সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব-৩০+৩১

0
252

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৩০
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

জীবন তাদের কোন মোড়ে নিয়ে এসে দাঁড় করিয়েছে। না ঠিকমতো ভালো থাকতে দিচ্ছে, না ঠিকমতো বাঁচতে দিচ্ছে। রজনী’র মলিন মুখ’টা দেখে, আয়াতে’র ভেতরে খারাপ লাগা কাজ করতে লাগলো। অল্প কিছু দিনের চেনা মানুষটা’কে কতটা ভালোবেসে ফেলছে রজনী। তা-না হলে, কিছু সময়ের ব্যবধানে নিজের এ হাল করতে পারে। আয়াত কিছু বলতে গিয়ে’ও থেমে গেল। বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলল।

–আপুকে নিয়ে আসার কি দরকার ছিল? আয়াতে’র কথা শেষ হবার সাথে সাথে আজাদ শিকদারের কঠিন কণ্ঠ ভেসে এলো।

–যে বাসায় মানুষ গিরগিটির মতো রং বদলে ফেলে, সেই বাসায় আমার মেয়েকে রাখতে পারবো না। আব্রাহাম নিজের ছেলে না বলে, আজ তোমাদের বাসা থেকে করে দিয়েছে। রজনী’ও তাদের মেয়ে না। আমার মেয়েকে মেরে ফেলতে এক সেকেন্ড সময় নিবে না। আমি মানছি আবরার খুব ভালো ছেলে। আবরার সারাদিনে কতক্ষণই বাসায় থাকে। আবরার না থাকার সুযোগ যদি ওরা নেয়। আমার মেয়ের একটা ক্ষতি হয়ে গেলে, তখন কি হবে। আমার রজনী একটু ত্যাড়া বাঁকা কথা বলে, এটা আমি সহ্য করতে পারি না। বাবা বলে সহ্য করে নেই। সেখানে ওরা পর মানুষ কিভাবে সহ্য করবে। আমি আবরার’কে বাবা-মা রেখে আলাদা হতে বলবো না। আমি যদি আবরার’কে বলি, রজনী’কে নিয়ে আলাদা থাকতে, তাহলে এটা বলা আমার অন্যায় হবে। রাজনী’কে যদি নিয়ে যেতে হয়। ওদের রজনীর লাইফ সাপোর্ট দিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এমনি এমনি মেয়ে দিব না।

–আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক আব্বু। এই জন্যই বলে, ছোটদের সাথে বড়দের তুলনা করতে নেই। তারা তো আর এমনি এমনি বড় হয় নাই। পুরো দুনিয়া দেখেই বড় হয়েছে।

–বাবা-মাকে আপনি বলা কবে থেকে শিখলে? এখনো আমাদের ওপরে রেগে আছো?

–না আব্বু রেগে নেই। আপনাদের ওপরে একটু অভিমান জমেছিল। সেটাও শেষ করে দিব। আপনারা যদি আমার একটা কথা রাখেন। আয়াতে’র কথা শুনে, গভীর ভাবে আয়াতে’র দিকে তাকালো আজাদ শিকদার। আয়াত বাবার কাছে বসে আদুরে কণ্ঠে বলল।

–আমরা ছাড়া আব্রাহামের কেউ নেই আব্বু। তোমরা আব্রাহাম’কে কখনো কষ্ট দিও না। মানুষ’টা ছোট বেলা থেকে, মানুষের অবহেলা, তুচ্ছ তাচ্ছিল্য পেতে পেতে বড় হয়েছে। যে বয়সে মায়ের আদর পাবার কথা। সে বয়সে মানুষের বাজে ব্যবহার পেয়েছে। তোমাদের কাছে একটাই অনুরোধ। তোমরা আব্রাহামের সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করবে না। কখনো আব্রাহাম’কে কষ্ট দিয়ে কথা বলবে না। যদি পারো আব্রাহামের বাবা-মা হয়ে উঠার চেষ্টা করবে। একদম আব্রাহামের সামনে আমাকে ভালোবাসবে না। আব্রাহামের সামনে সব সময় আমার সাথে রাগ দেখিয়ে কথা বলবে, আব্রাহাম’কে বেশি বেশি ভালোবাসবে। তাহলে হয়তো বাবা-মায়ের অভাব একটু হলে-ও পূর্ণ হবে। তোমরা যদি আব্রাহামে’র সামনে আমাকে ভালোবাসো। তাহলে আব্রাহামের’ও তার বাবা-মায়ের কথা মনে পড়বে। সে মনে মনে কষ্ট পাবে। এটা আমি সহ্য করতে পারবো না। কথা গুলো বলতে বলতে আয়াতের দু-চোখে এসে জমা হয়েছে অশ্রুকণা। আয়াতের কথা শুনে, আয়াতের বাবা নরম হয়ে গেল। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল।

