#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৪৩
#আরশিয়া_জান্নাত
মোস্তফা সাহেবের কাছে মানসম্মানের চেয়ে বড় কিছু ছিল না। সমাজের প্রতাপশালী মানুষ হওয়ার দরুন সকলের সম্মান আর মার্জিত ব্যবহার দেখেই তিনি অভ্যস্ত। তার ৪সন্তানের মাঝে প্রিয়া ছিল ৩নম্বর। বড় ২ভাইবোনের তুলনায় প্রিয়ার পড়াশোনার মান ভালো ছিল বেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানে অনার্স করা সেই অতি মেধাবী মেয়েটা আবেগের বশে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করে ফেলেছিল। যার খেসারত কতজন কে দিতে হচ্ছে বলা বাহুল্য। রুমানা প্রিয়ার স্কুল লাইফের অনেক কাছের বন্ধু হলেও তার বিয়ের পরবর্তী কোনো খবরই মোস্তফা কিংবা ফাহমিদা বিশেষ রাখেননি। বাসা ছেড়ে প্রিয়া যে সেখানে যেতে পারে এই চিন্তাও তাদের মাথায় আসেনি। অথচ চেনা গন্ডির সব জায়গায় কমবেশ খোঁজ নেওয়া হয়েছিল। মেয়ের এই অনাকাঙ্ক্ষিত পদক্ষেপে বহুবছর তিনি আত্মগ্লানিতে ভুগেছেন। ক্ষণে ক্ষণে মনে হয়েছে সমাজের কথা চিন্তা করতে গিয়ে সন্তান হারানো অহেতুক দাম্ভিকতার মাসুল ব্যতীত কিছুই নয়। শেষ বয়সে মানুষের মন আরো নরম হয়। শক্তপোক্ত যৌবন যখন পড়তে শুরু করে তখন আপনজনদের সুখশান্তি, তাদের ঘিরে বেঁচে থাকাই মুখ্য হয়ে যায়। তার ছেলেরা বর্তমানে একেক দেশে সেটেলড। মেয়েকেও ভালো জায়গায় বিয়ে দিয়েছেন। টাকাপয়সার কমতি কোনোকালেই তার ছিল না।জীবনের শেষ ধারে এসে কেবল একটাই আক্ষেপ কিংবা অনুতাপ ছিল। মনের কোথাও না কোথাও আশা ছিল অভিমানে হারিয়ে যাওয়া মেয়েটা বুঝি ফিরবে। রুমিকে পেয়ে তিনি আর রাগ করার সাহস পেলেন না। এই পৃথিবীতে যে আর যে কটা দিন বেঁচে আছেন অহেতুক কোলাহলে নিজেকে জড়াতে চান না।
নানাজান?
হুম
আপনার কাছে আমি যদি কিছু জানতে চাই উত্তর কি বলবেন?
কোন বিষয়ে জানতে চাইছো?
আমার মা-বাবার সম্পর্কে।
তোমার মায়ের সম্পর্কে জানতে হলে সবটাই খোলা বইয়ের মতো আছে। তার ঘরে গেলেই বুঝবে। তবে বাবার বিষয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। ঐ কার্লপ্রিট কাপুরুষটাকে পেলে আমি খুন করে ফেলতাম। ওর নসীব ভালো আমার সামনে আসেনি।
উনাদের বিয়ের কাগজপত্র কি আছে এখনো?
থাকবেনা কেন?
আমি কি সেসব দেখতে পারি?
প্রিয়ন্তি তোর পরিকল্পনা কি নানুভাই? কি দরকার ঐসব দেখার?
রুমি নানার পায়ের কাছে বসে বলল, সমাজ আমাকে অনেক অপদস্থ করেছে নানাজান। আমি ক্ষতবিক্ষত হয়েছি। আমি চাই সবটা দেখতে, আমার জন্মের আসল ইতিহাস জানতে। আমার মায়ের পরিণতি এমন করুণ হলো কেন সেই গল্পটাও যে জানা বাকি!
