সে আমার অপরাজিতা পর্ব-৩২

0
128

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৩২
#সারা মেহেক

বৃত্তর মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে। বিন্দু তার পাশে নেই। সে গিয়েছে তার খালার কাছে। মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে আফতাব হোসাইন বিন্দুর খালা,খালু ও দুই ভাইকে দাওয়াত করেছিলো। নতুন বেয়াইনদের প্রতি আফতাব হোসাইনের মেহমানদারীর কোনো কমতি ছিলো না। তিনি মন থেকে তাদের স্বাগত জানিয়েছেন৷ তাঁর এরূপ উদার ব্যবহারে সুফিয়া বেগম ও আহসান সাহেব ভীষণ খুশি হয়েছেন৷ তবে থেকে বিন্দুকে নিয়ে তাদের সকল চিন্তার অবসান ঘটেছিলো৷ তার ঠিক কয়দিন পরই আহসান সাহেব বেশ অসুস্থ হয়ে যান। ফলস্বরূপ বিন্দুকে তার খালাদের বাসায় রেখে আসে বৃত্ত।

সুফিয়া বেগমের সাথে রান্নাঘরে কাজ করছে বিন্দু। তার দেহখানা এখানে থাকলেও মনখানা পড়ে আছে বৃত্তর কাছে। কথায় আছে, দূরত্বের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক বর্গের সমানুপাতিক। বিন্দু এটা ভালোমতোই টের পেয়েছে। আজকাল বৃত্তর চিন্তায় সময় কাটে তার। কখনো বৃত্তর দুশ্চিন্তায়, তো কখনো বৃত্তকে ঘিরে কিছু সুখানুভূতিতে সময় কাটে তার৷ নিজেকে পরিস্থিতির সাথে সামলে নিয়েছে সে। বৃত্তকে মন থেকে স্বীকার করেছে। কেননা সে মানতে বাধ্য বৃত্তর মতো ভালো ছেলে সে ভাগ্যগুণে পেয়েছে।
আজকাল নিজ থেকেই কল করে বৃত্তকে। বৃত্তও কল রিসিভ করে যথেষ্ট সময় দিয়ে কথা বলে। আজও বিন্দু কল দিয়েছে বৃত্তকে। বৃত্ত মাত্রই অফিস থেকে ফিরেছে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। তবে বিন্দুর ফোন দেখা মাত্রই সে সকল ক্লান্তি ভুলে হাসিমুখে কল রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে বিন্দুর সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলো,
” কেমন আছেন?”

বৃত্ত জবাব দেয়,
“তোমাকে ছাড়া যেমন থাকার কথা তেমন আছি। তুমি কেমন আছো? ”

” আপনার মতোই!”

” হঠাৎ আমার কথা মনে পড়ছিলো বুঝি?”

” হঠাৎ মনে হওয়ার কি আছে? আপনার কথা সারাদিন ভাবি। একদম নির্দ্বিধায় স্বীকার করলাম।”

” তাহলে ফোন করো না যে?”

” আপনি যদি ব্যস্ত থাকেন তবে?”

” তোমার জন্য সকল ব্যস্ততাকে এখন বুড়ো আঙুল দেখাতে রাজি বিন্দু। এক মিনিটের কথায় দুনিয়া উলোটপালোট হয়ে যায় না। ”

বিন্দুর কণ্ঠে এবার হঠাৎ করে উদাসীনতার দেখা মিললো। বললো,
” আমাকে নিয়ে যাবেন না বৃত্ত?”

বৃত্ত কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। শুধালো,
” তুমি আসবে! খালু অসুস্থ যে?”

” খালু আগের চেয়ে কিছুটা সুস্থ হয়েছে। খালামনি আমাকে চলে যেতে বললো। বললো, এতদিন বলে শ্বশুরবাড়ি ছাড়া মেয়েদের থাকা উচিত না।”

বৃত্ত মৃদু হাসলো। বললো,
” শ্বশুরবাড়ি না, বলো স্বামী ছাড়া কোনো মেয়ের এতদিন থাকা উচিত না। তাহলে বলো, কখন নিতে আসবো তোমাকে?”

বিন্দু খাটে হেলান দিয়ে বললো,
” যখন আপনার মর্জি!”