–আমাদের তোমার এত খারাপ মনে হয়। আমরা যদি এতই খারাপ হতাম। তাহলে আব্রাহাম এত বড় ভুল করার পরে-ও তোমার সাথে আব্রাহামের বিয়ে দিতাম না। আবরার যখন আমাকে সবকিছু বলল। মনের অজান্তে ছেলেটার জন্য কষ্ট হতে শুরু করেছিল। তাই তো ওকে মাফ করে দিয়ে, তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছি। আমরা যদি আব্রাহামকে ভালো না বাসি। তাহলে কে ভালোবাসবে। আমরা সর্বদা চেষ্টা করবো। আব্রাহামের বাবা-মা হয়ে উঠার।

–আমি অনেক ভাগ্যবান জানো বাবা। যে, আমি তোমাদের মতো বাবা-মা পেয়েছি। যাদের কাছে মনের কথা বলতে, কোনো দ্বিধাবোধ করতে হয় না। তোমাদের মতো বাবা-মা যেনো প্রতিটি ঘরে ঘরে হয়। ও আম্মু তুমি আব্রাহামের সামনে একদম আমাকে খাইয়ে দিবে না। যদি পারো আব্রাহাম’কে ভালোবেসে আদর করে খাইয়ে দিবে।

–আমাকে তোর এত খারাপ মা মনে হয় আয়াত। ভুলে যাস না। তোর বাবা-মা আছে। তাই দুঃখ কষ্ট কি জিনিস। তা’ তুই অনুভব করতে পারছিস না। কিন্তু আমি অনুভব করেছি। আঠারো বছর বয়স হবার আগেই, পরিবারের বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম। খেতে বসে খাওয়ার খোঁটা’ও শুনেছি। এতিমের যে, কি জ্বালা তা একমাত্র এতিমরাই বুঝে। আমি নিজে একজন এতিম হয়ে, আরেকটা এতিম বাচ্চাকে কি করে কষ্ট দিব বল। তোর বাবার মুখে সবকিছু শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়ে ছিলাম। আমাদের সমাজে এতিমরা সবচেয়ে বেশি, অবহেলিত। আব্রাহাম এতিম বলে, আমরা তাকে দূর সরিয়ে দিব। এমনটা মনে করিস না৷ সবার সাথে আমাদের তুলনা দিবি না আয়াত। মায়ের কথা শুনে বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল আয়াতে’র। কোনো কথা বলল না। নিঃশব্দে ড্রয়িং রুম ত্যাগ করল।

বিকেলে আব্রাহাম আয়াতদের বাসায় আসলো। আয়াতে’র আম্মু আব্রাহাম’কে খেতে দিয়েছে। আব্রাহাম হাত ধুয়ে ভাতের প্লেটে হাত দিতে যাবে। তখনই আয়াতে’র আম্মু হাসিমাখা মুখ করে বলল।

–তুমি কিছু মনে না করলে, আমি তোমাকে খাইয়ে দেই? আয়াতে’র আম্মুর কথা শুনে, অবাক দৃষ্টিতে আয়াতে’র আম্মুর দিকে তাকালো আব্রাহাম। কত বছর পরে, কেউ এত আদুরে কণ্ঠে তার সাথে কথা বলল। এতদিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট গুলো বেড়িয়ে আসতে চাইলো। কিন্তু নিজেকে যথাসম্ভব দমিয়ে রাখলো আব্রাহাম। হাসতে হাসতে উত্তর দিল।

–সমস্যা নেই। আমি খেতে পারবো। আমি ছোট বাচ্চা নাকি। যে আমাকে খাইয়ে দিতে হবে?

