সে আমার শরৎফুল পর্ব-৩৫+৩৬

0
203

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৫

#আরশিয়া_জান্নাত

রিপার বাবা আমজাদ সাহেব তার বোনের বাসায় বসে আছেন। তার ভাগিনা শাকিল বলল, মামা আপনি এখন কি ঠিক করেছেন? রিপার শ্বশুড়বাড়ি যাবেন?

আমজাদ সাহেব চায়ে ছোট চুমুক দিয়ে বললো,এই মাসে ওর ডেট দিয়েছে, তোর মামীও কান্নাকাটি করে। একবার গিয়ে দেখে আসা উচিত না?

উচিত অনুচিতে পরে । আগে ভেবে দেখেন উনারা আসছে আর আমরা যে অপমান করছি এখন আমরা গেলে ছেড়ে দিবে ভাবছেন?

সেই জন্যই যেতে চাইছিলাম না। কিন্তু তোর মামী….

শাকিলের মা হাফসা বললো, তুই চুপ থাক। তোর যতো এডভান্স কথা। উনারা যদি মানুষ খারাপ হতো এতোদিনে অনেক কথাই শুনতে পারতি। পরের সংসার করা এতো সহজ না। আর রিপাও ধৈর্যশীল মেয়ে না। ও ঠিকই চলে আসতো বা খবর দিতো। আমার কথা শুনো ভাইজান। তোমরা ওদেরকে মেনে নাও। সবাই মিলে চলো ওকে দেখে আসি।

আম্মু তুমি বুঝতেছো না। ওরা খারাপ ব্যবহার করলেও কি রিপা সেটা বলার মুখ আছে? কোন মুখে বলবে, ও নিজেই তো গেছে। তাছাড়া ওনারা দেখে গেছে ও ধনী পরিবারের মেয়ে, খারাপ ব্যবহার করার সাহস আছে?

আরে ছাগল, শ্বশুড়বাড়িতে বাপের বাড়ির নাম কতোই বা থাকে? কত বড় বড় লোকের মেয়েরাও বাপের বাড়ির হেডাম দেখাতে পারেনা। আসছে আমার আম্বানির বংশ! আর শোন আমাদের না বললেও ওর মা-কে ঠিকই বলতো। তুই আর কথা বাড়াইস না দিবো এক চড়। তোর পেটে আমি হইনাই আমার পেটে তুই হইছোস। তোর চেয়ে আমি দুনিয়া বেশি জানি।

শাকিল একটু দমেই গেল। কিন্তু রিপন দমলো না। সে বললো, খালামণি তুমি সহজসরল আছো। তাই বুঝতেছ না। টাকাপয়সার জন্য মানুষ মুখোশ পড়ে থাকে। ধৈর্য ধরে ক’টা বছর গেলেই তো হলো। আগে পড়ে মামার সম্পত্তি তার সন্তানেরাই তো পাবে। এই হিসাব ওদের আছে।

সেটা ওরা ভালো ব্যবহার করলেও রিপা পাবে, না করলেও পাবে। শোন দেড় বছর কোনো মানুষ অভিনয় করতে পারেনা। আসল রূপ বেড়িয়ে আসেই,,,

হাফসার স্বামী শাহেদ বললেন, তোমরা থামো তো। যুক্তিতর্কের লড়াই বাদ দাও। ভাই আপনি কি চান সেটাই মুখ্য। অন্য সব বাদ। সন্তান যতো ভুল করুক বাপ মা তাকে ফেলতে পারেনা।রিপা আপনার মেয়ে আপনার রক্ত তার শরীরে আছে। এখন অন্যরা যাই করুক, বলুক, উদ্দেশ্যই বা যাই হোক আপনি অন্যের কথা ভাবতে গিয়ে নিজের সন্তানকে দূরে ফেলা ঠিক হবেনা। আর এটাও সত্যি সেদিন আপনারা যে ব্যবহারটা করেছেন তা ঠিক হয়নি।