” যদি অনুমতি দাও তবে এক্ষুণি নিতে আসছি।”

বিন্দু ঈষৎ ঘাবড়ায়। ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে ১২টা বাজে। তৎক্ষনাৎ সে বলে উঠে,
” না না। অনেক রাত হয়েছে। আপনি এখন ঘুমান।”

” আচ্ছা, মেনে নিলাম তোমার কথা। তবে রেডি থেকো, যেকোনো সময় চলে আসতে পারি।”

ওপাশে বিন্দু লাজুক হাসলো। বললো,
” সে দেখা যাবে। আপনি এখন ঘুমান।”

” আচ্ছা, তুমিও শুয়ে পড়ো।”

বিন্দু নিজ থেকেই কল কেটে দিলো। সে জানে বৃত্ত কল কাটবে না। যতক্ষণ সে না কেটে দিবে বৃত্ত কলেই থাকবে।

.

বিন্দু ফজরের নামাজ শেষে ঘুমিয়েছে আধ ঘণ্টা হলো। হঠাৎ ফোনের রিংটোনে ঘুম ভাঙে তার। আধো আধো চোখ মেলে ফোনের স্ক্রিনে বৃত্তর নাম দেখলো। এই অসময়ে বৃত্তর কল দেখে ভ্রু কুঁচকে নিজেকেই জিজ্ঞেস করলো,
” এত সকালে কল দিলেন কেনো উনি?”
বলেই সে কল রিসিভ করলো। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” এই সময়ে কল দিয়েছেন যে?”

” রেডি হও। তোমাকে নিতে এসেছি।”

বৃত্তর এহেন কথায় মুহূর্তেই বিন্দুর তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাব কেটে গেলো। তড়াক করে উঠে বসলো। কানে ফোন চেপেই আকাশসম বিস্ময় নিয়ে বললো,
” কিহ! এখন! সত্যি আপনি নিতে এসেছেন নাকি মজা করছেন?”

” একবার রুমের জানালা খুলেই দেখো, সত্য না মিথ্যে বলছি!”

বিন্দু তৎক্ষনাৎ তার রুমের জানালা খুলে দিলো। দেখলো, বৃত্ত সত্যিই বাড়ির বাইরের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে। বিস্ময়ে বিহ্বল বিন্দুর চোখ দুটো বড় হয়ে এলো। অবাক স্বরে বললো,
” আপনি! এই সময়ে!”

বৃত্ত মুচকি হাসলো। বললো,
” হ্যাঁ। আর তর সইছিলো না। ”

বিন্দু আর কথা বাড়ালো না। ফোন রেখে দরজা খুলে উঠোনে চলে এলো। দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো বৃত্তকে৷ মুহূর্তেই এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে ছেয়ে উঠলো সমস্ত অঙ্গ। ঠোঁটের কোনে দেখা মিললো স্বস্তি ও শান্তির হাসি। বৃত্তও শক্ত হাতে চেপে ধরলো তাকে। যেনো ছেড়ে দিলেই মুক্ত বিহঙ্গের ন্যায় উড়াল দিবে। অতঃপর ভোরের উদয়মান সূর্য্যের প্রস্ফুটিত আলোতে দুজনে কাটালো নিস্তব্ধ কিছু সময়ে।

——————-

নির্বাচনের মনোনয়ন ফর্ম জমা দেয়াকে কেন্দ্র করে পক্ষ-বিপক্ষ তিনটি দলের মা’ রা’ মা’ রি’ চলছে। এলাকায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছে। জরুরী পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। চারপাশে এ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে বৃত্ত ও বাদল আফতাব হোসাইনকে জোরপূর্বক বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।

