“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২২
(নূর নাফিসা)
.
.
মাহতাব যাওয়ার দুদিন পরই চিঠি এসেছে রোজার কাছে। এবার এসেছে মাহতাবের বাড়ির ঠিকানায়। মাহতাবের চিঠি।
“প্রিয়,
কি মায়ায় জড়ালে? কি রূপে হারালে?
নিজের ছায়ায় নিজেকেই পাই না খুঁজে।
এতোদিন বাড়ি ছাড়লে একটা শূন্যতা অনুভব করতাম। আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায় হয়ে তুমি নতুন শূন্যতার বিস্তার করলে। এখন একাধিক শূন্যতা অনুভব করতে হচ্ছে। কি করি বলোতো? জীবনের অধ্যায়গুলো তো এভাবে আরও বাড়তে থাকবে একসময়। তখন আমি বাড়ি ছাড়বো কিভাবে? এতো শূন্যতা নিয়ে পথ ফুরাবে আমার? দূরে থাকার দিন ফুরিয়ে আসবে না? প্রিয়জনদের প্রতি এতো মায়া কেন থাকতে হয় মানুষের? ভাবতে গেলে অদ্ভুত লাগে আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিকে। আবেগেও কতটা মাধুরি ঢেলে দিয়েছেন তিনি। একেকজনের প্রতি একেকরকম আবেগ। সুবহানাল্লাহ!
কি করছো? আমার অভাব অনুভব হয় না? একদম মিস করো না। পাশে আছি তো। যেমনটা ছিলাম ছুটির দিনগুলোতে। তেমনটাই মনে করে রেখো। পড়াশোনায় মনযোগ রেখো আপাতত। আর কিছু দিনই তো। একটা দিক থেকে ছুটি পেয়ে আরেকটা দিক নিয়ে ভাবতে পারবে৷ তোমার চিঠি কবে পাবো? আমি আগামী শুক্রবার গ্রামে আসবো। তার আগে না পারলে পরেই দিয়ো চিঠি। ভালো থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। মায়ের খেয়াল রেখো। চিঠিটা একবার বুকে জড়িয়ে নিয়ো। লেখার পর আমিও বেশ কিছুক্ষণ বুকে চেপে রেখেছিলাম। তোমার হাতের ছোঁয়া পাবে যে লেখাগুলো। বুকে একটু কোমলতা যদি উঠে আসে সেই ছোঁয়ায়।”
বন্ধ ঘরে চিঠি পড়ে মিষ্টি করে হাসলো রোজা। মুখের হাসি বজায় রেখে চোখের পাতা বুজে নিয়ে বুকে জড়িয়ে রাখলো চিঠি। বন্ধ ঘরেও লজ্জা লাগছে তার। যেন মাহতাব সামনে। সামনে থেকে আবদার করছে বুকে জড়িয়ে যেতে। তার বুকে কোমল হাতের ছোঁয়া দিতে! ইশ! ভারি সুন্দর তার মানুষটা। নতুন নতুন আবেগের জন্ম দেয় দূরে থেকেও।
পরপরই নিজে লিখতে বসে গেলো।
“ওগো প্রিয়,
নতুন অনুভবের জন্ম যখন মনে হয়েই যায়, সেই অনুভব কি এতো সহজেই ভুলে থাকা যায়? স্বল্প সময়ের জন্য জন্ম হলেও তো তার রেশ থেকে যায় দীর্ঘ সময় জুড়ে। তবে বলো, তোমার অভাব অনুভব না করে থাকি কি করে?
