#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১০
রাতটা ছমছমে। রাস্তার পাশে কুকুরটা আজ ক্লান্ত। মাথাটা নুইয়ে মুখটা সামনে দিয়ে রেখেছে। ভাবখানা এমন চোর গেলেও ঘেউ শব্দটা মুখ দিয়ে বের করবে না। রাতটা আজ উদাস উদাস। চেয়ারম্যান বাড়ীর পরিবেশ উৎসব মুখোর। তাসরিফ ছাদে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে তামজিদে’র সাথে। প্রায় দশ পনেরো মিনিটের আলাপে একবারও তাসরিফ দুপুরের খোঁজ দেয় নি। তামজিদ আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে নি ভেবে আজ তার ছোট ভাইয়ের বিশেষ এক দিন৷ তিনটা বছর ধরে সায়রা’র পেছনে ঘুরছে ও। এই পর্যন্ত অভদ্রতা করে নি। সায়রা’কে যথেষ্ট সম্মান করে ও। তামজিদে’র ভেতর চিরে এক সূক্ষ্ম ব্যথা নাড়া দেয়। তিন বছরে তাসরিফ ভালোবাসা পেয়ে গেলো তাহলে পাঁচ বছরে কেন তামজিদ পাচ্ছে না। দুপুর তো ভয়ে কথাই বলতে চায় না৷ বিষয়টা খুব চিন্তার। তামজিদ তওবা কেটেছে নাহয় এতদিনে তার নরম গদিতে থাকতো উষ্ণ দুপুরটা।
তাসরিফ ফোন রেখে নিচে নামছে। রাত হচ্ছে। এখনও খাওয়া হয় নি। বাড়ীতে ভালোই মানুষ জড়ো হয়েছে। এখন খেয়েদেয়ে আস্তে ধীরে কমছে।
.
দরজা জানালা আটকে পরণে থাকা বেনারসি শাড়িটার আঁচল বুক থেকে সরায় সায়রা। ঘন্টা খানিকের উপর হবে তাসরিফে’র মা মানুষ পাঠিয়ে ওকে পরিয়েছে এসব। গা ভর্তি অলঙ্কার, মুখ ভর্তি নব বধূর সাজ। আঁচলটার কোমড়ের কিছু গুজে রাখা কাপড় আলগা করে সায়রা। মৃত্যুকে এতটা বছর ভয় পেয়ে এসেছে অথচ আজ যেন মৃত্যু ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। খাটের উপর ড্রেসিং টেবিলের টুলটা তুলে তাতে উঠে দাঁড়ায় ও। আঁচলটা গিট দিয়ে ছুঁড়ে দেয় ফ্যানে। ফাঁসের মতো বানিয়ে ব্যস্ত হাতে তা গলায় পেঁচায়তেই দরজায় টোকা পরে। তাসরিফে’র কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। সে ডাকছে,
— য়রা? যরা দরজা খুলবে একটু?
সায়রা কথা বলে না। তারাহুরোয় তার ঝুলতে সমস্যা হচ্ছে। পা দিয়ে লাথি দিয়ে টুলটা ফেলে দিলো ও। দরজায় করাঘাত বাড়ছে। সায়রা’র দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ দুটো বড় বড় হয়ে আসে। লাল হওয়া চোখে পানি চলে আসে ওর। সায়রা দূর্বল না৷ জীবন তাকে নরম থেকে শক্ত হওয়ার শিক্ষা দিয়েছে। সেই সায়রা আজ ভেঙে চুরমার হয়েছে। বিষ বাক্য তার সহ্য হয় না। সহ্য ক্ষমতা সে হারিয়েছে। ধ্রিম করে আসা শব্দে দরজার পাল্লা খুলে তাসরিফ ভেতরে ঢুকে। অদ্ভুত চোখে সেকেন্ড খানিকটা সময় তাকিয়ে থাকে। দৌড়ে এসেই সায়রা’র পা জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে পুরুষ কণ্ঠে ডাকে,
— আব্বা…. আব্বা! আম্মা কোথায় তুমি?
