সে জন সোনা চিনে না পর্ব-২১

0
16

#সে_জন_সোনা_চিনে_না
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২১

আকাশ আজ পরিষ্কার। মাঝেমধ্যে শুধু বাতাস আসছে। সময়টা যদিও দুপুর কিন্তু মনে হচ্ছে বিকেল বিকেল এক আমেজ। দুপুর বারান্দায় বসা। ছয় মাসের পেটটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো ও। নিচে গাড়ি ঢুকছে। ইউনিফর্ম পরিহিত কালো চাঁদ তার বাড়ী ফিরেছে। দুপুর তপ্ত শ্বাস ফেলে পা ফেলে বাইরের দিকে। দরজা খুলতে হবে। কলিং বেলটা বাজার আগেই দুপুর দরজা খুললো। ক্লান্ত শাহ তখন মৃদু হাসলো। পেছনেই বাজার নিয়ে দাঁড়িয়ে একজন। শাহ ইশারায় তা রাখতে বলে। ছেলেটা রেখে চলে গেলো। শাহ নিজে দরজা থেকে তুলে ভেতরে এসে দরজা লাগালো। রান্না ঘরে নিয়ে রাখতেই দুপুর ট্যাবের পানি আনলো এক গ্লাস। পানিটুকু পান করতেই দুপুরকে বসালো নিজের পাশে। গালে হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— আর বমি হয়েছে?

দুপুর মাথা নাড়ে। সকাল থেকে যেই পরিমাণ খারাপ লাগছিলো দিন হতে হতে তা মিলিয়ে গেলো। এমনই হয় এখন। শাহ গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে। দুপুর তাকে দেখে। আগের মতো আর লুকোচুরি করে শাহ ইউনিফর্ম পরে না। বাসা থেকেই পরে যায়। দুপুর তো মাঝেমধ্যে নিজেই গোছগাছ করে রাখে। অভিযোগ গুলো এখন দুপুর আর করে না। সবার অভিযোগ করা মানায় না৷ কিছু মানুষ হয় যাদের শুধু টিকে যেতে হয়। কোনমতে বেঁচে যেতে হয়। দুপুর তাদের কাতারের লোক। স্বামীর আদর, যত্ন কপালে জুটেছে। চাওয়ার মতো আর কিছু তো দুপুর দেখে না। অতীত নিয়েও ভাবে না আবার ভবিষ্যৎ নিয়েও ভাবে না। মাঝখানে একমাস তিব্বি আর শশুর, শাশুড়ী থেকে গেলো তখন ভালো ছিলো দুপুর। সারাদিন মানুষ দেখতো চোখের সামনে কিন্তু এখন দেখা যায় না৷ দুপুরকে এক ঘন্টা শাহ’কে পাওয়া যায় এরপর পায় রাতে। দুপুরের এই দুই সময় প্রচন্ড ঘুম পায়। ম’রার মতো ঘুমায় ও। যখন জেগে থাকে তখন জনশূন্য এই ঘর। বারান্দাটায় বসে বসে গেট পানে তাকিয়ে থাকে ও। চোখ দুটো খুঁজে, এই বুঝি শাহ এলো। এই বুঝি একাকীত্ব ঘুচলো।

পেটের উপর বেশ সময় নিয়ে হাত বুলায় শাহ। দুপুর চুপ করে দেখে তা। আজকাল কথা বলতে মন চায় না। চুপচাপ থাকতে ভালো লাগে। কাজও নেই বিশেষ। কাউকে কাজ করার জন্য বাড়ীতে ঢুকায় না শাহ। কিসের ভয় পায় কে জানে? দুই দিন পরপর নিজেই ঘর মুছে। রান্নার তরকারিটা শুধু দুপুর করে বাকিসব শাহ নিজে করে। এখন আবার তরকারি করাও নিষেধ। দুপুরের মনে হয় ও একটা পুতুল যাকে শাহ চাইছে সাজিয়ে রাখতে। ভালোবাসার কত রূপ দেখলো দুপুর। এটাও একটা বহিঃপ্রকাশই হবে হয়তো, বউকে কাজ না করানো। ভাগ্য প্রয়োজন এতে। ভীষণ উঁচু ভাগ্য।

