সে আমার অপরাজিতা পর্ব-৩৩

0
134

#সে_আমার_অপরাজিতা
#পর্ব_৩৩
#সারা মেহেক

সামনের ব্যক্তিটিকে পুরোপুরি চিনতে কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো বিন্দুর। সহজেই চিনে ফেললো তার জীবদ্দশার সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তিটিকে, তার জন্মদাত্রী মা’কে। চেহারার জৌলুস একটুও কমেনি। বরং সৌন্দর্য ও পরিপক্বভাব যেনো আরোও বেড়েছে, টাকার গরমে বোধহয়।
বিন্দু কয়েক পা পিছিয়ে এলো। চেহারায় তার অবিশ্বাস্যভাব বিরাজ করছে। চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে ঘৃণার ফুলকি। কিছুতেই তার বিশ্বাস হতে চাইছে না মা নামক মহিলাটি আজ ঠিক তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু অন্য পরিচয়ে। তীব্র ক্রোধ ও অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বিন্দু বলে উঠলো,
” আপনি! আপনি তাহলে বেঁচে আছেন!”
বিন্দুর এরূপ কথায় উপস্থিত সকলে তাজ্জব বনে গেলো। বিস্মিত হলেন স্বয়ং শিউলিও। কি বলছে সে এসব! একদম আকস্মিকভাবে বাঁচা-ম’ রা নিয়ে কথা উঠলো কেনো? শিউলি বেগম বিস্ময়ের সহিত ক্ষুব্ধ স্বরে বলে উঠলেন,
” এসব তুমি কি বলছো বিন্দু! আমাকে কি চিনো তুমি?”
বিন্দু হাসলো। সে হাসিতে অবজ্ঞা বিরাজ করছে। শিউলির চোখে চোখ রেখে সে এবার তাচ্ছিল্যপূর্ণ স্বরে বললো,
” আমি ভেবেছিলাম কোলের মেয়ের শোকে আপনি বোধহয় মা’ রাই যাবেন। কিন্তু এ কি! আপনি তো বেঁচে আছেন! ওহহো,ভুলে গেলাম কি করে! মায়া মমতা ভুলে মেয়েটিকে তো আপনিই ম’ রা’ র জন্য ফেলে রেখে এসেছিলেন! ”
চমকে উঠলেন শিউলি বেগম। তবে বৃত্ত’র বউ বিন্দুই কি তার মেয়ে বিন্দু! মকবুল এর কাছে প্রথমে যখন বৃত্তর বউয়ের নাম শুনেছিলেন তখনই নিজের মেয়ে বিন্দুর কথা মনে পড়ে তার, যাকে আজ থেকে প্রায় আঠারো বছর আগে ফেলে রেখে এসেছিলেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও তিনি কল্পনা করেননি বৃত্তর বউ বিন্দুই তার সেই ছোট্ট মেয়ে বিন্দু।
আশেপাশের সব ক’টা মানুষ শিউলি ও বিন্দুর মধ্যকার এ সম্পর্ক নিয়ে অজ্ঞাত। জাহানারা বেগম ও শাহানা হোসাইন তো বিস্ময়ের চরম চূড়ায় অবস্থান করছেন। একদিকে মেহমানদের সামনে বিন্দুর এরূপ আচরণ, অপরদিকে বিন্দু ও শিউলির কথোপকথন। কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না তারা। জাহানারা বেগম অধৈর্য্য হয়ে বললেন,
” হচ্ছেটা কি এখানে? বিন্দু, তুমি এ ধরণের কথা বলতেছো কেনো? শিউলি কি তোমার পরিচিত?”

শিউলির চোখজোড়া মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো। বিন্দুকে চিনতে পেরেছেন তিনি। এই তো তার মেয়ে, যাকে দুটো বছর পাগলের মতো খুঁজেছেন তিনি। অথচ কোনো খোঁজই পাননি। ভেবেছিলেন মেয়ে বোধহয় মা’ রা গিয়েছে। কিন্তু তার বড় মেয়ে যে বেঁচে আছে! শিউলি বিন্দুর দিকে মমতার হাত বাড়িয়ে সিক্ত গলায় বললেন,
” বিন্দু, আমার মেয়ে বিন্দু। কেমন আছিস মা?”