জীবনের তাড়নায় জীবনের অধ্যায়গুলোকে কিছু সময়ের জন্য হলেও বিসর্জন দিতে হয়। আবার সুযোগে মায়ার চাদরে জড়িয়ে নিতে হয়। মায়ার স্রোতে অনুভূত অভাবটুকু ডুবিয়ে দিতে হয়। আমরাও নাহয় সেই স্রোতের অনুকূল যাত্রী হয়েই বেঁচে রইলাম। তোমার ফেরার অপেক্ষায় আছি। ভালো থেকো, সুস্থ থেকো। যত্ন নিয়ো নিজের প্রতি। কাজের সাথে সাথে শরীর ও মনের যত্নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া তোমার জন্য জরুরী। দূর দূরান্তে পরিবার ছেড়ে একা থাকা ব্যক্তিরা জীবন যোদ্ধা। সবদিকে একা একাই খেয়াল রাখতে হয় তাদের। এই যুদ্ধে তুমি বীর হয়ে উঠো। আমি নিজেকে মানিয়ে নিতে অভ্যস্ত আছি। ছোট থেকেই বাবাকে দীর্ঘ সময় দূরে থাকতে দেখেছি। এখনো দেখতে হয়। আল্লাহ যেন আমায় সবটা মেনে নেওয়ার ধৈর্য্য দেন।”
শেষ লাইন লিখে চোখ ঝাপসা হয়ে এলো তার। বুকের ভেতরটাও কেঁদে উঠলো। মাহতাবের মায়ায় পড়েছে তো বেশিদিন হয়নি। তাই যাওয়ার সময় চোখে জল আসেনি। হৃদয়টা একটু ধুকধুক করছিলো। তারউপর মায়া গভীর হলেও তার যাওয়াটা হয়তো মানিয়ে নেওয়া সহজ হবে এই সান্ত্বনায়, কিছুদিন পরই আবার চলে আসবে সে। কিন্তু বাবা? বাবা যে দীর্ঘ সময়ের জন্য ছুটে যায়। মনটা যখন আকুপাকু করে, চাইলেও ছুটে আসতে পারে না। একটা অসহনীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। এইতো, আগামী সপ্তাহেই আবার চলে যাচ্ছে। তা মনে পড়তেই চোখের কোটরে কান্নারা ভীড় জমিয়েছে। চাইলেই যে এক পলক দেখা হয় না বাবার সাথে! কী যে এক যন্ত্রণা হয় তখন, যখন বাবাকে দেখতে ইচ্ছে হয় এক মুহূর্তের জন্য! অথচ দেখতে পারে না। অপেক্ষা করতে থাকলেও তার অবসান ঘটে না সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরেও। তারা ছেলেমেয়েরা একটা দায়িত্ব নিলেও তো বাবা এই বয়সটা পরিবারের সাথে কাটাতে পারে। খুব তো হলো জীবন যুদ্ধ। আর কতকাল?
দুদিন বাদ আমজাদ আলী চলে যাবে, তাই শুক্রবার সকালে বড় হাড়িতে আতপ চালের ক্ষীর বসালেন হালিমা খাতুন। সারা বাড়ি ঘ্রাণে মৌ মৌ করছে। মৌসুমীকে পাঠালেন আশেপাশের বাড়ির বাচ্চাদের বলে আসতে, প্লেট নিয়ে ক্ষীর নেওয়ার জন্য। মৌসুমী ধেইধেই করে ছুটে বলে এলেই প্লেট হাতে বাচ্চারা ছুটতে লেগেছে এ বাড়ি। হাড়ি থেকে সবার আগে ক্ষীর নামালেন তিনি শ্বশুরের জন্য। মৌসুমী দাদাজানকে ক্ষীর দিয়ে এলো। সাথে হাত পাখা নিয়ে গেছে। এই ঠান্ডায় বৈদ্যুতিক পাখা ছাড়া যাবে না। তার বুড়ো দাদাজান কুঁকড়ে যাবে। তাই হাত পাখায় বাতাস করতে করতে গরম ক্ষীর ঠান্ডা করতে লাগলো।
“দাদাজান, নাও তোমার ক্ষীর। তোমার উপর কিন্তু আমার একটা রাগ আছে।”
“ক্যা? কি করলাম আমি?”
“আমার বিয়া উপলক্ষ্যে আমি তো তোমারে মিষ্টিমুখ করাইছি। তাই না?”
“হু।”
“কিন্তু তুমি আমারে বিয়া উপলক্ষ্যে কোনো উপহার দাও নাই এখন পর্যন্ত।”
“ও, এই কথা? তোরে না বিয়ার দিনই দিয়া দিলাম?”
“কি দিছো?”
“একটা জামাই দিলাম।”
“ইশ! জামাই দিয়া উল্টাইছো। এই ব্যাডারে না দিয়া একটা জামা দিলেও হইতো।”
“ক্যা? এই কথা ক্যা? সারাজীবন জামা নিয়া সংসার করবি? জামাই লাগবো না?”
