সে জন সোনা চিনে না পর্ব-১৫+১৬

0
16

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৫

অন্ধকারে গাড়ি চলছে। দুপুর ঘুমিয়ে আছে শাহ’র বাহুতে। এক হাতে বুকের পাশের শার্টটা খামচে ধরেছে। শাহ সেটা দেখছে আর হাসছে। কি ভাবছে তার দুপুর, তার শাহ তাকে মাঝরাস্তায় ছেড়ে যাবে? আলগোছে কপালের কাটা চুল কানে গুজে ও চুলের মাঝে ঠোঁট ছোঁয়ালো। গাড়িতে উঠেছে থেকে মেয়েটার মুখে মিশ্র এক ভাব দেখেছে শাহ। এই চিন্তায় ডুবে আবার প্রচন্ড খুশি। শাহ বুঝতে পারলো না দুটো চিন্তা কেন তার ছোট মাথায় থাকবে?
ওরা পৌঁছালো খানিক বাদে। ড্রাইভার গাড়ি থামাতেই শাহ আস্তে করে ডাকলো,

— দুপুর?

ঘুম ভাঙাতে অবশ্য মন চাইলো না কিন্তু অপারগ শাহ। বউ কোলে নিয়ে যাওয়া যাচ্ছে না আপাতত। গালে মৃদু চাপড় দিয়ে ডাকলো,

— দুপুর, আমরা এসে পরেছি। উঠবে এখন?

আস্তে ধীরে চোখ খুললো দুপুর। পুণরায় বন্ধ করে ঘুম জড়ানো গলায় বললো,

— ঘুমাই আরেকটুখানি?

— ঘুমাবে তো পাখি। খাটে চলো।

— ঘরে তো সতিন আছে। আমি যাব না।

শাহ মহা ঝামেলায় পড়লো। ড্রাইভার অপেক্ষা করছে গাড়ির বাইরে। দুপুরের গালে আদর করে শাহ বললো,

— স্বেচ্ছায় এসেছো না তুমি? ঘরসংসার তো তোমাকে করতেই হবে দুপুর।

টেনেটুনে ওকে বের করে শাহ। দুপুর সোজা হয়ে দাঁড়ায় ড্রাইভারকে দেখে। হাতে হাতে গাড়ি থেকে ব্যাগ নামায়। শাহ গাড়ির দরজা লাগিয়ে বলে,

— হায়াত, তুমি কি বাড়ি যাবে এখন?

— জ্বি, স্যার।

— সাবধানে যেও তাহলে। সকালে বের হব।

— জ্বি, স্যার।

— আটটার দিকে চলে এসো তাহলে।

— জ্বি, স্যার।

দুপুর ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে রইলো। হাতে তার অনেকগুলো জিনিসপত্র। হায়াত যেতেই দুপুর জিজ্ঞেস করে,

— আপনার ড্রাইভার উনি?

— অফিসের আবার আমারও বলা যায়।

— জ্বি স্যার বাদে কিছু বলতে পারে না।

— কি শুনতে চাও ওর মুখে?

— আমি আবার কি শুনতে চাইব?

— তাহলে ভেতরে চলো।

সুন্দর একটা বাসার দোতলায় উঠলো দু’জন। হাতের মালপত্র নিচে রেখে তালা খুললো শাহ। দুপুর মনোযোগ দিয়ে দেখছে সেটা। তালা খুলেই বাইরে জুতা খুলে শাহ। দেখাদেখি দুপুরও জুতা খুললো। ভেতরে অন্ধকার। বাতি জ্বালিয়ে শাহ বললো,

— ঢুকবে না কিন্তু।

দুপুর পা বাড়িয়ে থেমে গেলো। ভেতরে গিয়ে শাহ ফিরলো দুই মিনিট পর। হাতে তার একটা পলিথিন। সেই পলিথিন ভর্তি ফুল। গোলাপের ঘ্রাণে চারপাশ ভরে গেলো। শাহ ফুল ছিটালো দুপুরের উপর। হাসিমুখে বললো,

