#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩২
#আরশিয়া_জান্নাত
সাজেদা মুখ ভার করে শোয়ার ঘরে বসে আছেন। মনমেজাজ বিশেষ কারণে চটে আছে। ছেলে এতো বছর পর দেশে ফিরে মামার বাড়ি আসার আবদার করেছে তখনই তার খটকা লেগেছিল। রুমির প্রতি ফাহিমের আকর্ষণ আছে এটা অনেক আগের ঘটনা। তবে তখন অল্প বয়সের আবেগ ভেবে বিশেষ পাত্তা দেননি তিনি। কিন্তু এবার ছেলে জেদ ধরেছে রুমিকেই বিয়ে করবে। আপন ভাইয়ের মেয়েকে ছেলের বৌ করতে কোনো মায়েরই অমত থাকেনা। কিন্তু সাজেদা বেগম এই বিয়েতে একদমই আগ্রহী নন। না তিনি সলিড কোনো জবাব দিতে পারছেন ফাহিমকে। এই বিষয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা হয়নি তাই মা-ছেলের এই নিরব সংঘাত সম্পর্কে কেউই অবগত নয়।
রুমি এসে বললো, ফুফু ভাবি আসছে। বসার ঘরে আসেন।
সাজেদা পান চিবুতে চিবুতে বসার ঘরে এগোলেন।
তৃণা সালাম দিয়ে কদমবুসি করলো।
আল্লাহ সুখী করুন।
কেমন আছেন?
ভালো আছি। তুমি ভালো তো?
জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।
রুমানা কোথায় পেলি এই হীরার খোঁজ? মাশাআল্লাহ দেখতে তো চমৎকার।
তারপর হাতের ছোট ব্যাগ থেকে সোনার চেইন বের করে তৃণার গলায় পড়িয়ে বললেন, আমার ভাইয়ের সাত রাজার ধন ফুয়াদ। তার ঘরণী তুমি। যত্নে রেখো সংসারটাকে।
দোআ করবেন ফুফু।
তৃণা বাবা-মাও সঙ্গে এসেছিলেন, বড়রা সবাই আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে যেতেই রুমি তৃণাকে ইরহামের ঘরে নিয়ে গেল।
ভাবি তুমি তো এই প্রথম এ বাড়িতে এলে তাই না! এই হলো তোমাদের ঘর। দেখো তো পছন্দ হয় কি না?
তৃণা চারদিকে তাকালো, মাঝারি একটা ঘর। জানালার পাশে খাট, একটা কাঠের আলমারি, বইখাতায় ঠাসা একটা বুকশেলফ, চেয়ার টেবিল আর একটা ড্রেসিংটেবিল। সবচেয়ে সুন্দর হলো দখিনের খোলা বারান্দা।
তৃণা বারান্দায় রেলিং এ ঠেস দিয়ে বললো, এটা দারুণ!
আর তো কয়টা দিন, তারপর তুমি আমাদের এখানে চলে আসবে। অনেক মজা হবে। তবে ভাইয়া বলেছে ঢাকায় বাসা নিবে। আম্মার অবশ্য ওখানে যাওয়ার মত নাই। এখানে এতোবড় বাড়ি ফেলে ঢাকা যাবে কেন। তোমাদের একাই সেখানে উঠতে হবে হয়তো।
বড় আপুরা আসবেন না?
নাহ, বাচ্চাদের পরীক্ষা চলছে তো। তাই আপু আসতে পারছেনা। ফুফু তো আছে কয়দিন সুযোগ করে দেখা করবেন। জানো ভাবি মেজ ফুফু কতবছর পর এসেছেন?
কত বছর?
১৫বছর!
কি বলো? এতো বছর আসেনাই কেন?