“জামাও লাগে। দিনে দিনেই লাগে।”
“হো, তোর সবই লাগে। লাগে না কোনটা? তখন জামাই পাবি শুনেই রঙিলা হইয়া গেছোস, এখন আবার জামা খুঁজছ! জামা দিলে জুতা খুঁজবি। তা দিলে আরেকটা খুঁজবি। খোঁজাখুঁজির শেষ নাই।”
“ধুর! এতো কথা না বইলা একটা দিয়া দেও।”
“আমি কি কামকাজ করি?”
“তোমার কামকাজ করা লাগবো ক্যা? দুইটা পোলা আছে। একটা ধামরা নাতি আছে। তার কাছে চাইবা। তার কি সময় হয় নাই টাকাপয়সা রোজগার করার?”
“নাতি তো তোরে দিবোই। আমার আবার চাইতে হইবো ক্যা?”
“তোমার নাতি যদি কোটিপতিও থাকে, তবুও আমারে পাঁচটা টাকা দিবো না। আবার জামা! সব নিজের ওই ছোট পেটের ভেতর ঢুকাইবো। তাই তুমি চাইবা। ধমক দিয়ে চাইবা। দেখবা যেইখান থেকে সম্ভব, কাজ খুঁজে টাকা এনে তোমার কাছে দিবো।”
আহমদ আলী ক্ষীরের প্লেট সামনে নিতে নিতে হাসলেন।
“টাকা কামাই করা এতো সহজ না রে দাদুভাই। আর যখন কামাই করবো, তোর চাইতেও হইবো না। নিজে নিজেই প্রয়োজন খুঁজে সামনে এনে দিবো।”
“দুঃস্বপ্ন দেখাইলা?”
“নাহ। সুস্বপ্নই। তোর আব্বা এনে দেয় না তোদের প্রয়োজন বুইঝা? তেমন সংসারের সব কর্তারাই করে। তোর পোশাক চাই তো? সুকেশের তালাটা খোল।”
“না, না। তোমার জমানো টাকা নিতাম না।”
“টাকা দিতাম না। খোল।”
মৌসুমী ড্রয়ার থেকে চাবি নিয়ে দাদার ঘরের পুরনো স্টিলের সুকেশের তালা খুললো। আহমদ আলী বললেন,
“এইখানে তোর দাদীর কয়টা শাড়ি?”
মৌসুমী গুনে গুনে বললো,
“ছয়টা।”
“দুইটা তোর। দুইটা আফরোজার। দুইটা মমোর। খুশি?”
“কি বলো, দাদাজান!”
“হু। তোর যেই দুইটা পছন্দ হয় নিয়া যা।”
“আল্লাহ! দাদিজানের শাড়ি পরমু! ইশ! কত্তগুলা শাড়ি হইবো আমার।”
মৌসুমী লাল শাড়িটা নিলো প্রথমে। পরক্ষণে নিলো বাসন্তী রঙের শাড়ি। এই রঙের শাড়ি এখানে দুইটা। দুইটাই সুতি শাড়ি। শুধু নকশায় একটু ভিন্নতা।
“দাদাজান, লালটা নিলাম। বাসন্তী রঙের একটা নিলাম।”
“নে। লালটা তোর দাদির বিয়ের শাড়ি। বাসন্তী রঙের দুইটা দুই বসন্তে মেলা থেকে এনে দিছিলাম। লাল রঙের আরও কত শাড়ি এনে দিছি, তোর দাদি খুব পরতো লাল। আমার আম্মার লাল টুকটুকে বউ ছিলো সে। আমার লাল পরী। বাসন্তী রঙের আরেকটা আছে না? ওইটা আফরোজারে নিতে বলিস। বাকি আরেকটা তার যা পছন্দ হয়।”
“আচ্ছা। তোমারে এত্তোগুলা ভালোবাসি দাদাজান।”