— চাল ধুয়েছে কেন দুপুর? আমিই তো করতাম।

রান্নাঘর থেকে প্রশ্নটা এলো। দুপুর কি বলবে? বলবে যে একা বসতে ভালো লাগছিলো না তাই ধুয়েছি? বললেই বা কি হবে? না বললেই বা কি হবে? একই তো। চুপ থাকাই শ্রেয় তাহলে। দুপুর চুপ রইলো।
ভাত রান্না করে শাহ দু’জনের কাপড় ধুঁয়ে বারান্দায় মেললো। দুপুরের হাত ধরে তুলে বললো,

— গোসলে যাও এখন।

দুপুর ধীরে ধীরে পেট ধরে বাথরুমে গেলো। এটাও অবশ্য অন্যরকম এক ভালোবাসা। শাহ বাসায় থাকলেই দুপুর গোসল করে, দরজা সামান্য খুলে যাতে দুর্ঘটনা না ঘটে। দুপুরের ভালোই লাগে। এটাই বোধহয় ভালোবাসা। দুপুর তো ততটা বুঝে না। ওর মাথায় জঙ ধরেছে ইদানীং। সাধারণ চিন্তা ভাবনাও কঠিন ঠেকে ওর নিকট। জটিল সমীকরণ যেন সব।

— হলো? আসব দুপুর?

— হ্যাঁ।

হাতটা ধরে শাহ ওকে বের করে। কত সুন্দর চুল যা যত্ন করে মুছে শাহ। আয়নায় দুপুর নিজের প্রতিবিম্ব দেখলো। সৌন্দর্য কি কমলো একটু? কমলে দুপুর একটু স্বস্তি পেতো। আফসোস কমে নি। মাতৃ কালীন সৌন্দর্য তার বেড়েছে। নিয়মিত এই ফুলা গালে শাহ আদর করে। কতবার বলে,

— আমার দুপুরচন্ডীকে তো সারাদিন ভালোবাসা দিতে মন চায়।

দুপুর আগের সেই লজ্জা পায় না। লজ্জারও মেয়াদ থাকে। দুপুর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। লজ্জা ওকে আগের মতো আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে না। ধারে কাছেও থাকে না। নিজের হাতে ওকে খাওয়ালো শাহ। বিছানায় শোয়ালো সযত্নে। ভেজা চুলগুলো ছড়িয়ে সবেই শাহ চাইলো একটু স্বাভাবিক কথাবার্তা বলতে। দুপুর ঘুমে তলিয়ে গেলো। হু হা ছাড়া কথাও বললো না৷ শাহ দেখলো সত্যিই ঘুমে দুপুর। ক্ষুদ্র একটা শ্বাস ফেলে ওর কপালে চুমু খায় শাহ। পেটে হাতটা রেখে বলে,

— তুমি খুব ভালো একটা মেয়ে দুপুর। খুব ভালো। কি ভেবেছো তুমি চুপ করে থাকলে তোমার শাহ বুঝবে না কতটা দুঃখে মূর্ছা গেছে তার দুপুর চন্ডী? এত ঠুকনো বুঝি আমি? অনুভূতি প্রকাশে চাপা তো আমি ঠিক গায়ের রংটার মতো। বুঝো না তুমি? আসলেই বুঝো না? জানি তো তুমি বুঝো সবটা। আমার পেশাকে মেনে নেয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা তুমি করছো। তোমাকে আগলে রাখার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম তোমার আব্বুকে। আমি ওয়াদা পালন করছি দুপুর। এখানে খুব বিপদজনক ঠেকছে আমার। বদলিটা এবার হোক। তোমাকে পাখির মতো উড়াব আমি দুপুর। তোমাকে আমি বুঝাব সৌন্দর্য কলঙ্ক না বরং আশীর্বাদও হয়। আমার মেয়েটা আমার মতো কালো হলেও আমি দেখাব এই সমাজে কালোদের কিভাবে বেঁচে থেকে লড়াই করতে হয়। তোমার মতো সুন্দর হলেও তাকে শিখাব কিভাবে সৌন্দর্যকে নিজের দূর্বলতা নয় বরং মেধা নিয়ে দুনিয়া জয় করতে হয়।
জানো মাঝেমধ্যে তোমার সাথে নিজেকে মিলিয়ে ফেলি। ছোট থেকে চাপা রং নিয়ে অবহেলিত ছিলাম অথচ এখন পেশা আমাকে সম্মানিত করেছে। একই পথে তুমি দুপুর। গায়ের রংটা কাল হলো তোমারও কিন্তু আফসোস তুমি দাঁড়াতে পারলে না। আমি ওয়াদা করছি তোমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করব।
.
ঘুম ভাঙতেই দুপুর নিজেকে একা পেলো। শাহ চলে গিয়েছে। রোজকার মতোই টেবিলে ছোট ছোট চিরকুট। তাতে লিখা দুপুর কি কি খাবে এবং তা কোথায় কোথায় আছে। দুপুর বারান্দায় তাকায়। দরজা বন্ধ। শাহ আসলেই বন্ধ করে দিবে। উঠে মুখ হাত ধুঁয়ে বসতেই ফোনটা বেজে উঠে। দুলাভাই লিখা সেখানে। দুপুর সামান্য হেসে ফোনটা রিসিভ করে। ওপাশ থেকে চমৎকার মানুষটা জিজ্ঞেস করে,