সেটা জানিনা, আব্বা মারা গেলেন যখন তখনো আসেননি। আপার বিয়েতে শেষ এসেছিলেন। এরপর এবার এলেন। অবশ্য ফাহিম ভাই সুযোগ পেলেই আসতো
ওহ! হয়তো সাংসারিক সীমাবদ্ধতায় আসার সুযোগ পান না।
হতে পারে।
ইরহাম এসে বললো, রুমি তোকে আম্মা ডাকে।
রুমি চলে যেতেই ইরহাম বললো, যাক বাবা এই ঘরের কর্তী অবশেষে এই ঘরে পা রাখলেন!
তৃণা বিছানায় আয়েশ করে বসে বললো, আমিতো অনেকদিন ধরেই আসতে চাইছি, কর্তার ভিন্ন মত থাকলে কি করার!
ইশ খোঁটা দেওয়ার সুযোগটা মিস করতে মন চায় না?
সুযোগ বারবার আসেনা। তাই সুযোগকে কাজে লাগাতে হয়।
ইরহাম ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে বললো, হুম সেটা ঠিক।
তৃণা তার চুলে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, টায়ার্ড লাগছে তাই না?
না ঠিক আছে। এত আদর করে বিলি কেটোনা। আরামে ঘুম চলে আসছে!
তো ঘুমান না। নিষেধাজ্ঞা আছে নাকি?
একটু পর তো চলে যাবা। এখন ঘুমিয়ে কাটালে হবে?
আপনি বললে থেকে যাই?
নাহ। সারা পাড়া খবর করে বরণ করতে চাই। এরকম অনাড়ম্বর হলে তো হবেনা।
যতসব ঢং আপনার।
ইরহাম উঠে তৃণা দু’গালে হাত রাখলো। হেসে বলল, এই সপ্তাহে জাপান যাচ্ছি। এসেই তোমাকে নিয়ে আসবো ইনশাআল্লাহ।
।
আপা ডেকেছিলেন?
হুম। বসো একটু কথা আছে।
কি আপা?
রুমির বিয়ের ব্যাপারে কিছু ভাবতেছ না?
ও পড়তেছে তো তাই এখনো কিছু ভাবছি না।
সাজেদা একটু রয়েসয়ে বললেন, মায়ের মতো কেলেঙ্কারি বাঁধানোর আগে বিয়ে দিতেছ না ক্যান? নাকি আশায় আছ কখন পেট বাধাই আসবে আর তুমি সবার থেকে লুকাইয়া আশ্রয় দিবা?
রুমানা বিস্ফোরিত চোখে সাজেদার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপা কি বলেন এসব!
সাজেদা সিলিমসিতে পান ফেলে বললেন, সত্যি কখনো বদলায় না রুমানা। সত্যি সত্যিই থাকে। নষ্টা মায়ের মেয়েকে যতোই ভালো করে বড় করোনা কেন খাসিলত বদলাবেনা। কথায় আছেনা কয়লা ধুলে ময়লা যায় না। আমার ভাই মরছে আল্লাহ বেহেশত নসীব করুন। ওর মনে দয়ামায়া বেশি ছিল বলেই এমন মেয়েকে নিজের সন্তানের মতো আপন করে নিছে। অন্য বেডা হলে এমন করা তো দূর এই কাজের জন্য তোমারেও ঘরে রাখতো না। আবিয়াত্তা পোয়াতি বান্ধবীরে এই ঘরে আশ্রয় দিছো, সবাইরে কইছো তোমার আত্মীয় লাগে। সেতি তো বাচ্চা পয়দা দিয়াই মরলো। মাঝখানে তোমাগো কান্ধে জারজ সন্তানের ভার পড়লো! আমি বলি এর পিছে এতো খরচার দরকার কি? কোনোরকম মেট্রিক পাশ করাই বিয়ে দিয়ে দিলেই ঢের হইতো। আমার ভাইয়ের আলগা পিরিতি, আপন বোইনের লগে এতো বড় ঝগড়া করলো। তবুও এই মাইয়ারে বিদায় করলো না। আমি আমার ভাইয়েরে শেষ দেখাও দেখতে পারিনাই….
