#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে তামজিদ। দেশের সময় আর মালোশিয়ার সময়ের কিছুটা ব্যবধান। মালোশিয়ায় সময়টা রাত দুইটা হলেও বাংলাদেশে বারোটা। তামজিদ ফোন করলো তৌসিফ’কে। রিসিভ হতেই দু’জনের মাঝে কথোপকথন হলো। তামজিদ হেসে জিগ্যেস করে,
— ভাতিজা আর ভাতিজি কেমন আছে?
তৌসিফ পাশে তাকালো। রাত বাজে বারোটা অথচ বাচ্চা দুটো ঘুমাচ্ছে না। পৌষ নানান চেষ্টা করছে। ক্লান্ত হচ্ছে অথচ বাচ্চা দুটো আজ নাছোড়বান্দা। তৌশিটা একটু চুপ করলেই তায়ু কেঁদে উঠে। তৌশি’কে কোলে তুলে তৌসিফ। ছেলেকে এবার পৌষ একটু সামলাক। তৌসিফ ড্রয়িং রুমে এসে বসলো মেয়েকে বুকে নিয়ে। এক হাতে পিঠ চাপড়াচ্ছে। মেয়েটা উল্টো হাতে বাবা’র বুক চাপড়াচ্ছে যেন বলছে, ‘বাবা তুমি আগে ঘুমাও’। তৌসিফ হাসতে হাসতে উত্তর দিলো,
— আলহামদুলিল্লাহ। দু’জনই ভালো আছে।
— বলেছিলি ভাবীকে নিয়ে ঘুরে যাবি।
— বাচ্চা দুটো নিয়ে ভরসা পাই না দোস্ত। জমজ তো কাঁদলে একসাথেই কাঁদে। হাসলেও একসাথেই হাসে।
তামজিদ মজা করে বললো,
— এটা কিন্তু ভালো। বিয়ে একসাথে করিয়ে দিবি।
— ঘরজামাই আনব ভাবছি। আমার মেয়ে আমি কাউকে দিব না।
— আরেকটা তৌসিফ পেলেও না?
— নাহ।
— এরমানে এতটা খারাপ জামাই তুই?
— পৌষ’র কাছে আমি ভালো খারাপ দুই সত্তায়ই আছি। ওর মেহেরবানী ও আমার খারাপ মাফ করে ভালোটা মনে রাখে।
তামজিদ ব্যথিত বদনে হাসে। তার দুপুরটা যদি এভাবে ভাবতো। যদি তামজিদে’র খারাপ না দেখতো। যদি শুধু ভালোটা দেখতো তাহলে এতবছরে তার কোল জুড়েও তো দুটো ফুটফুটে বাচ্চা থাকতো। বয়স হচ্ছে অথচ প্রেয়সীর হৃদয় জেতা হচ্ছে না। জীবনটা এলোমেলো হচ্ছে। অনেকটা গোছানো বাকি। তামজিদ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
— আজ মাল যাচ্ছে। তোর জাহাজের শিপমেন্ট পাঠাচ্ছি।
— শুনেছি। লোক আছে আমার। চিন্তা নিস না।
— সব লাইসেন্স করা তবুও তো শত্রুর তো অভাব নেই। বাকি কয়েকটা শিপমেন্ট পাঠালেই দেশে ফিরব। ওখানে তাসরিফ একা হাতে সামলাচ্ছে। আব্বাও ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে। তুই তো পিছু হটে গেলি।
— রাজনীতি ছেড়েছি কিন্তু মাঠ না। ক্ষমতা আমার এখনও ততটাই কিন্তু এসব ঝামেলায় জড়িয়ে বউ, বাচ্চা নিয়ে শান্তি নষ্ট করতে চাই না।
এই দফায়ও দীর্ঘ শ্বাসই ফেলে তামজিদ। তাদের আরো কিছুটা সময় কথা হয়। ফোন রাখতেই তৌসিফ দেখলো বুকে থাকা তার রাজকন্যা ঘুম। তৌসিফ রুমে এসে দেখলো তায়ুশ চুপচাপ মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। তৌসিফ ‘বাবা’ বলে ডাকতেই তাকালো। ওকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে পৌষ ঘুমিয়ে পরেছে এদিকে ছেলে মা’কে পাহারা দিচ্ছে।