–মায়ের কাছে সন্তানরা সব সময় ছোটই থাকে। মায়ের বুঝি ইচ্ছে করে না। তার ছেলেকে খাইয়ে দিতে। আজকে নিজ হাতে খাইয়ে দিব। একটা কথা’ও শুনবো না। বলেই ভাতের প্লেট হাতে তুলে নিল। আব্রাহাম মাথা নত করে নিয়ে, টেবিলে হাত নাড়াতে লাগলো। আয়াতে’র আম্মু ভাত মেখে আব্রাহামের মুখের সামনে ধরলো। আব্রাহামের দিকে তাকিয়ে দেখলো আব্রাহামের দু-চোখ অসম্ভব ভাবে লাল হয়ে গিয়েছে। আব্রাহামের মুখের দিকে তাকিয়ে আয়াতে’র আম্মু প্রচন্ড মায়া হলো। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।

–এত কষ্ট পাবার কি আছে। আমরা কি মরে গিয়েছি। আজ থেকে আমরাই তোমার বাবা-মা। আমরা যতদিন বেঁচে আছি। নিজেকে কখনো একা মনে করবে না। মা হয়ে ছেলের কষ্ট নিজ চোখ দেখা কতটা কষ্টকর। সেটা তুমি সেদিন বুঝতে পারবে। যেদিন তুমি নিজে বাবা হবে। আয়াতে’র আম্মুর কথায় আব্রাহাম ভিষণ লজ্জা পেল। আয়াত সোফায় বসে মিটমিট করে হাসছে। আয়াত’কে হাসতে দেখে, কড়া চোখে আয়াতে’র দিকে তাকালো আব্রাহাম। আয়াতে’র আম্মুর কথায় আব্রাহাম অধিকার বোধ খুঁজে পেল। প্রতিটি কথায় মায়ের ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছে। এক মুহুর্ত বিলম্ব করল না। আয়াতে’র আম্মুর হাতে খেতে শুরু করল। আয়াতে’র আম্মু যত্ন সহকারে আব্রাহাম’কে খাইয়ে দিয়ে, রান্না ঘরে চলে গেল। আব্রাহাম আয়াতে’র পাশে বসে, গম্ভীর হয়ে বলল।

–অসভ্যের মতো হাসছিলে কেনো?

–তোমার অবস্থা দেখে, কথায় কথায় তর্ক করা ছেলেটা-ও কেমন ভেজা বিড়ালের মতো বসেছিল। তুমি আম্মুর কথার ওপরে একটা কথা’ও বলতে পারলে না।

–মায়ের মুখের ওপরে কি কথা বলা যায়। সবার সামনে বেয়াদবি করলে-ও মায়ের সাথে বেয়াদবি করা যায় না। আজকে অনেক দিন পরে মাতৃত্বের স্বাদ খুঁজে পেয়েছি। সেটা কিভাবে নষ্ট হতে দেই বলো। আব্রাহামের কথা শেষ হবার সাথে সাথে আয়াত সিরিয়াস হয়ে বলল।

–আব্বু তো রজনী আপুকে নিয়ে আসছে। আপু অনেক কষ্ট পাচ্ছে। আবরার ভাইয়া’কে বলো। যেনো আপুকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যায়।

–তোমার কি মনে হয়? আবরার ভাইয়া বাসায় বসে আছে। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে বাবা-মায়ের পেছনে পড়ে আছে। যেনো তারা ভাবিকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে নিয়ে যায়। বাবা মায়ের থেকে দূরে সরে গেলে, প্রকৃত স্বামী হওয়া গেলে-ও প্রকৃত সন্তান হওয়া যায় না। যাদের জন্য পৃথিবীতে আসতে পারলে, তাদের থেকে দূরে সরে যাওয়াটা কোনো সুসন্তানের কাজ হতে পারে না। আবরার ভাইয়া’কে সময় দাও। ভাইয়া ঠিক সবকিছু আগের মতো করে নিবে। আজকে থাকবে নাকি বাসায় যাবে। আয়াত বলল বাসায় যাবে। দু’জন মিলে, সবার থেকে বিদায় নিয়ে, বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিল।