চরম দ্বন্দ্বের এ পরিবেশে আফতাব হোসাইনের দলের কিছু ছেলেপুলে আহত হয়। বাদলসহ কয়েকজন মিলে দ্রুত তাদের হসপিটালে নিয়ে গেলে বৃত্ত এদিকটায় সামাল দেয়। প্রতিপক্ষের দলের আ’ ক্র’ ম’ ণ থামাতে পুলিশ লাঠিচার্জও করে। তবে তাদের হিং’ স্র’ তা’ র মাত্রা বাড়ছে বৈ কমছে না। বৃত্ত এলাকার এ অবস্থা দেখে চরম উদ্বিগ্ন হয়। এমতাবস্থায় হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠে। স্ক্রিনে বিন্দুর নাম দেখে বৃত্তর কপাল কুঁচকে আসে। মনে মনে আওড়ায়,
” এই সিচুয়েশন সম্পর্কে সামান্য জানলেই বিন্দুর টেনশন বাড়বে। এখন ফোন ধরা উচিত হবে না। ”
বলেই সে কল কেটে পাঞ্জাবির পকেটে ফোন রেখে দিলো।
ওদিকে চরম উৎকণ্ঠায় সময় পার করা বিন্দুর অস্থিরতা আরোও বাড়লো। আফতাব হোসাইনকে একা বাড়ি ফিরতে দেখেই মূলত তার ভয় বেড়েছে।
সে ফের কল করলো। বৃত্ত এবারও ফোন ধরেনি। শুধু পকেট থেকে ফোন বের করে সাইলেন্ট করে ফের ফোন পকেটে ঢুকিয়েছে। এ মুহূর্তে ফোন রিসিভ করা অনুচিত। এই অ’ রা’ জ’ ক’ তা’ পূর্ণ পরিবেশের কোনো আভাস বিন্দু অব্দি যাওয়া যাবে না।

বৃত্ত এবার বাদলকে কল করে হসপিটালের পরিস্থিতি সম্পর্কে জেনে নিলো। অতঃপর ফোন কেটে দিতেই অকস্মাৎ কোথা হতে একটা বড় ইটের টুকরো তার মাথার সামনের অংশটুকুয় আঘাত করলো। ঘটনা পুরোপুরি বুঝে উঠার পূর্বেই বৃত্ত টের পেলো তার কপাল বেয়ে গরম তরল বেরিয়ে আসছে। এটি যে রক্ত তা বুঝতে বুঝতে চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এলো। মাথা ঝিম ধরে এলো। কণ্ঠনালী হতে কোনোপ্রকার শব্দ নিঃসৃত হওয়ার পূর্বেই জ্ঞান হারালো বৃত্ত।

জ্ঞান ফিরতেই বৃত্ত নিজেকে সিলিং এর নিচে আবিষ্কার করলো। সিলিংটা যে নিজের রুমেরই তা বুঝতে খানিক সময় লাগলো। অতঃপর পাশে তাকিয়ে দেখলো বিন্দু শুকনো মুখে চেয়ে আছে তার দিকে। বিন্দুকে দেখেই সে দূর্বলচিত্তে হাসলো। যেনো কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলো,
” কি অবস্থা বিন্দু? এমন করে তাকিয়ে আছো কেনো?”

বিন্দু এতক্ষণ নীরবে ছিলো। বৃত্তর এই দুটো প্রশ্নই তাকে কাঁদিয়ে ছাড়লো। ঝরঝর করে কেঁদে অভিমানী কণ্ঠে রাগত স্বরে বললো,
” খবরদার কথা বলবেন না আমার সাথে। কতবার ফোন দিয়েছি আপনাকে জানেন? একবারও ফোন রিসিভ করেননি। আমার তো কোনো চিন্তাই নেই আপনার? এদিকে যে আমি টেনশনে ম’ রে যাচ্ছিলাম তাতে আপনার কি তাই না? আপনাকে যখন হসপিটালে দেখলাম তখন আমার অবস্থা কি হয়েছিলো জানেন?”

বিন্দুর শতশত অভিযোগে বৃত্ত হাসলো। বিন্দুকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত বাড়িয়ে জাপটে ধরলো তাকে। বিন্দু প্রথমে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করলেও পরে আর জোর খাটালো না। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই তারা একে অপরকে জড়িয়ে ধরে থাকলো। অতঃপর বিন্দু মাথা তুলে বললো,
” আমি সবাইকে ডেকে আনি বৃত্ত। সবাই টেনশনে আছে। ”

” আচ্ছা যাও। কিন্তু আমি কতক্ষণ এমন ছিলাম সেটা বলো তো।”