বলেই চোখের পানি মুছলেন।
রুমানা দৃঢ় গলায় বললেন, আপা আপনার ভাবনা এতো বছরেও বদলায় নাই। রুমি জারজ সন্তান না ওর বাবা-মা ধর্ম মেনে…..
হইছে আর সাফাই দিও না। যদি ধর্মমতেই বিয়েই করতো ওরে এমন চোরের মতো দূরে আইসা বান্ধবীর ঘরে থাইকা বাচ্চা দেওন লাগতো না। না তারে তোমাগোর মানুষ করা লাগতো। ওর আত্মীয় স্বজন সব কি মইরা গেছিল? ওর জামাই ই বা ক্যান আইলোনা মাইয়ারে নিতে? আমারে দুনিয়াদারি শিখাইতে আইসো না ভাই, বাতাসে চুল পাকেনাই আমার।
যাই হোক কাজের কথায় আসি, আমার ছেলের ভীমরতি উঠছে। ও চায় রুমিকে বিয়ে করতে। ওর সামনে আমি বিয়ের ব্যাপারে কথা তুলবো। তোমরা কোনোভাবেই মত দিবা না। আমার ছেলেরে কোনোভাবেই বুঝানো যাইতেছে না। আমার মরা ভাইয়ের দিকে চাইয়া কথাটা গোপন রাখছি। যদি চাও আমি মুখ বন্ধ রাখি তাহলে যা বলছি করো। আর দ্রুত এই অভিশাপটা পরের ঘরে পার করো,,
রুমানা আর বসলো না। তার শরীরটা কেমন টলছে যেন। প্রিয় বান্ধবীর সম্পর্কে এমন জঘন্য কথাবার্তা সহ্য করার ধৈর্য তার আর অবশিষ্ট নেই। মাস্টারসাহেবকে এই মুহূর্তে ভীষণ মনে পড়ছে। তিনি যতদিন বেঁচে ছিলেন এই তিক্ত সত্য থেকে রুমিকে আগলে রেখেছেন, তাকেও কোনোদিন বাজে কথার সম্মুখীন হতে দেননি। আজ সে নেই, কার বুকে আশ্রয় নিবে;কান্না করে মনটা শান্ত করবে রুমানা?
।
প্লেটে ভাত দিয়ে মুরগির লেগপিস তুলে দিলো পলি বেগম। আমজাদ সাহেব তরকারি মাখিয়ে বেশ আয়েশ করে এক লোকমা গালে তুলে কাঁচা মরিচে কামড় দিলেন। পলি বেগম বললো, ভালো হয়েছে?
তোমার রান্না খারাপ হয় কবে? ভাগ্যগুণে একটা রাধুনী বৌ পাইছি।
পলি বেগম খুশিমনে আরেকটু তরকারি দিলেন। আমজাদ সাহেবও পেটভরে ভাত খেলেন। খাওয়ার পর তিনি সচরাচর চা খান না। তবে আজ বোধহয় মন ভালো। তাই তিনি চায়ের আবদার রাখলেন। পলি দ্রুত চা করে আনলেন। স্বামীর মন ভালো আছে আভাস পেতেই মনে মনে ঠিক করলেন রিপার ব্যাপারটা একটু তুলে দেখবেন। চায়ের কাপে কয়েক চুমুক দিয়ে তিনি বললেন, কি ব্যাপার পেটের মধ্যে কি গুড়গুড় করতেছে তোমার? আমি এইখান থেইকা স্পষ্ট আওয়াজ পাইতেছি।
পলি বেগম হাত কচলাতে কচলাতে বললেন, বলছিলাম কি রিপার তো ৮মাস চলে। ওর প্রথম সন্তান হবে। মেয়েটা আপনারে দেখতে চায়। খালি আপনার কথা বলে। আমি বলি কি যা হবার তা তো হয়ে গেছে। নিজের সন্তান কে কি ফেলে দেওয়া যায়? এই সময়টা মেয়েদের কত কঠিন, হায়াৎমউতের কথা বলা যায়? আল্লাহ ভালোয় ভালোয় উদ্ধার করলে শান্তি।
চলেন না একবার যাই দেখে আসি কি হালে আছে?