___________________
দুপুর’কে আজ সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চাইছেন শাহজেবে’র বাবা। শাশুড়ী মা দুপুরকে বগলদাবা করেছেন৷ ছাড়ার নামগন্ধ নেই। এদিকে দুরুদুরু বুকে বসা দুপুর। ওর ভেতরে অস্থির লাগছে। কপাল ঘামছে। বাড়ী থেকে তার বের হওয়া নিষেধ। নিজের জন্য নিজেই এই নিয়ম জারি করেছে দুপুর। সেই কলেজ জীবনটা কোনমতে পাড়ি দিতেই দুপুর এক প্রকার ঘরবন্দী। ভার্সিটিতে শুধু গিয়ে গিয়ে পরীক্ষা গুলো দেয়া হয়। আজ ওনাদের সাথে বের হতে ভয় লাগছে। তাসরিফ জানলেই তা সোজা তামজিদ জানবে। বাসায় এসে তখন নানান প্রশ্ন তাদের। কেন গিয়েছে, কোথায় গিয়েছে, কার সাথে গিয়েছে। দুপুর ঘামতে লাগলো। এতটুকু প্রশ্নের উত্তরই তো ওরা দিতে পারবে না সেখানে বিয়ের কথা কিভাবে জানাবে তামজিদ’কে?
পাঁচটা বছর। পাঁচটা বছর ধরে তার জীবন আটকা তামজিদে’র হাতে৷ দুপুর যেন এক কাঠের পুতুল যাকে নাচানো ওয়ালা একমাত্র তামজিদ। মাঝেমধ্যে মন চায় এই রূপ জ্বালিয়ে দিতে। না থাকবে রূপ না থাকবে তামজিদে’র মোহ। এমন না দুপুর তার চেষ্টা করেনি। করেছে। একবার। দুইবার। বহুবার কিন্তু দুপুর প্রতিবার ব্যার্থ হয়েছে। চরম ভাবে ব্যার্থ হয়েছে।
তার এই রূপ তার গলার কাটা। এমন এক কাটা যা না যায় গেলা না যায় উপড়নো। দুপুর শুধু গলার কাটা জিইয়ে রাখে। আজও রাখছে।
সায়রা এসে পাশ থেকে শক্ত করে ধরলো দুপুরে’র হাত। দৃঢ়তা নিয়ে বললো,
— দুপুর অবশ্যই যাবে। শশুর বাড়ী ঘুরে আসুক। দেখে একটু পরিচিত হয়ে আসুক।
কত সুন্দর হাসিমুখে বললো কথাগুলো। মিরাজ সাহেবের মুখে আতঙ্ক। মানুষটা মারপ্যাঁচ বুঝেন না৷ এই যে এতটা জীবন খাটা খাটুনি খাটলেন তা দিয়ে বিশাল সম্পত্তিও করলেন। চাচাতো ভাইরা লুটেপুটে সব নিয়ে গেলো। দুটো মেয়েই তার। চেয়েছিলেন তাদের ভবিষ্যৎ সুন্দর করে সাজাতে। সন্ধ্যার স্বামী ইফাত ভালো মানুষ। সরকারি চাকরি করছে। চট্টগ্রামেই কত কষ্টে মিরাজ সাহেব মেয়ের নামে একটা জায়গা ক্রয় করেছেন৷ তার মেয়ে শিক্ষিত। সেই জায়গা ভবিষ্যতে কাজে লাগাতে পারবেন। দুপুরটার জন্য এখনও ভয় হয়। শাহজেব যদি উঠিয়ে নিয়ে যেতো তাহলে এই ভয়টা থাকতো না। দুপুরকে নিয়ে গেলে মিরাজ সাহেব বোন, মা আর বউ নিয়ে গ্রামে চলে যাবেন৷ একদম লুকিয়ে। বোনটার গতি তিনি আজও করতে পারেন নি। আজ পর্যন্ত জানে না কেউ কেন সায়রা বিয়ে করতে চায় না। জোর করলেই ফাঁ সি দেয়ার অথবা বাড়ী থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ভয় দেখাবে। সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছে তাই। এরমধ্যে চেয়ারম্যানের ছোট ছেলে ওকে জ্বালাতন শুরু করেছে। সায়রা থেকে তিন বছরের ছোট সে। সরাসরি