সোনালী আলোর ঘ্রাণ পর্ব-১৬+১৭

0
545

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১৬
(নূর নাফিসা)
.
.
খেতে যাওয়ার জন্য আজমাইন পাঞ্জাবি খুলতে লাগলে বিছানায় পা ঝুলানো অবস্থায় বসা মৌসুমী লজ্জাবোধ করে বললো,
“আমার সামনে যখনতখন কাপড় বদলাইবা না। আমার লজ্জা লাগে।”
আজমাইন বিস্ময়কর ভাবে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। তার ঘরে তার কাপড় বদলানোও নিষিদ্ধ নাকি?
“কাপড় বদলাই আমি, লজ্জা লাগে তোর? তুই আমার ঘরে কি করস? বের হো। উঠ!”
মৌসুমী ভেঙচি কাটলো তাকে। একটু লজ্জায় পড়াতে কি অপরাধ হয়ে গেছে তার যে, এভাবে বিতারিত করবে সে? প্রসঙ্গ পাল্টাতে মৌসুমী বিরক্তিকর মনোভাব দূর করে আবারও একটু লজ্জামাখা কণ্ঠে আবদার জুড়ে বসলো,
“এভাবে কথা বলে কেউ বউয়ের সাথে? সুন্দর করে কথা বলতে হয়। আমি বউ সেজেছি, কোথায় একটু মনযোগে দেখবা। দেখে দেখে মুগ্ধ হইবা। চোখে চোখে পলক ফেলে প্রেম কবিতা বলবা৷ তা না কইরা ধমকাচ্ছো।”
“আহাগো! রূপবতীর রূপ যেন গলে গলে পইড়া যায়, আমার তারে দেইখা প্রেমের কবিতা বলতে হইবো। দূর হো চোখের সামনে থেকে! উঠ!”
কাছে এসে মাথায় ঠুসিই মেরে বসলো। এক ঠুসি দেওয়াতে মাথায় হাত ঘঁষে ভ্রু কুচকে তাকালো মৌসুমী। উঠেনি বিধায় আরেক ঠুসি মেরে বললো,
“আবার তাকায় থাকোছ! উঠ!”
দ্বিতীয় ঠুসি খেয়ে মৌসুমী বসা থেকে উঠে সরে এলো দরজার দিকে। মুখটা গোমড়ামুখো বানিয়ে বললো,
“তুমি আমারে মারো ক্যা? কি অন্যায় করছি আমি?”
“তুই আমার ঘরে বসে রইছোস, এইটাই বড় অন্যায়।”
“এইটা এখন আমারও ঘর। আমি অবশ্যই বসে থাকমু।”
“না, থাকবি না।”
“একশোবার থাকমু। হাজারবার থাকমু। তুমি নিষিদ্ধ করার দারোগা না। আমার সাথে এমন করলে আমি দাদাজানের কাছে বিচার দিমু। জেঠুর কাছেও দিমু।”
“যা, দে গিয়া। বিচার দিয়া কি উল্টাস, দেখি।”
গোমড়ামুখে মৌসুমী বেরিয়ে গেলো। মাথা ঘঁষছে হাতে। বারান্দায় হেঁটে যাচ্ছে দাদাজানের ঘরের দিকে। পেছন থেকে হালিমা খাতুন ডেকে বললো,
“মৌসুমী, খাইতে আয়।”
“আসি।”
কিন্তু আগে তার বিচার, তাই যেতেই লাগলো। তবে খুব বেশি যাওয়া হলো না। বাবা যে রেগে আছে, সেটা তৎক্ষনাৎ মনে পড়ে গেলো আজমাইনের। মৌসুমী কি সত্যিই বিচার দিতে বেরিয়ে গেলো? এমনটা হলে তো বাবা এবার সঞ্চিত রাগটা দেখিয়ে ছাড়বে। আরেকটা ঝড় যাবে তার উপর। তাই সাথে সাথেই বেরিয়ে এসে মৌসুমীকে টেনে আবার ঘরে নিয়ে গেলো। হুটহাট টানায় হাটতে অসুবিধা হচ্ছিলো তার। ঘরের দরজা পেরিয়ে বললো,
“আল্লাহ! ছাড়ো। টানো ক্যা?”
