সে জন সোনা চিনে না পর্ব-১৯+২০

0
14

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৯

হৃষ্টপুষ্ট এক পুরুষ দেহ লেপ্টে বিছানায়। মুখটা গুজে রাখা নরম এক বালিশে। পুরুষটার মুখের একপাশ ঢেকে থাকলেও আরেক প্রান্ত দৃশ্যমান। চোখের নিচে কালো দাগটা যেন এক স্পষ্ট প্রমাণ তার নির্ঘুম রাতের। দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে বাইরে থেকে কেউ। সারারাত না ঘুমানো মস্তিষ্ক তখন তোয়াক্কা করে না কারো ডাকের। দরজাটা খট করে খুলে আপনাআপনি। ভেতরে আসে তাসরিফ। সূর্য এখন মাথার উপরে। তামজিদ কাল রাত থেকে বাড়ী ফিরে নি৷ আজ সকালে এসেছে। সারাটা দিন রাত এক করে সে খুঁজে যাচ্ছে দুপুরকে। তাসরিফ এই একমাস ধরে ভাইকে হাজার বার বুঝানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ। এই ব্যার্থতা বর্ণনাতীত। ইাশারায় কাজের মেয়েটাকে খাবার টেবিলে রাখতে বলতেই সে রেখে যায়। তাসরিফ গিয়ে তামজিদের পাশে বসে। খোলা পিঠে কিসের এক আঘাতের চিহ্ন, দেখেই বুকটা ধ্বক করে উঠে ওর। ড্রয়ার খুলে একটিসেপটিক লাগিয়ে ডাকে,

— ভাই, ভাই? উঠো।

তামজিদ নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে যাচ্ছে। এদিকে ওর ঔষধ বাকি। ইদানীং ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিচ্ছে। হুটহাট রাস্তা হারিয়ে ফেলে থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকে ও। গত একমাসে চারবার ঘটেছে এই কাহিনি। এলাকায় হলে এক কথা কিন্তু তামজিদ কাউকে না বলে কিছুদিন আগে চট্টগ্রাম গিয়েছে। এই খবর পেয়েছে তাসরিফ কিন্তু আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে নি ভাইকে। ডাক্তার ওর অবস্থা দেখে ব্রেইন স্টকের সম্ভাবনা প্রকাশ করলেও তামজিদ বিশেষ পাত্তা দিচ্ছে না৷ ও নিজের মতো চলছে। এলোমেলো।
তাসরিফ গায়ে হাত বুলিয়ে ডাকলো ভাইকে। এবার একটু আধটু চোখ খুলে তামজিদ। তাসরিফ’কে দেখেই হাসে। বলে,

— ঘুমাস নি?

— দুপুর এখন ভাই…..

কথাটা বলতেই ঝট করে উঠে বসে ও৷ চোখে দেখা যায় এক অদৃশ্য উন্মাদনা। তামজিদ’কে কিছু বলতে না দিয়েই তাসরিফ বলে উঠলো,

— বেলা হয়েছে অনেক। খাবে। উঠো। মুখ ধুয়ে এসো তো ভাই। আজ সায়রা নাস্তা বানিয়েছে।

তামজিদ কিছু একটা মনে করে উঠে যায়৷ মুখ মুছতে মুছতে ফিরে আসে। খেতে বসে বলে,

— তুই ভালো আছিস তো তাসরিফ?

ভাইয়ের প্রশ্নে সামান্য থতমত খেলো ও৷ ভালো থাকা আসলে কাকে বলে? যদি ভালোবাসার মানুষকে কাছে নিয়ে থাকা ভালো থাকা হয় তাহলে তাসরিফ ভালো আছে। যদি প্রতিরাতে ভালোবাসার মানুষের বুকে মাথা রেখে ঘুমানো ভালো থাকা হয় তাহলেও তাসরিফ ভালো আছে। কিন্তু যদি প্রিয় মানুষটা নিজেকে খোলসে পুরে নেয়, যদি মানুষটা এক নিরেট পাথরে রূপান্তরিত হয়ে যায়, যদি তার মাঝে এক আকাশসম অভিমান জমে থাকে তাহলে কি ভালো থাকা যায়?
সায়রা’কে ও নিজের কাছে আটকে রেখেছে। শিকলটা দেখা যায় না যদিও কিন্তু সে তালাবন্ধ তাসরিফে’র হাতে। কথাটা ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো ও৷
বললো,

— ভালো আছি ভাই।

— সায়রা একটা ভালো মেয়ে।

— জানি।

— জানিস না। ও কিন্তু চাইলেই ফেলে চলে যেতো বল কিন্তু দেখ গেলো না। আচ্ছা, ও কি জানে দুপুর কোথায় আছে?

