#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
হসপিটালের সবাই নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। সবাই আয়াতে’র দিকে কেমন আড়চোখে তাকিয়ে আছে। আয়াতে’র দৃষ্টি জরুরী বিভাগের দিকে সীমাবদ্ধ। দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে পড়ছে। নিজেকে আজ বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে, আজকে তার জন্য তার বাবা হসপিটালে। ঝড়ের গতিতে আবরার হসপিটালে প্রবেশ করল৷ আবরার’কে দেখে আয়াত রেগে গিয়ে বলল।
–সেদিন আমাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়ে শান্তি হয় নাই। আজকে আব্রাহাম’কে কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন৷ আমি জানি আপনি ইচ্ছে করে, আব্রাহাম’কে লুকিয়ে রেখেছেন। আমাদের সাথে কেনো এমন করছেন ভাইয়া? আমাদের একটু ভালো থাকতে দিন না। আমাদের আলাদা করে দিয়ে, রজনী আপু’কে বিয়ে করলেন। তাতে-ও আপনার শান্তি হলো না। এভাবে দুঃখে জীবন’টা পরিপূর্ণ করে দিলেন। আয়াতে’র দিকে তাকিয়ে আবরারের দৃষ্টি নত হয়ে গেল। ভেতরে অপরাধ বোধের অনুভূতি’টা দিগুণ ভাবে, তীব্র হতে শুরু করল। মলিন কণ্ঠে আয়াত’কে বলল।
–আয়াত তুমি আমাকে ভুল বুঝছো। সেদিন আমি তোমাকে তুলে নিয়ে যাই নাই। তোমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমি শুধু তোমাকে বাঁচিয়েছি। বিশ্বাস করো। আমি আব্রাহাম’কে লুকিয়ে রাখি নাই। আব্রাহাম আহনাফ ভাইকে খুঁজতে গিয়েছিল। আর ফিরে নাই। বিশ্বাস না হলে, তুমি আমাদের বাসার সিসি ক্যামেরা চেক করে দেখতে পারো। আমি জানি আমি অনেক অন্যায় করেছি। কিন্তু আয়াত বিশ্বাস করো। আমি এতটা খারাপ নই৷ আয়াত কিছু বলতে যাবে। তার আগেই ডক্টর বেড়িয়ে আসলো। আবরার দ্রুত ডক্টরের কাছে এগিয়ে গেল। ডক্টর গম্ভীর মুখ করে বলল।
–পেশেন্ট স্টোক করেছেন। উনি অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা করেন। উনাকে এমন কোনো কথা বলা হয়েছে। যা গভীর ভাবে উনার মস্তিষ্কে আঘাত করেছে। এখন ভালো আছেন। কেবিনে দিয়েছি। উনার রেস্টের প্রয়োজন। কেউ বিরক্ত করবেন না৷ উনি উত্তেজিত হয় এমন কোনো কথা বলবেন না। উনাকে সব সময় দুশ্চিন্তা মুক্ত রাখবেন৷ না হলে বড় কিছু হয়ে যেতে পারে। ডক্টরের কথা শুনে সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ালো।
আয়াত চুপচাপ এক কোণে বসেছিল। হঠাৎ করে রজনী এসে আয়াতে’র পাশে বসলো। আয়াত রজনী’র দিকে একবার তাকিয়ে, চোখ ঘুরিয়ে নিল। আবরার’কে উদ্দেশ্য করে বলল।
–ভাইয়া আমাকে একটা ড্রেস এনে দিতে পারবেন। এসব পড়ে থাকতে খুব অসুবিধা হচ্ছে,আয়াতের শান্ত কণ্ঠে বলা কথা’টা আবরারের হৃদয় ছুঁইয়ে গেল। ভেতর থেকে অদ্ভুত এক কষ্ট অনুভব করল। আজকে যদি আয়াতে’র জায়গায় অন্য কেউ থাকতো। তাহলে ঠিক এই ভাবেই শান্ত হয়ে বসে থাকতে পারতো। মেয়ে’টা এতটা শান্ত হয়ে বসে আছে কি করে? আবরার কোনো কথা বলল না। সোজা নিচে চলে গেল। আয়াতে’র আম্মু আয়াতে’র পাশে বসলো। মেয়েকে বুকে আগলে নিয়ে বলল।
–কষ্ট হচ্ছে মা?