শাকিল এবার তেঁতে বললো, ভুল কি বলছে? ওরা ছেলে পক্ষ হয়েও এতো মিনমিন করছিল কেন? দাপুটে কথা বলেনাই কেন? যাদেরকে লাথি মারলেও হাসে, কোনো প্রতিবাদ করেনা। তাদেরকে আমি মিচকা শয়তান ভাবি।

সবাই রগচটা বদমেজাজী হয়না। বিনয়ী কে খারাপ উপমা দিস না। ভদ্রলোকেরা অহেতুক চিৎকার চেচামেচি করেনা। আচ্ছা সব বাদ দেই তোরা তো কম ঘুরলি না, লোক লাগিয়ে ওয়াসির খবরারখবর ও নিয়েছিস। খারাপ কিছু পেলি? নাকি বলবি এখানেও মুখোশ পড়ে রেখেছে? অফিসের লোকদের টাকা দিয়ে বলছে ভালো কথা বলতে? রাজনীতি করে করে তোদের মনটা একদম নোংরা হয়ে গেছে। কাউকেই ভালো ভাবতে পারিস না।

শাহেদের কথাটা আমজাদ সাহেবের কানেই বেশি বাজলো। কেননা তিনিই তার ভাগিনাদের নিজের রাজনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়েছেন।

হাফসা বললো, ভাইজান আপনি বরং ওনাদের কল করেন, অথবা চলেন হঠাৎ একদিন গিয়ে উপস্থিত হই। তাহলেই নিজ চোখে দেখতে পারবো আমাদের মেয়ে কেমন আছে। আশেপাশে খবর ও নেওয়া যাবে?

আমজাদ সাহেব মাথা নেড়ে সম্মতি দিলেন। হ্যাঁ হঠাৎ গিয়ে দেখাটাই ভালো হবে।

১০দিন পর ইরহামকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করা হলো। ইরহামের দুলাভাই তানজিম বিল পে করে মাইশাকে বললো, তোমরা সব গোছগাছ করে নাও, আমি দেখি গাড়ি আসছে কি না।

মাঈশা কেবিনে ঢুকে দেখল তৃণা প্রায়ই সব গুছিয়ে ফেলেছে। ইরহাম আধশোয়া হয়ে আছে। মাইশা বললো, সব গোছানো শেষ?

হুম আপু।

ভাই ওয়াশরুমে যাওয়া লাগবে?

না।

মাইশা ব্যাগ ২টা নিয়ে বললো, আমি মুনাকে নিয়ে যাচ্ছি তোরাও তৈরি হয়ে নে।

তৃণা সাবধানে ইরহামের শার্টটা বদলে দিলো। চুলগুলোতে চিরুনি করে দিলো। শরীরের অন্যান্য ক্ষত কিছুটা শুকিয়ে এসেছে। তবে হাত আর পায়ের অবস্থা আগের মতোই।

তৃণা বাসায় ফোন করে বললো, আম্মু আমার জিনিসপত্র গুছিয়ে ও বাড়িতে চলে এসো। আমরা একটু পর রওয়ানা হবো।

আচ্ছা সাবধানে আয়।

ইরহাম বললো, তুমি আমাদের ওখানে যাচ্ছ?

তৃণা কাপড় ভাজ করতে করতে বললো, তো কোথায় যাবো?

না এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।

আপনার কি ভেবেছেন অসুস্থ স্বামীকে রেখে আমি বাপের বাড়ি পড়ে থাকবো?

নাহ সেটা বলিনি,

আপনি বললেও আমি শুনবো ভাবছেন?

ইরহাম দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,আমার ভাগ্যটাই খারাপ। যা করতে চাই তা করতে পারিনা। সব কেমন উলোটপালোট হয়ে যায়। ভেবেছিলাম বড় করে অনুষ্ঠান করে তোমাকে ঘরে তুলবো, এখন হুইল চেয়ারে বসে নিতে হচ্ছে!