স্বাভাবিক। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই করলো প্রশ্নটা। তাসরিফ ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। মাথা নেড়ে বললো,

— একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ জানে না বললো।

— আর জিজ্ঞেস করিস না। আমি খুঁজে নিব।

— হুম৷

— বাবা’র সাথে ঐ সাইডের ব্যাবসাটা দেখিস কিছুদিন। দুপুর আসুক এরপর আমিই সামলে নিব।

তাসরিফ মাথা নাড়ে। ওদের অস্ত্রের ব্যাবসা আছে কিন্তু সেগুলো সম্পূর্ণ বৈধ। এই দিকটা তামজিদ নিজে সামলায়। মালোশিয়া থাকাকালীনও ওখান থেকে এখানে সমলাতো। তাসরিফ শুধু মাঝেমধ্যে যেতো। নিজের কোটি টাকার ব্যবসা যে তামজিদ এভাবে হেলাফেলা করবে তা ভাবতে পারে নি তাসরিফ। ভাইকে খায়িয়ে ঔষধের মধ্যে ঘুমের ঔষধটা লুকিয়ে খাওয়ালো তাসরিফ। কিছুক্ষণ কথা বলে বের হতেই তামজিদ হাসলো। তাকে কি ভাবে সবাই? ঘুমের ঔষধ খাওয়াবে আর ও জানবে না।
আস্তে ধীরে উঠে বারান্দায় দাঁড়ায় তামজিদ। সুদূর আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে। ঘন ঘন মেঘ দেখে একা একা অভিযোগ তুলে,

— তোমাকে আমার কাছে আনতে হবে দুপুর। তুমি যেখানেই আছো খারাপ আছো৷ আমার মন বলে তুমি খারাপ আছো। আমি বাদে কেউ তোমাকে ভালো রাখতে পারবে না।
________________________

দুপুর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে চারপাশ। ওর চোখের দেখা ভুল হোক। দুপুর খুব করে চায় ভুল হোক সবটা। ড্রয়িং রুম থেকে আবার বরাবর সেই বন্ধ দরজায় তাকায়। একটু আগে সে ঐ রুমে গিয়েছিলো। নিজের জীবনে সে ঘৃণা বলতে দুপুর দুটো জিনিসকে করে। এক অস্ত্র, দুই পুলিশ। ঘৃণিত দুটো জিনিস একসাথে দেখে দুপুর হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজের কাছে আজ মনে হচ্ছে জীবনটা তার জন্য না। অন্তত এই পৃথিবী তার জন্য না। হাত পা আরেকটু গুটিয়ে নিলো দুপুর। বাড়ী ফিরে তখন শাহ ভাতের পানি ঝাড়াচ্ছে। দুপুর কাঁদতে ভুলে গেলো। ওর কান্না কেন পাচ্ছে না?
ঘৃণিত দুটো জিনিস সে একসাথে পেলো তাও কি না নিজের অস্তিত্বের সাথে মিশে থাকা মানুষটার মাঝে। নিয়তি এত কেন নিষ্ঠুর হবে? দুপুরকে আর কত পরীক্ষা দিতে হবে? আর কত দুপুর এভাবে জ্বলে জ্বলে ম র বে? যাকে নিজের দুনিয়া বানালো সেই মানুষটার মাঝেই যখন কলঙ্ক পেলো তখন গতি কি ই বা থাকলো দুপুরের?
নিজের মাথায় কারো হাত টের পেলেও দুপুর হাঁটু থেকে মাথা তুলে না। ও জানে সামনের মানুষটা কে। এই মূহুর্তে শুধু নিজের ফুপি বাদে কারো কথা মাথায় আসে না দুপুরের। তার মন চাইছে ছুটে যেতে তার কাছে। ফুপিকে জানাতে কত বড় প্রতারণা হয়েছে দুপুরের সাথে।

— উঠো ফ্রেশ হয়ে এসো দুপুর।

দুপুর নড়ে না। শাহ ওর পাশে বসে। গা ঘেঁষে। দুপুর নিরুত্তাপ। শাহ ওর পিঠে নিজের হাতটা রেখে বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— দিন গড়াচ্ছে সোনা। চলে এসো।