নিজে এসে প্রস্তাব দিয়েছিলো তিন বছর আগে। কেউ কিছু বলার আগেই সায়রা ধমকে বের করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব ঠান্ডা মাথায় গরম ড্যাগে বাড়ি দেয়া মানুষ। এই পর্যন্ত যতবার দেখা হয়েছে ততবারই মিরাজ সাহেবকে দেখে হেসেছেন। বাড়ী দাওয়াত করেছেন। মিরাজ সাহেব তখন মাথা নিচু করে রাখেন। তার ছোট মেয়েটার জীবন চেয়ারম্যানের বড় ছেলে নরক করে ছেড়েছে।
মাহমুদ এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। সায়রা’র প্রতিটি পদক্ষেপ যেন ও লক্ষ্য করছে। দুপুরের মা চা এগিয়ে দিলেন তাকে। মাহমুদ লক্ষ্য না করাতে নিজে কাপটা নড়বড়ে করে নিজের হাতে ফেললো। ধোঁয়া উড়া গরম চা। মাহমুদ হাত ঝাড়ে৷ দুপুরের মা ব্যস্ত হলেন। মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে। মিরাজ সাহেব হড়বড় করে বললেন,
— সায়রা বেয়াইকে বাথরুমে নিয়ে যা।
সায়রা খুব স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে গেলো। মাহমুদ তার পেছনে। বেসিনে হাত দিয়ে কল ছেড়ে রেখেছে মাহমুদ। সায়রা যেতে নিলেই বলে উঠলো,
— বার্নাল ক্রিম হবে?
— নাহ।
কাটকাট উত্তর সায়রা’র। মাহমুদ ব্যাকুল চোখে তাকিয়ে রয়। বলে,
— তুমি ভালো আছো সায়রা?
— দেখে খারাপ মনে হচ্ছে আপনার?
— এখনও আগের মতোই আছো তুমি। জেদী, দূরদৃষ্টি সম্পূর্ণ।
— আপনি অবশ্য আগের মতো ঠকবাজ আছেন কি না তা আমার দূরদৃষ্টি বলতে পারছে না।
মাহমুদে’র দৃষ্টি নত হয়। করুন স্বরে ডাকে,
— সারা?
— সারা ডাকবেন না মাহমুদ। সেই অধিকার আপনার নেই।
— ছিলো তো।
— নিজ হাতে গলা টিপে হ ত্যা করেছিলেন আপনি তা। বউ, বাচ্চা নিয়ে সুখে আছেন তাই থাকুন। সায়রাকে ঘাটতে আসবেন না। সংসারে আগুন লাগিয়ে দিব। তান্ডব চালাতে গিয়ে দুবার ভাববো না যে আমার ভাইঝির মামাতো শশুর আপনি।
মাহমুদ দৃষ্টি তুলে না। সায়রা চলে যায়। মাহমুদ এক পলক দেখে। নরম মেয়েটা এতটা কঠিন কিভাবে হলো? সেদিন কি মাহমুদ খুব খারাপ করেছিলো?
.
দুপুর’কে রাতের অন্ধকারে শশুর বাড়ী নেয়া হলো। সায়রা ভাইঝিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কানে ফিসফিস করে বললো,
— ভয় নেই৷ ফুপি আছি।
— তুমিও চলো না ফুপি।
— চুপ। দাঁত ব্রাশ বাথরুমের ভেতরই করবি।
— আচ্ছা।
— দুই দিন পর নিয়ে আসবে ভাই গিয়ে। ফোন দিবি পৌঁছে।
দুপুরে’র মা কোনায় দাঁড়িয়ে মেয়ে বিদায় দিলেন। আচ্ছা, তার সাথে মেয়েটার দূরত্ব কি খুব বেশি হয়ে গেলো? আজও সন্ধ্যা’র সাথে তৈরী হওয়া সম্পর্ক দুপুরে’র সাথে কেন হলো না? দোষটা মূলত কার তিনি জানেন না৷ সেই সময় সন্ধ্যাকে সামলাতে গিয়ে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তার দুপুর।
.