” গতকাল বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত হসপিটালে ছিলেন। তারপর বাবা ডক্টরকে বলে রাতেই বাড়িতে নিয়ে আসে আপনাকে। ঘুমের ওষুধের কারণে আপনার ঘুম ভাঙেনি সারারাত। ”

বৃত্ত কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। এত সময় কেটে গিয়েছে! বিন্দু সবাইকে ডাকতে গেলো। আফতাব হোসাইন ও বাদল আজ এখনও অফিসে যায়নি। বৃত্তর জ্ঞান ফেরা না পর্যন্ত কেউই দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছিলো না।

জাহানারা বেগম এসেই বৃত্তকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন কিছুক্ষণ। দাদির কান্না দেখে বৃত্ত আলতো হেসে বললো,
” এমন ম’ রা’ কান্না জুড়ে দিয়েছো কেনো দাদি? মনে হচ্ছে আমি ম’ রে গিয়েছিলাম।”

বৃত্তর এহেন কথায় জাহানারা বেগম কপট রাগে বৃত্তর বাহুতে জোরে মা’ র’ লে’ ন। বললেন,
” খবরদার যদি এমন কথা বলেছিস আরেকবার! আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।”

বৃত্ত হাসলো। এবার শাহানা হোসাইন এসে বৃত্তর মাথায় হাত বুলিয়ে মোলায়েম গলায় বললো,
” এখন এ শহরকে সামলাতে হবে বৃত্ত। কিন্তু এর আগে নিজেকে সামলাতে হবে। তোমার সাথে বিন্দুর জীবন জড়িয়ে আছে। এ শহরের মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। ”

শাহানা হোসাইনের সাথে আফতাব হোসাইনও যুক্ত হলেন। বললেন,
” সেসময় যেহেতু তোমার আশেপাশে আমরা কেউ ছিলাম না সেহেতু নিজের সাথে একজন বডিগার্ড রাখা আবশ্যক ছিলো। কিন্তু তুমি ওমন সিচুয়েশনে একা গিয়েছিলে কেনো?”

বৃত্ত নত দৃষ্টিতে বললো,
” আমার কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই কোথা থেকে একটা ইটের টুকরো ছুঁড়ে দেয় আমার উপর।”

আফতাব হোসাইন গম্ভীর স্বরে বললেন,
” যা হওয়ার হয়েছে। এখন থেকে নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে। আর আপাতত রেস্ট নাও।”

বৃত্ত এই শুনে কিঞ্চিৎ উদ্বিগ্ন গলায় বললো,
” কিন্তু পার্টির কাজ?”

আফতাব হোসাইন চোখ রাঙিয়ে বললেন,
” আগে তোমার শরীর। তারপর বাকিটা। তুমি যতদিন না পুরোপুরি সুস্থ হচ্ছো ততদিন তোমার কাজ বাদল সামলাবে। এ নিয়ে টেনশন করো না। রেস্ট নাও। চলো, সবাই যাই এখন। ”

বলেই আফতাব হোসাইন উঠে চলে গেলো। বাদলও তাঁর পিছু যেতে যেতে বৃত্তকে বললো,
” আগে সুস্থ হও ভাই। যতদিন বাসায় আছো ভাবীকে সময় দাও। আর আমাকে দ্রুত চাচ্চু বানিয়ে দাও। ”
বলেই সে দুষ্টু হাসি দিয়ে চলে গেলো। ওদিকে বৃত্ত হাত তুলে মা’ রা’ র ভান করলো। উপস্থিত সকলে হেসে উঠলেও বিন্দু লজ্জায় লাল হলো। বর্ষা বাদলের কথায় সায় জানিয়ে বললো,
” সত্যিই বৃত্ত ভাই। আমার খুব ইচ্ছা, আমার নিজের ভাতিজা থাকবে। যে আমাকে ফুপি ডাকবে, সময়ে অসময়ে নানা আবদার করবে। আমার যে এত ফুপি হওয়ার ইচ্ছা, আর তোমাদের কি বাবা মা হওয়ার ইচ্ছা জাগে না?”
বলেই সে বিন্দুর দিকে চাইলো। জিজ্ঞেস করলো,
” কি ভাবী? ইচ্ছে করে না ছোট একটা কিউট বাবুর কাছ থেকে ‘ মা’ ডাক শুনতে?”
বিন্দু জবাব দিবে এর পূর্বে শাহানা হোসাইন বর্ষাকে বাঁধা দিয়ে বললেন,
” তুই চুপ কর। শোনো বিন্দু, হুটহাট বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিও না। আমরা সবাই চাচ্ছি বলেই যে বাচ্চা নিতে হবে তা না। বাবা মা হবে তোমরা। দায়িত্ব তোমাদের বেশি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে বাচ্চা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিবে। কারণ বাচ্চা সারাজীবনের দায়িত্ব। আবেগের বশে এত বড় দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিও। ঠিক বললাম না আম্মা?”