এর পেছনে আমিও অনেকাংশে দায়ী। তখন অবশ্য আমার কাছে আমার করা কাজ ভুল মনে হয়নি। তবে এখন মনে হয় আরেকটু নরম হলেই ভালো হতো। সমাজের কারো কিছু তো হারায়নি হারিয়েছে আমার কলিজার টুকরা। সে যাই হোক তোর যা জানার তার ঘরে গেলেই জানতে পারবি।
রুমি নানার সঙ্গে তার মায়ের ঘরে গেল। তাকে সে ঘরে রেখে মোস্তফা সাহেব বেরিয়ে গেলেন। ঐ ঘরে ঢুকতে তার ভালো লাগেনা। মন ভেঙে আসে, কষ্ট হয়। একটা সময় এই ঘরটায় আলো করে থাকা মানুষটার অভাববোধ বুকের ভেতর অসহনীয় যন্ত্রণা তোলে।
রুমি পুরো ঘরটার দিকে চেয়ে দেখল। দামি আসবাবপত্রে সাজানো এই বড় ঘরটিতে একসময় তার মা থাকতো। রুমি যেন সব ছুঁয়ে ছুঁয়ে মাকে অনুভব করার বৃথা চেষ্টা করছে। দেয়ালে টাঙ্গানো সোনালী ফ্রেমে বাঁধাই করা সাদাকালো ছবিতে হাসিমাখা মুখটা দেখে রুমির চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। রুমি ঘুরে ঘুরে পুরো ঘরটা দেখে। জানলার পাশে বসে দূরের দিঘি টায় চোখ যায়। হয়তো এখানে বসে মুগ্ধ নয়নে কত বিকেল কাটিয়েছে তার মা। টেবিলে বসে ড্রয়ার খুলতেই বেশকিছু কাগজপত্র পাওয়া যায়। রুমি এক এক করে সব খুলে পড়ে, পড়াশোনার ফিরিস্তি ডিঙিয়ে খুঁজে পায় একটা খয়েরী রঙের ডায়েরী। সেখানেই দেখতে পায় তার বাবা-মায়ের বিয়ের ছবিসহ কাবিননামা। রুমি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। তার বাবা-মায়ের বিয়ে অন্তত হয়েছিল। সে অবৈধ নয় এইটুকু নিশ্চিত হতেই বুকের উপর থেকে ভারি পাথরটা যেন নেমে যায়। ডায়েরীর ভাঁজে ভাঁজে তার মায়ের লেখা ঘটনাবলী পড়ে রুমি কখনো হেসেছে, কখনো দু’চোখ ভরে কেঁদেছে। পুরোটা দিন তার কেটে যায় মায়ের সান্নিধ্যে।।।
।
মাইশা তেলের বাটি নিয়ে মায়ের পেছনে বসলো। কুসুম গরম তেল মাথায় ঘষতে ঘষতে বলল, আম্মা রুমি কবে ফিরবে বলেছে কিছু?
নাহ।
ওকে যদি উনারা ফিরতে না দেন?
না দিলে কিছু বলার আছে?
নেই বলছো! ও আমাদের বোন না?
রুমানা হেসে বললেন, কাকের গল্প জানিস খুকি? ছন্নছাড়া কোকিল কখনো নিজে ঘর বানায় না,লুকিয়ে কাকের বাসায় ডিম পেড়ে যায়। কাক ও পরম মমতায় সেই ডিমে তা দেয়, বাচ্চা পাখিটাকে মাতৃস্নেহে বড় করে তোলে। কিন্তু আজীবন ধরে রাখতে পারেনা, সে ঠিকই উড়ে যায়। এখানে কাকের কোনো অধিকার নেই দায়িত্ব ছাড়া!
আমি তেমনটা ভাবিনা আম্মা। মানুষের মনে আল্লাহ মায়ামমতা দিয়েছে। সেখানে সংবিধানে লেখা অধিকার ধার ধারেনা। অধিকার নেই বললেই হলো?
অধিকার আছে কি নেই সেই তর্কে না যাই। আমি শুধু চাই ও সম্মান পেয়ে বাঁচুক। এখানে থেকে ভবিষ্যত কি? বিয়ের ব্যাপারে কে ই বা এগোতে চাইবে? তারচেয়ে ভালো হলো না ও ওর আপননিবাসে ফিরে গেছে? ওখানে কেউ অন্তত ওকে জারজ বলে অপমান তো করবেনা….
