“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১১
(নূর নাফিসা)
.
.
রাতে মোয়াজ্জেম আলী ঘরে ফিরলে শ্বশুরের সিদ্ধান্তটা নিয়ে আপত্তিজনক মন্তব্য করলেন সেলিনা বেগম।
“ওগো, শুনছেন?”
“কি?”
“আব্বা কইলো আজমাইনের সাথে মৌসুমীর বিয়া দিবো।”
“দেক।”
সেলিনা বেগমের রাগ জন্মালো তার এমন বেখেয়ালি জবাবে। তাই ঠমকে বললো,
“দেক মানে কি? এইটা কোনো কথা কইলেন? বাপ মানুষ এমন ছন্নছাড়া হইলে চলে মাইয়ার বিয়ার ব্যাপারে?”
“ক্যা, তোর কি হইছে?”
“আশেপাশে ভালোমন্দের একটা খোঁজ করবেন না? আজমাইনের সাথে বিয়া হইতো ক্যা? পোলা হইছে ছোড। কামকাজ করে না, পড়াশোনায় ভালা না, তিড়িংতিড়িং ঘুরাফেরা করে। ভাবছিলাম মাহতাবের মতোন একটা ভালা চাকরিওয়ালা শিক্ষিত পোলা বাইর করবো আব্বা। তা না কইরা আজমাইন বাইর করছে আমার মাইয়ার লাইগা। এই পোলা সংসারের বুঝে কিছু? কোনো দায়িত্বজ্ঞান আছে? দুনিয়াতে যেন পোলার অভাব পইড়া গেছে।”
“ক্যা, আমার ভাতিজা খারাপ কি? আমার ভাইয়ের যেটুক আছে তার পোলার জীবন পাড় হইয়া যাইবো বইসা খাইয়া। তোর এতো মাথাব্যথা উঠে ক্যা? তুই চুপ কইরা বইসা থাক।”
“হো, থাকমুই তো। মাইয়া তো আমার না। বানের জলে ভাইসা আইছে৷ বাপ দেখছিলাম জগতে, আপনার মতো এমন বাপ দেখি নাই।”
“দেখোস নাই যখন, বইসা বইসা দ্যাখ।”
“বয়েই গেছে দেখবার লাইগা।”
“না দেখলে বাপের বাড়ি দৌড় দে। আব্বা যখন কইছে, বিয়া আজমাইনের লগেই হইবো। তুই চাইলেও আছোস, না চাইলেও আছোস।”
কতক্ষণ যাবত বাবামায়ের ঘ্যানঘ্যান ভালো লাগছে না মৌসুমীর। সে পাশের রুম থেকে এসে বললো,
“মা, তুমি এতো টেনশন করো ক্যা? দাদাজান ঠিক সিদ্ধান্তই নিছে। দাদাজানের সিদ্ধান্ত আমার পছন্দ হইছে। অযথা ঘ্যানঘ্যান কইরা ঝগড়া বাঁধাইয়ো না।”
স্বামীর কথায় তো এমনিতেই মুখটা ফোলে আছে দুঃখের ভারে। এখন মেয়ের কথা শুনে যেন আগুন ধরে গেলো মাথায়। তাই চোখ পাকিয়ে ঝনঝনে গলায় বললো,
“ঝাটা মাইরা মুখ ত্যাড়া কইরা ফালামু মাইয়ার পো! নির্লজ্জ কোনহানকার! লজ্জাশরমের গোষ্ঠী ধুইয়া খাইছে৷ বাপ মায় বিয়ার কথা কয়, এনে আইয়া গলা ঝারে!”
