“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৪
(নূর নাফিসা)
.
.
সকাল হতেই যার চোখ পড়ছে গালে, সে-ই জিজ্ঞেস করছে কি হয়েছে। ব্যাথা পেলো কিভাবে? বিকেলে রোজা এসেও জিজ্ঞেস করেছে। গোমড়ামুখে মৌসুমী প্রত্যেককেই এক জবাব দিয়ে গেছে, রাতের বেলা রাক্ষস এসে কামড় দিয়েছে। কেউ হয়তো রাক্ষসকে চিনতে পেরেছে, কেউ পারেনি। সারাদিন বাড়ির এদিকসেদিক ঘুরেফিরে আত্মীয়দের সাথে দেখা করলো আমজাদ আলী। সন্ধ্যা হতে গভীর রাত পর্যন্ত গল্পসল্প করলো ঘরের সদস্যদের সাথে। মনটা তো তারও চায় না যেতে, তবুও যেতে হবে পরিবারকে ভেবে কিছু অর্জনের সন্ধানে। পরদিন সকালে মরিয়মও এসেছে বিদায় জানাতে। দুপুরেই স্বজনদের ছেড়ে দীর্ঘ যাত্রায় আবারও পাড়ি জমিয়েছে দুই সন্তানের জনক। এগিয়ে দিতে সাথে গিয়েছিলো মাহতাব এবং আজমাইন। যেতে যেতেও ছেলের মাথা হাত বুলিয়ে খুব বুঝ দিয়ে গেলেন। ভালো হয়ে চলার, মায়ের কথা মান্য করার আদেশ করে গেলেন। বাবার বিদায়ে একরকম বিষণ্ণতা ধারণ করেই বাড়ি ফিরেছে আজমাইন। অথচ সচরাচর মন খারাপ হয় না তার। এইটুকুর স্থায়িত্বও কতক্ষণ, ভাবা দায়! কিন্তু বাকি সদস্যদের মন ঠিক হতে ভারি সময়ের ব্যাপার। আজ আহমদ আলীর বাড়ির বড্ড মন খারাপের দিন।
পরপরই আবারও শুরু হলো স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। আমজাদ আলী গন্তব্যে পৌঁছে জানিয়েছেন ঠিকঠাক পৌঁছাতে পেরেছেন তিনি। পরবর্তী দিন মাহতাবও ফিরে গেছে। রোজা দুদিন মায়ের কাছেই কাটিয়েছে মায়ের মন খারাপের সাথী হয়ে। আবারও ফিরেছে সংসারে। মৌসুমীর পরীক্ষা অতি নিকটে। ব্যস্ততায় ব্যস্ততায় যেন এবারের শীতকাল দ্রুতই ফুরিয়ে যাচ্ছে। অথচ শীতকাল প্রিয় মনগুলো তাকে ডেকে বলে,
আরেকটু থেকে যা না রে!
আরেকটু শীতলতায় ঘিরে রাখ প্রকৃতিকে।
আরেকটু হিমায়িত হই তোর হিমেল হাওয়াতে।
জমিয়ে রাখ নাহয় আরেকটু শীতল আমেজে।
পিঠা পুলি কি আর সারাবছর খাওয়া হয় রে?
তোকে ঘিরেই তো গ্রামবাংলার এক অনন্য ঐতিহ্য ফুটে রে।
তুই চলে গেলে,
কুয়াশাচ্ছন্ন ভোর আর সরষের হলুদ মাঠ তবে আবার কোথায় পাবো রে?