অকস্মাৎ ড্রইংরুমে ছোটখাটো একটা বাজ পড়লো যেনো। শিউলির মুখে এ কথা শুনে উপস্থিত সকলের লোম খাঁড়া হয়ে এলো, বিন্দু ব্যতিত। শিউলির স্পর্শ লাগার পূর্বেই বিন্দু ঝট করে হাত হটিয়ে কয়েক কদম পিছিয়ে এলো। স্পষ্ট বিতৃষ্ণায় বলে উঠলো,
” খবরদার! ছোঁবেন না আমাকে। আপনার সামান্য স্পর্শও আমার জীবন ধ্বংস করে দিবে। বহু বছর পর একটু সুখের মুখ দেখেছি আমি।”

শিউলি কাতরে উঠলেন। মেয়েকে এত বছর পর কাছে পেয়ে এতোটা ঘৃণিত বাণী শোনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। এদিকে শাহানা হোসাইন বিস্মিত হয়ে বিন্দুকে জিজ্ঞেস করলেন,
” বিন্দু, তুমি না বলেছিলে তোমার মা মা’ রা’ গিয়েছে? তাহলে শিউলি কি করে….”

বিন্দু ঘৃণা পূর্ণ চাহনিতে শিউলির দিকে তাকিয়ে বললো,
” ছোট্ট আমি’টার জন্য ঐদিনই আমার মা মা’ রা’ গিয়েছিলো যেদিন সে আমাকে আর আব্বুকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। কেনো ছেড়ে গিয়েছিলো জানেন? ঐ লোকটার প্রেমের টানে।”
বলে সে মকবুল হোসাইনের দিকে আঙুল তুললো। মকবুক হোসাইন এতক্ষণ বিন্দুর দুঃখে দুঃখিত হচ্ছিলেন। কিন্তু আচমকা নিজের উপর আঙুল উঠায় থতমত খেয়ে গেলেন তিনি। এদিকে শিউলি বাদে উপস্থিত সকলেই চরম বিস্ময়ে সেদিকে চেয়ে রইলো। কেউই বিশ্বাস করতে পারছে না যে শিউলি বিন্দুর মা এবং তিনি মকবুলের প্রেমে পড়ে ছোট্ট বিন্দুকে রেখে চলে গিয়েছিলো।
শিউলি কোনোদিকে ভাবছে না। সে এখন বিন্দুকে একটু ছুঁতে চাইছে। আদর করতে চাইছে। সিক্ত গলায় অসহায় হয়ে বিন্দুকে বললেন,
” বিশ্বাস কর মা, আমি আসার পর একটা সপ্তাহও ভালো থাকতে পারিনি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আবারো ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও ছিলি না তোরা। পুরো শহরের কোথাও পাইনি। আমি তোর…..”
বিন্দু প্রায় চিৎকার করে বললো,
” থামুন! আপনার অজুহাত শুনতে চাইনি আমি। এত বছর পর এসে এসব নাটকের মানে হয় না। দয়া করে আমার সাথে আর কথা বলতে আসবেন না। ”
বলেই বিন্দু ফিরে চলে যেতে নিলো। কিন্তু কয়েক কদম যাওয়ার পরপরই তার মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো। সেকেন্ডের মাঝেই সে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। তবে মেঝেতে পড়ে যাওয়ার পূর্বেই বর্ষা দৌড়ে এসে তাকে ধরে নিলো।