বলতেই গলাটা কেঁপে উঠলো রুমানার।
আমাদের মন খারাপ দূর করতে ওর ভালো থাকা নষ্ট করতে চাই না খুকি। ও যেখানে ভালো থাকবে, সেখানে ই থাকুক। মায়ায় আটকে ওর ক্ষতি করতে চাইনা।
ওনারা যে ওকে আপন করে নিয়েছে নিশ্চয়তা কি? এমনো তো হতে পারে ঐখানে আরো বেশি কটু কথা শুনছে?
তেমন হবেনা আশা করি। প্রিয়ার কাছে ওর পরিবারের সবার কথা শুনেছি। উনারা খারাপ মানুষ নন। নিজ সন্তানের শেষ চিহ্নটুকু কেউই অবহেলায় ফেলতে পারেনা….
আম্মা উনাদের সম্পর্কে সুধারণা যখন তোমার ছিল এতো বছরে খবর দিলেনা কেন? কেন ওনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেনা? আন্টি মারা যাওয়ার পরো কেন বললেনা কিছু? তোমার কাছে তো ঠিকানা ছিল।
এর পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রিয়ার মনে ভয় ছিল উনারা রুমিকে আশ্রয় দিবেনা, অনাথ আশ্রমে হয়তো দিয়ে দিবে। কেননা তখন তার বাবা মেয়ের উপর ক্ষিপ্ত ছিলেন। রাগী মানুষ কি করে ফেলে ঠিক নেই। তাই ও আমাদের কাছেই রুমিকে নিরাপদ ভেবেছিল। তখন তো যাতায়াত ব্যবস্থা এতো উন্নত ছিল না। তাই এখানেই ওকে ওকে দাফন করা হয়। ওর মৃত্যুর সংবাদ দেওয়ার কথা ভাবলেও এদিকের নানান জটিলতায় আর হয়ে উঠেনি। এটা আমাদের হয়তো ভুল ছিল।
বুঝলাম।
ইরহামকে একটু বুঝাইস। ও বেশি দূর্বল হয়ে গেছে। রুমিকে আনতে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে গেছে ছেলেটা।
আমাদের সবার মনের অবস্থা ওর মতোই। পালা জিনিসের জ্বালা আরো বেশি আম্মা।
।
তৃণা রুমে ফিরে দেখে ইরহাম বেলকনিতে দাঁড়িয়ে উদাস দৃষ্টি তে চেয়ে আছে। সে ধীর পায়ে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো দু’হাতে জড়িয়ে ধরে পিঠে গাল ঠেকিয়ে বললো, আপনাকে এমন মনমরা দেখতে ভালো লাগছেনা ইঞ্জিনিয়ার সাহেব!
আমি ঠিক আছি তৃণা। চিন্তা করোনা।
রুমি ফোন করেছিল।
কি বললো?
সবার খোঁজখবর নিলো।
ফেরার কথা বলেনি কিছু?
বলেছে উনারা ছাড়তে চাইছেন না, আরো কিছু দিন পর আসবে।
ওহ!
তৃণা তাকে নিজের দিকে ঘোরালো। গালে হাত রেখে বললো, ও ফিরবে বলেছে। ভরসা করতে পারেন না? রুমি আপনাকে অনেক ভালোবাসে, ও আমাদের মায়ায় হলেও ফিরবে। দেখুন ওর উপর অনেক ঝড় গেছে। ও একটু শান্তিতে জিরিয়ে ফিরুক না?
আমি খুব খারাপ বড় ভাই তাই না তৃণা? ওকে সামলাতে পারিনি। সমাজের কটুক্তি থেকে রক্ষা করতে পারিনি।
এভাবে ভাববেন না ইরহাম। আমাদের হাতে সব থাকেনা। ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই অপ্রস্তুত ছিলাম। এখানে আপনার দোষ নেই।
ইরহাম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ম্লান হেসে বললো, ও যদি ওখানে ভালো থাকে আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবেনা। ওর সুখে থাকাই আমার জন্য আসল। ও ওর আপনজনদের কাছে আছে, উনারা নিশ্চয়ই আমার চেয়ে বেশি যত্নে রাখবে। আমি স্বার্থপরের মতো নিজের মনের শান্তির জন্য ওকে আনবোনা।
ওর দুঃখের দিন শেষ হোক। সুখের দিন শুরু হোক সেই দোয়া করি।
তোমার দোয়া কবুল হোক!