–না আম্মু। আমার আবার কিসের কষ্ট! ভাগ্য যা ছিল। তাই হয়েছে। ভাগ্য যেটা থাকবে, সেটাই হবে। তুমি আমি চাইলে-ও সেটা বদলাতে পারবো না। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। তুমি বাবার দিকে মনযোগ দাও। একদম বাবার কাছে গিয়ে উল্টা পাল্টা কথা বলবে না। বাবা চিন্তা করবে এমন কোনো কথা বলবে না। আমার কথা জানতে চাইলে, বলবে আয়াত ভালো আছে। দেখতে চাইলে, আমাকে ডাকবে। আমি গিয়ে দেখে আসবো।
–হসপিটালে এত মানুষ এলাও করবে না। তোরা সবাই বাসায় চলে যা। আমি তোর বাবার কাছে থাকি।
–বাবা যদি আমাকে খুঁজে তখন কি করবে?
–আমি তোকে ফোন দিব। তুই ফোনের কাছে থাকবি কেমন। বলেই রজনী’র কাছে গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বলল।
–আজকে রাতটা বোনের সাথে থাকবে। এক মুহূর্তের জন্য বোন’কে একা ছাড়বে না। প্রতিবেশীরা যেনো বোন’কে দু’কথা শোনাতে না পারে, আজকে তোমার বোনের দায়িত্ব তোমার কাছে দিলাম। আশা করি নিজের দায়িত্ব সুন্দর ভাবে পালন করবে। আল্লাহ আমাদের কিসের পরীক্ষা নিচ্ছেন। উনি ভালো জানেন, রজনী এই প্রথম তার মায়ের চোখে অশ্রু দেখলো। ভেতরে ভেতরে তিনি’ও দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছেন। হয়তো মেয়েদের শক্ত রাখার জন্য, নিজেকে পাথরের ন্যায় শক্ত রেখেছেন।
–আম্মু তুমি চিন্তা করো না। আমি আজকে আয়াতে’র সাথে থাকবো। আমি থাকতে ওকে, কেউ বাজে কথা শোনাতে পারবে না। রজনী’র কথা শেষ হবার সাথে সাথে আবরার আসলো। রজনীর আম্মু আবরার’কে বুঝিয়ে বলল। সে, আর রজনী যেনো, আয়াতের পাশে থাকে। আয়াত কেমন শান্ত হয়ে গিয়েছে। চুপচাপ সবকিছু মেনে নিচ্ছে,সে যেনো পুতুল। তাকে সবাই যেভাবে চালাচ্ছে। সে সবার মন মতো চলছে।
আয়াত হসপিটাল থেকে আসতে চাচ্ছিল না। আয়াতে’র আম্মু জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। সবাই চলে আসার পরে, নিজেকে আর দমিয়ে রাখতে পারল না আয়াতে’র আম্মু। হসপিটালের ফ্লোরে বসে কান্নায় ভেঙে পড়লো। মেয়েটার অসহায় চেহারার বারবার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আয়াতের আম্মুর মনে হচ্ছে, তার বুকে কেউ তীর ছুড়ে দিয়েছে। তার মন বারবার বলে উঠছে, তার মেয়ে ভালো নেই। একদিকে স্বামী, অন্য দিকে মেয়ে।কোনদিকে যাবে বুঝতে পারলেন না আয়াতে’র আম্মু। ফ্লোরে বসে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছেন আর চিন্তা করছেন৷
আয়াত বাসায় এসে দেখলো, যে বাড়িটা একটু আগে-ও মানুষ দিয়ে পরিপূর্ণ হয়েছিল। কিছু সময়ের ব্যবধানে সেই বাড়িটা একদম ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। দুই চারজন ছাড়া কেউ নেই। আয়াত কোনো কথা না বলে, নিজের রুমে চলে গেল। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। একটা জামা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। সাওয়ার ছেড়ে দিয়ে, হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলো। এতক্ষণের ধরে রাখা সব আবেগ, চাপা কষ্ট, বুক ভারি করা নিঃশ্বাস সব পানির সাথে ধুইয়ে মুছে চলে যেতে চাইছে। চাইলেই কি সবকিছু মুছে যায়।