তৃণা ইরহামের বা হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিয়ে বলল,আপনি এতো বড় একটা বিপদ থেকে বেঁচে ফিরেছেন এতেই আমি আল্লাহর দরবারে শোকর। বাকি কোনোকিছুই আমার কাছে মূল্যবান লাগছেনা। আপনি জাস্ট আমার পাশে থাকুন আর কিচ্ছু চাই না আমার।

আমি তোমাকে নিষেধ করবোনা তৃণা। তুমি আমার আশেপাশে থাকো সবসময়। জানো যখন এক্সিডেন্টটা হচ্ছিল আমার শুধু একটাই আফসোস হচ্ছিল আমি তোমাকে আবার দেখতে পারবো কি না। তুমি সবসময় চাইতে আমার কাছে থাকতে, অথচ আমি দূরে রাখতাম। তখন বারবার মনে হয়েছে আমি ভুল করেছি। জীবনটা খুব ছোট। এই জীবনে ভবিষ্যৎ অদৃশ্য মরিচীকা। সেই মরিচীকার আশায় বসে না থেকে বর্তমানটা কাজে লাগাতে হয়। বর্তমানটা মন ভরে উপভোগ করতে হয়। কখন কার ডাক আসে কোনো নিশ্চয়তা নেই।

আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। এতো হতাশ হবার কিছু নেই। এখন থেকে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত হবে বর্তমানকে ঘিরে। আপনি চাইলেও আমাকে দূরে রাখতে পারবেন না। আমি আপনাকে আর একা ছাড়ছিনা। মাথায় রাখুন।

ইরহাম হেসে বললো, যথা আজ্ঞা।

ওয়াসি এসে ইরহামকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে নিচে নিয়ে গেল। গাড়ি চলছে বিবাড়িয়ার উদ্দেশ্যে।

রাতে খাওয়া শেষে তৃণা ইরহামের পাশে বসলো। ওকে মেডিসিন খাইয়ে বললো, কপালের ব্যথা টা কমেছে?

হুম‌।

তৃণা ওর ব্যান্ডেজগুলো আলতো ছুঁয়ে বললো, অনেক ব্যথা তাই না?

তৃণা প্লিজ আবার কাঁদতে বসো না। রোজ তুমি এগুলো ধরে কান্না করো আমার ভালো লাগেনা।

তৃণা চোখের পানি মুছে বলল, আমার জায়গায় থাকলে বুঝতেন! আমার মনের অবস্থা কল্পনাও করতে পারবেন না আপনি।

ইরহাম বা’হাতে তৃণার চোখের পানি মুছে বলল, আমি বুঝি কলিজা। কিন্তু তুমিও বোঝার চেষ্টা করো আমার কষ্ট হয়। এই কয়দিন হসপিটালে সবাইকে কান্না করতে দেখেছি। আমার খুব খারাপ লাগে। আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ৪জন নারীই কান্নার সাগর হয়ে গেছে। আমি আর কত সহ্য করবো?

তৃণা নিজেকে সামলে বললো, আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি ইঞ্জিনিয়ার সাহেব। আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন। আপনাকে এমন দেখতে আমার ভালো লাগছেনা। আল্লাহ আপনাকে সকল বালা মসিবত থেকে রক্ষা করুন।

ইরহাম ওর কপালে চুমু দিয়ে বলল, পাগলী বৌ আমার। আচ্ছা শোনো ফাহিম কি চলে গেছে?

হ্যাঁ, কেন?

ফুফু ওর এখানে আসাটা পছন্দ করেনা। তাছাড়া রুমির এখন অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি চাই না ও কোনো সমস্যা করুক।

কেউ আসলে তাকে নিষেধ করা যায়?

তা জানি।

কাশফাত ভাইয়ার ছুটি বেশি নেই, উনারা চাইছিলেন বিয়েটা সেরে ফেলতে।

আম্মা বলেছিল। প্ল্যান তো ছিল আমি আসার পর সব হবে,,

আপনি একটু সুস্থ হয়ে নিন। বাকি সব আমরা সামলে নিবো।

ধন্যবাদ তৃণা!

কেন?

কারণ তো অনেক কয়টা বলবো?

এখন কেন বললেন তাই বলুন।

আমার জীবনে থাকার জন্য! আমাকে এতো ভালোবাসার জন্য।

তাই না?