— এবার আসো।

ভেতরে দুই হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহ। দুপুর ত্রস্ত পায়ে ঢুকে। জড়িয়ে ধরে শাহকে। হাত বাড়িয়ে দরজা আটকালো শাহ। একটু উঁচুতে তুলে দুইবার ঘুরলো। খিলখিল করে হাসে দুপুর। মুখ গুজে গলায়। শাহ’র গলা জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে বলে,

— আই লাভ ইউ শাহ। আই লাভ ইউ।

উচ্ছাসে তরুণীর হৃদয় দুলে দুলে উঠে। তিরতির করে কাঁপে সে। শাহ থামে। নামায় কোল থেকে। কপালের মধ্যিখানে গভীর চুমু দিয়ে বলে,

— দুপুর, এখন তো রাত।

— তো?

— রাতে যদি এখন আমি দুপুরচন্ডী ফুটাই, তোমার নীতির খেলাফ হবে না তো?

দুপুর দুই হাতে ঠেলে সরালো শাহ’কে। শাহ হাসছে। দুপুরের মাঝে লজ্জার বালাই নেই। ফটফট করে বলছে,

— এসব গোছাবে কে শাহ?

— আমার বউ।

— উহু। দু’জন মিলে মিলে।

— এরপর?

— এরপর আমার মাথা।

দুপুর ব্যাগ পত্র গোছালো। তখনও বেড রুম দেখা হয় নি ওর। দু’জন মিলে সব গুছিয়ে নিতেই দুপুর বললো,

— গোসল করব? বেড রুম কোনটা?

দুই রুম আর একটা ড্রয়িং রুমের বাসা। মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দর গোছানো একটা ঘর। শাহ ইশারায় দেখালো ডানপাশের ঘরটা। বললো,

— এটায় যান।

দুপুর দেখলো পাশেরটা তালা দেয়া তাই জিজ্ঞেস করে,

— এটা বন্ধ কেন?

— ওটা প্রয়োজন পড়ে না তাই।

— খুলি?

— না, দুপুর। ওটায় গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজ আছে।

— তো আমি কি সেগুলো দিয়ে ছিনিমিনি খেলব?

উত্তরের অপেক্ষা না করে দুপুর গোসল করতে যায়। পিছনে ছুটে শাহ। ঘর্মাক্ত শার্ট খুলে বারান্দায় মেলে দিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কল দেয় মিরাজ সাহেবকে। জানায় ওরা ফিরেছে। আরো কিছুক্ষন কথা বলে ফোন কাটে শাহ। বাথরুমের দরজায় টোকা দিতেই দুপুর জিজ্ঞেস করে,

— কিছু লাগবে শাহ?

— হ্যাঁ।

— কি?

— তোমাকে?

— দেড়ী হবে।

— আমাকেও নাও।

— উহু।

শাহ ঠাই দাঁড়িয়ে। দরজাটা যখন সামান্য খুলে শাহ তখন মুচকি হাসে।

__________________________

রাত তিনটা, তামজিদের গাড়ী থেমেছে দুপুরের বাড়ীর সামনে। চিরায়ত অভ্যাস সরূপ চাবি দিয়ে মেইন গেইট আর দুপুরের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে ও। লাইট জ্বালাতেই দেখে বিছানা খালি। কপালে ভাজ পড়ে ওর। এদিক ওদিক দেখে সরাসরি বাথরুমে ঢুকে। কোথায় গেলো? সায়রা’র রুমে?
ব্যস্ত পায়ে গিয়ে দেখে সেই রুমটাও খালি। দাদীর ঘরেও নেই। বৃদ্ধা একা একা ঘুমাচ্ছেন। এখন বাকি শুধু মিরাজ সাহেবের রুম৷ তামজিদ বুঝতে পারছে না দুপুর সেই ঘরে কি করছে? এত রাতে মা-বাবার রুমে কি তার। বুকের ভেতর তখন চিনচিন ব্যথা হচ্ছে। কেমন করে জানি মোচড়াচ্ছে। তামজিদ এক দৌড়ে ছাদে গেলো। না, কোথাও নেই। দৌড়ে নামে আবার নিচে। ওর মাথাটা ধীরে ধীরে বিগড়াচ্ছে। ধুপধাপ করে মিরাজ সাহেবের দরজায় ধাক্কাচ্ছে ও। ভেতরে দু’জনই জেগে গেলো। ভীতু দৃষ্টিতে তাকালো দু’জন। দুপুরের মা বললেন,

— তামজিদ এসেছে বোধহয়।

— হু।

— কি করবেন?