দুপুর তখনও অবশ্য নড়ে না। শাহ ওকে সেখান থেকে কোলে তুলে। পা বাড়ায় গোসলের উদ্দেশ্যে। পানির প্রতিটি বিন্দু আজ যেন বলে কয়ে যাচ্ছে দুপুরকে। মাথাটা ঝিম মে’রে আছে। শাহ ওকে কখন বের করলো, কখন খাওয়ালো দুপুর কিছুই টের পেলো না। এই যে এখন দুপুরকে জড়িয়ে বুকের মধ্যে নিয়ে শুয়ে আছে দুপুর তো তাও অনুভব করতে পারছে না৷ যেই শাহ’র বুকে এতটা দিন দুপুর সুখ খুঁজলো সেই শাহ থেকে পাওয়া সবচাইতে বড় ধোঁকায় দুপুর সিটিয়ে আছে। কথা বলার ভাষা ওর জানা নেই যেন।
আজ সকালে শাহ যাওয়ার পর দুপুর কৌতুহল বশত ঐ ঘরটা খুলে। খোলা সহজ ছিলো না অবশ্য। আজ তারাহুরোয় শাহ চাবিটা টেবিলে রেখে চলে গেলো। দুপুর সারাদিন কাজ করলেও চাবিটাকে মাথা থেকে সরাতে পারলো না। অগত্যা রুম খুলে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে সাধাসিধা একটা রুম৷ খাট, আলমারি আর পড়ার টেবিল। বিসিএস সহ নানান বই। দুপুর কৌতুহলী হয়ে হাতায় কিছুক্ষণ। খাটে বসে কিছুক্ষণ বই ঘাটে অতঃপর গিয়ে আলমারি খুলে। ভাজে ভাজে অনেক পোশাক রাখা। দুপুর দেখে মাঝ বরাবর একটা ড্রয়ার৷ টান দিতেই খুললো। দুপুর হতবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো। সেখানে রাখা পুলিশের ইউনিফর্ম সহ গান। দুপুর তখনও তেমন কিছু ভাবলো না কিন্তু হাতে এলো নানান সময়ে ট্রেনিং থেকে শুরু করে নানান ছবি। সবগুলোয় শাহ আছে। বিভিন্ন মেডেল সহ শাহ’র ছবি। দুপুর সেগুলো দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। এক ঘন্টা, দুই ঘন্টা, কতটা সময় দুপুর জানে না। শাহ এসে কলিং বেল দিলেও দুপুরের কানে তা ঢুকে নি। নিজের কাছে থাকা চাবি দিয়ে খুলেই শাহ ঢুকেছে। বরাবর রুমটা খোলা দেখে দুই মিনিট দাঁড়িয়ে যায় ও অতঃপর ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে পা বাড়ায় সেই রুমে। তার ভাবনায় যা ছিলো তাই ঘটেছে। দুপুর সব দেখেছে। এই জিনিস গুলো শাহ বেশিদিন লুকাতে পারতো না যদিও তবুও ও চায় নি এভাবে জানুক দুপুর। শাহ সেখান থেকে ওকে ধরে বের করে ড্রয়িং রুমে বসায়। ঐ ঘরটায় সব গুছিয়ে পুণরায় লক করে তবে এবার তালা ঝুলায় না। যা জানার দুপুর জেনেছে। শাহ ওর কাছে হাঁটু গেড়ে বসে কিছু বলে, দুপুর শুনে না। চুপচাপই থাকে।

দুপুর চোখ বুজে আছে। শাহ বুঝলো ঘুমিয়েছে। ফোনটা হাতে নিয়ে কল করলো মিরাজ সাহেব’কে। ওপাশ থেকে যা শোনা গেলো তার জন্য শাহজেব প্রস্তুত ছিলো না। ফোনের ওপাশে কাঁদছে সন্ধ্যা। ফোনটা ইফাত হাতে নিলো। শুধু বললো,

— দুপু’কে নিয়ে আসবেন একটু?

শাহজেব হতভম্ব ভাব নিয়েই উত্তর করে ছোট করে,

— হু।

#চলবে…..