— কেমন আছো দুপু?

— খুব ভালো দুলাভাই। সকাল কেমন আছে?

— এই তো খেলাধুলা করছে। আজ সকাল থেকে বেশ ফুরফুরে মেজাজে আছে বুঝলে। হাত-পা ছুঁড়ছে শুধু।মুখের হাসি যেন সরেই না।

— বাবাকে পেয়েছে না মেয়ে। খুশি তো সে থাকবেই।

— একশত ভাগ সত্যি কথা বললে দুপুর। আমাকে দেখলেই মেয়েটা হাসে। সন্ধ্যা প্রায়ই ভিডিও কলে দেখায় ওকে যখনই কান্না করে। অফিসের কাজ ফেলে মেয়ের সাথে দুটো কথা বলতেই দেখি কান্না নেই। মেয়ে আমার হাসছে।

— মা তো ওর গোমড়ামুখো তাই কাঁদে আমার ভাগ্নী৷ বাবা যে হাস্যমুখ তাই হাসে।

— বরাবর বলে….

কথাটুকু গিলে নিলো ইফাত। শব্দ করে হেসে ফেললো দুপুর। পেটে হাত চেপে হাসতে হাসতে বললো,

— বউ সামনে নাকি দুলাভাই?

নীচু স্বরে ইফাত উত্তর করে,

— হু।

— ম র লে তাহলে। কপাল খারাপ।

— না না তোমার আপু কিছু মাইর টাইর দেয় না আমাকে।

— খুব জানা আছে আমার। চোখ ঘুরানিই যেই ভয় পান মা ই র দেয়ার প্রয়োজনই বা কোথায়?

সন্ধ্যা নরম দৃষ্টি ফেলে তাকিয়ে আছে ইফাতের দিকে। অসহায় ইফাত স্ত্রী’র চোখের আকুতি বুঝে। খুব করে চাইছে দুপুরের সাথে কথা বলতে কিন্তু দুপুর কথা বলে না৷ এখন ইফাত সন্ধ্যাকে দিতে চাইলেই এক বাহানায় ফোন কাটবে দুপুর তার থেকে তো ভালো একটু কথা বর্তা হোক। সন্ধ্যার কত কথা জমা বোনটার সাথে অথচ বলা যাচ্ছে না। এই সময়ে কত কত পরামর্শ দেয়ার অথচ দেয়া যাচ্ছে না। সন্ধ্যা হয়তো কখনো গর্ভবতী হয় নি কিন্তু জানা তো আছে। কিছু তো বলতো বোনকে কিন্তু জীবনের ছোট ছোট কিছু কাজ আজ দু’বোনের মাঝে আকাশ-পাতাল ব্যবধান সৃষ্টি করেছে যা সন্ধ্যা চাইলেও দুপুর চায় না ঘোচাতে। আরো কিছুটা সময় কথা বলে ফোন রাখে ইফাত। সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে৷ কপালে চুমু খেয়ে বলে,