“তুই কই যাস?”
“যেখানে ইচ্ছা, সেখানেই।”
“ঠিক কইরা বল?”
“তোমার নামে বিচার দিতে।”
“দিবি না।”
“দিমু না ক্যা? অবশ্যই দিমু।”
“মাইর দিমু তবে।”
“দিছোই তো। তার বিচারই দিমু।”
“এই মাইর না। কাশেম মোল্লার মতো কঠিন কঠিন মাইর দিমু।”
“আমিও কঠিন কঠিন বিচারই দিমু।”
“ঠিক আছে, তুই থাকবি এই ঘরেই। বিচার দেওয়ার দরকার নাই। সবাই সারাদিন পরিশ্রম কইরা ক্লান্ত। এখন এইসব হাবিজাবি বিচার দিতে গেলে তোরেই দেখবি রাগের বশে মাইরা বইছে।”
কথার প্রেক্ষিতে মৌসুমী আন্দাজ করতে পেরেছে আজমাইন বোধহয় দাদাজান ও জেঠুকে ভয় করছে। তাই তাকে আটকাচ্ছে। ভালো একটা সুযোগ এবং শক্তি হলো তবে তার দাদাজান ও জেঠু। মনে মনে হেসে সে বললো,
“ঠিক আছে। এবারের মতো ক্ষমা করে দিলাম। যাও।”
“তুই আমারে ক্ষমা করার কে? আমি তোর কাছে ক্ষমা চাইছি? খালি সাবধান করলাম তোর ভালোর জন্যে। এইখানে থাকবি, কিন্তু বেশি বেশি কথা বলা বন্ধ রাখবি।”
“আমার মুখের একমাত্র মালিক আমি। আল্লাহ তায়ালা এই মুখটা আমার মালিকানায় দান করছে। আর তাই, আমি স্বাধীন। আমার যখন যা ইচ্ছা, তা-ই বলমু। নিষেধ করার জন্যে কোনো দারোগা, দারোয়ানের প্রয়োজন বোধ করি না। সে আমারে অযথা মারবো আর আমি কিছু বলমু না? হুহ্! বিয়ার রাতে মানুষ নয়া নয়া প্রেমের আলাপ করে, আর সে আইছে আমারে সাবধান করতে। বললেই হইলো!”
শেষ অংশ বিড়বিড় করেই বললো মৌসুমী। আজমাইন বললো,
“নয়া নয়া প্রেমের আলাপ? এই, তুই জানোস কেমনে এতো কিছু? তোর বিয়া হইছে আরও?”