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২০

বোকা বোকা চোখে এদিক ওদিক তাকিয়ে আছে দুপুর। সন্ধ্যা ছোট বোনকে দুই হাতে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছে। দুপুরের মস্তিষ্ক নিশ্চল। বুঝে উঠতে পারছে না এখনও কি হয়েছে। ঐ তো শাহ ওকে আস্তে ধীরে ডেকে তুললো এরপর বোরকা পরালো। গাড়ি আসতেই ওরা তাতে চড়ে বসলো। গাড়ি থেকে যখন নামতে বললো দুপুর তখন ভয়ে ভয়ে এদিক ওদিক তাকায়। শাহ অভয় দিয়ে ওকে বের করে। দুপুর দেখলো জায়গাটা ওর অচেনা কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ইফাত ওর চেনা। খুব কাছের একজন মানুষ সে। দুলাভাই নামক মানুষটা দুপুরকে দূর থেকে আগলে আগলে রেখেছে কতগুলো বছর। ফোনালাপেই কত কত সমস্যা সে সমাধান করলো। ইফাত এগিয়ে আসে। দুপুরকে যেতে বলে ওদের সাথে। ঐ তো দুপুর তার শাহ’র হাত ধরে ঢুকলো। এখনও ও দাঁড়িয়েই আছে। অবাক হয়ে। সৌন্দর্য যদি অভিশাপ হয় তাহলে সেই অভিশাপে জলজ্যান্ত মানুষ কয়লা হয়। দুপুর খুব করে ভাবলো, সে কেন ম র লো না? চোখের সামনে দেখে এলো ও তিনটা দেহ। তার কত প্রশ্ন ছিলো মায়ের জন্য জমা। কেন দুপুর বঞ্চিত ছিলো আদর থেকে? কেন মা বিশ্বাস করতো না তাকে? কিসের দায় ছিলো তার? উত্তর গুলো দেয়ার জন্য আজ মা নেই। বাবা নেই। দুষ্ট সেই দাদীটাও নেই।দুপুর বিরক্ত চোখে সন্ধ্যাকে দেখে। ও কেন কাঁদছে এভাবে? কানে বিঁধছে ওর চিৎকার।
শাহ দুপুরের দিকে তাকিয়ে আছে। ও বেশ চিন্তিত। দুপুরকে এখানে বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবে না কিন্তু এখন এখান থেকে যাওয়াটাও তো সমীচীন হবে না।

তখনই হাসপাতালে দুটো ছুটন্ত পা ধেয়ে আসে। দুপুর দেখে শাড়ী পরিহিত ওর মা আসছে যার পেছনে তাসরিফ ছুটছে। না না, মা না সে।
ফুপিকে এই মূহুর্তে পাগলের মতো দেখাচ্ছে। তাসরিফ পেছন থেকে আচমকাই ওর হাত টেনে ধরলো। মুখ থুবড়ে পরতে পরতে বাঁচলো সায়রা। সায়রা নিজেকে ছাড়িয়ে দৌড়ে আসে। দুপুর সন্ধ্যা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। সায়রা ঝড়ের বেগে এসে দুপুরকে আগলে নিলো। জড়িয়ে নিলো বুকের মধ্যে। দুই গালে অসংখ্য চুমু দিয়ে বলতে লাগলো,

— ঠিক আছিস সোনা? দুপু, ফুপির কলিজা, তুই ঠিক আছিস না?

— ফুপি?

ফুপিয়ে উঠে দুপুর। সায়রা ঢোক গিলে। এখনও দেখে নি ও কাউকে। উত্তর করে ও,

— হু।

— আব্বু নেই ফুপি। আম্মু, দাদী কেউ নেই।

শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরে সায়রা। ভেতর ফেটে আসা কান্না চেপে রাখে। দুপুর তখন নিজের আবরণ থেকে বেরিয়ে আসে। চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ওর কান্নায় ছটফট করে কেউ। এই মূহুর্তে ঠিক হচ্ছে না কাঁদা। একদমই না৷ মানব ছায়া আরো একটিবার ভেঙে যায়। কারো কান্নায় নিজের কেন এমনটা লাগবে? সায়রা ছাড়ে না দুপুরকে।