তুই থেকে যা, যা রে আরেকটু সময় ধরে।
আমজাদ আলী চলে যাওয়ার পরবর্তী সপ্তাহেই জাবেদ কাকা হাজির হলো ফুপুর বাড়ির দুয়ারে। মরিয়মের সাথে দেখা হতেই কথাবার্তা বললেন তিনি। জিজ্ঞেস করলেন রোজা আছে কি না এই বাড়িতে। নাকি বাবার বাড়ি? মরিয়ম রোজাকে ডেকে দিতেই দুইটা চিঠি রিসিভ করলো রোজা। এবার দুই চিঠি একত্রে পাঠালো নাকি মাহতাব? গত সপ্তাহে দেয়নি বলে? চিঠি হাতে ঘরে যেতে যেতে দুইটার উপরেই নাম লেখা দেখলো। একই তারিখে পোস্ট হওয়া দুই চিঠি এসেছে একই শহর থেকে। কিন্তু মানুষজন ভিন্ন! ঠিকানাও কিঞ্চিৎ ভিন্ন। একজন মাহতাব, একজন সেই আলো! দুইটাই মাহতাবের চিঠি ভেবে মুখে হাসির রশ্মি ফুটতে গিয়েও চিন্তিত ভাব ধারণ করলো আলোর জন্য। এই আলোর পরিচয় জানার জন্য ঘরে এসে সে দ্বিতীয় চিঠিটাই আগে খুললো। অল্পস্বল্পই লেখা তাতে,
“কেমন আছো, আফরোজা? বাড়ির সবাই ভালো আছে? আমাকে চিনতে পেরেছো? পারোনি হয়তো। আমি এক টুকরো পৃথিবীর কাঙাল হয়ে আসা ক্ষীণ আলো। সংসার মহলে আমার রশ্মি ছড়িয়েছিলো আঁধার কালো। এই আঁধারের কালোতেই হয়তো আবারও নিভে যাবো। আলোর প্রদীপ আমার সেই কবেই নিভে গেছে ভুলে ভুলে। সংসার ভিটা উজ্জ্বল করো তুমি ফুলে ফুলে।”
ভারি দুশ্চিন্তা চেপে গেলো রোজার মাথায়। কথার রেশ বলে দিচ্ছে যেন তার খুবই পরিচিত কেউ। অথচ চোখের সামনে ধোঁয়াশায় মিলিয়ে আছে তার পরিচয়। কে সে? কার মায়া এভাবে টানে তাকে চিঠিতে? এতোগুলো বছর কাটলো, এতোগুলো দিন ফুরালো, অথচ চিঠি এলো বিয়ের দিনকাল থেকে। কে তাকে এভাবে গেঁথে রেখেছে স্মরণে? অতি আপন মানুষগুলো তো তার চোখের সামনেই ঘুরাফেরা করছে। তবে আর কে বাকি আছে তার সংসারমহলের বাইরে পড়ে?
এতো দুশ্চিন্তা মাথায় চেপেই মাহতাবের প্রেমের বার্তা পড়লো। আজ আর সেভাবে অনুভব করা হলো না লিপিবদ্ধ বাক্যগুলোকে। মাথায় তার অন্য কিছু সংরক্ষিত হয়ে আছে। একটা অপরিচিত মুখ তাকে ভীষণ উত্তেজিত করে তুলছে। ভীষণ জানতে ইচ্ছে করছে ওই অপরিচিত মুখের পরিচয়কে। সে কি কোনোভাবে মাহতাবের সাথে সম্পর্কিত? নাকি তার বাবামায়ের সাথে? কোন কূলে গিয়ে তার সন্ধান করবে? কোন পথে হাঁটা ধরবে অপরিচিতের মুখোশ টানতে?
এদিকে একই দিনে এ বাড়িতে অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো। স্কুলে গিয়েছিলো মৌসুমী বিদায় অনুষ্ঠানের মিলাদে অংশগ্রহণ করতে এবং পরীক্ষার প্রবেশপত্র সংগ্রহ করতে। দুপুরে ফেরার পথে আজমাইনকে দেখতে পেলো এক চায়ের দোকানে। মাটিতে চটের বস্তা বিছিয়ে মনযোগে খেলছে। চা বিক্রেতা তার বয়সীই পাড়ার ছেলে। এছাড়া যারা উপস্থিত আছে, প্রত্যেকেই প্রায় একই বয়সের ছেলেপুলে। এতো মনযোগে কি খেলছে, তা দেখতে এগিয়ে গেলো মৌসুমী। দোকানের বেড়া ঘেঁষে দাঁড়িয়ে উঁকি দিয়ে বিস্ময়ের সাথে নিশ্বাসে অদ্ভুত শব্দ ফুটিয়ে মুখে হাত দিয়ে বললো,
“আল্লাহ! তাস খেলতাছে!”