আপনাকে একটা কথা বলার ছিল.
বলো?
এখন বলবো নাকি পরে বলবো বুঝতে পারছি না।
কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?
নাহ সমস্যা নয়।
তাহলে?
আমি নিশ্চিত না আসলে, তবে মনে হচ্ছে…
মনে হচ্ছে?
আমার ২টা সাইকেল মিস গেছে….
ইরহাম কিছুক্ষণ সময় নিলো কথাটা বুঝতে। পরক্ষণেই উত্তেজিত গলায় বলল, তার মানে তুমি বলতে চাইছো সে আসতে চলেছে?!
তৃণা ওর বুকে মুখ লুকিয়ে বললো, আমি জানি না।
ইরহাম আনন্দে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এটা যদি সত্যি হয় আমার চেয়ে খুশি আর কেউ হবেনা কলিজা। তুমি এখনি চলো টেস্ট করিয়ে আনি। আমার তো ইচ্ছে করছে পুরো শহরকে জানান দেই।
এই এই এখনি না প্লিজ…..
চলবে,,,,
#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৪৪
#আরশিয়া_জান্নাত
তোমাকে ধন্যবাদ দিয়ে দায়সারা হতে পারবোনা। তুমি আমার যে উপকার করেছ তার কথা আমি কখনো ভুলবোনা।
এভাবে বলবেন না চাচা আমি সেই হারে তেমন কিছুই করতে পারিনি
প্রিয়ন্তি আমাকে সব বলেছে। ওর জন্য তোমাদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে। সমাজের মানুষের কথা শুনতে হয়েছে, তোমরা নিজেদের ভিটা ছেড়ে উপজেলায় ঘর বেঁধেছ কোনোকিছু ই অজানা নয়। আর সবচেয়ে বড় কথা ওকে তোমরা আপনের মতোই রেখেছ। আমার নাতনি আমার ঐশ্বর্যে ভোলেনি, ওর কাছে ওর ভাইয়া ভাবী, মা বোন ওরাই অধিক প্রিয়! কিন্তু মা আমরা যে ওকে আর দূরে রাখতে পারিনা। আমাদের মেয়ে তো আর নেই ওর অংশটাকে শেষ নিঃশ্বাস অবধি বুড়োবুড়ি কাছে রাখতে চাই।
রুমানা ইরহাম আর মাঈশার দিকে চাইলো। দুই ভাইবোনের মুখই মলিন হয়ে আছে। রুমানার মনে হলো তার দুই ছেলেমেয়ে সেই ছোটবেলায় ফিরে গেছে। তাদের পছন্দসই খেলনা হারিয়ে গেলে যেভাবে কাঁদো কাঁদো মুখ করে মায়ের কাছে আসতো ঠিক যেন তেমন।
চাচা রুমি আপনাদের নাতনি। ওর বিষয়ে আপনাদের অধিকার বেশি। আমি বহুবছর ওকে নিজের কাছে রেখে কোনো না কোনোভাবে আপনাদের বঞ্চিত করেছি। আপনাকে বাঁধা দেওয়ার মুখ আমার নেই। তবে অনুরোধ করবো বছরে একবার হলেও ও যেন এখানে আসে, ওর ভাইবোনেরা ওকে অনেক ভালোবাসে। ছোটবোনকে চোখের আড়াল করার ক্ষমতা ওদের নেই!
ও নিয়ে তুমি ভেবো না, আমার বাড়ির দরজা তোমাদের জন্য সবসময় খোলা। যখন মন চায় ওরা ওখানে যাবে, প্রিয়ন্তিও এখানে আসবে।
কি বলিস প্রিয়ন্তি?