বলতে বলতে এসে বসা অবস্থায়ই দাদাজানকে জড়িয়ে ধরলো মৌসুমী। আহমদ আলী হাসলেন নাতনির খুশিতে। বেগমের শাড়িগুলো পড়ে থেকে কেন ধুলায় মাখামাখি হবে অযথা? খুব তো তুলে রাখা হলো যত্নে। সেই যত্নআত্তির শক্তি তো নেই আর। নাতনিরা গায়ে জড়িয়ে ভালোবাসুক এবার বেগমকে। পুনরায় তালা লাগিয়ে শাড়ি নিয়ে বের হতে হতে দেখলো, আজমাইন ঘুম থেকে উঠে বেরিয়েছে মাত্র। তাকিয়ে আছে প্লেট হাতে লাইন ধরা বাচ্চাদের দিকে। মা হাতে কাঠের চুঙা নিয়ে এক খাপ্পা করে ক্ষীর তুলে দিচ্ছেন প্লেটে প্লেটে। যারা পেয়ে যাচ্ছে, পিলপিল পায়ে গেইট দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে সাবধানে। মমোও দাঁড়িয়েছে তাদের সাথে। মৌসুমী তার সামনে দিয়ে ঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,
“হা কইরা কি দেখো? প্লেট হাতে নিয়া লাইনে দাঁড়াও সময় থাকতে। পরে গেলে পাতিল পোছাপোছি করতে হইবো।”
“কি দেয় মা? ক্ষীর রান্না করছে?”
“আরে, হো। হো। তাড়াতাড়ি যাও।”
“ক্ষীর বিলাইতাছে ক্যা হঠাৎ?”
“আজ শুক্রবার না? আরেকটা বিয়া করামু তোমারে।”
আজমাইন গরম চোখে তাকালে চৌকাঠ পার হতে হতে সে বললো,
“দেখো, আজমাইন! এমন করে তাকাইয়ো না আমার দিকে। ভয় পাই না একদমই। উল্টা প্রেমে পইড়া যাই। বুঝছো?”
আবারও নাম ধরে ডাকায় আজমাইন একইভাবে তাকিয়ে থেকে বললো,
“তোর মাইরে পোষায় না, না?”
“মাইর কি আমি দিতে জানি না নাকি?”
মৌসুমীর প্রত্যুত্তরে সে বারান্দা থেকে রুমের দিকে পা বাড়ালেই মৌসুমী খিলখিলিয়ে হেসে দ্রুত দরজা আটকে দিলো ভেতর থেকে।
“হিহিহি… তুমি দৌড়ানি দিলে আমি দরজাও বন্ধ করতে জানি।”
“পালাস ক্যা? দরজা খোল। দেখি মাইর কেমন দেস?”
“উহু। শুধুমাত্র ভালোবাসতে পারলে এই মনের দরজা খুলবো মৌসুমী। মারামারি পছন্দ না। প্রেম কুঠুরির দরজা তোমার জন্য সারাজীবন খোলা।”
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৩
(নূর নাফিসা)
.
.
আজমাইনের হাতে ক্ষীর পাঠিয়ে দিয়েছে হালিমা খাতুন। রোজা টেনেটুনেও রাখতে পারেনি ভাইকে একবেলা খায়িয়ে রাখার জন্য। খেলার মাঠ কিংবা খেলার আসর বাদে অন্যত্র কোথাও গেলেই তার যত তাড়া! মায়ের হাতের ক্ষীর হতে মাহতাবের জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছে রোজা। আজ যে তার আসার কথা। অপেক্ষায় আছে। খুব অপেক্ষা। অথচ অপেক্ষার একেকটা মিনিট একেকটা ঘন্টার চেয়েও অধিক মনে হয়। সকাল যেন দুপুর হয়ই না, দুপুর যেন বিকেল হয়ই না। অন্যদিকে মন আরও বলে সময় না যাক ফুরিয়ে। বাবাকে এক পলক দেখলেও যে প্রাণটা যায় জুড়িয়ে। বাবার যাওয়ার সময় নিকটে চলে এলো যে! মায়া তো ছাড়ার বদলে বেড়েই চলেছে।