— দুপু ভালো আছে।

— জানি তো আমি। শাহ ভালো ছেলে।

— তাহলে কাঁদছো কেন সন্ধ্যা। এভাবে কেঁদো না প্লিজ।

সন্ধ্যা কান্নায় ভেঙে পরে। ইফাত ওকে বুকে আগলে নেয়। ছোট্ট আট মাসের সকাল মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মায়ের কান্না দেখে বাবার দিকে তাকায় ও। ইফাত মেয়েকেও কোলে তুলে। ছোট্ট জানটার যখন তিন মাস তখন তাকে নিজেদের কাছে এনেছিলো ইফাদ। সন্ধ্যা তখন পরিবারের শোকে খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছিলো। হন্য হয়ে হাসপাতাল হাসপাতাল ঘুরে এই পাখিটা পেয়েছে ওরা। ইফাত জানে না ও কারো পাপ নাকি কারো রহমত। শুধু এটা জানে ও ইফাতের পৃথিবীর এক খুশির টুকরো যার আগমনে ওর সংসার প্রাণবন্ত হয়েছে। পাখিটার যেমন বাবা-মা নেই তেমনই ইফাত-সন্ধ্যার ছিলো না সন্তান। তাই তো নিজেদের অভাব পূরণে দু’জন দু’জনের কাছে চলে এলো। সেই থেকে সন্ধ্যা’র শোক কিছুটা যেন কেটেছে। সকাল’কে নিয়েই ওর দিন কাল কেটে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা ইফাতের বুকে মুখ গুজে কাঁদতে কাঁদতে আফসোস করতে লাগলো,

— দুপুরটাকে ফুপি আর বাবা বাদে কেউ ভালোবাসি নি আমরা ইফাত। কেউ না৷ ছোট থেকেই ওর সৌন্দর্য আমার চোখে বিঁধতো। অল্প ব্যবধানের বয়স ছিলো দু’জনের। মা আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হলো। ওর সব সমস্যা ফুপি দেখতো। সব। কখনো বড় বোন হিসেবে পাশে ছিলাম না আর এখন থাকতে চাইছি কিন্তু পারছি না। আমি কেন এত খারাপ ইফাত? কেন একটা ভালো বোন হতে পারলাম না? কেন পারলাম না?
ওর কাছে তো ফুপি নেই এখন৷ ও কি জানে এই সময় কিভাবে চলতে হয়? কিচ্ছু জানে না ইফাত। ও কিছুই জানে না। এই সমাজ ওর রূপ দেখে ওকে একা ঠেলেছে। ঘরের কোণে বসে বাইরের সমাজ চেনা যায় না৷ ওর ঐ রূপ বাদে কিছু নেই ইফাত। আমার বোনটা জানে না এই সময়ে কিভাবে থাকতে হয়। শাহজেব নিজেও তো বাসায় থাকে না। দুপুর একা নিজেকে সামলাবে কিভাবে?

সন্ধ্যার আর্তনাদ কমে না। দুপুরকে এখানে আনতে চেয়েছিলো ইফাত কিন্তু দুপুর কিছুতেই আসবে না। জীবনটা আসলে অদ্ভুত। ভীষণ অদ্ভুত।

_____________________

— তুমি কি খাবে এখন?

তাসরিফ কপাল চেপে বসে ছিলো। সায়রা’র ডাকে উত্তর দিলো,

— মাথা ব্যথা হচ্ছে য়রা৷ বমি পাচ্ছে।

— তাহলে বাথরুমে গিয়ে বমি করো।

তাসরিফ কাটকাট উত্তর বাদে অবশ্য নরম কিছু আশা করে না কিন্তু তবুও মনের কোথাও যেন সূক্ষ্ম ব্যথা হয়। মন বলে তবে কি সায়রা এখনও মাহমুদ’কে ভালোবাসে? তাসরিফ জানে উত্তর হলো ‘না’। সায়রা’র মনে মাহমুদ নেই আবার তাসরিফও নেই। কিছু মানুষ থাকে যারা জীবন থেকে ভালোবাসা একবার হারালে দ্বিতীয় বার সেই ভালোবাসা তাদের জীবনে আসতে দেয় না। হয়তো ভয় পায় অথবা বিতৃষ্ণা জন্মায়। সায়রা’রও তেমনই কিছুটা৷ ও তাসরিফে’র সাথে থাকে, কথা হয়, খাওয়া হয়, এক বিছানায় ঘুম হয় কিন্তু ভালোবাসাটা হয় না৷ তাসরিফে’র মন বলে হয়তো কখনো হবে কিন্তু কোথাও যেন মস্তিষ্ক বলে উঠে, “হবে না তাসরিফ, কখনোই হবে না। সায়রা নামক মেয়েটা ভালোবাসায় একবার হেরেই পরাজয় বরণ করেছে। দ্বিতীয়বার আর এই ফাঁদে পা দিবে না।”