জাহানারা বেগমও সম্মতি জানিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ একদম ঠিক বলেছো। আমরা বুড়ো হয়ে গিয়েছি। নাতি পরনাতি নিয়ে খেলার ইচ্ছা সবারই থাকে। কিন্তু আমাদের ইচ্ছা পূরণ করতে গিয়ে নিজেদের কাঁধে অনিচ্ছাকৃত কোনো দায়িত্ব তুলে নিস না।
আচ্ছা এ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। বর্ষা, তুই বৃত্ত আর বিন্দুর জন্য খাবার দিয়ে যা। বিন্দু সকাল থেকে কিছু খায়নি। ও নিজেও খেয়ে নিবে আর বৃত্তকেও খাইয়ে দিবে। আমরা আপাতত যাই। বিন্দু,তোমার কিছু প্রয়োজন হলে আমাদের জানিও।”

বিন্দু আলতো মাথা নাড়িয়ে বললো,
” আচ্ছা দাদী।”

————————-

দুদিন পার হয়ে গিয়েছে। বৃত্তর শরীর এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে দূর্বলতা কাটেনি। দূর্বলতা মূলত এসেছে এন্টিবায়োটিকের কারণে।
বিন্দু সময় সুযোগ মতো বৃত্তর সেবায় সময় কাটাচ্ছে, তার পাশে থাকছে। বৃত্তও এভাবে বাড়িতে থেকে ক্ষণে ক্ষণে বিন্দুর সঙ্গ বেশ আনন্দ নিয়ে উপভোগ করছে।

রাত তখন এগারোটা বাজে। রাতের খাবার খেয়ে এসেছে দুজনেই। বিন্দু খাটে বসে আছে আর বৃত্ত তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। বিন্দুর হাতগুলো এলোমেলোভাবে বৃত্তর মসৃণ চুলের মাঝে বিচরণ করছে।
হঠাৎ বিন্দু বলে উঠলো,
” আমার বাবার সম্পর্কে আপনি জানেন তো তাই না?”

অকস্মাৎ এহেন প্রশ্নে কিঞ্চিৎ অপ্রস্তুত হলো বৃত্ত। বললো,
” হ্যাঁ! তবে হঠাৎ এ প্রশ্নে কেনো?”

বিন্দু লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়লো। বললো,
” আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুটো ঘটনা আপনার জানা প্রয়োজন বৃত্ত। কি কারণে আমি রাজনীতি ঘৃণা করি সেটাও জানা প্রয়োজন। ”

বৃত্ত এবার নড়েচড়ে উঠলো। বিন্দু পুনরায় বলতে আরম্ভ করলো,
” আমার বাবাকে স’ ন্ত্রা’ সী’ রা মে’ রে’ ফেলেছে, এই তো শুনেছিলেন খালার কাছে, ঠিক না?”

” হুম।”