আমজাদ সাহেব চুপচাপ চা শেষ করলেন। হ্যাঁ না কিছু বললেন না। পলি বেগম হতাশ হয়ে রান্নাঘরে গেলেন।
ফাহিমকে মানা করার পর পরিস্থিতি অনেকটাই গোলমেলে হয়ে যায়। ও কিছুতেই এই প্রত্যাখ্যান মানতে পারেনি। মায়ের সঙ্গে রাগারাগি করে শেষে কোথায় যেন চলে গেছে কেউ জানেনা। এদিকে সাজেদা বেগম যাওয়ার আগে বলে গেছেন ও তান্ডব চালানোর আগেই যেন রুমির বিয়ের ব্যবস্থা করা হয়। নয়তো পরিণাম ভালো হবেনা। রুমানা অনেক অসহায় বোধ করলো। তিনি বুঝে উঠতে পারছেন না এতো অল্প সময়ে তিনি কি করবেন, কাকে বকলবেন এই সমস্যার কথা। এই সত্যিটা প্রকাশ হলে রুমিকে আর কেউই আপন করে নিবেনা। ইরহাম ও দেশে নাই, কি থেকে কি করবেন কিছুই মাথায় আসছেনা তার।
রুমি আদা চা নিয়ে মায়ের ঘরে ঢুকলো, রুমানা বেগম কপালে হাত দিয়ে শুয়ে ছিলেন। তাকে দেখে বললেন, চা এনেছিস?
হুম মা। নাও গরম গরম চা টা খাও ভালো লাগবে।
রুমানা বেগম স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। রুমি দেখতে ঠিক তার মা প্রিয়ার মতো হয়েছে। চঞ্চল প্রকৃতির হাসিখুশি মেয়ে। রংটা একটু চাপা হলেও মায়াময় চেহারা। প্রিয়া অবশ্য রূপবতী ছিল। রূপবতীদের ভাগ্য সবসময় ভালো হয় না তার জলন্ত প্রমাণ হয়তো সে।
রুমি মায়ের পায়ের কাছে বসে বললো, মা অযথা চিন্তা করছো কেন? যা হবার তা হবেই। ভাগ্যকে কেউ কোনোদিন বদলাতে পারেনা।
হঠাৎ এই কথা বললি কেন?
তুমি ফাহিম ভাইদের নিয়ে চিন্তা করছো তাই না?
উনাদের সাথে এমনিতেই আমাদের সম্পর্ক বিশেষ ভালোনা। তার উপর তুমি বিয়েতে অমত দিলে। সবমিলিয়ে চিন্তায় আছ বোঝাই যাচ্ছে।
তোর কি ফাহিমকে পছন্দ ছিল?
ভাই হিসেবে অপছন্দ নয়, তবে জীবনসঙ্গী করতে চাইনা।
কেন? খারাপ কি? এডুকেটেড ছেলে,বিদেশে সেটেলড। যে কোনো মেয়ের জন্যই পারফেক্ট সম্বন্ধ বলা চলে। জীবনসঙ্গী করতে আপত্তি কিসের?
রুমি হেসে বললো, মা এতোই যখন পারফেক্ট মনে করো তবে মানা করলে কেন?
আমি মানা করার পেছনে আলাদা কারণ আছে। তাই তোরটা জানতে চাইছি।
যদি বলি তুমি যে কারণে মানা করলে আমিও একই কারণে অমত করছি?
রুমানা চমকে তাকালেন মেয়ের দিকে। তবে কি রুমি সবটা জেনে গেছে? ঐ রিপোর্টটা দেখেছিল? নাকি তাদের কথোপকথন শুনেছে কোনোভাবে?