প্রত্যেকেই এদিকে তাকালে মৌসুমী চোখ মটকে আজমাইনকে বললো,
“বড় মা নামাজ পইড়া তোমার জন্য দোয়া করে আর কাঁদে, এদিকে বইসা বইসা জুয়া খেলতাছো তুমি? খাড়াও, জানাইতাছি বাড়িতে।”
আজমাইন ভ্রু কুচকে তৎক্ষনাৎ ধমকে উঠলো,
“তুই এইখানে ক্যা? থাপড়াইয়া কান তব্দা লাগায় দিমু। বাড়ি যা!”
“হু যাইতাছি। তোমার রূপ দেখতেই আইছি, কতো ভালা পোলা যে তুমি। আজ খালি বাড়িতে যাইয়ো।”
বলতে বলতে হনহনিয়ে হাঁটা ধরলো মৌসুমী। আজমাইন ক্ষেপে দোকানের বাইরে বেরিয়ে পেছন থেকে বললো,
“খবরদার উল্টাপাল্টা বলছোস তো!”
মৌসুমী যেতে যেতে আবারও বললো,
“খালি যাইয়ো বাড়িত!”
আজমাইন আবার দোকানের ভেতরে চলে গেছে। বাড়ি এসেই মৌসুমী বিচার দিয়ে দিয়েছে হালিমা খাতুনের কাছে। ছেলে জুয়া খেলছে শুনে কাজের মধ্যে কিছুটা স্তব্ধই হয়ে রইলেন যেন তিনি। মুখে বললেন না কিছুই। পুনরায় কাজ চালিয়ে গেলেন। মনের গম্ভীরতা বুঝতে পেরেছে মৌসুমী। ঘন্টাখানেক পরে আজমাইন বাড়ি ফিরেছে মৌসুমী তখন গোসল করে পড়তে বসেছে রোজার টেবিলে। আজমাইন নিজ ঘরে গিয়ে গোসলের জন্য লুঙ্গি, গামছা নিচ্ছে। এমনি পিছু হাত লুকিয়ে হালিমা খাতুন এসে হাজির হলেন ঘরে। নিজের ঘর থেকেই তখন দেখেছিলেন তাকে গেইট দিয়ে প্রবেশ করতে। এখন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কই ছিলি এতোক্ষণ?”
আজমাইন আড়চোখে একবার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার লুঙ্গি নিতে ব্যস্ত হয়ে জবাব দিলো,
“এদিকেই তো।”
“এদিকেই কি করছিলি?”
“এমনেই আড্ডা দিছিলাম।”
“জুয়া খেলোস কবে থেকে?”
আজমাইন একইভাবে স্থির থেকে চুপ করে রইলো চিন্তিত হয়ে। মৌসুমী কি বাড়ি এসে বলে দিলো তবে সেই কথাই? এ তো না বলার মেয়ে না। পারলে একটু ঘটলে আরেকটু বাড়িয়ে বলবে। জবাব না পেয়ে হালিমা খাতুন পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন একই কথা। আজমাইন ফিরে তাকিয়ে বললো,
“আরে, কিসের জুয়া? মৌসুমী বলছে এইটা তোমারে। না? ওর কথা তুমি বিশ্বাস কইরা নিলা?”
“তুই খেলছোস কি না সেইটা বল।”
“মাথা খারাপ! জুয়া খেলমু? আমার কাছে কি টাকাপয়সা আছে?”
“থাকে তো। না থাকলে খেলতে যাস ক্যামনে?”
“আরে, হুদাই ধামকি দাও। আমি গেছি নাকি!”
হালিমা খাতুন রগরগে চোখে আরও কড়া গলায় বললেন,
“তুই খেলোস নাই? তাস হাতে তোরে দোকানের ভেতর বইসা থাকতে দেখে নাই মৌসুমী? কালু, আবুর লগে তোর কিসের আড্ডা? তাগো চিনে না এলাকার লোকজন? জানে না মানুষ কেমন?”