” আসলে এটা সম্পূর্ণ ভুল। আমার বাবাকে কোনো স- ন্ত্রা- সী মা’ রে’ নি। বাবা খু’ ন হয়েছিলো এলাকার পাতি নেতার লোকেদের কাছে। কি কারণে জানেন? খুবই তুচ্ছ ঘটনা সে। আমাদের এলাকার নাজমুল নামের পাতি নেতা যে, সুযোগ পেলে বড় বড় নেতাদের পা চাটা যার স্বভাব, সে চাঁদাবাজিতে মারাত্মক পারদর্শী ছিলো। বাজারের এমন কোনো দোকান নেই যেখান থেকে সে অবৈধ চাঁদা উঠায়নি। চাঁদা না দিলে রাস্তায় বেধড়ক পে’ টা’ তো সেই লোককে। আমার বাবারও বাজারে এক শুকনো জিনিসপত্রের দোকান ছিলো। বাবা বসতো না। বেতন দিয়ে লোক রেখেছিলো। একদিন ছুটির দিনে বাবা সে দোকানে বসে। তখন নাজমুলও আসে চাঁদা তুলতে। বাবা তখন বাজারের সবার সামনে একা দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছিলো। আর এ প্রতিবাদ খাতা কলমে প্রমাণ করতে থানায় মামলাও করেছিলো। সেই থেকে নাজমুলের চাঁদা চাওয়া বন্ধ হলো ঠিকই। কিন্তু নিজের শত্রুর খাতায় তারা বাবার নাম তুললো। এবং একদিন তারা সুযোগ বুঝে আমার নিরীহ বাবাটাকে মে’ রে’ ফেললো। ”
বলতে বলতে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। বৃত্ত তড়িৎগতিতে উঠে দ্রুত বিন্দুকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো। শান্ত করার চেষ্টা করলো তাকে। বিন্দুও দ্রুত শান্ত হয়ে এলো। তবে কান্না পুরোপুরি থামলো না। সে ফের বলতে আরম্ভ করলো,
” এ নিয়ে আমি কেস করেছিলাম। আসামী করেছিলাম সরাসরি নাজমুলকে। ও কখনও অস্বীকার করতো না। বরং সগর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটতো, যেনো মানুষকে মা’ রা’ কোনো গর্বের কাজ। থানায় কেস করতে গিয়ে বুঝলাম দুনিয়া বড়ই কঠিন। আর এ কঠিন দুনিয়ায় সবচেয়ে নিকৃষ্ট দুটি পেশার মানুষ হলো পুলিশ ও রাজনীতিবিদ। বাবার কেস চলাকালীন আমি যে কতোটা অসহায়, অপদস্ত হয়েছি তা ভাবলেও আজও রক্ত হিম হয়ে আসে। এক পর্যায়ে তো নিজের সম্মানহানীর হু’ ম’ কিও পাই আমি। এসব দেখেই আমার খালা, খালু আর জুবায়ের ভাই আমাকে কেস বন্ধ করে দিতে বলেন। প্রথমে আমি রাজি না হলে খালু আমাকে অনেকভাবে বুঝিয়ে কেস উঠিয়ে দিতে সক্ষম হয়। আমি চেয়েছিলাম আমার বাবা যেনো ন্যায়বিচার পায়। কিন্তু রাজনীতি আর আইনি গেঁড়াকলে পড়ে আমার বাবা মৃ’ ত্যু’ র পরেও ন্যায়বিচার পায়নি।'”
বলতে বলতে বিন্দু পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়লে বৃত্ত তাকে সামলে নিতে উদ্যত হয়। আনমনে ভাবতে থাকে বিন্দুর কথাগুলো। মেয়েটা তার বাবাকে এত নিষ্ঠুরভাবে হারিয়েছে। তাকে ন্যায়বিচার দিতে গিয়ে অপদস্ত হয়েছে। এতকিছুর পরও কি রাজনীতিকে ঘৃণা করা অযৌক্তিক?

বিন্দু কিছুক্ষণ বৃত্তর কাঁধে মাথা রেখে কাঁদলো। অতঃপর কান্নার দমক কমে এলে সে মাথা তুলে সিক্ত কণ্ঠে বললো,
” আরোও একটি ঘটনা আছে যা আমার দৃষ্টির অগোচরে ঘটেছে। ঘটনাটা বলতেও আমার সম্মানে আঘাত লাগছে। আসলে….”
তাকে থামিয়ে বৃত্ত আশ্বাসের সুরে বললো,
” বেশি পার্সোনাল হলে বলার দরকার নেই। আমাদের সবার জীবনেই এমন কিছু না কিছু অতীত থাকে যা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে থাকে না। ”