— কি করব? ও যা চায় করবে। ভয় পেও না। বড়লোকের জুলুম আর কত? ভেবেছিলাম পালিয়ে যাব। সময়টা পেলাম না। মা জেগে যাবে দরজাটা খোলা দরকার।

পেছন থেকে স্ত্রী আটকাতেই মিরাজ সাহেব বললেন,

— আমার মেয়ের অনেক ভুগেছে বুঝলে। আজ থেকে ও শান্তি পাবে। আমাকে মে রে ফেললেও কেউ শাহ’র ঠিকানা বলবে না।

দু’জন দরজা খুলতেই দেখলো এলোমেলো তামজিদকে। চোখ দুটো বিক্ষোভে ভরপুর। তাদের ঠেলে ভেতরে ঢুকেই চিৎকার করে ডাকতে লাগলো,

— দুপুর! দুপুর! বেরিয়ে এসো।

ঘর খালি। দুপুর নেই। কথাটা মাথায় আসতেই তামজিদ ক্ষেপে যায়। দাঁত কিড়মিড় করে মিরাজ সাহেবকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,

— দুপুর কই?

মিরাজ সাহেব নিরুত্তাপ। দাদী ততক্ষণে উঠে আস্তে ধীরে আসছেন৷ তামজিদ দেখলো একবার তাকে। মাথা ঘুরয়ে দাঁত দিয়ে দাঁত কামড়ে চোয়াল শক্ত করে। দ্বিতীয় বার জিজ্ঞেস করে,

— দুপুর কই?

উত্তর আসে না এবারেও। পা দিয়ে সজোরে লাথি মারে তামজিদ। কাঠের চেয়ার উল্টে পড়ে। দাদী বৃদ্ধ স্বরে বলে,

— দাদু ভাই এমন করে না।

তামজিদ তখন উগ্র হলো। ভয়ংকর এক গালি উচ্চারণ করে জিজ্ঞেস করলো,

— বউ কই আমার? আমার দুপুর কই? বের কর? কই ক ব র দিয়েছিস? কবর থেকে টেনে তুলে দিবি! এক্ষণ দিবি!

থরথর করে কাঁপছেন বৃদ্ধা। মিরাজ সাহেব মা’কে ধরে বসালেন। তামজিদের তর সইলো না। হাতটা গেলো পিঠের নিচে। কোমড়ের দিক থেকে পি স্ত ল বের করে তাক করলো মিরাজ সাহেবের দিকে। দুপুরের মা দৌড়ে গিয়ে ঝাপ্টে ধরে তামজিদের পা। হাউমাউ করে কেঁদে বলে,

— বাবা, আব্বা মাফ করে দাও৷ ওনাকে মে রো না। দুপুর নেই। বাবা কথাটা শুনো.. একটু শান্ত হও।

তামজিদ তাকালো না অব্দি নিচে। মিরাজ সাহেবের বুকে পরপর দুটো গু লি ছোঁড়া হলো। র ক্ত ফিনকি দিয়ে বের হচ্ছে। চিৎকার করে উঠলো দুটো নারী। একজন ছেলের জন্য তো একজন স্বামীর জন্য। তামজিদ এগিয়ে এসে ঠান্ডা স্বরে বললো,

— দুপুর চাই আমার যেকোনো মূল্যে।

হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলো ও। ছটফট করছে মিরাজ সাহেব। নিজের বাড়ীতে ঢুকেই এত রাতে তাসরিফে’র দরজায় আঘাত করে তামজিদ। ভেতরে তখন দু’জন ছিলো অঘোষিত প্রেম সাগরে ডুবন্ত। সায়রা অবাক চোখে তাকাতেই দেখলো তাসরিফ হন্তদন্ত হয়ে উঠছে। সায়রা’কে টেনে তুলে নিলো নিজের কাছে। পাশ থেকে ওরনাটা নিয়ে ওর বুকে দিয়ে বললো,

— অপেক্ষা করো, আসছি।

বাইরে তখন চিৎকার করছে তামজিদ,

— দরজা খুল! খোল দরজা! তাসরিফ, ভেঙে ফেলব কিন্তু!

