সে আমার মানসিক শান্তি পর্ব-৪১ এবং শেষ পর্ব

0
496

#সে_আমার_মানসিক_শান্তি
#পর্ব_৪১(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu

ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটে ছুঁই ছুঁই। আহনাফ চুপিচুপি নিজের বাবা-মেয়ের রুমে প্রবেশ করল। সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে। এই সুযোগটাই কাজে লাগাতে চায় আহনাফ। উদ্দেশ্য একটাই বাবাকে খু*ন* করা। আহনাফ নিঃশব্দে বাবার বিছানার দিকে এগিয়ে গেল। হাতের ছুরিটা বের করে, যখনই বাবাকে আঘাত করতে যাবে। তখনই একজোড়া শক্ত হাত আহনাফকে ধরে ফেলে। চমকে উঠে আহনাফ। চারিদিকে আলো জ্বলে উঠলো। পেছনে তাকিয়ে আব্রাহামকে দেখে, আত্মা কেঁপে উঠলো। আবরার,রজনী, আয়াত তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আহনাফের বাবা বিছানা ছেড়ে উঠে, ছেলের গালে কষে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। রাগান্বিত হয়ে বলল।

–তোর এত অর্ধ পতন হয়েছে। তুই কি মানুষের কাতারে পড়িস। নিজের বাবাকে খু*ন* করতে তোর বিবেকে বাঁধা দিল না। বাবার কথায় রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আহনাফ বলল।

–কিসের বাবা? কার বাবা? তুমি আমার নিজের বাবা না। তাহলে তোমাকে মারতে আমার কেনো বিবেকে বাঁধা দিবে? আহনাফের কথায় চমকে উঠলো সবাই। সবার মুখের পরিবর্তন আসলেও আব্রাহামের মুখের পরিবর্তন আসলো না। আব্রাহাম জানতো। আহনাফ এমন কিছুই বলবে। আব্রাহাম শান্ত কণ্ঠে বলল।

–আপনার ছেলের দোষ নেই খালু। আপনার ছেলেকে যা বোঝানো হয়েছে। আপনার ছেলে সেটাই বুঝেছে। আহনাফ ভাই তুমি ভুল ধারনা এতদিন মনে পুষে ছিলে। আমি তোমার বাবা ছেলে নই। তুমি আর আবরার ভাইয়া খালুর ছেলে। আব্রাহামের কথা শুনে, চমকে উঠলো আহনাফ। রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।

–তুই আমার সাথে মজা করছিস। তুই বাবার ছেলে না মানে?

–মানেটা খুব সহজ। আমি তোমার ছোট খালার ছেলে, আর তুমি আর আবরার ভাইয়া আমার বড় খালার ছেলে।

–কিন্তু আমি একবার আব্বুকে বলতে শুনেছিলাম। আব্বু আম্মুকে বলছিল। আহনাফ আমাদের ছেলে নয়। তারপরে উনিও আমাকে বলেছেন। আমি আমার বাবার ছেলে নই। তাই তো তিনি আমাকে সবার থেকে দূরে সরিয়ে, দিয়েছেন। আমি টাকার নেশায় আর বাবার ওপরে জমে থাকা ক্ষোভে বাবাকে মা*রা*র* জন্য মরিয়া হয়ে উঠে ছিলাম। যখন জানতে পারলাম। বাড়িটা তোর নামে, তখন আমার আরো রাগ হয়েছিল। প্রথমে তোকে মেরে, বাবাকে মারতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আজকে তুই আমাকে কি কথা শোনালি।

–আমার ভাবতেই ঘৃণা হচ্ছে, তোর মতো ছেলে আমি জন্ম দিয়েছি। তোর জন্য আব্রাহামকে আমি কত অবহেলা করেছি। অথচ ছেলেটাকে আমাকে তোর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য, আমার পাশে ছায়া হয়ে থেকেছে। আমার সব বিপদ নিজের করে নিয়েছে। তোর মতো কুলাঙ্গারকে মে*রে* ফেলতে ইচ্ছে করছে।

–কিন্তু উনি যে বলল আমি তোমাদের ছেলে না। তাই জন্য আমি তোমাকে মারতে রাজি হয়েছিলাম। আহনাফের কথার মানে কেউ বুঝতে পারলো না৷ সফিউল চৌধুরী রাগান্বিত কণ্ঠে বলল।

–উনি টা কে? সফিউল চৌধুরী কথা শুনে, আব্রাহাম তাচ্ছিল্য করে বলল।

–উনিটা খুব গভীর জলের মাছ। তাকে ধরা কি এতই সহজ। আপনি নিজ থেকে, সামনে আসবেন। নাকি আমি যাব। আব্রাহামের কথা শুনে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে রুমের মধ্যে প্রবেশ করল আয়াতের চাচা। আয়াতের চাচাকে দেখে, আয়াত ও রজনী দু’জনেই চমকে উঠলো। নিজের চাচাকে বিধস্ত অবস্থায় দেখে দুজনেই এগিয়ে যেতে চাইলে, আব্রাহাম থামিয়ে দেয়।