বাড়ীর কাজের মানুষ সহ সকলে দৌড়ে এসে হতভম্ব হয়ে যায়। ফ্যানে ঝুলন্ত একটা দেহ যার পা দুটি আঁকড়ে ধরে আছে তাসরিফ। ফ্যান থেকে খুলে বিছানায় রাখা হলো সায়রা’কে। মেয়েটার জ্ঞান নেই। মোটা দাগ গলায়। ছিলেছে অনেকটা। ডাক্তার ডাকা হতে হতে কাজের লোকটা মাথায় পানি ঢালা শুরু করে। তাসরিফে’র মা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন এক কোণায়। এই মেয়ে যে এমন কিছু করবে তা তার ধারণায় ছিলো না।
তাসরিফ পা গ লা মি করছে। একবার সায়রা’র পায়ের তালু ঘঁষে দিচ্ছে তো একবার হাতের। মুখে পানির ছিঁটাও ওর জ্ঞান ফেরাতে পারছে না। তাসরিফ পাল্স খুলে না পেয়ে চিৎকার করে উঠে,
— আব্বা? আব্বা? ও নড়ে না কেন আব্বা? আব্বা দেখেন আপনি। এক্ষণ দেখেন। ওকে নড়তে বলেন আব্বা। আমি ওর চৌদ্দ গুষ্টি পুঁতে ফেলব আব্বা। ওকে উঠান আব্বা। উঠান ওকে।
ভয়ে গুটিয়ে যায় সকলে শুধু দরজার কাছে শক্ত হয়ে থাকে ওর মা। চেয়ারম্যান সাহেব নিজে ছেলেকে সামলাতে সামলাতে অস্থির। এরমধ্যে হাজির হয় ডাক্তার। শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়াতে এক ঘন্টা স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাসের জন্য কৃত্রিম অক্সিজেন দিলেন। ইনজেকশন পুশ করে গলার দিকটা ভেজা তুলা দিয়ে মুছে দিয়ে কিছু খুচরা ঔষধ লিখে দিলেন। এদিকে তাসরিফ একে একে প্রশ্ন ছুঁড়ে যাচ্ছে। ডাক্তার জানালেন সমস্যা নেই, ঠিক হয়ে যাবে।
— তাহলে মুখে অক্সিজেন কেন?
তাসরিফে’র প্রশ্নে তিনি আস্তে করে বললেন,
— শ্বাসপ্রশ্বাস একটু স্বাভাবিক হলেই খুলা হবে।
— জ্ঞান ফিরবে কখন?
— একটু সময়…
— কতটুকু সময়?
ডাক্তার বেকায়দায় পড়তেই চেয়ারম্যান সাহেব নিজে বললেন,
— আপনি যান৷ আমরা সামলে নিব আর ডাক্তার সাহেব বাইরে যাতে এই খবর না ছড়ায়।
ডাক্তার একেবারে জায়গায় তিনবার মাথা নাড়লেন। বিদায় হতেই চেয়ারম্যান সাহেব ঘর খালি করালেন। একটু একা থাকুক। সবাই চলে গেলে চেয়ারম্যান সাহেব ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
— যা করার বুঝে শুনে করবে।
— ওকে খু ন করতে মন চাইছে আব্বা।
— একটু পর এটা মন চাইবে না। খনিক সময়ের জন্য যেটা মন চায় সেটা না করাই ভালো। তুমি তো আমার বুদ্ধিমান ছেলে।
চেয়ারম্যান চলে যেতেই তাসরিফ দরজা আটকে এলো। ঘড়ি ধরে এক ঘন্টা পর মুখের মাক্স মুখে দিয়ে গলার খয়েরী দাগটা দেখলো। গা থেকে চাদর সরাতেই নজরে এলো এলোমেলো শাড়ী। বুকের দিকটা স্বাভাবিক নিঃশ্বাসের তালে ওঠানামা করছে। তাসরিফ ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করলো তা। ঠিকঠাক সব আছে বুঝে আসতেই সায়রা’র গালে মৃদু চাপড় দিয়ে ডাকতে লাগলো,
— য়রা? য়রা? উঠো তো।
সায়রা’র বন্ধ চোখ দিয়ে পানি আসে। তাসরিফ মুছে তা। লাভ অবশ্য হয় না। পুণরায় গড়িয়ে পড়ে তা। সায়রা চোখ খুলে ধীরে ধীরে। মুখের উপর তাসরিফে’র মুখ দেখে চমকে উঠে। তাসরিফে’র লাল হওয়া চোখ, সিগারেট পোড়া ঠোঁট, তীক্ষ্ণ এক চোয়াল যার মধ্যে কালো কুচকুচে চাপ দাঁড়ি। সায়রা দেখে সাতাশ বছরের পুরুষটাকে। নিজের থেকে তিন বছরের ছোট ছেলেটাকে দেখে ওর ভেতরে অনুভূতি আসে না। মরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই তাসরিফ অদ্ভুত ভাবে বলে উঠে,
— মাহমুদের কথা মনে পরেছিলো য়রা?