ঘড়ির কাটায় রাত এগারোটা ছুঁই ছুঁই। রজনী নিজের রুমে শুইয়ে শুইয়ে বই পড়ছিল। কিছুতেই পড়াতে মন বসছে না। সারাক্ষণ আবরারের কথা মন পড়ছে। সারাদিনে মানুষ’টা একবারো খোঁজ নিল না। বড্ড অভিমান হলো রজনীর। দু-চোখ বন্ধ করে, হাজারো জল্পনা কল্পনা করতে লাগলো। রজনী’র ভাবনার মাঝেই রজনীর ফোন বেজে উঠলো। রজনী তড়িঘড়ি করে, ফোন হাতে তুলে নিল। ফোনের স্কিনে আবরারের নাম দেখে, অজান্তেই রজনীর মুখে হাসি ফুটে উঠলো। রজনী ফোন রিসিভ করতেই আবরার কাতর স্বরে বলল।

–তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একটু বেলকনিতে আসবে। একটু দেখেই চলে যাব। আবরারের কথা শেষ হবার সাথে সাথে রজনী দৌড়ে বেলকনিতে গেল। রজনীকে এত দ্রুত বেলকনিতে আসতে দেখে ভরকে গেল আবরার। রজনী এত দ্রুত বেলকনিতে চলে আসবে। সে কল্পনা’ও করতে পারে নাই। আবরার’কে আরো অবাক করে দিয়ে রজনী নিচে নেমে আবরারের কাছে গেল। কোনো কথা না বলে, আবরার’কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল। থমকে গেল আবরার। এটাই কি সেই মেয়ে। যে সব সময় হাসতে জানে না। সারাক্ষণ মুখটা গম্ভীর করে রাখে। সব সময় ত্যাড়া বাঁকা কথা বলে। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, আবরারে’র রজনী’কে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল।

–আপনি আসলেই রজনী। আমার বউ রজনী কান্না করার মতো মেয়েই না। সত্যি করে বলুন? আমার বউ কোথায়? আবরারে’র কথা শুনে, রজনী আবারের বুকে ঘুষি মারলো। আবরার ব্যথায় কুকড়িয়ে উঠলো। রজনী কান্না ভেজা কণ্ঠে বলল।

–আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো আবরার। তোমাকে ছাড়া আমি এক মুহুর্ত থাকতে পারছি না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলছি তোমাকে। তোমাকে ছেড়ে থাকা অসম্ভব। রজনীর কথা শুনে, আবরারের বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল৷ এতদিন এই কথা গুলো শোনার জন্য কতটা আকুল হয়ে ছিল আবরারের মন। ইচ্ছে করছে রজনী’কে কোলে নিয়ে নাচতে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকায় নিজেকে দমিয়ে নিল আবরার। রজনীর গালে হাত দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল।

–তুমি চিন্তা করো না। আমি আছি না। খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে আমার কাছে নিয়ে যাব। সবকিছু আহনাফ ভাইয়ের জন্য হয়েছে। আহনাফ ভাই যদি স্বার্থপর না হতো। তাহলে আমাদের পরিবারটা আজ সুখ-শান্তিতে পরিপূর্ণ থাকতো। আমি সবকিছু আগের মতো করে দিব। তুমি চিন্তা করো না। আরো কিছুক্ষণ রজনীকে বুঝিয়ে গেল আবরার।

এর মাঝে কেটে গিয়েছে কয়েকদিন। আবরার দুই পরিবারের মনমালিন্য কাটাতে একটু সক্ষম হয়েছে। তবে ভালোবাসা’টা আগের মতো নেই। আজ দু’দিন হলো রজনী’কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাবা-মাকে বুঝিয়ে রজনীর লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রজনী’কে নিতে এসেছিল। সেদিন থেকে রজনী নিখোঁজ। রজনী নেই দু’টো দিন পার হয়ে গেল। আবরারের অবস্থা পাগল প্রায়। কতই না আশা নিয়ে এসেছিল। এবার সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সে কি জানতো তার জন্য অন্য কিছু অপেক্ষা করছে। দু’টো দিন হলো, প্রতিটি মানুষের খাওয়া-দাওয়া নেই। অধরের কোণে হাসির রেখা সরে গিয়ে, মুখে এসে ধরা দিয়েছে মলিনতা। আয়াত মনমরা হয়ে বসেছিল। তখনই আয়াতে’র ফোনে ফোন আসলো। আয়াত দ্রুত ফোন তুলল। কথা বলা শেষ হলে, আয়াত এক মুহুর্ত দেরি করল না। দ্রুত গতিতে বাসা থেকে বের হয়ে গেল।

চলবে…..