বিকেলে মাহতাব চলে এলো। আগামী পরশু শ্বশুর চলে যাবে। আবার কবে না কবে দেখা হয়, একটা আক্ষেপ থেকে যেন না যায় তাই দুইটা দিনের ছুটি নিয়ে এসেছে। এমনকি আগামী দুই মাসে সাপ্তাহিক ছুটি ব্যতীত ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আর ছুটি নিতে পারবে না, সেই প্রতিশ্রুতিও দিতে হয়েছে বিপরীতে। এই মাসটা অনেক ছুটির উপর কাটলো যে! আগামীকাল রোজাকে নিয়ে মামাবাড়ি যাবে মাহতাব। মামার বিদায়ের পরই কর্মস্থলে ফিরে যাবে আবার। সন্ধ্যার একটু আগে ফিরলে রোজাকে উঠুনে মুরগির খাবার ছিটাতে দেখলো সে। এদিকে রোজার একটু নজর পরেছিলো সাইদুরের বউয়ের দিকে চাচীদের ঘরে। বউটা কেমন একরোখা। ঘরের বাইরে এসে কি একটু হাওয়া-বাতাস লাগাতেও মন চায় না? নিজেদের বাড়িই তো। বাইরের মানুষ তো আর এসে ভীড় করে না। সারাক্ষণ ঘরবন্দী থাকতে কি ভালো লাগে? নিজেই আসতে চায় না, নাকি চাচীই আসতে দেয় না? উনি যা বড়াই করেন, মনে তো হয় ছেলের বউকে মাথায় তুলেই রাখেন। উনার নিষেধ থাকার তো কথা না তবে। মেয়েটাই এমন একরোখা হয়তো। আর ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে কি যে ফোন চেপে রাখে কানে! এতোই মজা ওই ফোনে কথা বলতে? কোথায়, তার কাছে তো ভালো লাগে না কানে ফোন চেপে ধরতে। এসব ভাবনাতেই যেন বিলীন হয়েছিলো মনে মনে। হঠাৎই ব্যাগ হাতে মাহতাব পেছনে গলা খাঁকারি দিলে হঠাৎ কেঁপে উঠলো রোজা। একটু ভয়ই পেয়েছে ভাবনার মধ্যে বিলীন থাকার কারণে। তবে মনের মানুষকে দেখে মুখের হাসি প্রবল রঙিন হয়ে ফুটলো। আজ সারাদিনে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কতবার তাকালো রাস্তার দিকে। অবশেষে তার ফেরার সময় হলো। মুখের হাসির বিপরীতে মাহতাবও মিষ্টি হেসেছে। সালাম দিয়েছে আগে সে-ই।
“আসসালামু আলাইকুম।”
রোজা যেন লজ্জায় পড়লো আৎকে উঠার কারণে। লজ্জাময়ী কণ্ঠেই বললো,
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো।”
“খুব অপেক্ষা করছিলে?”
“খুব তো। শরীরটা ভালো আছে?”
“আলহামদুলিল্লাহ। মা কোথায়?”
“ঘরেই আছে।”
জবাব দিতে দিতে হাতের ব্যাগটা নিতে যাচ্ছিলো রোজা। মাহতাব বাধা দিয়ে বললো,
“উহুম, আমিই নেই। মুরগির ভালোই যত্ন নেওয়া হচ্ছে দেখা যায়।”
“আজ একটা জবাই দেওয়া হয়েছে তোমার ফেরার উদ্দেশ্যে। রান্নাই করছে ফুপু।”
“চলো ভেতরে?”