ভ্রু কুচকে মুখ বাঁকিয়ে ভেঙচি কেটে চলে গেলো মৌসুমী। মোয়াজ্জেম আলী বললেন,
“তোর মুখও বন্ধ রাখ। ভালা কিছু যখন তোর সহ্য হয় না। মাইয়াও রাজি। বিয়া পাক্কা। আর কোনো কথা নাই।”
“এই, যান তো আপনে। যান। আব্বা আপনেরে ডাকছে। কিছু কইলেই তাগো জ্বইলা পুইড়া যায়। ভালোমন্দের কোনো চিন্তা নাই। বাপের এক টুকরা জমি পাইছে, বইসা বইসা খাইয়া ফুরানের ধান্দায় আছে। সম্পদ আছে দেইখ্যা আর কাজ কইরা খাইতে হইবো না।”
মোয়াজ্জেম আলী তার বকবক শুনতে বসে নেই। চলে গেছে বাবার ঘরে। সেলিনা বেগম নিজের সাথেই দুঃখের গল্প করতে বসেছেন রাগের ঢলে।
পরদিন সকালে মাহতাব চলে গেলে বিকেলে মরিয়ম এলেন বাবার ডাকে৷ বাড়িতে বড়দের সবাই-ই উপস্থিত আছে। আহমদ আলী আগেই বলে দিয়েছিলেন থাকতে। শেষ রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে আজ ধান মেলেনি কেউ। নিজের ঘরেই ছেলেমেয়ে ও ছেলের বউদের নিয়ে একটা বৈঠক বসলেন তিনি। প্রথমে জানতে চাইলেন এই দুইটা বিয়েতে কারো কোনোরকম আপত্তি আছে কি না? কেউই আপত্তি রাখেনি। সবার মুখ স্বাভাবিক থাকলেও সেলিনা বেগমের মুখটা কিছুটা মলিন। তাই আহমদ আলী তাকে একাধিক বার আলাদা করে জিজ্ঞেস করলেন আপত্তি আছে কি না? জবাবে তিনি “না” বলেছেন। আপত্তি থাকলেও এই আসরে তার “হ্যাঁ” বলার সাধ্য নেই। শ্বশুর মশাই যখন ঠিক করেছেন, এর উপর কথা বলা বেয়াদবি হবে। তারউপর মোয়াজ্জেম নির্ভাবনায় খাড়া রাজি। সে আর অন্যদিকে গিয়ে কোন কূল ধরবে তবে?
বৈঠকে দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে সুশীল মতামতে সন্তুষ্ট হলেন নিজেরা। মরিয়মের অর্থসম্পদের কোনো অভাব নেই। ছেলে একটাই। সে কোনো দাবিই রাখছে না ভাইয়ের কাছে। ভাইঝিকে সে গলার হার, মাথার টিকলি, হাতের আংটি আর কানের দুল দিয়ে ঘরে তুলবেন। হালিমা খাতুন খুশিমনে শখ করে বললেন তিনি তবে হাতের বালা আর গলার চেইন দিয়ে দিবেন। চেইন রোজাকে আগেই গড়ে দিয়েছেন। বালাজোড়া নতুন বানাতে দিবেন। তাদের পর্ব শেষ হলে সেলিনা বেগম মলিন মুখে বললেন তার দেওয়ার সামর্থ্য নাই। মোয়াজ্জেম টুকটাক যা কাজ করে, তিন বাচ্চা নিয়ে নিত্য সংসার সামলাতেই হোচট খেতে হয়৷ সরকারি স্কুল থাকায় শুধু পড়াশোনাটুকু করাতে পারছে। নয়তো এটাও বিলাসিতার শিকড়ে গাঁথা থাকতো। সুতরাং সঞ্চয় তার কিছুই নেই। নিজের গহনাগাঁটি বলতে বাবার বাড়ি থেকে দেওয়া কানের চটা দুল আর শ্বাশুড়ির দেওয়া চেইনটা আছে। নতুন করে কিছু গড়ে দিতে পারেনি মোয়াজ্জেম। বাচ্চাকাচ্চার চাহিদার দিকে তাকালেই তার পকেট খালি হয়ে যায়। টুকটাক হাতের কাজ করে টাকা জমিয়ে এক জোড়া চিকন ইয়াররিং গড়ে দিয়েছিলেন মৌসুমীকে বছর চারেক আগে। এইটুকুই থাকার মধ্যে যা আছে। তবুও নিজের গলার চেইনটা দিতে চাইলো মেয়েকে। হালিমা খাতুন বাঁধা দিয়ে বললো,
“তোর কিছুই দিতে হইবো না, সেলিনা। ওইটুকু তুই রেখে দে সিয়ামের বউয়ের জন্য। আমার যতটুকু সাধ্য আছে, আমি ততটুকু দিয়াই ছেলের বউ ঘরে তুলমু। আমার হারটা মৌসুমীরে দিমু আর এক জোড়া কানের দুল বানাইতে দিমু আফরোজার বালার সাথে।”