অপ্রকাশ্যে জিভ কাটলো মৌসুমী। ঠিকই তো, সে জানে কিভাবে? তাকে কি বলা যাবে বন্ধুবীদের গল্পসল্প আর দুষ্টুমির কথা? নাকি বলা যাবে তার কল্পরাজ্যের প্রেমিক পুরুষের কথা? হুম, বলা যায়। সে তো এখন বর। বর মানেই মনের নিকটবর্তী বন্ধু। পরক্ষণে ঠোঁট চেপে হেসে বললো,
“বলবো, বলবো। সব বলবো। এখন খাইতে চলো।”
এমনি মমো এসে হাজির হয়েছে দরজার সামনে।
“আজাম ভাই, বড় মা খাইতে ডাকে।”
মৌসুমী ঘুরে দাঁড়িয়ে তার মাথায় হালকা ধাক্কা দিয়ে সাথে নিয়ে যেতে যেতে বললো,
“আজাম ভাই, আজাম ভাই করস ক্যা? দুলাভাই কইতে পারোছ না? দুলাভাই ডাকবি।”
মৌসুমীর চ্যাটাং চ্যাটাং জবাবে আজমাইন কয়েক সেকেন্ড স্থির দৃষ্টিতেই তাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। ভালো স্পর্ধা হয়েছে দেখা যায় এই মেয়ের! প্রেমের ভুতও চেপেছে দারুণ। কেমন পাঁকা পাঁকা কথা বলে, আশ্চর্য হওয়ার ব্যাপার। বেশি পাঁকমো করলে থাপড়ে ঠিক করে ফেলবে, এমন একটা নির্ভাবনা নিয়ে সে-ও খেতে চলে গেলো। আবার ফিরে এসে সাদা সেন্টু গেঞ্জিটাও পাল্টে একটা হাফ হাতার রঙিন গেঞ্জি পরে গেলো। সামনে শীতকাল। এখনই হালকা হালকা ঠান্ডা পড়ে যায় সন্ধ্যা নামলে। একটু বৃষ্টির দেখা দিলে তো কথাই নেই!
বাড়ি থেকে কান্না করে আসার কারণে মুখটা একটু মলিনই ছিলো রোজার। আশেপাশের মানুষ চিনে তাকে, তবুও নতুন বউ হিসেবে দেখতে আসছে বারবার। মাহতাবের চাচী, শাহিনুর এসে দেখে গেছেন। কথা বলে গেছেন। সোনার গহনার বাহারে জেনে গেছেন বাবার বাড়ি থেকে কি পেয়েছে আর শ্বশুর বাড়ি থেকে কি পেয়েছে। মনের সন্দেহ দূর করতে গহনা স্পর্শ করে করে দেখেও গেছেন খাঁটি সোনা কি না। মরিয়মও কম কিসে? পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বলে যাচ্ছেন কোনটার পরিমাণ কতটুকু, কতটুকুতে খরচ কেমন গিয়েছে। আপাতত এইটুকু দিয়েছে, প্রয়োজন হলে পরে আরও দিবে। পাশের বাড়ির এক চাচী এসে হাসিমুখে মরিয়মকে বললেন,
“কইছিলাম, আমার ভাগিনার লাইগা দিতো আপনার ভাইঝিরে। দিলো না। তখন কইলেই পারতেন, নিজের পোলার লগে ঠিক কইরা রাখছেন।”
মরিয়মও হাসিমুখে বলে দিলেন,
“তখন ঠিক কইরা রাখলে কইতাম। এখন ওইসব কথা বইলা লাভ নাই। আর ভাইঝি আমার শিক্ষিত মাইয়া, আমার ভাই কোন দুঃখে যাইবো ফাইভ পাশ মিস্ত্রির কাছে বিয়া দিতে? মানানসইয়ের একটা ব্যাপার আছে তো, নাকি?”
মহিলা যেন কিঞ্চিৎ দমে গেলেন। দমে যাওয়া রোধে মরিয়ম বললেন,
“সবচেয়ে বড় কথা হইলো, যার জুরি যেদিকে।”
“হো, সেইটাই। দেখেন নাই, কম সুন্দর বুঝি আমার ভাইগনা বউ? লম্বাচওড়া, উজ্জ্বলতা সবই মিলায় দিছে আল্লাহ।”
“না, না। বহুত সুন্দর। তাছাড়া যার যার সুন্দর তার তার নিজের কাছে। সেই সুন্দর নিয়া খুশি থাকাই দরকার।”
শাহিনুর বলে উঠলেন,
“আমার পোলার বউয়ের চেয়ে সুন্দরী বউ এই এলাকা জুইরা নাই। এমন সুন্দর বউ পাইবেন খুইজা?”