আয়াতে’র কোনো খোঁজ না পেয়ে রজনী, আবরার দু’জনেই চিন্তিত হলো, একঘন্টা হয়ে গেল। আয়াতে’র কোনো খোঁজ নেই। দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে, আয়াতে’র রুমের দিকে গেল। আয়াত সাওয়ার নিয়ে, বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে আছে। দু-চোখ রক্তিম বর্ন ধারণা করেছে। দু-চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গুলো গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে। আজকে তারা জোট বেঁধে লেগেছে। কিছুতেই আয়াত’কে শক্ত থাকতে দিবে না।
“চিন্তা করে লাভ নেই। ” টান থাকলে একাই ফিরে আসবে। ”
আয়াত কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে জবাব দিল। তাকে আমার চাই না। যে, শুধু মাত্র নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য, আমার সাথে বিয়ের অভিনয় করতে পারে। এমন মানুষ আমার লাগবে না। অভিনয় যদি করারই ছিল। তাহলে সবটা আগে আমাকে জানাতে পারতো। তাহলে দু’জন মিলে, একসাথে অভিনয় করতাম৷ এভাবে আমার অনুভূতি গুলোকে নিয়ে খেলার কি দরকার ছিল। আমি আব্রাহাম’কে কোনোদিন মাফ করবো না। ওর কষ্ট দেওয়ার ছিল। সে আমাকে কষ্ট দিতে পারতো৷ আমার পুরো পরিবারকে কেনো দিল? আমার বাবার সন্মান কেনো নষ্ট করল? আমার বাবা অসুস্থ হয়ে, হসপিটালের বেডে শুইয়ে আছে। আমার বাবা ভেতরে থেকে যে, কষ্ট পাচ্ছে, আব্রাহাম তার আংশিক ফিরিয়ে দিতে পারবে। আয়াতে’র কথা শুনে, চমকালো আবরার। গম্ভীর হয়ে রজনীর দিকে তাকালো।রজনী মুখ ঘুরিয়ে নিল।
–তোমাকে এসব কথা কে বলেছে আয়াত? তুমি মানুষের কথা কান দিও না। আব্রাহাম তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি হয়তো আব্রাহামে’র সত্যি’টা জানো না। তাই এমন কথা বলছো? আব্রাহামে’র সত্যিটা জানলে, তুমি আব্রাহামে’র পাশে থাকতে।
–ভাইয়া আমি একা থাকতে চাই। আমার কিছু ভালো লাগছে না৷ আমি একা কিছু সময় কাটাতে চাই৷ ভয় পাবেন না। আত্মাহত্যা করার মতো পাপ কাজ! আমি করবো না। কারণ যে জীবন আল্লাহ তায়া’লা দিয়েছেন। সেটা নষ্ট করার কোনো অধিকার আমার নেই। নিশ্চিতে থাকতে পারেন। আপু তুমি ও’ যাও।
–আয়াত আমি তোকে একা ছাড়তে পারবো না। মা আমাকে বারবার করে বলে দিয়েছে, তোর সাথে থাকতে। আমি এক চুল পরিমাণ’ও সরবো না।