সায়রা চকিত দৃষ্টি ফেলে তাকালো। তাসরিফ পুণরায় বলে উঠলো,
— স্বামীর বাড়ী এসে পুরাতন প্রেমিককে ভুলতে না পেরে শোকে ম র ছিলে?
বিষে ভরা প্রশ্ন ছুঁড়ে তাসরিফ। সায়রা থমকে চুপ করে থাকে তাতেই তাসরিফ চড়াও হয়। এত দিনের পরিচিত তাসরিফ এটা না। সায়রা বুঝে যায় অনেকিছু। চোখ বন্ধ করে পানি ফেলতেই তাসরিফ গালে চাপড় দেয়। চোখ খুলে সায়রা। তাসরিফ শক্ত করে বলে,
— চোখ বুজবে না।
সায়রা বুঝলো ছেলেটা ভয় পাচ্ছে। মৃত্যু না হওয়ার মনে মনে কষ্টও হলো। এই নাটকীয় জীবন তার চাই না৷ চাওয়ার মতো তেমন কিছু অবশ্য নেই। আচমকা তাসরিফ হমলে পড়ে ওর উপর। সায়রা থমকে যায়। ওর বুকে মুখ গুজে হাউমাউ করে কাঁদছে তাসরিফ। ঘর কাঁপানো কান্না। দরজার বাইরে সকলে উপস্থিত হয়। প্রথমে ভয় পেলেও ধীরে ধীরে সরে যায় সকলে। সায়রা কিছু বলতে চায়। বলতে চায়, ‘কেঁদো না, ম রি নি’। গলায় চাপ লেগে ব্যথা লাগায় বলতে পারে না। না পারে সান্ত্বনার হাত তাসরিফে’র মাথায় দিতে।
কতক্ষণ কাঁদলো তাসরিফ জানে না৷ ও বুক থেকে মুখ তুলে সায়রা’র মুখটা দুই হাতের আজলে নেয়। কপালে, গালে সারা মুখ জুড়ে আদর করতে করতে বলে,
— তুমি আর এমন করো না য়রা। কখনো করো না। তুমি বাঁচলে আমি বাঁচব বাকিরা বাঁচবে। তুমি নেই তো আমিও নেই সাথে তোমার পরিবারও নেই য়রা। কাউকে বাঁচিয়ে রাখব না।
তাসরিফ শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে সায়রা’কে। সায়রা নড়ার শক্তি পায় না৷ গায়ের সবটুকু শক্তি তার শেষ। দৃষ্টি তার খোলা জানালার বাইরে। সেখানে দেখা যায় কালো আকাশের। আকাশে আজ চাঁদ নেই। সায়রা মৃত চোখে তাকিয়েই থাকলো।
‘মনের খবর কে ই বা রাখলো তার
দেহেই যে তার সুখ।
দেহের খবর কে ই রাখলো তার
মন ই যে আসল হিংসুক’
_____________________________
— কোথায় যাবেন আপনি?
দুপুরের অবাক করা প্রশ্ন। তিব্বিও ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। শাহজেব বসে ওদের পাশে। তিব্বির হাতে থাকা বাটি থেকে সমুচা নিতে নিতে বলে,
— কাজে যেতে হবে না।
দুপুর অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
— আজই তো এসেছেন।
— আজ না গতকাল এসেছিলাম আমি। ছুটি নিয়ে তো আসি নি।
দুপুরের কাল রাত থেকে উচ্ছসিত মুখটা মলিন হলো। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। আস্তে ধীরে উঠে পা বাড়াতে চাইলো রুমে তার আগেই আঁচলে টান লাগলো। তিব্বি মলিন কণ্ঠে বললো,
— ভাবী থাকো না।
শাহ বিরক্ত হয়ে বললো,
— আঁচল ছাড়।
— কেন ভাইয়া?