তার অহংকারে ভেতরে ভেতরে জ্বলে উঠলো মরিয়ম। পাশেরজন তো চুপই হয়ে গেলেন। মরিয়ম একটা প্রত্যুত্তর করলেন,
“না, না। সাইদুরের বউ সুন্দরীই। এই রূপ হয়তো এলাকায় পাওয়া যাইবো না, তবে গুণে কিন্তু রূপের মতো আগায় নাই। তাছাড়া পড়ালেখা তো তেমন করে নাই। পড়ালেখায় মনযোগী পোলাপানের পরিশ্রমের কারণে রূপের সৌন্দর্য বাড়ে না। এতো চাপের মধ্যে রূপচর্চায় মনযোগ দেওয়ার সময় কই?”
“এতো পড়ালেখা কইরা কি হইবো? মেট্রিক পাশও হাড়ি মাইজ্জা ভাত রান্না কইরা খায়। এম এ পাশেরও একই দশা। যাইগা। বইয়া থাইকা লাভ নাই। বউ ঘরে একা।”
চলে গেলেন তিনি এবং পাশের জনও। মরিয়ম পেছন থেকে ভেঙচি কাটলো। তার ছেলে যখন পছন্দ করেছে, তবে এই পছন্দই সই। অন্যের রূপের আগুন দেখার দরকার নেই। ছেলে শুনলে আবার মন খারাপ করে বসবে। যা হওয়ার, হয়ে গেছে। এতোসব ভেবেই মনকে সান্ত্বনা দিলেন মরিয়ম। পাশের রুমে বসে তাদের কথাবার্তা সবই শুনছিলো রোজা। কথার ধরণে মনে হলো চাচীশ্বাশুড়ি, শাহিনুর বুঝি রূপের বড়াইয়ে খোঁচা মেরে গেলেন ফুপুকে। গহনাগাঁটিও কেমন নেড়েচেড়ে দেখছিলেন বারবার। কিন্তু তার মন খারাপ হলো না মোটেও। কিছু মানুষের স্বভাব এমনই হয়। ওসবে মনযোগ ফেলে লাভ নেই।
আজ বাইরের আকাশে চাঁদ নেই। কিন্তু মনের আকাশের চাঁদ ভারি সুন্দর হয়ে ফুটেছে। সারাদিনের ব্যস্ততায় ক্লান্ত মুখটাকেও নতুন জীবনের আলিঙ্গনে ভারি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মুখের ওই হাসিটা হৃদয়ে শিহরণ জাগায় বারেবার। তবুও চোখ জুড়িয়ে নাহি ফের চাহি দেখতে পায় লজ্জায়। বর সাজে দারুণ সুন্দর লাগছিলো মাহতাবকে। বাইরের কাজকর্ম গুছিয়ে ঘরে এসেছে এতোক্ষণে। রাত বেড়েছে, আশেপাশের মানুষদের নতুন বউ দেখার তৃপ্তিও আপাতত ফুরিয়েছে। মেহমান বলতে ঘরে মাহতাবের একজন ফুপু আছে, ফুপাতো ছোট ভাই আছে। সকলের আয়নায়ই তো কমবেশি দেখা হলো নিজেকে, এবার চাঁদের আয়নায় একটু দেখে নেওয়ার সময় হলো বধূ সাজটা। ঘরে বিদ্যুৎ আছে, ঘরটাকে আলোকিত করতে মানসম্মত বাতি আছে। তবুও এই আলো যেন পর্যাপ্ত নয় রোজাকে দেখতে। তাই রুমে আসার পরপরই মুচকি হেসে রুমের লাইট নিভিয়ে দিয়েছে মাহতাব। রোজা এর কারণ বুঝে উঠার আগেই দিয়াশলাই জ্বেলে উঠেছে মাহতাবের হাতে। আগুন মোমবাতিতে ঢেলে দিয়ে মোমবাতির আলোয় আলোকিত করলো ঘরটাকে শুধুমাত্র ওই মুখটাকে সোনালী আলোর ঝলকানিতে দেখার জন্য। মোমবাতি নিয়ে রোজার মুখোমুখি হলো মাহতাব।
“ইচ্ছে ছিলো জ্যোছনার রূপালী আলোয় দেখবো তোমায়। কিন্তু জ্যোছনা জ্বলেনি। তাতে কি? সোনালী আলোয় সোনাবউ দেখাচ্ছে তোমায়, তা জানো কি?”