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

আয়াত আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে। আয়াতে’র পেছনে দু’জন পুলিশ হাঁটছে, একদম সাধারণ মানুষের মতো। পড়নে নেই পুলিশের পোশাক। আয়াত কি জানে না? তার থেকে-ও বেশি চালাক তার বিপক্ষের লোকেরা। তবু-ও কেনো বোকামি করতে গেল। রজনী’র দেওয়া ঠিকানায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে এক ঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। আয়াত পেছনে তাকিয়ে দেখলো, তার সাথে আসা পুলিশ দু’টো নেই। রজনীর ফোন পেয়ে দ্রুত বাসা থেকে বের হয়েছিল আয়াত। রজনী আয়াত’কে একা আসতে বলেছিল। আয়াতে’র কেনো জানি মনে হয়েছিল রজনী বিপদের মধ্যে আছে। তাই সে একা যাওয়াটা নিরাপদ মনে করল না। তার চেনা দু’জন পুলিশকে সাথে নিয়ে নিল। তাদের দেখতে না পেয়ে একটু ভয় পেল আয়াত। সামনের দিকে ঘুরতে যাবে। তার আগেই কেউ আয়াতে’র দু-চোখ বেঁধে ফেলল। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল।

–ভুলে-ও চিৎকার করার চেষ্টা করবে না। নিজেকে খুব চালাক মনে করো। কোন সাহসে পুলিশ নিয়ে আসো। বোনের যদি ভালো চাও। তাহলে চুপচাপ আমাদের সাথে চলো। আগন্তুকের কথায় পুরো শরীর কেঁপে উঠলো আয়াতে’র। অজানা ভয় এসে মনে হানা দিয়েছে। পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। পা যেনো আর চলছে না। আগন্তুকের সাথে আয়াত সামনের দিকে এগোতে লাগলো। একটু পরে আয়াতে’র দু’চোখের বাঁধন আপনা-আপনি খুলে গেল। চেয়ারে হাত-পা অবস্থায় রজনীকে দেখে, আয়াতের ভেতরে মোচড় দিয়ে উঠলো। তার আদরের বোনের একি অবস্থা। আবরার ভাইয়া জানে, তার প্রেয়সীর এই অবস্থার কথা। জালনে হয়তো সবকিছু শেষ করে দিবে। আবরার ভাইয়ার শখের মানুষটার একি হাল করেছে তারা। আবরার ভাইয়া নিজে শেষ হয়ে গিয়েছে। কখনো রজনী আপাকে কষ্ট পেতে দেন নাই। আজ তার শখের মানুষ’টা কষ্ট পেতে পেতে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আয়াত দৌড়ে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরলো। আয়াত’কে এখানে আসতে দেখে রজনী রাগান্বিত হয়ে বলল।

–তুই এখানে আসতে গেলি কেনো? তোর কোনো ধারনা আছে? তুই না জেনেশুনে কোথায় চলে এসেছিস? রজনী কথা শুনে আয়াত এবার কান্না করে দিল। কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল।

–তুমি সবাই’কে না জানিয়ে কেনো চলে এসেছো? সবাই তোমার জন্য চিন্তা করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। আবরার ভাইয়ার কথা বাদই দিলাম। মানুষটা তোমাকে কাছে পাবার জন্য আর কত যুদ্ধ করবে বলতে পারো। বাবা-মাকে মানিয়ে কতটা আশা নিয়ে তোমাকে নিতে এসেছিল। এভাবে কাউকে কিছু না বলে, উধাও হয়ে গেলে কেনো আপু? আবরারের কথা মনে হতেই রজনী বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। ভেতরটা হাহাকারে ভরে গিয়েছে। মনে হচ্ছে কতশত জনম ধরে আবরার’কে দেখে নাই। মানুষটা খুব অল্প সময়ে তার জীবনের অংশ হয়ে গিয়েছে। সে পাশে না থাকলে মনে হয়। তার বিশাল কিছু হারিয়ে গিয়েছে। রজনী কাতর স্বরে বলল।

–আবরার কেমন আছে আয়াত?