হুম ঠিক তাই।

তৃণা লাইট অফ করে নীল ডিমলাইটটা অন করলো। বালিশ ঠিক করে ইরহামের দিকে ফিরে শুয়ে বলল, আজকে বহুদিন পর শান্তির ঘুম আসবে আমার।

ইরহাম হাত বাড়িয়ে বললো, এখানে মাথা রাখো।

হাতে ব্যথা পাবেন না?

এই হাতে ব্যথা নেই তো।

তবুও।

তুমি কাছে থাকো স্বস্তি লাগে।

তৃণা সাবধানে ইরহামের বাহুতে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ইরহাম তার চুলে বিলি কাটতে লাগলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই তৃণা গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ওর গাঢ় নিঃশ্বাসের‌ শব্দ শুনে ইরহাম মনে মনে বলল, তুমি অনেক ক্লান্ত তৃণা। আমার জন্য তোমাকে হসপিটালে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমার নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়, অনেক শান্তি লাগে জানো? আমি ভুল মানুষকে চুজ করিনি….

চলবে….

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৬
#আরশিয়া_জান্নাত

আস্সালামু আলাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন?

ওয়ালাইকুমুস সালাম। এইতো বাবাজী আল্লাহ রাখছে ভালো। তুমি ভালো তো?

জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।

তা বাবাজী তোমার বাবা-মা কই?একটা জরুরি কথা বলার ছিল..

মা তো আপুর বাসায় গেছে, আর আব্বু অফিসে। কি বলবেন আঙ্কেল আমাকেই বলেন।

সরোয়ার সাহেব একটু হাঁসফাঁস করে উঠলো। ছেলেকে বলে আদৌ কাজ হবে কি না তা নিয়েও একটু সন্দেহ আছে। তাকে নিরব দেখে কাশফাত বললো, আঙ্কেল কোনো সমস্যা? আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারেন।

আসলে বাবাজী কি বলবো, বলতেও একটু সংকোচ হচ্ছে। তবে তুমি অভয় দিলে বলতে পারি।

জ্বি বলেন।

তুমি তো মনে হয় ফয়েজ মাস্টারের ছোটমেয়ে রুমিরে বিয়ে করতেছ, নাহ?

হ্যাঁ কথাবার্তা অনেক টাই ফাইনাল।

মেয়ের সম্পর্কে খোঁজখবর নিছিলা বাবা?

খোঁজখবর বলতে?

মানে মেয়ে কেমন পরিবারের লোকজন কেমন সব খবর নিছো?

হুম যাবতীয় খবরাখবর নেওয়া হয়েছে। কেন আঙ্কেল?

আচ্ছা! তাহলে তো তোমাদের মন অনেক বড় বাবাজি। মানুষ বলে বড়লোকদের আল্লাহ ধন দিলেও মন দেয়না। কিন্তু তোমাদের মনও দিছে। তোমাদের প্রতি সম্মান আরো বাইড়া গেল!

কাশফাত একটু অবাক হয়ে বললো, আপনি কি বলছেন কিছু ই বুঝতে পারছিনা, রুমিকে বিয়ে করলে বড় মন হবার কি আছে?

সরোয়ার বললো, মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ। তোমরা আসলেই অনেক স্বচ্ছ মনের মানুষ ওর ব্যাপারটাকে ব্যাপারই ভাবছোনা। অনেক খুশি হইছি বাবা।

আঙ্কেল একটু ঝেড়ে কাশেন তো। ঘটনা খুলে বলেন।

ঘটনা বিশেষ কিছু না। আমরা বহু পুরানা লোক তো। আমাদের যতশত খুঁত ধরা আর কি। এখনের যুগে ঐসব কিছুই না।

খুঁত টা কি শুনি?

দেখো বাবা তোমাদের সাথে আমার অনেক আগে থেকে পরিচয়। তাই আপন ভেবেই বলতেছি, অন্য কিছু মনে নিও না। ফয়েঝ মাস্টার লোক অনেক ভালো ছিল। তার পরিবারের সম্পর্কে খারাপ বলতে পারে এমন লোক গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া উপজেলায় নাই এই আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু..