দৌড়ে দরজা খোলা মাত্রই হতভম্ব হয়ে গেলো তাসরিফ। তামজিদের সাদা শার্টে র ক্ত লেগে আছে। ভাইয়ের বুকে হাত দিয়েই অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে,

— কি হয়েছে ভাই?

— দুপুর কই?

— ভাবী? ভাবী তো বাসায় ভাই। তুমি আসার পর থেকে তো আমি যাই না।

গরম মাথায়ও তামজিদ ভাবলো তাই তো, দায়িত্ব তো এখন তার ছিলো। এতদিন দুপুর যায় নি তাহলে আজ কই গেলো?

— তোর বউ কই?

তাসরিফের বুকটা ধুক করে উঠে। এবার আস্তে উত্তর দেয়,

— ভাই, য়রা…

তাসরিফে’র বুকে ধাক্কা দিয়ে উন্মাদ তামজিদ তখন দিন কাল ভুলে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। সায়রা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। পি স্তল এবার ঠেকলো সায়রা’র কপালে। তাসরিফ দৌড়ে এসে সামনে দাঁড়ায়। কাঁপা গলায় জোর দিয়ে ডাকে,

— ভাই!

— এ্যাই সায়রা, বউ কই আমার?

— বিয়ে দিয়েছিলাম তোর কাছে?

সায়রার কণ্ঠে সেই পুরাতন তেজ। তাসরিফ ঘামছে। এটা কি হচ্ছে ও জানে না৷ এভাবে ভাই ঘরে ঢুকতে পারে না৷ কখনোই না৷ মাত্র যদি ও সায়রাকে না ঢেকে যেতো? গা গুলিয়ে আসে ওর। তামজিদ জোড়ালো ভাবে উত্তর দিলো,

— সব শেষ শুধু বিয়েটাই বাকি।

— তাহলে বউ ডাকিস কেন? কাপুরুষের মতো যে ভাইয়ের বসরে ঢুকলি লজ্জা লাগে না? জা নো য়া র পানা বাদ দে এবার। বের হ এখান থেকে!

হঠাৎ আক্রমণ করে বসে তামজিদ। সায়রা’র চুল মুঠ করে টেনে ধরে। তাসরিফ চিৎকার করে উঠে,

— ভাই! ভাই ছাড়ো বলছি। ছাড়ো ওকে। বউ হয় আমার।

কোন ভাবেই তাসরিফ ছাড়াতে পারছে না। সায়রা’কে ফুঁসতে ফুঁসতে তামজিদ বলে,

— তোর ভাইকে দুটো গু লি গিলিয়ে এলাম সায়রা। বাকি দুটো তোর মা আর ভাবীর পেটে দিব। তার আগে বলে দে আমার দুপুর কই?

সায়রা’র ভেতরটা মূহুর্তেই ফাঁকা হয়ে গেলো। ভাই কি বেঁচে আছে আদৌ?
ততক্ষণে তাসরিফ দুই ধাক্কা দিয়ে সরিয়েছে তামজিদকে। জড়িয়ে নিয়েছে সায়রা’কে বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে চিৎকার করে বলছে,

— আমার ঘর থেকে বের হও৷ বের হও ভাই।

সায়রা দেখে উন্মাদ তামজিদ তখনও লাল চোখে তাকিয়ে। তাসরিফে’র বুকে ঠেকেই সায়রা বললো,