“যাও, হাতমুখ ধুয়ে পোশাক ছাড়ো। খোঁয়ার আটকে আসি আমি। শেয়াল ঝাপায় সন্ধ্যা হতেই।”
“আচ্ছা, এসো।”
ঘরে চলে গেলো মাহতাব। মায়ের সাথে দেখা করলো। পোশাক পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে ওযু করেই বের হলো। এরই মধ্যে মাগরিবের আজান পড়লো। সে বেরিয়ে চলে গেলো মসজিদে। রোজাও তখন খোঁয়ার আটকে ঘরে গেছে। ওযু করে নামাজে দাঁড়িয়েছে। পরপর নামাজের জন্য ফুপুর অনুপস্থিতিতে রান্নাঘর সামলিয়েছে। নামাজ শেষে বাড়ি ফিরে গল্পে জমেছে মা ও স্ত্রীর সাথে। স্বল্প সময়ের ছুটিতে এলে সে ঘরের বাইরে সময় কমই কাটায়। আর এখন তো মা একা নয়। স্ত্রীও আছে ঘরে। গল্পেসল্পে সময় এমনিতেই কেটে যায়। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর যখন নিজের রুমে এলো, স্ত্রীর সাথে একক গল্প জমালো। রোজা ক্রিমের কৌটাগুলোও মাহতাবকে দেখালো। ফুপুর সাথে প্রথম থাকাকালীনই সে দুই রাত ব্যবহার করেছিলো, তারপর যেমনটা তেমনই রয়ে গেছে নিজের ঘরে। ওইটুকু ফুপুর বলার জন্যই ছিলো। তার এসবে মন টানে না। মাহতাবকে দেখাতেই সে হাসলো। কৌটাগুলো হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বললো,
“ভুল করে সেদিন মাকে বলে ফেলেছিলাম, প্রকৃত সুন্দরীদের রঙ এতোটা উজ্জ্বল হয় না। সাইদুরের বউ হয়তো ক্রিম মেখে ফরসা হয়েছে। এসব তারই ফলাফল।”
“ফুপুর বোধহয় আমার গায়ের রঙ পছন্দ না। তিনি চান, আমি আরও ফরসা হয়ে যাই।”
মাহতাব মুখে হাসিটুকু ঝুলিয়ে রেখেই কিঞ্চিৎ অতীত মনে করলো রোজার চেহারায় তাকিয়েই। তার মা যে উজ্জ্বল রঙ প্রত্যাশার কারণে রোজাকে বউ করে ঘরে আনতেই চাইছিলো না, তা তো রোজা জানে না। জানলে নিশ্চয়ই কষ্ট পাবে। কিছু জানা অজানাতেই থাকা ভালো। এখন তো সবটা ঠিক আছে। তবে কেন অজানাকে নিয়ে ভাবাভাবি আর? রোজার পরবর্তী কথায় ভাবনা দূরে ঠেলে দিলো মাহতাব।
“আমার ভালো লাগে না নিয়ম করে এসব ব্যবহার করতে। ত্বক আরও ফ্যাকাসে হয়ে যাবে না? তুমি কি বলো?”
মাহতাব হাতের কৌটা ছেড়ে দিয়ে রোজার গাল স্পর্শ করে বললো,
“বউ তো আমার এমনিতেই সুন্দরী। ওসবের প্রয়োজন নেই। মায়ের একটু ফরসা রঙে আকর্ষণ বেশি। পরহিংসাও বেশি। আর আমার আকর্ষণ শ্যামাঙ্গিনীতে। কোনো পরহিংসা নেই। তুমি তোমার মতোই থাকো। অন্যের অতুলনীয় হয়ে।”
কথার মুগ্ধতায় দৃষ্টি নামিয়ে মিষ্টি হাসলো রোজা। ফুপু এনেছে যখন, থাকুক আছে। নিয়মিত ব্যবহার হয় কি হয় না, সেই গল্প শোনানোর প্রয়োজন নেই।
এদিকে ক্ষীরের স্বাদে নিজেই ক্ষীর হয়ে গেছে মৌসুমী। সারাদিন ক্ষীর খেয়েই দিন পাড়ি দিয়েছে। যদিও রান্নার পরপরই খাওয়ার দিকে আকর্ষণ জাগেনি তার। তবে সকালে আজমাইনকে খেতে দিতে গিয়ে তারই প্লেট থেকে এক চিমটি খাওয়ার পর নিজের জন্য একটা বোল নিয়ে গেলো। শ্বাশুড়ি মায়ের হাতের এক বোল ক্ষীর সংরক্ষণ করে রাখলো মুখের তৃপ্তি মেটানোর জন্য। দুপুর রাতে অন্যদের ভাতে মাছে কাটলেও তার কেটেছে ক্ষীরে ক্ষীরে। রাতেও তাকে ক্ষীর খেতে দেখে আজমাইন বললো,
“রাক্ষসীর হাড়ি ফুরায় না নাকি? আর কত খাবি? ক্ষীর খেতে খেতেই তো মারা যাবি। দ্যাখ, পোক জোক জন্মায় গেছে নাকি।”
“দেখো, আজমাইন! খাবার নিয়া এইসব কইবা না। এইটা তোবারক। উল্টাপাল্টা কইলে গুনাহ হইবো।”
“তুই যে কব্জি ডুবায় খাইতাছোস, এইটা গুনাহ হয় না? তোবারক পেট ভরে খায়?”