বলতে বলতেই দরজা বন্ধ করে এগিয়ে এসে পেছনে লুকানো হাতের মোটা লাঠি দ্বারা ইচ্ছেমতো পেটাতে লাগলো। প্রতি ঘায়ে লাফাচ্ছে আজমাইন। ব্যাথায় আর কতটুকু? আঘাত যাতে না লাগে সেই জন্যই তার বেতের আগে থেকেই লাফালাফি। হালিমা খাতুন এক হাতে তার হাত ধরে অন্যহাতে পেটাচ্ছে আর বলছে,
“অমানুষের বাচ্চা! তোরে নিয়া কত ভয়, কত চিন্তা কইরা মরি। আর তুই গিয়া জুয়ারির লগে আড্ডা দেস? তোর বাপেরে দেখছোস জীবনে জুয়ার আড্ডায় যাইতে? তুই গেছোস কোন সাহসে? আরেক ব্যাডায় এই বয়সেও দূরে পইড়া সারাদিন কাজ কইরা মরে, আর তুই ঘরে বইসা টাকা উড়ানের ধান্ধা করোস? জীবনে কামাই কইরা দেখছোস দুই টাকা, কত যে পরিশ্রম করা লাগে? বাপদাদার সম্মান বাড়াইতে পারোস না, শেষ করতে লাগছোস ক্যা? এই আশায় তোরে খাওয়ায় পরায় লালন করতাছি? আর কত জ্বালাবি!”
“ওই মা! ওই মা! আমি খেলি নাই। একটু তাস হাতে নিয়া দেখছিলাম।”
“তুই নিবিই ক্যা, দেখবিই ক্যা? তোরে কলেজে ভর্তি করছি, পড়ালেখা করবি। তা না কইরা জন্মের খেলা খেলোস! আবার কস ধরছোস, খেলোস নাই! কলেজ যাস নাই ক্যা? অমানুষ হওয়ার জন্যে জন্ম দিছিলাম?”
লাফাতে লাফাতে হাত ছাড়িয়ে দরজা খুলে দৌড় দিয়েছে আজমাইন। সব আঘাত তো লাগেনি, তবে যেগুলো লেগেছে ঠিক কড়াভাবেই লেগেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে উঠুনে দাঁড়িয়ে শুধু পায়ে হাতিয়ে যাচ্ছে। বাথরুমেও যাচ্ছে না যদি আবার সেখানেই গিয়ে মারে! হালিমা খাতুনকে বেরিয়ে বারান্দায় আসতে দেখে সে গেইটের দিকে এগিয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়েই কতক্ষণ ফুসলেন তিনি। কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। উনি কি সাধে হাত তুলেন সন্তানের গায়ে? এখনো ভালোমন্দ না বুঝলে আর কবে বুঝবে?
আজমাইন মাইরের ভয়ে পুকুরে গোসল করতে চলে গেলো। লুঙ্গি, গেঞ্জি নিজ হাতেই ধুয়ে নিয়ে ফিরলো। মনে মনে খুঁজছে মৌসুমীকে। আজ তো তাকে তুলোধুনো করে ছাড়বে! দেখা পেয়েও গেলো। উঠুনের রশিতে লুঙ্গি নেড়ে দেওয়ার সময় চোখ পড়লো রোজার রুমের জানালার দিকে। টেবিলে মনযোগে লিখছে কিছু। ঠান্ডা লাগছে বিধায় কাঁপতে কাঁপতে আগে শরীর গরম করতে গেলো। ঘর থেকে সরিষার তেলের বোতল নিয়ে রোদে দাঁড়িয়ে তেল মালিশ করলো সর্বাঙ্গে। মমো বারান্দার সিড়িতে পা ঝুলিয়ে বসে বসে বোনের পুরনো ওড়না জড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইছে আর একা একাই খেলা করছে। আজমাইনকে তেল মালিশ করতে দেখে ছুটে এসে হাত পাতলো তেল নেওয়ার জন্য।
“আজাম ভাই, এট্টু দাও তেল?”