–তুমি যেমন রেখেছো? আয়াতে’র কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল রজনী। আয়াত আবার কিছু বলতে যাবে। তার আগেই পুরুষালী কণ্ঠ ভেসে এলো।

–আরে ছোট শালীকা-ও যে চলে এসেছে। এবার আড্ডাটা জমিয়ে দেওয়া হবে। আহনাফের কণ্ঠ শুনে রজনী রাগান্বিত হয়ে বলল।

–আর কত নিচে নামবেন। আমাকে তুলে নিয়ে এসেছেন। আপনাকে কিছু বলি নাই। নির্লজ্জের মতো আয়াত’কে কেনো এখানে নিয়ে এসেছেন। আয়াত’কে ছেড়ে দিন। না হলে আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না।

–এত মার খেয়েও শিক্ষা হয় নাই। এত তেজ তোমার। মরনের ভয় নেই মেয়ে তোমার!

–না নেই। আপনি আয়াত’কে ছেড়ে দিন। কাপুরুষ একটা। নিজের শক্তি সঠিক জায়গায় প্রয়োগ করুন। দুর্বল জায়গায় কেনো প্রয়োগ করছেন? পুরুষের শক্তি শক্ত জায়গায় দেখানোটাই হচ্ছে পুরুষত্ব। সেই শক্তি যদি নারী মতো কোমল ফুলের ওপরে প্রয়োগ করেন। সেটাকে কাপুরষ বলে। রজনীর কথা শুনে, আহনাফ ক্রোধ নিয়ে রজনীর দিকে এগিয়ে আসে। শক্ত করে রজনীর দু’গাল চেপে ধরে বলল।

–আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। তুমি আস্ত একটা ত্যাড়া মেয়ে। সোজা কথায় কাজ হবে না। তোমার নাকি ভয়ডর নেই। তোমার বোনের-ও ভয়ডর ছিল না। আমি ভয় তৈরি করে দিয়েছি তার মনে। তোমার মনে ভয় কিভাবে তৈরি করতে হয়। সেটা আমার ভালো করেই জানা আছে। আবরার পাগল হয়ে অলিতে-গলিতে রজনীকে খুঁজে চলেছে। উন্মাদ আবরার’কে যদি একটা চলন্ত গাড়ি এসে পিষে দিয়ে চলে যায়। তখন রজনী কি করবে। তার তেজ ঠিক এতটাই থাকবে। আহনাফের কথা শুনে, রজনী দু-চোখ বন্ধ করে ফেলল। কথাটা ভাবতেই রজনীর অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো। আহনাফের কথা যদি সত্যি হয়ে যায়। তবে সে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। রজনীর ভয়ার্ত চেহারা দেখে আহনাফ হেসে উঠলো। আয়াত আহনাফকে তোয়াক্কা না করে রজনীর হাতের বাঁধন খুলে দিতে লাগলো। আহনাফ শক্ত করে, আয়াতের হাত চেপে ধরলো। আহনাফ রাগান্বিত দৃষ্টিতে আয়াতে’র দিকে তাকালো।

–তোমাকে’ও ভাই আদর দিতে হবে। খুব সাহস দেখাচ্ছ। অবশ্য আমি কাকে কি বলছি। একটা বেয়াদবের বউ, বেয়াদবই হবে। সেটাই স্বাভাবিক।

–আমার স্বামী বেয়াদব। আমাকে নিয়ে, সবার সামনে সংসার করে খাওয়ার ক্ষমতা তার আছে। আপনি এত আদব। তাহলে বউকে নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ান কেনো? বউকে নিয়ে সুস্থ ভাবে সুন্দর জীবনযাপন করতে পারেন না কেনো? বেয়াদব হয়ে যদি, উচিৎ কাজ করতে পারে। তবে আমার বেয়াদব স্বামীই শ্রেয়। আপনার মতো কাপুরুষ স্বামী আমার চাই না। আহনাফ কষে আয়াতে’র গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। আয়াত তাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পড়ে গেল৷ আয়াতে’র গায়ে হাত তোলায় রজনী হুংকার দিয়ে উঠলো। রজনী কিছু বলতে যাবে। তার আগেই আহনাফ রজনীর মুখে রুমাল চেপে ধরলো। সাথে সাথে রজনী সেন্সলেস হয়ে গেল।

