সে জন সোনা চিনে না পর্ব-০৮

0
19

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৮

— রাতের কটা বাজে এখন?

জোড়ালো এক ধমক খেলো তাসরিফ। মাথাটা তার সবসময়ের মতোই নিমজ্জিত। সায়রা দাঁত কটমট করে বলে উঠে,

— দেব চটকানা? খাবে?

— আচ্ছা।

সায়রা অবাক হলো। বেয়াদব ছেলে বলে কি? চটকানা নাকি খাবে। সাতাইশ বছরের এই দামড়া লোকটাকে সায়রা চাইলেই চটকানা দিতে পারছে না৷ হাত মুঠ করে রাগ দমন করার চেষ্টা করতে করতে সায়রা বললো,

— আচ্ছা? আচ্ছা মানে কি বোঝাতে চাইছো তুমি? চটকানা খেতে চাইছো? তুমি কি বুঝতে পারছো তুমি কি বলছো?

— জ্বি।

— তাসরিফ!

সায়রা ধমকে উঠে পুণরায়। সায়রা ফুঁসে উঠে বলতে লাগলো,

— আচ্ছা, জ্বি এসব কতক্ষণ চলবে? বাসায় যাও বলছি।

— ভাবীকে দেখেই চলে যাব।

— চুপ করো ফালতু ছেলে। কিসের ভাবী? ও ভাবী না তোমার! লজ্জা লাগে না হাঁটুর সমান মেয়েকে ভাবী ভাবী ডেকে মুখে খই ফুটাও?

— লাগে না।

— নির্লজ্জ তুমি?

— য়রা আমার কথাটা…..

— কি কথা… কি কথা তোমার? ভাবীকে দেখবে, এটাই তো? আচ্ছা, তোমাদের দুই ভাইয়ের কি সামান্যতম লজ্জা কাজ করে না এতটুকু মেয়ের সাথে এরূপ ব্যবহার করতে? তোমাকে দেখলে ও আতঙ্কিত হয়ে যায় তা কি বোঝো? আমিই পা গল অবশ্যই বোঝো। বুঝেই শয়তানি করো দুই ভাই।

— শয়তান বললে?

— সন্দেহ আছে নাকি? বাড়ী যাও তাসরিফ শেষবার বলছি।

— এরমানে ভাবী বাসায় নেই?

মনে মনে সায়রা ঘাবড়ালো। তাসরিফ চালাক পুরুষ। ওর বুঝতে সময় লাগবে না। ও বুঝা মানেই তামজিদও জানবে যা আপাতত হতে দেয়া যাবে না৷ সায়রা কথার মোড় ঘুরালো যেই মোড় ওর কাছে জঘন্য। বিশ্রী। বললো,

— য়রা বলে ডাকো কেন তাসরিফ? তোমার বড় হই। তিন বছরের বড়। আপা ডাকবে।

তাসরিফ কিন্তু চট করে বুঝে গেলো কথা ঘুরাচ্ছে সায়রা তবুও সায়রাকে বুঝতে দিলো না সেটা। ভাবুক না তার য়রা নিজেকে চালাক। দোষ তো নেই। অল্প মাথা তুলে বললো,

— আম্মার কাছে প্রস্তাব পাঠাচ্ছি আবার। আব্বা আসবে।

— লজ্জা কাজ করে না তোমার?

— নাহ। তোমার ক্ষেত্রে তো একদমই না৷

— আমি তোমার তিন বছরের বড় তাসরিফ।

— তাতে কি? ভাই ছোট মেয়ে বিয়ে করবে আমি করব বড়৷

— আমি তোমাকে বিয়ে করব না এটা ভালো করেই জানো।

— বিয়ে করতেই হবে য়রা। বিয়ে ছাড়া বাচ্চাকাচ্চার ডাক শুনব কিভাবে?

সায়রা হতভম্ব হলো। শুধু মাত্র ধরা যাতে না পড়ে তাই এত কথা নাহয় বিয়ে থেকে বাচ্চা পর্যন্ত অন্তত তাসরিফ’কে যেতে দিতো না৷ সায়রা অবাকতা কাটিয়ে প্রশ্ন করলো,

— তোমার মা-বাবা রাজি হন কিভাবে আমি বুঝি না।

— ভালোবাসা থাকলে দুনিয়ায় মানুষকে মানানো ব্যাপার না।

— ভালোবাসা না এটা। তোমার মিথ্যা স্বপ্ন। এখনও জোয়ান আছো তাসরিফ, পরামর্শ থাকবে ভালো দেখে কাউকে বিয়ে করে নাও।

— ভালোই তো তুমি য়রা।

— বুড়ির পেছনে পরে আছো। তোমার জীবন মরীচিকার ন্যায় তাসরিফ। দুই ভাই কোন গুনাহ করে বেড়াও কে জানে।

তাসরিফ হঠাৎ জলন্ত চোখে তাকালো। সায়রা’র বুক ধ্বক করে উঠে। তাসরিফ সেকেন্ডের ব্যবধানে চোখ নামিয়ে বলে উঠে খড়খড়ে কণ্ঠে,

— আমাদের কোন ব্যাবসায় এক পয়সা হারাম নেই য়রা। অন্তত হারাম খেয়ে বড় হই নি। যা করি, যা বলি সবটা হালাল। মিথ্যা অন্তত বলি না।

সায়রা ডগমগালো। তাসরিফ কি তবে ধরে ফেললো ওর মিথ্যা? শুকনো ঢোক গিলে বললো,

— বাড়ী যাও।

— ভাবী কোথায়?