রুমি বললো, মা তুমি ভেবোনা আমি তোমার মতের বাইরে কিছু করবো। তুমি যা বলবে তাই হবে। ফাহিম ভাই কেন পৃথিবীর কোনো ছেলেই তোমার অমতে তোমার মেয়েকে বিয়ে করতে পারবেনা। তুমি এসব চিন্তা ছাড়ো তো।
রুমানা বেগম স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।
চলবে,,,
#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৩
#আরশিয়া_জান্নাত
আচ্ছা ওয়াসি আমি যদি বাবু হবার সময় মরেটরে যাই তুমি কি আবার বিয়ে করবে?
ওয়াসি ফাইলপত্র রেখে রিপার দিকে তাকালো। আজকাল মেয়েটা বড্ড নরম ধাঁচের হয়ে গেছে। সারাক্ষণ উদ্ভট চিন্তায় থাকে। তার ভয় হচ্ছে এটা কথাবার্তায় বোঝা যায়। ওয়াসি ওঠে এসে রিপাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরলো। নরমস্বরে বললো, আমি জানি তুমি খুব কঠিন একটা সময় পার করছো। তবে চিন্তা করোনা আমাদের হাতে যখন ছোট্ট রাজকুমারীটা আসবে তখন সব কষ্ট নিমিষেই ভ্যানিশড হয়ে যাবে। মনোবল রাখো সোনা!
তুমি কথাটার জবাব দিলেনা,,
আমি ঐসব নেগেটিভ চিন্তা মাথায়ই আনতে চাইনা, জবাব দিবো কি?
তার মানে বিয়ে করবে?
সেটা কখন বললাম?
জবাব না দেওয়া মানেই সম্মতি। তোমার তো ভালোই হবে নতুন বউ পাবা। আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি না?
এই তুমি কি পন্য যে নতুন পুরাতন হবে! মানুষ কখনো পুরনো হয়না। সময়ের সাথে সে আপন অথবা পর হয়। আর তুমি তো আমার জানপাখি!
তোমরা ছেলেরা মুখেই এমন বলো। বউ মরতে দেরি, ৪০দিনও পার করোনা এর আগেই বিয়ের জন্য পাত্রী দেখা শুরু।
বলছে তোমারে?
বলছেই তো। কত দেখছি এমন।
ভুল দেখছো। সবচেয়ে খারাপ পুরুষটাও এতো দ্রুত বিয়ে করবেনা। নিম্নে ৩/৪ মাস চুপ থাকবে।
ওহ তার মানে তুমি ৩/৪মাস কষ্ট করে থাকবে তারপর বিয়ে করবে?
আরেহ বাবা আমি কখন এটা বললাম?
কথার অর্থ তো এটাই দাড়াচ্ছে!
রিপা তুমি অযথাই আমাকে ভুল বুঝছো। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভালোবাসা কি এতো সস্তা?একটা বিড়ালের বাচ্চাকে কয়টা দিন আদর করে পাললে যেখানে মায়া পড়ে যায়। সহজে অন্য বিড়ালছানা আনতে মন সায় দেয়না। সেখানে তুমি আমার কত বছরের ভালোবাসার মানুষ। আমি তোমাকে এতো দ্রুত ভুলবো ভাবলে কিভাবে?
ঐসব জানি না। আমি আগে থেকে বলে দিচ্ছি যদি বিয়ে করো আমি ভূত হয়ে এসে ঘাড় মটকে দিবো। আর শোনো আমার বাবুকে এখানেই রাখবে। আম্মুর চেয়ে ভালো করে ওকে কেউ বড় করতে পারবেনা। আমি জানি উনি ওকে অনেক আদর করবে,,,,
রিপা! এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে। কিচ্ছু হবেনা তোমার। এসব আজেবাজে চিন্তা ঝেড়ে ফেলো তো। আল্লাহ তোমায় সহীহ সালামতেই রাখবেন ইনশাআল্লাহ।
রিপা ওয়াসির বুকে মাথা রেখেই কাঁদতে লাগলো। ওর আজকাল এতো কান্না পায় কেন? কেন ইচ্ছে করে আপনজনদের ঘিরে থাকতে, কোথাও না যেতে। আচ্ছা বাবা-মা কে কি এই জীবনে আর দেখা হবেনা? ওদের না দেখেই বিদায় নিতে হবে?