–আপনি সব সত্যি কথা বলবেন নাকি, আমাকে কিছু করতে হবে। আয়াতের চাচা একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করে।

–আমি আরোহীকে পালাতে সাহায্য করি। আহনাফের সাথে যখন প্রেম করতো। আমি আরোহীকে সব সময় সাহায্য করতাম। আরোহীর বাবাকে সবাই অনেক ভালোবাসতো। আমার মা তার সব সম্পত্তি আমার বড় ভাই মানে, আরোহীর বাবাকে দিয়ে দিয়েছিল। সেদিন থেকে আমার মনে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আমি আরোহীর বাবাকে একটু একটু করে শেষ করে দিব। আহনাফের সাথে ভালো সম্পর্ক তৈরি করে ফেলি। তারপরে আরোহীকে বলি আহনাফের সাথে পালিয়ে যেতে, তাহলে আজাদ ভাইয়ের সন্মান একটু হলে-ও নষ্ট করতে পারবো। আজাদ ভাইয়ের একটু অসন্মান আমাকে আকাশ সমান তৃপ্তি দিয়েছিল। প্রতিশোধের নেশা আমাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিচ্ছেলো। আমি এখানেই থেমে ছিলাম না। আহনাফকে বলি আহনাফ তাদের বাবা মায়ের আসল সন্তান না। এর প্রমান হিসেবে দেখাই সফিউল চৌধুরী তার বাড়ি আব্রাহামের নামে লিখে দিয়েছে। আগুন ঘি ঢালার মতো, আমার এই একটা কথাই যথেষ্ট ছিল। আহনাফ ভাবতে শুরু করল সে প্রেম করে বিয়ে করেছে। তাকে কেউ মেনে নিল না। তার প্রাপ্য সম্পত্তি তার থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হলো। তারপরে শুরু আহনাফের কালো পথে আসা। আমি আর আহনাফ মিলে অবৈধ ব্যবসা শুরু করি। আমাদের দিন বেশ ভালোই চলছিল। আহনাফ বস্তিতে আকাশ সেজে থাকতো। আবরার সব সত্যিটা জেনে যায়। আবরারকে ভয় দেখানো হয়। সে যদি সত্যিটা সবাইকে সবকিছু বলে দেয়। তাহলে রজনীকে মে*রে* ফেলা হবে। প্রেয়সীকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে দমে যায় আবরার। এর মাঝে সফিউল চৌধুরী ছেলের ভালো অবস্থা দেখে গোলে যায়। ছেলের সাথে সবার আড়ালে সম্পর্ক তৈরি করে। বাবা ছেলে মিলে, আয়াতকে কি*ড*ন্যা*প* করে, আরোহীকে আব্রাহামের কাছে পাঠায়। কিন্তু আব্রাহাম খুব চালাক। সে আগে থেকেই সব তথ্য সংগ্রহ করছিল। সে যে আগে থেকেই জানতো আরোহী তার কাছে আসবে। আয়াতকে বস্তিতে লুকিয়ে রাখা হয়। আব্রাহাম আহনাফকে গু*লি* করে, আমি এই সুযোগটা হাত ছাড়া করতে চাইনি। আমি বস্তিতে চলে যাই আয়াতকে নিয়ে আসতে। কিন্তু সেখানে গিয়ে হতাশ হই। আব্রাহাম আয়াতকে নিয়ে চলে আসে। আমি বস্তির বুড়িটাকেও খু*ন* করে আসি। যেনো আমার বিরুদ্ধে কেউ কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে না পারে। বুড়িটাকে টাকা লোভ দেখিয়েছিলাম। আয়াতকে আমার হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল। কথা গুলো বলে থামলো।

–এত অল্পতে থামলে চলবে, আমাকে মাঝরাতে কোথায় নিয়ে গিয়ে ছিলেন। আয়াতের বাবাকে কিভাবে বিয়তে রাজি করালেন। আমাকে আহনাফ ভাইয়ের খোঁজ দিবেন বলে, সবার চোখে কিভাবে আমাকে খারাপ বানিয়েছেন। সেটাও বলবেন নাকি আবার মা*র* শুরু করবো।আব্রাহামের কথায় আয়াতের চাচা আবার বলতে শুরু করল।