— তাসরিফ…

— ভাবী কোথায়!

সায়রা’কে শেষ করতে না দিয়ে জোরে ধমকে উঠে তাসরিফ। সায়রা দুই পা পিছুতেই তাসরিফ এগিয়ে আসে। আঙুল তুলে শাসিয়ে বলে,

— ভদ্র আমি শুধু তোমাকে ভালোবেসে য়রা। আমার ভদ্রতা শুধু মাত্র তোমার সামনে ঐ পর্যন্তই। ভাবীকে কোথায় লুকাবে? পাতালে? ওখান থেকে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসব৷ *** মাথা গরম করবে না কাল। মা-বাবা আসবে প্রস্তাব নিয়ে তোমার জন্য। তাদের হাত খালি হলে খুব কষ্ট পাব আমি।

সায়রা’র কপালে ঘাম জমলো। নিমিষেই কণ্ঠে শিথিলতা আনে তাসরিফ। ঠান্ডা হয়ে বলে,

— ভাবীকে ডেকে দাও য়রা।

সায়রা’র বুক সমান তালে ওঠানামা করছে। ওর মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না৷

________________________

দুপুরের দিন আজ ভালোই কেটেছে। শশুর বাড়ী এক রাত একদিন তার পাড় হলো বেশ চমৎকার ভাবে। শাশুড়ী চমৎকার রান্না করেন। দুপুরকে সকালের নাস্তা নিজ হাতে রুমে এনে দিলেন। এদিকে দুপুর উঠেই দেখে দিনের আলো ফুটে সূর্য মাথার উপর। ভালোই সংকোচ লাগলো। প্রথম দিন এত দেড়ী তাও স্বামী হীনা শশুর বাড়ী তার। তিব্বি স্কুল থেকে এসেই গা এলিয়ে দেয় তার কাছে। আঁচলে নিজের কপাল মুছে। দুপুরের দিনটা কাটে সুন্দর। ঝলমলে। বিকেল হতেই উঠানে ভাবী দেবর মেতে উঠে খেলায়। ঘর কেটে ব্যাডমিন্টন খেলা হলো। গাছে পানি দেয়া হলো। সুন্দর একটা সন্ধ্যাও কাটানো হলো।
এই তো মাত্র রাতের খাবার খেয়ে সবাই ঘুমাতে গেলো। এখন তো দুপুরের ভালো লাগছে না। মনটা শাহ শাহ করছে।
বৈশাখের বাতাসে গাছগুলো এদিক ওদিক নড়ছে। ফুরফুরে আসা দমকা হাওয়া যেন গায়ে হুল ফুটিয়ে যাচ্ছে। দুপুর জানাল দিয়ে বাইরে নজর দিলো। দুই হাতে মুখ ঢেকে করুন সুরে বলে উঠলো,

— দুপুরের বর নেই। বর তার কাছে নেই। আকাশের বুকে থাকা চাঁদটা যেমন সঙ্গীহীন ঠিক তেমন দুপুর আজ সঙ্গীহীন। বরের অভাবে দুপুর শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে অথচ নিষ্ঠুর বর আজ একটা বার ফোনও দিলো না। দুপুরও দিবে না৷ দুপুরের চাই না কালা মানিক। এমন পুরুষ হয় যার বউ ছাড়া থাকতে কষ্ট হয় না? সেখানে কালো চাঁদ পেয়েছে দুপুরের মতো সুন্দরী বউ তার বুকে তো সারাক্ষণ চিনচিন ব্যথা হওয়ার কথা অথচ কালো চাঁদের কোন হদিস নেই৷ নিষ্ঠুর পুরুষ। কালো মানিক। হাতের কাছে সোনা পেয়েও মূল্য দিচ্ছে না। যেদিন সোনা হারাবে সেদিন কপাল চাপড়ে আফসোস করবে।

একা একা কথাগুলো বলেই মুখ ভেঙালো দুপুর। ধপ করে বিছানায় শুয়ে পরলো। পরণে তার সুতির শাড়ী। অবস্থা এখন এলোমেলো। বালিশ বুকে চেপে বেশ খানিকটা সময় খাটে গড়াগড়ি করেছে মনের দুঃখে। গান গায় দুঃখী গলায়,

‘কারে দেখাব মনের দুঃখ গো
আমি বুক চিরিয়া’

দুপুরের চোখ বুজে আসে। ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় সে গভীর অতলে। ঐ তো দুপুর। কলেজ থেকে সেদিন বাড়ী ফিরছিলো একা একা। সময়টা দুপুর হওয়াতে রাস্তা ফাঁকা। নোট করতে গিয়ে দেড়ীটা হলো। হঠাৎ তখন সামনে আসে তামজিদ। দুপুর’র চমকে গেলেও সরে আসতে চাইলে তামজিদ সোজা হাত ধরে আটকালো। দুপুর ভয়ে চিৎকার করে উঠতেই তামজিদ এক টানে কাঁধে তুলে হাঁটা ধরে। দুপুর চিৎকার করে কিন্তু সুনসান রাস্তায় কেউ ওর ডাক শুনে না। এগিয়ে গিয়ে তাসরিফ’কে দেখে দুপুর ভাইয়া বলে ডেকে উঠতেই তাসরিফ বলে উঠে,

— কেটেজে যাবে ভাইয়া?