দুপুরে’র মনটা গাড়িতে ভয়ে কুঁকড়ে ছিলো। এই বুঝি তাসরিফ এসে গাড়ি থামালো কিন্তু আজ তাসরিফ এখানে নেই। চেয়ারম্যান বাড়ীটা আজ নিস্তব্ধতায় ঘেরা ছিলো। দুপুর ভাবলো যাক এই দফায় বাঁচা গেলো।
তিব্বি ভাবীর হাত ধরে টান দিলো। দুপুর তাকাতেই হাসিমুখে তিব্বি বললো,
— আমরা চলে এসেছি ভাবী।
দেবরের হাত ধরে গৃহ প্রবেশ হলো দুপুরের। শাশুড়ী মা আদর করে দিয়ে বললেন,
— রুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে ফেলো মা। যা লাগবে সোজা আমাকে বলবে। আর হ্যাঁ, একা ঘুমাতে কি ভয় পাও? আমি আসব সাথে?
দুপুর তাকালো শশুরের দিকে। তার মুখটা শুকিয়ে আছে যখনই শুনেছে শাশুড়ী মা দুপুরের সাথে থাকবে। দুপুরের মায়া হলো। বললো,
— একাই ঘুমাতে পারব আন্টি।
— রাতে ভয় পেলে ডাকবে ঠিক আছে? আমি দেখে যাব একটু পরপর।
তিব্বি ভাবীর হাত ধরে নিয়ে এলো ভাইয়ের রুমে। দরজা খুলতেই দুপুরের নাকে ঠেকলো অদ্ভুত এক ঘ্রাণ। অর্ধ চেনা ঘ্রাণটা তীব্র হলো যখন ভেতরে ঢুকলো ও। শাহজেব যেদিন প্রথম থাকলো ওদের বাসায় সেদিন এই ঘ্রাণটা এসেছিলো ওর নাকে। চন্দনের মতো কিছুটা সাথে মিশ্রিত বেলীর সুবাস। দুপুর এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো। কাঠের একটা আলমারি পাশেই ড্রেসিং টেবিল। খাটটা দু’জনের জন্য পারফেক্ট। সাইড টেবিলটায় শাশুড়ী মা এসে পানির জগ রেখে গেলেন। দুপুর জানালা খুলে দিলো। বাইরে উঠান দেখা যাচ্ছে। তিব্বি ভাবীর হাত ছেড়ে বললো,
— ভাবী ভাইয়াকে কি ফোন দিব?
— দরকার নেই।
— আজ রাতে আমরা মজা করব অনেক।
দুপুর কিছু বলার আগেই শাশুড়ী মা এসে ধমকে নিয়ে গেলেন ওকে। কাল স্কুল আছে এদিকে তিব্বি কথা না শুনে দুপুর’কে জ্বালাচ্ছে এটা ভেবেই ওকে নিয়ে চলে গেলেন। দুপুর বসলো বিছানায়। তাদের মতোই মধ্যবিত্ত পরিবারের একটা রুম অথচ দুপুরের ভেতরে অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। ওর ইচ্ছে ছিলো দুপুরে বিয়ে করে দুপুর বেলা স্বামীর হাত ধরে শশুর বাড়ী আসবে কিন্তু আফসোস তা সম্ভব হয় নি। ইহকালে তা আর সম্ভবও না। দুপুরের মন খারাপ হলো। উঠে মুখ ধুয়ে ব্যাগ থেকে একটা শাড়ী বের করলো। তাঁতের শাড়ী। গোলাপি শাড়ীটা সুন্দর করে গায়ে জড়ালো দুপুর। জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিলো। উঠানে চাঁদের আলো পরেছে। দুপুুর হতাশ হয়ে বললো,
— আমার কালো চাঁদটা কেন আজ আমার আকাশে উঠলো না?
ঐ মুহুর্তে ফোন বাজে। দুপুর দেখে দুলাভাই লিখা তাতে।
#চলবে….