–ঠিক আছে৷ তোমাকে সরতে হবে না। বলেই আয়াত রুমের বাহিরে চলে গেল। বাহির থেকে রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়ে বাবা-মায়ের রুমে চলে গেল। অনেক ডাকাডাকি করে-ও কেউ দরজা খুলল না। রজনী হতাশ হয়ে আবরারের দিকে তাকালো। আবরার রক্তিম চোখে রজনীর দিকে তাকিয়ে আছে।
–আয়াতে’র মনে আব্রাহামে’র প্রতি ঘৃণা তুলে দেওয়ার খুব দরকার ছিল রজনী। তুমি মরিচীকার পেছনে ছুটছো। তুমি আব্রাহাম’কে কোনোদিনই পাবে না। আব্রাহামের জন্য তোমার মনে একটা সুপ্ত অনুভূতি কাজ করে, সেটা আমি আগে থেকেই জানতাম। জোর করে যে, ভালোবাসা হয় না। সেটা তুমি ও ভালো করে জানো। আমি’ও ভালো করে জানি। বোন হয়ে বোনের কষ্ট বাড়িয়ে দিতে বুক কাঁপলো না। আমার থেকে বেশি স্বার্থপর হয়ে গিয়েছো তুমি? বলেই বেলকনিতে চলে গেল। রজনী অবাক নয়নে আবরারের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। সে তো আয়াতে’র সাথে কথাই বলে নাই। তাহলে আবরার কিসের কথা বলল। বিয়ের আগে আব্রাহামের প্রতি তার একটা অনুভূতি কাজ করতো ঠিকি। কিন্তু তাই বলে নিজের বোনের খারাপ চাইবে। এতটা জঘন্য মন মানসিকতা তার নয়৷ আবরার তাকে কেনো ভুল বুঝলো। আবরার তাকে ভুল বোঝাতে তার এত কেনো এত কষ্ট হচ্ছে, কই আগে তো কখনো এমন কষ্ট অনুভব করে নাই। আব্রাহামের প্রতি তার সব অনুভূতি কবেই কেটে গিয়েছে। তাহলে তাকে এখনো কেনো এই কথা শুনতে হয়। না চাইতে-ও কথাগুলো রজনী’কে গভীর ভাবে আঘাত করল। দু-চোখ বেয়ে অশ্রু কণা গুলো গড়িয়ে পড়লো।
সারারাত ঘুম হলো না আয়াতে’র কান্না করে রাত্রি পার করে দিয়েছে। দু-চোখ ফুলে গিয়েছে। রাতে ঘুম না হবার দরুনে মস্তিষ্ক কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগছে। ভোরের আলো ফুটে ওঠার সাথে সাথে আয়াতে’র দু-চোখের পাতা নিভে যেতে শুরু করল৷ কিছুক্ষণের মধ্যে নিদ্রা দেশে তলিয়ে গেল আয়াত।
চলবে…..
#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_২১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
আজকে সাতদিন পরে, আয়াতে’র বাবাকে হসপিটাল থেকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। আয়াত এই কয়দিন নিয়মিত বাবার কাছে গিয়েছে। তবে বেশিভাগ সময় নিজেকে চার দেওয়ালে, আবদ্ধ রেখেছে। আজকাল আয়াতে’র কিছুই ভালো লাগে না। সবকিছু বিষাদে ভরপুর হয়ে গিয়েছে। বাহিরে গেলে, সবাই তার দিকে কেমন করে তাকিয়ে থাকে। আয়াত’কে নিয়ে কত হাসাহাসি করে, তা আয়াতে’র নজর সুন্দর ভাবে পড়ে। তাই তো সে, নিজেকে চার দেওয়ালের ঘরে আবদ্ধ করে ফেলছে। বাবা আসার খবর পেয়ে, আয়াত রুমে থেকে বাহিরে বের হয়ে আসলো। খুশি মুখ করে, বাসার পাশে গিয়ে বসলো।
–আব্বু এখন তোমার কেমন লাগছে? অনেক দূর থেকে এসেছো। এখানে বসে আছো কেনো? রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। শরীরের একদম অযত্ন করতে দিব না। চলো রুমে গিয়ে শুইয়ে থাকবে। চিন্তা তো একদমই করবে না।