— বিয়ে দিয়েছি ভাইঝির। শশুর বাড়ী আছে জামাই এর বুকে।

ঝন করে শব্দ হলো একটা। হাতের পি স্ত ল তখন ফ্লোরে পড়েছে। তাসরিফ শক্ত করে বুকে ধরে রাখলো সায়রা’কে। ওর বুকের ভেতর ভয়ে কাঁপছে। এদিকে তামজিদ জানে সায়রা মিথ্যা বলে না৷ মিথ্যা বলার মেয়ে ও না। কার বুকে ওর পাখিটা? কাকে বিয়ে করলো? আজ-কাল কি জামাই গুলো ভালো? ওর দুপুরের মতো সুন্দর পুতুলের যত্ন নিতে পারবে? যদি আঘাত করে? যদি দুপুরের সুন্দর চোখটার নিচে কালি পড়ে? গোলাপি ঠোঁট দুটো কার আয়ত্তে? তামজিদ ঘামছে। ঘামতে ঘামতে শরীর ছেড়ে বুক চেপে ধরে। তাসরিফ শুধু দেখলো ভেঙেচুরে চুরমার হওয়া ওর বড় ভাইকে। ফ্লোরে তখন সাদা শার্ট পরিহিত শক্তপোক্ত পুরুষটা উল্টো হয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে।
ততক্ষণে বাইরে থেকে সবাই ছুটে এসেছে। সায়রা ছাড়ছে না তাসরিফ’কে। তাসরিফ হতবুদ্ধ হয়ে বসা। সায়রা ওর বুকের মধ্যে ফিসফিস করে বলে,

— ভাইকে মে’রে ফেলেছে। মে’রে ফেলেছে।

তাসরিফে’র ধ্যান ভাঙলো। দৌড়ে গিয়ে সবার সাথে ভাইকে টেনে তুললো। হাসপাতালে রওনা দিলো সবাই। একা বাড়ীতে সায়রা তখন চুপ করে বসা। ঘন্টা পার হলো বোধহয় হঠাৎ ভাবলো লা শ দেখা উচিত। খালি পায়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ীর উদ্দেশ্যে। সেখানে ফ্লোর মুছচ্ছে একজন মহিলা। তাকে সায়রা চিনে। তাসরিফে’র বাড়ীর কাজের লোক। ওর বৃদ্ধ মা বসা তার পাশেই তাসরিফ। সায়রা’কে এই অবস্থায় দেখে তাসরিফ হতবাক হয়ে চেয়ে রইলো অতঃপর ছুটে গেলো। সায়রা’কে ধরে বললো,

— কেন এসেছেন সায়রা? একা একা, জুতা কোথায়?

— লা শ দেখব।

— পা’গল হয়েছেন। আপনার ভাই হাসপাতালে আছেন য়রা। আমি ভর্তি করিয়ে এলাম। আপনার ভাবী আছে সাথে। গুরুতর কিছু না য়রা। দুটো গু লিই পাশ ছুঁয়ে গিয়েছে।

— ইশ! তোমার ভাই নিশানাও লাগাতে পারে না।

— কি বলছেন?

— রোজ রোজ নিয়ম করে মা রা থেকে একেবারে মা রাই ভালো।

— ভাই হার্ট অ্যাটাক করেছে য়রা।

— ম রবে তো?

তাসরিফ দেখছে সায়রা ঠিক নেই। কাজের বুয়ার কাছে দায়িত্ব দিয়ে ওকে নিয়ে বাসায় ফিরলো তাসরিফ। দু’জনেই ফ্রেশ হওয়া দরকার। মনে মনে খুব কঠিন এক সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে তাসরিফ নিয়েছে। সায়রা’কে নিয়ে এ বাড়ীতে থাকবে না ও। কোনভাবেই না৷ তামজিদ এখন থেকে পা গল হয়ে যাবে। বেঁচে থাকলে ও কাউকে বাঁচতে দিবে না। সায়রা’কে এ বাড়ীতে নিরাপত্তা দিতে অক্ষম তাসরিফ। বিয়ে করেছে, বউ ওর। আজকে তামজিদ যা করলো এরপর থেকে সায়রা’কে কোন ভাবেই এখানে রাখা যাবে না।

#চলবে…..