পিটপিট করে চোখ মেলে তাকালো বিন্দু। পাশে তাকিয়ে দেখলো বৃত্ত উদ্বিগ্ন চাহনিতে চেয়ে আছে। বৃত্তর পাশেই বর্ষা, জাহানারা বেগম, শাহানা হোসাইন ও শিউলি। শিউলিকে দেখা মাত্র বিন্দুর মেজাজ চটে গেলো। ক্ষণেই অন্যদিকে ফিরে বৃত্তকে বললো,
” আমি একটু একা থাকতে চাই বৃত্ত। সবাইকে চলে যেতে বলুন প্লিজ। ”
বিন্দুর এই ‘সবাই’ এর অর্থ হলো শিউলি, এ কথাটি বুঝতে কারোর সময় লাগলো। তবে বৃত্ত’র কিছু বলার পূর্বেই শিউলিসহ সকলেই রুম ছেড়ে চলে গেলো। বৃত্তও যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু বিন্দু তার হাত ধরে যেতে বাঁধা দিলো। বললো,
” আপনি থাকুন বৃত্ত। ”
বলে সে উঠে বসতে চাইলো। বৃত্ত তাকে হাত ধরে সাহায্য করলো। বসা মাত্রই সে বৃত্তকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রাখলো। বৃত্ত বুঝতে পেরেছে বিন্দুর মন এখন বিক্ষিপ্ত। মাত্রই একটা ট্রমা পেয়েছে সে। এ মুহূর্তে তার পাশে থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

বেশ কিছুক্ষণ পর বিন্দু কথা বললো। চাপা কষ্ট ও খানিক আনন্দ নিয়ে বললো,
” বৃত্ত, আমি মেবি প্রেগন্যান্ট। ”
চট করে বিন্দুকে ছেড়ে বিস্মিত চাহনিতে চাইলো বৃত্ত। তার চাহনিতে একই সাথে বিস্ময় ও খুশির ঝলক ফুটে উঠছে। অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” সত্যি! সত্যি বলছো বিন্দু?”
বৃত্তর এ প্রতিক্রিয়ায় কষ্টের মাঝেও মৃদু হেসে উঠলো বিন্দু। বললো,
” আমি শিওর না। কোনো টেস্ট করিনি। দু মাস যাবত পিরিয়ড বন্ধ। আর রিসেন্টলি কিছু লক্ষণও মিলে যাচ্ছে। স্ট্রিপ টেস্ট করে নিশ্চিত হতে হবে।”
খবর নিশ্চিত নাকি অনিশ্চিত তা জানে না বৃত্ত। তবে এটুকুতেই তার মনে খুশি ধরছে না। বিন্দুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সিক্ত আনন্দের সুরে বললো,
” ইন শা আল্লাহ টেস্ট পজিটিভ আসবে। থ্যাংকস বিন্দু। তোমার কারণে আমি বাবা ডাকটা শুনতে পাবো। ”
তার খুশি দেখে বিন্দুও ভীষণ খুশি হলো। তবে মুহূর্তেই বৃত্তকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
” তবে এখনই কাউকে জানাবেন না প্লিজ। বিশেষ করে ঐ মহিলাকে তো মোটেও জানাবেন না। আমি চাই না আমার অনাগত সন্তানের উপর উনার কালো ছায়া পড়ুক। ”
বৃত্ত রাজি হলো। বিন্দুকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সে স্ট্রিপ আনতে রুম থেকে বের হলো। বৃত্তকে দেখেই শিউলি প্রায় দৌড়ে চলে এলেন। উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
” বিন্দু এখন কেমন আছে বৃত্ত? ”
বৃত্ত কাঠ কাঠ গলায় বললো,
” ভালো আছে। তবে আপনাকে রুমে যেতে নিষেধ করেছে।”
বলেই সে বাইরে চলে গেলো।