জানাজার ব্যবস্থা করলো শাহ আর ইফাত। এ বাড়ীতে ছেলে বলতে আর কেউ নেই। ওদের দৌড়াদৌড়ির মাঝে হাসপাতালের ফর্মালিটি সব তাসরিফ পালন করলো। অ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ তিনটা যখন নেয়া হলো তখন তাসরিফ সায়রা’কে অনেক চেষ্টা করলো তার মা, ভাই আর ভাবীকে দেখাতে কিন্তু সায়রা যাবে না। কিছুতেই যাবে না। তাসরিফে’র মন চাইলো ওকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। একটু স্বান্তনা দিতে কিন্তু পারলো না। সম্ভবই হলো না। ইফাত এসে সন্ধ্যাকে টেনে তুললো। কিছুতেই উঠবে না ও। নিজের বুকের মধ্যে ঠেস দিয়ে ওকে নিয়ে গাড়িতে তুলে ইফাত। ফিরে এসে শাহ’কে বলে,

— দুপু আর ফুপিকে নিয়ে যাই। জানাজার সময় হচ্ছে।

— আমি দেখছি।

শাহ এগিয়ে আসে। সায়রা’র সামনে দাঁড়িয়ে দুপুরকে আস্তে করে বলে,

— দুপুর, উঠে এসো সোনা।

দুপুর তখনও সায়রা’র বুকে। শাহ নিজের হাতটা ওর মাথায় রাখে। পুণরায় ডাকে। দুপুরকে নিয়ে শাহ সরে যায় সেখান থেকে। তাসরিফ বসে সায়রা’র মুখ বরাবর। চিকন হাতটা নিজের হাতের মাঝে নেয়। অনুরোধ করে বলে,

— একটাবার দেখে নিন য়রা। আর কখনো সুযোগ হবে না।

ফ্যাচফ্যাচে কণ্ঠে সায়রা বললো,

— তাদের আমি কখনো মৃত কল্পনা করি নি। করতে চাই না।

— যদি আফসোস হয়….

— যাদের মৃত্যু আমি এই পর্যন্ত শতবার কামনা করেছি তাদের জন্য আফসোস কেন করব? তারা তো মুক্তি পেলো। শুধু আমি বাকি।

— য়রা!

টলমলে চোখে তাকালো সায়রা। তাসরিফ ওর হাতটা আরেকটু চেপে ধরে। সাহস করে নিজের বুকে টানে। সায়রা এলো। বুকে মাথা রেখে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। গুমরে কেঁদে উঠলো। তাসরিফ ওকে ধরে রাখে নিজের সাথে। ছাড়ে না। এই প্রথমই হোক ওকে নিজের করে ধরেছে ওর য়রা।

__________________________

আজ বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। চট্টগ্রামে তিনটা কবর খনন করা হয়েছে। তিনটা জীবিত মানুষ যারা পালাতে চেয়েছিলো এক রাজ্য থেকে, কে জানতো তারা হারিয়ে যাবে এই জগৎ থেকে। ছোট্ট জীবনটার সার্থকতাও খুব ক্ষুদ্র। এই তো বৈরী আবহাওয়ায় একটা ট্রাক ধাক্কা দিলো প্রাইভেট গাড়িটাকে। হারিয়ে গেলো চারটি জীবন পৃথিবী থেকে। তাদের মাটিতে চাপা দিয়ে লোকালয়ে ফেরত এসেছে সকলে কিন্তু রেখে এসেছে তাদের সেই অন্ধকারে। যেখান থেকে কেউ ফেরত আসে না।

দুপুরকে কেউ খাওয়াতে পারছে না। হঠাৎ পা’গ’লামো বাড়ছে ওর। বাইরে প্রচন্ড বৃষ্টি। ঝড়ের আঘাতে গাছপালা উল্টে পরছে। সায়রা বারংবার চেষ্টা করেও থামাতে পারছে না৷ দুপুর খাবে না৷ চিৎকার করে কাঁদছে। বারবার বলছে,

— বাবার কাছে যাব ফুপি। আমাকে বাবা এনে দাও। বাবা এনে দাও আমাকে ফুপি।

সন্ধ্যা কাঁদছে হুহু করে। শাহ না পেরে দুপুরকে জোর করবে তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে ও। শাহ বিচলিত হলো। জ্ঞান হারালো কেন? এই সময়ে দুপুরের জ্ঞান হারানোটা একদমই ঠিক হচ্ছে না। ওকে নিয়ে পাশের একটা রুমে চলে যায় শাহজেব৷ মুখে পানি ছিটায়। সায়রা কপাল চেক করে দেখে জ্বর আসছে। মাত্রই বলতে নেয়,

— ওকে খায়িয়ে এন্টিবায়োটিক দিতে হবে….