হুম নানাজান। (রুমি মাথা নেড়ে বলে)
তোর কিসব নেওয়ার আছে নিয়ে নে, আমরা একটু পরেই রওয়ানা দিবো।
রুমি চলে যেতেই মোস্তফা সাহেব বললেন, প্রিয়ার শেষ স্মৃতি বলে তোমার চাচী ওর নাম রেখেছে প্রিয়ন্তি। ওর মামারা সব দেশে ফিরবে, ভাগনীকে দেখার জন্য তর সইছেনা কারো।
আমার ছোট মেয়ে তো কানাডা থেকে রোজ কল করে ওর পছন্দ অপছন্দ জেনে নিচ্ছে। কি কি আনবে বুঝতেই পারছেনা… বহুবছর বাদে আমার বাড়িতে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।
রুমানা হেসে মাথা নাড়লো। তার মনটা নিশ্চিত হলো। উনার কথা শুনে বোঝা গেল ওখানে রুমির আর কোনো দুঃখ থাকবেনা। ও ওখানে অনেক ভালোই থাকবে
রুমি নিজের জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে বললো, ভাবী আমি অনেক খুশি হয়েছি, আল্লাহ তোমাদের অনেক ভালো সন্তান দান করুন!
তুমি ওখানে ভালো থাকবে তো রুমি?
হয়তো। এখানে থেকে আর কত বোঝা হবো বলো? আর কয়জনকে ই বা সাফাই দিবো আমি অবৈধ নই?
তোমাকে বাঁধা দিবোনা তবে কখনো যদি সেখানে কোনো অসুবিধা হয় ফিরে আসতে সময় নিও না। এখানে সবাই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
আমি জানি। ভাবী ভাইয়া আমাকে অনেক ভালোবাসে ওর হয়তো বেশি কষ্ট হবে। তুমি আমার ভাইয়াকে দেখে রেখো। সময়ের সাথে সব সয়ে যাবে আশা করি…
তুমি খুব স্ট্রং রুমি। তোমার ভাইয়া আরো আমাকে বলছিল তোমাকে যেন বলি নিজেকে সামলাতে…
রুমি হাসলো। হেসে বলল, ভাইয়ার কাছে আমি এখনো সেই ছোট্ট খুকি কি না!
তৃণা ওর মাথায় হাত রেখে বলল, আল্লাহ হয়তো তোমার দুঃখের দিন শেষ করেছে। তিনি তোমায় অনেক সুখী করুন। তুমি ভালো আছ শুনলে আমাদের সবার সব কষ্ট মুছে যাবে।
রুমি চোখের কোণ মুছে বলল,ভাবী আমি তোমার জন্য একটা উপহার এনেছি। প্লিজ গ্রহণ করবে!
।
ওয়াজেদ সাহেব বেশ মন দিয়ে পত্রিকা পড়ছেন। প্রতিটা কলাম শেষ করার মতো অফুরান সময় তার নেই। তবে সুযোগ পেলেই সবটা শেষ করা তার অভ্যাস। তাহমিনা নওরিনকে গোসল করিয়ে হাতে পায়ে তেল মালিশ করছে। রিপা দুপুরের রান্না করছে। সে এখন পাক্কা গিন্নির মতো রান্নাঘর সামলায়। দরজায় বেল বাজতেই কলির মা দরজাটা খুলে দিলো।
আরেহ বুজান যে, আস্সালামুআলাইকুম। আপা দেখেন কে আইছে।
সবাই দরজায় তাকিয়ে দেখে তাহমিনার বড় বোন শাহিনুর এসেছে। তাকে দেখেই ওয়াজেদ সাহেবের মুখটা পাংশু হয়ে গেল। বড় জেঠস কে সে বরাবরই এড়িয়ে বাঁচে। আজ ভেবেছিল সারাদিন ঘরে কাটাবে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দোকানে গিয়ে বসাই নিরাপদ।
আরেহ বড়াপা, কেমন আছেন?
ভালোই। তোদের কি খবর? কি ব্যাপার আমাকে দেখে খুশি হস নি তোরা?