“গোসল করছোস?”
“হো।”
ছোট হাতের তালুতে বোতল চাপ দিয়ে হালকা তেল দিয়ে আবার বোতলের ক্যাপ লাগিয়ে রাখলো। তাদের কথা শুনে এদিকে লক্ষ্য করেছে মৌসুমী। আজমাইনের চোখে চোখ পড়তেই খিলখিলিয়ে হাসলো সে। পাশের রুমে থেকে তো সে আজমাইনের লাফানো ঝাপানো শুনেছেই তখন। তাই ওই মুখ দেখতেই হাসি পাচ্ছে তার। এদিকে হাসতে দেখে আজমাইন নিজের রুমে যেতে যেতে চোখ মটকে বিড়বিড় করে গেলো,
“খাড়া, আইতাছি।”
“সোনালী আলোর ঘ্রাণ”
পর্ব- ২৫
(নূর নাফিসা)
.
.
তার বিড়বিড় বুঝতে পেরে মৌসুমী আগেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়েছে। সত্যিই আসবে নাকি? রুমের ভেতর পেলে তো তাকে উত্তমমধ্যম দিবে। তাই সে পালানোর জন্য আগেভাগেই প্রস্তুত। দেহে টিশার্ট চাপিয়ে ঠিকই আবার বেরিয়ে এলো আজমাইন। তাকে এদিকে এগোতে দেখেই মৌসুমী মুখে চাপা হাসি রেখে বারান্দা দিয়ে ছুটেছে কয়েক কদম। আজমাইন এবার দৌড়ানি দিতেই সে প্রাণ নিয়ে ছুটলো বারান্দার শেষ অংশে রান্নাঘরের দিকে। হালিমা খাতুন এখানেই আছন। রান্নাঘরের মাঝামাঝিতে বসে তরকারি কেটেকুটে রাখছিলেন সন্ধ্যার আগেই চুলা জ্বালাবেন বলে। এদিকে ছুটে এসে চৌকাঠ পেরুতে যাওয়ার সময় হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো মৌসুমী। হালিমা খাতুন তাকে লক্ষ্য করা মাত্রই আৎকে উঠে সাথে সাথে বটি কাত করে ফেললেন। তবুও রেহাই হলো না! হুমড়ি খেয়ে পড়ে মৌসুমীর হাত চলে গেছে কাত করা বটিতে। ঘ্যাচাং করে বেঁকে কেটে গেলো হাতের তালু। আজমাইনও এসে ছোটা থামিয়ে দাঁড়িয়েছে দরজার সামনে। সে দেখে হতবাক! হালিমা খাতুন মৌসুমীর দৌড় দেওয়া আর পরপরই আজমাইনের এসে হাজির হওয়া দেখেই উপলব্ধি করে ফেলেছেন সে যে দৌড়ানি দিয়েছিলো। সাথে সাথেই তিনি পাশ থেকে কাঠের ডালঘুঁটনি নিয়ে ছুঁড়ে মারলেন দরজার দিকে। হাতে নিতে দেখেই আজমাইন লাফিয়ে ছুটে বারান্দা পেরিয়ে দৌড়ে গেছে গেইটের দিকে। এদিকে মৌসুমী কান্না শুরু করে দিয়েছে। বিপদ দেখে হালিমা খাতুন হাহাকার যন্ত্রণা নিয়ে তাকে টেনে তুলে বসালেন। আবারও ডালঘুঁটনি হাতে তুলে আরেক দফা ছুঁড়তে গেলেন দরজার সামনে থেকে। আজমাইন গেইটের বাইরেই চলে গেছে এবার দৌড়ে। আজ তার খবর হয়েছে ভালো! কপালে যখন দুর্গতি লেখা, সবদিকেই বিপদ! বিকেল হয়ে গেছে, অথচ দুপুরের ভাত টুকু তোলা হলো না মুখে। সে তো ভাত খাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই যাচ্ছিলো ওদিকে। যাওয়ার পথে একটু ডোজ দিয়ে যেতো শুধু। কি বিপদটাই না ঘটে গেলো! আর জুটেছে তার ভাত! এদিকে তড়িঘড়ি করে আবার এসে মৌসুমীর হাত দেখতে লাগলেন হালিমা খাতুন। মৌসুমী দেখানোর জন্য চাপা হাত সরাতেই বুদবুদ করে যেন রক্ত ঝরতে শুরু করলো! লম্বা করে প্রায় অনেকটাই কেটে গেছে। মনের ব্যাথায় প্রায় কান্না করার অবস্থা হালিমা খাতুনের। আঁচলের কাপড় ছিঁড়ে হাতে প্যাচিয়ে দিলেন সাথে