“আমি পেট ভরে খাই আর পিঠ ভরে খাই, তাতে তোমার জ্বলে ক্যা? শান্তিতে খাইতাছি, বিরক্ত কইরো না। যাও।”
“আমার ঘরে বইসা আমারেই কস যাও? তুই যা, বের হো।”
“ওই, এইটা আমারও ঘর। সমান সমান অধিকার। ঠিক আছে, তোমার যাইতে হইবো না। বসে থাকো। আমার কাছে বসে থাকো। বউয়ের সেবাযত্ন করো বসে বসে।”
“বসে থাকমু না শুয়ে থাকমু, ওইটা তুই ঠিক করবি?”
বলতে বলতে বালিশ টেনে শুয়ে পড়লো আজমাইন। মাত্রই খেয়ে এসেছে ওই ঘর থেকে। শোয়ার পরই লম্বা করে ঢেকুর তুললো। পা দুটো তুলে দিলো বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসা মৌসুমীর কোলে। আর একটুর জন্য তার বোলে চলে যায়নি পা!
“নে, পা টিপ। স্বামীর সেবা কর।”
কিছুটা ক্ষিপ্ত হলো মৌসুমী। ঠমকানো কণ্ঠে বললো,
“খাইতাছি, চোখে দেখো না? পা সরাও! আইছে স্বামীর সেবা পাইতে। তুমি আমার কি সেবা করো?”
“দুপুরেও না কল চেপে দুই বালতি পানি ভরে দিলাম?”
“তোমার কাপড়চোপড়ই তো ধুইছি।”
“যাই করছোস, আমি না গেলে কল তো তোরই চাপতে হইতো। হাতের শক্তি বাঁচায় দিছি না? এখন ওই শক্তি খরচ কর।”
“খাইতাছি, পা সরাও।”
“বহুত খাইছোস। রাখ ওইটা। পা না টিপলে উঠতে পারবি না।”
দুই পায়ে তাকে চেপে ধরে রাখলো আজমাইন। মৌসুমী হাতের বোল দিয়েই পায়ের আঙুলে মেরে বসলো। ব্যাথায় পায়ের ভর হালকা হতেই চট করে উঠে দৌড় দিলো হাসতে হাসতে। এদিকে বিকৃত মুখে উঠে বসেছে আজমাইন। পায়ের আঙুল চেপে ধরেছে হাতে। মৌসুমী কুটিকুটি হেসে দরজার সামনে থেকে বললো,
“এইবার নিজের পা নিজে টিপো বসে বসে।”
আজমাইন সাথে সাথেই নেমে গেলো। আঘাতপ্রাপ্ত পায়ে ভর ফেলতে পারছে না ঠিক, তবে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার জন্য তাড়া না করলেই নয়। মৌসুমী ছুটে বাবার ঘরেই যাবে নাকি শ্বাশুড়ির কাছেই লুকাবে বুঝতে পারলো না। এদিকে আজমাইনকে ছুটে আসতে দেখে লাফিয়ে উঠুনেই নেমে গেলো। নিজেদের ঘরে গিয়ে চট করে দরজা লাগানোর উপায়ও হবে না। তার পৃথক রুমটায় তালা লাগানো। এপাশের দুইটার দুইদিকে দুই দরজা। একটা লাগাতে লাগাতে আরেকদিকে ঢুকে যাবে এই বাঁদর ছেলে। হালিমা খাতুনই তাকে বাঁচাতে পারে এই মুহুর্তে। তাই আবার দৌড়ের উপর থেকেই ওদিকে শ্বাশুড়ির ঘরে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলো পথ কাটিয়ে। যেন উঠুনে গোল্লাছুট খেলছে আজমাইনের সাথে। দৌড়ের সাথে মুখে হাসিও ফুটেছে কুটিকুটি। কিন্তু বাঁদরের সাথে কি পেরে উঠা যায়? তাকে দৌড়াতে দৌড়াতে বিনুনি টেনে ধরেই ফেলেছে আজমাইন। সাথে সাথেই চিৎকার করে উঠলো বড় মাকে ডেকে। বিনুনি হাতে প্যাঁচিয়ে শক্ত করে ধরেছে আজমাইন। অন্যহাতে গাল চেপে ধরে জোরেশোরে কামড় বসিয়ে দিয়েছে গালে। মৌসুমী চিৎকারও দিতে পারেনি দুইগালে চাপ দিয়ে রাখায়। জিজ্ঞেস করলো,
“আরও মারবি? চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলবি?”