কিন্তু?

যারে তুমি বিয়ে করতে যাচ্ছ, সে তো তার আপন মেয়ে না,পালক মেয়ে।

রুমি পালক মেয়ে!

হ্যাঁ।

এতিমখানা থেকে এডপ্ট করেছে? নাকি কোনো আত্মীয়র মেয়ে?

বলেতো আত্মীয়র মেয়ে, তবে

তবে?

কানাঘুষা আছে ও জারজ সন্তান।

আঙ্কেল! কি বলেন এসব?

কাশফাতের চিৎকারে সরোয়ার মিনমিনে গলায় বলল, বাবাজী আমার উপর চিল্লাইয়া লাভ আছে? যা রটে তা কিছু টা হলেও বটে। বিশ্বাস না হইলে মাস্টারের বৌরে জিগাও। ওদের আশেপাশের মুরুব্বিদের জিজ্ঞাসা কইরা দেখো। যদিও সবাই মুখ খুলতে চাইবেনা, তবুও খোঁজ নেও।

কাশফাতকে চিন্তিত দেখে সরোয়ার মনে মনে খুশি ই হলো। যাক কথাটা কানে তোলা গেল! তিনি তো ভেবেছিলেন আধুনিক যুগের ছেলে এসব পাত্তাই দিবেনা।
ওখান থেকে হয়ে সরোয়ার সোজা আনন্দবাজার চালের আরতে গেল। তাকে দেখে ইরহামের ছোটচাচা বাহার খাতাটা রেখে কাজের ছেলেটাকে বললো, ২কাপ চা নিয়ে আয়।

কি খবর কাজটা করতে পারলে?

সরোয়ার হেসে বললো, কি যে বলেন ভাই এসব কাজ করতে কি বছর লাগে? দুই মিনিটেই সব হয়ে যায়।

তা কি মনে হয়? ওরা এরপরও বিয়ের ব্যাপারে আগাইবো?

মনে তো হয় না। যদি ছেলে কিছু না বলে আমি ওর বাপ মার কানে তুলমু। চিন্তার কিছু নাই।

ভাইসাহেব আমার মেয়েটার কথা মাথায় রাইখেন। রুমির সাথে ভেজাল হলে পরে আমার মেয়ের কথা তুলে দেখবেন।

ঐটা আমার মাথাতে আছে, এখন কিছু টাকা দেন হাটবাজার করতে হবে। আপনার ভাতিজা বাসমতি চাইলের বিরিয়ানি খাইতে চায়, আছে না আপনার গুদামে?

বাহার ক্যাশ থেকে ৫০০টাকার বান্ডেল দিয়ে বললো, এই কে আছস বাসমতি চালের প্যাকেট ৩টা দে তো।

সরোয়ার তৃপ্তির সাথে চায়ে চুমুক দিলো।

তৃণা তার শাশুড়ির সাথে রান্নাঘরে বসে রান্না করছে। রুমানা পাশে থেকে তদারকি করছে। ইরহাম বসার ঘরে বসে টিভি‌ দেখছে আর একটু পরপর রান্না ঘরে উঁকি দিয়ে তৃণাকে দেখার চেষ্টা করছে।

আম্মা রুমি কলেজ থেকে কখন আসবে?

সবে ১২টা বাজে, ওর আসতে দেরি আছে।

ওহ। আম্মা

কি?

দুপুরের জন্য কি রান্না করতেছ?

খাওয়ার সময় দেখবি। এখন রান্নাঘর থেকে চিল্লাই চিল্লাই বলতে পারবোনা।

ইরহাম নিজের পায়ের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলল, হুহ আজ হাঁটতে পারছিনা বলে! তৃণা তুমিও না কেমন, একবার এসে দেখা দিয়ে যাওয়া যাচ্ছেনা? একা একা বোর হচ্ছি আমি।

তার মনের কথাটা যেন তৃণা শুনলো। সাথে সাথে কোমড়ে গুজে থাকা শাড়ির আঁচল খুলে হাত মুছতে মুছতে এসে বলল, আপনার কিছু লাগবে?