আম্মু আমি বলি কি রিপার সি-সেকশন করে ফেলি?
কি বলোস তুই? ডেট আসবার আগেই এসব কি কথা?
আমার ভালো লাগছেনা আম্মু। ও সারাক্ষণ কিসব বলে। তার চেয়ে ভালো হয়না সিজার করে বাচ্চা নিয়ে ফেলি। এতে মা সন্তান দুজনেই ভালো থাকবে।
দেখ বাবা আমি বুঝতে পারছি তোদের দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কিন্তু পারতে সিজার করানো ঠিক না। এটা শরীরের অনেক ক্ষতি করে। আজীবন ওকে পেইন হতে হবে।
সবাই ই তো এটা করাচ্ছে। ওরা তো দিব্যি চলছে। তুমি পুরনো ভাবনায় আছ।
তুই গিয়ে দেখছোস ওরা দিব্যি ভালো আছে? যা গিয়ে খবর নে।
রেগে যাচ্ছ কেন? আমি কি করবো বলো না? ও যা বলে যা করে আমার সত্যিই ভয় লাগে। ওর কিছু হলে আমি কি করবো আম্মু?
কিচ্ছু হবেনা। আল্লাহ ভরসা।
তুমি বুঝতেছ না আম্মু, নরমেল ডেলিভারিতে মানুষ মরে যায়। আমি বলি কি….
তোর মাথা গেছে, এখন আমারটাও যাওয়ার ব্যবস্থা করিস না। ওর কন্ডিশন বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি ডাক্তার বলে সি সেকশন লাগবে, করাবো। তবে আমি চাই নরমেলেই আসুক। এতে কষ্ট হলেও পরবর্তীতে সমস্যা হয়না। বেশি বেশি নামায পড় আল্লাহর কাছে দোয়া কর। সব ঠিক হয়ে যাবে।
ওয়াসির মুখ দেখেই বোঝা গেল ও বিশেষ সন্তুষ্ট হয়নি। বিষয়টা নিয়ে আরো কিছুদিন ঘাটবে,,,
তাহমিনা দু’হাত তুলে বলল, আল্লাহ এই পাগল দুটোকে একটু বল দাও। বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে ওদের কোল আলো করে দাও। ওরা যেন সুখে থাকে।
।
বাসায় অপরিচিত অনেকগুলো মানুষকে দেখে ময়নার মা একটু ঘাবড়েই গেলেন। কৌতুহলী কন্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা কে? কাকে চান?
তাদের মধ্যে একজন বলল, এটা কি ফয়েজ মাস্টারের বাড়ি না?
জ্বি।
উনার স্ত্রী সন্তানেরা কোথায়? ডাক দাও।
ময়নার মা ভেতরে গিয়ে রুমানাকে ডাকলো। রুমানা হাতের কাজ বাদ রেখে বাইরে এসে দাঁড়ালো। একজন মহিলা এগিয়ে এসে বললেন, আস্সালামু আলাইকুম আপা। আমরা আপনার ছোট মেয়ে রুমিকে দেখতে এসেছি। যদি আপত্তি না করেন আমরা কি কথাবার্তা বলতে পারি?
রুমানা বেগম বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এনারা খুব ধনী পরিবারের মানুষ। হঠাৎ এমন সম্বন্ধ আসলো কিভাবে?
রুমানা সবাইকে বসার ঘরে বসতে দিয়ে চা নাস্তার আয়োজন করলেন। তারা সঙ্গে করে অনেক ফলমিষ্টি এনেছে বলা বাহুল্য। রুমানা বেগম দ্রুত তার বড় জামাইকে কল করলেন, তৃণার বাবাকেও খবর দিলেন। ময়নাকে দিয়ে ইরহামের ছোট চাচা ও পাশের বাড়ির ভাইকেও খবর পাঠালেন।
রুমির ঘরে গিয়ে বললেন, রুমি চটজলদি একটা শাড়ি পড়ে নে তো মা। কিছু মেহমান এসেছে।
রুমি বলল, হঠাৎ মেহমান? কে উনারা?