আয়াত মাটি থেকে চোখ তুলে তাকাতেই, আয়াতে’র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। নিজের দু-চোখ’কে বিশ্বাস করতে পারছে না আয়াত। আয়াত এতটাই অবাক হয়েছে, যে সে কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না। আহনাফ তার গায়ে হাত তোলায় সে-ও আহনাফকে আঘাত করতে চেয়েছিল। কিন্তু চোখে মেলে তাকিয়ে এমন কিছু দেখতে পাবে। তা কল্পনা’ও করতে পারে নাই আয়াত। আয়াত ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো। আহনাফ চোখ দিয়ে ইশারা করতেই একজন কালো পোশাক পড়া লোক আয়াতে’র দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো। আয়াত নিষ্পলক ভাবে সামনে থাকা মানুষটিকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করছে। আয়াতে’র ভাবনার মাঝেই আয়াতের মুখ কেউ চেপে ধরলো। তার পরে কি হয়েছে জানা নেই আয়াতে’র।

আব্রাহাম বাসায় এসে আয়াত’কে না দেখতে পেয়ে পাগল হয়ে গিয়েছে। মেয়েটা সারাদিন একা একা বাসায় থাকে। আজকে ব্যস্ততার জন্য খোঁজ নেওয়া হয় নাই। তার জন্য ভেতরে ভেতরে খুব গিল্টি ফিল হচ্ছে আব্রাহামের। আব্রাহামের চিন্তার মাঝে আবরার ফোন করে জানালো আয়াত রজনীর কাছে। রজনীকে পাওয়া গিয়েছে। সে যদি তাদের সাথে যেতে চায়। তাহলে তাড়াতাড়ি আয়াতদের বাসার সামনে চলে আসে। আব্রাহাম এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। তাড়াতাড়ি করে বাসা থেকে বের হয়ে গেল। সারাদিন না খেয়ে থাকার দরুনে শরীর আর চলতে চাইছে না। অবাধ্য শরীরটাকে জোর করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে আব্রাহাম।

অবশেষে তারা নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে গেল। সেখানে গিয়ে দেখলো আয়াত রজনীর হাতের বাঁধন খুলছে। রজনী সেন্সলেস হয়ে আছে। রজনীর মলিন মুখ দেখে আবরারের বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো। দ্রুত পায়ে রজনী কাছে গেল। আয়াতে’র সাথে সে-ও সাহায্য করল। রজনীকে নিজের কাছে নিয়ে ডাকতে লাগলো। আবরারের অস্থিরতা দেখে, আবরারের বাবা-মায়ের চোখের কোণে এসে জমা হয়েছে অশ্রুকণা। তাদের ছেলে মেয়েটাকে এতটা ভালোবাসে, তা রজনী নিখোঁজ না হলে, বুঝতেই পারতো না। এখন বুঝতে পারছে তারা কতবড় ভুল করেছিল। আবরার কেমন পাগল হয়ে উঠেছে। এদিকে আব্রাহাম কাতর হয়ে আয়াতে’র দিকে তাকিয়ে আছে। আয়াত ভুল করেও আব্রাহামের দিকে তাকায়নি। এমন ভাব করছে যেনো সে আব্রাহামকে চিনে না। সবাই রজনীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আয়াত’ও সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলছে। আব্রাহামের বড্ড অভিমান হলো। আবরার রজনী’কে দ্রুত কোলে তুলে নিল। যতদ্রুত সম্ভব তাকে বাসায় যেতে হবে। রজনীর চিন্তায় এতটা উন্মাদ হয়ে আছে আবরার। সে হয়তো ভুলেই বসেছে, সে নিজেও একজন ডক্টর। রজনীর জন্য আবরারের এমন পাগলামি দেখে, রজনীর বাবার গর্ব হলো ভুল ছেলের হাতে তিনি তার মেয়েকে তুলে দেন নাই। বুকটা প্রশান্তিতে ভরে গেল তার। সবাই যখন গাড়িতে উঠছিল। তখন আব্রাহাম সব অভিমান ভুলে নিজেই আয়াতে’র কাছে গেল। অভিমানী কণ্ঠে বলল।

