ব ভালোভাবে পালন করেছো। আর আমি চাই, আমাদের বংশ পরম্পরায় রাজনীতি চলুক। এখন আমি শহর সামলাচ্ছি, সামনে তুমি সামলাবে, তারপর বাদল, তারপর তোমাদের সন্তানরা। এভাবেই চলবে। এ বছর তুমি নির্বাচনে দাঁড়াবে। পরের বার বাদল দাঁড়াবে। এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি তোমাদের নিয়ে। ”
বাবার কথায় বৃত্ত ও বাদল একে অপরের দিকে উদ্বিগ্ন চাহনিতে চাইলো। বৃত্ত এবার বললো,
” কিন্তু এসব অনেক বড় দায়িত্ব বাবা। আমি কি আদৌ পারবো?”
” কেনো পারবে না? তোমার শেখার জন্যই আমি সবসময় তোমাকে আমার সাথে ছায়ার মতো রাখার চেষ্টা করেছি। তুমি পারবে বৃত্ত। আর আমি চাই না কোনো অযোগ্যের হাতে শহরটা যাক। আমার হাতে গড়া এ শহরটাকে আমার ছেলে সামলাবে। এটাই চাই আমি। ”
বলেই তিনি বৃত্তর জবাবের অপেক্ষা না করে বিন্দুকে বললেন,
” আমাদের সব কথা তো শুনলে বিন্দু। তাই বলছি, এখন থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করে চলবে। দূরে কোথাও গেলে অবশ্যই কোনো এক বডিগার্ডকে নিয়ে যাবে। আর আমাদের কাউকে অবশ্যই জানাবে। যদিও ধীরেধীরে আমি সিকিউরিটি সিস্টেম টাইট করবো। তবুও নিজের সেফটি নিজের কাছে। কি? বুঝলে কথা?”
বিন্দু বাধ্য মেয়ের ন্যায় মাথা নাড়িয়ে বললো,
” জ্বি বাবা।”
” আচ্ছা, অনেক কথা বললাম। এবার উঠি। অফিসে যেতে হবে। বাদল,তুমি এখন আমার সাথে অফিসে যাবে। আর বৃত্ত, তোমার যদি এ সম্পর্কিত কোনো কথা বিন্দুকে বুঝিয়ে দিতে হয়, তাহলে এখন বুঝিয়ে তারপর অফিসে আসো। আর বাকি কথাবার্তা সন্ধ্যায় এসে বলবো আমি। ”
বলেই আফতাব হোসাইন উঠে গেলেন। পিছে বৃত্তকে প্রচণ্ড উদ্বিগ্নতায় রেখে গেলেন। এতদিন যাবত বাবার কাজগুলো নিতান্তই ক্ষুদ্র মনে হয়েছে। কিন্তু এখন নিজের কাঁধে এসব দায়িত্বের বোঝা আসবে। কিভাবে সে সামলাবে সব। উপরন্তু বাবার এ সিদ্ধান্ত বিন্দুর জীবনে আরোও বিপদ ডেকে আনবে। তার প্রাণ হুমকি যা- তা। কিন্তু বিন্দুর উপরে একটা আঁচড়ও সে সহ্য করতে পারবে না। অথচ তার বাবা পরোক্ষভাবে বিন্দুর উপরই যেনো সকল বিপদ ডেকে আনলেন।

#চলবে
®সারা মেহেক