তাসরিফ উঠে বাথরুমে গিয়ে মুখে পানি দিয়ে বেরিয়ে এলো। খাবার টেবিলে সবাই বসা। সায়রা খাবার বাড়ছে। তামজিদ খেতে খেতে কথা বলছে। বাবা কিছুটা চিন্তিত। তামজিদের অ’স্ত্রর ব্যবসাটা সম্পূর্ণ বৈধ। সিপমেন্ট কখনো আটকায় নি। এবার দেড়ী হচ্ছে কিছুটা। সমুদ্র পথে তো আগেও আসতো কিন্তু কখনো তো এতটা দেড়ী হয় নি। জাহাজ পাড়ে আসতে পারছে না৷ আজ দুই দিন বন্দরে আটকে আছে। চেয়ারম্যান সাহেব খেতে খেতে বললেন,

— তুমি বিকেল পর্যন্ত কোথায় ছিলে আব্বু? আমি ভাবলাম তুমি বন্দরে।

— একটু কাজ থাকে এই সময় আমার।

চেয়ারম্যান সাহেব আর জিজ্ঞেস করলেন না আগ বাড়িয়ে। সকাল সকাল বের হয় এরপর সন্ধ্যার সময় কাজে হাত দেয় তামজিদ। কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করলেই বলবে কাজে ছিলাম। এত বড় ছেলে তাই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করাও অনুচিত মনে হয়।
সায়রা শশুড়ের পাতে মাছ দিতেই চেয়ারম্যান সাহেব হেসে বললেন,

— বসে পরো মা।

— পরে খাব।

কারো সাথেই নরম বা নম্রতা সহকারে কথা বলে না সায়রা কিন্তু গলার স্বর তার থাকে অতি স্বাভাবিক। শাশুড়ী এখন অবশ্য ঘাটে না ততটা। নিজের মতো থাকে সায়রা। তামজিদ মাথা এদিক ওদিক কিছু খুঁজতেই মরিচের আচারটা ওর দিকে দিলো সায়রা। তামজিদ সামান্য হেসে ধন্যবাদ দিলো। সায়রা তখন তাসরিফ’কে ডাল দিচ্ছে।

দুই ভাইয়ের মধ্যে আজ অনেকক্ষণ কথা চললো। তামজিদ যাবে কাল জাহাজের বিষয়টা দেখতে। তাসরিফ ভাইকে আশ্বাস দিয়ে বললো,

— চিন্তা করো না ভাইয়া। সামনে ঈদ তাই হয়তো দেড়ী হচ্ছে।

তামজিদ কিছুটা নিশ্চিত হয়। তাসরিফ উঠে চলে যায়। দরজা আটকে তামজিদ আয়নায় নিজেকে দেখে। মাথায় ছোট ছোট চুল উঠছে। দুই মাস আগে হঠাৎ পেছন থেকে কেউ আক্রমণ করেছিলো। ফলাফল মাথা ফেটেছে। সাতটা সিলাই হলো সাথে চুলগুলো কাটা হলো। দুই মাসে চুল হয়েছে অবশ্য কিন্তু মাঝে আবার ড্রেসিং করতে কাটতে হলো। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে তামজিদ সামান্য হাসে। বলে আনমনে,

— তোমাকে রোজ এতক্ষণ দেখি অথচ মন ভরে না পাখি। এত সুন্দর কিভাবে হলে তুমি? টানা চোখ দুটো কেমন কেন দেখায় বলো তো? বর কি যত্ন নেয় না? সে কি দেখে না তার দুপুর উদাস হয়ে সারাক্ষণ ঐ বারান্দায় বসে থাকে? এত সুন্দর একটা বউ কেউ এভাবে রাখে?

এতটুকু স্বাভাবিক ভাবে বলে কেঁদে ফেলে তামজিদ। দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলে,

— আমার কাছে থাকলে আমি দেখাতাম কিভাবে রাখে বউ৷ এই বুকে রাখতাম দুপুর। আমার বুকে। তুমি মা হবে পাখি৷ কত রূপ লাবন্য তোমার ঐ মুখে। এত রূপে আমি সুখ দেখি না পাখি। সুখ কোথায় তোমার জান?
.
— আপনি খেলেন না যে য়রা?

তাসরিফে’র প্রশ্নে সায়রা স্বাভাবিক ভাবে উত্তর করে,

— মন চায় নি।

— একটু খেয়ে নিন।

খাবারের প্লেটটা নিজের হাতে নিয়ে ঢুকেছে তাসরিফ। সায়রা বই পড়ছে তখন। সামান্য চোখ সরিয়ে বলে,

— ঘুমাবে এখন?

— না তো।

— যাও তাহলে। প্রয়োজন হলে ডাকবে।

— য়রা!