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৬

হাসপাতালের বিছানায় কৃত্রিম অক্সিজেনের সাহায্যে শ্বাস টানছে তামজিদ। বাইরে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন মা৷ চেয়ারম্যান সাহেব চিন্তিত মুখে ডাক্তারের সাথে কথা বলে মাত্র ফিরলেন। ছেলের অবস্থা খারাপ। খবর সুখকর না বরং একটু শোচনীয়। ডাক্তার কড়াকড়ি ভাবে বলেছেন তামজিদকে মানষিক চাপ থেকে বিরত থাকতে কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? দুপুর কাকে বিয়ে করলো, কবে করলো, কিভাবে করলো? প্রশ্ন গুলো মাথায় ঘুরছে। চোখে চোখে তো রাখা হয়েছিলো। মিরাজ সাহেবকে সহ দেখে রাখতেন যাতে মেয়ের বিষয়ে কারো সাথে কিছু বলতে না পারেন। এত খোঁজ, এত খবর মিথ্যা হলো।
শান্ত ভাবে ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। ছেলেটার হার্ট অ্যাটাক শুনে তার বুকেই চাপ দিচ্ছিলো। এখন তো তাও নাহয় ঘুমে আছে, চিন্তা তো তখনকার জন্য যখন এই ঘুম ভাঙবে। কিভাবে সামলাবেন তামজিদকে?
ওকে সামলাতে পারে একমাত্র তাসরিফ। ছোট ভাইকে জানপ্রাণ দিয়ে ভালোবাসে সে কিন্তু আজ তাসরিফ নেই। হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ডাক্তারের হাতে দিয়েই চলে গিয়েছে। কানে খবর এসেছে মিরাজ সাহেবকে নাকি শ্যুট করেছে তামজিদ। লাইন্সেস করা পি স্ত ল তাই বলে রেগে এই কাজ করলো ছেলে? তাসরিফের রাগটাও এবার কঠিন, বাবা হিসেবে এতটুকু তিনি বুঝেন৷ সায়রা’কে খুব ভালোবাসে সে। বউ এর অসম্মান মানবে না তাসরিফ।

ভোরের আলো ফুটছে সবে। চারপাশে কলকাকলীতে মুখরিত। এখনও চোখ খুলে নি তামজিদ। ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। তার ভাষ্য মতে জ্ঞান ফিরবে শিঘ্রই। ঘন্টা খানিক পরই চোখ মেলে তামজিদ। প্রথম প্রায় দশ মিনিট অবুঝের মতো এদিক ওদিক ভ্রান্ত দৃষ্টিতে চাইলো। নিজেকে বুঝার চেষ্টা করলো। মা ছেলেকে দেখে কেঁদে ফেললেন৷ চেয়ারম্যান সাহেব ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তার চেকআপ করছেন তখন। হঠাৎ তামজিদ জোড়ালো কণ্ঠে বলে উঠলো,

— দুপুর এসেছে?

উপস্থিত সকলেই চমকালো এহেন প্রশ্নে। চেয়ারম্যান সাহেবের কপালে ঘাম। ছেলে বলতে কি এটা? এখন যদি দুপুরকে চায় তাহলে কোথা থেকে আনবে? তামজিদ আবারও জিজ্ঞেস করলো,

— দুপুর আসে নি আমাকে দেখতে?

কেউ উত্তর দিতে পারলো না৷ তামজিদ একে একে সবাইকে দেখছে। মা, বাবা, ডাক্তার, সাদা কাপড়ে দু’জন নার্স। চোখটা দরজা সহ মাথার উপর সাদা দেয়াল সবই দেখলো। দেখলো না শুধু দুপুরকে। চোখের খায়েশ তার মিটছে না। পলক ঝাপটায় তামজিদ। হাতে তখনও ধীর গতিতে স্যালাইন চলছে। উঠে বসতে চাইতেই বাঁধা দিলো ডাক্তার। তামজিদ শুধু গরম চোখে তাকালো। ডাক্তার ছাড়লেন না। পূর্ব পরিচিত তামজিদে’র। জোর খাটিয়ে বললেন,

— শুয়ে থাক তামজিদ।

— সর।

— কোথায় যাবি তুই?

— দুপুরের কাছে।

চেয়ারম্যান সাহেব এগিয়ে এসে ছেলের হাত ধরলেন৷ বুঝানোর ভঙ্গিতে বললেন,

— দুপুর তো নেই বাবা। তুমি শান্ত হও। চাপ নিও না এখন।

তেঁতে উঠে তামজিদ। নেই মানে? কেন নেই? তারা কেন দেখে রাখলো না? রেগে হাতের ক্যানোলা টেনে খুললো ও। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাচের পানির জগটা ছুঁড়ে মা রলো ফ্লোরে। দুই পা পেছালো৷ সকলে। রাগে অদ্ভুত ভাবে গুঙিয়ে কাঁদছে তামজিদ। মা এগিয়ে এলেন৷ তামজিদে’র হাতটা ধরবেন তার আগেই হুংকার দিয়ে উঠে ও। চিৎকার করে বলে,

— দেখে রাখো নি কেন? কেন দেখে রাখলে না? কোথায় খুঁজব ওকে আমি?