শাহ যেন তেতে উঠে,

— না, না এন্টিবায়োটিক দেয়া যাবে না। এভাবেই উঠবে।

বলেই দুপুরকে ডাকতে থাকে। দুপুর একটু চোখ খুলতেই সায়রা তারাতাড়ি খাবার আনতে যায়। শাহজেবে’র যেন শ্বাস ফিরে এলো। দুপুরের গাল দুটো আঁকড়ে ধরে চিন্তিত গলায় বলে,

— খাবার এলে চুপচাপ খাবে দুপুর। কোন কথা না।

— আমি খাব না। আপনি বাসায় চলে যান শাহ।

শাহ অদ্ভুত এক দৃষ্টিতে তাকালো। দুপুরের ভেতর কাঁপে সেই দৃষ্টিতে। শাহ’র নরম হাতের এক স্পর্শ তখন দুপুরের উদরে। দুপুর চমকে উঠতেই শাহ খুব ধীরে বললো,

— খেতে যে হবেই।

দুপুর চোখের পানি ছেড়ে দিলো। শাহ ওকে ধরে উঠাতেই দুপুর সরে বসে। আস্তে করে জিজ্ঞেস করে,

— বাবা কেন আপনার সাথে আমার বিয়ে হতে দিলো শাহ? আমার উত্তর চাই। বাবা নেই কেন শাহ? কেন নেই?

দুপুরের কান্নার বেগ বাড়ছে তখন, পাল্লা দিয়ে বাজছে ফোনটা। শাহ’র বাসা থেকে ফোন আসছে বারবার। আবহাওয়ার জন্য তারা আসতে পারে নি৷ এখনও চেষ্টা করছে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। সায়রা তখন খাবার নিয়ে ঢুকেছে। খুব সামান্য খাওয়ানো গেলো ওকে। সায়রা’কে ধরেই কাঁদছে দুপুর। শত হাজার অভিযোগ কাকে দিবে দুপুর? কে শুনবে এই অভিযোগ?
.
শাহ বাইরে কোথাও গিয়েছিলো। ফিরলো মাত্র। সায়রাকে বললো,

— আপনি বিশ্রাম করুন এখন একটু। ওকে আমি দেখছি।

দুপুর ছাড়ে না সায়রাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদে। সায়রা জিজ্ঞেস করে,

— ও কি অসুস্থ।

শাহ চোখ নামিয়ে নিতেই এত দুঃখে সামান্য হাসলো সায়রা। মনে মনে বললো, “একটুর জন্য নিজের এক মেয়ের সুখের সাক্ষী হলে না ভাইয়া। তোমার জন্য খুব করুণা হয় আমার।”

সায়রা যেতেই শাহ দরজা আটকে দিলো। দুপুর ওর দিকে তাকাচ্ছে না৷ শাহ গায়ের ভেজা শার্টটা খুলে রেখে খালি গায়ে বসলো ওর সামনে। দুপুরের গাল ধরে মুখটা নিজের দিকে ফেরালো। আলতো হাতে চোখটা মুছে দিতে দিতে বললো,

— এত ঘৃণা আমাকে দুপুর?

— আমার উত্তর চাই শাহ।

— নাহয় কি করবে? ছেড়ে দিবে তোমার শাহ’কে।

দুপুর টইটুম্বুর চোখে তাকালো। শাহ ওর নরম গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— না চাইতেও আমাদের অনেক কিছু মেনে নিতে হয় দুপুর। তুমিও মেনে নাও যেভাবে মেনে নিয়েছিলে আমার গায়ের রং।

দুপুর হঠাৎ চোখ নামালো। শাহ বললো,

— কালো বলে জীবনে কত জায়গায় আটকালাম দুপুর অথচ দেখো এই কালো চাঁদের ঘরে চাঁদমুখের তুমি। কালো বলে তো তুমিও বিয়ে করতে চাও নি। সুন্দররা কখনোই অসুন্দরদের মেনে নেয় না কিন্তু তুমি নিয়েছো। বিয়ের রাতেই নিয়োছো। স্বার্থ কিছুটা তোমারও ছিলো দুপুর। কিছুটা হয়তো আমার।

— আমিই…

— শু…. আমি জানি কি বলবে কিন্তু এটা মেনে নাও দুপুর, তুমি নিজেকে বাঁচাতেই আমাকে বিয়ে করেছো। সৌন্দর্য বৈ তেমন কিছুই নেই। অমান্য করবে? না পড়াশোনা না সাংসারিক গুন। আমি মেনে নিলাম তো দুপুর। তুমিও নাহয় মেনে নাও।