সাথেই। ডাক্তারের কাছে না নিলেই নয়! তারপর ছুটে গেলেন টাকা নিতে। আল্লাহই বাঁচিয়েছেন। যেভাবে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, এরচেয়েও বড় অঘটন ঘটতে পারতো বটিটা ঠিক সময়ে সরিয়ে নিতে না পারলে। মুখমণ্ডলই গিয়ে বটির উপর পড়তে পারতো! কিংবা দাঁড় করানো বটিতে হাতটা পড়লেই আরও ভয়ানকভাবে হাতের ক্ষত হতো। দেহে বোরকা চাপিয়ে মৌসুমীকে নিয়ে দ্রুত ডাক্তারের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন তিনি। রাস্তায় দাঁড়িয়ে আজমাইন ভেজা বেড়ালের মতো তাকিয়ে দেখেছে তাদেরকে। মৌসুমীর হাতে কাপড় প্যাচানোও লক্ষ্য করেছে। চোখ দুটো ভেজা। ব্যাথায় নিঃশব্দে কাঁদছে আর চোখ মুছে যাচ্ছে মৌসুমী। ফেরার পথেও দেখেছে ওই হাতে সাদা ব্যান্ডেজ করা। অনেকটাই কেটে গেছে তবে। নয়তো এতোখানি ব্যান্ডেজ লাগে? আজমাইন তাদের দেখে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে দোকানের ভেতরে। বাড়ি যাওয়ার সাহস হচ্ছে না আর।
এদিকে মৌসুমী বাড়ি এলেই সেলিনা বেগম জিজ্ঞেস করতে লাগলেন, কিভাবে হাত কাটলো? মমোর কাছে শুনেছে শুধু, আপুর হাত কেটে গেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে আর তাদের দেখতে পায়নি৷ তখন থেকেই যেন ফেরার অপেক্ষা করছিলেন তিনি। এখন ফিরলে জিজ্ঞেস করতেই মৌসুমী জবাব দিলো পড়ে গিয়ে বটিতে হাত লেগে গেছে। সেই তিনি তাকে বকাঝকা শুরু করলেন এমন বেহুশ হয়ে চলাচল করে কেন? সে কি ছোট বাচ্চা, যে হুটহাট পড়ে যাবে? কাণ্ডজ্ঞান থাকে কোথায়? বকাঝকা করতে দেখে হালিমা খাতুন আবার চলতে চলতে মলিন কণ্ঠে জানালেন, আজমাইন তাড়া করায় সে দৌড় দিয়ে পড়ে গেছে। এবার দুজনের কাণ্ডজ্ঞানকেই দোষারোপ করে ফুসতে লাগলেন। আক্কেল তাদের কোনোদিনও হবে না। এতো বড় হয়েছে, এখনো ঠোকরা ঠুকরি লেগে থাকে। একজন খোঁচা দিলেই আরেকজন মাইর দেয়। এই কাহিনী তো তার সেই ছোট থেকেই জানা। বেদনার উপর বেদনা মৌসুমীর ভালো লাগলো না। মায়ের কথায় বিরক্ত বোধ করে চলে গেলো সে। হাতের ব্যাথায় শরীরের ঠান্ডার কাঁপা-কাঁপি যেন বেড়ে গেছে তার। সোয়েটার গায়ে দিলো দ্রুত। ডাক্তার যে ইনজেকশন পুশ করলো, আবার না জ্বর-টর এসে যায়! কেটেছে আবার ডান হাত। চারদিন পর পরীক্ষা। লিখতে পারবে তো এই হাতে? তা দেখতে খাতা-কলম নিয়ে বসলো একটু। হাতে চাপ পড়ে, ব্যাথা বাড়ে। লিখতে পারবে না এই হাতে। বারবার চাপ ফেললে রক্ত ঝরবে আরও। আঙুলে তো আর সমস্যা হয়নি, এই চারদিনে একটু টান ধরলেই হবে। এখন অযথা রক্ত ঝরানোর প্রয়োজন নেই। পড়া শেষ করে রাখা যাক।
তাকে আর কোনো কাজ করতে দেয়নি হালিমা খাতুন। সন্ধ্যার পর যেন হালকা জ্বরজ্বর অনুভূত হতে লাগলো। পড়তেও ভালো লাগছে না। তবুও বই নিয়ে বসে আছে। মোয়াজ্জেম আলী কাজ থেকে ফিরে শুনলো মেয়ের হাত কেটে গেছে। তখন আবার মৌসুমীকে ডাকলেন। ব্যান্ডেজ করা হাত দেখে বললো,
“কাটলো ক্যামনে?”