ছি ছি কি যে বলেন খুশি হবোনা কেন? কত দিন বাদে বোনের কাছে এলেন। আসুন না ভেতরে আসুন।
ওয়াজেদ সাহেব সালাম দিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করেই মানে মানে বেরিয়ে পড়লেন।
এটা ওয়াসির মেয়ে না?
হুম।
আল্লাহ বাঁচাক। দাদুমণি আমাকে চিনছো? আমি তোমার বড় দাদু। মনে থাকবে? ওলে ওলে হাত পা নেড়ে দাদুকে ধরতে চায়? দাঁড়াও দাঁড়াও দাদু আগে হাতমুখ ধুয়ে নি। তারপর কোলে তুলবো। তাহমিনা তোর ছেলের বৌ কই? তামজিদ তৃণার কি খবর?
কলির মা বলল, আপনারা বসেন আমি খবর দিতাছি।
শাহিনুর হাতমুখ ধুয়ে সোফায় বসতেই রিপা এলো। সালাম দিয়ে বলল, ভালো আছেন খালামণি?
হুম আল্লাহ ভালোই রাখছে। তা তুমি ভালো তো?
জ্বি ভালো।
তাহমিনা বললো, তুই নওরিন কে নিয়ে বস ওর ক্ষুধা পাইছে। আমি বড়াপার জন্য খাবার দিচ্ছি।
তাহমিনা চলে যেতেই শাহিনুর বলল, বাচ্চা নরমাল হইছে নাকি সিজারে?
নরমাল
ওহ! তোমার মায়ো সাহস আছে বলতেই হয়। অবশ্য আমার বোইন যে কিপ্টা জীবনেও ছেলের বৌরে সিজার করাবে না। তা মায়ো তোমার যত্ন করে তো? হাত খরচ টরচ দেয়?
রিপা একটু অবাক ই হলো। ছেলের বৌয়ের কাছে আপন বোনোর বদনাম করা টা কি উনার কোনো পরীক্ষা নাকি স্বভাব?
না খালামণি আমার শশুড় শাশুড়ি দুজনেই অনেক উদারমনা। নরমাল ডেলিভারি করার ইচ্ছা আমার ছিল। তাছাড়া সিজার পারতে করানো উচিত না।
ঐসব গরীবদের কথাবার্তা। বড়লোকদের কাছে এখন সিজারটাই সহজ। যাই হোক মধ্যবিত্ত ঘরের বৌ তুমি, রথ না দিলে দাম পাইবানা এটাই স্বাভাবিক। তো তোমার বাপের বাড়ির লোকেরা মানি নিছে তো? আসে যায় নিয়মিত?
হুম আসে,
ওয়াসি তোমারে টাকাপয়সা দেয় নাকি সব সংসারেই দিচ্ছে?
মায়ের কাছেই দেয়।
ওমা মা কি বলো? তোমারে দেয়না? এখন মেয়ে হইছে ওর ভবিষ্যৎ গড়তে হইবোনা? এখন থেকেই পুঁজি রাখো। জামানা ভালো না। আমি আবার যা বলি উচিত বলি। এখন সে আপনার হোক কি পর।
তাহমিনা আসতেই শাহিনুর সুর বদলে বলতে লাগলো, কি বলিস তাহমিনা আমি কি কাউরে পর ভাবি?
নাহ। বড়াপা আসেন উপস্থিত যা আছে তা দিয়েই দু’টো ভাত খান।
শাহিনুর খাওয়ার ঘরে যেতে যেতে বলল, রান্না দায়িত্ব কি বৌ রে দিয়ে দিছোস নাকি তুই করোস?