দুপুর তিক্ত সত্যিটা শুনে চুপ করে গেলো। আসলেই তো সুন্দর মুখটা বাদে সে তেমন যোগ্য কেউ না যাকে পেতে এত তামঝাম হবে। শাহ’র বউ হওয়ার যোগ্য তো একেবারেই না।
ওকে চিন্তিত দেখে শাহ নিজের কাছে টানলো। দুপুর ধীরে ধীরে শুধু বললো,

— যেই অ’স্ত্রর ভয় আমার জীবন নরক করেছিলো সেই অ’স্ত্রই কি না কপালে এলো শাহ? আমার বাবা কত কত পুলিশের কাছে দৌড়ালো শাহ। কেউ সাহায্য করে নি। নানা ভাবে লাঞ্ছিত করে তাড়িয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ফেরত আসতো বাবা৷ ক্ষমতা আর টাকা পুলিশের ইউনিফর্ম ক্রয় করতে পারে শাহ। তারা জঘন্য হয়। খুব খারাপ হয়। আমি ঘৃণা করি তাদের। সবাইকে।

ঘৃণিত সেই পেশায় জড়িত মানুষটার বুকেই দুপুর কাঁদছে। শাহ জানে এই কথা। মিরাজ সাহেব জেনে শুনেই মেয়ের ভালো চাইতেই শাহ’র সাথে বিয়ে দিয়েছিলো। পরিচয়টা হয়েছিলো শাহ’র বাবা’র অফিসে। পুরাতন কলিগ সবটা শুনে সাহায্যই করেছিলো একপ্রকার। শাহ শুরুতে রাজি ছিলো না৷ আগুন সুন্দরী এই মেয়ে। তার মতো কালো কাউকে কেন বিয়ে করবে? তার মধ্যে পড়াশোনায় মোটামুটি। শাহ অবশ্য জানতো না এই মেয়ে ছোট বেলায় কতটা মেধাবী ছিলো। তার সৌন্দর্যই তাকে ধ্বংস করেছে। ঠেলে দিয়েছে অন্ধকারে।
শাহ ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— সুন্দরী মেয়েদের ভাগ্য খুব খারাপ হয় দুপুর। খুব খারাপ।

_______________________

জানালাটা মাত্রই খুললো সায়রা। সন্ধ্যা’কে ইফাত ঘুম পারালো মাত্র। সায়রা চমকে তাকালো বাড়ীর গেটে। সেখানে বৃষ্টিতে ভিজে তাসরিফ দাঁড়িয়ে এক ছাউনির নিচে। জানালা লাগাতে ভুলে গেলো সায়রা। দৌড়ে নামলো নিচে। রাগে ওর গা কাঁপছে। এই ছেলে কি প্রমাণ করতে চাইছে এই বৃষ্টিতে ভিজে? সায়রা’কে দেখে তাসরিফ অবাকই হলো। সায়রা ওর ধরে ভেতরে নিলো। রুমে নিয়ে ভিজে শরীর মুছতে মুছতে রাগী স্বরে বললো,

— কি করছিলে ওখানে?

— আপনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।

— ভেতরে আসা যাচ্ছিলো না? ভিজেছো কেন?

— কেউ তো ডাকলো না য়রা।

সায়রা’র হাত থামলো। নিজেকে সামলে বললো,

— ডাকার মতো তো কিছু রাখো নি। কে ডাকবে? বাসায় যাও নি কেন?

— আপনাকে ছেড়ে বাড়ী যাব?

সায়রা ইফাত থেকে কাপড় এনে ওকে দিলো। ভেজা কাপড় মেলে দিয়ে খাবার নিয়ে এলো। তাসরিফ তাকিয়ে রইলো ওর পানে। প্লেট হাতে নিয়ে সবার আগে সায়রা’কে খাওয়ালো। ঐ শুকনো মুখটা দেখেই তো তাসরিফ বুঝে সবাইকে খাওয়ালেও এই মেয়ে নিজে খায় নি। সবার খেয়াল রাখলেও নিজের রাখে নি।

রুমের বাতিটা নেভাতেই ফুপিয়ে কাঁদে সায়রা। তাসরিফ ওকে ভালোমতো বুকে জড়ালো। বললো,

— কাঁদো। মন খুলে কাঁদো তো য়রা।

#চলবে…..