নিজের কোমড়ের দিকে হাতড়ে পি স্ত ল খুঁজলো। না পেতেই রাগী স্বরে জিজ্ঞেস করে,

— পি স্তল কোথায় বাবা?

— তামজিদ বাবা কথা শোন৷ এখন এমন করো না।

তামজিদ হন্তদন্ত হয়ে পি স্তল খুঁজে। রাগে গজরাতে গজরাতে বলে,

— মিরাজকে খু ন করব আমি৷ ওকে খু ন করে দিব৷ দুপুর ওর বাবার লা শ দেখতে তো আসবেই। ওখান থেকেই লুকিয়ে ফেলব ওকে। ওকে আসতে হবে বাবা৷ দুপুরকে আসতে হবে। ও জানে তো আমি ওকে কতটা চাই।

চেয়ারম্যান সাহেব ছেলের হাতটা ধরলেন শক্ত করে। বুঝানোর মতো বললেন,

— মিরাজ সাহেবকে তুমি দুটো গু লি করেছো তামজিদ।

— ম রার মতো করি নি৷ ওর বুক ঝাজড়া করব আমি। কত সাহস! আমার দুপুরকে বিয়ে দেয়….

“দুপুরকে বিয়ে” কথাটা বলতে গিয়ে কণ্ঠনালী অদ্ভুত ভাবে কাঁপলো তার। বুকের ভেতর চিনচিন করে ব্যথা হচ্ছে। সেই ব্যথা বলে কয়ে ধীরে ধীরে বাড়ছে। বেড থেকে হুরমুর করে নামতে গিয়ে মুখ থুবড়ে নিচে পড়লো তামজিদ। দৌড়ে সবাই ধরতে ধরতে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো ও। বুকে হাত চেপে কাঁদছে সে। ভালোবাসা হারানোর কান্না। কাছে পেয়ে হারিয়ে ফেলার কান্না। এক অদ্ভুত ব্যথা যা চোখে দেখা যায় না অথচ ম র ণ যন্ত্রণা দিয়ে যায় অন্তঃপটে। ছেলের কান্নায় চেয়ারম্যান সাহেব অসহায় হলেন৷ ডাক্তার ওকে থামাতে চাইলেও পারছেন না। উন্মাদ হয়ে উঠে তামজিদ। ওয়ার্ড বয়রা ধরতে আসলেই হাতের কাছের জিনিস ছুঁড়ে দিচ্ছে। ওকে সামলানো কঠিন। কারো কথা না শোনা তামজিদ’কে এখন সামলানো একটু বেশিই কঠিন।

তখনই ত্রস্ত পায়ে কেবিনে আসে কেউ। দুই হাঁটু গেড়ে বসে জড়িয়ে ধরে তামজিদকে। ছোট ভাইয়ের বুকে মুখ গুজে কাঁদে তামজিদ। তাসরিফ চোখের ইশারায় ডাক্তারকে ঘুমের ইনজেকশন দিতে বলে। তামজিদ ছোট ভাইয়ের বুকে তখন অদ্ভুত সেই ভঙ্গিতে কাঁদছে। মুখে তার শত অভিযোগ দুপুরকে ঘিরে।

— অ্যই তাসরিফ, তুই জানিস না ওকে আমি কতটা ভালোবাসি? দুপুর তো জানে৷ ও আমাকে ছাড়লো কিভাবে? ভুলে গেলো কিভাবে? ও কার কাছে থাকে ভাই? কার কাছে থাকে?