বৃত্তর মতকে সম্পূর্ণরূপে বাঁধা দিয়ে বিন্দু বললো,
” এ ঘটনাটি আপনার জানা উচিত বলেই বলছি। আমি চাই না আমার কোনো অতীত আপনার অজানা থাকুক। ”
বলেই সে কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে বলতে আরম্ভ করলো,
” আমার মা নামক মহিলাকে চিনেন না নিশ্চয়ই? ”
মায়ের প্রতি এমন অবজ্ঞাপূর্ণ সম্বোধনে খানিক বিস্মিত হলো বৃত্ত। তার জবাব দেয়ার পূর্বেই বিন্দু তাচ্ছিল্যপূর্ণ গলায় বললো,
” আমিও চিনি না ঐ মহিলাকে। আমার খালার কাছে যতদূর শুনেছি, আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, বয়স বোধহয় ২ কিংবা ৩ বছর ছিলো, তখন সেই মা নামক মহিলাটি আমাকে আর বাবাকে রেখে চলে যায়। অভাবের সংসার মেনে নিতে পারেনি। এর মধ্যে আবার আমার জন্ম। বহু কষ্টে আমাকে ততদিন মানুষ করেছিলো। পরে কিভাবে যেনো কোন এক এলাকার চেয়ারম্যানের সাথে তার সম্পর্ক গড়ে উঠে। সেই সম্পর্কের জোরে সে তার নাড়ী ছেঁড়া মেয়ে আর বৈধ সম্পর্কের স্বামীকে রেখে অবৈধ মানুষটির পিছনে চলে যায়। এরপর আর সে কোনোদিন আমাদের খোঁজ নেয়নি। আজও মাঝে মাঝে ভাবি, একজন মা এতোটা নির্দয় কি করে হতে পারে! স্ত্রী হিসেবে সে নাহয় খারাপ হলো। কিন্তু মা হিসেবে একজন কি করে এতোটা নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী হতে পারে তা আমার জানা নেই। ঐ মহিলার পুরোনো ছবিটা যতবার আমার চোখের সামনে পড়ে ততবার ঘৃণায় গা গুলিয়ে আসে। নিজের উপরও ঘৃণা জন্মায় যখন ভাবি ঐ মহিলার পেট থেকে আমি জন্ম নিয়েছি। ”
এই বলে আরেক দফায় কান্নায় ভেঙে পড়ে বিন্দু। এবার বৃত্তকে শক্ত করে জড়িয়ে অবিরাম কান্না জুড়ে দিলো সে। বৃত্ত অসহায় চাহনিতে বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। এত কিছু শোনার পর বিন্দুর রাজনীতিকে ঘৃণা করা অমূলক নয়। বরং বিন্দুর স্থানে সে হলেও এরূপ ঘৃণা করতো। বোধহয় এর চেয়েও বেশি ঘৃণা করতো।

—————–

বৃত্ত পার্টির কাজকর্মে ফের হাত দিয়েছে। টানা পাঁচদিন ঘরে বসে শরীরে ভীষণ আলসেমি ভর করেছিলো। ফলস্বরূপ আজ কাজে উদ্দীপনা ফিরে পেতে বেগ পোহাতে হয়। বিশেষ করে এই পাঁচদিনে বিন্দুর সঙ্গ কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত তার মনারন্যে উষ্ণ অনুভূতির সূচনা ঘটাচ্ছে, যার দরুণ কাজে মনোযোগ দিতেও কষ্ট হচ্ছে।

পার্টির মিটিং শেষে বৃত্ত আফতাব হোসাইনের মাধ্যমে জানতে পারলো তার চাচাতো চাচা মকবুল হোসাইন, যিনি কি না বর্তমানে খুলনার এমপি, তিনি সন্তানসহ সস্ত্রীক তাদের বাড়িতে বেড়াতে আসবেন৷ বিশেষভাবে বিন্দুকে দেখার জন্য। তাই বৃত্ত কল করলো বিন্দুকে। বিন্দু তখন ভার্সিটি থেকে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে ফিরছিলো। বৃত্তর কল রিসিভ করতেই বিন্দু জিজ্ঞেস করলো,
” মিটিং কেমন হলো?”

বৃত্ত মৃদু হাস্যে বললো,
” ভালো হয়েছে৷ ”

বিন্দু আলতো হাসলো। জিজ্ঞেস করলো,
” এই অসময়ে ফোন করেছেন যে?”