— চুপ। আস্তে কথা বলো। তোমার না মাথা ব্যথা।

তাসরিফ ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে সায়রা’র কাছে আটকাতে ব্যর্থ সে বারবার নাহয় এত ভাবে কথা শোনানোর পর তাসরিফ হয়তো অতটাও গভীর ভাবে ছুঁতো না সায়রা’কে কিন্তু বেহায়া এই মন৷ নির্লজ্জ এই ভালোবাসা। প্রিয়জনকে পেয়ে কেমন হায়া হারিয়ে ফেলে।
কিছুটা জোর করে ওকে খাওয়ালো তাসরিফ। বিছানায় শোয়া মাত্র সায়রা’র কপালে চুমু খেয়ে তাসরিফ বললো,

— ভাবীর বাসায় ঘুরে আসবেন য়রা?

— দুপুর ওর নাম।

— স্যরি য়রা।

— ওখানে যাব কেন?

— আপনার মন খারাপ ভালো হতো।

— মন খারাপ নেই আমার।

— আছে। আমি বুঝি।

সায়রা আগ বাড়িয়ে তাসরিফে’র গালে হাত রাখলো। শান্ত স্বরে বললো,

— তুমি আমাকে যেমন ভাবে চাইছো আমি তেমন হতপ পারব না তাসরিফ। সময় আছে হয় আমাকে ছেড়ে দাও, নতুন ভাবে নতুন কাউকে নিয়ে শুরু করো নাহয় আমার মৃত্যু পর্যন্ত আমাকে এমন ভাবেই পাবে তুমি। কোনদিন তোমাকে সন্তানের মুখ দেখাব না। আদর সোহাগ বিছানায়ই সমাপ্ত। কোন অতিরিক্ত খাতির যত্নও পাবে না। এই যে তোমার মাথা ব্যথা স্ত্রী হিসেবে টিপেও দিব না মাথাটা। আমার দ্বারা এসব হবে না। একত্রিশ বছর বয়স আমার তাসরিফ। ঐ আবেগ নেই আমার মাঝে। সবটা মৃত। তুমি বুঝতে পারছো? আপোষ করো নাহয়? থাকলে তো বছর খানিক। শখ মিটেছে না আমায় নিয়ে? তালাক দিয়ে দাও নাহয়। আমি চলে যাই। সুন্দর একটা ছোট্ট মেয়ে বিয়ে করাব তোমাকে। ছোট ছোট বাচ্চা হবে। তোমার সুখ আমি খুব করে দেখব।

— তালাক দিব না।

— আচ্ছা, না দিলে। আমি অনুমতি দিলাম। তুমি বিয়ে করো। আমি আমাদের বাসায় থাকব। যখন মন চাইবে যাবে।

— বিয়ে করব না য়রা।

— এই বুড়ো দেহে এখনও রুচি তোমার? সখ কবে মিটবে?

আচমকা মুখটা চেপে ধরে তাসরিফ। রাগ তার তরতর করে বাড়ছে। হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

— সখ না আপনি আমার। ভালোবাসা! ভালোবাসা! বুঝেছেন?

সায়রা নিজেকে আস্তে ধীরে ছাড়ালো। তাসরিফ’কে বুকে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে কিছুটা ভেঙিয়ে বললো,

— ভালোবাসা ভালোবাসা.. বুঝেছি। ঘুমাও তুমি।

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তাসরিফ। ও জানে সায়রা ওকে ততটা গভীর ভাবে নিচ্ছে না৷ মাঝেমধ্যে কেন জানি কান্না পায় ওর। ভীষণ কান্না।

এই আধ রাতে চেয়ারম্যান বাড়ীর দরজায় ধাক্কা পরে। সায়রা হেসে উঠলো। বললো,

— যাহ! তাসরিফ তোমার বাসর হলো না আজ। কে এলো যাও দেখো।

তাসরিফ উঠে গায়ে টিশার্ট জড়ালো। আসলেই তো এতরাতে কে এলো? দরজা খুলতে খুলতে বাকিরা বেরিয়ে এলো। চারজন পুলিশ দাঁড়িয়ে। ওদের মধ্যে একজন বললো,

— চেয়ারম্যান সাহেব আপনার বড় ছেলে তামজিদের নামে দুটো মামলা এসেছে। একসাথে তিনটা খু ন এবং অবৈধ অ’স্ত্র মামলা।

#চলবে…..