ইরহাম তার ঘর্মাক্ত লাল মুখখানি দেখে ঢোক গিললো। অন্যদিকে ফিরে বললো, আজকের পেপারটা নাগালে পাচ্ছিনা। দাও তো একটু।

টিভি দেখতে দেখতে কেউ খবরের কাগজ পড়ে?

আমি পড়ি, টিভিতে এখন ইন্টারেস্টিং কিছু আছে?

তৃণা টি টেবিল থেকে খবরের কাগজ টা নিয়ে তার হাতে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যেতে নিলে ইরহাম বলল, তৃণা দাঁড়াও।

হুম?

বাসায় কোনো গেস্ট আসলে শাড়ি পড়বেনা।

মানে?

তুমি শাড়ি পড়ে মেহমানদারি করতে গিয়ে আঁচল সামলাতে পারবেনা। এই যে এখন নিউজপেপার নিতে গিয়ে ঝুঁকলে, একপাশ থেকে তোমার পেট দেখা গেছে। আমি দেখেছি ওটা সমস্যা না, অন্য কেউ কেন দেখবে?

তৃণা নিজের দিকে চেয়ে বললো, আপনি বলেই সাবধান থাকিনি। আগেও তো কতবার শাড়ি পড়েছি কখনো দেখেছেন কিছু দেখা যাচ্ছে?

ইরহাম মাথা চুলকে বললো, এখন কিছু বললে তো আমাকেই দোষ দিবা…

সত্যি বলেন?

তোমার পেটের কিনারায় যে গাঢ় তিলটা আছে, ওটা অনেক আগে থেকেই জানা হয়ে গেছে!

তৃণা অবিশ্বাসী গলায় বললো, একদম মিথ্যা, আমি ভার্সিটিতে পেট দেখানো ব্লাউজ কখনোই পড়িনি। সবগুলো কোমড় অবধি লং ছিল,,,তাছাড়া আর কখন শাড়ি পড়া দেখেছেন আপনি?

তাহলে হয়তো ভুল বলেছি বাদ দাও‌

তৃণা সন্দিহান দৃষ্টিতে ইরহামের দিকে তাকিয়ে রইলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো ইরহাম কখন তাকে দেখেছিল?

তাহমিনা ৩০টা কাঁথা এনে বললো, রিপা দেখ তো কাঁথা গুলো সুন্দর কি না?

অনেক সুন্দর তো। কে বানিয়েছে?

লতাকে বলেছিলাম কাঁথা সেলাই করে দিতে।‌ ও দিয়ে গেল।

ও অনেক ভালো ডিজাইন করে আম্মু! আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।

হুম, তাই তো ওকে দিয়েছি। এখন শুধু আমাদের ঘরের নতুন সদস্যের আগমনের অপেক্ষা।

ওয়াজেদ সাহেব ঘরে ঢুকে বললেন, তাহু কোথায় আছ? তাড়াতাড়ি আসো।

তাহমিনা সামনের রুমে এসে দেখেন দু’হাত বোঝাই করে মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে ওয়াজেদ সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন।

কি ব্যাপার হঠাৎ এতো মিষ্টি আনলে কেন?

তুমি না বললে বৌমা ছানামুখী খেতে চাইছে? মিষ্টির দোকানে গেলাম যখন কয়েক পদের নিয়ে আসছি। তৃণার জন্যও কিছু এনেছি।

রিপা এই রিপা দেখে যা তোর শ্বশুড়ের কান্ড। ছেলের বৌ মিষ্টি খেতে চেয়েছে বলে পুরো মাতৃভান্ডার যেন তুলে এনেছেন তিনি!