“পড়ে গিয়ে।”
“অনেকখানি কাটছে?”
“কাটছে কিছুটা।”
“ডাক্তার ওষুধ দিছে না?”
“হু, দিছে।”
“মাইয়ার কামকাজ! ঠিকমতো চলাচল করতে পারোস না? এতো দৌড়াদৌড়ি করতে হয়? ঘটাইলি তো একটা অঘটন। দুইদিন পর পরীক্ষা!”
“আমি কি জানতাম, হাত কেটে যাইবো?”
“যা, ঠান্ডার মধ্যে বাইরে ঘুরিস না।”
কিছুক্ষণ হালিমা খাতুনের কাছে এসে বসে রইলো। রান্নাবান্না শেষ হতেই হালিমা খাতুন গরম গরম খাবার নিয়ে গেলো আহমদ আলীর ঘরে। তিনিও মৌসুমীর হাতের খবর জিজ্ঞেস করলেন। পরপর এসে মৌসুমীকে ভাত মেখে খায়িয়ে দিলো হালিমা খাতুন। মুখটা গম্ভীর হয়ে আছে। এই মায়ের মনটা যে ভারি খারাপ হয়ে আছে ছেলের কষ্টে, তা উপলব্ধি করা যায় ওই মুখে তাকালে। মৌসুমী অন্যান্য দিনের মতো বকবক করেনি। একদম চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র হালিমা খাতুনকেও সাথে খাওয়ার জন্য জোরটুকু করে গেলো। অতিরিক্ত কথা বলেনি। জোরাজুরিতে গলা দিয়ে কিছু ভাত নামিয়ে নিয়েছেন তিনি। আজমাইনের খবর নেই। কোনো খবর রাখতেও চাইছে না বাহিরটা। তবে ভেতরটায় দুশ্চিন্তা চেপে আছে। মৌসুমীরও একটু অভিমান জমে আছে আজমাইনের প্রতি। সে ভয়টা না দেখালেই তখন এই কাণ্ডটা ঘটে না। বড় মায়ের মনটাও কি খারাপ করে দিলো বারবার অপ্রত্যাশিত কাজ করে। এই কারণেই যেন অভিমানটা একটু বেশি জমা হলো। সে আর আজমাইনের ঘরে রইলো না আজ। রোজার ঘরেই ঘুমানোর বন্দোবস্ত করে নিলো। এই ছেলে এক ঘরে থাকলে তার পড়াও হয় না ঠিকমতো। এখানে থেকে একটু পড়াও যাবে, অভিমানটাও কড়াকড়ি করা যাবে। মেরেছে তো সে, যাবে কেন তবে? দৌড় না দিলেও তো তখন মারতোই ঠুসঠাস! বাইরে থেকে ঠান্ডা আসার কারণে জানালাটাও বন্ধ করে রাখলো। মশাও আসছে, ঠান্ডাও লাগছে। এরপর চেয়ারে পা তুলে, দেহে সোয়েটারের উপরও চাদর জড়িয়ে মিনমিন করে পড়তে লাগলো। দীর্ঘক্ষণ বাইরে থেকে আজমাইন বাড়িতে পা ফেললো। প্রায় ঘুমানোরই সময় হয়ে এসেছে। এই ঠান্ডায় বাইরে আর কতক্ষণ? দেহে শর্ট হাতার একটা টিশার্ট আছে মাত্র। শীত প্রতিরোধক পোশাক পরা হয়নি দৌড়ের উপর