–আমি’ও যে, এখানে আছি। সেদিকে তোমার খেয়াল আছে। তুমি একা একা এখানে এসেছো। আমাকে একটা বার জানানোর প্রয়োজন মনে করেছিলে? তোমার যদি কিছু হয়ে যেত। তাহলে আমার কি হতো একটা বার ভেবেছিলে? আর একটু হলে, আমার দেহ থেকে প্রান পাখিটা বের হয়ে যাচ্ছিল। আব্রাহামের কথায় আয়াত অদ্ভুত দৃষ্টিতে আব্রাহামের দিকে তাকালো। আয়াতে’র অদ্ভুত দৃষ্টি আব্রাহামকে কিছু বলতে চাচ্ছে। কিন্তু আব্রাহাম আয়াতে’র চোখের ভাষা বুঝতে আজ ব্যর্থ হচ্ছে। মেয়েটা এভাবে কি দেখছে। সে তো আমার চোখের দিকে তাকাতে লজ্জা পেত। আমার মৃত্যুর কথা, তার ছোট্ট হৃদয়টাকে কাঁপিয়ে তুলতো। আজ মেয়েটা এত শান্ত কি করে? আব্রাহামের অভিমানের পাল্লা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হতে শুরু করল। আব্রাহামকে নিরাশ করে দিয়ে আয়াত শান্ত কণ্ঠে বলল।

–আপুর ওপরে অনেক অত্যাচার করা হয়েছে। এই সময়টায় আমি আমার পরিবারের সাথে থাকতে চাই। তুমি যদি অনুমতি দাও। তাহলে ক’টাদিন আমি আব্বু আম্মুর কাছে থাকতে চাই। আয়াতে’র কথা শুনে, গভীর দৃষ্টিতে আয়াতে’র দিকে তাকালো আব্রাহাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল।

–আচ্ছা ঠিক আছে। দেখেশুনে যেও। আর সাবধানে থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। আব্রাহামের কথা শুনে এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না আয়াত। দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। আয়াতের যাওয়ার দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে থাকলো আব্রাহাম। তাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে। রাতে যে তাকে ছাড়া আব্রাহামের ঘুম হয় না। আজকে আয়াতে’র বলা কথা গুলো মনে পড়লো। কথা গুলো আয়াত বিরবির করে বলেছিল। সেটা আব্রাহাম শুনতে পেয়েছিল। আয়াত সত্যি সত্যি তার কথা প্রমানিত করতে চায়। আমাকে কষ্ট দিয়ে, সে যদি ভালো থাকে, তাহলে তার দেওয়া কষ্ট আমি ভালোবাসা মনে করে, পরম আবেশে গ্রহণ করে নিব। আব্রাহাম সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় চলে আসলো। আব্রাহাম ভেবেছিল আয়াত তাকে আজ অন্তত থাকতে বলবে, আয়াত বললেই আজকের রাতটা সে আয়াতদের বাসায় থাকতো। আয়াত আব্রাহামকে সম্পূর্ণ নিরাশ করে আব্রাহামকে একটা বারের জন্য থাকতে বলেনি। আয়াতে’র অবহেলা আব্রাহামকে একটু একটু করে শেষ করে দিচ্ছে। আব্রাহাম নিজেই নিজেকে শান্ত দিচ্ছে। সে আমাকে অবহেলা করছে, তো কি হয়েছে। মানুষটাও আমার আর মানুষটার অবহেলাও আমার। এত কষ্ট পাবার কিছু নেই। আজ অবহেলা করছে। দু’দিন পরে নিজ থেকে কাছে টেনে নিবে। তখন ঐ ভালোবাসার কাছে এই অবহেলা তুচ্ছ মনে হবে। বাসায় এসে আব্রাহামের খাওয়া হলো না। ক্লান্ত শরীর বিছানা এলিয়ে দিল। আজকে আব্রাহামের ভিষণ কষ্ট হচ্ছে, এই কষ্টের কারন খুঁজে বের করতে পারছে না আব্রাহাম। ভেতরটা এত ফাঁকা ফাঁকা লাগছে কেনো তার। পুরো দুনিয়া তার কাছে শূন্য মনে হচ্ছে। হয়তো আয়াত আজ তার পাশে নেই। তাই তো নিজেকে এতটা অসহায় মনে হচ্ছে, আয়াত ছাড়া সে কতটা অসহায় ভেবেই আনমনে হেসে উঠলো আব্রাহাম। তবে ভেতরে থেকে কেনো জানি শান্তি পাচ্ছে না। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে অস্থিরতা বেড়ে চলেছে। সারারাত ছটফট করতে করতে কেটে গেল আব্রাহাম। এমন কেনো হচ্ছে, সে বুঝতে পারলো না। সকাল হবার সাথে সাথেই সে ছুটে চলল শিকদার বাড়ি।

চলবে…..