দুদিকে মাথা নাড়লে পরপর চুলে থু থু মেরে ছেড়ে দিলো আজমাইন। এখানেও হুমকি,
“যা খালি মায়ের কাছে বিচার দিতে!”
ঘ্যানঘ্যান কান্না জুড়ে বাথরুমের দিকে চলে গেলো মৌসুমী। চিৎকার আর কি করবে, একদিকে থু থু মারার কারণে ঘৃণা লাগছে। আরেকদিকে কামড় দেওয়ার কারণে ব্যাথা পেলেও লজ্জা লাগছে ভীষণ। থু থুর কারণে বিচার দিতে ইচ্ছে হলেও হুমকির জন্য দেওয়া হলো না। বাথরুমে এসে বোল ধুয়ে নিজের মাথাটাও ধুয়ে নিলো উপুর হয়ে। এবার খচ্চরের মুখে মারতে ইচ্ছে হচ্ছিলো বোলটা। ছি! ঘেন্নাপিত্তি কিছু নেই এই পিশাচের। আর তার দাঁতগুলো! ইশ! না জানি গালটা কেটেই ফেলেছে। বাথরুম থেকে আঁচল দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দাদাজানের ঘরে উঁকি দিতে গেলো।
“দাদাজান, ঘুমায় গেছো?”
“না। আয়।”
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে মৌসুমী বললো,
“এখনো দরজা খোলা ক্যা? ঠান্ডার মধ্যে তাড়াতাড়ি ঘুমায় থাকো। রাতে টয়লেটের বেগ পাইলে সাবধানে চেয়ারে বইসো।”
“আচ্ছা।”
“ওষুধ খাইছো?”
“হু, খাইলাম। যা, ঘুমায় থাক গিয়া।”
“ঘুম? আমার ঘুম আর কপালে নাই। জেনেশুনে আমার এতো বড় সর্বনাশ কেন করলা, দাদাজান?”
“ক্যা, কি হইছে?”
“ওই শয়তান আমারে একটুও ভালোবাসে না। খালি মারে আর মারে।”
আহমদ আলী হালকা হেসে বললেন,
“তারে এখনো ভালোবাসার নেশায় ধরে নাই। খেলার নেশায় বড় মাতাল। ওই নেশাটা দূর করতে পারলেই ভালোবাসা বুঝবো। তখন শুধু ভালোই বাসবো।”
“এই নেশা দূর হইবো ক্যামনে? এখন কি তাবিজ-কবচ আইনা লটকায় দিমু তোমার নাতির গলায়?”
আহমদ আলী আবারও হাসলেন। দুদিকে মাথা নেড়ে বললেন,
“সবুর কর। একটা বয়সে এমনিতেই সব দূর হইয়া যাইবো। ভালোবাসায় তাবিজ কাজ করে না। ভালোবাসা ভালোবাসার মাধ্যমেই জাগ্রত হয়। সবুর কর দাদাভাই, সবুর কর।”
“ধুর! ঘুমাও। দরজা লাগাও। শুভ রাত।”
ঘরে এসে কয়েকবার শুধু আয়নায় নিজের চেহারাটাই দেখে গেলো। বড় বড় দাঁতের ছাপগুলো স্পষ্ট দেবে আছে। রক্ত জমাট জমাট ভাব। ওদিকে তার দাঁতওয়ালা বর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছে। তার এতো সুন্দর গালটায় কোথায় আদর করে একটা চুমু এঁকে দিবে, তা না! আসছে গোদাই দাঁতের খোদাই করতে!
চলবে।