— কেন মানে? তোর বউ এটা? আমার বউ৷
— আমার তো এখন বউ নেই। এখন ধরি তোমার বউয়ের আঁচল। বিয়ের পর নিজের বউয়েরটা ধরব।
শাহ প্রচন্ড বিরক্ত হয়। আঁচলটা তার নিজস্ব। দুপুর তিব্বির মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বললো,
— ঘুমাতে যাও সোনা। কাল স্কুল আছে না।
কি সুন্দর মেনে গেলো তিব্বি। শাহজেব এখনও বিরক্ত। সোনা নামে কেন ডাকবে দুপুর? নিজের বউ নিয়ে তার বড্ড হিংসে হয়। তিব্বিকে দুপুর নিজে গিয়ে রুমে দিয়ে এলো। বেরিয়ে এলো আধ ঘন্টা পর। শাহ ঠাই বসা। এরমানে ঘুম পারিয়ে দিয়ে এলো? এত বড় পুরুষটা গাল ফুলিয়ে রাখলো। তার মুখ ভরা অভিমান। দুপুর টেবিলের বাটি, মগ গুছিয়ে রান্না ঘরের লাইট অফ করে রুমে চলে গেলো। শাহ’র মন বসলো না টিভিতে। বন্ধ করে নিজেও রওনা হলো বউর পিছু পিছু।
খাটের উপর পা গুটিশুটি করে বসা দুপুর। পরণে লাল সুতির শাড়ী। শাহ দুপুরের দিকে বলাতে পরেছিলো মেয়েটা। লাল টুকটুকে বউ দেখাচ্ছে তাকে। শাহ দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসতেই দুপুর মাথা নিচু করে রাখে। শাহ বুঝে ওর মন খারাপ। প্রথমে নিজের মন খারাপ জাহির করতে বলে,
— তিব্বিকে সোনা বলে ডাকবে না।
জানপ্রাণ অবাকই হয় দুপুর। বলে,
— কি বলেন!
— আমাকে ডাকবে এই নামে। কালো বলে কি সোনা হতে পারব না? বউ এর চোখেই যদি সোনা না হই তাহলে বাইরের মানুষতো তামাও বলবে না।
দুপুর মনোযোগ দিয়ে কথা শুনছে। শাহ বলতে লাগলো,
— তিব্বিকে মুখ মুছতে আঁচল দিবে না। ওটা আমার।
— ওহ আচ্ছা আচ্ছা।
— চুল এলোমেলো করে দিবে না।
— এটাও সমস্যা?
— হ্যাঁ। আমাকে দিও।
গম্ভীর থাকা দুপুর এবার ঘর কাঁপিয়ে হেসে ফেললো। শাহ নিজেও হাসলো। গা ঘেঁষে বসলো দুপুরের কাছাকাছি। দুপুর মাথা রাখে ওর কাঁধে। হেয়ালি গলায় বলে,
— আপনাকে আমার কেমন লাগে জানেন?
— কেমন?
— কালো চাঁদ লাগে। আমার ব্যক্তিগত চাঁদ যাকে চাইলেই ছোঁয়া যায় কিন্তু আপনি তো কাছে থাকেন না৷ থাকতে চান না।
শাহ আস্তে করে জড়িয়ে ধরে দুপুরকে। ফিসফিস করে কানে বলে,
— দুপুর চন্ডী, একবার যেহেতু তোমায় পেয়েছে ছাড়ার নামগন্ধ আমার মধ্যে থাকবে না। খুব শিঘ্রই একেবারের জন্য নিয়ে যাব।
— কোয়াটারে?
— হুম।
— এখন গেলে কি সমস্যা?
— ওখানে আরেকটা বউ আছে আমার। তাকে বিদায় করে তবেই না তোমাকে তুলব।
শাহ’র এহেন দুষ্টামি দুপুরের ভালো লাগে না৷ বুকে মৃদু আঘাত করে বলে,
— ঐ বউকে বিদায় করার জন্য আমি আছি তো।
#চলবে…..