–তোকে দেখেই আমার অর্ধেক অসুস্থতা কমে গিয়েছে। আল্লাহ আমার মেয়েকে আরো ধৈর্য ধরার তৌফিক দান করুক। তোর চেহারার কি হাল করেছিস মা। শরীর’টা শুকিয়ে গিয়েছে। চেহারায় মলিনতা এসে গিয়েছে। রাতে ঘুমাস না বুঝি। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গিয়েছে। আমি এত টাকা পয়সা রোজকার করি। কাদের জন্য? তোদের জন্য রোজগার করি। আর তোরা যদি এভাবে পাগলের মতো হয়ে থাকিস। তাহলে আমার কষ্ট লাগবে না বল। চুলের কি হাল করেছিস। বাসায় তেল নেই।
–তুমি এসেছো।এখন তুমি আমাকে খাইয়ে খাইয়ে মোটা বানিয়ে দিবে। নিজের যত্ন না নিলে, বকা দিবে। দেখবে আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছি। তোমার বকার অভবে দিন দিন বড্ড এলোমেলো হয়ে যাচ্ছি আব্বু। এখন থেকে নিয়ম করে আমাকে বকবে। দেখবে আমি আবার আগের মতো হয়ে গিয়েছি। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আব্বু। তোর অসুস্থতা আমাকে ভিষণ করে কষ্ট দিচ্ছিল। এখন থেকে আগে মতো আমাকে রাগ দেখাবে।আমি আবার আগের মতো হয়ে যাব। কথা গুলো বলতে বলতে আয়াত কান্না করে দিল৷ আয়াতে’র বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। আয়াত দু-চোখের পানি মুছে নিয়ে বলল।
–আব্বু তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে নাও। তোমার সাথে আমি শপিং করতে যাব৷ সামনে রোজা-ঈদ আসছে। আমার কিন্তু একটা জামাতে হবে না। অনেক গুলো জামা লাগবে। আয়াতের কথা শুনে, আয়াতে’র বাবা হেসে দিল। তার মেয়েটা বুঝি অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। বাবাকে কষ্ট বুঝতে দিবে না। তাই বুঝি বাবার সাথে এত ছলনা করছে। কিন্তু বাবারা যে, সব বুঝে। আয়াতে’র বাবা আয়াতে’র চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। তার মেয়ে ভালো নেই। বাবা হয়ে কি সব কথা মেয়েকে বলা যায়। তিনি নিরব রইলেন। স্ত্রীকে ডেকে নিজের রুমের দিকে, অগ্রসর হলেন। আয়াত আর বিরক্ত করল না। মায়ের সাথে, বাবাকে রুমে নিয়ে যেতে সাহায্য করল।
আয়াতে’র আম্মু রান্না করছিল। এমন সময় আবরার এসে বলল।
–আম্মু অনেক দিন থাকলাম। এবার আমাকে যেতে হবে। আব্রাহাম’কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা-মা বাসায় একা রয়েছেন। তাদের অনেক কষ্ট হচ্ছে, আজকে আমি আসি। পরে আবার আসবো।
–এটা কেমন কথা বাবা। তোমার শশুর অসুস্থ থাকায়। তোমার ঠিকমতো যত্ন নিতে পারলাম না। এখন চলে যাবে। দুপুরে খেয়ে যেও। রজনী কি তোমার সাথে যাবে।
–সমস্যা নেই আম্মু। আমি আপনাদের পরিস্থিতি সবকিছু জানি। তাই আমাকে এত কৈফিয়ত দিতে হবে না। ভালোভাবে থাকবেন। আব্বুর খেয়াল রাখবেন। আমি রোজ একবার করে এসে, আব্বুকে দেখে যাব। রজনী মনে হয় যাবে না।
–কেনো রজনী যাবে না?