লজ্জিত দৃষ্টি নত রেখে ঠোঁটের দুই ধার টানটান করে হাসলো রোজা। মাহতাব তার থুতনি ধরে নত মুখখানা মুখোমুখি করে বললো,
“সবার চোখে নিজেকে দেখবে বলেছিলে, আমার চোখে দেখেছো একবার? কেমন দেখলে?”
“ওই চোখে দেখলে নিজের রূপের মুগ্ধতায় নিজেকেই মরতে হবে।”
“এমন মরা হাজারবার মরা যায়।”
“তার জন্য আমি প্রস্তুত নই। ওই চোখ আমাকে সারাজীবন অপলক দেখুক। সেই চোখের মায়া আমি এক পলকের জন্যও কেড়ে নিতে চাই না।”
“এতো মায়া কেন তোমার মাঝে? সর্ব রূপে মায়া ফুটে কেন? আমি যে তোমার সর্বস্তরের মায়ায় পড়ে গেছি, মায়াবিনী।”

“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ১৭
(নূর নাফিসা)
.
.
যদিও মৌসুমী ভেবেছিলো গল্পে গল্পে সময় কাটাবে, তখনকার জিজ্ঞাসা সূত্রে ভেবে রাখা গল্পগুলো জানাবে। কিন্তু তার বর মহাশয় খেয়ে এসে কাঁথা মুড়ে ঘুম দিয়েছে৷ বিয়ের উপর বিরক্ত হয়ে দুইটা বালিশের একটার দখল তাকে ছেড়ে দিতে হয়েছে মৌসুমীর জন্য। বিছানার একপাশে চেপে যেতে হয়েছে অন্যপাশে জায়গা রেখে। এদিকে মৌসুমী পড়েছে মহা যন্ত্রণায়! যতবারই চোখে ঘুম এসে ধাক্কা দেয়, ততবারই ধাক্কা দেয় আজমাইন! এই লোক এক জায়গায় ঘুমানোর মানুষ নয়। ক্ষণে এদিক, ক্ষণে ওদিকে ছুটে যাচ্ছে হাত পা। মৌসুমীকে কখনো ধাক্কাই মারছে, কখনো পা তুলে দিচ্ছে তার উপর৷ তার ধাক্কাধাক্কিতে বারবারই ছুটে আসা ঘুম ফের ছুটে যায় পালিয়ে। ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা ধাক্কা দিয়েছে সে কয়েকবার। যদিও এতে খুব একটা লাভ হয়নি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই শ্বাশুড়ি মায়ের কাজ এগিয়ে দিতে গেছে। ঘরসহ পুরো উঠুন ঝাড়ু দিয়ে ঝকঝকে পরিষ্কার করেছে৷ বারান্দা থেকে ময়লা বেড কভার আর কাঁথা তুলে বাথরুমে ভিজিয়ে এসেছে। দাদাজানের জন্য চা দিয়ে এসেছে। পরপর রান্নাবান্নার কাজ এগিয়ে দিতে এসেছে। হালিমা খাতুন খুশি হয়ে গাল টেনে বললো,
“ওরে আমার কাজের বুড়ি রে! মা ডেকে ডেকে কাজ করাতে পারে না, আর আমার কাজে ডাকার আগেই ছুটে এসেছে। তোর মায়ের হিংসা লেগে যাবে তো এতে।”
“লাগুক। ডাকাডাকি তো মায়ের অভ্যাস। কাজ কি আমি কম করি?”