চিনি না, বললো তোকে দেখতে এসেছে।
রুমি হাই তুলে বলল, আম্মা তুমিও না কেমন! অচেনা একদল মানুষ এসে বলল আর তুমিও তাদের বসতে দিয়ে দিলে? যদি ওরা ডাকাতদল হয়? বা ছদ্মবেশী? ধরো দিনে এসে দেখে গেল রাতে হামলা করলো?
কি অলুক্ষণে কথা এসব? তাদের দেখে ভদ্রলোক ই মনে হচ্ছে।
বাইরে থেকে দেখে কি মানুষ চেনা যায়? দেখা গেল ভদ্রলোক সেজেই এসেছে। দিনকাল ভালো না বুঝলে। ওদের আনা কোনোকিছু মুখে তুলবা না, শুকেও দেখবা না বলে দিচ্ছি।
রুমানা বেগম এবার একটু দমে গেলেন। আসলেই তো চেনে না জানেনা হুট করে কারো সামনে মেয়েকে পাঠানো তো ঠিক হবেনা।
আচ্ছা তুই তাহলে ঘরেই থাক, আমি সবাইকে খবর পাঠিয়েছি উনারা আসুক তারপর যা হবার হবে।
রুমি বেলকনী থেকে রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললো, বাপরে খরচা দেখি কম করেনি, তিন তিনটা কার করে এলো! এরা আসলেই ধনী পরিবারের লোকজন নাকি সব লোক ভুলানোর কারসাজি?
এক ঘন্টার মধ্যেই সবাই উপস্থিত হলেন। কথাবার্তা বলে তাদের পরিচয়ও জানতে পারলেন। ওয়াজেদ সাহেব বললেন, আপা চিন্তার কারণ নেই উনারা এখানকার বহু পুরোনো মানুষ। বেশ নামডাক আছে তাদের। ছেলেরা ২ ভাই ৩বোন। বোনদের বিয়ে হয়ে গেছে, ভাইবোনদের মধ্যে ছেলে ৩য় জন।
ছোট চাচা বললেন, ছেলে কি করে? বংশমর্যাদা কেমন?
বংশমর্যাদা ভালোই। ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। ছুটিতে আসছে, রুমিকে কলেজ যেতে দেখছে পছন্দ হইছে। তাই সরাসরি পরিবারসমেত বিয়ের আলাপ নিয়ে আসছে। এরকমই তো বলছেন উনারা। ভাইবোন সব সরাসরি ঢাকা থেকে আসছে,,,
ওহ আচ্ছা, এ দেখি এলাহি কান্ড! রুমির তো ভাগ্য খুলে গেছে। তা ভাবী কি কন আপনে?
জামাই কি বলো?
আম্মা রুমিকে বলেন উনাদের সামনে আসতে। দেখুক কথা বলুক। ভালো লাগলে কথা আগাবে নয়তো নাই। দেখতে তো অসুবিধা নাই। উনারা যখন এতো আগ্রহ করে আসছে দেখুক। আল্লাহ চাইলে এখানেই হয়তো ওর নিয়তি লেখা!
মাইশা ততক্ষণে উঠে গিয়ে রুমিকে শাড়ি পড়তে জোরাজোরি শুরু করলো। রুমি বললো, শাড়ি পড়তে পারবোনা আপা। আমি শাড়ি পড়ে হাঁটতে পারিনা। পরে কুচি প্যাঁচিয়ে পড়লে ইজ্জত থাকবেনা। তারচেয়ে বরং সালোয়ার কামিজেই যাই?
তাই বলে ছেলেপক্ষের সামনে শাড়ি ছাড়া যাবি! এটা কেমন অভদ্রতা রুমি?