–সেটা আপনার মেয়ে ভালো জানে আম্মু। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে আবার হসপিটালে যেতে হবে। বলেই আবরার এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। দ্রুত পায়ে, বেড়িয়ে গেল।
স্রোতের ন্যায় এক মাস পনেরো দিন কেটে গেল। আব্রাহামে’র এখনো খোঁজ মেলেনি। আবরার নিজের সবটুকু দিয়ে, চেষ্টা করছে, আব্রাহাম’কে খুঁজে পাবার জন্য। আজকে আবরার একটু আশার আলো দেখতে পেয়েছে। পুলিশ আব্রাহামে’র খবর জানতে পেরেছে। আবরার পুলিশের সাথে সেখানেই যাচ্ছে। মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠছে। আব্রাহামে’র জন্য কতগুলো মানুষ ভালো নেই। সবকিছুর জন্য আবরার নিজেকে দায়ী ভাবছে। ভেতরে ভেতরে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আব্রাহাম’কে নিয়ে আসলে, সবার সব দুঃখ কষ্ট দূর হয়ে যাবে। সবাই আব্রাহাম’কে ভুল বুঝে আছে। কিন্তু আমি তো জানি আব্রাহাম সম্পূর্ণ নির্দোষ। এসব কথা ভাবতে ভাবতে শহর থেকে তিন ঘন্টা দূরে, একটা গ্রামে এসে, গাড়ি দুটি থেমে গেল। আবরার অস্থির হয়ে, সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তখনই একজন পুলিশ বলে উঠলো।
–উত্তেজিত হবেন না। উত্তেজিত হলে, আমরা আমাদের কাজ শেষ করতে পারবো না। আমাদের ঠান্ডা মাথায় কাজ করতে হবে। ভুলে যাবেন না। আমরা পুলিশ হয়ে নয়। আমরা এই গ্রামে ঘুরতে এসেছি। আপনি মাস্ক দিয়ে মুখ’টা লুকিয়ে ফেলুন। অপরাধী যদি, আপনার পরিচিত হয়। তাহলে আপনাকে দেখা মাত্রই, আপনাকে সে শনাক্ত করে ফেলবে। এবং সর্তক হয়ে যাবে। আবরার পুলিশের কথা মতো মাস্ক পড়ে নিল।
চারিদিকে রাতের আঁধার নেমে এসেছে। গ্রামের সবাই সন্ধ্যা হবার সাথে সাথে বাসায় চলে গিয়েছে। ফাঁকা রাস্তা। মাঝে মধ্যে দু-একজন যাওয়া আসা করছে। রাতের আঁধার একটু তীব্র হতেই পুরো গ্রাম মরুভূমিতে পরিনত হলো।
অন্ধকার রুমে বিধস্ত অবস্থায় বসে আছে আব্রাহাম। তার সামনে বসে আছে আহনাফ। মুখে তার তৃপ্তির হাসি। আব্রাহামে’র চোখে-মুখে ক্রোধের ছাপ স্পষ্ট। চেচিয়ে বলল।
–তুমি যেই উদ্দেশ্য আমাকে এখানে ধরে নিয়ে এসেছো? তোমার সেই উদ্দেশ্য কোনোদিন পূরন হবে না।
–এত মার খেয়ে-ও শিক্ষা হয় নাই। আরো একটু ভাই আদর করবো নাকি।
–আব্রাহাম মরতে ভয় পায় না। মরতে একদিন সবাইকে হবে। তুমি কি মনে করেছো। তোমাকে এমনি এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে। তুমি তোমার কর্ম ফল পাবার জন্য তৈরি থেকো।
আব্রাহামে’র কথা শুনে, আহনাফ আব্রাহামে’র গাল চেপে ধরলো। রক্তিম চোখে তাকিয়ে ক্রোধ নিয়ে বলল।
–তোর মনে এতটুকু ভয় নেই। কি করলে তুই শান্ত হবি। তোর এত জেদ কোথায় থেকে, একটা কারণে তোকে সহ্য করছি। না হলে সেদিনই তোকে মেরে ফেলতাম।
–আমি আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় করি না। আমি তোমার গোলাম নই। যে, তোমার সব কথা শুনতে বাধ্য হব।
আহনাফ কিছু বলতে যাবে। তার আগেই একজন কালো পোশাক পড়া লোক এসে বলল।