হালিমা খাতুন মুচকি হাসলেন।
“উহুম, আমার মৌসুমীর মতো কাজ কেউ করে না। আফরোজা এতো বড় হয়েও না। মায়ের কাজও করে দিবি ডাকার আগে। বুঝলি?”
“হুম।”
মেয়েটাকে গহনাগাঁটিতে ভালোই দেখাচ্ছে। নতুন সাজের নতুন চেহারায় অন্যরকম একটা প্রাপ্ত ভাব চলে এসেছে যেন এইটুকু সময়ের ব্যবধানে। হালিমা খাতুন মনযোগে দেখলেন তাকে কিছুটা সময়। চোখের তৃপ্তিতে মন ভরে নিয়েছেন৷ বেশ ভালো লাগে তার এই সবকটা বাচ্চাকে। সর্বস্ব উজাড় করে মমতা ঢেলে দিতে চায় বাচ্চাদের। তবুও যেন অতৃপ্তই রয়ে যায়। খানিক বাদে আজমাইনকে ঘুম থেকে উঠতে দেখে মৌসুমী বললো,
“ঘুমের মধ্যে এতো নড়চড় করো ক্যা? সারাদিনের খেলায় পোষে না? স্বপ্নেও খেলো?”
আজমাইন সদ্য ঘুমভাঙা চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বললো,
“ক্যা? তোরে লাথি মারছি দুচারটা?”
“লাথি না মারো, ধাক্কা তো মারছো কয়েকবার। আরেকটুর জন্য পড়ে যাই নাই।”
“গেলি না ক্যা? যাওয়া উচিত ছিলো।”
“তুমি কি ইচ্ছা কইরা ধাক্কা মারছো তবে?”
“নাহ। ইচ্ছা কইরা মারি নাই। তোরে ধাক্কাও আমি মারি নাই। আসলে একটা ব্যাপার তুই জানোসই না।”
“কি ব্যাপার?”
“ভয়ংকর একটা ব্যাপার আছে।”
“ব্যাপারটা কি?”
“বললে ভয় পাবি।”
“পাইতাম না। বলো।”
“ধাক্কা তোরে ভুতে দিছে৷ আমি দিন দুপুরে বাইরে খেলা করি না? আমার ভেতর ভুত ঢুকছে। তুই প্রেম প্রেম করছ না? একটা শাকচুন্নিও প্রেমে পড়ছে। যার কারণে তোরে আমার বিছানায় সহ্যই করতে পারে না। তাই তোরে ধাক্কাইছে।”
“কি!”
“জ্বি। আজ ধাক্কা মারছে, কাল গলা টিপে দেখবি মেরেই ফেলছে। তাই বলি, তুই আর আমার সাথে থাকিস না। আমার সাথে শাকচুন্নি ঘুমায়।”
বিছানা ছেড়ে হাই তুলতে তুলতে হাতমুখ ধুতে বেরিয়ে গেছে আজমাইন। মৌসুমীর মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে আজমাইনের কথায়। আসলেই কি ভুত আছে? নয়তো এতো ছটফট কেন করে ঘুমের মধ্যে? এই শাকচুন্নিকে তো তবে তাড়াতে হবে। দুনিয়ায় এতো মানুষ রেখে তার বরের উপর নজর দিবে কেন? নাকি আজমাইন মিথ্যা বলে গেলো তাকে? শাকচুন্নির নজর যদি পড়েই থাকে তার উপর, তবে সে জানলো কিভাবে? তার কি জানার কথা? কেউ কি নিজে নিজে বলতে পারে তার উপর জ্বিনপ্রেতের ছায়ার ব্যাপারে? আজ রাতে বিষয়টা ভালোভাবে লক্ষ্য করা দরকার। যদি সত্যিই হয়, তবে হুজুর কবিরাজের তালাস করতে হবে শীঘ্রই। বর একান্তই তার। শাকচুন্নিকে সতীন বানানোর কোনো সাধ নেই।
ভোরে মাহতাব ও রোজার ঘুম একত্রেই ভেঙে গেছে। বাড়ির পাশে মসজিদ হওয়ায় আজানের ধ্বনি একটু জোরেই শুনতে পাওয়া যায়। মাহতাব মসজিদে চলে গেলে রোজা ঘরেই নামাজ আদায় করে নিয়েছে। পরে ফুপুর কাছে গিয়ে দেখলো তিনিও মাত্রই নামাজ পড়ে রান্নাবান্নার কাজে লেগেছেন। শাকসবজি কেটে দেওয়ার জন্য রোজা এগিয়ে গেলে মরিয়ম বললেন,
“তোর আজ কাটাকুটি করার দরকার নাই। একটু আরাম কর। এইটুকু আমিই পারমু।”
“কেন ফুপু?”