তামজিদ চোখের ইশারা দিতেই তাসরিফ ড্রাইভিং সিটে বসে। শহর পেরিয়ে ছুটে যায় গাজীপুরের দিকে। নির্জন নিস্তব্ধ এক জায়গায় গাড়ি থামতেই দুপুর এবার চিৎকার থামিয়ে কেঁদে উঠে। তামজিদ তখনও শক্ত করে হাত ধরে রাখা। তাসরিফ গাড়ি থেকে নামে না। দুপুরকে পুণরায় কাঁধে তুলে জঙ্গলের মাঝে থাকা সুন্দর সাদা রঙ করা বাড়িতে ঢুকে তামজিদ।
দুপুরের গগনবিদারী চিৎকার গুলো আটকে থাকে দেয়ালের মাঝে। ফিরে এসে হানা দেয় কানে। দোষ? দোষ তো ঐ একটাই। সুন্দরী রূপবতী তরুণীদের দোষই তাদের রূপ। তামজিদ এখানে নিজের দোষ দেখে না। পঁচিশ বছরের জীবনে এই প্রথম তার মন থেকে কাউকে ভালো লেগেছে। এই প্রথম সে নিজের মা-বাবাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছে তাদের থেকে অনেকটা নিচু পরিবারে। সম্ভান্ত্র পরিবারের তামজিদ এক সরকারি চাকুরিজিবি বাবার কাছে প্রস্তাব পাঠিয়ে যখন খালি হাত পেলো তখন তার আঘাত লাগলো আত্ম গড়িমায়। সবচাইতে সহজ এবং কুৎসিত উপায়ে সে দুপুরকে নিজের করতে মরিয়া হয়ে উঠলো।

কালো বন্ধ সেই রুমে দুপুর হাঁটু ভাজ করে বসা৷ কারো পায়ের ছায়া দেখে মুখ তুলতেই তামজিদকে দেখে পেট মুচড়ে উঠে৷ বমি গলায় আটকে আসে। তামজিদ যখন ওর কাছে এসে তুলতুলে গালে হাত রাখে তখন দুপুর চিৎকার করে উঠে পরে। এক প্রকার লাফিয়ে উঠে ঘুম থেকে। শ্বাসকষ্ট রুগীর মতো হাঁপাতে হাঁপাতে ফোন করে শাহ’কে। রিসিভ হয় সেকেন্ডের মধ্যে। দুপুর কেঁদে ডেকে উঠে করুন গলায়,

— শাহ?

— দুপুর?….

— কোথায় আপনি শাহ? কোথায়? কেন একা রেখেছেন আমাকে? একা যদি রাখারই ছিলো তাহলে কেন বিয়ে করেছেন? আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে শাহ৷ দুপুর মা’রা যাচ্ছে শাহ। দুপুর সত্যিই মা-রা যাচ্ছে।

শান্ত কণ্ঠে শাহ বলে উঠে,

— সব ঠিক আছে দুপুর। আচ্ছা সোনা তোমার আশেপাশে কি পানি আছে?

দুপুর মাথা কাত করে। বলে,

— হ্যাঁ।

— এক গ্লাস পানি খাবে৷ ফাস্ট।

তিন ঢোকে দুপুর পানি খেলো। শাহ এর কথা মতো দু’জন তিন বার ভেঙে শ্বাস ত্যাগ করলো। দুপুর এখন শান্ত। শাহ আদর করে বললো,

— বালিশে মাথা রাখো।

দুপুর রাখে। শাহ মোহনীয় গলায় বলে,

— মানুষের বিকেল পছন্দ। কারো পছন্দ রাত। আমি কালো হলেও রাত আমার পছন্দ না, না পছন্দ ভোরের আলো। আমার পছন্দ ব্যতিক্রম। ঠিক রসায়নের এক বিক্রিয়া যেন। আমার পছন্দ দুপুর। খড়খড়ে তপতপে এক দুপুর। যেই দুপুরে তোমায় পাওয়া যায়, খুব কাছে থেকে স্পর্শ করা যায় আমার সেই দুপুর খুব করে পছন্দ। আমার বুকফাটা আর্তনাদ কতটা করুণ তুমি বুঝো একটা বার। এক কালো মানিক তার দুপুরকে আপন করে কাছে পায় না আজ কতটা দিন। কতটা রাত। নিজের শোক বুঝলে নারী, আমায় বুঝলে না।

#চলবে….