” কেনো? অসময়ে ফোন করতে পারি না তোমাকে? তোমার খোঁজ নেয়ার জন্য বুঝি সময় বেঁধে নিতে হবে?”

” মিস্টার….আপনার সামনে নির্বাচন। এখন বউকে সময় কম দিয়ে পার্টির কাজে মনযোগ দেয়া উচিত।”

” পার্টির কাজের জন্য আরোও মানুষ আছে। কিন্তু আমার বউয়ের জন্য তো এই এক বৃত্তই আছে।”

” ঢং কম করুন। কি কাজে ফোন দিয়েছেন তাই বলুন।”

” ইশ! ভালোবাসাকে ঢং বলা নিষ্ঠুর মেয়ে তোমার নামে মামলা করা উচিত।”

বিন্দু হাসলো। বৃত্ত এবার মূল কথায় ফিরে আসলো,
” এখন সিরিয়াস হচ্ছি। ”

” হুম, হোন।”

” শোনো, খুলনা থেকে আমার এক চাচা তার বউ বাচ্চাসহ আসবে, তোমাকে দেখতে। আমাদের রিসিপশনে আসতে পারেনি। তাই এখন এসে সরাসরি দেখবে তোমাকে। ”

” কবে আসবেন তারা?”

” আজই আসবে। সন্ধ্যার দিকে বোধহয়।”

” আচ্ছা। ”

” সেভাবে প্রিপারেশন নিয়ে রেখো। বুঝতে পেরেছো? ”

” হ্যাঁ।”

” আচ্ছা, তাহলে এখন রাখি। কাজ আছে কিছু।”

” আচ্ছা। ”

বৃত্ত কল কেটে দিলে বিন্দু ভাবনায় পড়লো। নতুন মেহমানের সামনে যেতে হবে আমার। পোশাকআশাকের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে!

সন্ধ্যারও বেশ পড়ে অর্থাৎ রাত প্রায় আটটার দিকে মকবুল হোসাইন তার পরিবার সমেত আফতাব হোসাইনের বাড়ি এসে পৌঁছলেন। মকবুল হোসাইনের স্ত্রীর নাম শিউলি। তাদের দুটো ছেলেমেয়ে। বড় ছেলে, তার নাম তিয়াস। মেয়ে ছোট, তার নাম তরী। তিয়াস বর্ষার সমবয়সী আর তরী তার চেয়ে দু বছরের ছোট।

মকবুল হোসাইন সপরিবারে বাড়িতে ঢুকলে জাহানারা বেগম সাদরে আমন্ত্রণ জানান তাদের। শাহানা হোসাইনও হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানান তাদের। বিশাল ড্রইংরুমে বসে জাহানারা বেগম, শাহানা হোসাইন ও বর্ষা সকলের সাথে ভাব বিনিময় করেন। অতঃপর বর্ষাকে পাঠান বিন্দুকে নিচে নিয়ে আসার জন্য।

বর্ষাকে বিন্দুকে নিয়ে আসতে গেলে বিন্দু কিঞ্চিৎ ভয়ভীতির সাথে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো,
” আমাকে কেমন লাগছে বর্ষা?”

বর্ষা হাসিমুখে বললো,
” সবসময়কার মতো গর্জিয়াস এন্ড বিউটিফুল। ”

” তারা উল্টাপাল্টা কিছু জিজ্ঞেস করবে না তো?”

” কি জিজ্ঞেস করবে? এমনভাবে কথা বলছো যেনো তোমাকে ছেলেপক্ষ দেখতে এসেছে।”
বলেই সে সশব্দে হেসে উঠলো। হেসে ফেললো স্বয়ং বিন্দুও।

বর্ষা বিন্দুকে নিয়ে নিচে নেমে এলো। বিন্দু মাথা তুলে মকবুল হোসাইনকে সালাম জানিয়ে শিউলি
বেগমের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো। মাথা তুলতেই তার দৃষ্টি স্থির হলো শিউলি বেগমের মুখমণ্ডলের উপর। কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই সে বিশাল এক ধাক্কা খেলো যেনো।
®সারা মেহেক

#চলবে