“কিছুনা। এমনি। নয়া হাত এতো তাড়াতাড়ি পুরান করার দরকার নাই। হাতের রঙ টাটকা থাকুক। গলার হারটা খুইলা ফেলছোস?”
“হ্যাঁ। তোমার কাছে দিবো ভেবেছিলাম। খুলে রেখেছি রাতে।”
“নতুন বউ গহনাগাঁটি পইরা থাকলে ভালো দেখায়।”
রোজা ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বললো,
“হার কি পরে থাকা যায় সেভাবে?”
“আচ্ছা, ঠিক আছে। হার না-ই পর। চেইন রাখিস গলায়। বালা, দুলও থাকুক। এগুলা খুলিস না কিন্তু। হাত, কান, নাক খালি থাকলে বউয়ের সৌন্দর্য থাকে না।”
“আচ্ছা।”
রোজা তবুও ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে দিলো। ফুপু একা হাতে সব করে, সেটা ভাবতেই ভালো লাগে না। সেখানে নিজে উপস্থিত থেকে এতোটা আরামের ব্যাপারটা নিজের কাছেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য হয়ে ফুটে। ঘর ঝাড়ু দেওয়ার সময় মাহতাব ঘরে ফিরেছিলো। এখন ঝাড়ু দেওয়া শেষে কোনো কাজ না থাকায় রুমে ফিরে এলে মাহতাব বাইরে যাওয়ার প্রস্তাব করলো। ফুপু আবার কিছু বলে কি না, সেই দ্বিধায় পড়লে মাহতাব বলে নিলো তার মায়ের কাছে। বাড়ির বাইরে এসে স্নিগ্ধ-বাতাসের স্পর্শে প্রাণটাও স্নিগ্ধকর দোলে দুলতে লাগলো। পূর্বাকাশে চকচকে সোনালী আলো ফুটেছে। নতুন দিনের নতুন আলো। খুব একটা সময় হয়নি আজকের এই আলো এদেশের মাটিতে পড়েছে। হেমন্তের এই সকালগুলো ভারি আরামদায়ক হয় নাতিশীতোষ্ণতার কারণে। বাচ্চাদের ঘুমঘুম চোখে দুলতে দুলতে মক্তবে যেতে দেখা যাচ্ছে। কেউ কেউ কাজে যাওয়ার ব্যস্ততায় ছুটেছে। তবে এখনো হয়তো ঘুম ভাঙেনি পাড়ার সবার। নিত্যকার কোলাহলের সৃষ্টিও হয়নি। তবে শীঘ্রই হবে ঘুমকাতুরে গম্ভীর কণ্ঠ ঘুমকেটে ঝনঝনে হলে। প্রাক ভোরে ঘুম ভেঙেছে পাখিদের, বাধ ভেঙেছে কিচিরমিচির শব্দের। লোকায়ত কণ্ঠ জাগ্রত হলেই এই মধুর কিচিরমিচির ঢাকা পড়বে জনকণ্ঠের ভীড়ে।