বৌমাই করে। ওর রান্নার হাত ভালো চিন্তার কিছু নাই।
আমি আরো ভাবলাম এখনো বুঝি তুই রান্না করিস। তোর তো আবার খেটে খাওয়ার অভ্যাস।
তাহমিনা হেসে বলল, বড় সংসারের বৌ হয়ে এই অভ্যাস হয়েছে। এখন তো আর সেই ভরা সংসার নেই। সবাই যার যার হালে আছে।
হুম তাও ঠিক।
রিপার কাছে এই বড় খালামণি মানুষ টা বিশেষ সুবিধার লাগলোনা। তবুও সে হাসিমুখে এটা ওটা এগিয়ে দিতে লাগলো।
।
কয়েক দফা বমি করে তৃণার অবস্থা বেশ কাহিল। সে কোনোমতে দরজার পাশের চেয়ারটায় বসে আছে উঠে বিছানায় যাওয়ার জো নেই। কষ্ট করে সেখানে গিয়েও লাভ কি ফের বমির বেগ পাবে আর তাকে ওয়াশরুমে ছুটতে হবে। তাই এখান বসে থাকাই শ্রেয়। রুমানার প্রেশার বাড়ায় তিনি ঘুমের ঔষধ খেয়ে শুয়েছেন। বাড়িটা একটু বেশিই খালি হয়ে গেছে। বৌ শাশুড়ি বাদে এই বাসায় এখন কেউই নেই। ময়নার মা বিকেলে পাড়া বেড়াতে যায়। তাই সেও এখন কাছে নেই। তৃণা ধীর পায়ে বিছানায় গিয়ে বসে। হাতড়ে ফোন বের করে মায়ের কাছে কল করে। তাহমিনা অবশ্য অনেকবার বলেছে ও বাড়িতে গিয়ে থাকতে। কিন্তু তৃণাই যায়না, ভেবেছিল আরো কয়েকমাস যাক তারপর নাহয় যাবে। এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছে..
হ্যালো আম্মু, তুমি এখানে আসতে পারবে?
কি হয়েছে তাজু? তোর গলা এমন শোনাচ্ছে কেন?
আমার শরীর অনেক খারাপ লাগছে আম্মু। তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো।
আচ্ছা আমি এক্ষুনি আসছি।
তৃণার মাথাটা ভীষণ ঘুরছে । সে বালিশে মাথা চেপে শুয়ে পড়লো। সারা শরীর কেমন যেন খিচে আসছে। এতো শরীর খারাপ লাগছে কেন হঠাৎ? বমি হওয়ায় কেউ এতো দূর্বল হয়ে পড়ে? তৃণা দু’চোখ বুজে নেয় চোখ মেলে রাখলেই সব টলছে মনে হয়।
আধঘন্টার মধ্যেই তাহমিনা ইরহামদের বাড়ি আসে। দ্রুত মেয়ের ঘরে গিয়ে দেখে তৃণা বিছানায় পড়ে আছে। মেয়ের মুখ দেখে তাহমিনার কলিজায় পানি থাকেনা। এ কি হাল হলো তার মেয়ের। মুখটা এমন দেখাচ্ছে কেন! তিনি দ্রুত তৃণার গায়ে মাথায় হাত দেন, শরীর টা কেমন ঠান্ডা হয়ে আছে। মেয়েটা এভাবে পড়ে আছে অথচ এ বাড়িতে কারো কোনো খবর নেই! পোয়াতি বৌকে কেউ একা রাখে?!
তামজিদ বাবা তাড়াতাড়ি গাড়ি আন, ওকে হাসপাতালে নিতে হবে। আমার মেয়ের কি হলো! ও আল্লাহ আমার মেয়ের কি হলো!
তামজিদ তাড়াতাড়ি গাড়ি আনতে ছুটলো। ভাগ্যিস সে সঙ্গে এসেছিল নয়তো কি হতো! তাহমিনার কান্নাকাটির শব্দ শুনে রুমানার ঘুম ভাঙে। ঘুমঘুম চোখে উঠে এসে বোঝার চেষ্টা করে কি হয়েছে।
আপা আপনি কোথায় ছিলেন, আমার মেয়ের কি হয়েছে? ওর হাত পা এতো ঠান্ডা কেন? আপনারা এতো কেয়ারলেস হলেন কিভাবে? আমার মেয়ে….
তামজিদ বলল, আম্মু চলো গাড়ি এনেছি। দেখি সরো আমি আপুনিকে নিচ্ছি।
তাহমিনা ছেলের সঙ্গে বেরিয়ে গেল। রুমানা বেগম তখনো ঘুমে ঢুলছেন। সেই বেচারির ও কি দোষ!
চলবে….