–স্যার সাত-আট জন আমাদের বাসার দিকে এগিয়ে আসছে। আপনি কি নতুন লোক নিয়োগ দিয়েছিলেন? লোকটির কথা শুনে, আহনাফের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে, তো নতুন লোক নিয়োগ দেই নাই। তাহলে কারা আসছে। আহনাফ আব্রাহামে’র দিকে তাকিয়ে দেখলো, আব্রাহামে’র অধরের কোণে রহস্যময় হাসি। আহনাফ আর বুঝতে দেরি হলো না৷ আহনাফ এটাই বুঝে উঠতে পারছিল না৷ আব্রাহাম এতটা শান্ত রয়েছে কিভাবে, সেদিন আয়াত’কে ফোন করার নাম দিয়ে, আব্রাহাম কাকে ফোন দিয়েছিল। আর ভাবতে পারলো না আহনাফ। দ্রুত আব্রাহাম’কে সেন্সলেস করে ফেলল। এখনই তাদের এখানে থেকে চলে যেতে হবে। কিন্তু আব্রাহাম’কে নিয়ে কিভাবে যাবে। মস্তিষ্ক কেমন জানি শূন্য হয়ে আসছে। আব্রাহাম’কে রেখে, বাসার পেছন রাস্তা দিয়ে পালিয়ে গেল। একটু পরেই আবরার আর পুলিশ বাসাটা’র মধ্যে প্রবেশ করল। আব্রাহাম’কে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে থাকতে দেখে, আবরার দৌড়ে আব্রাহামে’র কাছে গেল। কয়েকবার ডাকলো। তবু-ও আব্রাহাম রেসপন্স করল না। আব্রাহাম’কে ভালোভাবে দেখে, আবরার বুঝতে পারলো। আব্রাহাম’কে সেন্সলেস করা হয়েছে। আহনাফ ভাই এত চালাক যা বলার বাহিরে, পালিয়ে যাবার আগে, ঠিক আব্রাহাম’কে সেন্সলেস করে দিয়ে গিয়েছি। যেনো আব্রাহাম আহনাফে’র কোনো রকম খোঁজ দিতে না পারে। আহনাফ ভাই কি এটা জানে না। চোরের দশদিন সাধুর একদিন।
–তোমার ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ। তাকে শারিরীক ভাবে প্রচুর অত্যাচার করা হয়েছে। তা তোমার ভাইকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আগে তোমার ভাইকে হসপিটালে নিয়ে যাবে। নাকি অপরাধীদের শনাক্ত করতে যাবে। আমার মনে হয়। তোমার ভাইকে আগে হসপিটালে নেওয়া উচিৎ।
আবরার কোনো কথা বলল না। দু’জন পুলিশের সাহায্যে, আব্রাহাম’কে গাড়িতে তুলে নিল। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে, আব্রাহাম’কে হসপিটালে নিয়ে আসলো। হসপিটালের সবথেকে ভালো চিকিৎসা আব্রাহাম’কে দেওয়া হচ্ছে, আব্রাহামে’র মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে, আবরারের বুকটা কেঁপে উঠলো। ভেতর’টা হাহাকার ভরে উঠেছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাকে মাকে ফোন দিল। আবরারের মা ফোন তুলতেই আবরারকে বলে উঠলো।
–আবরার এত রাত হয়ে গিয়েছে। তুই বাসায় আসবি না। রজনী না খেয়ে তোর জন্য অপেক্ষা করছে। তুই এমন হয়ে গিয়েছিস কেনো? ঠিক মতো বাসায় আসিস না। তোর ব্যবহার আমাকে দিন দিন হতাশ করছে।
–আম্মু আব্রাহাম’কে খুঁজে পেয়েছি। তুমি একটু হসপিটালে আসবে। ওর এখন একজন ভালোবাসার মানুষের বড্ড প্রয়োজন। ওর মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছে না। তুমি একটু আসবে। চোখ মেলে, তোমাকে দেখলে অনেক খুশি হবে।
–যে,ছেলে আমাদের কথা ভাবে না। বিয়ের দিন না বলে, হারিয়ে যায়। সেই ছেলের মুখ আমি দেখতে চাই না। আব্রাহামে’র কথা একদম আমার কাছে বলবি না। আব্রাহাম আমাদের মানসন্মান সবকিছু নষ্ট করে দিয়েছে।