হাটতে হাটতে মাহতাব রোজাকে নিয়ে খুব বেশি দূরে যায়নি। কথা বলতে বলতে কিছুটা পথ এগিয়েই আবার ফিরে এসেছে৷ থেমেছে পুকুর ঘাটে। গাছের পাতার ফাঁকে চকচকে রোদ এসে প্রতিবিম্বিত হচ্ছে পুকুরের টলটলে জলে। মোটামুটি বড়সড় এক পুকুর। একপাশে বাঁধানো ইট সিমেন্টের পাকা ঘাট। মাহতাবের দাদার পুকুর। বাবা চাচা মিলে ঘাট বাঁধাই করেছে বহু বছর আগেই। এখনো নতুনত্ব ফুটিয়ে তুলতে রঙ ঢেলে মেরামত হয়। আশেপাশের অনেকেই ব্যবহার করে পুকুরের জল। ওপাশে অন্যান্যদেরও আছে। যাদের নেই, তারাই আসে। নিরব ঘাটের নিরিবিলিতে এসে বসেছে রোজা ও মাহতাব। একেবারে জলের সংলগ্নে। জুতো খুলে টলটলে জলে পা রেখেছে রোজা। মাহতাব তার পাশেই আছে, তবে সিড়ির একধাপ উপরে বসে। রোজাকে পা ভেজাতে দেখে বললো,
“খুব পরিষ্কার দেখাচ্ছে না পুকুর?”
“হুম। গোসল করে ফেলো। তোমার শখ, আমি পুকুর ঘাটে এলে গোসলে নামবে।”
“করবো। তবে এখন না। তোমায় নিয়েই সাঁতার কাটবো।”
“ইশ! আমি আসবো না এখানে গোসল করতে।”
“কেন?”
“এতো মানুষের চোখ এড়িয়ে সম্ভব না বাইরে গোসল করা।”
“এইযে, এখন এসেছি। কেউ দেখেছে?”
“না দেখুক। তখন যে দেখবে না, তার নিশ্চয়তা কি?”
“সুযোগ বুঝেই আসবো।”
মুচকি হেসে জবাব দিলো মাহতাব। রোজাও বিপরীতে মুখে হাসি নিয়ে মেহেদী রাঙা হাতে স্বচ্ছ জলে হাত ভেজালো। ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশে হাত উঁচিয়ে এক চিলতে জল ছিটিয়ে দিলো গভীর জলের উপর। বিন্দু বিন্দু জলের ছিটায় ক্ষীণরেখায় ঢেউ খেলে গেছে বৃত্তাকারে। মাহতাব মুচকি হেসে নিচের সিড়িতে নেমে বসলো। মেহেদী রাঙা ভেজা হাতটা ধরলো নিজের হাতের মুঠোয়।
“এই হাতের ছোঁয়ায় যেন একটু বেশি স্বচ্ছ হয়ে গেলো পুকুরটা। তাই না? নাকি আমার চোখের স্বচ্ছতা?”
“ইশ! যা বলবে!”
মাহতাব হাতের পিঠে হাত রেখে পুনরায় পানির নিচে রাখলো দুজনের একত্রিত হাত। পানির স্বচ্ছতার নিচে পরিষ্কার ও কোমল দেখাচ্ছে হাত দুটোকে।
“এই যে, দেখো। সদ্য ফোটা পদ্মের চেয়েও সুন্দর তোমার হাত। পাখির পালকের চেয়েও কোমল। এই কোমলতার পরশে আগলে রেখো আমাদের ছোট্ট সংসারমহল।”
“হাত সুন্দর? সুন্দর তোমার ওই চোখ। সুন্দর হতে পারে তোমার মন। তাই দেখতে পাও এতো সৌন্দর্য, অনুভব করতে পারো তার মোহ। তোমার ইচ্ছের পূর্ণতায় সদাসর্বদা আমার চেষ্টা থাকবে অবিরল।”
“আলহামদুলিল্লাহ।”