তার মেয়েও সোনার গহনা জড়িয়ে স্বামীর ঘরে যাচ্ছে তবে, ভেবে মনে মনে খুশি হলো সেলিনা বেগম। যদিও কিছুক্ষণ পূর্ব পর্যন্ত আজমাইনকে নিয়ে বিশাল আপত্তি জুড়েছিলো। দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারে জেনে এখন অনেকটা ভালো বোধ করছে। শুধু তা-ই নয়, এই বাড়িতে আয়োজন একটাই হবে, যেহেতু একদিনে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে ছেলে এবং মেয়ের। মেয়ের বিয়ে একা দিলে যে আয়োজন করতে হতো, ছেলের বিয়েটাও তাতেই মিটে যাচ্ছে। বাড়তি কোনো খরচ হচ্ছে না এদিক থেকে। তাই মোয়াজ্জেমকে আয়োজন থেকেও মুক্তি দিলেন আমজাদ আলী। তাকে কোনো আয়োজন করতে হবে না, আয়োজনের পিছু খরচ করতে হবে না। এক আয়োজনেই ঘরে উঠে যাবে মৌসুমী। মোয়াজ্জেম যেন আরও নির্ভাবনায় বসে রইলেন। কোনো ভেজাল, কোনো ঝঞ্জাট নেই তার। মেয়ে শুধু এই ঘর থেকে ওই ঘরে চলে যাবে, এ-ই। আমজাদ আলীর মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে, তাই পরবর্তী সপ্তাহের শুক্রবারই বিয়ের দিন পাকা করলেন আহমদ আলী। ততোদিনে আবহাওয়া ভালো থাকলে ধানের কাজও অধিকাংশ এগিয়ে যাবে। বৈঠক শেষ করে মোয়াজ্জেম আলী এবং সেলিনা বেগম একত্রে বারান্দা দিয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলো। ওঘর থেকে খানিকটা দূরে এসে মোয়াজ্জেম আলী বললেন,
“দেখছোস এইবার? আমার ভাই কতটা করে আমাগো? কোনো আয়োজন লাগবো না। কোনো গহনাগাঁটির ব্যবস্থাও করা লাগবো না। পারবি এমন কইরা অন্য জায়গায় মাইয়া বিয়া দিতে? কইবো, আগে জামাইর ঘর সাজা, পরে গহনা জুইড়া মাইয়া বেটি পাঠা। তারউপর আমার ভাতিজা দেখতে রাজপুত্রের কম কিসে? খাটো না, কালা না, বুচা না। একটু চিকন আছে, বয়স বাড়লে স্বাস্থ্যও বাড়বো। দেখার মতো পোলা হইবো। আর কি লাগে তোর?”
“মাহতাব তো আরও অনেক উপরে সবদিক থেইকা।”
প্রত্যাশার তুলনাটা বুঝাতে সেলিনা বেগম শুধু প্রকাশ করলেন কথাটা। মোয়াজ্জেম আলী ঘরে প্রবেশ করতে করতে নিচু গলায়ই গর্জে উঠে বললেন,
“দ্যাখ, আরেকবার ত্যাড়ামি করলে ভালা হইতো না তোর। কালকা থেইকা মাহতাব মাহতাব করতাছোস। মাহতাবের লগে আমার ভাতিজীর বিয়া হইতাছে তা-ও তুই মাহতাব ক্যান জপবি? তোর মতিগতি কিন্তু ঠিক লাগতাছে না আমার। মাহতাবের উপযুক্ত হইছে আফরোজা। তোর মাইয়া সেই উপযুক্ত হয় নাই। না বয়সে, না যোগ্যতায়। ভাবি কতকিছু দিতাছে মাইয়ারে, তুই পারবি তোর মাইয়ারে দিতে? আবার মাহতাব করস! প্যাচ লাগানো কথা মুখে আনবি, পিটাইয়া ভাইয়ের বাড়ি দেখতে পাঠামু।”
মিনমিনে গলায় দমে যাওয়া সেলিনা বেগম বললেন,
“এহ! আমি কি কইছি আজমাইনের কাছে বিয়া দিতাম না? খালি বেশি বেশি করে। হোক বিয়া। আজমাইনের সাথেই হোক। একটু বুঝাইয়া কইয়েন কোনো কাজকর্মে যেন লাইগা যায়। নইলে আপনের মতো অভাব সারতো না জিন্দেগীতেও।”
“সেই চিন্তা তোর করা লাগতো না। সময় হইলে আপনাআপনিই করবো।”
সেলিনা বেগম চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। রান্না বসিয়ে মেয়েকে দিয়ে গিয়েছিলেন আগুন ঠেলতে। এদিকে চুলার আগুন ফুঁকতে ফুঁকতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে মৌসুমীর! বারবারই পাতালতা চুলার মুখে ঠেলে দেয় আর আগুন নিভে যায়। ধোঁয়া উঠে। সকালে পাতালতা হালকা ভিজে যাওয়ায় এই অবস্থা। মাকে আসতে দেখে ফুঁকানি ছাইকাঠি আছাড় মেরে ফেলে বললো,
“নেও, তোমার রান্না তুমিই ভালো কইরা খাও। জীবনটা আমার মুখ দিয়ে বের হইয়া যাইতাছে ফুঁকতে ফুঁকতে!”
“এহ! যা, মাইয়া। যা। রান্নাবান্না কইরা যে জীবন তোর কেমন চলবো, ভালা বুঝা যায়। দুইটা শুকনা চ্যালাকাঠ দিবো, তা না কইরা ভিজা পাতাগুলা ঢুকাইতাছে। ধোঁয়া দিয়া আন্ধার কইরা ফেলছে বাড়িঘর!”
চলবে।