–কেনো দিয়েছে, সেটা আমি তোমাদের বলেছি।
–আমি তোর কথা বিশ্বাস করি না। তুই আর আমাকে ফোন দিবি না। নিজের মা-বউয়ের দিকে নজর নেই। ভাইয়ের জন্য দরদ উথলে পড়ছে।
–মা হয়ে কিভাবে, এমন কথা বলতে পারছো? কথা গুলো বলতে তোমার বুক কাঁপছে না। আবরারের মা কোনো কথা না বলেই কল কেটে দিল। আবরার কিছুক্ষণ আব্রাহামে’র দিকে চেয়ে রইলো। আব্রাহামে’র পাশে বসে, আব্রাহামে’র মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
পরের দিন সকাল বেলা, হসপিটালের কোলাহলে ঘুম ভেঙে যায় আব্রাহামে’র। দু-চোখ মেলে নিজেকে হসপিটাল আবিষ্কার করল। পাশে তাকিয়ে দেখলো। আবরার আব্রাহামে’র হাতের স্যালাইন খুলছে। আব্রাহাম’কে তাকিয়ে থাকতে দেখে, আবরার বলল।
–এখন কেমন লাগছে? বড় ভাইয়ের কাছে আদর খেতে গিয়েছিলি। তোর বড় ভাই তোকে এত আদর দিয়েছে। যে, সোজা হসপিটালে ভর্তি হতে হলো। তোর শরীর একদম দুর্বল। তোকে এখন একদম বেড রেস্টে থাকতে হবে। পন্ডিতি করে উঠতে যাস না। মাথা ঘুরে পড়ে যাবি।
–আমি আয়াতে’র কাছে যাব ভাইয়া। আমাকে আয়াতে’র কাছে নিয়ে চলো।
–যা আয়াত তোর জন্য জুতা আর ঝাড়ু নিয়ে বসে আছে। সবকিছু তোর ওপরে প্রয়োগ করবে। বেশি কথা বলিস না। আগে সুস্থ হয়ে নে। তারপরে আয়াতে’র কাছে যাবি। আয়াতে’র জন্য এত চিন্তা থাকলে, সেদিন নিজের কথা ভেবে পালিয়ে যেতি না। তোকে বারবার করে বলে ছিলাম। আয়াত’কে হারিয়ে ফেলিস না। তুই শুধু আয়াত’কে না। দু’টো পরিবারের মনে আঘাত করেছিস। সবাই তোর ওপরে রেগে আছে। আয়াতে’র দিকে তাকানো যায় না। মেয়েটা’কে তুই একদম মেরে ফেলছিস।
–আমি সবার সবকিছু মেনে নিব। তুমি আমাকে যা বলবে, আমি তাই করবো। আমি আয়াত’কে না দেখে আর থাকতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আহনাফ ভাই, আমাকে শারীরিক ভাবে এত অত্যাচার করেছে, তবু্-ও আমি ব্যথা পায় নাই। কিন্তু আয়াতে’র কথা ভাবলে, দুই পরিবারের কথা ভাবলে, আমার মনে হতো কেউ, আমার ভেতরটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। আমাকে আয়াতে’র কাছে নিয়ে চলো ভাইয়া। এভাবে থাকলে, আমি মরে যাব।
–এভাবে উত্তেজিত হোস না। তুই ঠিক করে কথা বলতে পারছিস না। তুই আগে শান্ত হ। আমি রোজ সন্ধ্যায় আয়াতে’র বাবাকে একবার করে দেখে আসি। আজকে যাবার সময় তোকে নিয়ে যাব। তুমি খেয়ে,ফ্রেশ। আগে একটু সুস্থ হ। চেহারার কি অবস্থা করেছিস। একবার নিজেকে আয়নায় দেখছিস। তোকে আর কি বলবো। তোর অবস্থার জন্য তুই নিজেই দায়ী। আমার একটা কথা শোন। দিনের আলোয় যাওয়ার থেকে,রাতের আঁধারে যাওয়া অনেক ভালো হবে। লোকজন দেখলে, কানাঘুঁষা করতে, এক সেকেন্ড সময় নিবে না।আবরারের কথায় শান্ত হয়ে গেল আব্রাহাম।
সন্ধ্যা বেলায় আয়াতে’র বাসার সামনে আবরার আর আব্রাহাম দাঁড়িয়ে আছে। আব্রাহামে’র শরীর তরতর করে কাঁপছে। শরীর দুর্বল হবার দরুন আব্রাহামে’র শরীর কাঁপছে। আবরার আব্রাহাম’কে ধরে দরজার সামনে নিয়ে আসলো। এক হাতে আব্রাহাম’কে ধরে আরেক হাতে, কলিং বেলে চাপ দিল।
চলবে…..