রিপা সামনের রুমে এসে দেখে, দই, ছানামুখি, রসমালাই, প্যারা সন্দেশ সহ নানাপদের মিষ্টান্ন।

ওয়াজেদ বলল, বিবাড়িয়া মিষ্টির জন্য বিখ্যাত, এক পদ খেয়ে দেখলে মন ভরবে? তাই সবপদ থেকে একটু একটু এনেছি। ঢাকার মেয়ে খেয়ে বুঝুক আমাদের শহরটা ছোট হলেও অনেক মূল্যবান। তুমি ওকে খেতে দাও, আমি তৃণার ওখানে যাচ্ছি।

তাহমিনা বললো, বুঝলি বৌমা তোর শ্বশুরটা উপরে উপরে ভার ভার ভাব দেখালেও তোর জন্য অনেক টান। কাল রাতে বলেছিলাম তুই ছানামুখী খেতে চেয়েছিস, ব্যস নিয়ে এলো।
দাঁড়া চামচ বাটি আনছি তুই বস।

রিপা খুশি তে আপ্লুত হয়ে প্যাকেট থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে খেতে লাগলো।
দেখলি সোনা তোর দাদাভাই কত্ত মিষ্টি এনেছে মায়ের জন্য? তুই পৃথিবীতে এলে বুঝবি উনারা সবাই কত্ত ভালো। সবার চোখের মধ্যমণি হয়ে থাকবি তুই। আমরা সবাই তোর অপেক্ষায় আছি, তাড়াতাড়ি চলে আয় না মায়ের কোলে?

ওয়াজেদ সাহেব তৃণার হাতে মিষ্টি দিয়ে বললেন, জামাইয়ের শরীর কেমন এখন?

এইতো ভালোই। আব্বু তুমি ভালো সময়েই এসেছ বসার ঘরে চলো। কাশফাত ভাইয়ারা এসেছেন।

তাকে দেখেই ইরহাম ও কাশফাত সালাম দিলো। তিনি ইরহামের পাশে বসলেন। তখন কাশফাতের বাবা কবির চৌধুরী বললেন, আপনারা আমাদের থেকে এতোবড় কথা গোপন রাখবেন আমরা কল্পনাও করিনি।

ইরহাম বলল, কোন বিষয়ে বলছেন আঙ্কেল ঠিক বুঝলাম না?

দেখো বাবা রুমিকে আমার ছেলে দেখে পছন্দ করেছে। আমরাও আর দ্বিমত করিনি। কিন্তু তাই বলে এমন মেয়েকে আমরা ঘরে বৌ করে কিভাবে তুলবো যার জন্মের ঠিক নেই? আমাদের বংশের তো একটা মর্যাদা আছে।

কথাটা শুনে উপস্থিত সবাই ভীষণ অবাক হলো। বিশেষ করে ইরহাম নিজে। সে রাগান্বিত হয়ে বললো, কি যা তা বলছেন আপনি?

আমার কথা বিশ্বাস না হলে তোমার মা-কেই জিজ্ঞাসা করো। রুমি তোমাদের আপন বোন কি না! তার পরিচয় ই বা কি!

ওয়াজেদ সাহেব বললেন, আপনাদের হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।

না ভাই, ভালোমতো খোঁজখবর নিয়েই আমরা আজ এসেছি। দেখুন যা শুনলাম তা যদি সত্যি হয় তবে এই বিয়েটা আমরা সম্পন্ন করতে পারবোনা। আমার ছেলের জেদের কারণেই আপনাদের কাছ থেকে সরাসরি সত্যিটা শুনতে আসা। নয়তো….

কাশফাত বললো, দেখুন ভাইয়া রুমি যদি আপনাদের এডপ্টেড বোন হয় আমার কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু ওর বাবা-মায়ের সম্পর্কে আমাদের জানা জরুরী। আমি চাইনা এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ বা সংশয় থাকুক। অনুগ্রহ করে আসল ঘটনা বললে ভালো হতো।

ইরহাম অসহায় দৃষ্টিতে পর্দার আড়ালে থাকা মায়ের দিকে তাকালো। রুমানা বেগমের নিরবতা তার মনকে আরো ভীত করে তুলছে। তবে কি সত্যিই রুমি তার আপন বোন না? ওদের কথাই সত্যি?

চলবে,,