আপা তুই কি চাস আমি ঘরভর্তি লোকের সামনে পড়ে যাই? তখন ব্যাপারটা আরো জঘন্য হবেনা? পুরো পাড়ায় কথাটা ছড়ালে মানসম্মান আর থাকবে? সবাই দলে দলে এসে বলবে, কিলো রুমি তুই বলে পাত্রপক্ষের সামনে শাড়ি পইড়া ধেইধেই কইরা গিয়া ধুমসে চ্যাগাইয়া পড়ছোস! না না না এটা আমি সহ্য করতে পারবোনা।
ওর ভাবভঙ্গি দেখে মাইশার ছেলেমেয়ে হোহো করে হেসে দিলো।
অগত্যা রুমির যুক্তিতর্কে মাইশা বাধ্য হয়ে রাজী হলো।
কাজ করানো জর্জেট সালোয়ার কামিজ পড়েই পাত্রপক্ষের সামনে গেল রুমি।
ছেলের দিকে আড়চোখে তাকাতেই রুমির তাকে চিনতে অসুবিধা হলোনা।
দু’পক্ষের আলাপচারিতা শেষে উনারা রুমিকে আংটি পড়িয়ে গেলেন।বিয়ের তারিখ ঠিক করা হবে ইরহাম আসার পর এমনটাই কথাবার্তা হলো।
রুমানা বেগমের বুকের উপর থেকে যেন একটা পাথর সরলো। এখন শুধু আল্লাহ আল্লাহ করে ভালোয় ভালোয় বিয়েটা হলে শান্তি। ফাহিম বা তার মায়ের উৎপাত শুরু হবার আগেই সব ঠিকঠাক হয়ে যাক।
।
আকাশে গাঢ় কালো মেঘ ধরেছে। শীঘ্রই ঝুম বৃষ্টি হবে বোধহয়। ঝড়ো হাওয়ায় সবকিছু লন্ডভন্ড হবার উপক্রম। তৃণা দ্রুত দরজা জানালা আটকাচ্ছে। ছাদের কাপড়গুলোও আনতে হবে। সে চেঁচিয়ে বললো মা তুমি ভাবির ঘরে যাও, আমি কাপড় আনছি।
তৃণা ছাদে গিয়ে কাপড় নিতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। দ্রুত কাপড় নিয়ে আধভেজা হয়ে সিড়িঘরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো ঝুম বৃষ্টি। আজ এই বৃষ্টিটা দেখে মন ভালো হচ্ছেনা বরং ভীষণ মন খারাপ লাগছে। ঝকঝকে রোদ্দুরের আকাশটা হুট করে কালো মেঘে ঢেকে ভারি বর্ষণ করছে কেন? কি এতো কষ্ট তার যার বোঝা আর বইতে পারছেনা?
ছাদ থেকে কাপড় এনে ঘরে মেলে দিয়ে বসতেই তার ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে চেনা নাম্বার দেখে বুঝল জনাব ল্যান্ডিং করেছে। হাসিমুখে কল রিসিভ করতেই কানে এলো অচেনা কন্ঠস্বর।
হ্যালো এটা কি ইরহাম সাহেবের বাড়ির কারো নাম্বার?
জ্বি আমি উনার ওয়াইফ। আপনি কে? ইরহাম কোথায়? তার ফোন আপনার কাছে কেন?
দেখুন আপনি আমাকে চিনবেন না। কললিস্টে আপনার নাম্বার আগে থাকায় কল করেছি। ইরহাম সাহেবের গুরুতর এক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনারা দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল চলে আসুন।
তাজু কে কল করেছে? তুই এমন কাঁপছিস কেন? কতবার বলি বৃষ্টির পানি গায়ে লাগতে দিস না। লাগলো তো ঠান্ডা। উফ,,
তাজু এই তাজু কি হয়েছে মা?
মায়ের স্পর্শ পেতেই তৃণা কেঁদে উঠলো অস্পষ্ট গলায় বলল, মা, উনি উনি এক্সিডেন্ট….. কথাটা শেষ করবার আগেই সে মায়ের হাতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
চলবে,,,