থাকায়। বেলা শেষে এবার একটু সাহস সঞ্চয় করলো মনে। মারলে মা-ই তো মারবে, তাতে কি হবে? একটু মাইর নাহয় খেলোই। তাতে যদি মায়ের শান্তি হয়, তো হোক। বাড়িতে পা রেখে দেখলো পুরো বাড়ি নিরব। দাদাজানের ঘরের আলো নিভানো। চাচার ঘরের যেই দুই রুমের আলো জ্বলতে দেখা যায় বেশিরভাগ সময়, তার মধ্যে একটা নিভানো। একটা জ্বলে আছে। এদিকে তাদের ঘরের তিন রুমের আলোই জ্বলে আছে। মায়ের রুমের জানালা খোলাই আছে। হালিমা খাতুন দেখেছে তাকে, কেমন হাত গুটিয়ে কুঁকড়ে থেকে দাঁড়িয়েছে উঠুনে। মাকেও দেখেছে আজমাইন। হালিমা খাতুন জানালা লাগিয়ে রাখলেন তখন। বোধহয় ছেলের অপেক্ষাতেই জানালাটা খুলে রেখেছিলেন, জেগেছিলেন অবসর সত্ত্বেও। ছেলের উপস্থিতি দেখতেই এবার নিশ্চিন্ত হলেন। আজমাইন নিজের রুমে গেলো। দরজা খোলাই ছিলো। কিন্তু ঘরকন্যা নেই ঘরে। সে আবার কোথায় গেলো? তাদের ঘরে চলে গেছে? নাকি আপুর ঘরে? লাইট জ্বলতে দেখা গেলো যে! আজমাইন জ্যাকেট পরে তারপর আবার বের হলো দরজার বাইরে৷ একবার চিন্তা করলো মাকে ডাকবে, খাবার দেওয়ার জন্য। পরক্ষণে ভাবলো এখন ডাকলেই আরও রেগে যাবে মা। তাই একা একাই খেয়ে নিতে রান্নাঘরে অগ্রসর হলো। খোলা তালা ঝুলে আছে রান্নাঘরের দরজায়। আজমাইন নিজ হাতেই প্লেটে ভাত নিয়ে খাওয়া সারলো। পরক্ষণে দরজায় তালা লাগিয়ে নিজের রুমে যাওয়ার সময় মৌসুমীর হাতটা দেখার ইচ্ছে জাগলো। কতখানি কেটেছে, কতটা রক্ত ঝরেছে, এখনো ব্যাথা পাচ্ছে নাকি, আরও কোথাও আঘাত পেয়েছে নাকি এসবই জানতে ইচ্ছে হলো। তাই রোজার ঘরের সামনে এসে দরজায় টোকা দিলো। মৌসুমী চেয়ারে বসে বসে ঝিমাচ্ছিলো। দরজায় টোকার শব্দ সৃষ্টি হলে আৎকে উঠলো। কে হতে পারে, কোনো শব্দ ছাড়া টোকা দিচ্ছে? এসময় চোর আসবে নাকি! আজমাইন নয়তো? চুপ করে কান পেতে রইলো মৌসুমী। দরজায় টোকা তে সাড়া না পাওয়ায় জানালায় টোকা দিয়ে ধাক্কাতে লাগলো। মৌসুমী আরও সতর্ক হয়ে রইলো। এর পরপরই আজমাইন টোকার সাথে ফিসফিসে গলায় ডাকতে লাগলো,
“মৌসুমী? এই মৌসুমী? ঘুমিয়ে পড়ছিস? এই মৌসুমী?”
চলবে।