–আমি আব্রাহামকে আমার গোপন রুমে নিয়ে যাই। তাকে আয়াতকে ঠকাতে বলি। যার বিনিময়ে সে পাবে তার আহনাফ ভাইকে। আমি জানতাম সফিউল চৌধুরী আহনাফের পালিয়ে যাওয়ার কারনে আব্রাহামকে দোষারোপ করে। আমি সুযোগ বুঝে দুর্বল জায়গায় আঘাত করি। আব্রাহাম আমার জালে পা দিয়ে দেয়। আমি আয়াতের বাবাকে সাতপাঁচ বুঝিয়ে বিয়ের জন্য রাজি করাই। আয়াতের বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসে। আমার সব কথা মেনে চলে। আমার কথা রাখতে, আর মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। বিয়ের দিন আমি আর আহনাফ আব্রাহামকে তুলে নিয়ে যাই। ভেবেছিলাম সবাই আব্রাহামকে ঘৃণা করবে। কিন্তু আব্রাহাম এতিম বলে, সবাইকে মাফ করে দিল। তখন থেকেই আব্রাহাম আর সফিউল চৌধুরীকে মা*র*তে* চাইতাম। কিন্তু বরাবরের মতোই ব্যর্থ হতাম।

–তোমরা সবাই ব্যর্থ হয়েছো। কিন্তু আমি আব্রাহাম ব্যর্থ হয় নাই। আর কারো জন্য মায়া লাগে না। এবার সবাই নিজেদের কর্মের ফল পাবার জন্য প্রস্তুত হও। কথা গুলো বলেই কাউকে ইশারা দিয়ে ডাকলো। আহনাফ নিজের করা ভুল গুলো কথা ভেবে আফসোস করতে লাগলো। সে এমন সময় এসে নিজরে ভুলগুলো উপলব্ধি করতে পারলো। তার ভুলগুলো শুধরে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পুলিশ এসে, সফিউল চৌধুরী, আহনাফ, আরোহী, আর আয়াতের চাচাকে নিয়ে চলে গেল। তারা হাজার মাফ চাইলেও তাদের জন্য কারো মনে এতটুকুও মায়া তৈরি হলো না। আব্রাহামের আবরারকে নিয়ে কোনো অভিযোগ নেই। তাই আবরারের কোনো ক্ষতি সে করল না। আবরার যেভাবে তার ক্ষতি করেছিল। ঠিক সেই ভাবেই আয়াতের বাবাকে বুঝিয়ে তার উপকার করেছিল। আব্রাহাম কারো ঋন রাখে না। হয়তো শোধ করে দিল। পুরো বাড়ি নীরবতাময় হয়ে উঠলো। আব্রাহামের খালা আব্রাহামের হাত ধরে অনেক কেঁদেছে। তবুও আব্রাহাম তাদের বাসায় থাকে নাই। সুখের সন্ধানে প্রেয়সীকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ি থেকে বেড়িয়ে আসলো।

সময় স্রোতের ন্যায় তাল মিলিয়ে চলে যায়। এর মাঝে কেটে গিয়েছে ছয়টি বছর। আজকে আব্রাহাম আর আয়াতের বিবাহ বার্ষিকী। আয়াত বার বার করে বলেছিল। আজ যেনো আব্রাহাম হসপিটালে না যায়। তবুও আব্রাহাম চলে গিয়েছে। সময় বদলে গেলে-ও আয়াতের অভিমান করাটা এখনো বদলায়নি। আয়াত মন মরা হয়ে বসেছিল। তখনই আয়াতের চার বছর বয়সী মেয়েটা এসে, আয়াতে কোলে বসে বলল।

–আম্মু তুমি মন খারাপ করছো কেনো?

–তোমার আব্বু অনেক পঁচা তাই। আমাদের একটুও ভালোবাসে না। দেখলে আমাদের কথা না, ভেবে আমাদের রেখে হসপিটালে চলে গেল।

–আমি আব্বুকে ফোন করে বলে দিব। তুমি আব্বুকে পঁচা বলেছো।

–এই তোকে আমি সারাদিন দেখে শুনে রাখি। খাইয়ে দেই। ঘুরতে নিয়ে যাই। আর তুই সারাদিন আব্বু আব্বু করিস কেনো?

–দেখতে হবে না মেয়েটা কার? আমার মেয়ে অবশ্যই আমার দলে থাকবে। আমার নামে বাজে কথা বলে, মেয়ের কান ভারী করা হচ্ছে। আব্রাহামের কথায় দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করল আয়াত। আয়াতকে রেগে যেতে দেখে, আব্রাহাম হাসতে লাগলো। আব্রাহামকে হাসতে দেখে পরীও হেসে দিল। আব্রাহাম ভালোবেসে মেয়ের নাম রেখেছে পরী।বাবা-মেয়েকে হাসতে দেখে আয়াতও হেসে ফেললো।

(সমাপ্ত)