————————–

রাতে প্রেগন্যান্সি টেস্ট করলো বিন্দু। রেজাল্ট পজিটিভ। চরম খুশিতে আত্মহারা হয়ে উঠলো বৃত্ত ও বিন্দু। আগামীকাল হসপিটালে গিয়ে আল্ট্রাসনোগ্রাফি করে ১০০% নিশ্চিত হবে। এরপর সবাইকে বলবে। উপরন্তু কাল সকালেই মকবুল হোসাইন তার পরিবারকে নিয়ে চলে যাবেন। আজই চলে যেতো। তবে এতদূরে হওয়ায় রাতে যাত্রাপথে সমস্যা হতে পারে। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদেরকে রাখা হলো বাসায়।
বিকেলে বৃত্ত সবাইকে শিউলির সত্যতা জানিয়েছিলো। ঘৃণায় তখন শিউলির সাথে কেউ কথা বলেনি। এমনকি মকবুল হোসাইনের সাথেও না। এদিকে আঠারো বছর পূর্বে নিজ কৃতকর্মের জন্য আজ সকলের সামনে লজ্জিত বোধ করছে সে। তার ছেলেমেয়ে দুটোও মা বাবার এ কৃতকর্মের জন্য কারোর সামনে যেতে পারছে না। ঘরে গুটিশুটি মে’ রে বসে আছে।
খানিক সুস্থ বোধ করার পরও বিন্দু শিউলির সাথে আর কথা বলেনি। তবে কড়া নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যেনো তার সাথে কোনোরূপ যোগাযোগের চেষ্টা যেনো না করে শিউলি। আপাতত সে এসব তিক্ত স্মৃতি ভুলে খুশির মুহূর্তগুলো উপভোগ করতে চাইছে।

———————-

বিন্দু এখন সাড়ে তিন মাসের গর্ভবতী। তার প্রেগন্যান্সিতে কিছু কমপ্লিকেশ থাকায় বেশ মেনে শুনে চলে সে। বাড়ির প্রতিটি সদস্য এখন বিন্দুর প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীল। বংশে নতুন সদস্য, প্রথম নাতি/নাতনি আসতে চলেছে যে!
এদিকে বিন্দুকে ইদানিং কম সময় দিতে পারছে বৃত্ত। এ মাসেই নির্বাচন। শেষ সময়ের মিছিল মিটিং, প্রচারে ভীষণ ব্যস্ত সে। বিন্দু অবশ্য এ নিয়ে অভিমান বা রাগ দেখায় না। কেননা এ মুহূর্তে এসব দেখিয়ে লাভও নেই। নির্বাচন সামনে, ব্যস্ততা থাকা স্বাভাবিক।

আজ শহরে সভার আয়োজন করা হয়েছে। বৃত্ত সেখানে ভাষণ দিবে। বাদলও আছে সেখানে। আফতাব হোসাইনেরও উপস্থিত হওয়ার কথা। তবে পার্টির কাজে একটু ব্যস্ত থাকায় দেরিতে আসবেন তিনি। ততক্ষণে ছোট ছোট নেতারা জনসম্মুখে ভাষণ দিচ্ছে। বৃত্তও এখন ভাষণ দিবে। সেটার প্রস্তুতিই নিচ্ছে।

মিনিট পাঁচেকের মধ্যে মাইকের সামনে উপস্থিত হলো বৃত্ত। সভায় উপস্থিত সকল জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলো সে। নিজেদের দলের সকল কর্মসূচী সম্পর্কে আগাম ইঙ্গিত দিলো। সকলকে আশ্বাসের বাণী শোনালো। বলা বাহুল্য, এত বছরের এ দলের উপর আস্থা রেখেই জনগণ করতালি দিয়ে জায়গাটা মুখরিত করলো।
বৃত্ত নিজের ভাষণ শেষ করে তার জায়গায় বসার পূর্বেই স্টেজের পিছনে বুম শব্দে বি’ স্ফো’ র’ ণ ঘটলো। কারোর আর বুঝতে বাকি রইলো না যে সভায় বো’ ম’ ফেলা হয়েছে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো চারপাশ। আহত হলো অনেকে। নিহত হলো অনেকে। ওদিকে থাকা অনেকের হাত পা উড়ে গেলো। পরিস্থিতি মুহূর্তের মধ্যে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলো। সকলে ছোটাছুটি করতে লাগলো। সন্দেহ নেই ব্যাপক জানমালের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এতে। মূল সারীর নেতাগুলোর কি অবস্থা কেউ জানে না। স্টেজের নিচে পড়ে আছে বোধহয়। আদৌ বেঁচে আছে কি না জানা নেই।
#চলবে
®সারা মেহেক