আবার কাঁদে তামজিদ। বুকে হাত চেপে রাখে। অভিযোগ তুলে পুণরায়,

— তুই জানিস না আমার দুপুরটা বোকা? ও তো যাকে তাকে বিশ্বাস করে বসে থাকে। ওকে বিয়ে দিলো কিভাবে? ভালো-মন্দই তো বুঝে না ও। আমার দুপুর… আমার দুপুর… অ্যই তাসরিফ আমাকে দুপুর এনে দে। দুপুর চাই আমার তাসরিফ… ওকে এনে দে না। দে নারে ভাই। আমার বুকটা কেমন জানি করছে তাসরিফ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। দুপুর এনে দে আমাকে। দু…পু…র এ..নে দে।

তাসরিফে’র বুকেই ঢলে পড়লো ও। পাঁজা কোলে তুলে বেডে রাখতেই ডাক্তারটা রুম শিফট করলেন কারণ ততক্ষণে তামজিদে’র অবস্থা খারাপ হয়ে গিয়েছে। শ্বাস টান উঠেছে। উত্তেজিত হওয়াতে বুকের চাপ বেড়েছে। মেঝেতে বসে পরলেন মা। র ক্ত শূন্য মুখে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন স্বামীকে,

— আমার তামজিদ বাঁচবে তো?

________________________

মুখে পানির ছিটেফোঁটা পড়তেই চোখ মেলে তাকালো দুপুর। খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে শাহ। দুপুর কপাল কুঁচকে জোড়ানো গলায় বলে,

— ঘুমাব শাহ।

— সংসার করবেন না দুপুর?

— হুউ।

— তাহলে উঠুন।

— ঘুম হয় নি তো।

শাহ থামলো না৷ এগিয়ে এসে ভেজা চুল গুলো ঝাড়লো ওর মুখের উপর। বালিশে মুখ গুজে দিতেই দুপুরের উন্মুক্ত কাঁধে নিজের ঠান্ডা হাত রাখে শাহজেব। লাফিয়ে উঠে দুপুর। চোখ দুটো রসগোল্লার মতো করে তাকিয়ে বলে উঠে,

— কি চাই?

— নাস্তা সাথে হালকা পাতলা একটা রোম্যান্টিক কিস্সি। সে-ই সাথে একটু জড়িয়ে ধরে বিদায় আর আমার ফেরার অপেক্ষা করা একটা বউ।

দুপুরের মনটা ভীষণ খারাপ হলো। নিজে জোরজবরদস্তি এখানে এলো। মুখের বুলি ছিলো সংসার করবে অথচ প্রথম দিন ই কি না নাস্তা বানাতে পারলো না। ওর উদাস মুখ দেখে শাহ ঝুকলো। কপালে ঠান্ডা একটা ছোঁয়া দিয়ে বললো,

— মন খারাপ করে লাভ নেই পাখি। আ’ম ওয়েটিং।

দুপুর বিছানা ছাড়লো৷ শাহ ওর হাত টেনে নিজের কাছে নিলো। কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— মন খারাপ করে লাভ নেই৷ গাড়ি এক ঘন্টা পর আসতে বলেছি।

দুপুরের মুখটা জ্বলজ্বল করে উঠলো। দৌড়ে বাথরুমে ঢুকতেই পেছন থেকে শোনা গেলো,

— কাল থেকে একা গোসল করতে পারব না দুপুর। বউ চাই আমার।

দুপুর মনে মনে মুখটা লাজুক করে বললো,

— কালো চাঁদের সখ কত।

একা হাতে শাহ’র জন্য রুটি আর ডিম করলো দুপুর। চা বানিয়ে টেবিলে দিতেই শাহ বললো,

— বসো আমার সাথে।

— আপনি আগে…

— বসতে বলেছি।

দুপুর বসা মাত্রই রুটি ছিড়ে ওর মুখে দিলো শাহ। দুপুর নরম চোখে তাকিয়ে রইলো। শাহ তখন চোখ টিপে। টিটকারি দিয়ে বলে,

— দুপুরেও দুপুর চাই আমার দুপুর। দুপুর চন্ডী ফুটাতে আমার বেশ লাগে।

দুপুর উঠে দাঁড়ালো। গটগট করে চলে গেলো রুমে। শাহ এদিকে হাসছে। খেতে খেতেই বলছে,

— গাড়ি আসছে দুপুর। আমার জুতা দাও।

#চলবে..